জয়ঢাকের অভিযান লাইব্রেরি- এভারেস্ট-এরিক শিপটন(অনু-বাসব চট্টোপাধ্যায়) অন্নপূর্ণা-মরিস হারজগ(অনু তাপস মৌলিক) কন-টিকি অভিযান- থর হেয়ারডাল (অনু-শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়)
এই অভিযানের আগের পর্ব- পর্ব ১, পর্ব ২ পর্ব ৩, পর্ব ৪
(ডেভিড লিভিংস্টোন ছিলেন পেশায় ডাক্তার। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজকও। লিভিংস্টোন প্রথম আফ্রিকা পাড়ি দেন ১৮৪১ সালে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। আফ্রিকার অবাধ দাস ব্যাবসার বিরোধী ছিলেন তিনি। বেশ কয়েক দশক ধরে আফ্রিকায় অভিযানে যান ডক্টর লিভিংস্টোন। প্রতিটি অভিযানে আফ্রিকার জনজাতি, ভূতত্ত্ব, পরিবেশ খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য লিখে রাখেন নিজের ডায়েরিতে। এই ধারাবাহিকে তাঁর নীলনদের উৎসের খোঁজে যাত্রার গল্প শুনছি আমরা।)
————————————————————————————–
উনিয়ানেম্বে পোঁছে সৈয়দ বিন সালিমের সঙ্গে চললাম তার কুইকুরুর তাঁবুতে। পথের দু-পাশে অসংখ্য নারী-পুরুষ আমাকে অভিবাদন জানাল, অবশ্যই সাদা চামড়া দেখে। মা-বাবার পায়ের ফাঁকে দাঁড়িয়ে ছোটো ছোটো বাচ্চারা বিস্ময়ে চোখ মেলে আমাদের মিছিল দেখতে লাগল।
দেখলাম সালিম শেখের বাড়ির চৌহদ্দি কাঠের বেড়া দিয়ে ঘিরে সুরক্ষিত করা। সালিম নিজের হাতে চা বানিয়ে রুপোর কাপ-ডিশে পরিবেশন করল। একটু দূরে কিছু উদাসীন ছন্নছাড়া আরব বসে বসে গড়গড়ায় টান দিচ্ছে। আমিও আমন্ত্রিত হলাম ওদের সঙ্গে যোগ দেবার জন্য। উৎকৃষ্ট আসাম চা গুনে গুনে এগারো কাপ খেয়ে ফেললাম। তাই দেখে শেখ একটু হয়তো অবাক হল।
কীভাবে আমি জাঞ্জিবর থেকে উনিয়ানেম্বে পৌঁছলাম, পথের নানা বিবরণ, ইত্যাদি বিস্তারিতভাবে খুব আগ্রহী হয়ে শুনতে চাইল সৈয়দ বিন সালিম। এমনকি সে অভিযাত্রী বার্টন আর স্পেকের খবরও নিল। ক্যাপ্টেন স্পেক মারা গেছে শুনে সালিম খুব দুঃখপ্রকাশ করল। আমি বিদায় নিতে চাইলে সে আমার সঙ্গেই চলল আমার নব আস্তানায়। শুনলাম টাবোরা থেকে একঘণ্টা হেঁটে গেলে তবেই আমাদের আস্তানা জুটবে। জায়গাটার নাম কুইহারা।
কুইকুরু ছাড়াতেই আমাদের একটা ছোট্ট পাহাড় পেরোতে হল। তারপর পৌঁছে গেলাম কুইহারা। দুটো অনুচ্চ পাহাড়ের মাঝে এক ঘাসে ঢাকা উপত্যকায় দূরে নজরে এল কয়েকটা মাটির ঘর, ছাদগুলো খড়ে ছাওয়া। এখানে সবে ভুট্টা কাটা হয়েছে দেখলাম ক্ষেতে। উসাগরা পাহাড় থেকে ধেয়ে আসা ঠান্ডা হাওয়া আমাদের মজ্জা কাঁপিয়ে দিল, যদিও চারদিক সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে। কিন্তু এই উপত্যকা প্রাণহীন, মৃত্যু-শীতল স্তব্ধতা বিরাজ করছে চরাচর ঘিরে। আকাশটাও সূর্যের প্রখর আলো থাকা সত্ত্বেও যেন মলিন।
ঘরগুলোর কাছে পৌঁছে দেখি বেড়া দিয়ে ঘেরা এক ছোটোখাটো গ্রাম সেখানে। এক বিশাল প্রবেশ দরজা দিয়ে ঢুকে পড়তেই দেখি আমার দলের লোকেরা আমাকে স্বাগত জানাল। তারা আমার আগেই সেখানে পৌঁছে মহা হট্টগোল বাধিয়ে দিয়েছে। একজন তো আমাকে দেখামাত্র সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতে গেল। আমার সাগরেদ শেখ সৈয়দ বলল, “বানা, আমরা তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম। এসব তোমারই ঘরবাড়ি। এই দেখো, তোমার জন্য ওরা আলাদা বাড়ি দিয়েছে, তোমার শোবার ঘর, এই তোমার অস্ত্রশালা। এই হল তোমার স্নানের জায়গা…” ওর উৎসাহ আর ধরে না!
আমি বম্বেকে হুকুম দিলাম কাপড়ের গাঁটরি, পুঁতির ভাণ্ডার আর তারের বান্ডিল স্টোর-রুমে সাজিয়ে রাখতে। এখানে বারুদ আর বন্দুক গুছিয়ে রাখতে বললাম একজায়গায়। কাপড়ের এক বান্ডিল খুলে কুলিদের যথাযথ দান করে বিদেয় করলাম।
আমার চার কাফিলার দলপতির কাছ থেকে তাদের পদযাত্রার বিবরণ শুনলাম খুঁটিয়ে। একটা দল এক আফ্রিকান উপজাতির সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করে জিতে ফিরে এসেছে। দ্বিতীয় দল এক চোরকে গুলি করে মেরেছে। তৃতীয় দল নিরাপদে পৌঁছেছে। চতুর্থ দল একটা কাপড়ের বিশাল বান্ডিল খুইয়ে এসেছে। তবে মোটের উপর সবাই অক্ষত অবস্থায় এইখানে পৌঁছেছে, এটাই যা রক্ষে। চারজন দলপতিকেই পাঁচটা করে ধুতি উপহার দিয়ে খুশি করলাম।
কাজ মিটে যেতে প্রচণ্ড খিদে পেল। কিন্তু মেঘ না চাইতেই জল! একদল আরব খাবারের ভাণ্ডার নিয়ে এসে হাজির। বিস্মিত হয়ে দেখি বিশাল এক ভাতের হাঁড়ি, বড়ো এক পাত্রে মুরগির ঝোল, এক বড়ো থালায় কাটা পাকা পেঁপে, বেদানা, লেবু, আরও কত কী! এরপর আর-একটা দল তাড়িয়ে আনল পাঁচটা মোটাসোটা বলদ, আটটা ভেড়া, এক ডজন মুরগি, এক ডজন মুরগির ডিম। রাজসিক আতিথেয়তা একেই বল। এত খাবার পেয়ে আমি ওদের কৃতজ্ঞতা জানাবার কোনও ভাষাই খুঁজে পেলাম না।
