জয়ঢাকের অভিযান লাইব্রেরি- এভারেস্ট-এরিক শিপটন(অনু-বাসব চট্টোপাধ্যায়) অন্নপূর্ণা-মরিস হারজগ(অনু তাপস মৌলিক) কন-টিকি অভিযান- থর হেয়ারডাল (অনু-শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়)
এই অভিযানের আগের পর্ব- পর্ব ১, পর্ব ২ পর্ব ৩, পর্ব ৪, পর্ব ৫
(ডেভিড লিভিংস্টোন ছিলেন পেশায় ডাক্তার। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজকও। লিভিংস্টোন প্রথম আফ্রিকা পাড়ি দেন ১৮৪১ সালে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। আফ্রিকার অবাধ দাস ব্যাবসার বিরোধী ছিলেন তিনি। বেশ কয়েক দশক ধরে আফ্রিকায় অভিযানে যান ডক্টর লিভিংস্টোন। প্রতিটি অভিযানে আফ্রিকার জনজাতি, ভূতত্ত্ব, পরিবেশ খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য লিখে রাখেন নিজের ডায়েরিতে। এই ধারাবাহিকে তাঁর নীলনদের উৎসের খোঁজে যাত্রার গল্প শুনছি আমরা।)
————————————————————————————–
২৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৭১।
পাহাড় আর ঝোপ-জঙ্গল পেরিয়ে একটানা পথ চলে আমরা পৌঁছে গেলাম উগুন্ডা। এই বিশাল গ্রামটা উনিয়ানেম্বের পশ্চিম সীমান্তের এক কোনায় অবস্থিত। এখানে প্রায় চারশো ঘরে হাজার দুয়েক গ্রামবাসী বাস করে। গ্রামটি শক্ত কাঠের বেড়া দিয়ে ঘেরা। চারদিকে পরিখা কেটে, মাটির পাঁচিল তুলে শত্রুর আক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা সুস্পষ্ট। গ্রামের মাইল দুয়েক ঘিরে চারধারে গাছ কেটে পরিষ্কার করা, যাতে দূর থেকে শত্রুর আগমন নজর করা যায়। বোঝা গেল মিরাম্বোর ডাকাত দলের আক্রমণ প্রায়শই হয়ে থাকে এই এলাকায়। এখানকার আদিবাসীদের নাম ওয়াগুন্ডা।
এই গ্রাম জুড়ে বিশাল শস্যের ক্ষেত। নিজেদের জন্য ব্যবহার করার পর উদ্বৃত্ত শস্য তারা গ্রামের পাশ দিয়ে যাওয়া কাফিলাতে বেচে দেয়। যতই নিরাপদ হোক গ্রামের আশ্রয়, এরা যে মিরাম্বোর লুটেরাদের সাংঘাতিক ভয় পায়, বোঝা গেল যখন দলে দলে ওয়াগুন্ডারা এসে ভিড় করল কুলির কাজ করার জন্য। এরা যেনতেন প্রকারে এই গ্রাম থেকে পালাতে পারলে যেন বাঁচে।
শুধু মিরাম্বোই নয়, আরও অনেক লুটেরার ভয় দেখাতে লাগল স্থানীয় অধিবাসীরা। সামনের পথে পদে পদে বিপদ লুকিয়ে আছে জানতে পারলাম। মগো নামের এক দস্যু দলপতি নাকি এই গ্রামের দিকে হাজার খানেক ডাকাত নিয়ে রওনা দিয়েছে। শিম্বা নামের আর-এক ডাকাত নাকি ক’দিন আগেই এক কাফিলার উপর হামলা করেছে। নানা গুজব এখানে বাতাসে উড়ে বেড়ায়।
উগুন্ডা গ্রাম ছেড়ে আরও তিন-চার ঘণ্টা পায়ে হেঁটে আমরা পৌঁছলাম কিসারি গ্রামে। এখানে একজন লোকের সঙ্গে আলাপ হয়ে জানতে পারলাম, প্রচুর মালপত্র নিয়ে কোনও কাফিলার সঙ্গী হবার জন্য সে অপেক্ষা করে আছে দুই মাস ধরে। তাকে যেতে হবে উফিপা। বড়ো আশায় আমাদের দলের লোকদের ধরে পীড়াপীড়ি করতে লাগল যদি কেউ তার সঙ্গী হয়। কেউ রাজি না হওয়ায় বাধ্য হয়ে দক্ষিণের দিশায় যাবার আশা সে ত্যাগ করল, আর আমরা কিসারি গ্রামে দু-চারদিন বিশ্রাম নিয়ে এগিয়ে গেলাম।
ফুটিফাটা পথ, সংকীর্ণ জঙ্গল পেরিয়ে দেখা পেলাম বিশাল এক হ্রদের—তাতে একফোঁটা জল নেই। ফেটে যাওয়া মাটিতে অসংখ্য গণ্ডার, হাতি, মোষ আর জেব্রার পায়ের ছাপ দেখতে পেলাম। এককালে এখানে প্রচুর পশুদের অবাধ বিচরণ ছিল, সন্দেহ নেই। এইভাবে চলতে চলতে আমরা পৌঁছে গেলাম কিকুরু।
