জয়ঢাকের অভিযান লাইব্রেরি- এভারেস্ট-এরিক শিপটন(অনু-বাসব চট্টোপাধ্যায়) অন্নপূর্ণা-মরিস হারজগ(অনু তাপস মৌলিক) কন-টিকি অভিযান- থর হেয়ারডাল (অনু-শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়)
আগের পর্বগুলো– পর্ব–১, পর্ব ২, পর্ব ৩, পর্ব ৪, পর্ব ৫
(জো টাসকার-এর লেখা সহ)
দুজন অভিযাত্রী। হিমালয়ের একটি শৃঙ্গের দুরূহতম ঢাল। সকলেই ভেবেছিল, এমনকি বিখ্যাত পর্বতারোহীরাও, এ অসম্ভব। এ তো আত্মহত্যার নামান্তর। মাত্র দুজন, তাও হিমালয়ের গহন প্রান্তরে, শৃঙ্গ অভিযান? সঙ্গে আর কেউ নেই? যাহ অবিশ্বাস্য! সেকারণেই ১৯৭৬ সালের চ্যাঙাব্যাঙ আরোহণ এক যুগান্তকারী ঘটনা। দুই দক্ষ পর্বতারোহী পিটার বোর্ডম্যান এবং জো টাসকার চ্যাঙাব্যাঙ-এর পশ্চিম ঢাল বরাবর আরোহণের অতুলনীয় কীর্তি স্থাপন করলেন। ২২ আগস্ট ব্রিটেন থেকে রওনা হয়ে ১৫ অক্টোবর পশ্চিম গাড়োয়ালের চ্যাঙাব্যাঙ শৃঙ্গ আরোহণ সেরে ১ নভেম্বর দুজন অভিযাত্রী দেশে ফিরে যান। পরবর্তীকালে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৮২ সালে এভারেস্টের উত্তর পূর্ব গিরিশিরা বরাবর আরোহণ অভিযানের শেষ পর্বে চূড়ায় ওঠার ঠিক আগে দুজনেই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে চিরকালের মতো হারিয়ে যান। ব্রিটিশ তথা পৃথিবীর সর্বকালের সেরা পর্বতারোহীদের মধ্যে এই দুই পর্বতারোহীর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।
৬
সারভাইভাল
২৮ সেপ্টেম্বর – ২ অক্টোবর
“বরং জামাকাপড়গুলো ধুয়ে নিয়ে পরিষ্কার প্যান্ট পরে নিই সামিটের জন্য ” জো বলল, “বলা যায় না কখন কী ঘটে।”
“হতে পারে বাসের ধাক্কাও খেতে পারো।” আমি বলি।
অ্যাডভান্স বেস ক্যাম্প অবধি হাঁটার যোগাড়যন্ত্র চলছিল, কিন্তু সেকাজটা যথারীতি, এটা সেটা, গড়িমসি করতে করতে বেলা গড়িয়ে তিনটে বেজে গেল, তবে বেসক্যাম্প ছাড়ার চাড় পেলাম।
আজকে কী বার যেন? ওহো, মঙ্গল – মঙ্গলবার, ২৮ সেপ্টেম্বর। তাঁর মানে বেসক্যাম্পে পৌঁছোনোর পর তিন সপ্তাহ কেটেছে আর হান্স ফিরে যাবার পর উনিশ দিন। বেরোনোর আগে আমি আমার মিটিং-এর ডায়েরিটা খুলি। ব্রিটেনে যে মিটিংগুলোয় থাকতে পারিনি সবকটা কমিটি-মিটিং-এর তালিকায় চোখ বোলাই, আর তারপর সেগুলোর সঙ্গে পাহাড়ের এই কদিনের ঘটনার যোগসূত্র তৈরি করি। ভাবি, আমাদের ক্লাইম্বটা নিয়ে যে অত্যধিক ঘোরের মধ্যে আছি সেটা কিছুটা হলেও একটা বাস্তব কাঠামোর মধ্যে বাঁধা যাবে। এটা অনেকটা পুরোনো খবরের কাগজ পড়ার মতো ব্যাপার।
গ্রাবরেখার উপত্যকা অঞ্চলটার মুখে যখন পৌঁছোলাম বরফ পড়া চালু হয়ে গেল, আর তেমনি ঠান্ডা বাতাস বইতে লাগল ঋষি গঙ্গার গিরিখাতের দিক থেকে। গ্রাবরেখার ওপরে উঁচিয়ে থাকা একটা কুড়ি ফুট উঁচু বিরাট বোল্ডারের আড়ালে আশ্রয় নেওয়া গেল। জো বলেছিল, ওর মতে বেস ক্যাম্পে ফিরে যাওয়াই ঠিক হবে কেননা আবহাওয়াটা এখনও স্থিতিশীল নয় আর চ্যাঙাব্যাঙে আগের চেয়ে অনেক বেশি বরফ থাকবে। আমি বলেছিলাম, এটা একটা বিচ্ছিন্ন বরফপাত, জো খামোখা এটায় প্রভাবিত হয়ে পড়ছে, আর আমরা বিকেলের দিকে এমনটা ঢের দেখেছি তাতে চ্যাঙাব্যাঙের ইতরবিশেষ হয়নি, হলেও নতুন পড়া বরফ তাড়াতাড়িই ঝেড়ে ফেলেছে সে। সুযোগ পেলেই যদি পেছনে ফিরতে থাকি তাহলে আমরা ওপরে ওঠার ঝোঁক আর গতি কোনোটাই রাখতে পারব না ফলে চড়াটা আর হবে না। আমি যুক্তিসঙ্গতভাবে তর্কটা করতে চাইছিলাম, কিন্তু অপরাধীও লাগছিল দুটো দিন নষ্ট করে ফেলার জন্য আর একই সঙ্গে ব্যাখ্যাতীত একটা টান অনুভব করছিলাম, ভাবছিলাম পাহাড়ের ওপরে ফিরে যাই, দেখি অবস্থাটা আমাদের নীচে ফিরে আসতে ফের বাধ্য করে কিনা। খুব কঠিন একটা অবস্থা, যদিও মুখচোখ ঠিকঠাক, শান্ত, স্থির, কেননা এই প্রথম আমাদের কৌশলগত মতের অমিল হল। আমাদের দুজনের কারোরই জানা ছিল না আমরা খুব ভেবেচিন্তে তুল্যমূল্য বিচার করে তর্কটা করছি নাকি অযৌক্তিক আবেগ থেকে বলছি। নৈতিকভাবে আমি একটু ভালো অবস্থানে কেননা আমি তর্ক করছিলাম ইতিবাচক পদক্ষেপের জন্য। যদিও আমি জো-কে যথেষ্ট ভালোভাবে জানি, ওর সিদ্ধান্তের ওপর পূর্ণ শ্রদ্ধাও আছে। একঝলক মনে হল জো-র উৎসাহে কি ভাটা পড়ল! ভাবনাটা তক্ষুনি চেপে গেলাম জো-কে জানি বলেই। উলটে, আমিই হয়তো, সহজে কাজ সারতে চাইছি! শেষ অবধি ঠিক হল অ্যাডভান্স বেস ক্যাম্প অবধি যাব তারপর সেখানে বসে অবস্থার পর্যালোচনা করা যাবে। সিদ্ধান্তটা নিয়ে নেবার পর সেটা নিয়ে আর কেউ উচ্চবাচ্য করলাম না।
হিমবাহে পা পড়তেই ধীরে ধীরে অন্ধকার আমাদের ঢেকে ফেলল, নীচে নেমে আসার সময় পাথরের নীচে যেসব পোশাক-আশাক ছেড়ে গিয়েছিলাম সেগুলোর খোঁজ করছিলাম আমরা। পাথরটার ওপরে কেয়ার্ন করে রেখেছিলাম কিন্তু সেটা পাশাপাশি সমান্তরাল তিনটে গ্রাবরেখার কোনটার ওপরে তা ভুলে গেছি। একঘণ্টা ওপর নীচ করে চাঁদের আলোয় অবশেষে ওগুলো খুঁজে পাওয়া গেল। জব্বর ঠান্ডা ছিল।
“শালা ‘গোরু খোঁজা’ খোঁজ হল,” জো বলেছিল, “মনে হচ্ছিল পাহাড়ে রেসকিউ কোর্সে ট্রেনিং নিতে এসেছি।”