চেহারা দেখে বুঝলাম, এই আরবেরা ওমানের লোক, সবাই বেশ ধনী। টাবোরাতে এরা বেশ রহিস জীবনযাপন করে। টাবোরা হল আফ্রিকাতে আরবদের সবচাইতে বড়ো উপনিবেশ। প্রায় হাজার খানেক লোকের বাস সেখানে। কুইহারা উপত্যকা এরা চাষবাসের জন্য ব্যবহার করে। এখানকার জমি খুব উর্বর, তাই পশুপালনের জন্য খুবই উত্তম জায়গা। তাই এখানে দুধ, মাখন আর ঘিয়ের কোনও অভাব নেই। আম, কমলালেবু, পেঁপে থেকে শুরু করে টম্যাটো, শসা, বেগুন পর্যন্ত এখানে ফলানো হয়। ধান চাষ হয় সর্বত্র। ভারতীয় ভুট্টা, বাজরা এবং গমও চাষ হয়। সস্তায় খাবারদাবার কেনাও যায় এখানে। জ্যাম, জেলি, বিস্কুট, কফি, চা ইত্যাদি যেসব জিনিস এখানে পাওয়া যায় না, অনায়াসে সেসব এরা দাসদের দিয়ে সমুদ্রের উপকূল থেকে নিয়ে আসে বয়ে। এদের ব্যবহার্য কার্পেট আর বিছানার আড়ম্বর দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে যেতে বাধ্য। সবাই যথেচ্ছ সোনাদানা পরে থাকে গায়ে। আর প্রতিটি ধনী আরবের সঙ্গে হারেম তো আছেই।
পরদিন আমার ঘরের দরজায় সব আরব ধনী ব্যবসায়ী দেখা করতে এল দল বেঁধে। এদের সাহায্য ছাড়া যে কোনও সাদা চামড়ার লোক আফ্রিকা থেকে ঘরে ফিরে যেতে পারবে না। এরাই আমাকে গতকাল নানাবিধ খাবারদাবার উপঢৌকন দিয়ে খুবই খুশি করেছে। তাই একে একে সবাইকে আমি অভিবাদন জানালাম। তাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ অনর্থক বকবক করা শেষ হলে ওরা ফিরে গেল টাবোরায়। যাবার সময় জানিয়ে যেতে ভুলল না যে, খুব শিগগির আমার জন্য এক বিরাট ভোজসভার আয়োজন করা হবে।
কুইহারাতে তিনদিন বিশ্রাম নিয়ে টাবোরার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে আঠারো জন সশস্ত্র জওয়ান। উপত্যকা পার হয়ে সুলতান বিন আলির মাটির বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। বয়সে প্রবীণ, ধনী এই ব্যক্তি ছোটোবড়ো সবার কাছেই খুব সম্মাননীয়। বেড়া দিয়ে ঘেরা ছোটোখাটো একটা গ্রামের মতো জায়গাতেই তাঁর বাড়ি। বসতে না বসতেই আমাদের জন্য শরবত আর মোচা কফি এসে গেল। কফিতে গলা ভিজিয়ে চললাম খামিস বিন আবদুল্লার বাড়ি। আগে থেকেই সে আমার সম্মানে অনেক অতিথি ডেকে এক মহাভোজের আয়োজন করে রেখেছিল। সাদা পোশাকের আরবেরা তখন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে শুনলাম। জরুরি সভা বসে গেছে। আমাকেও আমন্ত্রণ জানানো হল।
খামিসের কথা আমি ক্যাপ্টেন স্পেকের ডায়েরিতে পড়েছিলাম। খুবই সাহসী এক যোদ্ধা এই মানুষটি। আরবদের স্বার্থ বজায় রাখতে উপজাতির খুনি দলপতিদের অনেককেই শায়েস্তা করেছে। তাঁর চেহারাটিও দেখবার মতো, বেশ সম্ভ্রম জাগায়। এখন আফ্রিকার এক দলনায়ক মোরাম্বোর উৎপাতে অতিষ্ঠ আরবদের দলবদ্ধ করে সে যুদ্ধের পরিকল্পনা করছে। মোরাম্বো আগে নাকি এক আরব দলের কুলি ছিল। তারপর সে বেশ কিছুকাল উইলিয়াঙ্কুরুর জঙ্গলে ডাকাতি করেছে। উওএহ্-এর রাজা মারা যেতে দলবল নিয়ে সে অনধিকার প্রবেশ করে সেই এলাকায়। তারপর তাদের স্বঘোষিত সুলতান বলে নিজেকে ঘোষণা করে। এখন সে নাকি প্রতিজ্ঞা করেছে, আরবদের এই দেশের মাটি থেকে উচ্ছেদ না করা পর্যন্ত সে শান্তি পাবে না।
কিছুদিন আগে উজিজির পথে আরবদের এক কাফিলাকে আটক করে সে পাঁচ কেজি বারুদ, পাঁচ বান্ডিল কাপড় আর পাঁচটি বন্দুক দাবি করে। দাবি মেটানোর পরও সে নাকি অখুশি হয়ে আরবদের ফিরে যেতে বলে। উজিজির পথ আরবদের জন্য বন্ধ করে দিয়ে বলে, “যদি এই পথে যেতে যাও, তবে আমার মরদেহের উপর দিয়ে যেতে হবে।”
“মোরাম্বো বলেছে, উনিয়ানেম্বের একচ্ছত্র আধিরাজ সে-ই হবে, আরবদের এই মাটিতে কোনও স্থান নেই। এখন ওমানের সন্তানেরা আমায় বলো, এটা কি হতে দেওয়া যায়?” প্রশ্নটা সভায় উপস্থিত আরবদের দিকে ছুড়ে দিয়ে অপেক্ষা করে খামিস বিন আবদুল্লা।
উপস্থিত আরব তরুণেরা অসম্মতি জানিয়ে গলা তোলে। তাদের থামিয়ে দিয়ে আর-এক আরব দলপতি বলে, “বাবার কাছে শুনেছি, এক সময় বোগোমায়া থেকে উজিজি, কিলোয়া থেকে লুন্ডা, আর উসেঙ্গা থেকে উগান্ডা স্রেফ হাতে লাঠি নিয়েই নাকি পার হয়ে যেত আরব দল। কিন্তু সেদিন আর নেই। আমরা অনেক আগে থেকেই ঘুষ দিতে দিতে আফ্রিকার এক প্রান্ত থেকে আর-এক প্রান্তে চলে এসেছি। কিন্তু মোরাম্বোর জমানায় এবার আমাদের যাতায়াত, ব্যাবসাবাণিজ্য সব তুলে দিতে হবে মনে হচ্ছে, যদি এমন করেই দিন চলতে থাকে। তোমরাই বলো, এবার কি আমাদের বহুদিনের হাতির দাঁতের ব্যাবসা একেবারে লাটে উঠিয়ে দিতে হবে চিরকালের জন্য?”
একটু বিরতি নিয়ে সে আবার ঘোষণা করে, “যুদ্ধ, যুদ্ধ চাই বন্ধুগণ! মোরাম্বোকে উচ্ছেদ করতে হবে; তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে হবে উওএহ্ আর উইলিয়াঙ্কুরুর শাসনভার। আমরা আবার স্রেফ লাঠি হাতে আফ্রিকার পথে চলতে চাই। সবাই তৈরি?”