এই এলাকায় সেটসি মাছির দাপট দেখে বোঝা গেল সামনে অনেক পশু শিকার করার সুযোগ আসবে। হঠাৎ রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেল এক মৃতদেহ—শরীরে গুটি দেখে বুঝলাম স্মল পক্স তার জীবন কেড়ে নিয়েছে। আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা জিনিস বলে দেয়, লোকটা কোনও ডাকাতি করে ফিরে আসবার সময় অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, তারপর সাথীরা তাকে ফেলে চলে গেছে মৃত্যুমুখে। আরও এগোতে এমন অনেক মরা মানুষের হাড়গোড় রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখলাম।
জঙ্গলের রাস্তা ফুরিয়ে গেল। এবার আমরা এসে পড়লাম সমতলভূমিতে। নজরে পড়ল জিরাফের লম্বা লম্বা মাথা। আমার সঙ্গীরা জিরাফ দেখে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল। অবশেষে আমরা এসে পড়েছি এমন জায়গায়, যেখানে খাবারের অভাব হবে না একটুও। আর-একটু এগোতে চোখে পড়ল মানিয়ারার শস্যক্ষেত্র। কিন্তু গ্রামবাসীরা ডাকাতদের সঙ্গে বছরের পর বছর যুদ্ধ করতে করতে এতটাই সন্দিহান হয়ে উঠেছে যে, তারা আমাদের গ্রামে আশ্রয় দিতে অস্বীকার করল। গ্রামের বাইরে একটা জলার ধারে কতগুলো ভাঙাচোরা কুঁড়েঘর দেখিয়ে ওখানেই আস্তানা গাড়তে বলল। পরিশ্রান্ত সঙ্গীরা আশ্রয় দেখে একটুও খুশি হল না।
অসহযোগী গ্রামবাসীদের কাছ থেকে খাবার জোগাড় করার জন্য দুটো রাজকীয় পোশাক আমার রসদ থেকে বার করে বম্বের হাতে গ্রামের মোড়লকে পাঠালাম। কিন্তু মোড়ল বম্বেকে ফিরিয়ে দিল, পোশাক দুটো সে নাকি ছুঁয়েও দেখেনি। খাবার জোগাড় না হওয়ায় আমার দলের লোকেরা খুব রেগে গেল এবং অভুক্ত পেটে শুয়ে পড়ল। পরদিন আবার বম্বেকে পাঠালাম মোড়লের কাছে। এবার চারটে রাজকীয় পোশাক, দুটো ধুতি পাঠালাম। বম্বেকে মিষ্টি কথায় মোড়লের সঙ্গে কথোপকথন করতে নির্দেশ দিলাম। বলা যায় না, এই মোড়ল আবার যদি মিরাম্বোকে নকল করে আমাদের উপর চড়াও হয়ে বসে—তাহলেই বিপদ।
আমার কূটনীতিক চালে কাজ হল। ঘণ্টা খানেক পর বম্বে ফিরে এল। পিছনে জনা বারো কালো লোক, মাথায় তারা নানা খাবারের বোঝা বেঁধে এনেছে। এখানকার সুস্বাদু শস্য চরোকো, মাতামা, চাল, বিনস—আরও অনেক শাকসবজি। এরপর মোড়ল নিজেই এল আমার সঙ্গে দেখা করতে। সঙ্গে তিরিশজন রাইফেলধারী, বিশজন কুড়ুলধারী দেহরক্ষী। আমি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে তাঁকে কুর্নিশ করলাম। লোকটা খুব খুশি হল। তার পিছন পিছন এল আরও নানা খাবারের সম্ভার—মুরগি, ছাগল, মধু, ঘি। প্রায় দিন পাঁচেকের খাবার জমা হল আমার দলের লোকদের জন্য। আমি মোড়লকে আমার তাঁবুতে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এলাম। আগে থেকেই সেখানে সবচাইতে দামি পারস্যের গালিচা আর ভল্লুকের চামড়া বিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাদের বসার জায়গা করার জন্য।
কিছুক্ষণ স্থানীয় দর্শনার্থীরা আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল, আমার দেওয়ালে টাঙানো বন্দুকের দিকে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগল। চোখ চাওয়াচাওয়ি করে তারা আঙুল কচলাতে লাগল, তারপর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। নিজেদের মধ্যে ওরা দুর্বোধ্য কিনিয়ামওয়েজি ভাষায় কথা বলতে লাগল। আমার দোভাষী মাগঙ্গা ওদের জানাল, তারা আসাতে আমি যারপরনাই খুশি হয়েছি। মোড়ল আমার ষোলো ঘড়ার বন্দুকটা দেখতে চাইল। আমার দোনলা বন্দুকটাও দেখল। ছোটো ছোটো পিস্তলগুলো দেখে খুব বিস্মিত হল। দোনলা বন্দুক থেকে আমি আকাশের দিকে তাক করে গুলি ছুড়তে ওরা আওয়াজে ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠল। তারপর উত্তেজিত হয়ে আবার বসে পড়ল।