“নাইট রানার্স অব বেঙ্গল” বইয়ের গল্পটা মনের মধ্যে ঘুরঘুর করছিল। এদিক দিয়ে সোজাই তো ফিরব এই ভেবে ওটা অ্যাডভান্স বেস ক্যাম্পে ছেড়ে এসেছিলাম। ফিরে পৌঁছোনোর পরেই ওটা তুলে পড়তে শুরু করলাম। ওটাকে আবার ক্যাম্প ওয়ানে নিয়ে যেতে চাইছিলাম না, পাছে পড়া শেষ করতে না পারি। আমাদের চড়ার ওই রুটটা যথেষ্ট দুরূহ, মনে মনে ভাবি, হয়তো আমি আর এটাকে দেখতেই পাব না, কেননা চড়া শেষ করার পর পাহাড়ের অন্য পাশ দিয়ে নেমে এসে আবার এই ভাঙাচোরা ঢাল ধরে উঠে গিয়ে ক্লাইম্বিং গিয়ার ফেরত নিয়ে আসার সম্ভাবনা দূর অস্ত। টর্চের ব্যাটারি নষ্ট হচ্ছিল দেখে জো বিরক্ত হচ্ছিল, কারণ ও যখন রাতের খাবার তৈরি করছিল আমি বইটার শেষ কয়েকটা পাতা পড়ে নিচ্ছিলাম, শেষ অবধি কী হল জানার জন্য। ব্যাটারি যদি ফুরিয়ে আসত, আমি
ভয়ানক চিন্তায় পড়ে যেতাম। বইটাতে এতই ঢুকে গিয়েছিলাম, যে এমনটা হলে সেটা হত একটা ছোটো ছেলের মিঠাইয়ের ব্যাগ হারিয়ে ফেলার মতো। চ্যাঙাব্যাঙ আমায় ‘পলায়নী মনোবৃত্তি’র দিকে ঠেলে দিচ্ছিল।
ধার-এর ওপরের ক্যাম্প অবধি পাহাড়ের ঢালের ওপরের আইসফিল্ড ছোটো হয়ে আসছিল। ফলে বিরাট অংশের পাথরের দেয়াল আর ভাঙাচোরা পাথরের স্তূপ বেরিয়ে এসেছিল। যেখানে যেখানে বরফ পাথরকে ঢেকে রয়েছে সেখানকার বরফ খুবই পাতলা আর ভঙ্গুর। চড়াটা বেশ পরিশ্রমের, নিরাপদ মনে হবে এমন পথ দেখে ঠিক করা এবং উত্তরোত্তর ভয়ানক হয়ে ওঠা এই রাস্তায় চড়া। ধারের ওপর পৌঁছে সেই বরাবর ক্যাম্প ওয়ানে পৌঁছোনোটা বরাবরের তুলনায় বেশি স্বস্তির হয়েছিল।
ধারের ওপরের ক্যাম্পে বেশ আগে আগেই পৌঁছোনো গেল; সমস্ত যন্ত্রপাতি, চড়ার সরঞ্জাম গোছানো শুরু করলাম, লম্বা গোছগাছ। খাবার দাবার, আমরা ঠিক করেছিলাম, ছদিনের জন্য নেব। একবার হ্যামকে বিভক করা শুরু করলে আমাদের ব্যবস্থাপনা নিখুঁত হতে হত। বিভিন্ন রকমের খাবার আমরা আলাদা আলাদা এক একটা থলেতে পুরে নিলাম তারপর ওপরে মোটা মার্কার দিয়ে লিখলাম ‘ব্রেকফাস্ট’, ‘সাপার’, ‘ব্রিউ’ ‘ডে-ফুড’। এরকম একটা থলেতে বড়ো করে যোগ চিহ্ন এঁকে দিলাম তারপর অনেক আলোচনাটনা করে চড়ার জন্য দরকারি প্রাথমিক চিকিৎসার সব জিনিস ভরে নিলাম, তাতে তুষারক্ষতের জন্য রনিকল, ডালমেন স্লিপিং পিল, স্নায়ু শান্ত রাখার জন্য ভ্যালিয়াম আর কিছু অমনিপোন অ্যাম্পুল রেখে দিলাম ব্যথা প্রশমনের জন্য, যদি সেরকম বিপর্যয় ঘটে!
সমস্ত খাবার দাবার, দুজনের জন্য দুটো করে স্লিপিং ব্যাগ, হ্যামকগুলো, জ্বালানি আর অবশিষ্ট চড়ার সরঞ্জাম গুছিয়ে নিয়ে আমাদের স্যাকগুলো মাটি থেকে প্রায় বুক উচ্চতা অবধি দাঁড়াল। একেকটার ওজন ষাট পাউন্ড মতো হল।
শেষমেষ আমরা যখন বেরোলাম তখন ভালোমতো বিকেল হয়ে গেছে। হাওয়া চলছিল কিন্তু বরফ পড়ছিল না। ভালোমানুষের মতো আমরা একে অন্যেকে উৎসাহ দিচ্ছিলাম, প্রচুর আশার কথা শোনাচ্ছিলাম এই ভেবে যে নীচ থেকে দড়ি-দড়া টেনে তোলার কাজটা ধরেও ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে ফিক্স রোপের মাথায় পৌঁছে যেতে পারব আমরা।
জো প্রথমে বেরোল, ওর পেছনে আমি। শিগগিরই এটা বোঝা গেল যে স্যাকগুলো বড্ডো ভারী আর আমাদের যথেষ্ট বিশ্রাম নেওয়া হয়নি। নীচ থেকে তিনটে দড়ি তুলে গুটিয়ে কয়েল করে, আর আরো একখানা নীচ থেকে ওপরে টেনে তুলে আমি যারপরনাই ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। আমার গন্ধমাদন স্যাকটা নিয়ে আর কাঁধের ওপর দড়িদড়া ফেলে জুমার ঠেলা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ল। একখানা পেগ-এর ওপর দিয়ে জুমারটা দড়িতে আটকাচ্ছিলাম এমন সময় একটা ঝাঁকুনিতে পেছনদিকে কাত হয়ে ছিটকে গেলাম। দড়িটা ধরে টাল সামলালাম। আমার রুকস্যাকের একটা কাঁধের স্ট্র্যাপের সেলাই ছিঁড়ে স্যাকটা পালটি খেয়ে গেছে, এখন ওটা আমার একটা কাঁধ আর কোমরের বাঁধাটা থেকে ঝুলছে। অনেকক্ষণ বেয়াক্কেলে সময় গেল ওটাকে ঠিকঠাক কাজ চালানোর মতো আটকে নিতে। ততক্ষণে বরফ পড়া শুরু হয়ে গেছে, বাতাসের চাবুক চলছে। আমার ওপরে, ধারের ক্যাম্প থেকে পাঁচটা দড়ির সমান উচ্চতায়, জো বাতাসে কোলকুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে, আমার অপেক্ষায়।
আমি এরকমটা আগেও করেছি, আল্পসে, হিন্দুকুশ পর্বতে – গোঁয়ারের মতো নিজেকে এমন পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়ে নিজেই নিজেকে লক্ষ করেছি কীভাবে তা থেকে বের হয়ে আসছি, কীভাবে লড়াইটা চালাচ্ছি। একটু থামলাম, ভারী বোঝাটা নিয়ে হাঁফাচ্ছিলাম, জো-র দিকে তাকিয়ে ভাবি, ও কী ভাবছে, ওকে প্রেরণাটা জোগাচ্ছে কে? খুব সম্ভবত আমি একটু বেশিবেশি নাটুকেপনা করে ফেলছি, বড্ডো বেশি ব্যক্তিকেন্দ্রিক, আর জো হয়তো শান্ত, বাস্তববাদী এবং লক্ষ্যনির্ভর রয়েছে।
আমরা দুজনেই ওপরে যাবার কথা ভাবছিলাম; মাত্র পাঁচটা পিচ চড়ার পর রাতের মতো ফিরে আসাটা হয়তো সেই সময়ের নিরিখে শারীরিকভাবে অনেক সহজ কাজ হত। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত নেওয়াটা একেবারেই অসম্ভব হত কেননা তখনও আমরা আমাদের যাকিছু আছে তার সর্বস্ব লুটিয়ে দিইনি পাহাড়টাকে।
আর কীভাবে শিখব আমরা?
