ধারাবাহিক অভিযান-দি শাইনিং মাউন্টেন-পিটার বোর্ডম্যান- পর্ব ৫-অনুবাদ ইন্দ্রনাথ-শরৎ ২০২২

জয়ঢাকের অভিযান লাইব্রেরি- ভারেস্ট-এরিক শিপটন(অনু-বাসব চট্টোপাধ্যায়)  অন্নপূর্ণা-মরিস হারজগ(অনু তাপস মৌলিক) কন-টিকি অভিযান- থর হেয়ারডাল (অনু-শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়)

আগের পর্বগুলো– পর্ব, পর্ব ২, পর্ব ৩, পর্ব ৪

(জো টাসকার-এর লেখা সহ)

obhijaanHead piece Shining mountain (1)

দুজন অভিযাত্রী। হিমালয়ের একটি শৃঙ্গের দুরূহতম ঢাল। সকলেই ভেবেছিল, এমনকি বিখ্যাত পর্বতারোহীরাও, এ অসম্ভব। এ তো আত্মহত্যার নামান্তর। মাত্র দুজন, তাও হিমালয়ের গহন প্রান্তরে, শৃঙ্গ অভিযান? সঙ্গে আর কেউ নেই? যাহ অবিশ্বাস্য! সেকারণেই ১৯৭৬ সালের চ্যাঙাব্যাঙ আরোহণ এক যুগান্তকারী ঘটনা। দুই দক্ষ পর্বতারোহী পিটার বোর্ডম্যান এবং জো টাসকার চ্যাঙাব্যাঙ-এর পশ্চিম ঢাল বরাবর আরোহণের অতুলনীয় কীর্তি স্থাপন করলেন। ২২ আগস্ট ব্রিটেন থেকে রওনা হয়ে ১৫ অক্টোবর পশ্চিম গাড়োয়ালের চ্যাঙাব্যাঙ শৃঙ্গ আরোহণ সেরে ১ নভেম্বর দুজন অভিযাত্রী দেশে ফিরে যান। পরবর্তীকালে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৮২ সালে এভারেস্টের উত্তর পূর্ব গিরিশিরা বরাবর আরোহণ অভিযানের শেষ পর্বে চূড়ায় ওঠার ঠিক আগে দুজনেই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে চিরকালের মতো হারিয়ে যান। ব্রিটিশ তথা পৃথিবীর সর্বকালের সেরা পর্বতারোহীদের মধ্যে এই দুই পর্বতারোহীর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।   

দি ব্যারিয়ার

obhijaanshining82

২১ – ২৭ সেপ্টেম্বর

একটা ভনভন আওয়াজ, যেন কৌটোয় একটা মৌমাছি আটকা পড়েছে, আধো তন্দ্রায় কানে এসে পড়ছে। ওটা জো-র হাতঘড়ির অ্যালার্ম, ঘড়িটা দুজনের মাঝে একটা অ্যালুমিনিয়ামের প্লেটে রেখে দিয়েছিলাম। মিশকালো অন্ধকার। পাহাড়ের ধারের ওপর বয়ে যাওয়া হাওয়া তাঁবুর কানাত ধরে একটানা একইরকমভাবে নাড়িয়ে যাচ্ছে, বেশ জোরালো আর ভীতিজনক। জো মনে হয় এখনও ঘুমোচ্ছে। আমার চোখ ফের জুড়িয়ে আসতেই চারপাশের পৃথিবীটা হাওয়া হয়ে গেল।

চোখটা ফট করে খুলে গেল। জো-র হাতঘড়ির জ্বলজ্বলে কাঁটাগুলোর দিকে তাকালাম। নির্ঘাৎ একটা ঘণ্টা কেটে গেছে, সকাল সাড়ে ছটা বাজে। পাহাড়ের এতটা ওপরে একটা কনকনে ভোর। তাঁবুর ভেতর হালকা আলোর আভাস। হুড়মুড় করে ভাবনাগুলো এসে জড়ো হল। রুট! কটা বাজে! সকালের খাবার! স্লিপিং ব্যাগ থেকে হাতটা বার করে আড়মোড়া ভেঙে সামনে ঝুঁকে তাঁবুর ভেতরের দরজার চেনটা খুলে দিলাম। হেডটর্চটা জ্বালিয়ে থার্মোমিটারটা দেখি – মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। নিশ্চিতভাবে আরও ঠান্ডা পড়েছে। দস্তানাটা গলিয়ে তাঁবুর বাইরের দরজার চেনটা খুলি, বাতাস এসে মুখে ঝাপটা মারে, তাঁবুর খোলা ফ্ল্যাপটা বাতাসে ফরফর করে উড়তে থাকে। তাঁবুর পাশ থেকে আইস অ্যাক্সটা টেনে নিয়ে বরফের কর্নিশের দেয়ালে আঘাত করি। অ্যাক্সের চওড়া দিকটা দিয়ে একটা বড়ো বরফের চাঁই ভাঙতে পারলাম, ওটা তাঁবুর দরজার মুখে গড়িয়ে এসে পড়ল, গুঁড়ো বরফ আর ছোটো ছোটো বরফের দানা চারপাশে ছিটকে পড়ে, চোখেমুখে এসে লাগে। আমি ঝট করে তাঁবুর বাইরের দরজার চেনের জিপটা টেনে দিই, এবারে স্টোভটা জ্বালাই। নতুন গ্যাসের সিলিন্ডার; প্রোপেন আর বিউটেনের মিশ্রন খুব দ্রুত পাত্রের বরফের তালটা গলাতে থাকে। জো একটু ওটাকে নাড়িয়ে দিয়েই পাশ ফিরল। আমিও ঝিমিয়ে নিতে চাইছিলাম খানিকটা, কিন্তু বরফ গলার সময় খেয়াল রাখতে হয়। ব্রেকফাস্ট বানাতে হবে, সবই আমাদের ওই মগে করে খাওয়া – প্রথমে এক মগ চা, তারপরে পরিজ, তারপর কৌটোর মাছ, ফের গরম করা ফলের রস। বরফ গলানো আর এই রান্নাবান্না করতে আড়াই ঘণ্টা লাগল। জো কেবল পরপর খেল, বিড়বিড় করে ঘুমের মধ্যেই অস্ফুটে শব্দ করছিল, এই চোখ খুলছে, এই ঘুমোচ্ছে, নিজের ভাবনায় বিভোর, ভাবখানা এরকম যে এখনও দিন শুরুই হয়নি।

স্টোভটা বন্ধ করতেই জো যেন দিন শুরু হবার অনুমতি দিল। বলল, “ভেবো না, রাতের খাবারটা আমিই বানাব।”

“তার মানে গোটা রুটে কি আমাকেই সকালের ব্রেকফাস্টটা বানাতে হবে?” আমি জিজ্ঞাসা করি।

“কেন? তুমি কি চাও যে ওটা আমিও বানাই?”

ধরাচুড়ো জুতোটুতো পড়ে তাঁবুর মধ্যেই এদিক সেদিক নড়াচড়া শুরু করে দিই। বেরোবার আগে পকেটে লজেন্স আর চকোলেট ঠেসে নিই গোটা দিনের জন্য। তাঁবুর বাইরে পাহাড়ের ধারের ওপরে একজনের মতো দাঁড়াবার জায়গা, ক্র্যাম্পন আর হারনেস লাগিয়ে নেবার জন্য। আমরা ঠিক করেছিলাম একটা অ্যাংকর থেকে লাগানো দড়িতে একইসঙ্গে দুজনে জুমার করে উঠব না। জো প্রথমে তৈরি হয়ে ছিল, আর যেহেতু আজ ওর  লিড করার পালা, ওই শুরু করল, একেবারে তাঁবুর দরজা থেকে উঠে গেছে যে ফিক্সড রোপটা, সেখান থেকে। তখন সকাল নটা পঁয়তাল্লিশ। ও প্রথম অ্যাংকরটা পেরোলে আমি ওকে অনুসরণ করলাম।

আমরা দুজনেই রুকস্যাক ভর্তি করে দড়িদড়া আর চড়ার সাজসরঞ্জাম নিয়ে উঠছিলাম আর সেটা বেশ কঠিন একটা কাজ। জুমারের দাঁত বসে যেতেই, টেরিলিনের দড়িটা নরম আর কমজোরি লাগছিল আর আমি আমার শরীরের ভার পুরোপুরি তার ওপরেই ছেড়ে দিচ্ছিলাম। নিজেকে দড়ি-পরীক্ষা-করার-ওজন-এর মতো লাগছিল। আর কখনোসখনো সেটা ছিঁড়েও যায় – আমাকে এটা জানতেই হত কেননা আমার কাজের একটা বিষয় ছিল পর্বতারোহনের সরঞ্জামের সর্বোচ্চ ক্ষমতা পরীক্ষা করা। এই দড়িগুলোর কোনো নির্দিষ্ট মান নেই, এগুলো ইয়টিং এর জন্য তৈরি করা হয়েছিল। বিএমসি টেকনিকাল কমিটি আমার সম্পর্কে কী ভাববে? আর একটা খুঁট উপড়ে এলে কী হবে? এই দড়িগুলো টান পড়লে বাড়ে না ফলে এগুলো খুব বেশি ঝাঁকুনি সহ্য করার মতো করে বানানো হয়নি। আমি যে পেগটা লাগাই তার ওপরে আমিই খুব একটা বিশ্বাস রাখতে পারি না, ব্যাপারটা এরকম যে ওটার দুর্বলতাগুলো আমি বেশ ভালোমতোই জানি। আমার খালি মনে হয় ওটা অন্য কেউ লাগাক তাহলে আমি অন্ধের মতো তার ওপর বিশ্বাস করতে পারি! রাতের ঘুমটুম হয়ে এখন আমার শরীর আর মন দুইই একদম চাঙ্গা, সমস্তরকম সম্ভাব্য বিপদের জন্য সজাগ। আমার ওপরে জো, ও বরফে আঘাত করছিল আর গুঁড়ো বরফ এবং খণ্ড খণ্ড বরফ ভেঙে পড়ছিল। সকালবেলার হাওয়া আর ঠান্ডা দুটোই বেশ প্রতিকূল। কিন্তু আমি তো নিজেই নিজের স্বপ্নের হাতে বন্দি, তাই দড়ি বেয়ে ওঠায় লেগে রইলাম।

বরফের ওপরে একটা ধাপে দাঁড়িয়ে জো আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। ও বেশ কিছু সরঞ্জাম হারনেসের র‍্যাকে লাগিয়ে নিয়ে কয়েকটা দড়ির কয়েল খুলছিল। আমি ওর স্যাক খালি করে বাকি জিনিসগুলো আমার স্যাকে নিয়ে নিলাম আর ওই একই পিটনে নিজেকে আটকে নিলাম। কথাবার্তাহীন ক্রিয়া কেবল। জো অ্যাক্স আর হ্যামার মেরে মেরে বরফের দেওয়ালে উঠতে শুরু করল, খুব দ্রুত আর সুন্দরভাবে উঠছিল ও।

ও যখন আমার মাথার ওপরে কুড়ি ফুট উঁচুতে, আমি চেঁচিয়ে বললাম, “ওখান থেকে সোজা উঠে যেতে পারবে তুমি।”

ও বলল, “পাথরের ওপরে বরফের স্তরটা এখানে সত্যি সত্যিই খুব পাতলা।”

ও আরেকধাপ উঠল আর আমি পরিষ্কার শুনতে পেলাম গ্রানাইটের ওপরে ধাতব আঁচড়ের শব্দ। ও র‍্যাকের পিটনগুলো দেখেশুনে একটা পাতলা ছুরির মতো পিটন বার করে ওর ডানদিকে পাথরের ফাটলে ঠুকল। “আরে ভাই,” আমি মনে মনে বলি, “অনেকটা চড়তে হবে আজ।”

“আমি নেমে আসছি।” জো বলল, “আরও ডানদিক থেকে চেষ্টা করব।”

“কিন্তু তোমার দশফুট ওপর থেকেই তো জায়গাটা ঠিকঠাক লাগছে।”

“আমার মনে হয় না এই পেগটা খুব একটা কাজের…” জো বলে।

মনে হচ্ছিল ডানদিকের রাস্তাটা আমাদের রুট থেকে অনেকটা সরে যাবে। ‘ও ওখানে না হাতড়ালেই ভালো হত,’ আমি ভাবলাম, ‘আমি ঠিক জায়গাটা চড়ে দিতাম, ও চট করে খুব কঠিন রাস্তায় চড়তে চায় না।’ কিন্তু মুখে কিছু বললাম না। একটা সীমার পর নিজের খেয়ালটা নিজেকেই রাখতে হয়। একটা মন্তব্য করে দেওয়া তো বেশ সোজা কিন্তু নিজে চেষ্টা না করেই বলে দেওয়াটা অনৈতিক। ভাবনা-চিন্তা রূঢ় হতে পারে, হতেই পারে, হবেও, কিন্তু সেটা যখন একটা গঠনমূলক মতামত হিসেবে তৈরি হবে ঠিক তখনই আমার মুখ খোলা উচিত। ক্লাইম্বটার সাফল্যই আসল কথা।