আরবেরা যে অচিরেই যুদ্ধে নামবে, সে-বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহই রইল না। কেবল চিন্তা হচ্ছে ডক্টর লিভিংস্টোনের জন্য। আমরা কি যুদ্ধের ময়দানে ভুল করে পা দিয়ে ফেলেছি? আদৌ কি আমরা লিভিংস্টোনের দেখা পাব, যাঁর জন্য এত পথ ধেয়ে আসা এত কষ্ট করে! তীরে এসে কি তরী ডুববে শেষে?
আরবদের আলোচনায় যা বুঝলাম তা হল, এরা দিন পনেরোর মধ্যে যুদ্ধ শেষ করে শান্তি আনতে চায়। আমি মনে মনে স্থির করলাম, এদের সাহায্য করব। নিজেদের মালপত্র নিয়ে কিছু দূরে তাঁবু পাতব, তারপর ওদের সঙ্গে কিছু জওয়ান নিয়ে যুদ্ধে নেমে পড়ব। যুদ্ধে জিতে গেলে মোরাম্বো আর তাকে সাহায্যকারী উপজাতি রুগা-রুগাদের হটিয়ে সোজা চলে যাব উজিজি। আরবদের উৎসাহ আর উদ্দীপনা দেখে তারা যে যুদ্ধ জয় করে নেবে, এমনটাই মনে হতে লাগল।
যুদ্ধ প্রস্তুতির সভা শেষ হতে মহাভোজ শুরু হল। নানাধরনের উপাদেয় খাবার চোখের নিমেষে হাজির। কাজু, কিশমিশ, পেস্তা মেশানো সুগন্ধি পোলাও, মুরগির রোস্ট, কাবাব, মিষ্টি রুটি, শরবত, বিভিন্ন ফল, মাস্কাটের প্রসিদ্ধ সুস্বাদু মিষ্টি, নানা জাতের বাদাম-সহ মধ্যাহ্নভোজ একটু গুরুপাক হয়ে গেল। আমরা সবাই কিছুক্ষণ আগে যে যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করছিলাম, এখন কারও আর তা মনেই নেই বোধহয়।
মহাভোজ মিটে যেতে আমি টাবোরাতে ঘুরে ঘুরে শহর দেখলাম। কিছু কিছু বাড়ির দরজায় আঁকা শিল্পকলা চোখে পড়ার মতো। স্থানীয় উপজাতির লোকেরা নাকি এমন হাতের কাজে সিদ্ধহস্ত। বিকেল নাগাদ আমার নিজের ডেরায় ফিরে এলাম হাঁটতে হাঁটতে। সঙ্গে নিয়ে এলাম সুখস্মৃতি। আমার লোকেরা একপাল বলদ, তিন বস্তা সুগন্ধি চাল বয়ে নিয়ে এল আমার পিছন পিছন। শুনলাম এসবই খামিস বিন আবদুল্লার উপহার।
হঠাৎই একদিন জানতে পারলাম ডক্টর লিভিংস্টোনের এক কাফিলা নাকি উনিয়ানেম্বেতে থেমে রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আমি সৈয়দ বিন সালিমকে জানালাম এই কাফিলার সব জিনিসপত্র আর মানুষ যেন আমার সঙ্গেই থাকতে পারে। যুদ্ধ শেষ হলে একসঙ্গে রওনা দেব উজিজির পথে। সৈয়দ সঙ্গে সঙ্গে রাজি।
এক সকালে লিভিংস্টোনের কাফিলার নেতা আসমানি তার গোটা তাঁবু উঠিয়ে নিয়ে এল আমার ডেরায়। আমার হাতে সে একটা চিঠি ধরিয়ে দিল, যা দেখে আমি চমকে উঠলাম। এই পুরো কাফিলার রসদ যাচ্ছিল উজিজি এবং চিঠিটা ডক্টর লিভিংস্টোনের উদ্দেশে লেখা। তারিখ দেওয়া আছে নভেম্বর ১, ১৮৭০। এরা প্রায় ১০০ দিন বাগামোয়োতেই কাটিয়ে দিয়েছে, যা জাঞ্জিবর থেকে মাত্র পঁচিশ কিলোমিটার দূরে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, মাত্র কিছুদিন আগেই নাকি এরা উনিয়ানেম্বেতে এসে রাস্তা খোলা পাবার অপেক্ষায় দিন কাটাচ্ছে। অথচ পঁয়ত্রিশ জনের এই দল যদি আর-একটা মাস আগে এখানে পৌঁছত, তবে বেচারা লিভিংস্টোনকে রসদের অভাবে ধুঁকতে হত না।
কয়েকদিন পর হঠাৎ আমার শরীর খারাপ হয়ে পড়ল। প্রথমে আমার নিম্নাঙ্গ অসাড় হতে লাগল, তারপর ধুম জ্বর। আমি বিছানা নিলাম। এদিকে মাথা খুব কাজ করছে, কিন্তু চলার শক্তি নেই। নিজের ফেলে আসা জীবন সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মতো মনে পড়তে লাগল। একবার স্বপ্ন দেখলাম ডক্টর লিভিংস্টোনের সঙ্গে দেখা হয়েছে। আমরা দুজনে খুব কুশল বিনিময় করছি। লিভিংস্টোন আমাকে পেয়ে খুব খুশি হয়েছেন।
যেদিন সুস্থ হলাম, সেদিন আমার সহায়করা জানাল, আমি নাকি দুই সপ্তাহ ধরে বিছানায় পড়ে পড়ে ভুল বকেছি। এদিকে আমার কিছুই মনে পড়ছে না। দলের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ল। সবাই আরোগ্য লাভ করতেই আমরা পূর্ণ উদ্যমে এগিয়ে চললাম মোরাম্বোর দেশের দিকে আক্রমণ করতে।
আমার সঙ্গে পঞ্চাশ জন মানুষ চলল যুদ্ধ অভিযানে। কিন্তু আমার অনুগত বম্বে আর এগোতে রাজি হল না। খুব সম্ভব ভয় তার উপর চেপে বসেছিল। কষে দুই ঘা লাঠির বাড়ি লাগাতে বাধ্য হলাম। তারপর সে আর এগোতে অস্বীকার করেনি। এমনকি শ্বেতাঙ্গ শ পর্যন্ত শরীর খারাপের অজুহাতে এগোতে রাজি নয়। কুলিদের বললাম, তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে মার্চ করতে। ওরা আমার কথামতো শ-কে কাঁধে বসিয়ে ছুটতে লাগল।
উত্তর-পূর্বদিক থেকে প্রবল হাড় কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়া বইছে। আমার লোকেরা লাল কম্বল গায়ে জড়িয়ে নিল। দূর থেকে দেখলে যে-কেউ মনে করত যেন লাল ঢেউ দ্রুত এগিয়ে আসছে। পিঠের বোঝা ছাড়াও সবার হাতে আছে বন্দুক। আরব ক্যাম্পে এসে থামলাম বিশ্রাম নেবার জন্য। সৈয়দ বিন মাজিদের ছেলে এসে আমাকে আপ্যায়ন করে নিয়ে গেল তার তাঁবুতে। শুনলাম আরবরা আমার অপেক্ষাতে বসে আছে অধীর আগ্রহ নিয়ে।