“রাতের মতো এখানেও থাকতে পারি আমরা,” জো বলে, “অন্ধকার হবার আগে কিছুতেই ব্যালকনিতে পৌঁছোতে পারব না।”
“হ্যামকে চড়ার আগে কিছু খাবারদাবার খেয়ে নিলে ভালো হয়।” আমি বলি, “আর হ্যাঁ, স্টোভটা তোমার কাছে।”
আমি নিশ্চিতভাবে জানতাম শীতকালের অ্যালপাইন আর হিমালয় পর্বতে বিভক করার বিষয়ে জো-র মতো দক্ষ লোক ঠিকই একটা খাবারের এবং আরামের রাত কাটানোর ব্যবস্থা করে ফেলবে। আমি স্লিং-এর ওপরে বসে ছিলাম; জো একটা পাথরের খোঁচার ওপরে দাঁড়িয়েছিল। শান্তভাবে এবং পরপর নিয়ম মেনে ও স্টোভ, প্যান এবং ব্রিউয়ের সরঞ্জামগুলো বার করে আনল, এবং প্রত্যেকটা বাইরে বের করেই দড়িতে আটকে নিচ্ছিল। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম, জো ওর হাফ লিটারের নীল রঙের পলিথিন মগটা হারনেসে আটকাল। নীল হারনেস, নীল পোশাক, নীল মগ – সবকটা একরকম রঙের! আমি আমার মগটা বার করে একই কাজ করলাম। মগগুলো অদ্ভুতরকম লাগছিল, বেমানানভাবে আমাদের বরফে জমে যাওয়া দাড়ির নীচটায় ঝুলছিল, হাওয়ায় উড়ে আসা বরফকুচি লেগে ছিটকে যাচ্ছিল মাঝে মাঝে। করুণ প্রতীক্ষায় রয়েছে যেন ওগুলো, যেন লাইনে দাঁড়ানো অলিভার টুইস্ট। জো বরফ খুঁড়ে একটা তাক মতো বানিয়ে স্টোভটা বসালো তার ওপরে। গ্যাস জ্বলতেই চাইছিল না, ফরর ফরর করছিল। হাওয়া আড়াল করে আগুনটাকে বাঁচিয়ে, স্টোভের ওপর প্যানটা ঠিকমতো রেখে বরফ গলিয়ে জল বানাতে জো-কে রীতিমতো লড়াই করতে হচ্ছিল। আমি দেখলাম ওর ওপরের দস্তানাটা পুড়ে একটা ফুটো হয়ে গেছে, কিন্তু ও সেনিয়ে কিছুই বলল না। “তোমার যদি কোনো কাজ করার থাকে, স্রেফ কাজটায় মন দাও আর করে ফেল।” মনে পড়ল, কিছুদিন আগেই ও বলেছিল একবার। দুঘণ্টা বাদে ও ঈষদুষ্ণ দু-মগ স্যুপ তৈরি করল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমরা গিলে নিলাম সেটা। হাওয়া আর ঠান্ডা কোনোটাই বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারা যাবে না ভেবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল রাতে মধু চিনি আর বাদাম দিয়ে বানানো মার্জিপান এবং চকোলেট খেয়ে থাকা হবে। আর যত তাড়াতাড়ি পারা যায় হ্যামকে ঢুকে পড়তে হবে। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিল আর স্যালফোর্ডের হিমঘরে আমাদের মহড়াটা একেবারেই হিসেবের বাইরে বলে মনে হচ্ছিল।
“আমি ফিক্স রোপ থেকে ঝুলিয়ে নেব, ওপরটায় থাকব, ফার্স্ট ফ্লোর।” জো বলল।
“শালা, ঘাড়তেরা,” আমি মনে মনে ভাবি, “সারা রাত আট মিলিমিটার টেরিলিন দড়িতে ঝুলবে। ওপর থেকে একটা পাথর পড়ে দড়িটা কেটে গেলে কী হবে? দ্বিতীয় কোনো সুরক্ষা অবধি নেই।”
নীচের পাথরের খোঁচটা বরং ঝুলে থাকার জন্য ভালো বিকল্প বলে আমার মনে হল, যদিও মোটেও গ্রাউন্ড ফ্লোরের মতো মনে হচ্ছিল না। আমার ভূমিকাটা অবশ্য এই দুর্ভাবনাগুলো জো-কে জানানো নয় – সম্ভবত আমার এইসব ফুসফুসে ভাবনাগুলো জো-র মনে আসতে সাহসই পাবে না! আমার হ্যামকটা আর তার ওপরের ঢাকনাটা আটকানোর জন্য কুস্তাকুস্তি শুরু করতেই আমি আবার নিজে নিজেই বাস্তবে ফেরৎ চলে এলাম। জো আমার ঠিক চার ফুট ওপরে, একলা একলা একইরকম কিন্তু নিজস্ব যুদ্ধটা চালাচ্ছিল:
“চারদিকে সর্বত্র বরফ। এটাই বাস্তব – কোনো সহজ বেরোনোর রাস্তা নেই, যেমনটা ছিল কোল্ড স্টোরের দরজা পেরিয়ে একটু গরম চা, নিরাপত্তারক্ষীর সঙ্গে গপ্পগাছা আর গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরে একটা ঠিকঠাক ঘুম… ঠান্ডার চোটে ভুল করে দেখি ক্র্যাম্পন পরেই হ্যামকে শুয়ে পড়েছি; হ্যামকের কাপড়টা ছিঁড়ে দিচ্ছিল ওটা। হাওয়া আটকানোর জন্যে হ্যামকের নীচে একটা আলাদা আচ্ছাদন স্ট্র্যাপ দিয়ে আটকানো থাকা খুবই জরুরি – আমার একটা স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গেল।”
সর্বত্র হ্যামকের একটা না একটা অংশ, দড়ি এবং স্লিং। ভেতরে ঢুকতে অনেকটা সময় লাগল। নড়াচড়া করতেই হাঁফ ধরে যাচ্ছে, এতটা উচ্চতায় বাতাসের জন্য খাবি খেতে হচ্ছে আমায়, আর মাথার ঢাকনাটা টেনে দেবার পর তত বাতাসও নেই এখানে। আমার কাছে মাত্র দুটো ক্যারাবিনার – সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল যে নিজেকে আটকাবো নাকি জিনিসপত্র? নিজের জুতো খোলাটা এক্কেবারে দড়াবাজিকরের মতো। চিত হয়ে শুয়ে মাথার ওপরের ঢাকনার ছাদের দিকে পা-টাকে সোজা উঁচু করে তুলে ধরতে হচ্ছিল। এইসব করতে যে ধস্তাধস্তি হচ্ছিল, তাতে একটা কথা মনে আসতেই ভেতরটা কেঁপে উঠল, সেলাইটা যদি ছিঁড়ে যায় আমি ছিটকে বেরিয়ে দু-হাজার ফুট তলায় গিয়ে পড়ব। আমার জীবনটা ওল্ডহ্যামের সেলাই-দিদিমনির সুতো থেকে ঝুলে ছিল। জুতোগুলোর ফিতে একটা স্লিং বেঁধে ছাতে ঝুলিয়ে দিতেই, আমার দুর্ভাবনা শুরু হল যে একটা ফিতে হয়তো ছিঁড়ে যাবে। জুতো ছাড়া আমি অসহায় হয়ে পড়ব, মোজা পরে নিশ্চই অ্যাডভেঞ্চার চালু রাখা যাবে না!