চড়ার এই পর্যায়ে দান ছেড়ে আমায় লিড করতে দেওয়াটা জো-র পক্ষে মানসিকভাবে খারাপ হবে।

“ঠিকাছে” বলে আমি অল্প অল্প করে দড়ি ছাড়তে থাকি আর জো ওই পেগটা থেকে নীচে নামতে থাকে। ‘আমায় ওটা খুলতে হবে।’ আমি মনে মনে ভাবি।    

জো অন্য দিক দিয়ে ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল, তারপর পেগটা অবধি উঠে ওটায় একটা স্লিং আটকে আমার দড়িটা তার ভেতর দিয়ে নিতেই আমি ওটায় ঝুলে নেমে গেলাম যাতে অন্য পাশ দিয়ে জো যেখানে বসে আছে সেই অবধি উঠতে পারি। পৌঁছে আমি দড়িটা হারনেস থেকে খুলে ওটাকে স্লিং-এর ভেতর থেকে টেনে তুলে নিয়ে ফের নিজের সঙ্গে আটকে নিলাম।

“তুমি ওই ব্লকগুলো দিয়ে ট্যাভার্স করে ফিরে গিয়ে আমাদের রুট বরাবর পৌঁছে যেতে পারো।”  আমি ওকে বললাম। ভেতরে ভেতরে অস্থির লাগছিল, ওই ধারের ওপর দাঁড়িয়ে গোটা দেওয়াল চড়ার ব্যাপারটা আমায় ভাবাচ্ছিল, কিন্তু আমায় আমার পালা আসার জন্য অপেক্ষা করতেই হত।

জো শুরু করল, একটা সরু জায়গা দিয়ে যাচ্ছিল ও, বোল্ডারটা বিশাল, দেখে মনে হচ্ছে আলগা একটা পাথর, ওর উচ্চতার সমান, আর জো যেন একটা তক্তার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণে রোদ পুরোপুরি আমাদের ওপর এসে পড়েছে আর পাথরও সহনীয় হয়ে উঠতে শুরু করেছে। আমার পঞ্চাশ ফুট উঁচুতে একটা বাল্‌জের ওপরে যখন জো একটা পেগ লাগাচ্ছে আমি একটা সামান্য বেরিয়ে আসা ঢালু পাথরের তাকের মতো জায়গায় বসে ছিলাম। তিব্বতের আরও বেশি বেশি অংশ দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু আমার তাকাতে ইচ্ছে করছিল না, আমি লিড করতে চাইছিলাম, কিন্তু, একই সঙ্গে আমার অস্থিরতাটা চেপে রাখছিলাম, আমার এক অংশ বলছিল ওটা অসঙ্গত। মনে হচ্ছিল ওই পিচটা চড়তে জো বড্‌ডো সময় লাগাচ্ছে। আমার চড়ার পালা এলে প্রথম কিছুটা চড়াই অংশে আমায় জুমার করে করে উঠতে হল, আর তখনই পাথর থেকে লাট্টুর মতো ঘুরে দূরে সরে যাচ্ছিলাম যেটা আমায় ঘাবড়ে দিচ্ছিল। জো-র পক্ষে এই চড়ার কাজটা যে কী কঠিন ছিল সেটা বলাটা অসম্ভব – আমি তো স্রেফ পেছন পেছন জুমার করে উঠে যাচ্ছিলাম আর রানিং বিলেগুলো খুলে খুলে নিচ্ছিলাম। যে জায়গাটা থেকে ও প্রথমে লিড করতে পারেনি, জো-কে দেখলাম ঠিক তার ওপরেই পৌঁছে গেছে।

ও বলল, “আমি নীচে নেমে দড়িটা ঘুরিয়ে এপাশে নিয়ে আসছি।” ও আমার লাগানো ফিক্স রোপটা ধরে নীচে নেমে গেল আর ওটাকে নীচ থেকে খুলে দোল খাইয়ে পাথরের বেরিয়ে আসা অংশটার ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে এল, ততক্ষণ আমি ওকে ওপর থেকে দড়ি দিয়ে বিলে দিচ্ছিলাম। তারপর ও সোজা জুমার করে আমার দিকে উঠে এল আর ফিক্স রোপটা আমাদের আসল রুট বরাবর সোজা হয়ে গেল।

“এরকম ফিক্স রোপ সোজা করার কাজটা আমাদের মনে হয় চড়তে চড়তে বারবারই করতে হবে, যদি আমরা ওই আইসফিল্ডের জায়গাটায় পৌঁছোতে চাই।” আমি বলি। আইসফিল্ডটা, গতদিন যত দূরে লাগছিল, এখন তার চেয়ে আরও দূরে লাগছে।

জো এইবারে ওর চড়ায় চাপটা বাড়িয়ে ফেলল। যখন ও বুঝতে পারল যে যথেষ্ট বেলা হয়ে গেছে, ও খুব দ্রুত আমাদের ওপরে ১৫০ ফুট ঝুরো পাথর এবং বরফ অংশটা চড়ে ফেলল। খুব দ্রুত একটা ক্লাইম্বিং ছিল ওটা, ফলে আমরা এমন একটা অংশে এসে পৌঁছোলাম যেখান থেকে ঢালটা ৫৫ থেকে ৬৫ ডিগ্রি হয়ে গেছে। ওভারহ্যাঙের বাধাটা থেকে আমরা তখনও ২৫০ ফুট তলায়। কাছাকাছি আসছিলাম তবে ধীরে ধীরে। কেবল সেই মুহূর্তটায় বাঁচছিলাম আর তার পরের বাধাটার কথা ভেবে চলেছিলাম। গোটা পাহাড়ের গা-টা এমন টুকরো টুকরো একের পর এক বাধা হিসেবে যদি দেখি, প্রত্যেকটার আলাদা আলাদা সমাধান, তাহলেই একসময় চূড়ায় পৌঁছে যাব আমরা।

আমাদের অতিরিক্ত সব সরঞ্জাম সর্বোচ্চ পৌঁছোনো বিন্দুতে বেঁধে রেখে দড়ি বেয়ে সোজা ক্যাম্পে নেমে এলাম। অ্যাবসেইলিংটা বেশ দ্রুত আর সোজাসুজি হল, আর সন্ধে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে পৌঁছোতে পেরে খুশিই হলাম আমরা – তখনও আলো ছিল। পরেরদিন আরো কঠিন ক্লাইম্বিং রয়েছে, কিন্তু সেটা পরের বছর হলেও কিছু যায় আসে না। আপাতত তাঁবুর মধ্যে আমাদের সামনে গরম গরম পানীয় আর তার পরেই বারো ঘণ্টার পরিপূর্ণ বিশ্রামের সুখ। 

সারারাত আর তার পরেরদিন অবধি কনকনে ঠান্ডা বাতাস বয়ে চলল। এরই মধ্যে অ্যালার্ম বাজল আর আমাদের কাজকর্মও শুরু হয়ে গেল। পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে, সকাল সাড়ে আটটায় বেরিয়ে সাড়ে দশটার মধ্যে আমরা আবার আমাদের জায়গায় এসে পৌঁছে চড়ার জন্য তৈরি হয়ে গেলাম। ক্র্যাম্পনটা খুলে জো একটা লম্বা খাঁজ বরাবর চড়তে শুরু করল, ওটা মোটামুটি সোজা ওভারহ্যাঙের দিকে চলে গেছে। একটা অসামান্য, শক্ত, খাড়াই্‌, ফ্রি ক্লাইম্বিং – মূলত ফাটল বরাবর জ্যামিং এবং লে-ব্যাক পদ্ধতিতে চড়া, পাথরের ফাটলটা বেশ এবরোখেবড়ো আর অসমান – অনেকটা ফ্রেঞ্চ আল্পসের বিখ্যাত গ্রানাইটের মতো। যদিও এখানকার জিওলজিকাল ম্যাপে নির্দিষ্ট করে দেওয়া নেই, কিন্তু চ্যাঙাব্যাঙের গ্রানাইটের একটা অদ্ভুত রহস্য আছে। সেটা হল এই সাদা, বড়ো দানাযুক্ত গ্রানাইট পাথরের ইনট্রুশন যেটা আশপাশের পাহাড়ের চেয়ে চ্যাঙাব্যাঙকে একেবারে আলাদা অদ্ভুতরকম আকৃতি দিয়েছে। এটা এতটাই সাদা, যে প্রথমবার একে দেখার পর লঙস্টাফ ভেবেছিলেন পাহাড়ের চূড়ায় একটা অসম্ভব ঢালের ওপরে বরফ জমে রয়েছে। আমাদের কাছে এটা এতটা শক্ত এবং ধরার জন্য খরখরে লাগছে যে মনেই হয় এটা তৈরিই হয়েছে ক্লাইম্ব-এর জন্য।

খাঁজটার অনেকটা ওপরে একটা বড়ো পাথরের চাঙর অবধি জোকে বিলে দেওয়া গেল, আর তারপর আমি লিড করা শুরু করলাম।। সুর্য মেঘের আড়াল হয়ে গিয়েছিল; ততক্ষণে গায়ে রোদ এসে পড়ার কথা। মাঝে মাঝে শক্ত অংশ চড়ার জন্য বা ইকুইপমেন্ট বেছে নেবার সময় আমি ওপরের মিটেনটা খুলে স্রেফ নীচের গ্লাভস আর আঙুলবিহীন মিটেন ব্যবহার করছিলাম। খাঁজটার ওপরে অনেকটা বরফ, যার বেশিরভাগটাই আমি আমার ছোটো আইস-হ্যামারটা দিয়ে ঠুকে ঠুকে ভেঙে দিয়েছিলাম। জো আর আমার মধ্যেকার পাথরের দূরত্ব যত বাড়ছিল, আমি তত বেশি বেশি মজা পাচ্ছিলাম। ঠিক এটার জন্যই তো এসেছি আমি। চড়ার শারীরিক এই উত্তেজনার জন্য, একটা সরু ফিক্স রোপে ঝুলে থাকার জন্য তো নয়। একশো ফুট চড়ে ফেলায় নিজেকে আত্মবিশ্বাসী, হালকা এবং অপ্রতিরোধ্য মনে হচ্ছিল। আমার ভারহীন লাগছিল, যেকোনো কসরৎ, ব্যথা বা বিপদের অনুভূতি থেকে মুক্ত, ভালোলাগায় পরিপূর্ণ আর পুরো ব্যাপারটা নিজের নিয়ন্ত্রণে। এমনকি এতখানি উচ্চতাও আমার শ্বাসে কোনোরকম ব্যাঘাত ঘটাতে পারছে না।

অনুভূতিটা বেশিক্ষণ রইল না। খাঁজটা ক্রমশ মিলিয়ে গিয়ে একই রকম খাড়াই একটা মসৃণ দেয়াল হয়ে গেছে যেখানে ধরার মতো কিছুই প্রায় নেই। উঠে আসতে আসতে আমি প্রায় সমস্ত সরঞ্জামই ব্যবহার করে ফেলেছি। আমার কুড়ি ফুট ওপরে দেয়ালটা ওর ডানদিকের ধার বরাবর খানিকটা সহজ হয়ে এসেছে মনে হল, ঠিক ওভারহ্যাঙের তলাটায়। আমি যদি কোনাকুনি ওই জায়গাটা অবধি ট্র্যাভার্স করে যেতে পারি, তাহলে সম্ভবত ওভারহ্যাঙের ডানদিক বরাবর চড়া যাবে; ওখানটাতেই, দেখে যা মনে হচ্ছে সবচেয়ে সরু হয়ে আসা অংশ। আমাকে আইসফিল্ডের তলায় মূল দেয়ালটার ঠিক ওপরের অংশটা চড়তে হবে, যেখান থেকে পড়লে সোজা ১০৫০ ফুট নীচে। পাথরের ফাটলের নিরাপত্তা ছেড়ে যেই পা বাড়িয়ে দুটো ছোটো ফুটহোল্ডে পা রেখেছি আমার জুতোজোড়াকে বড্‌ডো বেঢপ আর বড়ো মনে হল। নীচে, হাওয়া চলছিল, জো অপেক্ষায়। 

“আমার যদ্দুর চড়ার ছিল হয়েছে। পিট এবারে লিড করার কাজটা ধরে নিয়েছে, ও একটা খাঁজ ধরে ওভারহ্যাঙগুলোর দিকে উঠছে। এবারে আমরা আসলি দেয়াল বেয়ে উঠছি। হাওয়া থেকে আড়াল হবার কোনো আশ্রয় নেই। আমি পা এদিক সেদিক করে ফুটহোল্ডে সবচেয়ে আরামে দাঁড়াবার চেষ্টা করলাম। পিট মেঘের আড়ালে অদৃশ্য। আমি ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি।

“ঠান্ডা একেবারে আমার হাড়ের ভেতরে গিয়ে লাগছে। দড়িটা আস্তে আস্তে সরছে; জানি না ও কী করছে, আমি চেঁচিয়ে পিটকে বললাম আর বেশি বাকি নেই দড়ির। মেঘের একটুখানি ফাঁক দিয়ে ওকে দেখতে পেলাম একটা বরফভর্তি ফাটলের দুপাশে ব্রিজিং করছে। ওর বিশ্রাম নেবার কোনো জায়গাই ওখানে নেই বলে মনে হল। চিন্তা হচ্ছিল। ওর গলা আমার কাছে অস্পষ্ট লাগছিল, আমার গলাও ওর কাছে তাইই লাগছিল হয়তো। কুয়াশায় আবার সব ঢেকে গেল, আরও খানিকটা সময় কাটল। ‘কী যে ছাই করছে ও?’

