মূল: থর হেয়ারডাল
আগের কথা
তিরিশে জুলাই ১৯৪৭, সক্কালবেলা নজরদারের চোখে পড়ল একটা দ্বীপ। অভিযাত্রীদের মাথার ওপরে অজস্র সামুদ্রিক পাখির ঝাঁক। ঘুম ভেঙে সক্কলে জড়ো হল ভেলার ডেকে। মাস্তুলে চড়ে দেখা গেল দক্ষিণপূর্ব দিগন্তে আবছা পেন্সিল রেখার মতো একটুকরো ডাঙা। হিসেবনিকেশ করে দেখা গেল ওটা পুকাপুকা। দ্বীপের দিক থেকে বাতাস বয়ে আনছিল ধোঁয়ার গন্ধ। অভিযাত্রীরা জানল শেষমেষ তারা পলিনেশীয়াতে পৌঁছেছে। কিছুক্ষণ পর পুব দিগন্তে মিলিয়ে গেল দ্বীপটা। কনটিকি ভেসে চলল। পরের দিন আবার লক্ষ করা গেল দুটো নতুন মেঘের স্তূপ। ম্যাপ থেকে জানা গেল ওদিকের প্রবালদ্বীপ দুটো ফাংগাহিনা আর আঙ্গাটাউ। ভেলার মুখ করা হল আঙ্গাটাউয়ের দিকে। নীল জলের হ্রদঘেরা দ্বীপের চারপাশে দুর্ভেদ্য প্রবাল প্রাচীর। সেখানে বড়ো বড়ো ঢেউ ভেঙে পড়ছে। কাছাকাছি গেলে জলের প্রবল ঘূর্ণিতে ভেলা টেনে নিতে পারে। প্রাচীরের কোনো না কোনো অংশে কোনো ফাঁক দিয়ে ঢোকা যায় কিনা, এইবারে তার চেষ্টা চলতে লাগল। সারাদিন ধরে প্রাচীরের পাশ বরাবর চলেও কোনো উপায় হল না। দ্বীপের তীরভূমি, জঙ্গল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। এইবারে তার অধিবাসীদের দেখা গেল। এবং তার কিছুক্ষণের মধ্যে দুজন স্থানীয় লোক ক্যানোয় চড়ে প্রবাল প্রাচীর ডিঙিয়ে হাজির। অভিযাত্রীরা আশায় বুক বাঁধলেন। এইবারে নামা যাবে দ্বীপে। আরও চারটে ক্যানো এসে হাজির হল। চারটে ক্যানো এবং কিছু স্থানীয় মানুষ এবং ছয় অভিযাত্রী মিলে প্রবল সংগ্রাম শুরু হল। সন্ধ্যা হল, রাত নেমে এল, কিন্তু প্রাচীর ডিঙোনোর কোনো সুরাহা হল না। ন্যুট রাবারের ডিঙি চেপে স্থানীয়দের সর্দারের সঙ্গে চলে গেল। রাত বাড়ছে। দ্বীপ থেকে আসা বাকি স্থানীয় লোকগুলো হাল ছেড়ে ফিরে গেল। নইলে তাদেরও ফিরতে সমস্যা হবে যে। ভেলা ক্রমশ সমুদ্রের গভীরে পিছিয়ে যেতে লাগল। আলোর সংকেত দেখাতে থাকলেন অভিযাত্রীরা, যদি ন্যুট ফিরে আসে। রাত গভীর হল। তবু কেউ ফিরে এল না।
১৮
সাড়ে দশটা। দুলতে থাকা মাস্তুল থেকে বেঙ্গট নেমে আসছিল। এবারে অন্যের পালা। তখনি সচকিত হয়ে উঠলাম। সমুদ্রের মধ্যে অন্ধকারের ভেতর থেকে পরিষ্কার কারও গলা শোনা গেল। আবার, আবার শোনা গেল। পলিনেশীয়ান কথাবার্তা। ঘন আঁধারের ভেতর যতটা পারি গলা তুলে চিৎকার করে উঠলাম আমরা। ওরাও চিৎকার করে জানান দিল। বাকি অন্যান্যদের মধ্যে ন্যুটের গলাও ছিল। আমরা উত্তেজনায় যেন পাগল হয়ে গেলাম। যত ক্লান্তি সব উধাও হয়ে গেল; পাষাণভার নেমে গেল। আঙ্গাটাউ থেকে ভেসে সরে গেলেই বা কি? সমুদ্রে তো আরও দ্বীপ আছে। এখন এই নটা বালসা কাঠ, তাদের ভাসতেই তো সুখ, যতক্ষণ আমরা ছজন একসাথে ভেলার ওপরে আছি ওরা যেদিকে খুশিই ভেসে যেতে পারে।
অন্ধকারের ভেতর থেকে ঢেউয়ের মাথায় চেপে তিনটে আউট্রিগার ক্যানো বেরিয়ে এল আর সবার প্রথমে ন্যুট লাফ দিয়ে উঠে এল প্রিয় কনটিকিতে, পেছন পেছন আরো ছজন বাদামি চামড়ার লোক। বলা কওয়া ব্যাখ্যার সময় ছিল না, স্থানীয়দের উপহার টুপহার দিয়ে শিগগির বিদায় দিতে হবে, তাদের ফিরে যেতে হবে দ্বীপে, এক তুমুল দুঃসাহসিক যাত্রায়। ডাঙার কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না, আকাশেও তারা প্রায় নেই, এ অবস্থায় হাওয়া এবং ঢেউয়ের প্রতিকূলতায় তাদের বৈঠা বেয়ে দ্বীপে ফেরার সঠিক রাস্তা খুঁজে নিতে হবে যতক্ষণ না ডাঙার আগুনটা ফের চোখে পড়ে। সিগারেট এবং অন্যান্য উপহার দেবার পর, শেষ বিদায়ের সময় আন্তরিকভাবে তারা হাতে হাত মিলিয়ে গেল।
আমাদের জন্য ওরা সত্যিই খুব উদ্বিগ্ন ছিল; ওরা পশ্চিম দিকটা নির্দেশ করছিল, বোঝাচ্ছিল আমরা ভয়ঙ্কর প্রবালপ্রাচীরের দিকেই যাচ্ছি। সর্দারের চোখে জল, সে আমার চিবুকে আলতো করে চুমু খেল, আমি ঈশ্বরকে আমার দাড়ির জন্য ধন্যবাদ দিলাম। তারপর তারা গুটিগুটি ক্যানোয় ফিরে গেল আর আমরা ছজন কমরেড আবার ভেলার ওপরে একত্রে, একলা।
ভেলাকে নিজের মতো চলতে দিয়ে আমরা ন্যুটের গল্প শুনতে লাগলাম।
ন্যুট ভালো মনে সর্দারকে নিয়ে ডিঙি চেপে ডাঙার দিকে তো চলল। সর্দার নিজেই ছোট্ট দাঁড়টা বেয়ে প্রবালপ্রাচীরের ফাঁকটার দিকে বেয়ে চলেছিল। এমন সময় ন্যুট আশ্চর্য হয়ে দেখল কনটিকি থেকে ওকে ফিরে আসার আলোর সংকেত দেখানো হচ্ছে। ও সর্দারকে ফিরতে ইশারা করল বটে কিন্তু স্থানীয় লোকটি ওর কথা শুনতে অস্বীকার করল। ন্যুট তখন নিজে দাঁড়টা টেনে নিল কিন্তু স্থানীয় লোকটি ওর হাত থেকে দাঁড়টা ছিনিয়ে নিল। চারপাশে প্রবাল-প্রাচীরের উন্মত্ত ঢেউ, এসময় আকচাআকচি শুরু করার কোনো মানে হয় না। প্রাচীরের ফাঁক দিয়ে ওরা সোজা ভেতরে ঢুকে পড়ার পর একটা উঁচু ঢেউ ওদের তুলে নিয়ে দ্বীপের ওপরে বড়ো সুদৃঢ় একখন্ড প্রবালের ওপর নিয়ে ফেলল। পাড়ে দাঁড়ানো স্থানীয় মানুষেরা ডিঙিটা ধরে দ্বীপের ওপরের দিকে টেনে তুলে নিল এবং নারকেল গাছের নীচে ন্যুটের চারপাশে বিশাল ভিড় জড়ো হয়ে অজানা ভাষায় নানান কথা বলতে শুরু করে দিল। বাদামি রঙের, খালি-পা-ওয়ালা, মহিলা এবং শিশুরা ওকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে ওর শার্ট আর প্যান্টের কাপড় পরীক্ষা করে দেখছিল। ওরা নিজেরা পুরোনো ছেঁড়াফাটা ইউরোপীয় জামাকাপড় পরে ছিল অথচ দ্বীপে সাদা চামড়ার কোনো লোক ছিল না।