পরের সমস্যাটা ছিল ডুভেট আর দুটো স্লিপিং ব্যাগ খুলে তাঁর মধ্যে সেঁধোনো। টেরিলিন স্লিপিং ব্যাগটা বার করতে গিয়ে ওটা যে থলের মধ্যে পোরা ছিল সেটা আমার হাত ফসকে হ্যামকের বাইরে গিয়ে পড়ল। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, উৎকণ্ঠায় পাগল হবার যোগাড়। আমার গলা এত জোরে হয়েছিল যে, বাতাসের গর্জন ছাপিয়ে জো-র কানেও পৌঁছেছিল।
“কী হল?” ও চেঁচায়।
আমি উত্তর দিলাম, “ওহ, স্লিপিং ব্যাগ রাখার থলেটা হাত ফসকে ফেলে দিয়েছি,”, নিজেকে অভিসম্পাত দিচ্ছিলাম একেবারে আদর্শ অতিনাটকীয় প্রতিক্রিয়াটার জন্য।
বহুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে, দেহটা মুচড়ে, নড়ে চড়ে স্লিপিং ব্যাগটা পায়ের দিক থেকে টেনে কাঁধের উপর তুললাম; দেড় ঘণ্টা লাগল থিতু হতে। মনটাকে অন্য দিকে নিতে একটু চকোলেট ভেঙে নিলাম মুখে। আমরা সবচেয়ে উঁচু যে জায়গায় পৌঁছেছিলাম, দুর্ভাগ্য আমাদের, বড়ো স্পেসার চকোলেট বারগুলো সেখানেই তুলে নিয়ে রেখে এসেছিলাম। হ্যামকের দেয়ালগুলো তফাতে রাখার কোনো ব্যাবস্থা না থাকায় ওরা আমাদের দুপাশ থেকে চেপে রেখেছিল, দম নিতে বা নড়াচড়ায় অসুবিধে হচ্ছিল। আমি একটা ঘুমের বড়ি খেয়ে নিলাম, তাতে সুবিধে হল অন্ধকারের মধ্যে পরের বারো ঘণ্টা ঘুম আর আধো জাগার মধ্যে দোলাচল চলতে লাগল। প্রত্যেকবার ঘুম ভাঙতেই চমকে উঠছিলাম ভেবে যে কোথায় আছি। এরকমই একবার বেশি অক্সিজেনওয়ালা বাতাস নেবার জন্য মাথাটা ওপরের ঢাকনা থেকে বাইরে বার করেছিলাম। সারামুখ ভরিয়ে বরফের কুচি এসে অভ্যর্থনা করল। আমার দশ ফুট ওপরে দেখতে পাচ্ছিলাম জো-র কালো সসেজের মতো আকৃতিটা ঝুলে আছে আর তার ওপরে চ্যাঙাব্যাঙের অন্ধকার দেয়াল এবং সামিট-রিজের সীমারেখা। এই পাহাড়ে পরিপ্রেক্ষিতের সমস্যাটা ছিল না – ওটা স্রেফ আমাদের মাথার ওপরে খাড়া দাঁড়িয়ে ছিল। ধার ছাড়িয়ে আরো দূরে মেঘ ভেসে ভেসে এসে চাঁদকে ঢেকে দিচ্ছিল, চাঁদের আলো থেকে আড়াল করে দিচ্ছিল আমায়। মেঘের ফাঁকে ফাঁকে আমি একটা দুটো তারা দেখতে পাচ্ছিলাম মাঝে মধ্যে। “তুমি যদি একটা তারাও দেখতে পাও, বেরিয়ে পড়ো।” এমনটাই বলা হয়ে থাকে। আমি হ্যামকের মধ্যে গুটিয়ে ঢুকে আসি, একটু গরম হবার চেষ্টায়। নিজের মনের ভেতরেই একটা হালকা ভাবনা খেলা করে যাচ্ছিল যে খুব হেক্কড় হয়েছি যা হোক, এবং হঠাৎই উপলব্ধি হল, কার্যকারণ যাইই থাক, আমিই আসলে চালকের আসনে।
আপনা থেকেই ভোর হল:
“রাতটা যেন শেষই হচ্ছিল না, অস্বস্তিকর আর ঠান্ডা; বেরিয়ে পড়ার অথবা একটু উষ্ণতা পাবার সময়টা যেন কত দেরি! যাহোক কোনো পরিবর্তন চাইছিলাম, আমাদের যা অবস্থা, তার চেয়ে খারাপ কিছু হতে পারত না।
“আমাদের হ্যামক আর তার ঢাকনার ফাঁক দিয়ে বরফকুচি অনবরত ঢুকে আসছে, আমার পা-টা বেরিয়ে ছিল, তাতেই জমে অসাড়; খুবই অস্বস্তির মধ্যে ছিলাম। কিন্তু প্রায় যেকোনো পরিস্থিতিতেই মানিয়ে নিতে পারা সম্ভব।
“সকালটা, যেন অন্ধকার থেকে আলতো করে সরে হালকা ধূসর একটা রঙের মধ্যে আসা, তারপরই আলো। নড়ার কোনো উৎসাহই পাচ্ছি না। লম্বা রাত্রিটা কেটেছে তাতেই হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি। কিন্তু বাইরেটা একেবারেই আকর্ষনীয় কিছু ছিল না।”
বাতাসের প্রবল ঝাপটা থেকে রেহাই নেই এতটুকু, অসংখ্য বরফের কুচি নিয়ে খেলছে বাতাস – দেয়াল বরাবর ওপরে নীচে যথেচ্ছ লোফালুফি চলছে। তুষারপাত থেমেছে ঠিকই কিন্তু মনে হচ্ছে যেন এখনও পড়ছে। মেঘ যদি সরেও যায়, আমাদের ওপর রোদ পড়তে পড়তে সকাল সাড়ে এগারোটা। গাড়োয়াল জুড়ে আশঙ্কার কালো মেঘ। আমি ভাবছিলাম জো বেরোবে কিনা। আমি মনে মনে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম, আবার একইসঙ্গে ভাবনাও হচ্ছিল, কেননা কালকের গতিতে এগোলে আমাদের সামনে বিপুল একটা পরিশ্রমের দিন রয়েছে।
“অ্যাই জো!” বাতাস ছাপিয়ে জোরে চেঁচাই, “উঠে পড়ব নাকি?”
কোনো উত্তর নেই। আমি আবার গলা চড়িয়ে ডাকি – আরো জোরে।
“কী?”
“উঠে পড়ব?”
“হ্যাঁ।”
যখন ও চেচাঁল, অদ্ভুত শোনাল ওর গলাটা। কদাচিৎ ওর এমন গলা শুনেছি। জো চেঁচিয়ে কিছু বলছে, একথা আমি কল্পনাও করতে পারি না, এক যদি না যোগাযোগের অসুবিধের জন্য বাধ্য হয়।
আমি কল্পনা করেছিলাম, জো বিভকে অভ্যস্ত বলে, চটপট তৈরি হয়ে নেবে। আমার বিভক করার সামর্থ্য নিয়ে ওর খুব একটা শ্রদ্ধাভক্তি ছিল না। আমি সবসময়েই আমার এলোমেলো স্বভাবের জন্য ওর টিটকিরির জবাবে বলতাম ওর বিভকে পারদর্শী হবার একটাই কারণ – ও এত ধীরে ধীরে চড়ে যে ওকে পাহাড়ে অনেক বেশিবেশি রাত্রি কাটাতে হয়। ওইদিন সকালে, ঠিক করলাম, দ্রুত তৈরিও হব আর ব্যাগও গুছিয়ে নেব।
স্লিপিং ব্যাগ থেকে বেরিয়ে হ্যামকের মধ্যে মাথার ওপর নানান লুপে ঝুলতে থাকা গাদাগুচ্ছের সরঞ্জামের মধ্য থেকে জুতোজোড়া উদ্ধার করে পা গলিয়ে নিলাম। ডুভেট জ্যাকেটটাও রইল, এত ঠান্ডা। ঠিক করলাম বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে তারপর স্লিপিং ব্যাগগুলো গুছিয়ে নেব আর জুতোর ফিতেগুলো শক্ত করে বেঁধে নেব। আস্তে আস্তে হ্যামকের কিনারায় গিয়ে পা নামিয়ে আগের দিনের ঝুলিয়ে রাখা স্লিং-গুলোয় পা ঢুকিয়ে দিলাম।
বাতাস ঘণ্টায় পঞ্চাশ মাইল বেগে আছড়ে পড়ছিল। বাইরের মিটেনটা খুলে, হাতে ভেতরের গ্লাভস এবং আলাদা আলাদা আঙুল-হীন আরেকটা মিটেন পরা অবস্থায় দ্রুত স্লিপিং ব্যাগটা গুঁজে নিয়ে হ্যামকটাকেও গুটিয়ে ঠেসে স্যাকের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলাম। তারপর ভেতরের আর বাইরের দু-প্রস্থ জুতোর ফিতে বাঁধতে শুরু করলাম। গোটাটা শেষ করতে করতে পাঁচ মিনিট কেটেছে, ততক্ষণ হাতের একেবারে বাইরের মিটেনটা খোলা ছিল। খেয়াল করলাম – আমার কয়েকটা আঙুলের ডগা শক্ত হয়ে গেছে আর সাড় পাচ্ছি না কোনো। নিজেকে অভিসম্পাত দিই – সাধারণত আমি এর চেয়ে একটু বেশিই সাবধান থাকি। হাতের আঙুলে মুখের গরম ভাপ দিই, কিন্তু কিছু লাভ হয় না। তারপর ওপরের পোশাক আর জ্যাকেটের চেনটা খুলে হাতটা বুকের কাছে নিয়ে আঙুলগুলোকে বগলের নীচে চেপে ধরি। ধীরে ধীরে একটু একটু রক্ত চলাচল শুরু হল, কিন্তু জানতাম কিছু না কিছু ক্ষতি এর মধ্যে হয়ে গেছে। এভারেস্টের দক্ষিণ শৃঙ্গটিতে আমার আঙুলের সঙ্গে একইরকম ঘটনা ঘটিয়েছিলাম, সেবারে অক্সিজেনের সরঞ্জামের কিছু একটা মেরামতের দরকার ছিল। কিন্তু ওখানে বাতাস প্রায় ঘণ্টা দেড়েক সময় নিয়েছিল আমায় জখম করতে; এবারে ব্যাপারটা ঘটল বিধ্বংসী গতিতে।
আমার ওপরে জো-র লাল হ্যামকের মধ্যে প্রবল একটা ঠেলাঠেলি চলছিল, হ্যামকটা ফুলে ফুলে উঠছিল। আমার ‘উইনি ও পু’-এর গপ্পটা মনে পড়ছিল যেখানে উলের ঘর ভেঙে পড়ায় কার্পেটের তলায় চাপা পড়া শূকরছানারা দিকভ্রষ্ট হয়ে এলোমেলোভাবে ধস্তাধস্তি করছিল। একঘণ্টা পর জো বেরোল। পুরো তৈরি এবং স্যাক গুছোনো, কেবল হ্যামকটা ছাড়া এবং ওকে দেখে বিচ্ছিরিরকম উষ্ণ লাগছিল।
“আমার ফ্রস্টনিপ হয়েছে,” আমি ঘোষণা করি।
“সেটা আবার কী?”