“নীচে আর বিলের দড়ি বাকি নেই। আমি চেঁচিয়ে বলি ওকে, শুকনো গলায় যতটা চেঁচানো যায় আর কি। ও নিশ্চই বুঝেছে আমি কী বলতে চাই। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখানে পাথরের সঙ্গে আমার শরীরে আটকানো দড়ির গিঁটটা খুলে ফেললাম, যাতে আরেকটু দড়ি ওকে দেওয়া যায় তলা থেকে। আশা করছিলাম, আশাই, কেননা ভরসা ছিল, যে ও নিরাপদই আছে আর পড়ে যেতে পারে না। আমার দড়িটা খোলা, ও পড়ে গেলে ব্যাপারটা বিপজ্জনক হবে।

“ঠান্ডায় আমার গোটা শরীর জড়োসড়ো, শিথিল হয়ে ছিল এবং কাঁপুনি দিচ্ছিল, একটু উষ্ণতা খুঁজছিলাম। এবারে বরফ পড়তে শুরু করল। আমি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি বুদ্ধিসুদ্ধি নিয়ে, ‘কবে আমরা এই পাগলামি থামিয়ে নীচে উষ্ণ জায়গাতে ফিরে যাব?’

‘কাম অন পিট!’ মনে মনেই চেঁচাই আমি।”

একটা পাতলা ফাটল ধরি আঙুলের ডগাগুলো দিয়ে তারপর সেখানে একটা সফট স্টিলের পিটন পুঁতে দিই। ঠিকঠাক লেগেছে মনে হয়, তাই ওটাকে ব্যবহার করে পুরো ওজন ওতে ভর করে পা দিয়ে খানিকটা উচ্চতা বাড়াই যাতে অন্য হাতটা আরেকটু ওপরে যেতে পারে। দেয়ালের ওপরে একটা ছোট্ট ঢেউখেলানো জায়গার বরফ সরিয়ে ওখানে আঙুলগুলো বাঁকিয়ে একটা হ্যান্ডহোল্ড নিলাম। ওটার ওপরে পুরো ভরসা করে শরীরটাকে কাত করে দেয়ালে পা ঘসে ঘসে ম্যান্টলশেলফ পদ্ধতিতে ওটার ওপরে উঠে এলাম। পরিশ্রমে আমার হাঁফ ধরে গেল। ওখান থেকে আমার আইস অ্যাক্স দিয়ে একটা পাথরের ধারে আটকে নিজেকে টেনে তুলে একটা ঢালু বরফে ঢাকা তাক মতো জায়গায় টলমল করে উঠে দাঁড়ালাম। আমার কাছে থাকা শেষ দুটো পিটন গেঁথে নিলাম এখানে। ওদের মধ্যে একটা তো বেশ জবরদস্ত আটকেছে, ফলে আমি চেঁচিয়ে জোকে বললাম, “ও কে জো, আমি পৌঁছে গেছি।” তখন খেয়াল করলাম যে বরফ পড়ছে। আমার কোনো ধারণাই নেই এই পিচটা লিড করে উঠে আসতে আমার কত সময় লেগেছে। আমি এতটাই বুঁদ হয়ে ছিলাম মনে হচ্ছিল যেন সময় থমকে আছে।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যে মেঘ ভাঙা তুষারপাত আরম্ভ হয়ে গেল, আর তারপরেই শিলাবৃষ্টি। সবে বিকেল তখন, আমরা আরেকটু ক্লাইম্ব করতে পারতাম কিন্তু তুষারঝড়ে নেমে যাওয়া ছাড়া আর কিছু সম্ভব ছিল না। আমি হাতুড়ি দিয়ে আরও দুটো পিটন গেঁথে সঙ্গে করে নিয়ে আসা ফিক্স রোপটা শক্ত করে বেঁধে দিলাম। আমায় দুটো দড়ি একসঙ্গে বাঁধতে হল তারপর ওটায় ঝুলে পড়ে মেঘের মধ্য দিয়ে জো-র কাছে নেমে এলাম।

“ওপরে ব্যাপারটা জমে গেছে, দারুণ আকর্ষনীয়।” আমি বলি, “ডান পাশ দিয়ে ঘুরে আমরা ওভারহ্যাঙগুলোয় উঠতে পারব মনে হয়। ওখানে বেশ একটা চওড়া জায়গাও আছে শুরু করার জন্য, ব্যালকনির মতো।” আর তারপর থেকে জায়টাকে ওই নামেই ডাকা শুরু হল।

“আমি দেখলাম তুমি আমার দুটো পুরোনো ক্লাইম্বিং রোপকে ফিক্স করেছ।” জো বলে চলে, “ঠিকই থাকবে ওগুলো, যদিও হলদে দড়িটায় আমি বেশি ঝাঁকুনি দিতাম না। ওটাতে আমার এর আগে অনেকবার ফল্‌ হয়েছে।”  

আমরা দ্রুত অ্যাবসেইলিং করে নীচে ক্যাম্পের দিকে নামতে শুরু করি। ঝড়টা মোটে আধ ঘণ্টা ছিল, আর যতক্ষণে আমরা তাঁবুতে পৌঁছোলাম ততক্ষণে মেঘের ফাঁকফোকর দিয়ে পড়ন্ত সূর্যের আলো এসে পড়েছে। তারপরেই, হঠাৎ, আশ্চর্যজনকভাবে, পাহাড়ের ধারের ওপর সর্বক্ষণের সঙ্গী যে ঝোড়ো বাতাসটা ছিল সেটা এক্কেবারে থেমে গেল। তাঁবুও আর ফরফর করে উড়ছে না, আমাদেরও গলা তুলে একে অন্যেকে কথা বলতে হচ্ছে না। আমরা রাতের খাবার সেরে ফেললাম আর ক্রিসমাস পুডিং এবং কাস্টার্ড দিয়ে একটু উদ্‌যাপনও হল।

“ইস। একটা ক্যাসেট প্লেয়ার আনলে হত এখানে।” জো বলল, “একটু রক গান, মন্দ হত না।”

আমি টুকরো কাগজে টুকটাক ডায়েরির নোট লিখে রাখছিলাম। আমার ডায়েরিটা গ্রাবরেখার ওপরে অ্যাডভান্স বেস ক্যাম্পে রেখে এসেছি। ভেবেছি এই দেওয়াল চড়তে গিয়ে আমাদের যদি কিছু হয়ে যায় কেউ না কেউ ওটা খুঁজে পেলে বুঝতে পারবে ওই অবধি কী কী হয়েছে। এছাড়াও আমি ওটা সেন্সর করে এসেছি – আমার আর জো-র ভেতর মাঝে মধ্যে যে মতপার্থক্য হত সেটা আমি লিখিনি অথবা রুটটা নিয়ে আমার দুর্ভাবনার কথা। ভেবেছিলাম, “কী হবে, এটাই যদি আমার শেষ লেখা হয়,আর কেউ সেটা পড়ে?’ আমি দেখেছি অভিযানের এই অদ্ভুত দুনিয়াতে যা বলা কওয়া হয়, তা যদি নথিবদ্ধ হয়ে যায়, রঙ টঙ চড়ে তা সহজেই বাড়িয়েচারিয়ে একজন পর্বতারোহী নয় এমন লোকের কাছে বা ওয়াকিবহাল নয় এমন লোকের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছে দেয় বা ভুলবোঝাবুঝি তৈরি করে, যারা ‘দুর্ঘটনার নেপথ্যের কারণগুলো’ জানতে ব্যগ্র থাকে। জো, আমার এই একনিষ্ঠ লেখালেখিতে বেশ কৌতূহলী ছিল।

“আমি অবাক হই, পিট প্রতিটা মুহূর্ত তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করার বদলে, কেন এই হালহকিকত সবটা নথিবদ্ধ করে রাখতে চায়। সাধারণত লাগসই সাহিত্যের কোটেশন বেশ ভালোই জানা ওর, আর আমি যখন ওকে বলি যে, গ্রাহাম গ্রিন বলেছিলেন যে একজন লেখকের সবচেয়ে বড়ো সমস্যাটা মনে রাখার চেষ্টা করা নয়, বরং ভুলে যাবার চেষ্টা করা, তখন ও ভাবল যে আমি ডায়েরি লেখার আলসেমির সপক্ষে সাফাই দিচ্ছি।”     

খরখরে গ্রানাইটে লেগে আঙুলের ডগাগুলোর ছাল উঠে গেছে। এই ঘসা খেয়ে ছিঁড়ে যাবার জন্য ভেতরের গ্লাভসটা বহুবার বদলাতে হয়েছে আমাদের। সৌভাগ্যবশত অনেকজোড়া গ্লাভস এনেছি সঙ্গে করে। আমি আঙুলে সাবধানে অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম লাগিয়ে সেগুলো প্লাস্টার দিয়ে ঢেকে দিলাম – আমি জানতাম ঠান্ডাতে খোলা রাখলে কাঁটাছেঁড়ায় দ্রুত সংক্রমণ হয়ে যায়। একবার হিন্দুকুশ অভিযানে পায়ে সেপটিক হয়ে পা এমন ফুলে গিয়েছিল যে জুতোই গলাতে পারছিলাম না। আমি পায়ে পাউডার লাগিয়ে ম্যাসাজ করে মোজা বদলে তারপর স্লিপিং ব্যাগে ঢুকলাম। তুষারক্ষত কিংবা সংক্রমণ হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে বড়ো শত্রু। সন্ধে সাড়ে সাতটার মধ্যেই আমাদের কাজকর্ম সব শেষ আর দুজনেই আটটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম।

রাত্রি আমার ছেঁড়া ছেঁড়া পাহাড়ের স্বপ্নগুলো ঢেকে দিল, যেন চ্যাঙাব্যাঙ চড়ার ব্যাপারটা আমার বাকি পশ্চিমি জীবনের তুলনায় অকিঞ্চিৎকর একটা ভাসমান সামান্য অংশ। আমার জীবনের সামান্য এক ভগ্নাংশ জুড়ে আমি ক্লাইম্ব করছি, আর আমার স্বপ্ন জুড়ে কেবল আমার স্মৃতি, আমার বাড়ি-ঘর, সেখানকার লোকজন।