ন্যুট কয়েকটা চালাকচতুর লোককে পাকড়াও করল আর ইশারা করে ওদের বোঝানোর চেষ্টা করল যাতে ডিঙিতে উঠে ওর সাথে ফিরে যায়। তখন একটা মোটাসোটা লোক হেলতে দুলতে ন্যুটের কাছে এল, ও ভাবল লোকটা নিশ্চই সর্দার গোছের কেউ হবে, কেননা ওর মাথায় একটা পুরোনো ইউনিফর্মের টুপি ছিল আর ও বেশ কর্তৃত্ব নিয়ে উঁচু গলায় কথা বলছিল। সবাই সরে গিয়ে তার আসার পথ করে দিল। ন্যুট নরওয়েজিয়ান আর ইংরিজিতে বোঝাল যে ওর কিছু লোক দরকার যাদের নিয়ে ওকে ভেলায় ফিরে যেতে হবে এবং সেটাও ভেলাটা বহুদূরে ভেসে চলে যাবার আগেই। লোকটা হাসি হাসি মুখে তাকাল কিন্তু কিস্যু বুঝল না এবং ন্যুটের প্রবল প্রতিরোধ সত্ত্বেও গোটা হৈহট্টগোলের ভিড়টা ওকে গ্রামের মধ্যে ঠেলে নিয়ে চলল। ওখানে দেখা হল কুকুর শুয়োর আর দক্ষিণ সমুদ্রের সুন্দরীদের সাথে; তারা আবার সঙ্গে করে তাজা ফল নিয়ে এসেছিল। এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে ওরা ঠিক করেছিল যেকোনো মূল্যে ওকে ওই দ্বীপে রেখে দেবে, কিন্তু ন্যুট সে লোভে পড়ার বান্দা নয়; ও মনের দুঃখে পশ্চিমে মিলিয়ে যাওয়া ভেলাটার কথাই ভাবছিল। স্থানীয়দের মনোভাবটা স্পষ্ট। ওরা আমাদের সাহচর্যই চাইছিল, ওরা জানত যে সাদা চামড়াদের জাহাজে অনেক ভালো ভালো জিনিস আছে। ওরা যদি ন্যুটকে ডাঙায় রেখে দিতে পারে তাহলে বাকিরা আর অদ্ভুতদর্শন নৌকোটা নিশ্চিত এসে ভিড়বে। কোনো জলযান আঙ্গাটাউয়ের মতো একটা বেয়ারা দ্বীপে সাদা চামড়ার কোনো লোককে ফেলে চলে যাবে না।
আরো নানান অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হবার পর ন্যুট বেরিয়ে এসে ডিঙির দিকে ছুট লাগাল, চারপাশে মেয়েপুরুষের উৎসুক ভিড়কে সঙ্গে নিয়েই। ওর শরীরের অঙ্গভঙ্গী এবং আন্তর্জাতিক ভাষা আর না-বোঝার মতো ছিল না। ওরা বুঝেছিল ন্যুটকে অবশ্যই এই রাতেই বিচিত্র ভেলাটায় ফিরে যেতে হবে আর ও যাবেও; এও বুঝেছিল, যে ভেলাটারও খুবই ব্যস্ততা যে তাকেও তখুনি ভেসে যেতে হবেই।
তখন স্থানীয়রা আরেকটা ফন্দি খাটাল; ওরা ইশারায় বোঝাল যে বাকিরা অন্য দিক দিয়ে পাড়ে আসছে। কয়েক মিনিটের জন্য ন্যুট ধন্দে পড়ে গেল কিন্তু তখুনি বেলাভূমিতে থাকা মহিলা আর শিশুরা চেঁচামেচি করে উঠল, ওরা পাড়ের আগুনটা জ্বালিয়েই রেখেছিল। তিনটে ক্যানো ফিরে এসেছে। ক্যানোর লোকেরা ন্যুটকে এসে আমার চিরকুটটা দিল। তখন ওর মরিয়া অবস্থা। নির্দেশ ছিল একলা সমুদ্রে না যাবার, অথচ স্থানীয়দের কেউই একেবারে ওর সঙ্গে যেতে রাজি ছিল না।
স্থানীয়দের নিজেদের মধ্যে খুব একচোট হৈচৈ, চেঁচামেচি, তর্কাতর্কি চলল। যারা গিয়েছিল আর ভেলাটা দেখে এসেছিল তারা নিশ্চিতভাবেই বুঝেছিল যে ন্যুটকে ধরে রেখে আমাদের বাকিদের তীরে ভেড়ানোর আশা তেমন কার্যকরী হবে না। শেষমেষ সর্বজনবোধ্য উচ্চারণে ন্যুটের আশ্বাস, হুমকি, কনটিকিকে ধরার জন্য ওই তিনটে ক্যানোর নাবিকদের ওর সঙ্গে সমুদ্রে যাবার জন্য রাজি করাল। অতএব ওরা ওই রাতে ডিঙিটা পেছনে বেঁধে আবার সমুদ্রে বেরিয়ে পড়ল। বাকিরা আগুনের চারপাশে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল তাদের সোনালি চুলের বন্ধুটি যত দ্রুত এসেছিল তত দ্রুতই মিলিয়ে গেল।
ক্যানোগুলোকে ঢেউ উপরে তুলে দিতেই ন্যুট আর তার সঙ্গীরা দূর সমুদ্রে ভেলার হালকা আলোর সংকেতটা দেখতে পেয়ে গিয়েছিল। লম্বা সরু ছুঁচোলো পলিনেশীয় ক্যানোগুলো সঙ্গে আটকানো বাঁকানো ভাসান-কাঠ নিয়ে জলের মধ্যে ছুরির মতো কেটে চলল কিন্তু ভেলার মোটা গোল কাঠের গুঁড়িতে আবার পা না রাখা অবধি গোটা সময়টাকে ন্যুটের অনন্তকাল বলে মনে হচ্ছিল।
“পাড়ে দারুণ কাটালে?” টরস্টাইন হিংসুটে স্বরে জিজ্ঞাসা করল।
“ওহো, তুমি যদি হুলা মেয়েদের দেখতে!” ন্যুট ওকে খোঁচায়।
আমরা পাল নামিয়ে হাল তুলে রেখে বাঁশের কেবিনে ঢুকে পড়ি আর আঙ্গাটাউয়ের সৈকতের পাথরের টুকরোর মতো অসাড়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
তিনদিন সমুদ্রে ভেসে চললাম, একটাও ডাঙার দেখা নেই।
আমরা সোজা অশুভ টাকুমে এবং রারোরিয়া প্রবালপ্রাচীরের দিকেই ভেসে চলেছি, আমাদের ভেসে যাবার পথে, নাক বরাবর চল্লিশ পঞ্চাশ মাইল দূরে ওটার অবস্থান। আমরা প্রচণ্ড চেষ্টা চালালাম যাতে ওই ভয়ঙ্কর প্রাচীরের উত্তরে ঘুরে যেতে পারি এবং একদিন রাতে নজরদার তাড়াহুড়ো করে এসে আমাদের বাইরে ডেকে নেবার আগে অবধি সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল।
সেদিন দেখি, বাতাসের গতি বদলে গেছে। আমরা সোজা টাকুমে প্রাচীরের দিকেই চলেছি। বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছিল আর কিচ্ছুটি দেখা যাচ্ছিল না। প্রাচীরটাও খুব বেশি দূরে নেই।
মধ্যরাত্রে আমরা যুদ্ধকালীন মন্ত্রণাসভা বসালাম। এবারে মরণ-বাঁচন প্রশ্ন। উত্তরের দিক দিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার আশা এখন আর নেই। বরঞ্চ এখন দক্ষিণ দিক দিয়ে এড়িয়ে যাওয়ারই চেষ্টা করতে হবে। পাল গুটিয়ে রেখে, হাল নামিয়ে দিয়ে পেছন থেকে আসা অনিশ্চিত উত্তুরে হাওয়ায় এক বিপজ্জনক যাত্রা আরম্ভ হল আমাদের। পঞ্চাশ মাইল দীর্ঘ প্রবাল-দেওয়ালটা পেরিয়ে যাওয়ার আগেই যদি পুবের হাওয়া ফিরে আসে, আমরা তার পাল্লায় পড়ে সোজা গিয়ে দেয়ালে আছড়ে পড়ব।