ওদের উৎসাহ বাড়িয়ে দিতে এবার আমি আমার ওষুধের বাক্স খুললাম। ওরা হাঁ করে তাকিয়ে থেকে জানতে চাইল ওগুলো কী। আমি উত্তর দিলাম, দোয়া, যার অর্থ হল দাওয়াই বা ওষুধ। আমি বাক্স থেকে ঔষধি ব্রান্ডি বার করে ছিপি খুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “চেখে দেখবে নাকি? আরবদের কাছে এসব জিনিস পাবে না। আমি কিন্তু আরবদেশের নই। এই দাওয়াই নিলে গায়ে তাকত আসে, তবে বেশি নেওয়া খুব খারাপ।”
একজনের মুখে এক চামচ ঢেলে দিতে সে লাফালাফি করতে করতে বিচিত্র মুখব্যাদান করে বলতে লাগল, “কড়া দোয়া। তেতো, বাজে খেতে।”
কিন্তু এরপর লাইন পড়ে গেল। সবাই এক চামচ ব্রান্ডি মুখে দিয়ে সাদা চামড়ার মানুষকে অবাক করে দিতে চায়। তাদের আনন্দ দেখার মতো ছিল। সব দেখেশুনে মোড়ল বলল, “আরবরা একেবারে নোংরা, সাদা মানুষ সব জানে।”
আনন্দ-ফুর্তি শেষ হতে ওরা বিদায় নিল।
৪ অক্টোবর, ১৮৭১।
মানিয়ারা থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা চলার পর আমরা গম্বে (বর্তমান নাইজিরিয়া) নদীর ধারে পৌঁছে গেলাম। আহা, এখানে যেন স্বর্গীয় সব দৃশ্য আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। বিস্তীর্ণ প্রান্তর জুড়ে নদী এঁকে-বেঁকে চলেছে, দুই পাশে ছোটো ছোটো ঘাসের গালিচা পাতা, ছোটো ছোটো বিক্ষিপ্ত জঙ্গল। নদীর ধারে জল খেতে আর ঘাসে চরে বেড়াচ্ছে নানা জাতের হরিণ, জেব্রা আর জিরাফ। গাছে গাছে ডাকছে পাখি। গাছের ডালে মৌমাছির চাক থেকে চুইয়ে পড়ছে মধু।
গম্বে হল শিকারিদের স্বর্গরাজ্য। আমার ভিতরে ঘুমিয়ে থাকা শিকারি আবার জেগে উঠল। দুই বন্দুকবাহী সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম শিকারে। একটু এগোতেই চোখে পড়ল নদীর একটা ছোটো খাঁড়ি। সেখানে তিন-তিনটে স্প্রিং-বক হরিণ একেবারে আমার হাতের সামনে। দোনলা বন্দুক নিয়ে সেদিকে দেগে দিতেই একটা হরিণ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। বাকি দুটো ভয় পেয়ে চোঁ-চা দৌড়! আমার সঙ্গীরা হরিণটার ছাল ছাড়াতে লাগল।
ক্যাম্পে ফিরে হরিণের সেঁকা মাংস, কেক আর এক কাপ গরম মোচা কফি খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম জঙ্গলে। স্বর্গরাজ্যে এসে আমাকে শিকারের নেশায় পেয়ে বসেছে। ভাবলাম পাখি শিকার করব। কিন্তু কীভাবে যেন পাখিগুলো আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেল।
নদীর জল এত স্বচ্ছ, দেখেই আমার স্নান করার ইচ্ছে হল। সাথীদের বললাম আমার জন্য অপেক্ষা করতে। এই ফাঁকে টুক করে স্নানটা সেরে ফেলি। গায়ের পোশাক নদীর পাড়ে খুলে রেখে জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাব, হঠাৎ আমার নজর গেল জলের ভিতরে কালো এক প্রকাণ্ড শরীরের দিকে। একটা কুমির! কুমিরটা খুব সম্ভব আমার জলে ঝাঁপানোর অপেক্ষায় ছিল। শেষ মুহূর্তে তার পেটে যাবার আগে খাবার নিজেই যে সতর্ক হয়ে যাবে, ব্যাটা বুঝে উঠতে পারেনি। এ-যাত্রা বেঁচে গেলাম। কুমিরটাও মনের দুঃখে জল তোলপাড় করে ফিরে গেল নদীর গভীরে। আমিও জামাকাপড় পরে নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে এলাম স্নান না সেরেই।