আমরা ওয়ানিমইয়েজি পৌঁছলাম। এখানে প্রায় হাজার দুয়েক লড়াকু লোকের সমাবেশ হল। বেশিরভাগের হাতেই আছে আধুনিক জার্মান, আমেরিকান, ফরাসি বন্দুক আর চাকু। গুলিগালাও আছে যথেষ্ট। এছাড়া বল্লমও আছে অনেকের কাছে। বিশাল বিশাল ব্যানার আর পতাকা উড়িয়ে, কাড়ানাকাড়া আর শিঙা বাজিয়ে আমরা মার্চ করতে লাগলাম মোরাম্বোর দেশের দিকে।
ওয়ানিমইয়েজির এক ঘোষক সব আফ্রিকান যোদ্ধাকে ডেকে জড়ো করে বলল, “মাসিওয়ার পুত্ররা, ওয়ানিমইয়েজির সন্তানেরা, সামনের পথ তোমাদের অপেক্ষায়, জঙ্গলের চোরেরা তোমাদের পথ চেয়ে। এই চোরেরা তোমাদের রাস্তা কাটে, তারা তোমাদের হাতির দাঁত চুরি করে, ছিনিয়ে নিয়ে যায় তোমাদের মেয়েদের, বউদের। দেখো আরবেরা তোমাদের পাশে, সাদা চামড়ার মানুষ তোমাদের সঙ্গে। যাও যুদ্ধ করো, ছিনিয়ে নাও ওদের কাপড়, ওদের সব পালিত পশু, ওদের দাস বানাও, বেচে দাও। যা পার সব খেয়ে শেষ করো। ওদের মারো। যাও এবার যুদ্ধ করো।”
এই উত্তেজক ঘোষণা হবার পর গ্রামের দরজা খুলে দেওয়া হল। স্রোতের মতো যোদ্ধারা গুলি ছুড়তে ছুড়তে, লাফাতে লাফাতে, ডিগবাজি খেতে খেতে এগিয়ে চলল জঙ্গল ভেদ করে।
পাঁচ ঘণ্টা মার্চ করার পর আমরা জিম্বিজো পৌঁছলাম। বিশাল এক চাষের ক্ষেতের পাশে এসে থেমে গেল আমাদের সৈন্যদল। একেবারে হাতের কাছে শত্রুর দেখা না পেলে গুলি ছুড়তে বারণ করা হল প্রতিটি দলকে। খামিস বিন আবদুল্লা গুঁড়ি মেরে জঙ্গল ভেদ করে গ্রামের পিছন দিকে চলল দলবল নিয়ে। বাকিরা প্রধান প্রবেশ পথের সামনে অপেক্ষা করতে লাগল ডাইনে আর বাঁয়ে। আমি আমার দল নিয়ে পুবদিকের দরজা আগলানোর জন্য এগোতে লাগলাম জঙ্গলে না গিয়ে রাস্তা বরাবর। ঠিক তখুনি আমাদের উপর ছুটে এল এক ঝাঁক গুলি।
শত্রুদের লড়াই করার এক অদ্ভুত স্টাইল দেখতে পেলাম। ব্যাঙের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে কখনও বাঁদিকে, কখনও ডাইনে, সামনে পিছনে করতে করতে ওরা গুলি ছুড়তে লাগল। আমরা চারদিক থেকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে গ্রামে ঢুকে পড়লাম। বেচারা গ্রামবাসীরা প্রাণভয়ে গ্রাম ছেড়ে পাহাড়ের দিকে ছুট দিল।
গ্রামের ভিতর গিয়ে দেখি আমাদের বেশিরভাগ গুলি ওদের শক্ত কাঠের বেড়ায় গেঁথে গিয়েছে। গোটা কুড়ি মাত্র মৃতদেহ ছাড়া গ্রাম একেবারে জনশূন্য। এরপর আরও দুটো গ্রাম আক্রমণ করে, তাদের যাবতীয় জিনিস জ্বালিয়ে দিয়ে, প্রচুর হাতির দাঁত আর শস্য লুট করে আমরা এগিয়ে চললাম সামনে। জনা পঞ্চাশেক দাসও জুটে গেল আমাদের ঝুলিতে। বেশিরভাগ লুটের মাল অবশ্য গেল আরবদের দখলে।
পরদিন সকালে উইলাঙ্কুরুতে আক্রমণ করল তরুণ আরবদের নেতৃত্বে পাঁচশো যোদ্ধা। এখানেই নাকি মোরাম্বো লুকিয়ে আছে। আর-এক দল গেল পাহাড়ের দিকে গ্রাম ধ্বংস করতে।
এখানে এসে আবার আমার জ্বর এল। আমি বম্বে আর শ-কে বললাম আমার দলের লোকেরা আমার নির্দেশ ছাড়া যেন আরবদের সঙ্গে যুদ্ধে না যায়। কিন্তু শুনলাম অর্ধেক লোক নাকি ইতিমধ্যেই যুদ্ধে নেমে পড়েছে উইলাঙ্কুরুতে।
সন্ধে নাগাদ বিদ্যুৎ চমকের মতো এক খবর আমাদের তাঁবুতে ধেয়ে এল—আরবদের সঙ্গে যত যোদ্ধা গিয়েছিল উইলাঙ্কুরুতে, তারা সবাই মোরাম্বোর লোকদের হাতে মারা পড়েছে।
অনেক রাতে আমার কয়েকজন লোক উইলাঙ্কুরু থেকে ফিরে এল। তাদের কাছে শুনলাম, আরব দলপতি সউদ বিন সইদ ঝটিকা আক্রমণ করে উইলাঙ্কুরুর গ্রামে যুদ্ধ জিতে নেয় মুহূর্তে। মোরাম্বো তার ছেলেদের নিয়ে পালিয়ে যায় জঙ্গলে। বিজয়ীরা একশো হাতির দাঁত, ষাট বান্ডিল কাপড় আর দুশো দাস বন্দি করে ঘরে ফিরে আসছিল, ঠিক তখুনি মোরাম্বো আর তার দলবল ঘাসের ঝোপের আড়াল থেকে ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রায় সবাইকে কুড়ল দিয়ে কেটে ফেলে। বীর সউদ তার বন্দুক থেকে গুলি ছুড়ে দুজনকে ঘায়েল করে, কিন্তু মোরাম্বোর ছোড়া বর্শা আমূল বিঁধে যায় সউদের বুকে। বাকিরা কোনোমতে প্রাণ নিয়ে লুটের মাল ফেলে রেখে ছুটে পালায়। এদের অনেকেই আবার মোরাম্বোর লোকের হাতে মারা যায় জঙ্গলেই।
যুদ্ধের এই মর্মান্তিক খবর আমাকে একেবারে ভেঙে দিল। শরীর আরও অসুস্থ বোধ হতে লাগল। সারারাত ধরে আহত যোদ্ধাদের বয়ে নিয়ে আসতে থাকল লোকে। তাদের ব্যথার যন্ত্রণায় চিৎকার আর গোঙানোর আওয়াজে দু-চোখের পাতা এক করতে পারলাম না। আমার যেসব লোক যুদ্ধে মারা গিয়েছে বলে খবর এসেছিল, তারাও আর ফিরে এসে বেঁচে থাকার প্রমাণ দেয়নি।
পরদিন সকালে আরব দলপতিরা একে অপরকে দোষারোপ করতে লাগল। কেউ বলল, আগে থেকে শান্তি প্রস্তাব দিলে আজ আর এই হারের দিন দেখতে হত না। কেউ প্রস্তাব দিল, এইবেলা মানে মানে কেটে পড়া যাক, ঘরে ফিরে যাওয়া ঢের ভালো। প্রধান দলপতি খামিস বিন আবদুল্লাকে দেখে অপমানিত, ব্যথিত মনে হল। আমাদের অস্থায়ী তাঁবুগুলোতে নেমে এল শোকের ছায়া। বেশিরভাগ মানুষ শুনলাম ফিরে যেতে যায় যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে।