“এটা, ইয়ে, ওই যেটা ডিক-এর হয়েছিল, – যদিও অতটা খারাপ নয় আশাকরি। ভেবো না। এটা আমায় থামাতে পারবে না।”
বিভক করা ব্যাপারটায় জো জিতে চলেছিল।
আমি আমার আঙুল নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়েছিলাম, জো-ও ভাবনায় ছিল:
“হতেই পারত যে অভিযানটা এখানেই শেষ হয়ে গেল। দেখে যা মনে হচ্ছে এই পাহাড়ে চড়ার সবচেয়ে কঠিন অংশের অর্ধেকটা এখনও বাকি এবং পরবর্তী কয়েকটা দিনে পিটের আঙুলের আরো বেশি ক্ষতি হয়ে যেতে পারে… কিন্তু ওর সংকল্প থেকে পরিস্কার টের পাওয়া যায় যে তুচ্ছ, অপ্রাসঙ্গিক বিরোধ কিংবা বৈরিতা থাকলেও আমরা আমাদের লক্ষ্য থেকে নজর সরাইনি এবং সেটা হল আমরা এসেইছি পাহাড়টা চড়তে।”
ব্রেকফাস্ট তৈরির চেষ্টাটা বিফলে গেল, আর ওটার আশাও ত্যাগ করা হল। স্টোভটাই জ্বালাতে পারলাম না আমরা। বিকেলে ঠিকঠাক আশ্রয়ে বেশ উষ্ণতা পাওয়া যাবে এই আশায় আমরা এগোনো শুরু করলাম। দুজনেই জানতাম এই উচ্চতায় খাবার এবং পানীয় ছাড়া দীর্ঘক্ষণ চড়লে কীরকম দুর্বল করে দিতে পারে শরীরকে। প্রতিদিন তিন লিটার পানীয় পেটে না গেলে অচিরেই জল কমে যাবে শরীরে আর সেটা বুঝতেও পারব না অথচ শরীর দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়বে, আর উলটোপালটা ভুলভাল বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত নিতে থাকব। খুব উঁচুতে চড়ার সময় ঠুলিবাঁধা একলক্ষ্যে থাকা মন, তার মধ্যে একটাই উদ্দেশ্য রাখতে পারা বেশ সহজ, কিন্তু আবহাওয়ার কিংবা শারীরিক সক্ষমতার যেকোনো পরিবর্তন তোমাকে প্রভাবিত করবেই, সেটা থামাতে পারা দুস্কর।
আমি জো-র থেকে একটা দড়ির সমান উচ্চতা ওপরে জুমার করে উঠতে থাকি। ব্যালকনিতে পৌঁছোতে পৌঁছোতেই আমার হাতদুটো আবার অসাড় হয়ে পড়ে। আমি জানতাম একটাই আশা আছে ও দুটোকে কাজে লাগানোর মতো রাখতে হলে যে করে হোক আমায় হাতদুটো গরম রাখার চেষ্টা করে যেতে হবে। ব্যালকনির ওপর পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে আমি হাতদুটোয় ভাপ দিলাম, বগলে চেপে ধরে রইলাম, কুঁচকিতে চেপে রইলাম। জো যতক্ষণে পৌঁছোল, আমি বুঝে গিয়েছিলাম আমার হাতের তিনটে আঙুল প্রকৃতপক্ষে কোনো কাজে আসবে না।
মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্য বেরিয়ে এসেছে আর ‘টনি কুর্জ পিচ’টির দিকে মুখ তুলতেই দক্ষিণ-পশ্চিম গিরিশিরা থেকে সরাসরি আমাদের ওপরে সূর্যের আলো এসে পড়ছিল। ছোটো ছোটো বরফকুচি ওপরের আইসফিল্ড দিয়ে গড়াতে গড়াতে নীচে নেমে ধারটায় এসে ছিটকে যাচ্ছিল। ব্যালকনির ধারে সুর্যের কিরণ যেখানে স্পর্শ করেছে সেখানে আসার আগেই পাথর আর উর্ধ্বগতি হাওয়ার ধাক্কায় ছড়িয়ে পড়ছিল ওরা। আমার চারপাশের বাতাসে ভাসছিল ওরা, লক্ষ লক্ষ ঝিকমিকে আলোর কণা হয়ে, দেয়ালের ঢালে তাকাতেই আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। প্রথমটায় ওর সৌন্দর্য আমায় বিদ্রুপ করল, যেন জনপ্রিয় টেলিভিশন অনুষ্ঠানের চূড়ান্ত পর্যায়ে জোর করে তৈরি করা চকমকে রঙধাঁধানো উৎসব। তারপর ও আমায় আস্তে আস্তে প্রলুব্ধ করল আমাকে আমার ভেতর থেকে বার করে আনল – এই সৌন্দর্য অপার্থিব, অতিমানবীয়, কিন্তু এটা তুচ্ছ, মোহবিস্তারী বা ক্ষণস্থায়ী নয়। অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে করতেও আমি এর প্রশংসা করতে পারছিলাম।
খুব শিগিগিরই স্যাকটা নিজের একটা ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলতে লাগল। টনি কুর্জ পিচ বরাবর উঠতে শুরু করতেই ওটা দোল খেয়ে ওভারহ্যাঙগুলোয় আটকে আমায় পেছনদিকে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল, আমি তখন টানটান হয়ে ওপরে কোনো পেগ-এ হয়তো দড়িটা লাগাচ্ছি। ওটার জিদ্দিপনা আর বাগে না আসা ভাবখানায় ক্রমশ ঘৃনা করতে শুরু করলাম ওকে। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে স্যাকের আর আমার ওজন একত্রে একটা পেগ উপড়ে আনতে পারে এমনকি দড়িটাও ছিঁড়ে ফেলতে পারে। শেষপর্যায়ে ছাতের মতো অংশটা পেরিয়ে র্যাম্পে পৌঁছোতে পৌঁছোতে, বেসামালভাবে ঝুলে গেলাম আর কোনোমতে পা দিয়ে টাল সামলাতে হল।
“এ এক্কেবারে উন্মাদের মতো হচ্ছে।” আমি জো-কে লক্ষ্য করে চেঁচাই, “ আমি এই স্ট্যান্সেই কিছু সরঞ্জাম বার করে রেখে যাব।”
চেঁচিয়ে চেঁচিয়েই খুব অল্পসময় আলোচনা করে ঠিক করা গেল ওপরের সর্বোচ্চ বিন্দু অবধি কেবল কয়েকদিনের খাবার বয়ে নিয়ে যাব; তারপর তিনশো ফিট টেরিলিনের দড়ি যেটা নীচ থেকে খুলে এনেছি ওটা যতটা অবধি ওপরে পৌঁছে দেবে ততটা চড়ব, তারপর পরে একসময় ফিরে এসে এখানে রেখে যাওয়া সরঞ্জাম আর অন্য দড়িগুলো তুলে নিয়ে যাব। জো-ও পরিশ্রমটা টের পাচ্ছিল নিশ্চই। আমি আমার স্যাক থেকে জিনিসপত্র বার করে কিছু জিনিস ক্লিপ করে ঝুলিয়ে রেখে ফের স্যাক গুছিয়ে তুলতে তুলতে দেখি জো ধার বরাবর ঝুল খেয়ে র্যাম্পলাইনে পৌঁছে গেছে – ও ওর ছেড়ে রাখা জিনিস ব্যালকনির ওপরেই রেখে এসেছে।