কুমিরের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে ঝোপ-জঙ্গল পার হয়ে নদীর ধার থেকে উঠে আসছি, হঠাৎ সামনে দেখি দুটো সন্দেহজনক কালো আদিবাসী আমার কয়েক হাত দূর থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তারা আক্রমণ করার আগেই আমি সামনে ঝাঁপ দিলাম, হাতে একটা ছুরি বাগিয়ে। তাদের একজন ঠিক সেই মুহূর্তে আমাকে চিনতে পেরে, ‘বানা বানা’ বলতে বলতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। দোভাষীরা জানাল, তারা সাদা চামড়ার সাহেবের জন্য আগের দিন খাওয়ার জিনিস বয়ে নিয়ে এসেছিল। দুই পক্ষই জোরে জোরে হেসে উঠতে আসন্ন লড়াই থেকে বেঁচে গেলাম। আদিবাসীরা জানাল, তারা জঙ্গলে মধু সংগ্রহ করবার জন্য বেরিয়ে সাদা চামড়ার মানুষ দেখে প্রথমে ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিল। রঙ্গরসিকতা করে ক্যাম্পে ফিরে এলাম হৃষ্টচিত্তে।
তখন রাতের আকাশ ধূসর হয়ে উঠেছে। থালার মতো চাঁদ উঠেছে নদীর উপর। তার আলোয় মনে হচ্ছে যেন লম্বা রুপোর সুতো এঁকে-বেঁকে চলে গেছে দূরচক্রবালে। মাছরাঙা গাছের ডালে বসে একটানা ডেকে চলেছে। হরিণরা ঘোঁত ঘোঁত করে নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে ঘরে ফিরছে। হয়তো কোনও শ্বাপদ অন্ধকারে তাদের ঘাড় মটকানোর অপেক্ষায় রয়েছে। এর চাইতে ভালো রোমাঞ্চকর দৃশ্য আর পৃথিবীতে আছে কি না আমার জানা নেই। আমার সঙ্গীরা ক্যাম্পের চারদিকে কাঁটাঝোপ দিয়ে ঘিরে ক্যাম্প-ফায়ারের আয়োজন করে নিয়েছে। আমাদের শিবিরে খাবার বানানোর তোড়জোড়ের সঙ্গে ভেসে আসছে তাদের হর্ষ উল্লাস।
এরপর তিনদিন আমরা একই জায়গায় থেকে গেলাম শুধু শিকারের জন্য, মাংস সংগ্রহ করার জন্য। এত পশু আমি একসঙ্গে কোনোদিন শিকার করিনি। তবে আমার বন্দুকগুলো মানুষ মারার কাজেই বেশি উপযোগী, আফ্রিকার এই গহিন জঙ্গলে এইখানে এসে আমার এই বোধদয় হল, কারণ পশুদের মারতে হলে আরও ভারী শক্তিশালী বন্দুকের প্রয়োজন। আমার বন্দুক অনেক পশুর রক্ত ঝরাল, কিন্তু বেশিরভাগ ঘন জঙ্গলে পালিয়ে গেল। তাদের অনুসরণ করা অসম্ভব এই গভীর জঙ্গলে। তবে আমাদের সংগ্রহে মাংস কিছু কম হল না। সঙ্গীরা সেই মাংস কেটে শুকিয়ে বস্তাবন্দি করে রাখল আগামী অনিশ্চিত পথের জন্য।
আমি ক্যাম্প গুটিয়ে নিতে বললে সবাই অসন্তোষ দেখাতে শুরু করল। এখানে অনেক পশু সহজে শিকার করার সুযোগ থাকায় প্রত্যেকের থালায় তিন বেলা প্রচুর মাংস খাওয়ার জন্য থাকে। তাই তারা একটুও এগোতে রাজি নয়। আমি ভেরী বাজিয়ে যাত্রা শুরু করতে বলায় আমার দৈত্যাকার গাইড বলে উঠল, সে নাকি মুসুঙ্গুকে টাঙ্গানাইকার রাস্তা দেখাতে এসে জীবনের সবচাইতে বড়ো ভুল করে বসেছে।
সবাইকে আগে পাঠিয়ে আমি আমার বন্দুকবাহীদের সঙ্গে চললাম পিছন পিছন, যাতে কেউ কুঁড়েমি করার সুযোগ না পায়। আধঘণ্টা হাঁটার পর দেখি আমার কাফিলা থেমে গেছে পথের মাঝে। দল পাকিয়ে আমার লোকেরা আর আগে না এগোনোর জন্য নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। দূর থেকেও ওদের ক্রুদ্ধ আস্ফালন শোনা যাচ্ছে। ওরা বিদ্রোহ করার জন্য উদ্যত।
সেলিমের কাঁধ থেকে বন্দুক ছিনিয়ে নিয়ে দুটো গুলি আমার বন্দুকে ঠুসে দিয়ে রিভলভার জায়গামতো আছে কি না পরীক্ষা করে এগিয়ে গেলাম ওদের দিকে। আমাকে যুদ্ধংদেহী ভঙ্গিতে এগিয়ে আসতে দেখে উইঢিপির আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে আমার দিকে বন্দুক তাক করল আমার গাইড আসমানি আর একদা বিশ্বস্ত সাথী মাব্রুকি। আমি বন্দুকের নল ওদের দিকে উঁচিয়ে চিৎকার করে উঠলাম—“খবরদার! হাত থেকে বন্দুক ফেলে দাও, নইলে আমার বন্দুকের গুলি তোমাদের ঝাঁঝরা করে দেবে।”