অনেক রাতে ভেবেচিন্তে আমি বম্বেকে পাঠালাম সৈয়দ বিন সালিমের তাঁবুতে। তাকে বললাম আমার মত জানাতে যে, আমরা যেন লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে কখনোই পালিয়ে না যাই। তাহলে মোরাম্বোর হাত থেকে এই অঞ্চল উদ্ধার করা আর সম্ভব হবে না এবং সে উনিয়ানেম্বেতে থাবা গেড়ে বসবে।
গভীর রাতে আমার ঘুম ভাঙাল আমার ভৃত্য সেলিম।—“মাস্টার, জলদি উঠে পড়ুন, সবাই তাঁবু ছেড়ে পালাচ্ছে। খামিস বিন আবদুল্লা আগেই রওনা দিয়েছেন।”
দেরি না করে আমি তড়িঘড়ি পোশাক পরে নিয়ে টলতে টলতে দরজা খুলে বাইরে এলাম। প্রথমেই নজরে এল, আরব নেতা থানি বিন আবদুল্লাকে তার চাকরেরা একরকম টেনে-হিঁচড়েই নিয়ে চলেছে। আমাকে দেখেই থানি চেঁচিয়ে উঠে বলল, “বানা, তাড়াতাড়ি পালাও। মোরাম্বো আসছে।” চেঁচাতে চেঁচাতে জ্যাকেট শরীরে জড়িয়ে নিয়ে সে প্রাণভয়ে ছুটতে লাগল। ওর চোখ দুটো ভয়ে কোটর থেকে ঠিকরে বেরোবার উপক্রম।
এরপরই নজরে এল খামিস বিন আবদুল্লাহ, সেও পালাচ্ছে। আমার দুই সাথীও দেখি পালাবার মতলবে খামিসের পিছু নিয়েছে। আমার আদেশে সেলিম রিভলভার উঁচিয়ে ভয় দেখিয়ে ওদের ফিরিয়ে আনল। অবাক হয়ে দেখলাম, আমার নিজের লোক শ, খচ্চরের পিঠে উঠে আমাকে মোরাম্বোর জিম্মায় নির্দ্বিধায় ছেড়ে দিয়ে চম্পট দেবার তালে আছে। আমার পঞ্চাশ জন লোকের মধ্যে মাত্র সাতজন আমার সঙ্গে রয়েছে, বাকিরা হয় আগেই রওনা দিয়েছে, না-হয় আরবদের সঙ্গে পালাচ্ছে। এরপর আর তাঁবুতে থেকে যাবার কোনও অর্থ হয় না। সেলিমকে বললাম, “গাধার পিঠে জিন চাপা, আমরাও পালাই।”
সারারাত গাধার পিঠে চড়ে ভোরের দিকে আমরা মাফুতোতে পৌঁছে গেলাম। গ্রামবাসীরা আমাদের সাদরে গ্রহণ করল। প্রাণ বেঁচে যেতে বড়ো ভালো বোধ হতে লাগল। আমার আফ্রিকা অভিযান তবেই সার্থক হবে, যদি আমি প্রাণে বেঁচে থেকে ডক্টর লিভিংস্টোনকে খুঁজে বার করতে পারি। বিশ্বস্ত সেলিমকে জিজ্ঞেস করলাম, “হ্যাঁ রে, তুই কেন অন্যদের মতো আমাকে ছেড়ে চলে গেলি না?”
গোল গোল চোখে তাকিয়ে থেকে সরল উত্তর এল, “মাস্টার, আমি তোমার চাবুকের মার খেতে চাইনি।”
আরব দলপতিরা ভাবতেও পারেনি, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে আসবার জন্য আমি তাদের উপর ক্ষুব্ধ হতে পারি বা ওদের ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হতে পারি। শুধুমাত্র বন্ধুত্বের খাতিরেই আমি তাদের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য হাত মিলিয়েছিলাম। সকাল হতেই তাদের আমাকে ‘সালাম’ জানানো দেখে মনে হল যেন আমাদের মধ্যে সব সম্পর্ক আগের মতোই আছে। তারা আমার চারপাশে বসতে না বসতেই আমি একেবারে ফেটে পড়লাম।—“এই যুদ্ধ কিন্তু আপনাদের আর মিরাম্বোর মধ্যে। আমার জানা ছিল না এত সামান্য প্ররোচনায় আপনারা রণে ভঙ্গ দিতে পারেন। যুদ্ধ এত কম সময়ের জন্য স্থায়ী হবে, এ আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। আর-একটু লম্বা যুদ্ধ চললে আমদের জিত নিশ্চিত ছিল। কিন্তু যেভাবে আপনারা আপনাদের আহত আর অসুস্থ সাথীদের যুদ্ধক্ষেত্রে ফেলে রেখে চলে এলেন ভীরুর মতো, আমার মনে হয় না আমি আর আপনাদের জোটে থাকতে পারব। আমি আপনাদের যুদ্ধের কায়দাকানুন দেখে বুঝে গিয়েছি, এই যুদ্ধ জিততে কম করে বছর খানেক লেগে যাবে। সাদা চামড়ার আমি অন্যরকম যুদ্ধের সঙ্গে বহু পরিচিত। আমি কিছুটা অন্তত যা লড়াই করতে জানি, তাতে মনে হয়েছে এত সামান্য কারণে প্রকৃত যোদ্ধারা যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে চলে আসতে পারে না।”
আমার বক্তৃতা শেষ হবার পর একের পর এক আরব উঠে দাঁড়িয়ে প্রবল প্রতিবাদ করে জানাতে লাগল যে, তারা যুদ্ধের ময়দানে আমাকে একা ফেলে আসতে একেবারেই চায়নি, কিন্তু কয়েকজন আফ্রিকান লোক তাদের জানিয়েছিল যে, মুসুঙ্গো নাকি তাঁবু ছেড়ে পালিয়েছে ভয়ে। সেই শুনে দলে দলে লোক পালাতে শুরু করলে আরবরাও পাততাড়ি গোটাতে শুরু করে।
আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেল। একদিকে আরবদের আতিথেয়তার প্রতিদান যে খুব ভালো করে দিতে পারলাম তাও নয়, আর-একদিকে ডক্টর লিভিংস্টোনের কাছে পৌঁছতে দেরি হচ্ছে বলে চিন্তায় পড়ে গেলাম। যুদ্ধে মরে গেলেই বোধহয় সব ল্যাঠা চুকে যেত। কিন্তু মন বেঁধে আবার ফিরে গেলাম যেখান থেকে পালিয়ে এসেছিলাম। আরবেরাও তাদের শহর টাবোরায় ফিরে গেল। যে-করেই হোক আমাকে উজিজি পৌঁছতে হবে। উত্তরদিকে যাওয়া যাবে না, সেদিকে মিরাম্বো আর তার ডাকাতদের অধ্যুষিত এলাকা। দক্ষিণদিক দিয়ে ঘুরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। স্থানীয় একটা লোকও কুইহারার দক্ষিণদিকের রাস্তা সম্বন্ধে ভালো ধারণা দিতে পারল না। কেউ নাকি কোনোদিন সে-পথে পা মাড়ায়নি, কিন্তু সবাই নিশ্চিত ওইদিকে ডাকাতে ভর্তি।