 ২৩ সেপ্টেম্বর সকালটা পরিষ্কার এবং হাওয়া নেই। অ্যালার্ম বাজার পরও আমরা ঘুমিয়েই ছিলাম কিন্তু তাও সকাল আটটার মধ্যে বেরিয়ে পড়তে পেরেছি। আমিই প্রথমে জুমারিং করে রওনা দিলাম। আগেরদিন সন্ধ্যায় আমি দুটো দড়ি গিঁট বেঁধে ব্যালকনির নীচে একটা চাঙড়ের পেছনে লাগানো নরম ধাতব পিটনের সঙ্গে আটকে এসেছিলাম। এটাতে, আশা করেছিলাম, কোনাকুনি ওঠাটা সহজ হবে। জো-র পুরোনো হলদে ক্ষয়াটে দড়িতে, মাঝ বরাবর উঠেছি, সামান্য একটু ঝাঁকুনি আর আমি ডিগবাজি খেয়ে পেছনে। ‘হা ভগবান। দড়িটা নির্ঘাৎ ছিঁড়েছে,’ ভাবলাম, ‘আমি শেষ।’ পাশ দিয়ে পাথর দ্রুত সরে যাচ্ছে আর একঝলক দুহাজার ফুট নীচে হিমবাহ নজরে এল। তারপরেই দড়িটা একবার টানটান আরেকবার ঢিলে হতে থাকল আর আমাকে ঘুরিয়ে নিয়ে মাথা সোজা অবস্থায় ব্যালকনির নীচের দেওয়ালের ধার বরাবর ইয়ো-ইয়োর মতো ওপরে নীচে দোলাতে থাকল। প্রথমটায় বুঝতেই পারিনি কী ঘটেছে। বড়ো করে শ্বাস নিলাম, তারপর ঘন ঘন শ্বাস নিতে নিতে আমার চারপাশে পাগলের মতো দেখতে থাকলাম। দড়িটা ওপরে এখনো আটকানো, জুমারের দাঁতগুলো গভীর হয়ে দড়িতে বসে রয়েছে, কিন্তু দড়ির ওপরের স্তরটা তখনও কাটেনি। ‘ঠিকঠাকই আছি’ ভাবি আমি। আমার ওপরের দড়ির গিঁটটা ঠিকঠাক আছে, জো-র পুরোনো দড়িগুলোও। আমি দড়ি বরাবর ওপরের দিকে তাকাই, খুঁজে পাবার চেষ্টা করি কুড়ি ফুট দোল খেয়ে পড়ে যাবার কারণটা কী। চাঙরের পেছনের পেগটা বেরিয়ে এসেছে। ‘আমার দোষ।’ আমি মনেমনে বলি, ‘আমিই পুঁতেছি ওটা।’ তবু ওটা গতকাল আমার ভার রেখে দিয়েছিল। ‘ভগবানকে ধন্যবাদ, কালকে আট মিলিমিটার দড়িতে ঝুলে পড়ে যাইনি।’ আমি ভাবি, ‘ওটা না খুলে এলেও দড়িতে জুমার কেটে বসে যেতে পারত।’ ঠিক সেই মুহূর্তে ফিক্স রোপের গোড়ায়, একশো ফুট তফাতে দেয়ালের কোণ বরাবর জো উদয় হল।

“তুমি আজ খুব আস্তে আস্তে উঠছ, ওখানে কী করছ তুমি?’ ও চেঁচিয়ে বলে।

“ওহ। আমি কেবল ভাবছিলাম একবার এই দেওয়ালে দোল খেয়ে দেখলে কেমন লাগে,” আমি বলে উঠি, “যে পেগটা আমি ব্যালকনিতে ওঠার মাঝপথে লাগিয়েছিলাম ওটা খুলে এসে আমায় সেই সুবিধে করে দিল।”

“ভগবান”, জো বলে, “আমার মনে হয় আমি একটা হালকা চিৎকার আর একটা ঝনঝন আওয়াজ শুনেছি। তুমি ওখান থেকে ফিরে আসতে পারবে?”

“পারব, যদি না দড়িটা ছিঁড়ে পড়ে যায়।”

মজা, ভয়ের সঙ্গে লেপ্টেই থাকে। দড়ি বরাবর আমি জুমারটা আস্তে আস্তে ঠেলে তুলতে থাকি, যাতে কোনোরকম আচমকা ঝাঁকুনি এড়ানো যায়। পঞ্চাশ ফুট চড়ার পর আমি ব্যালকনির ওপরে। ক্যাম্প থেকে এখানে পৌঁছোতে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগল। দুর্ঘটনাটা ঘটার পর অসহায়ভাবে ঝুলতে থাকাটা, নিয়ন্ত্রণহীন একটা বোধ আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল – তুষারধস, পড়ে যাওয়া, গাড়ি উলটে যাওয়া এ-সবকিছুর অভিজ্ঞতাই অতীতে আমার হয়েছে। তাতে যেকোনো সময় মৃত্যুও হতে পারত। এখন আমাদের মাথার ওপর বহুদূর অবধি ওভারহ্যাঙের বাধা। 

আমাদের মাথার ওপরে, বাঁদিকে, ওভারহ্যাঙগুলো পাহাড়ের দেওয়াল থেকে পঞ্চাশ ফুট মতো বেরিয়ে এসেছে। ওর মধ্যে একটাই লাইন, ওভারহ্যাঙের ওপরেই একটা খাঁজ প্রায় একশো ফুট উঠেছে। আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম না ওর মধ্যে পেছনের দিকে পুরো খাঁজটা বরাবর কোনো ফাটল আছে কিনা, সন্দেহও হচ্ছিল যে ওটা চড়ার মতো সরঞ্জাম আদৌ আমাদের আছে কিনা। ওটা নিশ্চিতভাবেই পুরোটা একটা আর্টিফিশিয়াল ক্লাইম্বিং এবং হতেই পারে দুদিন লাগাতার নিঃশেষে চড়তে হল। সুতরাং আমাদের একমাত্র আশা ছিল ডানদিক বরাবর।

আমি হারনেসের র‍্যাকে একগাদা সরঞ্জাম ঝুলিয়ে নিয়ে স্যাকটা ব্যালকনিতে জো-এর পাশে রেখে গেলাম। সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব শক্ত যে কী আর কতটা নেব। যদি খুব বেশি নিই, ওটার ওজন বইতে বইতেই ক্লান্ত হয়ে যাব আর যদি দরকার হয় ফ্রি ক্লাইম্বিং করতে পারব না। পেটের মধ্যে গুড়গুড়ে ভয়টা চেপে রেখে আমি ব্যালকনির ধারের দিকে এগোলাম। ব্যালকনি থেকে বেরোনোর মুখে একটা চারফুটি চৌকো পাথরের আড়াল, দেখলে মনে হয় একটা আলগা পাথরের টুকরো। আমাকে এটা ব্যবহার করতে হল। আমি একটা লম্বা ছুরির মতো পিটন ওটার ওপরে একটা ফাটলে ঢুকিয়ে দিলাম, ওর সঙ্গে একটা লম্বা স্লিং আটকে নিয়ে, ঝুঁকে পড়ে দেখলাম। পিটনটা জায়গাতেই রইল। এইবারে ওটার ওপর বেশি নির্ভর করে ঝুঁকে ধারের ওপাশটায় তাকালাম। নীচে সাদাটে গ্রানাইট সিধে নেমে গেছে, কোথাও একটু বেরোনো অংশ বা ভাঙা অংশ কিচ্ছু নেই,  দৃষ্টি আটকাচ্ছে না। আমার নীচে এটা বেঁকে নেমে গেছে আর তলায় পাহাড়ের দেওয়ালটা জুড়ে একের পর এক বাঁকানো স্তরে স্তরে যে আইসফিল্ডটা ছড়িয়ে আছে, আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না কোথায় গিয়ে দেওয়ালটা সেখানে মিশেছে। এখান থেকে আমি গোটা পশ্চিম দেওয়ালটাকে এদিক থেকে ওদিক দক্ষিণ-পশ্চিম গিরিশিরা অবধি দেখতে পাচ্ছিলাম। বিরাট বিরাট দীর্ঘ পাথরের চাঁই, তার মধ্যে লুকোনো গোলাকার জায়গা আর শখানেক ফুট উঁচু উঁচু বরফের স্তম্ভের বাধা আমার সুমুখে। এত আলো যে আমি ভালোভাবে দেখতে চোখটা অর্ধেক বুঁজে ওদের দিকে তাকালাম কেননা দক্ষিণ পশ্চিম ধারের ওপর দিয়ে সূর্য উঠে গেছে, ঝকঝকে নীল আকাশ। ভাবলাম ‘ভালো, শিগগিরই গরম হয়ে উঠবে।’।

আমি আমার মাথার ওপরে ওভারহ্যাঙগুলোর দিকে তাকাই। ওখানে একটা র‍্যাম্প-এর মতো রেখা দেখা যাচ্ছে যেটা কোনাকুনি ডানদিকে উঠে গেছে আর তার মাঝে মাঝে একাধিক সিঁড়ির মতো থাক থাক করা। পুরো গঠনটাই একের পর এক গ্রানাইটের খণ্ড একটার ওপর একটা চাপানো। আমি জো-র দিকে ফিরে তাকাই, “এদিকটায় একটা ওঠার রাস্তা আছে, নিরেট পাথর কিন্তু আলগা।”

আমি প্রথম ধাপটার ধার ছাড়িয়ে ওপরের একটা ফাটলে এক ইঞ্চি ছুরির মতো পিটন গেঁথে একটা এট্রিয়ার ঝুলিয়ে দিলাম। আলতো করে তাতে পা রেখে পুরো ওজনটা দিতে দিতে কুঁজো হয়ে কাঁধটা ঝুঁকিয়ে মুখ নীচু করে হেলমেটটা সামনে করে দিলাম পাছে কোনোভাবে পেগটা বেরিয়ে এসে ছিটকে গায়ে লাগে। এবারে পুরো এট্রিয়ারের ওপর চড়ে গেলাম, ওটা তখনও জায়গাতেই রয়েছে। এবারে এট্রিয়ারের ধাপগুলো উঠে নিজেকে তাকটার ধারের ওপর টেনে তুললাম, খুব অসুরক্ষিত লাগছিল নিজেকে। প্রথম পেগটা সবসময়েই একেবারে বিচ্ছিরি হয়, যদি ওটা খুলে আসত আমি ব্যালকনির ওপরে পিঠ দিয়ে আছড়ে পড়তাম। এ-ধরনের আঘাত খুবই গোলমেলে হত আমাদের পক্ষে, কেননা যেসব পাহাড়ি অঞ্চলে সাধারণত হেলিকপ্টার উদ্ধার ব্যবস্থা থাকে আমরা তার বাইরে রয়েছি। পেগটা থেকে আমি দু-পা চড়লাম কেবল হাত পায়ের সাহায্যে, ফ্রি, বেশ কষ্টকর ছিল চড়াটা আর নিজেকে ওভারহ্যাঙের মধ্যেই একটা ছোটো কুলুঙ্গি মতো জায়গায় আটকে নিলাম, কুলুঙ্গির একদিকে হাঁটুটা ঢুকিয়ে আর আরেকদিকে পিঠটা ঠেকিয়ে। জো-র থেকে আমি ফুট পনেরো উঁচুতে কিন্তু যেখানে আমি ছিলাম সেখান থেকে কেবল ওর পা-দুটো দেখতে পাচ্ছিলাম, মাথাটা ওভারহ্যাঙের আড়ালে। আমি রোদ্দুরে ছিলাম কিন্তু জো বরফঠান্ডা ছায়ায়। কারণ ও এমনভাবে বিলেতে আটকা ছিল, যে রোদ্দুরের দিকে চলে আসা সম্ভব ছিল না। আমি দেখছিলাম ও একটা পা রোদ্দুরের দিকে টানটান করে দিল, তারপরে আরেকটা। ওদুটোকে ও একটু গরম করতে চাইছিল! ভয়ানক কঠিন ঠান্ডায় ছিল বেচারা।

“বারংবার আমি নিজেকে একই প্রশ্ন করে চলেছি আমি করছিটা কী ওখানে, আর তারপরেই আরেকটা প্রতিজ্ঞা করছি যে এটাই শেষবার।”

আমি ভুল দিকে মুখ করে ছিলাম, তাও ব্যথা লাগলেও কোনোমতে বেঁকেচুরে আরেকটা পিটন লাগালাম আমার মাথার ঠিক ওপরের ওভারহ্যাঙটার ডগায়। হাত টানটান করে খুব আস্তে আস্তে ঠুকে ঠুকে ওটা ঢোকালাম, একটা অদ্ভুতুড়ে ভয় হচ্ছিল যে জোরে ঠুকলে হয়তো ওভারহ্যাঙটা আমায় সুদ্ধ নিয়ে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। কী করে জানব যে এরকমটা হবে না! কেউ তো এর আগে আসেনি!