আমার কথায় ওরা এগিয়ে এল, কিন্তু বন্দুকের ট্রিগার থেকে আঙুল সরাল না। আমি আবার চেঁচিয়ে উঠলাম—“হাত থেকে এখুনি বন্দুক ফেলে দে তোরা, নইলে মরা শরীরগুলো এই পথেই পড়ে থাকবে।”
ওদের মাথায় তখন খুন চেপেছে। ওরা এগিয়ে আসছে, আর আমি ভাবছি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের ভবলীলা সাঙ্গ হবে। পৃথিবীর মাটিতে ওদের দিন ফুরিয়েছে। আমার চোখ ওদের প্রতিটি গতিবিধির উপর সজাগ, ঠিক তখুনি বন্দুক ফেলে দিয়ে মাব্রুকি হাউমাউ করে কেঁদে আমার পায়ে লুটিয়ে পড়ে বলল, “বানা, আমাকে মাপ করে দিন। বড়ো ভুল হয়ে গেছে। আমি আর কোনোদিন আপনার উপর হাতিয়ার তুলব না। আমরা বৃদ্ধ মুসুঙ্গুকে (ডক্টর লিভিংস্টোন) খুঁজে বার করতে টাঙ্গানাইকা যাব। আমরা সফল হবই বানা।”
আমি আসমানির উপর থেকে বন্দুকের নল বিন্দুমাত্র না সরিয়ে ওর চোখে চোখ রেখে মাব্রুকিকে মাটি থেকে টেনে তুললাম। আসমানি আমার দিকে তাকিয়ে উপেক্ষার হাসি হেসে বন্দুকের নল তাক করে আরও এগিয়ে এল। এই মুহূর্তে ওকে হিংস্র খুনি বলে মনে হতে লাগল। মাব্রুকি মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আসমানির পাশে গিয়ে দাঁড়াল। না, আর নয়। আর বেঁচে থাকার জন্য আসমানির হাতে একটুও সময় নেই। আমার বন্দুকের ট্রিগারে আঙুল আর-একটু নড়ল, ওর বন্দুক থেকে গুলি ছোটার ভগ্নাংশ আগে মাব্রুকি আসমানির বন্দুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বন্দুক ফেলে দিল মাটিতে। তারপর গর্জে উঠল—“পাপ। বানাকে হত্যা করার চিন্তা করাও পাপ। আমাদের ভুল হয়ে গিয়েছে। এখুনি বানার কাছে ক্ষমা চাও। এই খুনোখুনিতে কারও বিন্দুমাত্র লাভ নেই। যাও বানার কাছে ক্ষমা চাও।”
মাব্রুকির মতো আসমানি আমার পায়ে পড়ে গেল না ঠিকই, কিন্তু সে ক্লান্ত শরীরে আমার সামনে এসে মাথা নীচু করে দাঁড়াল। আমি ওদের মাপ করে দিয়ে পিঠ চাপড়ে দিলাম। এগোতে হবেই। যে করেই হোক খুঁজে বার করতে হবে ডক্টর লিভিংস্টোনকে।
আবার চলা শুরু হল। কিছুটা শুকনো ভূমি পেরিয়ে আবার এসে পড়লাম জলাভূমিতে। এই জায়গাটার নাম টঙ্গোনি। জঙ্গলে প্রচুর মধু পাওয়া যায়। সাদা আর লাল—দুই রঙের মধু। মধুখেকো পাখিগুলো গাছের মাথায় ডাকাডাকি করে কর্কশ গলায়। ওয়াকাঙ্গো উপজাতির লোকেরা স্রেফ পাখিগুলোর গতিবিধি লক্ষ করে গাছের মাথায় মৌমাছির ছাতা খুঁজে বার করে। ওরা আমার জন্য মধুর বড়ো বড়ো চাক পেড়ে নিয়ে এল। আমার লোকেরা মধুর সঙ্গে মোমও খেয়ে ফেলল খিদে মেটাতে।
আরও দক্ষিণ দিশায় এগিয়ে গিয়ে আমরা একটা গাছপালায় ঘেরা ঘাসের জমিতে তাঁবু ফেললাম। পথে জনমানবশূন্য জ্বলে যাওয়া গ্রাম দেখতে পেলাম। হয় মিরাম্বো, নয় রুগা-রুগা ডাকাতেরা ধ্বংস করে দিয়েছে এখানকার আবাদ। এই জায়গায় পানীয় জলের বড়ো অভাব। স্থানীয় লোকদের অনেকেই পরিষ্কার জল না পেয়ে কাদাগোলা জল খেয়ে পেটের অসুখে ভুগছে। আমি তাদের ওষুধ দিলাম।
তাঁবুতে সবাই একত্র হলে একটাই আলোচনা হতে থাকে—মিরাম্বো আর রুগা-রুগাদের ডাকাতি। ওদের ধ্বংসলীলা দেখে আমি নিজেও বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছি যে গুটিকয়েক মিরাম্বোর ডাকাত আমার এই বিরাট কাফিলাকে খতম করে দিতে পারে এক লহমায়। কিন্তু সে-কথা আর কাউকে খুলে বলছি না।