সবাই মিলে ঠিক করলাম ভেলার আছড়ে পড়াটা অনিবার্য হলে কী করা হবে। আমরা কনটিকিতে, ভেলার ওপর যেকোনো মূল্যে টিকে থাকব। মাস্তুলের ওপর চড়া হবে না, কেননা ঝাঁকুনিতে ওখান থেকে পাকা ফলের মতো টুপ করে খসে পড়ব। কিন্তু ঢেউ আছড়ে পড়লে মাস্তুলের দণ্ডটা আঁকড়ে ধরে থাকব। রাবারের ডিঙিটা ভেলার ওপরে আলগা রাখা হল, তাতে জলনিরোধক রেডিও ট্রান্সমিটার, কিছু খাবার, জল আর ওষুধপত্র বেঁধেছেঁদে রাখা হল। যদি আমরা প্রবালপ্রাচীর ডিঙোতেও পারি আর তীরে গিয়ে খালি হাতে উঠি তাহলে যাতে আমাদের ছাড়াই ওটা ভেসে গিয়ে তীরে ভিড়তে পারে। কনটিকির একেবারে পেছনের দিকে একটা লম্বা দড়ি বাঁধা বয়া ফেলে রাখা হল যাতে সেটাও ভেসে তীরে গিয়ে ঠেকলে তা ধরে ভেলাটাকে টেনে আনা যায়, যদি সেটা প্রাচীরে কোথাও আটকে থেকে যায়। আমরা গুটি গুটি গিয়ে ভেতরে শুয়ে পড়লাম, বাইরে বৃষ্টির মধ্যে একা নজরদার রইল।
যতক্ষণ উত্তুরে বাতাস বজায় ছিল আমরা দিগন্তের নীচে ঘাপটি মেরে থাকা প্রবালপ্রাচীরের দেওয়াল বরাবর আস্তে আস্তে ভেসে চললাম। কিন্তু এক বিকেলে হঠাৎ বাতাস মরে এল, এবং আবার যখন বইতে শুরু করল, বাতাসের অভিমুখ হল এবারে পুব দিক থেকে। এরিকের গণনা অনুযায়ী আমাদের অবস্থান তখন এমন একটা জায়গায় যাতে আমাদের খানিকটা আশা জাগল যে আমরা হয়তো রারোরিয়া প্রাচীরের দক্ষিণতম বিন্দুটাকে এড়িয়ে গেলেও যেতে পারি। আমরা ওটাকে এড়িয়ে ঘুরে ওটার ভেতরের দিকে চলে যাবার চেষ্টা করব যাতে আরো দূরে ওপাশে থাকা অন্য প্রবাল প্রাচীরের পাল্লায় গিয়ে না পড়ি।
রাত হল, সমুদ্রে আমাদের একশো দিন পেরিয়ে গেছে। সেরাতে একটা অস্বস্তি আর অস্থিরতা নিয়ে জেগে উঠলাম। ঢেউয়ের নড়াচড়াটা কিছুটা অস্বাভাবিক মনে হল। কনটিকির গতিবিধিটা এরকম পরিস্থিতিতে যেমনটা হয়, ঠিক তেমন নয়। লগগুলির ওঠানামার ছন্দের পরিবর্তন সম্বন্ধে আমরা বেশ ওয়াকিবহাল ছিলাম। এক মুহূর্তে মনে হল, কোনো তীরভূমি থেকে জলের টানে ভেলাটা ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে, জল ক্রমাগত ডেকের ওপর থেকে মাস্তুল অবধি উঠে আসছে। সমুদ্র ছাড়া আর কিছুই নজরে পড়ছে না। শান্তিতে ঘুমোতে পারছিলাম না। সময় পেরিয়ে যাচ্ছিল।
সকালবেলা, ছটার ঠিক আগে, টরস্টাইন তাড়াহুড়ো করে মাস্তুলের ওপর থেকে নেমে এল। ও নারকেল গাছের সারি দেওয়া দ্বীপমালা দেখতে পেয়েছে দূরে। কিছু করার আগেই আমরা হালের দাঁড়টা যতটা পারি দক্ষিণদিক চেপে নামিয়ে দিলাম। টরস্টাইন যেটা দেখেছিল সেটা রারোরিয়া প্রবালপ্রাচীরের পেছনদিকে মুক্তোর মালার মতো ছড়ানো দ্বীপমালা। একটা উত্তুরে স্রোত নির্ঘাত আমাদের ধরে নিয়েছে।
সাড়ে সাতটার সময় নারকেল গাছে ঘেরা সাতটা ছোটো ছোটো দ্বীপ পশ্চিম দিগন্ত জুড়ে দেখা গেল। একদম দক্ষিণতম দ্বীপটা আমাদের ভেলার প্রায় মুখোমুখি। তার পরে পরেই ভেলার ডানদিকের দিগন্ত জুড়ে দ্বীপ আর তাতে পামজাতীয় গাছের ঝোপঝাড় দেখা গেল, ক্রমে ক্রমে সেগুলো বিন্দুর মতো উত্তরদিকে মিলিয়েও গেল। একদম কাছাকাছি যেটা সেটাও চার পাঁচ সামুদ্রিক মাইল দূরে।
মাস্তুলের ওপর থেকে ভালো করে দেখা গেল যে আমাদের ভেলাটা যদিও দ্বীপমালার একদম নীচের দ্বীপটা তাক করে আছে, কিন্তু আমরা আড়াআড়ি এতটাই বেশি ভেসে যাচ্ছি যে ঠিক আমাদের ভেলার মুখ-বরাবর আমরা এগোচ্ছি না। আমরা সোজা প্রাচীরের দিকে কোনাকুনি ভেসে চলেছি। সেন্টারবোর্ডগুলো ঠিকঠাক করে নিলে হয়তো খানিকটা আশা ছিল ভেলার মুখ ঘুরিয়ে প্রাচীরটাকে এড়ানো যেত। কিন্তু হাঙরেরা পিছু নিয়েছে যে, আর তারা খুব কাছাকাছিই আছে, ফলে জলের নীচে ডুব দিয়ে আলগা সেন্টারবোর্ডগুলো আবার নতুনভাবে শক্ত করে দড়ি দিয়ে আটকে নেওয়া কার্যত অসম্ভব।
দেখলাম যে আমাদের হাতে কনটিকির ওপরে থাকার মতো আর মাত্র কয়েকটা ঘণ্টা আছে। অবধারিত প্রবালপ্রাচীরে ভেঙে পড়ার আগে এসময়টাকে কাজে লাগিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে নিতে হবে। সকলেই জেনে নিল, যখন সেই মুহূর্তটা আসবে, কাকে কী করতে হবে। প্রত্যেকেই জানত যে যার নিজের ঘেরে কী কী দায়িত্ব, সুতরাং আমরা কেউই এদিক ওদিক ঘুরে অন্যের কাজে বাগড়া দেব না বিশেষত যখন প্রত্যেকটা মুহূর্তই খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাতাসের প্রবল ধাক্কায় কনটিকি ওপর-নীচ ওপর-নীচ করতে থাকল। কোনো সন্দেহই নেই প্রাচীরের জন্যই জলের এই আলোড়ন তৈরি হয়েছিল; কিছু ঢেউ সামনে এগিয়ে আসছে কিছু আবার পিছিয়ে গিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে চারপাশের দেওয়ালে ধাক্কা খাচ্ছে।
তখনো আশায় ছিলাম, তাই পাল তোলা ছিল, যাতে ভেলাটা ঘুরে গিয়ে প্রাচীর এড়াতে পারে। ক্রমশ পাশাপাশি ভাসতে ভাসতে কাছাকাছি হলে, মাস্তুলের ওপর থেকে দেখা গেল নারকেলগাছে ছাওয়া দ্বীপগুলো কীভাবে প্রবাল প্রাচীর দিয়ে যুক্ত হয়ে আছে, খানিকটা জলের ওপর খানিকটা নীচে। কোথাও কোথাও যেখানে সমুদ্র ফেনায় ফেনায় সাদা হয়ে আছে, ঢেউ সোজা ছিটকে ওপরে উঠে যাচ্ছে, সেখানে আঁচিলের মতো জেগে আছে প্রাচীরের অংশ। রারোরিয়া প্রবালপ্রাচীর ডিম্বাকার আর ব্যাস পঁচিশ মাইল, লাগোয়া টাকুমের প্রবাল প্রাচীরকে না ধরেই বলছি। প্রাচীরের মুখ পুরো দৈর্ঘ্য বরাবর পূর্ব সমুদ্রের দিকে, যেদিক থেকে আমরা এসে ঢুকছি। প্রবাল প্রাচীরটা দিগন্তের একদিক থেকে অন্য দিক অবধি এক সরলরেখায় বিস্তৃত, কয়েকশো গজ কেবল ছাড়া, আর তার পেছনেই শান্ত নীল হ্রদের চারপাশে এলিয়ে রয়েছে দ্বীপমালা, সারিবেঁধে, পরপর।
একটা মিশ্র অনুভূতি হচ্ছিল, আমাদের সামনে দিগন্ত জোড়া প্রশান্ত মহাসাগরের নীল জল ছিঁড়েখুঁড়ে আকাশের দিকে পাক খেয়ে খেয়ে উঠছে। আমি জানতাম আমাদের জন্যে কী অপেক্ষায় আছে; আমি এর আগে টুয়ামাটু দ্বীপপুঞ্জে এসেছি, নিরাপদে জমিতে দাঁড়িয়ে পুবের দিকে তাকিয়ে দেখেছি প্রবালপ্রাচীরের ওপরে প্রশান্ত মহাসাগরের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ার অসাধারণ দৃশ্য। দক্ষিণে ক্রমাগত নতুন নতুন প্রবাল-প্রাচীর আর দ্বীপের উদয় হচ্ছে। সম্ভবত প্রাচীরের সামনে ঠিক মাঝ বরাবর রয়েছি আমরা।