ওখান থেকে একটা ঢালু অসমান তাকের মতো অংশ, একফুট মতো চওড়া, ঝুঁকে থাকা দেওয়াল বরাবর ওপরের দিকে উঠে গেছে। ওটার ওপরে বরফ জমে জমে দেয়ালের সঙ্গে মসৃণভাবে মিশে গেছে। আমি পিটনটায় ভর দিয়ে ঝুঁকে আইস অ্যাক্স দিয়ে বরফটা ভাঙতে চেষ্টা করলাম। কাজটা খুব কঠিন ছিল। যতক্ষণ না হাত ব্যথা হয়ে যায়, আর আঙুলগুলো নাড়াতে না পারি বা অ্যাক্সটা তুলতে না পারি, ততক্ষণ আইস অ্যাক্সটা চালিয়ে গেলাম, তারপর খানিকটা দম নিয়ে আবার শক্তি সঞ্চয় করে ফের শুরু করছিলাম। শেষমেষ র‍্যাম্পের বা তাকটার ওপরে শক্ত বরফ বেরিয়ে এল আর তার ওপরে আমি একটা পিটন পুঁতে দিলাম। এটা আমি যত জোরে পারি মেরে মেরে ঢুকিয়ে দিলাম তারপর ওটাকে ব্যবহার করে খানিকটা উচ্চতা বাড়ালাম। পরপর একটু ওপরে ওপরে আরও দুটো পিটন লাগাবার পর র‍্যাম্পটা শেষ, বেশ কয়েক ফুট ওটা নেই তারপর থেকে আবার বেরিয়ে রয়েছে। র‍্যাম্পের ওপর একটা পা রেখে টাল সামলে আরেকটা পা দেওয়ালে ভর দিয়ে যেখানে আবার র‍্যাম্পটা শুরু হয়েছে সেখানে পৌঁছোতে পারছিলাম। ওখানে বরফটা অনেকটা দূরে আর ভেঙে ফেলার পক্ষে যথেষ্ট শক্ত। মাথাটা দ্রুত কাজ করছিল, আমার চারপাশের খুঁটিনাটি নজর করে নিচ্ছিলাম, খুব আস্তে আস্তে বরফের ওপর নড়াচড়া করছিলাম। আমার চোখের সামনে সাদাটে গ্রানাইটের ওপর স্বচ্ছ কোয়ার্জের দানা, রুপোলি মাসকোভাইট এবং ঘন কালো টুরমালিন। আমার মনোযোগ ওদিকেই চলে গেল; আমার তুচ্ছতাটা ওরা প্রকট করে তুলল; প্রকট করে তুলল যে আমি আদতে ভঙ্গুর, উষ্ণ রক্তের এবং একটা জ্যান্ত কিছু যে কিনা এই খাড়াই, নির্মম চারপাশের দুনিয়ায় একপাশে ঝুলে আছে। 

আমার মনটা এক ঝাঁকুনিতে আবার বর্তমান পরিস্থিতিতে ফিরে এল। একটাই কাজ ছিল করার। আমি ঝুঁকে পড়ে আইস হ্যামারের ছুঁচোলো অংশটা সামনের বরফের শুরুতেই গেঁথে দিলাম, তারপর ওতে এট্রিয়ারটা ঝুলিয়ে আমার ভার রেখে ক্রমশ এগিয়ে গেলাম ওটার ওপর। অংশটা অনেকটা লম্বা, আর আমি জানতাম যদি আমি টাল খাই ওই হঠাৎ ঝাঁকুনিতে আইস হ্যামারটা খুলে আসবে এবং সঙ্গে কয়েকটা পিটনও। “দড়িটা খেয়াল রেখো, জো” আমি চেঁচিয়ে বলি। ও হয়তো কয়েক হাজার মাইল দূরে। মনে মনে ভাবি, ‘এখন যদি এখান থেকে পড়ি, আমি ঠিক শূন্যে ঝুলতে থাকব, আর তারপরে এই পাথরের গায়ে ফিরে আসতে মহা কসরৎ হবে – যদি সেই শক্তি থাকে অবিশ্যি।’ হ্যামারটা জায়গা মতোই রইল। আমি ওর একটু ওপরে একটা আইস স্ক্রু লাগালাম, সেটা ইঞ্চি চারেক ঢুকে গেল। আমি সেটার ওপর ভর দেবার আগে বেঁধে নিলাম। একটা ফুটহোল্ড দেখতে পাচ্ছিলাম, এই পিচটায় এই প্রথম। খুব একটা বড়ো নয়, ডিম রাখার কাপের মুখের মতো চওড়া। আঙুলগুলো দিয়ে কিছু একটা ধরার জন্য আঁচড়াতে আঁচড়াতে আমি আড়াআড়ি দু-পা এগোলাম আর ওটার ওপরে পুরো ভর দিয়ে দাঁড়ালাম। আমি সাবধানী হলে এখানে দাঁড়িয়ে বিশ্রাম করতে পারি এবং পরিস্থিতির একটা আন্দাজ নিতে পারি।

কি জায়গা রে! আমি ঘড়ির দিকে তাকাই – প্রায় দু-ঘণ্টা চড়ে ফেলেছি আর ঘেমে নেয়ে একশা, এদিকে পাথর আর বাতাস যথেষ্ট ঠান্ডা। এ-অবধি যত ক্লাইম্ব করেছি তার মধ্যে এটা অন্যতম কঠিন। শব্দহীন বাতাস, আমার একাকীত্বকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। এখান থেকে কোনদিকে যাব? পঞ্চাশ ফুট ওপরে বিশাল একটা আলগা পাথরের চাঁই দেখা যাচ্ছে যেটাকে আমরা অ্যাডভান্স বেস থেকে বাইনোকুলার দিয়ে গোটা ‘পশ্চিম গাত্রটা’ দেখার সময় আইসফিল্ডের ঠিক তলাতেই ঝুলতে দেখেছিলাম। আমরা ওটার নাম দিয়েছিলাম ‘গিলোটিন’। না, ওদিকে ওঠা নয়। দেয়ালটার ঢাল খাড়া থেকে একটু কমে সহজ হয়েছে আর আমি খুব সাবধানে ডানদিকে পনেরো ফুট মতো ট্র্যাভার্স করে গেলাম, ছড়ে যাওয়া আঙুলের ব্যথা ভুলে গিয়ে কাজে ডুবে গিয়েছিলাম। পাথরটা ঝুরঝুরে, ফলে আমার সঙ্গে থাকা শেষ পিটনটা গাঁথতে খুব সমস্যা হচ্ছিল। হাতুড়িটা দিয়ে একটা ফাটলে জায়গা করে নিয়ে আমি একটা নাট ফাঁসালাম তাতে, তারপর দড়িটা ওতে আটকে নীচের দিকে চেঁচালাম, ‘ও কে, জো, উঠে এসো, আমি পৌঁছে গেছি, যাহোক কোথাও, সাবধানে ধীরে ধীরে।’ আমি একটা ছোট্ট ফুটহোল্ডে দাঁড়িয়ে ছিলাম, পায়ের পেশিগুলো ধরে আসছিল আর অল্প অল্প কাঁপছিল। আমি পেগগুলোয় বেশ কয়েকটা লম্বা স্লিং আটকে তার ওপরে দাঁড়ালাম।

  পুরো নিঃশেষিত, কিন্তু গভীর তৃপ্তির সঙ্গে আমি ওখানটায় ঝুলে রইলাম। বেশ একটা লড়াই হল বটে কিন্তু আমি খানিকটা এগোতে তো পেরেছি – আর আমি কি এই লড়াইটাই চাইছিলাম না? এখানে, কোনো দর্শক নেই, ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলার মতো কিছু নেই, কিংবা খুঁটিনাটি সমস্তটা ফিল্মে তুলে রেখে বেশ একটা ঠেলে তোলা অনুভূতি, যেমনটা সেবারে এভারেস্টের বেলা হয়েছিল। এই পাহাড়টা আমাদের জিদ্দিপনাকে চ্যালেঞ্জ করছে – কিন্তু আমরাও ছেড়ে দেবার বান্দা নই।

জো ধার বরাবর উদ্বেগজনকভাবে ঝুলছিল। ও স্যাক ভর্তি বিপুল সরঞ্জাম বয়ে নিয়ে উঠছে, পঞ্চাশ পাউন্ড তো হবেই। ‘আশা করি পেগগুলো ধরে রাখবে।’ আমি মনেমনে ভাবলাম। আমার এক অংশ এই ক্লাইম্বটা করার জন্য বাহবা আশা করছিল।

“সরি, আমি এতটা বেশি সময় নিয়ে ফেললাম।” আমি যে পেগে ঝুলছিলাম ও সেইখানে উঠে এলে আমি বলি ওকে। আমার অর্ধেক সত্যিই এটা বলতে চাইছিল, আর বাকি অর্ধেক প্রশংসা চাইছিল।

“নিশ্চিতভাবেই এটা খুবই শক্ত ছিল।’ ও বলল।

না, আমরা এই ক্লাইম্বটায় নিজেদের ভয় বা সাফল্য আদানপ্রদান করতে পারিনি, আমাদের একেবারে একটা পেশাদারি সম্পর্ক বজায় রাখতেই হত। আমরা যদি আমাদের সম্পর্কটা ক্লাইম্বের সময় উন্মুক্ত করে মেলে দিতাম তাহলে পাহাড় আমাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিতে পারত। আমাদের একসঙ্গে যৌথভাবে এই পাহাড়ের বিপরীতে দাঁড়াতে হত, পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো গিলে ফেলতে হয়েছিল। সবার আগে জরুরি ছিল আত্মসংরক্ষণ, তা আমাদের যতই নিষ্ঠুর কিংবা সহানুভূতিহীন করুক না কেন। নিজের প্রাণ বাঁচানোটাই ক্রমশ সর্বক্ষণের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম কিন্তু জো-কে লিড করতে বলিনি। আমার মনে সবচেয়ে আগে যে চিন্তাটা ছিল সেটা আইসফিল্ড, আর আমি ওখানে পৌঁছোতে চাইছিলাম।

খুব জটিল একটা প্রকৌশল ছিল আমার হাত থেকে জো-র হাতে বিলেটা পরিবর্তন করা। খুব ভালো করে নিশ্চিত হওয়া, বারবার দেখে নেওয়া যে দুজনেই আলাদা আলাদা করে পেগ-এ বাঁধা আছি আর আমাদের কোনো সরঞ্জামেরই পড়ে যাবার মতো বিপদের ভয় নেই। পরিশ্রম, রোদ্দুর, পরিস্থিতি আর উচ্চতা সব মিলিয়ে আমাদের স্বপ্নের মতো আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। কিন্তু আমার ভেতরে এতদিনকার চর্চা বুঝতে পেরেছিল ঠিক এই সময়েই ভুলচুকটা হয়।

বিলের ঠিক ওপরেই একটা লম্বা খাঁজ ছিল, আর এবার আমি ওটা দিয়েই উঠতে শুরু করলাম। ওটা গিলোটিন বরাবর ওভারহ্যাঙের ওপর দিয়ে গিয়ে ক্রমশ সমান হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। কুড়ি ফুট সোজাসুজি আর্টিফিশিয়াল ক্লাইম্বিং-এর পর আমার মনে হল ডানদিকে উঁচুতে একটা দুর্বল অংশ দেখতে পাচ্ছি যেখানে আইসফিল্ডের নীচের অংশটা দেয়ালের ওপরে ঠেলে উঠে বিশাল একটা বরফস্তম্ভ তৈরি করেছে। আমি ওটার সমান্তরাল একটা পাথর-শিরা বরাবর চড়ছিলাম। আমি যদি ওই বরফস্তম্ভটায় পৌঁছোতে পারি, তার পাশের পাথরটা বেয়ে উঠে ফের বরফের ওপর এসে উঠি যেখানটায় ওটা ঠেলে এসেছে পাথরের ওপর তাহলে হয়তো আইসফিল্ডে পৌঁছোনোর একটা সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। কিন্তু ওই বরফস্তম্ভে পৌঁছোতে হলে আমায় দড়িতে টানটান ঝুলে নীচে নামতে হবে এবং একটা দীর্ঘ পিচ-চড়ার জন্য ঝাঁপাতে হবে। কিন্তু তখন আর অতটা সময় নেই, পড়ে আসা সূর্যের আলোয় পাথর ইতিমধ্যেই লাল হয়ে উঠেছে, আর ওভারহ্যাঙের ওপর দিয়ে ফিক্স রোপটাও আমাদের যথাযথ করে রাখতে হবে। যতটা ওপরে চড়েছি সেইখানে একটা ক্যারাবিনার লাগিয়ে আমার দড়িটাকে ওর মধ্যে দিয়ে গলিয়ে দিয়ে আমি জো-র কাছে নেমে আসি।

“তুমি আবহাওয়ার আশ্চর্য কতগুলো ঘটনা দেখতে পেলে না।” জো বলে।

আমি চারপাশে তাকালাম, দেখি দেওয়াল ঘিরে কুয়াশা-মেঘ জড়ো হচ্ছে।

“নীচে নামাই ভালো হবে।” আমি বললাম।

আমরা ওই পিচটাতে ছটা জায়গায় দড়িটা বেঁধেছিলাম। “ওপর-নীচ করার জন্য এই জায়গাটায় পুরো নিয়ন্ত্রণে থাকবে, পুরো রাস্তায় অতগুলো পেগ, দড়ির গিঁট, ক্যারাবিনার ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে যাওয়া নিয়ে।” আমি বলি।

“হ্যাঁ। পুরো টনি কুর্জ পিচ।” জো বলল।

টনি কুর্জ একজন অস্ট্রিয়ান ক্লাইম্বার ছিলেন, ১৯৩৬ সালে আইগার-এর নর্থ ফেস-এ মারা যান। ওঁর তিনজন সহ ক্লাইম্বার পরপর মারা যাবার পরও উনি প্রায় উদ্ধারকারী দলের হাতের নাগালে নেমে আসতে পেরেছিলেন কিন্তু বাজে আবহাওয়ার জন্য ওরা একটা ছোটো ওভারহ্যাঙ চড়ে ওঁর কাছে পৌঁছোতে পারেনি। ওঁর দড়ির একটা গিঁট ক্যারাবিনারে ফেঁসে যায়, আর উনি এতটাই শ্রান্ত ছিলেন যে ওখানে উদ্ধারকারীদের নাগালের সামান্য বাইরে থাকতে থাকতেই মারা যান। একটা দুঃস্বপ্নের পিচের অপ্রীতিকর নাম।