পরদিন আমরা মারেফু পৌঁছলাম। এখানে এসে আরবদের একটা দলের সঙ্গে দেখা হল। উনিয়ানেম্বে থেকে তারা রওনা দিয়েছিল ওয়াতুতার দিকে। দিন দশেক ডাকাতের ভয়ে এরা এখানে ডেরা বেঁধে বসে আছে। সামনে দুই গাঁয়ের মোড়লের মধ্যে বেধেছে যুদ্ধ। তারা আবার একই মায়ের পেটের ভাই নাকি। বৃদ্ধ আরব-কূটনীতিক হাসান আমাকে পরামর্শ দিল আর না এগোতে। আমি সরাসরি তাকে আমার অসম্মতি জানালাম। উলটে তাকে বললাম নির্ভয়ে আমার সঙ্গে বরং সে মারেফু সীমান্ত পর্যন্ত যেতে পারে, তারপর না-হয় নিরাপদ রাস্তা ধরে পৌঁছে যাবে ওয়াতুতা। বুড়ো মোটেই রাজি হল না।
ডাকাতদের এড়াতে আমি সরাসরি দক্ষিণ দিকে না গিয়ে টাঙ্গানাইকার দিকে এগোতে লাগলাম জঙ্গলের রাস্তা ধরে, মানুষের পায়ের ছাপ অনুসরণ করে। আসমানির সঙ্গে আলোচনা করেই রাস্তা বদলালাম।
এখানে বেম্বু নামের একধরনের ফল পাওয়া যায় যা খিদের থেকে রেহাই দেয়—অনেকটা পিচ ফলের মতো খেতে। শঙ্কু আকৃতির পাহাড়ের মাথা থেকে নীচে নেমে আমরা পেয়ে গেলাম উটেন্ডে গ্রাম। এখানে গ্রামবাসীরা ভয় পেয়ে গেল আমাদের হঠাৎ সামনে দেখতে পেয়ে। মোড়লের জন্য একটা ধুতি পাঠালাম। লোকটা উপহার নিতে অস্বীকার করল আরও বেশি পাবার আশায়। পরদিন সকালে মোড়লের বউয়ের জন্য লাল পুঁতির মালা দিতেই কাজ হল। বন্ধুত্ব হয়ে গেল ওদের সঙ্গে।
চার ঘণ্টা হাঁটার পর একটা নালা পড়ল, সেটা সোজা গিয়ে মিশেছে গম্বে নদীতে। এখানে জলাশয়ের ধারে অনেক হরিণ, মোষ, হাতি দেখা গেল। নানা জাতের পাখির ভিড়। একটা পালা-হরিণ মেরে মাংসের জোগাড় হয়ে গেল।
নালা ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতেই পৌঁছে গেলাম মোয়ারু গ্রামে। এখানে মোড়লের সঙ্গে তার ভাইয়ের বেজায় বিরোধ। আমরা আসার আগে মোড়লের ভাই দাদার কাছে হেরে ফিরে গিয়েছে নিজের গ্রামে। ভাগ্য ভালো, তাদের লড়াইয়ের মাঝে আমাদের পড়তে হয়নি।
উপত্যকার পশ্চিমদিকের ঢাল ধৌত হয় ম্রেরা নদীর জলে। সেই নদী গিয়ে মিশেছে টাঙ্গানাইকা হ্রদে। যদিও আমরা দশ-পনেরো দিন হাঁটলে তবেই হ্রদের কাছে পৌঁছতে পারব। উফিফা থেকে একটা কাফিলা ফিরছিল। তাদের কাছে খবর পেলাম, একজন সাদা চামড়ার মানুষ তারা উরুয়া নামের এক গ্রামে দেখেছে। নিঃসন্দেহে এই ব্যক্তি ডক্টর লিভিংস্টোন না হয়ে যান না।
ম্রেরা গ্রামের মোড়ল একসময় খুব ক্ষমতাশালী ছিল। এখন যুদ্ধ করতে করতে তার অধীনে মাত্র তিন-চারটে গ্রামই রয়ে গিয়েছে। এখানকার উপজাতিদের নাম ওয়াকোনোঙ্গ। গ্রামটা চারদিক থেকে ঘন জঙ্গলে সুরক্ষিত। শত্রুর পক্ষে এই গ্রামে ঢুকে ডাকাতি করা প্রায় অসম্ভব। এদের শত্রু হল একটু দূরের উপজাতি ওয়াজিভেরা। শত্রুদের মেরে ম্রেরা গ্রামের লোকেরা গাছের মাথায় তাদের মাথার খুলি টাঙিয়ে রেখেছে।
জলাভূমি পেরোতে গিয়ে একটা গোটা বুনো হাতির দলের সঙ্গে দেখা হল। তাদের ভাবটা এমন যেন আমাদের কাফিলার মতো কাফিলা তার রোজ দেখে থাকে। একেবারে উদাসীনভাবে তারা অন্য একটা কাদাজল জঙ্গলে ভরা রাস্তা ধরল। যাত্রাপথে সব গাছ ধরাশায়ী হয়ে গেল তাদের পায়ের চাপে আর শুঁড়ের অত্যাচারে। দলবদ্ধভাবে হাতিরা যখন জঙ্গল পার হয়, তখন বোঝা যায় তাদের জঙ্গলের রাজা কেন বলা হয়।