গিলোটিনের পাশে ওভারহ্যাঙ পাথরটায় জুমার করে ওঠাটা দেখতে ভয়ঙ্কর খাড়াই লাগছিল। আইসফিল্ডের পাশাপাশি দড়িগুলো মনে হচ্ছিল চিরকাল টিকে থাকবে। আমি ওগুলো বেয়ে এতটাই ধীরে ধীরে উঠছিলাম, যেন মনে হচ্ছিল দড়ির প্রসারনই আমার সমস্ত শক্তি শুষে নিচ্ছে। দড়ির ডগাটা কিছুতেই কাছে আসছে না, আমার পাশ থেকে বরফ সরছে না, আর চারপাশের পাহাড়ের ধারগুলো কিছুতেই নীচে যাচ্ছে না। আধাআধি আচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম আমি; আমার ওঠাটা ঝাঁকুনি দিয়ে দিয়ে, খেলনা পুতুল যেমন হয়, অমনি হচ্ছিল। বিকেল গড়িয়ে আসছিল। রামানি গ্লেসিয়ারের উপত্যকা অঞ্চলে মেঘ ঘন হয়ে আসছিল আর আমরা তারও ওপরে সূর্যের আলোর ছোঁয়া পাচ্ছিলাম। কিন্তু বরফঠান্ডা হাওয়ায় একটুও উষ্ণতা টের পাচ্ছিলাম না।
শেষ বিকেলে আমি সর্বোচ্চ বিন্দুটিতে পৌঁছোলাম। সরঞ্জামগুলো সবুজ ব্যাগে অবিকল রয়েছে। জো পৌঁছেই সোজা লিড করতে শুরু করল। এক সপ্তাহ হয়ে গেছে আমরা নতুন কোনো অংশ চড়িনি আর এইটুকু আমাদের উন্নতির নিরিখে যৎসামান্যই। আইসফিল্ডের ঢালটা এখন অনেকটা সহজ হয়ে এসেছে, পরপর স্ল্যাব ছড়িয়ে আছে ওপরের টাওয়ারের পায়ের কাছে। জো বরফের মাথায় পৌঁছে একটা ফাটল বরাবর চড়তে শুরু করল। ফাটলটা এধার থেকে ওধার স্ল্যাবের ওপর কোনাকুনি রয়েছে। ফাটলের দুপাশের দেয়ালে যেহেতু কোনো হোল্ড নেই ওকে ফাটলটায় শুয়ে পড়ে পা জ্যাম করে আটকে কখনো হোল্ডছাড়া নীচের স্ল্যাবের ওপর দুপায়ে দাঁড়িয়ে ফাটলে হাতটা গলিয়ে দিয়ে উঠতে হচ্ছিল। ও যখন পঞ্চাশ ফুট ওপরে, বরফদানা পড়া শুরু হল। খানিকক্ষণের মধ্যেই চারপাশ সাদা হয়ে গেল আর ওকে প্রায় দেখতেই পাচ্ছি না। ঢালু স্ল্যাবের ওপর দিয়ে বরফের তালগুলো নাচতে নাচতে হুড়মুড় করে নীচে আসতে শুরু করল স্রোতের মতো। আমি একটা পেগ পোঁতার শব্দ শুনলাম। বরফকুচির অনবরত ঝাপটার ভেতর দিয়ে আমি জো-র আপাত গাঢ় অবয়বটাতে খুব কষ্ট করেও চোখ স্থির করে রাখলাম আর হাতের দড়িটা শক্ত করে চেপে ধরে রইলাম। কিন্তু নিজের খেয়াল ও নিজেই রাখতে পারত। দড়িতে ঝুলে দোল খেয়ে আমার পাশে এসে নামল ও।
“এই একটু বৃষ্টি আরকি,” ও বলল, “আমি কাল ওখান থেকেই শুরু করব।”
আমরা আমাদের ওভারস্যুটের মাথার হুডগুলো টেনে দিয়ে পাথরে হেলান দিয়ে দাঁড়াই, পায়ের দিকে মুখ করে। দশ মিনিট পর আকাশ থেকে বরফের দানা পড়া বন্ধ হল বটে কিন্তু পাহাড়ের গা বেয়ে তখনও তা গড়িয়ে আসছে। চ্যাঙাব্যাঙ গা ঝেড়ে ফেলছে। কিছু বাদে বৃষ্টি থেমে গেল, একটা স্মৃতি হয়ে রয়ে গেল আমাদের, আর পাহাড়ের কাছে একটা অপ্রাসঙ্গিক ঘটনা।
আলোচনার কিছু ছিল না। একটা ছোটো পাথরের চাঁই বরফ ঠেলে বেরিয়ে ছিল। আমরা দশফুট মতো সরে গিয়ে বরফে পা রাখার জায়গা করে নিয়ে প্রত্যেকে তিনটে করে পেগ পুঁতে দিলাম, ওখান থেকে আমাদের হ্যামকগুলো ঝোলাব বলে। এখন আমরা স্পেসার-বারগুলো বার করতে পারব যাতে হ্যামকের দেয়ালগুলোকে তফাতে রাখা যায়, আগের রাতের মতো হ্যামকের মধ্যে দমঠেসে পড়তে হবে না। এত হাওয়া চলছিল যে রান্না করাই মুশকিল, ফলে আমরা গুঁতোগুতি করে নিজেদের আস্তানায় ঢুকে পড়লাম।
বুঝতে পারছিলাম শরীর ক্রমাগত ভাঙছে কিন্তু ঠিক ঠাহর করতে পারছিলাম না কতখানি। কোনো স্ট্যান্ডার্ড মাপ ছিল না যার সঙ্গে তুলনা টানতে পারি। আবছা একটা আন্দাজ করেছিলাম যে এইভাবেই ওপরে উঠতে থাকলে ক্রমে সব ঠিকঠাক হয়ে আসবে আর বাতাসও থেমে যাবে শিগগির। একেবারে অবসন্ন লাগছিল, কিন্তু জো-কে সেটা বলিনি, ও’ও বলেনি ওর কেমন লাগছিল। এইটাই খেলার নিরুচ্চারিত অংশ ছিল। ও যদি হাল না ছাড়ে আমিও ছাড়ব না। সেই রাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখলাম, নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের উষ্ণ, ঝকঝকে একটা বেলাভূমি, আকাশে গনগনে সূর্য আর একটুও হাওয়া নেই।
আমি জানি না রাতে তুষারপাত হয়েছে নাকি বরফদানা পড়েছে, কিন্তু বাতাস ছিলই, হাওয়ায় ওড়া বরফের টুকরো ফালাফালা করে দিচ্ছিল আর আমাদের ওপর আছড়ে পড়ছিল। আমাদের পাশ দিয়ে তুষারধস নামছিল, রাতের বেলা দূর দিয়ে ট্রেন যাবার মতো শব্দ করে। কপাল ভালো আমরা আইসফিল্ডের একেবারে বাঁদিকের প্রান্ত ঘেঁসে ছিলাম তাই মূল ধাক্কাটা এড়িয়ে যেতে পেরেছি, ওপরের টাওয়ারটা আইসফিল্ডের ওপরের ফানেলের মতো অংশটা থেকে আমাদের রক্ষা করেছে। ভোরবেলাও আমাদের পাশ দিয়ে সগর্জনে নেমে যাচ্ছিল বরফের তাল। যদিও ওগুলোকে ঠিক খুনি বলা যায় না। চ্যাঙাব্যাঙ এতটাই খাড়া পাহাড় যে ততখানি বরফ জমতেই পারে না যা আমাদের গুঁড়িয়ে দিয়ে ছিঁড়েখুঁড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
হাড়ের ভেতর অবধি ঠান্ডা ঢুকে যাচ্ছে। এটা শহর অঞ্চলের ঠান্ডা বোধের মতো নয় যে ঘর থেকে বাইরে বেরোলে আর ঠান্ডায় কাঁপুনি ধরে গেল। এই ঠান্ডাটা চারদিক থেকে আমায় কুরে কুরে খাচ্ছে।
“বেরোনোর আগে কি সূর্য ওঠা অবধি অপেক্ষা করব?” আমি চেঁচিয়ে বলি।
জো রাজি হয়। আমি জানতাম এই সকালের বাতাসে স্লিপিং ব্যাগ থেকে বাইরে বেরোলে শরীরের যে উষ্ণতাটা বেরিয়ে যাবে সেটা নিতে পারব না। আমি কি একটু বেশিই সতর্ক হয়ে পড়ছি, ভাবি মনে মনে, নাকি জো অপেক্ষায় ছিল যে দুর্বল সিদ্ধান্তটা আমিই নিই?