তাঁবুতে ফিরে রাতের খাবার শেষ করে আমাদের রোজকার ডায়েরি লিখলাম। “কোনো একদিন, আমি যাব, ওখানেই যাব।” জো গুণগুণ করছিল। ক্যারল কিং-এর একটা গান। কেবল এই একটা পংক্তিই আমাদের দুজনের মনে ছিল। “আমার মনে হয় এইটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পিচ।” আমি লিখেছিলাম, “এটা আমার কাছে খানিকটা মানসিক উত্তরণের মতো; এটা যদি আমায় আটকাতে না পারে, কিছুই পারবে না। কিন্তু সব ব্যাপারটাই খুব ধীরে ধীরে চলছে।”

জো লিখেছিল, “হিমালয়ে এটাই সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন ক্লাইম্বিং। অকিঞ্চিৎকর জিনিসও আমাদের স্নায়ুর ওপর চাপ তৈরি করছে। আশা করি পিট আরেকটু সতর্ক হবে।” আমাদের মাথার ওপরে চ্যাঙাব্যাঙের ওপরে আলো মরে আসছিল, যেভাবে শব্দ ক্ষীণ হয়ে আসে।

ফিরে এসে পরদিন সকালে মনে হচ্ছিল জায়গাটা যেন আমরা ছেড়েই যাইনি। এক রাতের ঘুমের পর তরতাজা অবস্থায়, আমি বরফের স্তম্ভটার দিকে নতুন মেজাজে এগোলাম। দড়ির টান রেখে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে আমি ওটার ওপরে ধাপ কাটি, এই ভেবে যে পাথরের ওপর বরফ আঠার মতো আটকে থাকবে। আমি বরফের ওপর লাথি মেরে মেরে অন্যদিকের পাথরটার দিকে এগোই। আমার একটা দড়ি জো-র ওপরে ঝুলে ছিল সোনালি দরজার মতো। একটা নিখুঁত ফাটল ওপরের দেওয়ালটাকে দুভাগ করেছে। আমি ওটা ধরে কুড়ি ফুট চড়ে কয়েকটা স্লিং লাগিয়ে ঝুলে রইলাম। ওটা এমন একটা পিচ, মূলত কোনাকুনি আর জো-র পক্ষে পরে চড়ার জন্য একটু কৌশলী। আমি দড়ি টানটান রেখে যেখানে বরফে নেমেছিলাম, জো-কেও নিজেকে ওখানে নামিয়ে আনার জন্য নীচে নামতে হবে আর এমনটা হতে পারে যে একটা দারুণ পেন্ডুলামের মতো শূন্যে ঝুলে ও আমার দিকে এগিয়ে এল।

“কীভাবে করব আমি এটা?” ও বিড়বিড় করল, তারপর দেখল এভাবে যাওয়া ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই। পাথরের ওপর ওর কয়েকটা নিঁখুত নড়াচড়া আর ও পেরিয়ে এপাশে।

আমাদের মাথার ওপরে কুড়ি ফুট ওপরে বরফের স্তম্ভটার ঢাল একটু বদলে গিয়ে একটা সংকীর্ণ বরফের খাতের চেহারা নিয়েছে যেটা আইসফিল্ড থেকেই নেমে এসেছে।

“মাথার ওপর দিকে যতটা পারি চড়ব, তারপর একটা পেগ পুঁতে দড়িটা টানটান করে লাগাব,” আমি বললাম। ক্র্যাম্পন পায়ে লাগিয়ে, ওই কৌশল করার জন্য তৈরি হলাম, জানতাম, যেই না আমি বরফের গায়ে ঝুলে পড়ব, আমার আর কিছু করবার থাকবে না, আমাকে চড়তেই হবে – আর একবার শুরু করলে জুতো বদলানোরও কোনো সুযোগ থাকবে না। যে ফাটলটাতে আমরা ঝুলছিলাম সেটা আমাদের পনেরো ফুট ওপরে শেষ হয়ে এসেছে। আমি ওটার ডগায়, যতটা ওপরে পৌঁছোতে পারি, একটা পেগ পুঁতে দিলাম আর তারপর আরেকটা পেগ উলটো করে দেওয়ালের একটা ভঙ্গুর চাঙরের ফাঁকে পুঁতে দিলাম। তারপর দড়িতে ভর করে বাঁদিকে ঝুঁকে এগোতে শুরু করলাম। বেশ গরম, আর মেঘমুক্ত দিন – এযাবৎ সবচেয়ে ভালো – আর পরিস্থিতিও একেবারে আদর্শ, বিশেষত এত উচ্চতায় এইরকম টেকনিক্যাল ক্লাইম্বিং-এর জন্য।

খুব খেয়াল করে পা রাখতে রাখতে, পাথরে ক্র্যাম্পন ঘসা লাগতে লাগতে, রোদ্দুরে ঝলসে উঠতে উঠতে, আমি শেষ অবধি এমন একটা জায়গায় পৌঁছোলাম যেখান থেকে আমি হাত টানটান করে দিলে আইস হ্যামার দিয়ে বরফস্তম্ভটা স্পর্শ করতে পারব। আমি একটা ছোট্ট ফুটহোল্ডে বেঁকে দাঁড়িয়ে ছিলাম, দড়ি টানটান, মুখোমুখি একটা বড়ো দোল খাবার মতো পরিস্থিতি। আমার নীচে জো-র ক্যামেরার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। ‘আমি এটার উল্লেখ করব না,’ ভাবলাম একবার, ‘ওর ফাঁকিবাজিটা বলব, কিন্তু আশা করি ও দড়িটা ঠিকঠাক ধরে আছে।’ তারপর বলে উঠি,‘দড়িটা দেখো জো, আমি বরফে যাচ্ছি।’ বলে আমি হাতে হ্যামার অ্যাক্স নিয়ে দড়িতে দুলে গেলাম, আশা করি আইস অ্যাক্সটা এক চাঙর বরফ নিয়ে খসে যাবে না, তার সঙ্গে আমাকেও গুলতির মতো ছিটকে দেবে না। দিলও না। আমি আইস অ্যাক্সের ছুঁচোলো দিকটা বরফে গেঁথে দিলাম, একইসঙ্গে ক্র্যাম্পনের ডগার কাঁটাগুলোও গেঁথে দিলাম বরফে। ওগুলোও আটকে রইল, কিন্তু আমার পুরো ওজনটা এখন দুহাতের ওপর। বরফে চড়ার সুকঠিন নিয়মটা এবার মনের ওপর ভেসে উঠল, তাড়াহুড়ো নয়। প্রথমে অ্যাক্স, তারপর হ্যামার, আমি আমার মাথার ওপরদিকে একে একে চালাই, তারপর দু-পা চটপট ক্র্যাম্পনের সাহায্যে বরফের আরেকটু ওপরে তুলে আনা যাতে আমার অ্যাক্স আর হ্যামারের বেরিয়ে থাকা অংশটা আমার চোখের সামনা সামনি চলে আসে। তারপর এটারই পুনরাবৃত্তি। পড়ে যাবার চিন্তাটা এখন মনের এক্কেবারে তলায় চলে গেছে। পুরোপুরি সমর্পিত এবং চড়তে মশগুল। তারপর ঢালটা সহজ হয়ে এল। একটা পাথর বরফ থেকে খানিকটা বেরিয়ে ছিল, আমি ওটার ওপর থেকে বরফ ভেঙে সরিয়ে পা-টা কাত করে রাখলাম। পরিশ্রমে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাবার মতো অবস্থা আমার। আগের কয়েক মিনিটের অক্সিজেনের ঘাটতি বেড়ে বেড়ে আমার দৃষ্টি ঝাপসা ও আবছা করে দিচ্ছিল। কয়েক মুহূর্তের জন্য আমার চারপাশের বরফ অন্ধকার হয়ে এল।

এইবারে ওপরের বরফের সঙ্কীর্ণ খাতটা দিয়ে চড়া শুরু হতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এখন আমার ওজনটা আমার পায়ের ওপর, হাতের ওপর আর নেই। প্রথমেই আমি থেমে বরফের ওপর দুটো পা-ই রাখার জন্য  ধাপ বানিয়ে জো-কে ওপরে ডেকে নিলাম। আরো একবার আমরা ফিক্স রোপটা সরাসরি টানটান ও সোজা করার চেষ্টা করলাম আর জো আঁকাবাঁকা ভাবে আটকানো দড়িটার থেকে নিজেকে পর্যায়ক্রমে খুলে, সমস্ত রানার এবং বিলেগুলো খুলতে খুলতে উঠল তাতে প্রায় একখানা দড়ির দৈর্ঘ্য বেঁচে গেল। এটা করা হল টনি কুর্জ পিচ-এর শেষ মাথা থেকে। তার মানে দাঁড়াল এই যে আমরা এদিক ওদিক না করে গিলোটিনের পরের ওভারহ্যাঙ বরাবর সোজা অ্যাবসেইল করে নেমে যেতে পারব। আমার চারটে লিড শেষ হয়েছে, এইবার সেটা করতে আমার প্রায় দিন তিনেক সময় লেগেছে। আমার কাছে ‘ব্যারিয়ার’ পেরোনো শেষ, এখন আমার বুকের মধ্যে আবার সেই দুঃখ বোধটা ফিরে এল। আমি ফের আমার ভেতরের অপ্রতিহত ভাবটা টের পাচ্ছিলাম যেটা এভারেস্ট থেকে নামার সময় টের পেয়েছিলাম। ক্লাইম্বিংটা এতটা বেশি রকমের নিংড়ানো না হলে আমি হয়তো এরকমটা অনুভবই করতামই না। আমাদের পরের অংশটায় চড়ার সম্ভাবনা বেশ উজ্জ্বল মনে হচ্ছিল, আইসফিল্ডটা ওপরের দিকে প্রায় পাঁচশো ফুট বিস্তৃত একেবারে ওপরের টাওয়ার অবধি।

“আমি হয়তো একটা পিচ চড়ে ফেলতে পারি।” বলেই, জো, দ্রুত আইসফিল্ডের ওপর দিয়ে চড়তে শুরু করল, আর যেখানে পাথর ঢুকে এসেছে আইসফিল্ডে সেখানকার একাধিক স্ফীত অংশ পেরিয়ে গেল। তারপর মোটামুটি ১৫০ ফুট ওপরে ও কয়েকটা পিটন ঠুকে অ্যাবসেইল করে আমার কাছে নেমে এল। ওকে খুব খুশি লাগছিল।

“বেশি কথাটথা না বলে, স্রেফ নিজেদের মধ্যেকার ভাবনার তরঙ্গের আদানপ্রদানেই এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে আমরা ওয়েস্ট ওয়াল চড়ে ফেলতে পারব, শুধুই যদি লেগে থাকতে পারি। আইসফিল্ডটার নিজের একটা প্রতীকী পরিমণ্ডল রয়েছে আর ওটার মধ্যে ঢোকা মানে অন্যান্য গোপন জায়গায় ঢোকার মতো – সে-জায়গাগুলোও  একইরকম বিশিষ্ট আর রহস্যঘেরা। আইগারের নর্থ ফেস-এর স্পাইডার নিয়েও আমার একইরকম অনুভূতি হয়েছিল।”

শিগগিরিই আমরা সাঁ করে দড়ি বেয়ে ক্যাম্পে ফিরে এলাম। প্রথম কয়েকটা অ্যাবসেইলিং-এর মধ্যেই সূর্য অস্ত যেতে বসেছিল। দক্ষিণ-পূর্ব গিরিশিরা আর দুনাগিরির চূড়ার ওপরে পুরোটা জুড়ে মেঘ উঠে আসছিল। সূর্যের আলো পড়ে পুরো মেঘের স্তরটা লাল হয়ে উঠেছিল, যেন মনে হচ্ছিল গোটা গিরিশিরা জুড়ে আগুন লেগে গেছে, দাবানলের মতো। আমি জো-কে দেখছিলাম আমার তলায়, কক্ষনো দেরি করছে না ক্যামেরা বার করতে, দ্রুত ছবি তুলে চলেছিল। ‘আদর্শ,’ আমি মনে মনে বলি, ‘ওই সবচেয়ে ভালো ছবিগুলো পেয়ে যাবে।’ আমার ক্যামেরাটা বার করে আমি একটা ছবি তুলতে গেলাম, কিন্তু ফিল্ম শেষ। ফিল্ম বদলানোর তাড়াহুড়োতে আমি হতাশ হয়ে দেখলাম, তোলা ছবির রোলটা হাত ফসকে নীচে পড়ে দ্রুত গতিতে লাফাতে লাফাতে ইনার লাইন পেরিয়ে পনেরোশো ফুট নীচে বাগিনি হিমবাহের দিকে চলে গেল। আমি দুদিনের ক্লাইম্বিং-এর ছবি হারিয়ে ফেললাম যা আর কখনও ফিরে পাওয়া যাবে না।