কনটিকিতে, অভিযানের অন্তিমপর্বের সমস্ত প্রস্তুতি সারা হয়ে গিয়েছিল। দামি সমস্ত জিনিস কেবিনের মধ্যে এনে বেঁধে রাখা হয়েছিল। সমস্ত কাগজপত্র, ফিল্ম এবং অন্যান্য জিনিসপত্র যেগুলো ভিজে গেলে নষ্ট হতে পারে, সব জলনিরোধক ব্যাগে ভরে রাখা হয়েছিল। পুরো বাঁশের কেবিনটা ক্যানভাস দিয়ে ঢেকে, বিশেষত শক্ত কাছি দিয়ে এপার ওপার করে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। যখন দেখলাম আর আশা নেই, বাঁশের ডেক খুলে ম্যাশেট ছুরি দিয়ে ভেলার নীচে বেঁধে রাখা সেন্টারবোর্ড-এর দড়িগুলো কেটে দেওয়া হল। সেন্টারবোর্ডগুলোয় পুরু হয়ে জেলিফিশ আটকে শক্ত হয়ে থাকায় ওপরে টেনে তোলাটা যথেষ্ট কঠিন হয়ে পড়েছিল। সেন্টারবোর্ড তুলে ফেলায় এখন ভেলাটা কাঠের লগগুলোর তলা অবধি মোটে ডুবে ছিল, ফলে আরো সহজেই আমরা প্রাচীরের ওপর দিয়ে ভেসে যেতে পারি। সেন্টারবোর্ডহীন, পাল গুটোনো অবস্থায় ভেলাটা আড় হয়ে ভেসে রইল, সম্পুর্ণ বাতাস আর ঢেউয়ের দাক্ষিণ্যে।
আমাদের সবচেয়ে লম্বা দড়িটা নিজেদের তৈরি নোঙরের সঙ্গে আটকে ভেলার বাঁদিকের মাস্তুলের গোড়ার দিকে বেঁধে রাখা হল। এতে করে নোঙর ফেলে দেওয়া হলে, কনটিকি তার ডানদিকের অংশ দিয়ে প্রথম ঢেউয়ের ওপরে উঠবে। জলের খালি ধাতব পাত্রে ব্যবহার-করা ব্যাটারি, ভারি ধাতুর টুকরো টাকরায় ভরে নোঙরটা বানানো হয়েছিল এবং তাতে আড়াআড়ি শক্ত ম্যানগ্রোভ কাঠ গুঁজে দেওয়া, ওগুলো পাত্রের এদিক ওদিক থেকে বেরিয়ে ছিল। পয়লা আর শেষ নির্দেশ ছিল একটাই, ভেলা আঁকড়ে থাকো। যাইই ঘটুক, আমরা ভেলার ওপরে শক্ত হয়ে টিকে থাকব আর প্রাচীরের সঙ্গে টক্করটা স্রেফ নখানা কাঠের গুঁড়ির ওপর ছেড়ে দেব। জলের ঝাপটা সহ্য করার জন্যে আমাদের সাধ্যের বাইরে গিয়ে লড়তে হত। যদি জলে ঝাঁপিয়ে পড়ি, জলের টানের কাছে অসহায় শিকার হয়ে পড়ব আমরা, আর ঢেউ আমাদের ধারালো প্রবাল প্রাচীরের ওপর ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলবে। ডিঙি চেপে গেলে প্রবল সমুদ্রের ঢেউতে হয় রবারের নৌকোটা উলটে যাবে অথবা আমাদের সঙ্গে নিয়ে ভারী রাবারের নৌকোটা প্রবাল প্রাচীরে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। কিন্তু কাঠের গুঁড়িগুলো এক না একসময় তীরে ভিড়বেই, আর যদি কোনোমতে আমরা ওর ওপরে টিকে যেতে পারি, তাহলে ভেলার সাথে আমরাও।
এরপর সবাইকে, গত একশোদিনে প্রথমবার, সব্বাইকে জুতো পড়ে ফেলতে বলা হল আর সঙ্গে লাইফ-বেল্ট তৈরি রাখতে বলা হল। শেষ সুরক্ষাটা অবশ্য কোনো কাজের হবে না কেননা জলে পড়া মানে সে লোকটা আছাড় খেয়েই মরবে, ডুবে মরতে হবে না। খানিকটা সময় ছিল, আমাদের পাসপোর্ট আর পকেটে সামান্য কিছু ডলার যা অবশিষ্ট ছিল সেটা নিয়ে নেবার জন্য। কিন্তু হাতে সময় না থাকাটা আমাদের সেটা করার জন্য ততটা ঝামেলায় ফেলেনি।
উদ্বেগজনক কয়েকটা ঘণ্টা ধরে অসহায়ের মতো পাশাপাশি ভাসতে ভাসতে একটু একটু করে প্রবাল প্রাচীরের দিকে এগোচ্ছিলাম আমরা। ভেলার ওপরে লক্ষনীয়ভাবে সব শান্ত চুপচাপ, আমরা কেবিন আর ডেকে ভিতর-বাইরে করছিলাম, নিঃশব্দে অথবা অল্প কিছু কথায় কাজ সেরে, যে যার নিজের নিজের দায়িত্বপালন করছিলাম। আমাদের গুরুগম্ভীর মুখগুলোই বলে দিচ্ছিল যে আগত ঘটনা সম্বন্ধে আমাদের কারো কোনো সন্দেহ ছিল না আর কোনোরকম স্নায়ুচাপ না থাকাটা বলে দিচ্ছিল যে ভেলাটার ওপর ক্রমশ আমাদের একটা দৃঢ় প্রত্যয় জন্মেছিল। ও যদি সমুদ্রে আমাদের এতটা পথ নিয়ে আসতে পারে, তাহলে পাড়েও ঠিক জীবিতই পৌঁছে দেবে।
কেবিনের মধ্যে মালপত্রের বাক্সপ্যাঁটরা বোঝাই, দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। টরস্টাইন কোনক্রমে এককোনে রেডিও কর্নারের ব্যবস্থা করে নিয়ে শর্টওয়েভ ট্রান্সমিটারটা চালু রেখেছিল। আমরা তখন কাল্লাও বন্দর থেকে ৪০০০ সামুদ্রিক মাইল দূরে ছিলাম; পেরুর নৌসেনার স্কুল আর আরো দূরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের দুজন শখের রেডিও অ্যামেচার, হল এবং ফ্র্যাংক আমাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছিল। কিন্তু আমাদের কপাল ভালো আগের দিনই আমাদের সঙ্গে কুক দ্বীপপুঞ্জের রারোটাঙ্গায় একজন দক্ষ হ্যাম রেডিও অপারেটরের যোগাযোগ হয়েছিল। অন্যান্যদের সঙ্গে এর তফাৎটা ছিল ওর সঙ্গে খুব সকালের দিকে যোগাযোগ হত, আলাদা করে, বাকিদের বাদ দিয়ে একটা অতিরিক্ত যোগাযোগ। যতক্ষণ আমরা প্রাচীরের দিকে ভেসে ভেসে চললাম ততক্ষণ টরস্টাইন বসে বসে রারোটাঙ্গাকে বার্তা পাঠাতে লাগল। কনটিকির লগবুকে লেখাঃ-
৮-১৫ খুব ধীরে ধীরে ডাঙার দিকে এগোচ্ছিলাম। এখন খালি চোখেই ভেলার ডানদিকে দ্বীপের পাম গাছগুলোকে আলাদা আলাদা নজর করতে পারছিলাম।
৮-৪৫ বাতাস হঠাৎ করে ঘুরে গেল, আমাদের পক্ষে অসুবিধেজনকই হল সেটা, প্রবালপ্রাচীর এড়িয়ে যাবার কোনো আশাই নেই। ভেলায় আমাদের কোনো স্নায়ুচাপ ছিল না কিন্তু ঝটপট কিছু প্রস্তুতি নেওয়া হল। আমাদের সামনে প্রাচীরের ওপরে কিছু একটা আছে, অনেকটা ভাঙাচোরা জাহাজের মতো দেখতে; কিন্তু হতেও পারে ওগুলো ভেসে আসা একগাদা গাছের গুঁড়ি।