সকালটা বেশ লম্বা আর অনেক অপেক্ষার পর রোদটাও যথেষ্ট আরাম দিল না। ভ্রান্ত উপশম ছিল একটা। হ্যামক থেকে বাইরে বেরিয়ে আমি স্টোভটা আড়াল করি, ওটা জ্বালাতে জো-কে সাহায্য করি, জো বরফ গলায় ফলের রস বানানোর জন্য। এত সময় লাগছিল ওইটুকু গলাতে যে আমরা ওটা যথেষ্ট গরম হওয়া অবধি অপেক্ষা করলাম না। আমি একটা মাছের টিন খুললাম। ভেতরে স্যুপের মধ্যে ওটা একেবারে জমে কাঠ আর বিস্বাদ হয়ে ছিল, তবু ওটা জোর করে গিললাম, কেননা অন্তত যদি খাবার চেষ্টা না করি তাহলে আমাদের সব পরিশ্রমই বিফলে যাবে।
বিকেল গড়িয়ে আসছিল, তার মধ্যেই জো আগের দিনের শুরু করা পিচটা চড়া শেষ করল, প্রায় ১৫০ ফুট দড়ি ছাড়তে হল।
“ঠিক আছে” জো চেঁচিয়ে বলে। ব্রিটেনে পর্বতারোহন কেন্দ্র গুলোতে যে পাঁচটা বাধ্যতামূলক ক্লাইম্বিং কল শেখায় তার মধ্যে সবচেয়ে কাছাকাছি এই শব্দটাই আজ অবধি জো ব্যবহার করেছে। আমি যখন স্টান্স ছেড়ে এগোলাম, দেখলাম গত চব্বিশ ঘণ্টায় পাহাড়ের মাত্র কয়েক বর্গ ফুট অঞ্চলের মধ্যেই কাটিয়েছি। জো-র কাছে পৌঁছে হতাশ হলাম, আবিষ্কার করি ও কোনো তাকের মতো অংশও খুঁজে পায়নি।
“দ্যাখো” ও বলল, “জাপানিদের রিজটা যেখানে ফুরিয়ে এসেছে সেই একই লেভেলে রয়েছি আমরা।”
ধারের ওপরে থাকতেই অনেকদিন আগেই আমাদের অল্টিমিটার খারাপ হয়ে গিয়েছিল, ফলে আমরা চারপাশের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে উচ্চতার আন্দাজ করতাম। জাপানি ক্লাইম্বারদের কাগজপত্র একেবারে ইস্কুলের ছেলেদের মতো নিখুঁত; দক্ষিণ-পশ্চিম গিরিশিরা অভিযানের দলনেতা ওদের রুটের একটা বিস্তারিত টোপোশিট পাঠিয়েছিল, আমরা ওটার সাহায্যে আমাদের উচ্চতা নির্ধারণ করছিলাম। মাত্র একটা দড়ির সমান উচ্চতা চড়ে ফেলার পর সামনে এতখানি দৃশ্য খুলে যেতে পারে দেখে রোমাঞ্চিত লাগছিল।
ঠিক করলাম বাকি আরেকটা যে দড়ি আমাদের কাছে আপাতত আছে, এবারে ওটায় আমি চড়া শুরু করব কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। “কাল সকালে নীচে নেমে সরঞ্জাম তুলে আনার আগে আমি ওটা লিড করব।” আমি বলি।
“এবারে তোমার রান্নার পালা।” জো বেশ জোর দিয়ে বলে। “গত দুদিন ধরে স্টোভটা নিয়ে আমি বিস্তর ঘেঁটেছি।”
আমি আদেশটা মেনে নিলাম আর ও আমাকে স্টোভটা এগিয়ে দিল। বড়ো বড়ো বেশ কয়েকটা ফুটহোল্ড ছিল যেখানে স্বচ্ছন্দে দাঁড়িয়ে থাকা যায়। আমি কোমরের কাছাকাছি পাথরের ওপরে বরফে একটা খোঁদল মতো করার চেষ্টা করলাম যাতে স্টোভটা ভালোভাবে বসানো যায়। স্টোভটা ভালো করে বসাতে বসাতেই অন্ধকার নেমে এল। হাওয়ার মধ্যে আধঘণ্টা ধরে একটা গোটা দেশলাই বাক্স খরচ করে স্টোভটা জ্বালানো গেল। খানিকটা বরফ গলানোও গেল বটে কিন্তু তত গরম হল না যাতে অক্সো কিউবগুলো গলে গিয়ে একটা আমিষ পানীয় বানানো যায়। তো আমি দুটো অক্সো কিউব চিবিয়ে নিয়ে প্যানের মধ্যে ফেললাম। জো ওর একটা বিভক ব্যাগ দিয়ে স্টোভটা আড়াল করছিল কিন্তু হাওয়া চারপাশ দিয়ে, তলা দিয়ে ঢুকেই যাচ্ছিল। ঠান্ডায় শুকনো করা চিলি উইথ বিন – আমাদের প্রিয় খাবার, কিছুতেই ফোটানো গেল না ফলে আধসেদ্ধই ঝপ করে গিলে নিলাম। অন্ধকারে দুটি ঘণ্টা লাগল একগাল খাবার বানাতে।
ঘণ্টাখানেক বাদে আমরা আমাদের হ্যামকে শুয়ে। ছেলেবেলায় আমাকে যা বলা হত সেটা কী ছিল? যদি ঘুম না আসে সুন্দর সুন্দর জিনিস ভাবো, ভালো ভালো জিনিস চিন্তা করো। বাস্তব থেকে পালাতে স্বপ্ন দেখাটাই সবচেয়ে সুখের। আমি আমার স্কুলের গরমের ছুটির দিনগুলোয় ফিরে গিয়েছিলাম। বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে, জানলায় বৃষ্টির ঝাপটা এসে পড়ছে, আমার নিজেকে উষ্ণ আর সুরক্ষিত লাগছিল। বাইরে রাস্তায় কেউ ছিল না। সব্বাই ঘরের ভেতর। আমি আমার বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছিলাম। তারপরই জানলাটা কী এক অতিপ্রাকৃত শক্তিতে খুলে গেল, পর্দা উড়ে গেল, কাগজপত্র উড়ে উড়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। আমি জেগে গেলাম। স্পেসার বারটা ছাড়িয়ে হ্যামকের ওপরের ঢাকনাটা বেলুনের মতো ফুলে ফেঁপে উঠেছে, আর আমি পাথর থেকে দুলে বাইরে চলে আসছি। বাতাস হঠাৎ তার দিক পরিবর্তন করে এখন নীচ থেকে ধাক্কা মারছে। আমি ঠেলেঠুলে হাতদুটো স্লিপিং ব্যাগ থেকে বার করে পাগলের মতো ফুলে ওঠা, চড়চড় আওয়াজ করে ওঠা কাপড়টা খামচে ধরি। কয়েকটা জুতোর ফিতে দিয়ে ক্লিপগুলো আরো শক্ত করে বাঁধি যাতে ঢাকনাটা নীচু হয়ে থাকে। এই করতে গিয়ে শরীর এমন ঠান্ডা হয়ে গেল যে আমি ঝটপট আবার স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে পড়তে বাধ্য হলাম। হাওয়ার কাছে আত্মসমর্পন করা ছাড়া উপায় ছিল না, আমার পায়ের কাছ থেকে হ্যামকের ঢাকনাটা বাতাসে খুলেই রইল। আমি শুধু পা ঘসতে থাকলাম যাতে ঠান্ডা থেকে খানিকটা বাঁচা যায়। মনে হচ্ছে বরফকুচিগুলো আমাদের খোঁজাটা বন্ধ করেছে, সম্ভবত আমরা আইসফিল্ডের ওপরে চলে এসেছি বলে, কিন্তু বাতাস এদিক ওদিক থেকে এলোমেলো বইছে, বাতাসের বেগ বেড়ে উঠছে, আমাদের রক্ষণের একটুখানি ফাঁকফোকর দিয়ে চারপাশ ঘিরে যেন রাগে আছড়ে পড়ছে। রাতটা নিঙড়ে নিল আমায়, ঘুমোতেই পারলাম না।
তিন দিন তিন রাত আমরা প্রকৃতপক্ষে প্রায় কিছুই না খেয়ে বা পান করে কাটিয়েছি। নিশ্চিতভাবেই আমরা আর বেশিক্ষণ এভাবে টানতে পারতাম না। ভোরবেলা হঠাৎ ভেতর থেকেই যেন কোনো একটা সাড়া পেলাম।
নেমে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা স্পষ্টই ছিল। আমি আর অন্য কিছু ভাবতেই পারিনি। আমরা এখানে থেকে আর একটা দড়ির দৈর্ঘ্যের সমান উচ্চতা চড়ে কী প্রমাণটা করব? পাক্কা এক ঘণ্টা লাগল নামার জন্য তৈরি হয়ে হ্যামক থেকে বেরোতে এবং ওটাকে গুটিয়ে, তার সঙ্গে আমার একটা স্লিপিং ব্যাগ সবুজ বিভক ব্যাগে ঢুকিয়ে এখানেই রেখে যেতে, এবারে অ্যাবসেইল। আমি জানতাম আমি যদি আরো কিছু সময় এই আইসফিল্ডের ওপরে থেকে যাই, যদি এরকমও মনে হয় যে আবহাওয়ার ক্রমশ উন্নতি হচ্ছে, তাহলেও আমি উচ্চতাজনিত কারণ আর তুষারক্ষতে আক্রান্ত হয়ে পড়ব, যা ইতিমধ্যে শুরুও হয়ে গেছে। জো ওপাশ থেকে আমার দিকে তাকাল।