“একটা দারুণ কভার ফোটো পেয়েছি ওখানে,’ আমি ক্যাম্পে পৌঁছোলে জো একগাল হেসে বলল। আমি শুধু হুঁ করলাম। খুব কঠিন দিন গেছে একটা।

“আমি জীবনের নরমসরম দিকগুলো নিয়ে খুব চিন্তা করি” [জো সেদিনে সন্ধ্যায় ডায়েরিতে লিখেছিল। সূর্যাস্তের সৌন্দর্য নিয়ে লিখেছিল ও]

“ এই সব অদ্ভূত জিনিস কেবল অংশতই নজর করা যায়, আর সঠিক তারিফ তো দূর, আমার মনের একটা কোণ থেকে কেউ আমাকে বলে ছবি তুলতে, আমি তুলি, কিছুক্ষণ ওটার দিকে তাকিয়ে থাকি আর তাদের উপভোগ করতে পারি।” 

দুটো দিনে কতকিছু ঘটে যেতে পারে। বাড়িতে আমি হয়তো বেশ কিছু মিটিং-এ অংশ নিতাম, নানা জায়গায় যেতাম, খবরের কাগজ দেখতাম, একগাদা চিঠি পড়তাম, চিঠি লিখতাম, অনবরত টেলিফোন ব্যবহার করতাম, হয়তো টেলিভিশন দেখতাম, পানশালায় যেতাম, কয়েকটা রেকর্ড চালিয়ে শুনতাম। কিন্তু এখানে, সমস্তরকম যোগাযোগ, সঙ্গীসাথি আর চলাফেরা অতীতেই বন্দি, দুদিন ধরে চ্যাঙাব্যাঙে একমাত্র প্রেরণা আর সর্বক্ষণের উদ্দেশ্য ছিল ‘ব্যারিয়ার’টা চড়ে ফেলা।

আমাদের কাছে এখন কেবল তিনটে দড়ি রয়েছে – এগুলোও ওপরে ব্যবহার করা হয়ে গেলে, আমাদের সঙ্গের ক্লাইম্বিং রোপ হিসেবে ধরে, মোট ১৭০০ ফুট দৈর্ঘ্যের দড়ি লাগানো হবে। ২৪ সেপ্টেম্বর সকালে অনেকটা পথ জুমার করে উঠতে হবে আমাদের।

“ভালো হয়েছে আমাদের সঙ্গে বেশি দড়ি নেই।” বেরোবার পরপরই জো বলে, “আমাদের শিগগিরিই থামতে হবে, নইলে জুমারিং করতে করতেই পুরো সময় আর শক্তি খরচ করে ফেলব। তাছাড়া, টনি ক্রুজ পিচটা দিয়ে বারবার ওঠা নামা করতে থাকলে, আর গিলোটিনের পাশ দিয়ে বারবার চড়লে, আজ না হোক কাল আমাদের কেউ না কেউ অতগুলো গিঁট আর পেগ-এর মধ্যে গুলিয়ে একটা না একটা ভুল করে ফেলব আর ভুল কিছু খুলে দিয়ে বসব।”

“আমরা কাল হ্যামকগুলো নিয়ে উঠব, আর নীচের দড়িগুলো টেনে ওপরে তুলে নেব।” আমি বলি, “ওপরে খুব একটা ক্যাম্প লাগানোর জায়গা নেই।”

তিনঘণ্টা বাদে আমরা আগের দিন যত অবধি চড়েছিলাম সেইখানে পৌঁছে গেলাম। আমরা অত্যন্ত ভারী মাল বইছিলাম, কেননা সব খাবারদাবার আর যন্ত্রপাতি আজকের সবচেয়ে উঁচু জায়গাতে রেখে আসব, পরের দিন আরো বড়ো চড়ার প্রস্তুতির জন্য। গিলোটিনের পাশে যে দড়িটা লাগানো ছিল যেটা কাল সোজা এবং টানটান করা হয়েছিল, ওটা চড়তে দম বেরিয়ে যাচ্ছিল, কেননা স্রেফ দড়িতে ঝুলছিলাম ওখানে। এখানে আমাদের ক্লাইম্বিং রোপ খুলে রেখেছিলাম, আর ফিক্স রোপটা নাইলনের হওয়াতে, জুমার টানতেই সেটা খানিকটা বেড়ে আবার পরক্ষণেই গুটিয়ে আমাদের ওপরে নীচে অসহায় পুতুলের মতো দোলাচ্ছিল। আমি দড়ির ঘসা খাওয়া, কিংবা অ্যাংকর খুলে আসা এসব ভাবনা থেকে মনটা সরিয়ে ওপরে চড়তে থাকলাম।

লিড করা ব্যাপারটা বেশ উত্তেজনা আনে, আর নিজের ভেতরের শক্তিও বের করে আনে; পেছন পেছন চড়াটা অনেক স্বচ্ছন্দ, ভাবনাহীন, তবে শারীরীক মানসিকভাবে দুর্বলও করে তোলে। এখানে চারপাশটা অসাধারণ, আর আমি পাগলের মতো ছবি তুলে চলেছিলাম, যাতে আগের দিনের পড়ে যাওয়া ফিল্মের দৃশ্যগুলো ফের তুলে নিতে পারি। জো খুব দ্রুত, আর চটপট বরফে চড়ছিল, আমার ওকে হিংসে হচ্ছিল, আইসফিল্ডে পৌঁছে ঢালটা বদলে যাওয়াতে, নড়াচড়ায় অনেক স্বাধীনতা এসেছিল। এই প্রথম আমি ওর লিড করার সঙ্গে অনেকটা একাত্ম অনুভব করছিলাম, কারণ ওখানে অনেককিছু লক্ষ করার ছিল, কেননা সুরক্ষার সুযোগ এতটাই কম, যে, পড়ে গেলে সেটা একটা ভয়ানক ব্যাপার হবে।

“আইসফিল্ডটা শ্যামবর্ণের, ভাল্লাগে না রঙটা, ওপর অবধি কয়েকশো ফুট উঁচু। বরফে সোজাসুজি ওপরে চড়ার চেয়ে আমি একটু বাঁদিক ঘেঁসে উঠলাম, যেখানে বরফের মাঝ দিয়ে পাথর দেখা যাচ্ছে। শক্ত বরফের ওপর দিয়ে টিপ-টো পদ্ধতিতে ওঠার চেয়ে এটা কম পরিশ্রমের। পাথরটা ভালো না, আর পিটন গাঁথতে গেলে ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়বে। অনেকবারই আমাকে টলমল করতে করতে অনিশ্চিতভাবে ওপরে ওঠার সময় একটা ঝুরঝুরে পাথর ছেড়ে বেয়ারারকম ভাবে সরে গিয়ে অন্যকিছু ধরতে হচ্ছিল, যেটা অপেক্ষাকৃত একটু পদের। সারাক্ষণ মাথার মধ্যে বেজে চলেছে পড়া চলবে না। শারীরিক পরিশ্রমের চেয়ে মানসিক চাপেই বেশি ক্লান্ত লাগছিল। একটা ঢালু পাথরের স্ল্যাবের ডগা থেকে ওপরের বরফে হাত টানটান করে যতটা ওপরে সম্ভব আমার আইস অ্যাক্সটা গেঁথে দিলাম, যেখানটায় নীচের পাথরের ওপর বরফ পাতলা হয়ে ঢেকে আছে। একটা বিচ্ছিরিরকমভাবে বেঁকেটেকে ক্র্যাম্পনটা লাগিয়ে নিলাম, এবারে বরফের জন্য আমি ঠিকঠাক প্রস্তুত, আইসফিল্ডের একেবারে মাথা অবধি, শেষ একশো ফুট চড়ার জন্য, যেখান থেকে ওপরের টাওয়ারটা শুরু হয়েছে। এরপর ওটায় চড়ার রাস্তা বার করতে হবে।”

জো-র পেছনে জুমারিং করে ওঠার পরিশ্রমটা একেবারে দুঃস্বপ্নের মতো। পনেরো ফুট মতো জুমার করার পর প্রসারিত নাইলনের দড়িটা টানটান হলে তবে আমি উঠতে পারছি। জো স্যাক ছাড়াই লিড করছে, ফলে আমি সমস্ত সরঞ্জাম আমার পিঠেই নিয়েছি, আর সেটা আমায় কেবল পিছনদিকে টানছে। পিঠে বোঝা নিয়ে, পাপের ভারে কুঁজো হয়ে হামাগুড়ি দেবার মতো, আমার এক একটা পা উঠতে সজ্ঞান ইচ্ছাশক্তির প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। পরিষ্কার আবহাওয়াটা ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছিল আর মেঘ উঠে আসছিল পাহাড়ের নীচের দেয়াল থেকে ওপরের আইসফিল্ডের ওপরে। হালকা তুষার পড়ছিল। কিন্তু আমার চারপাশের ঘেরাটোপে আবহাওয়াটা তখন অবান্তর। আমি শুয়ে পড়ে জুমার ধরা দুহাতের ওপর ভর রেখে বিশ্রাম নিচ্ছি। উচ্চতার প্রভাব পড়ছে ঢের বেশি, এ-অবধি চড়তে যত না কষ্ট হয়ে ছিল তার চেয়েও অনেক বেশি।

দড়ির আগায় জো আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল, চারপাশ দেখছিল, আমার লড়াইটাও। আমার ভেতরে ভেতরে ওকে মনে হচ্ছিল বহু দূরের, পরিপূর্ণ, বিচ্ছিরিরকম তরতাজা, আপাতদৃষ্টিতে মানুষের দুর্বলতায় নির্বিকার। প্রত্যেকবার আমি ঝিমিয়ে এলিয়ে পড়ার সময় শুনতে পাচ্ছি ওর ক্যামেরার শব্দ, ও আমার ছবি তুলছিল। একটা অভিমান ঠেলে উঠছিল আমার মধ্যে। ম্যানচেস্টারের কিছু বন্ধুর কথা মনে পড়ল, ওরা জো-র দুনাগিরির ওপরে বক্তৃতার ব্যাপারে বলেছিল। ও ডিক-এর একটা ছবি দেখিয়েছিল, চূড়ার গিরিশিরার ওপরে চিতপাত হয়ে শুয়ে। এটাকে ওরা কুরুচিকর ভেবেছিল। ক্যামেরা মিথ্যে বলে না – এটা বাস্তব এবং শীতল, নড়চড়হীন। তবু ক্যামেরার পেছনের লোকটা, যে ছবিটা তুলছে, ছবির খানিকটা গুণাগুণের জন্য সেইই দায়ী থাকে। জো আসলে যা যা ঘটছে তা পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ রেকর্ড করার জন্যে ব্যগ্র ছিল, যা যা আমি করছিলাম সব। ও কী করত ছবিগুলো নিয়ে? বক্তৃতা দিত? ‘কীভাবে আমি বোর্ডম্যানকে চ্যাঙাব্যাঙে নিয়ে গেছি?’ সন্দেহের বশে আমি যত জোরে পারি শ্বাস টেনে বলে উঠি, “তুমি আরেকটা এরকম ছবি তুললে আমি তোমায় ঠ্যাঙাব।”

বলে ফেলতেই আমার ইগোর বেলুনটা কেমন চুপসে গেল। আমি যখন জো-র কাছে পৌঁছোলাম, ওকে ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করলাম। ও কেমন ঠান্ডা মেরে গিয়েছিল, বিস্মিতও। মনে হল, ব্যাখ্যা না করতে গেলেই ভালো হত, আমি মর্যাদাটা হারিয়েছি। সুতরাং আমিও শক্ত হলাম, আমাদের নিজের নিজের খোলে গুটিয়ে থাকতে হবে এই ক্লাইম্বটা করার জন্য। ঘটনাটায় জো যুগপৎ স্তম্ভিত ও হতাশ হয়ে পড়েছিল।