৯-৪৫ বাতাস আমাদের শেষ দ্বীপটার দিকে নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু একটাকে আমরা প্রাচীরের ঠিক অপরদিকেই দেখতে পাচ্ছি। এখন আমরা গোটা প্রবালপ্রাচীরটাকেই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। দ্বীপগুলোর সামনে একটা বেল্টের মতো লাল-সাদা রঙের খোঁচা খোঁচা দেওয়ালটা সামান্য একটুখানি জলের ওপরে জেগে আছে। গোটা প্রাচীর বরাবর সাদা উত্তাল ঢেউ আকাশের দিকে ফুঁসে উঠছে। বেঙ্গট সবেমাত্র খুব ভালো একটা গরম খাবার পরিবেশন করল, বড়োসড়ো লড়াইটার আগে শেষ খাবার।
প্রাচীরের ওপরে ওটা একটা ভাঙাচোরা জাহাজই। আমরা এখন এতটাই কাছে যে প্রাচীরের ওপাশে উজ্জ্বল হ্রদের ওপার অবধি দেখতে পাচ্ছি আর ওপারে অন্য দ্বীপগুলোর সীমারেখাও দেখতে পাচ্ছি।
এটা যখন লেখা হচ্ছে আবার একটা ঢেউ ফুঁসে উঠেছে; গোটা প্রাচীর জুড়েই ঢেউটা উঠল, বাতাসে ঘুরন্ত জলের ঢেউয়ের আওয়াজ ভরপুর, কনটিকির শেষ উত্তেজক কাজটার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে যেন।
৯-৫০ এখন আরো কাছে। প্রাচীর বরাবর ভেসে চলেছি। মাত্র শখানেক গজ দূরে। টরস্টাইন রারোটাঙ্গার লোকটার সাথে কথা বলছে। খতম। এখুনি লগবুক বন্ধ করতে হবে। সবাই টগবগ করছে; গতিক সুবিধের নয়, কিন্তু আমরা পেরে যাব ঠিক।
কয়েক মিনিট বাদে নোঙর ফেলা হল আর সেটা সেটা নীচে গিয়ে আটকালো। এতে করে কনটিকি ঘুরে যেতে পেছনদিকটা প্রাচীরের মুখোমুখি হল। নোঙরটা ফেলাতে খানিকটা মূল্যবান সময় হাতে এল, টরস্টাইন পাগলের মতো বেতারযন্ত্রের চাবি টিপে যাচ্ছিল। ও সবে রারোটাঙ্গার সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছে। প্রাচীরের উত্তাল ঢেউয়ের সাথে সাথে সমুদ্রও ভয়ঙ্করভাবে ফুলে উঠে নীচে আছড়ে পড়ছে। সবাই এখন ডেকের ওপর কাজে ব্যস্ত, আর এইমাত্র টরস্টাইন বার্তাটা পাঠাতে পারল। ও জানিয়ে দিল আমরা রারোরিয়া প্রাচীরের দিকে ভেসে চলেছি। ও রারোটাঙ্গাকে প্রতি ঘণ্টায় একই কম্পাঙ্কে বেতার সংকেত শুনতে বলল। ছত্রিশ ঘণ্টার বেশি সময় কোনো বার্তা না পেলে রারোটাঙ্গা যেন ওয়াশিংটনের নরওয়ে দূতাবাসে খবর দেয়। টরস্টাইনের শেষ বার্তাটা ছিল এরকমঃ
“ব্যস। পঞ্চাশ গজ বাকি। চললাম। বিদায়।”
তারপরেই ও রেডিও বন্ধ করল। ন্যুট কাগজপত্রগুলো ভরে আটকে দিল আর দুজনেই যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে এসে ডেকে আমাদের সাথে যোগ দিল। ততক্ষণে এটা পরিষ্কার যে নোঙর ছিঁড়ে গেছে।
ঢেউগুলো ক্রমশ বড়ো, আরো বড়ো, বিরাট বিরাট হতে শুরু করেছে, দুটো ঢেউয়ের মাঝের অংশের গভীরতাও বেড়েছে আর ভেলাটা কেবল ওপরে উঠছে নেমে আসছে, উঠছে আর নামছে, ক্রমশ তার উচ্চতাও একটু একটু করে বেড়ে চলেছে।
চিৎকার করে সতর্ক করে দেওয়া হল, “আঁকড়ে থাকো প্রানপণে, মালপত্র নিয়ে ভেবো না, স্রেফ আঁকড়ে থাকো।”
আমরা জলপ্রপাতের এতটাই ভেতরে আর কাছে চলে গিয়েছিলাম যাতে আর গোটা প্রাচীরের ওপরে ঢেউগুলো ভেঙে পড়ার আওয়াজ কানে আসছে না। কেবল সবচেয়ে কাছের ঢেউটা পাথরের ওপরে ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবার আলাদা আলাদা বুম বুম আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি।
সক্কলে টানটান, তৈরি, যে যার মতো সুবিধেজনক দড়ি শক্ত করে ধরে আছে। কেবল শেষ মুহূর্তে এরিক গুঁড়ি মেরে কেবিনে ঢুকেছিল, তখনো একটা কাজ করা হয়নি ওর, নিজের জুতোটা ও খুঁজে পায়নি।
ভেলার পেছনের অংশে কেউ দাঁড়িয়ে নেই কেননা ওদিকেই প্রথম ধাক্কাটা প্রাচীরে গিয়ে লাগবে। ডেকের পেছনদিক থেকে মাস্তুল টানা দেওয়া দড়িদুটোর জায়গাও নিরাপদ জায়গা ছিল না। কেননা মাস্তুলটা ভেঙে পড়লে ভেলার বাইরে প্রবালপ্রাচীরের ওপরেই ঝুলতে থাকবে। হারম্যান, বেঙ্গট আর টরস্টাইন কেবিনের দেয়ালের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে রাখা কয়েকটা বাক্সের ওপর উঠে বসেছিল। হারম্যান ছাতের ওপর দিয়ে টানা দেওয়া দড়িটা ধরে রেখেছিল, আর বাকি দুজন মাস্তুলের সঙ্গে বাঁধা পালের দড়িগুলো ধরে রেখেছিল। আমি আর ন্যুট ঠিক করেছিলাম ভেলার সামনে থেকে মাস্তুলে টানা দেওয়া দণ্ডটা ধরে রাখব কারণ মাস্তুল, কেবিন সমস্তকিছু ভেসে সমুদ্রে চলে গেলেও ভেলার সামনে বাঁধা দন্ডটা আর যাই হোক ভেলার ওপরেই থাকবে, কেননা ভেলার সামনেটা এখন সমুদ্রের দিকে মুখ করে আছে।
যেই বুঝলাম এইবারে পুরোপুরি সমুদ্রের ঢেউয়ের পাল্লায় পড়ে গেছি, অমনি নোঙরের দড়িটা কেটে দেওয়া হল আর অমনি ভেলাটা ছিটকে গেল। বিরাট একটা ঢেউ ভেলার নীচ থেকে উঠে আমাদের শূন্যে তুলে ফেলল। চরম মুহূর্তটা এসে গেল, ঢেউয়ের ওপর দিয়ে আমরা তীব্র বেগে ছুটে চললাম, আমাদের লঝঝড়ে ভেলাটা ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ করতে করতে থরথর করে কাঁপতে থাকল পায়ের তলায়। উত্তেজনায় রক্ত ফুটতে থাকল। আমার মনে আছে, উৎসাহব্যঞ্জক আর কোনো কিছু না পেয়ে আমি হাত তুলে নাড়তে নাড়তে গলা ফাটিয়ে বলে উঠলাম, “হুররে!”; খানিকটা হালকা করল পরিস্থিতিটা, ক্ষতি তো নেই। অন্যরা নির্ঘাত ভেবেছিল আমার মাথাটা গেছে, কিন্তু সবাই বেশ উৎসাহভরেই হাসল। সমুদ্রের ঢেউয়ের ধাক্কায় আমরা তখন ছুটে চলেছিলাম, এইবারে কনটিকির অগ্নিপরীক্ষা। সবকিছু ঠিকঠাক হবে, হতেই হবে।