এদিকে যাত্রার শুরুতেই এক বিপত্তি এসে হাজির। কুলিরা কেউ এগোতে চায় না। স্থানীয় লোকেরা যুদ্ধের সময় এলাকা ছেড়ে কুলির কাজ করতে যায় না, তাতে নাকি সমাজের বারণ আছে। আমার অবস্থা হল সবচাইতে করুণ। ফিরে যদি যাই সমুদ্র উপকূলে, তবে পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে হয়তো মুখরক্ষা হবে, কিন্তু এই অভিযানের পিছনে সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে এত খরচ হয়ে গেছে, এখন ফিরে যাওয়ার অর্থ নিজের কাছেই নিজে হেরে যাওয়া। এছাড়া আমার উপর মানুষের এত আশা-ভরসা সব জলাঞ্জলি যাবে। ফিরে যাওয়ার চাইতে মরে যাওয়া অনেক বেশি শ্রেয়।
ভেবে ভেবে মাথার চুল পেকে গেল যে, মাত্র তেরো জন লোক নিয়ে এই একশোর বেশি গাঁটরি বয়ে নিয়ে উজিজি পৌঁছব কী করে? আবার লিভিংস্টোনের রসদের বোঝাও আছে। সেই বোঝার দায়িত্বে থাকা লোকগুলো দিব্যি অলস সময় কাটাচ্ছে উনিয়ানেম্বেতে। কিন্তু এই রসদ ডক্টর লিভিংস্টোনের কাছে পৌঁছতে না পারলে তাঁর পক্ষে আফ্রিকার জঙ্গলে টিকে থাকা মুশকিল হয়ে যাবে। কুলি জোগাড় করতে গেলেও তো তাঁর রসদ লাগবে! ইতিমধ্যেই হয়তো রসদ নিঃশেষ হয়ে যেতে তিনি রাস্তা খুঁজছেন নাইল নদের উৎসে যাবার জন্য। কোথাও হয়তো আটকা পড়ে আছেন। এইসব চিন্তায় মাথা খারাপ হবার জোগাড়।
১২ আগস্ট, ১৮৭১।
একটা চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটল। একটা লোক এসে বলল, লেক নয়াসা থেকে টাঙ্গানাইকার দিকে যাবার সময় এক আরব দলপতি সৈয়দ বিন ওমরের কাফিলার সঙ্গে সে যখন সফর করছিল, তখন ডক্টর লিভিংস্টোনের সঙ্গে তার দেখা হয়। সময়টা আনুমানিক সেই সময়, যখন তাঁর মারা যাবার খবর চাউর হয় সারা বিশ্বে।
লোকটার দেওয়া খবর অনুযায়ী, ডক্টর লিভিংস্টোন হেঁটে চলেছিলেন। তাঁর পরনে সাদা পোশাক আর মাথায় সাদা টুপি ছিল। তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁর সমস্ত জামাকাপড় নৌকোডুবি হয়ে ভেসে যায় নদীতে। তাঁর হাতে ব্রিচ রাইফেল ও পকেটে আরও দুটি রিভলভার ছিল। লিভিংস্টোনের সঙ্গে হাতে গোনা কয়েকটি কুলি ছিল। সেই কুলিদের একজন জানায়, ডক্টর লিভিংস্টোনকে তাঁর বেশিরভাগ সহকারী আর কুলি ছেড়ে চলে গেছে মাঝপথে।
ডক্টর লিভিংস্টোনের খবর পেয়ে খুব আনন্দ হল। এরপর এক দুঃসংবাদ অপেক্ষা করে ছিল। একদিন খবর এল, ফারকুহার মারা গিয়েছে। বড়ো দুঃখ পেলাম। ওর পায়ের গোদের কারণেই নাকি সে উসাগরাতেই মারা যায়। শেষকৃত্য পর্যন্ত হয়নি। জোটেনি ওর দেহটা মাটি চাপা দেবার মতো কোনও লোক। একজন স্থানীয় লোক ফারকুহারের উলঙ্গ দেহটাকে টানতে টানতে নিয়ে যায় জঙ্গলে। সেখানেই ফেলে রেখে আসে। শ-কে জিজ্ঞেস করলাম, “আমরা যে তিনজন শ্বেতাঙ্গ এই অন্ধকার দেশে একসঙ্গে এসেছিলাম, তার মধ্যে একজন চলে গেল। এরপর কার পালা?”
শ জবাব দিল না।
হঠাৎ একদিন শ খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল। সে বিছানা নিল। খবর এল, মিরাম্বো নাকি উনিয়ানেম্বের দিকে ধেয়ে আসছে। কিন্তু সৈয়দ বিন সালেম সেই খবর মিথ্যে বলে জানিয়ে আশ্বস্ত করলেন। বিপদ কিন্তু পিছু ছাড়ল না।
টাবোরার দিক থেকে একদিন সকালে বন্দুকের আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল। আমরা তখন পুঁতির মালা তৈরি করছিলাম। তড়িঘড়ি হাতের কাজ ফেলে রেখে ছুটে বাইরে এলাম। একটু দূরে গিয়ে উঁচু একটা ঢিপিতে উঠে দূরবীন দিয়ে দেখি টাবোরাতে বন্দুকের গুলির ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে মুহুর্মুহু।
খোঁজ নেওয়ার জন্য লোক পাঠালাম। সে যত দ্রুত গেল, ততটাই দ্রুত ফিরে এসে খবর দিল, মিরাম্বো প্রায় হাজার দুয়েক লোক নিয়ে টাবোরা আক্রমণ করেছে। উলটোদিক থেকে ওয়াতুতা উপজাতির হাজার খানেক লোক টাবোরায় হানা দিয়েছে। এরা নাকি মিরাম্বোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে ডাকাতি করছে এই অঞ্চলে।
দুপুর নাগাদ কুইহারায় আমাদের ঘরের দিকে দলে দলে টাবোরা থেকে পালিয়ে আসা আরব আশ্রয় নিল। তাদের মুখে দুঃসংবাদ পেলাম, খামিস বিন আবদুল্লা ও আরও কয়েকজন আরব দলপতি মিরাম্বোর সেনার হাতে প্রাণ দিয়েছে।
খামিস একজন সাহসী যোদ্ধা ছিল। মিরাম্বো আক্রমণ করার সঙ্গে সঙ্গে সে পাঁচজন আরব তরুণ আর পঞ্চাশ জন দাস সঙ্গে নিয়ে মিরাম্বোর দিকে এগিয়ে যায়। যেই মিরাম্বোর সেনা তাদের দিকে গুলি ছোড়ে, সবক’টা দাস খামিসকে ছেড়ে পালিয়ে যায়। হঠাৎ খামিস ও তার পাঁচ সাথীকে ঘিরে ফেলে মিরাম্বো। তারপর একে একে গুলি করে তাদের হত্যা করে।
আরবদের হত্যা করার পর ওয়াতুতা উপজাতির লোকেরা ওদের শরীর থেকে চামড়া আর চর্বি কেটে নেয়। প্রথা অনুযায়ী মৃত ব্যক্তিদের শরীরের অংশ ওরা ভাতের সঙ্গে ফুটিয়ে খেয়ে নেয়। ওদের বিশ্বাস, এর ফলে ওদের দেহে আসুরিক শক্তি আসবে, যার ফলে বন্দুকের গুলিও ওদের শরীর ভেদ করতে পারবে না। উপজাতিদের কুসংস্কারের পাল্লায় পড়ে বেচারারা সৎকারটুকুর মর্যাদা পর্যন্ত পেল না