ম্রেরা গ্রামের সব যোদ্ধার কাছে বন্দুক দেখতে পেলাম। ওরা গুলি, বারুদ আর কাচ চেয়ে বসল আমার কাছে। আমি নাকচ করে দিলাম ওদের দাবি। তবে গ্রামে ওরা আমদের আশ্রয় দিল। এই ফাঁকে আমি আমার ফেটে যাওয়া জুতো মেরামত করে নিলাম। কাঁটায় ছিঁড়ে যাওয়া পোশাকও সেলাই করে নিলাম। সামনে যে পথ পড়ে আছে, সেখানে মনুষ্য বসতি নেই, কাজেই নাকি খাবার পাওয়া দুষ্কর। তাই শস্য কিনে বোঝাই করতে লাগল আমার লোকেরা।
উকাওয়েন্ডি হয়ে উজিজির পথে।
১৭ই অক্টোবর ১৯৭১।
ম্রেরা গ্রাম ছাড়িয়ে আমরা এগিয়ে চললাম অজানার উদ্দেশ্যে। এখন আমার সঙ্গীদের ভিতর আবার উদ্দীপনা ফিরে এসেছে, আগের মতো বৈরি ভাব আর নেই। সামনে যদি মিরাম্বোও তার ডাকাতের দল নিয়ে দেখা দেয়, অনায়াসে আমরা তার মোকাবেলা করতে পারব বলেই মনে হয়। ফুর্তিটা এতটাই ফিরে এসেছে যে, মাব্রুকি বলেই বসল, সে নাকি টাঙ্গানাইকা হ্রদের মাছের গন্ধ পর্যন্ত পাচ্ছে। সবার রঙ্গরসিকতায় পথ চলা সহজ হতে লাগল।
জঙ্গল পাতলা হতে হতে তৃণভূমি এসে গেল। এখানে অনেক পিঁপড়ের ঢিপি। এইসব ঢিপিগুলো বর্ষার সময় তৈরি করে পিঁপড়েরা। কী চমৎকার কারিগরি! ঘরের ভিতর ঘর, হলের ভিতর হল, রাস্তাঘাট—স্থাপত্যশিল্পের অসাধারণ নিদর্শন! জীবন বাঁচাতে আর সুস্থ থাকতে ওরা আরামদায়ক বাসস্থান বানিয়ে চলে দিনরাত। এক-একটা ঢিপি হল এক-একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ পিঁপড়ে-শহর।
হঠাৎ করেই আমাদের সামনে যেন দেখা দিল এক স্রোতস্বিনী। একমাত্র যারা নোংরা নদীনালা আর গর্ত থেকে সংগ্রহ করে কাদাগোলা পূতিগন্ধময় জল খেয়ে জীবন বাঁচিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছে দিনের পর দিন, তারাই জানে স্নিগ্ধ স্বচ্ছ পানীয় জলের দেখা পেলে কতটা আনন্দে নেচে ওঠে মন। বহতা নদীটি নেমে এসেছে একটা অপূর্ব পাহাড় থেকে। সেদিকে চোখ পড়তে মনে হল, এর চাইতে রোমাঞ্চকর দৃশ্য আর হতে পারে না।
আমাদের সামনে এখন রাঙ্গোয়া নদীর অববাহিকা—এই নদীই গিয়ে মিশেছে লেক টাঙ্গানাইকাতে। নদীর ধারে তাঁবু খাটানো হল। রাঙ্গোয়া নদী আফ্রিকার দুই অঞ্চল—উত্তরে উসোয়া আর দক্ষিণে উফিফাকে ভাগ করেছে। তাঁবু খাটাতে না খাটাতে একদল কালো মানুষ এসে আমাদের ঘিরে ধরল। মাথার চুলের কায়দা আর সাজপোশাক দেখে তাদের জাঞ্জিবরের লোক বলে ভুল হয়। জানতে পারলাম দক্ষিণ উনিয়ামওয়েজির কাসেরা অঞ্চলের নেতা সিম্বা তাদের দূত হিসাবে আমার কাছে পাঠিয়েছে। সে আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায়, অবশ্যই কাপড়ের বিনিময়ে। সিম্বা স্বয়ং আমার সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারেনি বলে দুঃখপ্রকাশ করেছে। দুটি মূল্যবান রাজকীয় কাপড় আর দুটি ধুতি দিয়ে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে হল।
পরদিন তাঁবু গুটিয়ে চলা শুরু হল। এবার পথ একেবারেই মসৃণ নয়। পাহাড়ি পথ কখনও জলাভূমির মধ্যে দিয়ে চলে গেছে। কাদাজল পার হয়ে যেতে হচ্ছে। জমি এখানে কোথাও কোথাও বেশ পঙ্কিল। একটা হাতির পায়ের চাপে তৈরি হওয়া চওড়া গর্তে পড়ে গিয়ে গলা অবধি পাঁকে ডুবে গেলাম। কোনোরকমে উঠে এসে ভাবলাম জামাকাপড় ছাড়া প্রয়োজন। কিন্তু এতে সময় নষ্ট হবে ভেবে কাদা মেখে কালো ভূত সেজেই পথ চলতে লাগলাম।
ওয়াজিভরা পৌঁছলাম। সিম্বার পাঠানো লোকেরা আমাকে এইখানকার মানুষদের সম্বন্ধে সাবধান করে দিয়েছিল। তারা সিম্বার সঙ্গে যুদ্ধে রত। কিন্তু এখানে এসে কোনও শত্রু দেখতে পেলাম না। একটু এগোতেই চোখে পড়ল অজস্র পোড়া কুঁড়েঘর। বোঝা যাচ্ছে একসময় প্রচুর মানুষের বাস ছিল এখানে। ভাঙাচোরা পরিত্যক্ত গ্রামে আমরা বাসস্থান তৈরি করলাম সাময়িকভাবে।