আমাদের উৎসাহ শিগগিরই নিভে গেল। ঝকঝকে সবুজ কাচের দেয়ালের মতো একটা নতুন ঢেউ উঠল আমাদের পেছন দিক বরাবর। আমরা নীচে যেতেই ঢেউটা পাক দিয়ে আমাদের পেছন পেছন তাড়া করে এল আর ঠিক সেই একই মুহূর্তে আমি দেখলাম ওটা ঠিক আমার মাথার ওপরে; আমি প্রচন্ড একটা আঘাত অনুভব করলাম আর সঙ্গে সঙ্গেই তুমুল জলের নীচে ডুবে গেলাম। সারাটা শরীর দিয়ে অনুভব করতে পারছিলাম জলের প্রবল টান, শরীরের শেষ বিন্দু শক্তি নিংড়ে দিতে হচ্ছিল টিকে থাকার জন্য, একটা কথাই আউড়ে যাচ্ছিলাম মনে মনে, আঁকড়ে থাকো, আঁকড়ে থাকো! এরকম মরণবাঁচন পরিস্থিতিতে যা হয়, মস্তিষ্ক হাত ছেড়ে দেবার নির্দেশ দেবার আগেই অবশ্যম্ভাবীভাবে হাত ছুটে যায়। তারপরেই অনুভব করলাম বিশাল জলের তোড়টা নেমে যাচ্ছে আর ওর মরনকামড় শরীর থেকে আলগা হয়ে আসছে। বিরাট জলের পাহাড়টা কানফাটানো গর্জন করে এসে ভেঙে পড়ার সময় আমি আবার দেখতে পেয়েছিলাম ন্যুট শরীরটা গুটিয়ে নিয়ে দু-হাত-পা দিয়ে আমার পাশেই ঝুলছে। পেছন দিক থেকে বিশাল সমুদ্রটা নিষ্প্রাণ আর বিবর্ণ লাগছিল। জলের তোড় যেই ধেয়ে এল, সেটা জলের ওপর জেগে থাকা কেবিনের ছাতের ওপর দিয়ে বয়ে গেল; তিনজন ওখানে ঝুলছিল। জল ওদের ওপর দিয়ে বয়ে যাবার সময় ওরা কেবিনের ছাদে লেপটে আঁকড়ে ধরে ছিল।
আমরা তখনও সমুদ্রে ভেসেই ছিলাম।
এক লহমায় আমি ভালো করে আবার হাত পা বেড় দিয়ে শক্ত করে ‘স্টে’-র দণ্ডটা আঁকড়ে ধরলাম। ন্যুট নেমে পড়ে বাঘের মতো লাফ মেরে বাক্সগুলোর ওপরে গিয়ে উঠল বাকিদের সঙ্গে। ওখানে কেবিনটাই সব ঝাপটা সামলাচ্ছিল। ওরা হৈ হৈ করে বলল, সব ঠিক আছে কিন্তু এক্কবারে সেই সময়েই আমি দেখছিলাম একটা নতুন সবুজ রঙের দেয়াল ক্রমশ উঁচু হয়ে উঠে আমাদের দিকেই আসছে। আমি চেঁচিয়ে ওদের সতর্ক করলাম আর যতটা পারি গুটিয়ে গিয়ে যেখানে ঝুলছিলাম সেখানেই শক্ত করে ধরে রইলাম। পরমুহূর্তে আমাদের ওপর ভয়াল ব্যাপারটা ঝাঁপিয়ে পড়ল আর কনটিকি সম্পূর্ণ জলের তলায় ডুবে গেল। সমুদ্র তার সর্বশক্তি দিয়ে মানবদেহগুলোকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলছিল। দ্বিতীয় ঢেউটা ইতিমধ্যে আমাদের দিকে ছুটে আসছিল, তার পেছনে তৃতীয়টা, একইরকম।
এমনসময় ন্যুটের একটা উল্লাস-চিৎকার শুনলাম, “ভেলাটা দেখো। এখনও টিকে আছে!”; ও এখন দড়ির মইতে ঝুলে আছে।
তিনটে উপুর্যুপুরি ঢেউয়ের আঘাতের পর কেবল মাস্তুলের আর কেবিনের একটু করে অংশ ভেঙেছে। মনে হল, এই চারপাশের বিরুদ্ধ আবহাওয়ায় যেন আমরা একপ্রস্থ জয়লাভ করেছি, আর এটাই আমাদের নতুন করে শক্তি জোগাল।
তারপর দেখি কী, যে পরের ঢেউটা উঁচু হয়ে উঠছে, সেটা আগেকার সবগুলোর চেয়েও উঁচু; যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাস্তুল খাড়া রাখার জন্য সামনের দণ্ডটার যতটা ওপরে পারা যায়, উঠে, শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে ধরতে আবার চিৎকার করে পেছনের দিকে থাকা অন্যদের সতর্ক করলাম। তারপর পাশাপাশি উঁচু হয়ে ওঠা সবুজ দেওয়ালের মতো জলের গভীরে আমি নিজেই অদৃশ্য হয়ে গেলাম। যারা একটু পেছনে ছিল, তারা আমাকে প্রথমে জলের ভেতর অদৃশ্য হতে দেখে জলের উচ্চতার একটা আন্দাজ করেছিল, পঁচিশ ফুট মতো। যে কাচের মতো দেওয়ালের জলের গভীরে আমি অদৃশ্য হয়ে গেছিলাম, তার ওপরে ঢেউয়ের সাদা ফণা আরো প্রায় পনেরো ফুট উঁচু হয়ে ছিল। তারপর ওই বিশাল ঢেউটা ওদের গ্রাস করল আর সেসময় আমরা প্রত্যেকে একটা কথাই শুধু ভাবছিলাম – আঁকড়ে থাকো, আঁকড়ে থাকো, আঁকড়ে থাকো!
ততক্ষণে বোধহয় প্রাচীরে ধাক্কা মেরে দিয়েছি। মাস্তুলের স্টে-র ওপরে টানটা টের পেয়েছিলাম আমি, ওটা ঝাঁকুনি খেয়ে একটু আলগা হয়ে বেঁকে গিয়েছিল। কিন্তু ঝুলে থাকার জন্য আঘাতটা ওপর থেকে না নীচে থেকে এসেছিল সেটা বলতে পারব না। ডুবে থাকাটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য ঘটেছিল কিন্তু সেটা আমাদের শরীরের স্বাভাবিক সহ্যক্ষমতার অনেক বেশী দাবী করে। মানুষের শরীরের কলকব্জা, শুধুমাত্র পেশীশক্তি নয়, তার চেয়েও অনেক অনেক বেশি শক্তি ধরে। আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম, যদি মরতেই হয়, ওখানে ওইভাবেই মরব, স্টের ওপরে একটা গিঁটের মতো। সমুদ্রের ঢেউ আমাদের ওপর তীব্রভাবে আছড়ে পড়ে ডুবিয়ে আবার সরে গেলে আমাদের চোখের সামনে লুকিয়ে থাকা একটা দৃশ্য ফুটে উঠল যেন। কনটিকি আমূল বদলে গেছে, যেন কোনো জাদুকাঠির ছোঁয়ায়। সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস, সমুদ্রে আমরা যে কনটিকিকে চিনতাম সে আর নেই; কয়েক সেকেন্ডে আমাদের সাধের পৃথিবী লন্ডভন্ড হয়ে ভেঙেচুরে গেছে।
ভেলার ওপরে আমার পাশে কেবল একটা লোককে দেখলাম। কেবিনের ছাতে সে উপুড় হয়ে পড়ে, মুখ নীচে, দুহাত দুদিকে ছড়ানো। আর গোটা কেবিনটা ভেলার বাঁদিক ঘেঁষে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পেছনে হেলে পড়ে রয়েছে। স্থির দেহটা হারম্যানের। কোথাও আর জীবনের কোনো চিহ্ন নেই। পর্বতপ্রমান জল শুধু প্রবালপ্রাচীরে আছড়ে পড়ে চলেছে। বাঁপাশের মাস্তুলটা দেশলাইকাঠির মতো ভেঙে গেছে আর ওর ডগাটা ভেঙে পড়ে কেবিনের ছাত ফুঁড়ে ঢুকে গেছে। এতে করে গোটা মাস্তুল তার দড়িদড়া পাটাতন সহ বাঁপাশেই কাত হয়ে প্রবালপ্রাচীরের ওপরে পড়ে রয়েছে। পেছনদিকের হালের অংশটা মুচড়ে দৈর্ঘ্য বরাবর ঘুরে গেছে, আড়াআড়ি কাঠগুলো ভাঙা, হালের বৈঠাটা টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। ভেলার সামনে জল কেটে চলার জন্য লাগানো বোর্ডগুলো চুরুটবাক্সের মতো ভেঙে আছে, আর গোটা ডেকের বাঁশের বেড়াগুলো, ছিঁড়েখুঁড়ে ভেজা কাগজের মতো কেবিনের সামনের দেওয়ালে লেপ্টে। তার সঙ্গেই একত্রে যত বাক্স, কৌটো, ক্যানভাস, আর বাকি মালপত্র। বাঁশের লাঠি আর দড়িগুলো সর্বত্র জট পাকিয়ে আছে; এককথায় পুরো ছত্রখান অবস্থা।