“এটা ঠিক যে আমরা দুজনেই খাদের কিনারে, কিন্তু যেটা আমায় অবাক করল যে ওর রাগটা একেবারে এতটা উঠে এল! চাপের মুখে সবসময়েই হাজারটা কারণ থাকে মেজাজ হারানোর, কিন্তু মনে মনে সক্কলে জানে যে এটা পরিস্থিতির চাপে তৈরি হওয়া একটা বিষয়, ফলে সেটা চেপেই যায়। পিটার, জানি না কী কারণে, আমি বুঝতে পারলাম না, ওর রাগটা প্রকাশ করে ফেলল এবং আমি সতর্ক হয়ে গেলাম যে ও এতটা ছেলেমানুষও হতে পারে। আমি ভাবছিলাম যে এভারেস্টের পর ও ওর ভাবমূর্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন কী না, কিংবা লোকের চোখে জনপ্রিয় থাকার জন্য যেসব ভুলভাল ধারণা চালু তাতে ও বিশ্বাস করে কি না।

“ঘটনাটা সামান্যই ছিল, আর তা নিয়ে তর্ক করার জায়গা এটা নয়।”

বিকেল নাগাদ, জো তিনটে দড়ির দৈর্ঘ্য চড়ে ফেলল। আমরা সমস্ত খাবার দাবার গ্যাস ক্যানিস্টার, চড়ার সরঞ্জাম, যা যা সঙ্গে করে এনেছিলাম একটা সবুজ বিভক ব্যাগে পুরে অ্যাংকরে আটকে দিলাম। আমি আগে নামলাম। পায়ের তলা থেকে মেঘ উঠে আসছিল, তার মধ্যে দিয়ে আমরা রামানি হিমবাহ দেখতে পাচ্ছিলাম, ক্রমশ ছায়ায় অন্ধকার হয়ে উঠছে। মেঘ আর পড়ন্ত সূর্যের আলোয় ঋষিকোট-এর চেহারা আর রঙ দুইই বদলে গিয়েছিল। আমাদের চারপাশের আলো কেমন সম্মোহিত করে তুলছিল। মালপত্র ছাড়া দড়ি ধরে অবাধ এবং নির্ভার নেমে যাওয়া, সারাদিনের ক্লান্তি আর উচ্চতার কারণে আচ্ছন্ন হয়ে থাকা মনে একটা মুক্তির আস্বাদ দিয়েছিল। কিছুই ভাবাচ্ছিল না আমায়, মনে হচ্ছিল অ্যাংকর খুলে গেলে বা দড়ি ছিঁড়ে গেলে আমি ভাসতে ভাসতে নীচে মেঘের গদিতে গিয়ে পড়ব।

আইসফিল্ডের নীচ থেকে গিলোটিনের পাশ দিয়ে দড়িতে একটা বড়ো দোল খেয়ে নামার সময় মাঝপথে একটা বেয়াড়া গিঁট আমার সম্বিত ফিরিয়ে দিল। Tous les grandes chefs sont tues en rappels. ‘সমস্ত বড়ো বড়ো ক্লাইম্বাররা অ্যাবসেলিং-এর সময়েই মারা গেছেন!’পর্বতারোহণের কলাকৌশল বিষয়ে প্রথম যে বইটা আমি পড়ি তাতে এই আপ্ত বাক্যটা লেখা ছিল, তখন আমার চোদ্দো বছর বয়েস। টনি কুর্জ পিচ বরাবর নামার সময় আমার মাথায় এই কথাটাই ঘুরে ফিরে বেজে চলল। নিয়মানুবর্তিতাটা ফিরে এল, দড়ির গিঁট এবং দড়ির পুরো সংস্থানটা ফের আরেকবার খুব মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করা গেল। সূর্য ডুবে গেছে, আমি শীতল এবং থমধরা চারপাশের মধ্য দিয়ে ক্যাম্পে নেমে এলাম। দিনটা বেশ লম্বা ছিল আর আমরা বহুক্ষণ পাহাড়ের ওপরে কাটিয়েছি।

সেরাতে বাতাসটা ফের শুরু হল।

২৬ সেপ্টেম্বরের ভোরবেলা, ঘুম ভাঙল, খুব ক্লান্ত আর বিস্বাদ লাগছিল। তাঁবু আর পাহাড় পুরোই মেঘে ঢাকা আর খুব হাওয়া। খুব একটা আলোচনা করতে হল না, সেদিনটা বিশ্রাম ঘোষণা করতে। কিন্তু এই সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেই আমার অস্বস্তি হতে শুরু করল। আমরা মূল্যবান খাবার খেয়ে ফেলছিলাম, তাইই নয়, মানসিকভাবে ব্যাপারটা আরও গুরুত্বপূর্ণ ছিল এইজন্যে যে, ওপরে ওঠার যে গতিটা বজায় রেখেছিলাম এদ্দিন, সেটা ব্যাহত হল। জো, যাহোক, একবার সিদ্ধান্তটা হয়ে যাবার পর, গা ছেড়ে দিয়ে চোখ বুঁজে ঘুমের দেশে পাড়ি দিল। প্রথমটায় ওর এই দৃঢ় প্রত্যয়ে আমি অবাক হলাম, হিংসেও হল। আমি ঠিক করলাম আমি কেবল ওকে অনুসরণ করে খাপ খাওয়াতে পারি, তো ‘নাইট রানার্স অব বেঙ্গল’ বইটা নিয়ে তার মধ্যেই মজে গেলাম। বিকেলের দিকে বরফ পড়ায় আমাদের সিদ্ধান্তটা যে সঠিক তা আরও জোরদার হয়েছিল, সন্ধে অবধি আবহাওয়ায় কোনোই উন্নতি হল না। রাতের খাবারের পর আমরা ভোর ছটায় অ্যালার্ম দিয়ে রাখলাম, আশা করি বড়োসড়ো চড়াটা শুরু হবে এরপর।

ব্রেকফাস্ট সিদ্ধান্তটাকে মুলতুবী করে দিল। আমরা যুক্তি সাজাচ্ছিলাম, চেষ্টা করছিলাম বাস্তববাদী হতে – দুর্বলও হয়ে পড়ছিলাম। আবহাওয়াটা তখনও অনিশ্চিত আর আমরাও। চারপাশ থেকে পাহাড়ের ওপর ছেয়ে থাকা কুয়াশার আবরণটা নেই কিন্তু আকাশে সাদা মেঘ ছেয়ে আছে।

“এখানে আবহাওয়াটা বোঝা প্রায় অসম্ভব,” আমি বললাম, “বলতে চাইছি, যদি তুমি আল্পসে এরকম সিরাস মেঘ দেখো, ভয়ানক একটা কিছু আসছে বুঝতে পারবে, কিন্তু এখানে সেটা বলা অসম্ভব।”

“সমস্ত দড়িদড়া খুলে নিয়ে ওপরে উঠে, বাজে আবহাওয়ায়, আইসফিল্ডের ওপরে আটকে গেলে, তখন ব্যাপারটা চাপের হয়ে যাবে।” জো বলল।

সমস্যাটা খোলাখুলি এবং সরাসরি সামনে ধরাম করে ফেলা হল। আমরা দুজনেই ঠিক যা ভাবছিলাম তাইই বলছিলাম।

“আমরা এখানে যতদিন ইচ্ছে থাকতে পারতাম যদি এখানে সারাক্ষণ খাবার দাবার এনে দেবার মতো কুলিদের দল থাকত,” আমি বলি, “কিন্তু পুরো রাস্তাটা চড়ার মতো এখানে যথেষ্ট খাবার আছে বলে আমি ঠিক নিশ্চিত নই।”

“শালা, সব ওই অ্যাডভান্স ক্যাম্পে।” জো বলে।

“নিশ্চিতভাবেই চিনি আর পেছন মোছার কাগজ কম আছে।” আমি বলি।

“সেটা কিন্তু কঠিন ব্যাপার,” জো উত্তর দেয়, “এদ্দিনে বেস ক্যাম্পে কেউ না কেউ এসে পড়েছে।”

“আমরা প্রতিদিনই ঠিকঠাক এগিয়েছি – এবারে একটু অন্যরকম হলে কিন্তু ভালোই হবে আমাদের পক্ষে। এই সকালে এখুনি দুড়দাড় করে নেমে গেলে বেস ক্যাম্পে পৌঁছে যাব, কিছু জিনিস সেখান থেকে তুলে নিয়ে বিকেলের মধ্যে অ্যাডভান্স ক্যাম্পে। তারপর কালকে খুব দ্রুত এখানে উঠে এসে বড়ো চড়ার কাজটা শুরু করে দিতে পারি। এতে মাত্র একদিন নষ্ট হবে!” আমি প্রস্তাবটা বিবৃত করলাম। কিন্তু ওটা আমার একলার নয়। কথায় কথায় আমাদের আলোচনা থেকে সিদ্ধান্তটা উঠে এল।

মচমচে বরফের ঢালে নামাটা একটা নতুন অনুভূতি, বিশেষত মনঃসংযোগের ব্যাপারে, আরও এইজন্য যে গত দিনগুলোতে দড়িদড়ার এত প্রয়োগের ব্যাপারস্যাপারের পর। একবার গ্রাবরেখা ধরে যেই হাঁটা শুরু হল, আমরা আশ্চর্য হয়ে গেলাম যে আমরা দুর্বল বোধ করছি আর পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ছি। বোধহয় অনুভূমিক চলার পক্ষে আমাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো খাপ খেয়ে উঠতে পারছিল না। আমরা পাথর থেকে পাথরে ঠোক্কর খেয়ে খেয়ে চলছিলাম। পাহাড়টাকে অনেক দূরের আর নিষ্ঠুর লাগছিল। অ্যাডভান্স বেসক্যাম্প থেকে বাইনোকুলার দিয়ে আমরা ব্যারিয়ার এবং ওপরের আইসফিল্ডের যে রেখা বরাবর চড়েছি সেটা চিহ্নিত করতে পারছিলাম। ওখানে যাবার একমাত্র চিহ্ন হিসেবে যা দেখতে পাচ্ছিলাম সেটা বিভক স্যাকের ঝোলাটা। কুড়ি হাজার ফুট ওপরে ওটা একটা ছোট্ট ফুটকির মতো লাগছিল, আমাদের চেয়ে ৩০০০ ফুট ওপরে, চূড়া থেকে ২৫০০ ফুট তলায়। আমাদের অগ্রগতি, সবচেয়ে উঁচু যে অংশে পৌঁছেছি, তা নিয়ে আগে যা যা গর্ব অনুভব করেছি তা পাহাড়ের তলা থেকে যত দূরে সরছি ততই নগন্য এবং যথেষ্ট কম ও নীচুতে দেখতে লাগছিল। আগেকার দ্বিধাগুলোও সব হুড়মুড় করে ফিরে এল মনে। আমাদের ফিরতি পথে সূর্যের আলোও খিল্লি করছিল। এত গরম লাগছিল যে আরও এগোনোর আগে কিছু জামাকাপড় খুলে একটা পাথরের তলায় রেখে দিয়ে এলাম। গ্রাবরেখার ঢাল ধরে নীচের উপত্যকায় বেসক্যাম্পের দিকে বাঁক নিতেই মনে হল যেন বাড়ির রাস্তা ধরেছি। সবকটা বোল্ডার চিনতে পারছিলাম। একটা কোণায় বেস ক্যাম্পের তাঁবুটা খাটানো ছিল আর একশো গজের মধ্যে না আসা অবধি ওটাকে দেখা প্রায় অসম্ভব ছিল। কাউকে দেখতে পাবার আশায়, আমরা প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। কেউ ছিল না ওখানে। এমনকি আমাদের রেখে যাওয়া লেখাটাও একইরকম আছে। গত দশ দিনে কেউ এদিক দিয়ে যায়নি।

বিপুল পরিমাণে খাবার বানানো হল। ভারতে তৈরি রামের বোতল থেকে বেশ খানিকটা গলায় ঢেলে ঘাসের ওপর শুয়ে থাকা গেল। কিচ্ছুটি বদল ঘটেনি, যেমনটা রেখে গিয়েছিলাম, ঠিক তেমনটাই আছে – কেবল তাঁবুর কাছেই যে ছোট্ট নালাটা ছিল সেটা শুকিয়ে গেছে। আমরা সহমত হলাম এই ব্যাপারে যে সেদিন বিকেলেই অ্যাডভান্স বেস ক্যাম্পে পৌঁছোব ভাবাটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। জো তাঁবুর কানাতের ভেতরে একটা রুকস্যাকে হেলান দিয়ে ধপ করে বসে পড়ল, ওর টুপিটা চোখের ওপর নেমে এসেছে, যেন মনে হচ্ছে প্রখর দুপুরে রাস্তার পাশে কোনো জনবিরল পশ্চিমি শহরে একটা লোক ঝিমোচ্ছে।

“খালি ভাবো,” ও বলল, “ঠিক একবছর আগে, গতকাল, তুমি এভারেস্ট চড়েছ।” তখনও অবধি মাথায় আসেনি কথাটা। এভারেস্ট আমার মন থেকে সরে গিয়েছিল।

ক্রমশ

খেলার পাতায় সমস্ত ধারাবাহিক অভিযান একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s