টাবোরার দিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলল। ওরা আরবদের সব বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিল। শয়ে শয়ে লোক আমাদের দিকে কুইহারাতে পালিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে আমি কুইহারার সব বাড়িতে মাটির দেওয়ালে ফুটো করে বন্দুক তাক করে রাখার ব্যবস্থা করলাম। শ’দেড়েক বন্দুক লাগিয়ে দেওয়া হল। চারদিকে কড়া পাহারার ব্যবস্থাও হয়ে গেল। আশেপাশের ঝোপঝাড় কাটিয়ে রাখলাম যাতে শত্রুরা লুকিয়ে আমাদের উপর হামলা না করতে পারে। ঘরের বাইরেও রাইফেল পাতা হল মাটির স্তূপের আড়ালে। ছয়দিনের জন্য খাবার আর পানীয় জল জমিয়ে রাখা হল। মিরাম্বকে মোকাবেলা করার জন্য এবার আমরা তৈরি।
শুনতে পেলাম টাবোরা সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দিয়ে সব মূল্যবান বস্তু, হাতির দাঁত লুট করে নিয়ে গিয়েছে ডাকাতের দল। টাবোরা থেকে আসা আরব উদ্বাস্তুরা নাকি বলাবলি করছিল, তারা বিপদ বুঝলে সব ছেড়ে উপকূলের দিকে পালিয়ে যাবে। যদি সত্যি সত্যি এমন হয়, তবে আর আমার কিছুই করার থাকবে না। সেক্ষেত্রে আমিও সব রসদে নিজেই আগুন লাগিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হব।
বিকেল নাগাদ খবর এল মিরাম্বো টাবোরা থেকে বেশ কয়েক মাইল দূরে কাজিমার দিকে দলবল নিয়ে চলে গেছে। খুব সম্ভব আমাদের সমর সমাবেশের খবর পেয়ে সে আর এদিকে আসতে সাহস করেনি। এই খবরে আরবরা কাজিমা আক্রমণ করবার জন্য প্রস্তুত হতে লাগল। কিন্তু তাদের সংযত করতে বেশি সময় লাগল না।
আবার শান্তি ফিরে এল কুইহারাতে। আরবেরা বসে গেল যুদ্ধের সভায়। এই কাজটাতে এরা যত উৎসাহ দেখায়, লড়াইয়ের মাঠে নেমে তারা ততটাই ঢিলে। কিন্তু মিরাম্বো যে রাস্তা বন্ধ করে বসে ছিল বিগত কয়েকবছর ধরে, সেই রাস্তা এবার পাকাপাকিভাবে বন্ধ হয়ে গেল বলেই মনে হল। আরবরা এত শলাপরামর্শের পর জাঞ্জিবর ফিরে যাওয়া ঠিক করল। আমি উজিজির দিকে রওনা দেব বলে অন্য এক উপজাতি, ওয়াঙ্গওয়ানাদের থেকে কুলি নিলাম প্রায় তিনগুণ মজদুরিতে। দক্ষিণদিক দিয়ে উকাওয়েন্ডি হয়ে উজিজি রওনা দেব বলে কুইহারা ছেড়ে এলাম আরব শেখদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে।
ভেবেছিলাম নাইল নদীতে নৌকো বেয়ে উজিজির পথে রওনা দেব। কিন্তু বিধি বাম। শ জ্বর থেকে উঠেছে ঠিকই, কিন্তু সারাদিন সে বিছানায় শুয়ে থাকছে দুর্বলতার আছিলায়। আমি বেশ বুঝতে পারছি, এই মহাদেশে ওর মন টিকছে না, তাই ভেঙে পড়েছে একেবারে। এদিকে আরবেরা মুখে বড়ো বড়ো কথা বলে, কিন্তু কাজের বেলায় ঠনঠন। দেশি লোকগুলোর গড়িমসি দেখে ভয়ংকর মাথা গরম হয়ে যায়। এদের কোনও কাজের কথা বললেই, ‘কাল হয়ে যাবে’ শোনা যায়। সেই শুভ ‘কাল’টা মাস খানেক পরেও আসতে পারে। কিন্তু আমার হাতে বেশি সময় নেই। ইতিমধ্যে মাস দুয়েক বৃথা সময় নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
শ-কে শুয়ে থাকতে দেখে একদিন ওকে উৎসাহ দেবার জন্য এতদিন যা খুলে বলিনি, সেই কথা বলে দিয়ে ওকে টেনে তুলে পথে নামানোর চেষ্টা করলাম, “আমার প্রিয় তরুণ তুর্কী, এবার উঠে দাঁড়াও। চলো যাত্রা শুরু করি। তোমাকে একটা গোপন কথা বলি। আমি আদৌ এই দেশের ভূগোল নিয়ে মাথাব্যথা করার জন্য প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে আসবার বোকামো করিনি। আমার আসল উদ্দেশ্য হল ডক্টর লিভিংস্টোনকে খুঁজে বার করা। আর সেইজন্যই ন্যাশনাল হেরাল্ডের সম্পাদক মিস্টার বেনেট আমার পিছনে এত টাকা ঢেলেছেন। একবার ভাবো, ডক্টর লিভিংস্টোনকে খুঁজে বার করতে পারলে বেনেট যা টাকা তোমাকে দেবে, সেই টাকায় তুমি আরামে থাকবে বহুবছর। আমার কাছে ওই পঞ্চাশ ডলারের বিল আর তোমাকে জমা করে বসে থাকতে হবে না বিল মেটানোর অপেক্ষায়। ওঠো, গায়ে শক্তি আনো। জ্বর-টর সব ভুলে যাও। এই জ্বরে তুমি মরবে না। আমি ওষুধ দেব। আমার ওষুধের ভাণ্ডার সহজে খালি হবার নয়। যদি অসুস্থ হয়ে পড়ো, আমি নিজে তোমাকে কাঁধে তুলে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাব। এসো তোমাকে একটা এনার্জি ড্রিঙ্ক বানিয়ে দিই।”
আমার বক্তৃতায় শ একটু নড়েচড়ে বসল। তার চোখ দুটো কিছুক্ষণের জন্য উজ্জ্বল হয়ে উঠলেও আবার আগের মতো পাণ্ডুর হয়ে যেতে সময় লাগল না। আমার বানানো ডিম, চিনি, লেবু আর মশলার শক্তিবর্ধক পানিয়ও চাঙ্গা করতে পারল না শ-কে।
থানি বিন আবদুল্লার সঙ্গে তার তাঁবুতে দেখা করতে গেলাম। শুনলাম টাবোরা আক্রমণ করতে গিয়ে মোরাম্বো প্রায় দুশো মানুষ হারিয়েছে। সেই তুলনায় আরবদের ক্ষতি নাকি অনেক কম। যদিও প্রচুর হাতির দাঁত আর অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র লুট হয়ে গিয়েছে, কিন্তু মোরাম্বোর ক্ষতির তুলনায় অনেক বেশি।