আমার সারা শরীর দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। আমার একলা টিকে থেকে কী লাভ হল? এইবেলা আমি যদি একটা লোককেও হারাই, পুরো ব্যাপারটাই জলে যাবে, আর শেষ একসঙ্গে খাওয়ার পর এই সময় একটাই মাত্র মানুষকে দেখা যাচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তেই টরস্টাইনের ঝুঁকে-পড়া মূর্তিটা ভেলার বাইরে অংশে দৃশ্যমান হল। মাস্তুলের দড়িদড়া থেকে ও ব্যাটা বাদরের মতো ঝুলে ছিল, কোনোক্রমে আবার লগগুলোর ওপরে উঠে এসে হামাগুড়ি দিয়ে বিধ্বস্ত কেবিনটার দিকে এগোল। হারম্যানও, এইবারে মাথাটা ঘুরিয়ে আমার দিকে চেয়ে কষ্ট করে হাসল, কিন্তু নড়ল না। ক্ষীণ আশা নিয়ে আমি বাকিদের খোঁজে চেঁচাতেই শুনতে পেলাম বেঙ্গট শান্ত গলায় বলছে যে সক্কলেই ভেলার ওপরে আছে। ওরা দড়ি ধরে তুবড়ে যাওয়া শক্ত বাঁশের বেড়ার ওপাশে এলিয়ে পড়েছিল।
সবটাই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে গেল। ইতিমধ্যে উলটো স্রোতের টানে কনটিকি ডাইনির রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। আর একটা নতুন করে ওঠা ঢেউ ওর দিকে এবারে ধেয়ে আসছে। শেষবারের মতো আমি ঢেউয়ের গর্জন ছাপিয়ে গলা ফাটিয়ে চেঁচালাম,“আঁকড়ে ধরো!” কেবলমাত্র ওইটুকুই করতে পেরেছিলাম; আঁকড়ে থেকেই আমাদের ওপর ঝাপটে পড়া জলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলাম আবার দুই, তিন অনিঃশেষ মুহূর্ত। আমার জন্য ওটুকুই যথেষ্ট। আমি দেখলাম কাঠের গুঁড়িগুলোর মাথাটা ক্রমাগত প্রাচীরের ওপরের না উঠে ধারালো প্রাচীরের গায়ে ধাক্কা মারছে। তারপর আবার জলের টানে তলিয়ে গেলাম। আমি দুজনকে কেবিনের ছাতে টানটান শুয়েও থাকতে দেখলাম কিন্তু কেউই হাসল না আর। লন্ডভন্ড জিনিসগুলোর ওপাশ থেকে একটা শান্ত কন্ঠস্বর শোনা গেলঃ
“এটা পারবে না।”
আমিও সমান হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। মাস্তুলটা আরো আরো বাঁপাশে ঝুলে পড়েছিল, আবিষ্কার করলাম, আমি একটা আলগা দড়িতে ভেলার বাইরে ঝুলছি। পরের ঢেউটা এল। সেটা যখন চলে গেল, আমি হা-ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, আর আমার তখন একটাই চিন্তা কোনোমতে লগগুলোর ওপরে উঠে, বাঁশের স্তূপের আড়ালে শুয়ে পড়া। ঢেউ সরে গেলে প্রথমবার আমাদের নীচে খোঁচা খোঁচা লাল প্রবাল দেখতে পেলাম, আর বুঝলাম টরস্টাইন গুটিশুটি মেরে চকচকে প্রবালের ওপরে দাঁড়িয়ে। হাতে ধরা মাস্তুল থেকে ঝুলে থাকা একগোছা দড়ি। ন্যুট ভেলার পেছনে দাঁড়িয়ে ঝাঁপ মারার জন্য তৈরি। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম সব্বাই লগগুলোর ওপরে ওঠো; টরস্টাইন জলের তোড়ে ভেসে গিয়েছিল, অমনি বেড়ালের মতো লাফ দিয়ে উঠল।
দুটো কি তিনটে ঢেউ এল আরো, আমাদের ওপর, কিন্তু তোড়টা কম, আর তখন কী কী ঘটল সে আর মনে নেই, খালি মনে আছে, প্রতিবারই ঢেউ এসে সরে যেতে আমি আরো একটু প্রবাল প্রাচীরের কাছাকাছি ঝুঁকে পড়ছিলাম; ঢেউ আমাদের সেই প্রাচীরের ওপরেই তুলে দিয়েছিল। তখন কেবল ঢেউয়ের চূড়ার নোনতা জলটুকুই ছিটকে আসছিল আমাদের ওপর, আমি কোনোমতে গিয়ে ভেলার ওপরে উঠলাম। প্রাচীরের ওপরে যে লগগুলো সবচেয়ে ওপরের দিকে উঠে গিয়েছিল, সেদিকে গিয়েই সকলে মিলে উঠলাম।
সেসময়েই ন্যুট নীচু হয়ে ভেলার পেছন থেকে একটা আলগা ফেলে রাখা দড়ি হাতে প্রাচীরের ওপরে লাফ দিয়ে পড়ল। ফেরতা ঢেউয়ের টানে জলের ঘূর্নিতে ও তিরিশ গজ মতো ভেসে গেলেও পরের ঢেউটা আসতে আসতেই দড়ির শেষ মাথা ধরে নিরাপদেই দাঁড়াতে পারল, ঢেউটা ঢিমে হয়ে চ্যাটালো প্রাচীরের ওপর থেকে ফিরে গেল।
তারপর ভাঙাচোরা কেবিনের ভেতর থেকে জুতো পায়ে এরিক বেরিয়ে এল। ও যা করেছে, আমরা সকলেই তা করলে অল্প আয়াসেই এব্যাপারটা কাটিয়ে ওঠা যেত। কেবিনটা ভেসে যায়নি, কেবল ক্যানভাসের তলায় তুবড়ে নীচে বসে গিয়েছিল। এরিক ওর ভেতরেই মালপত্রগুলোর মাঝে চুপচাপ টানটান হয়ে পড়েছিল আর মুহুর্মুহু ওপরে ভেঙে পড়া ঢেউয়ের গর্জন শুনছিল; বাঁশের দেওয়ালগুলো নীচের দিকে বেঁকে গিয়েছিল। মাস্তুলটা পড়ার ফলে বেঙ্গট আঘাত পেয়ে অল্পক্ষণ অচেতন হয়ে পড়েছিল, কিন্তু ওও গুঁড়ি মেরে ভাঙাচোরা কেবিনের নীচে এরিকের পাশে চলে যেতে পেরেছিল। অগুনতি বেঁধে রাখা দড়ি আর বাঁশের বাতাগুলো মূল লগগুলোর সঙ্গে জলের চাপ সহ্য করেও অমন টিকে থাকবে একথা আগেভাগে বুঝতে পারলে আমরা সকলেই গিয়ে ওর তলাতেই শুয়ে থাকতাম।
এরিক এবারে ভেলার পেছনদিকের গুঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে প্রস্তুত। ঢেউটা সরে যেতেই ও লাফ দিয়ে প্রাচীরের ওপর এসে দাঁড়াল। এরপর হারম্যানের পালা, তারপর বেঙ্গট। প্রতিবারই ভেলাটা একটু একটু করে ভেতরের দিকে ঢুকে আসছে। টরস্টাইন আর আমার পালা যখন এল, তখন ভেলাটা প্রাচীরের সমতল জায়গার ওপর এতটাই উঠে এসেছে যে তখন আর ওটা থেকে লাফানোর কোনো মানে নেই। সবাই মিলে এবারে ওটার উদ্ধারকার্যে লাগলাম।
প্রাচীরের সবচেয়ে ভয়ানক বাধাটা পেরিয়ে এসে এখন আমাদের দূরত্ব তা থেকে কুড়ি গজ। ওখানেই ওপাশে, সমুদ্রের ঢেউ ফুঁসে উঠছে আর ওর আরো পেছন থেকেই সমুদ্রের ঢেউ একটার পর একটা সার বেঁধে ধেয়ে আসছে। প্রবালকীটেরা গোল রিঙের মতো প্রাচীরটা এমন উঁচু করে বানিয়েছে যে উঁচু ঢেউয়ের মাথাটুকুই শুধু প্রাচীর পেরিয়ে আমাদের পাশ দিয়ে ভেতরের হ্রদে ঢুকতে পারছিল। আর তাতে মাছের সংখ্যা প্রচুর। এখানে প্রবালের রাজ্যে তারা মহানন্দে নিজেদের নানান আকারে আর বিভিন্ন রঙবেরঙে সাজিয়ে রেখেছে।