ওয়াজিভরায় এসে আমি মোরগ শিকার করলাম তিনটে। একটা হরিণের পিছনে তাড়া করে দেখতে পেলাম অপূর্ব এক শঙ্কু আকৃতির ছোটো ছোটো পাহাড়ে ঘেরা নদী। প্রাকৃতিক দৃশ্যপট যেন আঁকা ছবির মতো। তাঁবু গুটিয়ে ওদিকেই রওনা দিলাম। ছয় ঘণ্টা চলার পর একটা ছোটো গ্রাম পাওয়া গেল। এখানেও মানুষ থাকে না, কিন্তু বাড়িগুলো প্রায় অক্ষত। এখানেই বিশ্রাম নেওয়ার জন্য থামতে হল। গ্রামবাসীদের হাতে ফলানো ফলের বাগানে অজস্র ফল পাওয়া গেল। পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে একটা ছোট্ট নদী। নদীতে মাছ ধরল আমার লোকেরা। জলের উপরে উড়ে বেড়াচ্ছে নানা জাতের পাখি। নদীর ধারে চরে বেড়াচ্ছে অজস্র হরিণ আর মোষ।
পরদিন আমরা টাম্বু নদীর ধারে পৌঁছলাম। এখানে জল বড়ো মিষ্টি। পাহাড় থেকে সোজা বয়ে এসেছে বলে ঠান্ডা আর পরিষ্কার জল। এই প্রথম আফ্রিকার এই এলাকায় এসে আমরা সিংহ আর চিতাবাঘের বাসা খুঁজে পেলাম।
আমাদের তাঁবুর সামনে যে দৃশ্যপট, তা শুধু একজন কবির পক্ষেই বর্ণনা করা সম্ভব। তাঁবু খাটানোর পর আমার পশুপালক নদীতে গাধা আর ভেড়াদের জল খাওয়াতে নামল। একটা সরু সুড়ঙ্গমতো পথ চলে গেছে নদীর দিকে। এই পথটা তৈরি হয়েছে হাতি আর গণ্ডারের চলাফেরার কারণে। অন্ধকার জায়গাটা দিয়ে পশুগুলো যখন জল খেতে নদীতে নেমেছে, ঠিক তখুনি কালো ডোরাকাটা একটা চিতাবাঘ ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। হিংস্র জন্তুটা একটা গাধার গলায় দাঁত ফুটিয়ে দিল। সেই আক্রমণে অন্য পশুরা এমন সমবেত চিৎকার-সহ লাফ দিল যে, চিতাবাঘটা ভয়ে শিকার ছেড়ে এক ছুট। আমি দৌড়ে গিয়ে দেখলাম, গাধাটার গলায় ক্ষত তেমন গভীর নয়, তবে রক্তপাত হচ্ছে।
ঘন অন্ধকার জঙ্গল দেখে মনে হল, যে-কোনো মুহূর্তে কোনও চিতাবাঘ বা সিংহ আমার উপরও ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। বেশ অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পেলাম। আমার বন্দুকবাহী কুলুলুকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকে পড়লাম জঙ্গলে। সন্তর্পণে আমরা জঙ্গলে ঢুকে আরও গভীরে যেতে লাগলাম, মনে আশা—যদি কপালগুণে হঠাৎ কোনও জঙ্গলের রাজার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। এখানে বিশাল বিশাল থামের মতো গাছ—এত উঁচুতে উঠে গেছে যে তাদের টিকি দেখার উপায় পর্যন্ত নেই। এক ফোঁটা সূর্যের আলো প্রবেশ করার রাস্তা দেয়নি ঘন গাছের পাতা। প্রতিটি অন্ধকার কোনায় সতর্ক চোখ মেলে আছি, হয়তো আমার মতো আজীব জন্তু দেখার অপেক্ষায় ঘাপটি মেরে বসে আছে কোনও মহাশয়। কিন্তু না, আমাকে কল্পিত আগন্তুকেরা হতাশ করল।
একটা ফাঁকামতো জায়গায় এলাম। এখানে পায়ের তলায় নুড়ি বিছানো জমি, একটা প্রকাণ্ড গাছ মাথার উপর ডালপালা মেলে দিয়ে আছে—মনে হচ্ছে আমিই জঙ্গলের রাজা, আর আমার মাথায় বিশাল ছাতা মেলে দাঁড়িয়ে আছে আমার ছত্রধর। হঠাৎ দেখি গাছের মাথায় একটা বাঁদর, আমাকে দেখে কিচকিচ শব্দ করে মুখ ভেংচাচ্ছে। প্রবল হাসি পেল। গলা খুলে, জঙ্গলের নিস্তব্ধতা ভেঙে অট্টহাস্য করতে লাগলাম। কিন্তু আমার হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। দলে দলে বাঁদরেরা আমাদের ঘিরে ধরল চারদিক থেকে। ওদের শান্তি ভঙ্গ করে যে বড়োই অপরাধ করে ফেলেছি, বুঝতে বাকি রইল না।
(ক্রমশ)