“কী করছটা কী?” ও জিজ্ঞেস করল।
“কী আবার, আমি নীচে নেমে যাচ্ছি,” আমি জবাব দিই।
এত নিশ্চিত ছিল ব্যাপারটা। আমার ভেতরের সহজাত প্রবৃত্তিই আমাকে বলছিল দ্রুত নীচে নেমে যেতে।
“শালা তোমায় নিয়ে এই এক ঝামেলা,” জো চেঁচিয়ে ওঠে, “ক্ষণে ক্ষণে মত বদলাও।”
“মজা করছ, না?” আমি সংশয় নিয়েই জিজ্ঞাসা করি, “তুমি নিশ্চই মনে কর না এরকম একটা রাতের পর আমি কোনোরকম লিড ক্লাইম্ব করতে যাব? আমার মনে হয় যতখানি সম্ভব সরঞ্জাম এখানে রেখে দিয়ে দুজনেরই সিধে বেসক্যাম্পে নেমে যাওয়া উচিত। এই দেয়ালে আর একটুও থাকলে নিজেদের নিজেরাই স্রেফ ভোঁভাঁ করে দেব। নীচের যে অংশটা দড়ি খুলে নিয়েছি ওঠার সময়, সে অংশটা অ্যাবসেইল করে নামার জন্য কেবল একটু দড়ি লাগবে আমাদের।”
“যাইই হোক কেবল জানিও আমায়।” বলল জো, তারপর প্রস্তাব দিল ও আগে নামবে, যাতে দড়িগুলো বাছাই করতে পারে। আমার তুষারক্ষত হওয়া আঙুলের ডগাগুলোর জন্য এরকম কাজ করা আমার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছিল। আমরা নীচে কোথায় নামছি এনিয়ে আলোচনাটুকু অবধি করিনি, কিন্তু তা নিয়ে জো তর্ক করেনি।
“ফিরে যাওয়াটা যে কী স্বাগতই ছিল। আমরা প্রতিটা মুহূর্ত থেকে মুহূর্তে বাঁচছিলাম। ফিরে আসার কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না, পরের কয়েক মুহূর্ত বেঁচে থাকাটা ছিল এইরকম, নেমে যাওয়া, উষ্ণতা সঞ্চয় করা, খাওয়া আর বিশ্রাম করা।”
আইসফিল্ডটা পাশ দিয়ে চলে গেল একটা হালকা নরম স্বপ্নের মতো; আমার আঙুলগুলোর মতোই আমার মনও অসাড় হয়ে পড়েছিল। প্রায় মূর্চ্ছা যাবার আগের অবস্থার মতো বোধ হচ্ছিল। গিলোটিনের পাশের দড়ির গিঁটটা পার হলাম। ওখানে ব্যাপারটা একটু জটীল, দড়ির গিঁটের ওপরে জুমারগুলো আটকে ডিসেন্ডারটা খুলে গিঁটের নীচে দড়িতে লাগিয়ে তারপর আবার জুমারগুলো খুলে গিঁটের নীচে লাগানো। সমস্ত মনোযোগ এক্ত্র করে নিয়ে আমি মনের একটা আবছা আলোছায়া কুঠুরিতে ঢুকে পড়ছিলাম। হ্যাঁ, লোহার খুঁটটা আছে ওখানে, যদি দরকার হয়। টনি কুর্জ পিচটা পেরিয়ে গেল খুব ধীরে ধীরে কিন্তু কোনো অসুবিধে ছাড়াই।
জো, খুব দ্রুত, নীচের ক্যাম্প ওয়ান অবধি ফের দড়িগুলো লাগিয়ে ফেলতে থাকল, আমি ওর পেছন পেছন এলাম। ক্যাম্প থেকে তিনটে দড়ির দৈর্ঘ্য ওপরে আমি একটা পিটনের অ্যাঙ্কর পয়েন্টে এসে ডিসেন্ডারটা খুলে নীচের দড়িতে লাগাচ্ছিলাম, হঠাৎ হাত ফসকে ওটা পড়ে গেল। দেয়াল বেয়ে লাফাতে লাফাতে সেটা নীচে নেমে গেল। আমাদের কাছে অতিরিক্ত ছিল না। আমি ক্যারাবিনার হাতড়ে ছখানা ক্যারাবিনার নিয়ে একসঙ্গে দড়িতে আড়াআড়ি ক্লিপ করে নিলাম যাতে একটা ফ্রিকশন ব্রেক পাওয়া যায়।
আমার পৌঁছতে পৌঁছতে তাঁবুর ওপর রোদ পড়ে বেশ গরম হয়েছিল আর জোর পা-টা তাঁবুতে ঢোকার মুখেই বাইরে বেরিয়ে ছিল। ও ঘুমিয়ে পড়েছিল।
“চা কফি কই?”
“কোনো পাত্র নেই।”
“শুকনো দুধের টিনগুলো, ওতেও তো কাজ হবে?”
আমি তাঁবুর ভেতর স্থির বাতাসের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকি। রোদে ভেতরটা গরম হয়ে আছে। তিনদিন আগে যখন এখানে স্টাফব্যাগে জিনিসপত্র গোছাচ্ছিলাম তারপর এই প্রথমবারের জন্য একটা উষ্ণ আবহাওয়ায় এলাম, মনে হচ্ছে যেন একজীবন কেটে গেছে। কিছুটা বরফ টিনে করে স্টোভের ওপরে চাপালাম। আগুনের শিখায় সহজেই গলে গেল ওটা। অবশেষে সভ্যজগতে। আমি ঢুলুঢুলু চোখে এলিয়ে শুয়ে পড়ি। তারপরেই টের পাই। আমার আঙুলগুলোতে অসহ্য যন্ত্রণা করছে। রক্ত চলাচল শুরু হয়েছে ফের। দপদপ করছিল আঙুলগুলো, আমার চোখে জল চলে এলো।
“ব্যথা লাগছে?” জো জিজ্ঞেস করে।
“কেবল যখন দাঁত ক্যালাই,” আমি দাঁত বার করে বলি, ভেতরে ভেতরে নিজেকে বোঝাতে থাকি ক্ষতটা তেমন গুরুতর নয়।
জো খুব সহানুভূতিশীল, ও ফার্সট এইড বাক্সটা থেকে কিছু ফোর্ট্রাল পেইনকিলার ট্যাবলেট বার করে আনে।
“তুমি এগুলো সবজান্তার মতো চিবোতে পারো, খুব একটা কাজের না, তাই না?”
“ডিক এগুলো ওর আঙুলের জন্য ব্যবহার করেছিল, ভেবেছিল এগুলো কাজের,” জো বলে, “তোমার মরফিন দরকার হবে না তো, হবে কি?”
“না, ততটা খারাপ অবস্থা নয়। খালি বিচ্ছিরি একটা ব্যথা। কয়েক মিনিটে ঠিক হয়ে যাবে!” আর হলও তাই; কিন্তু আমার আঙুলের ডগাগুলো খুব তুলতুলে হয়ে রইল আর আমি তিনটে আঙুলের একটারও ডগায় সাড় পেলাম না।
ব্ল্যাককুরান্ট-এর পানীয়টা তৈরি করা হল; আমি যত পানীয় খেয়েছি তার মধ্যে এটা সবচেয়ে ভালো। আমি ওটা মুখের মধ্যে নিয়ে ঘোরাতে থাকলাম মরুভূমির যাযাবরদের মতো।
দাঁড়িয়ে উঠে ধার বরাবর বরফ ঢালের দিকে এগোতেই হালকা টাল খেয়ে গেলাম।
“তুমি ঠিক আছ?” জো জিজ্ঞেস করে।
আমি জো-র ব্যক্তিত্বের আরেকটা দিক লক্ষ করতে শুরু করি। “ও দয়ালু এবং সহানুভূতিশীল” আমি ভাবি। “কেমন একটা আচ্ছন্ন লাগছে,” আমি স্বীকার করে নিই।
জো-র কাছে সব রোগেরই একটা করে বড়ি হাজির। “এই যে, এই ভার্টিগনটা নাও, দ্যাখো,” ও বলে, “দুনাগিরি থেকে নামার সময় ব্যবহার করেছিলাম, কাজে দিয়েছিল।”
বরফের ঢালটা যান্ত্রিকভাবে পাশ দিয়ে চলে গেল, আমি খেয়াল করে যাচ্ছিলাম ওর ফাটল ধরার বা ভেতরের গুড়গুড় আওয়াজ। শেষ অবধি যখন গিয়ে ঢুকলাম, অ্যাডভান্স ক্যাম্পকেই মনে হচ্ছিল স্বর্গ। ওখানে কেবলমাত্র কিছুটা চাল আর একটা কর্নড বিফের টিন ছিল, তাই খেলাম, এবং সেরাত ওখানেই কাটালাম। বেসক্যাম্প অপেক্ষায় থাক। নাইট রানার্স অব বেঙ্গল বইটা তাঁবুর মেঝেয় পড়ে ছিল, ঠিক যেখানে রেখে দিয়ে গিয়েছিলাম। আমার মনে পড়ল, তখন ভেবেছিলাম আমাকে হয়তো শিপটন কল পেরিয়ে ওটার কাছে ঘুরে আসতে হবে। আমি বইটা খুললাম আর যে অংশগুলো ছেড়ে ছেড়ে পড়েছিলাম সেই অংশগুলো পড়তে শুরু করলাম। মোমের আলোয় ভারতের সিপাহীবিদ্রোহের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলাম, যতক্ষণ না দুচোখে ঘুম নেমে এলো। চ্যাঙাব্যাঙ বহোত দূর।
ক্রমশ