আরবেরা আমার উজিজির পথে রওনা দেওয়ার একেবারেই পক্ষপাতী নয়। তারা নানাভাবে আমি ও আমার দলের লোকদের ভয় দেখাতে লাগল। অজানা উজিজির দক্ষিণদিকগামী পথে নাকি ডাকাতি করে রুগা-রুগা উপজাতির লোকেরা। তারা নাকি মোরাম্বোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে জঙ্গলে লুটপাট চালায়। ওয়াসেন্সি প্রদেশে সব উপজাতিরা নাকি একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধরত। আমরা তাদের মধ্যে পড়ে গেলে নির্ঘাত মৃত্যু। থানি ডক্টর লিভিংস্টোনের রসদ পর্যন্ত আমার হাতে ছেড়ে দিতে নারাজ।
আমার অত্যন্ত দক্ষ এক সৈনিক বারুতি, স্মল পক্সে মারা গেল। এই নিয়ে সাতজন আমার দলে মরল আফ্রিকায়। খুব মনখারাপ হয়ে গেল। বারুতি খুব সাহসী ছিল। ক্যাপ্টেন বার্টনের দলেও বহু যুদ্ধের সাথী সে এই আফ্রিকায়। বম্বে এমন মুষড়ে পড়ল যে, আমাকে জাঞ্জিবর ফিরে যেতে বলল বার বার। বারুতিকে কবর দিলাম এক বটগাছের নীচে। কবর খুঁড়ে ওর দেহ পাশ ফিরিয়ে দেওয়া হল এমন করে যাতে ওর মুখ মক্কার দিকে ঘুরে থাকে। ওর দেহ নতুন আমেরিকান কাপড় দিয়ে মুড়ে দেওয়া হল। কবরে মাটি চাপা দিয়ে একটা গাছ পুঁতে দেওয়া হল এর উপরে। জল ঢেলে দেওয়া হল। সাথীরা বলল, এই জল ওকে স্বর্গের যাত্রাপথে তৃষ্ণার্ত হতে দেবে না। আরবি ফতাহ্ পড়ে শোনানো হয়ে যেতে আমরা ফিরে এলাম তাঁবুতে।
উজিজির পথে (২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭০)
পদযাত্রা শুরু হল পঞ্চান্ন জন লোক নিয়ে। শ যেতে নারাজ। তার নাকি জ্বর এসেছে আবার, শরীর দুর্বল। ওকে বললাম, “আরবদের সামনে ন্যাকামো করো না। ঘোড়ায় চড়ে বসো। আমি নিজেও জ্বরে ভুগছি। সাদা চামড়ার মানুষ এত দুর্বলতা দেখায় না।”
যেসব আরবরা আমাদের বিদায় জানাতে এসেছিল, তারাও আমাকে বলল, যখন শ যেতে চাইছে না, আমি ওকে জোর করছি কেন? সেই শুনে আমার রাগ হল এবং আরও জেদ চেপে গেল। জোর করে শ-কে ঘোড়ায় তুলে দিয়ে বাকিদের মার্চ করার অর্ডার দিলাম। শেষ মানুষটা চলে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে আমি নিজে টুপি খুলে আরবদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। সঙ্গে চলল আমার চার রাইফেলধারী বিশ্বস্ত দেহরক্ষী।
আধঘণ্টা চলার পর দৃশ্যপট বদলে যেতে শুরু করল। উদ্ধত পাহাড় শৈলীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সবাই মনেপ্রাণে বেশ তাজা হয়ে উঠল। সবার মুখ থেকে জ্বরের ক্লান্তি উধাও। দেড় ঘণ্টা চলার পর আমরা কিনিয়ামওয়েজি পৌঁছে গেলাম। তাঁবু ফেলা হল। একটা গোটা তাঁবু লাগল আমাদের মালপত্র রাখতে। ডক্টর লিভিংস্টোনের রসদও কিছু কম ছিল না।
মাঝরাতে আমার প্রবল জ্বর এল। সকালে উঠে শুনি দলের সাথীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে যে আমি যেহেতু অসুস্থ, তাই আর এগোনো উচিত নয়। জানতে পারলাম অর্ধেক লোক উনিয়ানেম্বেতে ফিরে গেছে। এমনকি লিভিংস্টোনের ডাকবাহক পর্যন্ত চিঠির বোঝা নিয়ে উধাও। বেজায় রেগে গিয়ে সেলিমকে জনা কুড়ি লোকের সঙ্গে উনিয়ানেম্বেতে পাঠিয়ে দিলেম তাদের ধরে আনবার জন্য। একটা মজবুত দাস শৃঙ্খলও জোগাড় করে আনতে বললাম।
আমার দশজন ডিটেকটিভ রাতের দিকে ফিরে এল নয়জনকে সঙ্গে নিয়ে। সেলিম নিয়ে এল একটা লম্বা দাস শৃঙ্খল, যাতে অন্তত দশজন লোককে গলায় আটকে ধরে রাখা যায়। লিভিংস্টোনের চিঠির বোঝা নিয়ে ভারবাহক কুলিও ফিরে এল। সবাইকে ডেকে জড়ো করে আমার বক্তব্য স্পষ্ট করে বলে দিলাম।—“এই যে দাস শৃঙ্খল সবার সামনে রাখা হয়েছে, এই আফ্রিকা মহাদেশে প্রথম কোনও শ্বেতাঙ্গ এটা ব্যবহার করতে চলেছে। যারা আমার সঙ্গে নির্ভয়ে যাত্রা করবে, তাদের কোনও ভয় নেই। কিন্তু যারা মজদুরি, বন্দুক আর গোলাবারুদ নিয়ে পালানোর চেষ্টা করবে, যারা চুরি করবে, তাদের এই শৃঙ্খল থেকে নিস্তার নেই জেনে রেখো। এখন আমি যারা পালানোর চেষ্টা করেছিল, তাদের কিছু বলছি না, কিন্তু ভবিষ্যতে যদি এমন ঘটনা ঘটে, আমি তক্ষুনি মার্চ থামিয়ে আগে পলাতককে খুঁজে বার করব, তারপর গলায় শৃঙ্খল লাগিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যাব উজিজি। এটা কি সবার মাথায় ঢুকল?”
ভয়ে তারা সমস্বরে জানিয়ে দিল যে তারা খুব বুঝতে পেরেছে, এমন ভুল আর কখনও হবে না।
সকাল সকাল আবার রওনা দিলাম। ঘণ্টা দুয়েক মার্চের পর ইনেসুকা পৌঁছে তাঁবু ফেলা হল। এখানে রাতের বেলা আবার দুজন পালিয়ে গেল। বম্বে আর সেলিম গেল তাদের ধরে আনতে। উনিয়ানেম্বের পথেই ওরা দুটোকে খুঁজে পেয়ে বেঁধে নিয়ে এল। এবার আমি নিজে হাতে ওদের প্রথমে চাবুক মারলাম, তারপর গলায় দাস শৃঙ্খল আটকে দিলাম।
শ আর এগোতে রাজি নয়। আমি বললাম, যদি ফিরে যেতে যাও, তবে নির্ঘাত মৃত্যুকে ডেকে আনবে। তবে ফিরে যেতে চাইলে বাধা দেব না। আসলে অসুখ ওর শরীরে নয়, মনে। বিদায় দেওয়াই শ্রেয় মনে করলাম। চারজন কুলির কাঁধে চেপে শ অদৃশ্য হয়ে গেল আমাদের সামনে থেকে। আর-একজন নিজের দেশের সাথীর সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হলাম এই মহাদেশের জঙ্গলে। আগে জানি না কপালে কী আছে।
(ক্রমশ)