প্রাচীরের বেশ খানিকটা ভেতরে অন্যান্যরা রাবারের ডিঙিটা খুঁজে পেল, ওটা ভাসছিল বটে, এদিকে ভেতরটা জলে টইটম্বুর। ওরা ওটার মধ্যে থেকে জল ফেলে দিয়ে ভাঙা ভেলাটার কাছে টেনে আনল। ওর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো তোলা হল, যেমন রেডিওসেট, খাবার দাবার আর জলের বোতল। আমরা জিনিসপত্রগুলো সব প্রাচীরের ওপর দিয়ে টেনে টেনে বিশাল একখণ্ড প্রবালের ওপর রাখলাম। প্রাচীরের ভেতরের দিকে প্রবাল-খণ্ডটা বিচ্ছিন্ন একটা উল্কাখণ্ডের মতো পড়ে ছিল। তারপর আমরা আবার ভেঙে পড়া ভেলাটা থেকে আরো কিছু জিনিসপত্র আনতে গেলাম। কেননা, জানা ছিল না, জোয়ারের সময় চারপাশের সমুদ্র কদ্দুর উঠে আসবে।
প্রবালপ্রাচীরের ভেতরের দিকে অগভীর জলে সূর্যের আলোয় কিছু একটা চকচক করছিল। জল ঠেলে ঠেলে ওটা তুলে আনতে গিয়ে দেখি দুটো খালি কৌটো। ওখানে এটা আমরা মোটেই আশা করিনি, এবং আমরা আরো আশ্চর্য হলাম যখন দেখলাম ছোটো বাক্সগুলো বেশ সুন্দর আর সবে খোলা হয়েছে, ওপরে লেখা “আনারস”, যেমনটা আমাদের পরীক্ষামূলক নয়া ফিল্ডরেশনের গায়ে দেখেছি। নির্ঘাত ওগুলো আমাদেরই আনারসের টিন, শেষ যেগুলো খাওয়া দাওয়ার পর কনটিকি থেকে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। আমরা ওদের পেছন পেছনই প্রবালপ্রাচীরে উঠে এসেছি।
আমরা এবড়ো-খেবরো ধারালো প্রবালপ্রাচীরের ওপরে দাঁড়িয়ে, নীচটা উঁচু-নীচু, কোথাও গোড়ালি-জল, কোথাও বুক সমান, প্রবালের বুকে যেমন যেমন খাতে জল বয়ে গেছে, সেইমতো। গোটা প্রবালপ্রাচীরটা প্রবাল আর অ্যানিমনের দৌলতে মস, ক্যাকটাস আর লাল, সবুজ, হলুদ আর সাদা রঙের অস্মীভূত উদ্ভিদে ঢাকা রক গার্ডেনের মতো চেহারা নিয়েছে। হেন রঙ নেই যেটা ওখানকার প্রবাল বা শ্যাওলা বা ঝিনুক বা সামুদ্রিক কীট অথবা চমৎকার খেলে বেড়ানো মাছেদের গায়ে নেই। গভীর খাতগুলোতে ছোটো ছোটো চারফুট লম্বা হাঙর স্ফটিকস্বচ্ছ জলে এসে ঘোরাঘুরি করছে। আমাদের কেবল জলে হাত দিয়ে থাবড়ালেই হচ্ছিল, ওরা ঘুরে দূরে সরে যাচ্ছিল।
আমরা যেখানে আটকা পড়েছিলাম সেখানে আমাদের চারপাশে ছোটো ছোটো জলাশয় আর ভিজে প্রবালপ্রাচীর; আর খানিকটা দূরে শান্ত হ্রদ। প্রতিটা ঢেউ সরে যেতেই দেখছি আমাদের চারপাশের জল থেকে সারাক্ষণ নতুন নতুন প্রবাল এসে প্রাচীরে জড়ো হচ্ছে। আর অন্যদিকে প্রবাল প্রাচীরে ঢেউ অবিরাম গর্জন করে করে এসে আমাদের খানিক তলাতেই আছড়ে পড়ে সরে যাচ্ছে, নীচে নেমে যাচ্ছে, ঠিক যেখান থেকে উঠেছিল। জোয়ারের জল বাড়লে এই সরু প্রাচীরের ওপরে কী হবে তা একেবারেই অনিশ্চিত। সুতরাং আমাদের এখান থেকে সরে যেতেই হবে।
প্রাচীরটা উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত আধডোবা দুর্গের প্রাচীরের মতো। একদম দক্ষিণপ্রান্তে লম্বা লম্বা পামজাতীয় গাছের জঙ্গলে ঢাকা একটা লম্বাটে দ্বীপ। আর আমাদের ঠিক উত্তরে, মাত্র ছ-সাতশো গজ দূরে আরেকটা অপেক্ষাকৃত ছোটো নারকেল গাছে ছাওয়া দ্বীপ। এটা প্রাচীরের ভেতরের দিকে, নারকেল গাছগুলো আকাশের দিকে মুখ তুলে রয়েছে, সাদা বালির সৈকত স্থির হ্রদের জল অবধি ছড়ানো। পুরো দ্বীপটা ফুলে ঠাসা একটা সবুজ ঝুড়ির মতো অথবা এক টুকরো স্বর্গ যেন।
এই দ্বীপটাই বেছে নিলাম আমরা।
হারম্যান আমার পাশেই একমুখ দাড়ি নিয়ে হাসিহাসি মুখে দাঁড়িয়েছিল। ও একটাও কথা বলেনি, শুধু হাত ছড়িয়ে নিঃশব্দে হাসছিল। প্রাচীরের ওপরে খানিকটা দূরে কনটিকি, জল ছিটকে ছিটকে পড়ছিল ওর ওপরে। ভাঙাচোরা বটে তবু যথেষ্ট সম্মানজনক অবস্থায়। ডেকের ওপর সবই ভেঙেচুরে গেছে কিন্তু ইকুয়েডরের কুইভেদো অরণ্যের নখানা বালসা কাঠ একটুও টসকায়নি, একইরকম আছে। ওরাই আমাদের জীবন বাঁচিয়েছে। সমুদ্দুরে আমাদের মালপত্র অল্পই ভেসে গেছে, কেবিনের ভেতরে রাখা মালপত্রের অবশ্য কিচ্ছুটি যায়নি। ভেলার যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র আমরাই তুলে এনেছি, যেগুলো এখন নিরাপদে প্রাচীরের ভেতরের দিকে বিরাট পাথরটার ওপরে রোদ্দুরে রাখা আছে।
ভেলা থেকে নেমে পড়েছি বলে সত্যি সত্যি ভেলার সামনের পাইলট মাছের ঝাঁকের ছোটাছুটির অভাবটা অনুভব করছি। এখন বিশাল গুঁড়িগুলো প্রাচীরের ওপরে ছইঞ্চি জলের ওপরে পড়ে রয়েছে, বাদামি সামুদ্রিক কীট ভেলার সামনেটায় গাদাগাদি করে রয়েছে, পাইলট মাছেরা উধাও। ডলফিনরাও নেই। কেবল ময়ুরের মতো চিত্রবিচিত্র আর ভোঁতা লেজবিশিষ্ট একধরণের অজানা চ্যাপ্টা মাছ গুঁড়িগুলোর মধ্যে খুব কৌতূহলে একবার করে ঢুকছে আর বেরোচ্ছে। আমরা একটা নতুন পৃথিবীতে পৌঁছেছি। জোহান ওর গর্ত থেকে চলে গিয়েছিল। নিশ্চিতভাবেই ও এখানেই আরেকটা লুকোনোর জায়গা পেয়ে গেছে।
আমি শেষবারের মতো ভাঙা ডেকটার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম আর তখনই একটা ছিতরে যাওয়া বাক্সের মধ্যে ছোট্ট চারাটা দেখতে পেলাম। নারকেলের একটা চোখ থেকে আঠারো ইঞ্চির চারাটা বেরিয়েছিল, আর নীচ দিয়ে দুটো শেকড়। জল ঠেলে ঠেলে একহাতে নারকেল চারাটা নিয়ে এগোলাম। আমার একটু আগে আগে খুব আনন্দে জল ঠেলে ঠেলে ডাঙার দিকে চলেছে ন্যুট, হাতে ধরা ভেলাটার একটা মডেল, যেটা ও যাত্রাপথে নিজের হাতে বানিয়েছিল। অল্পক্ষণেই আমরা বেঙ্গটকে পেরিয়ে এলাম। ও চমৎকার রাধুনি ছিল। মাথায় ইয়াব্বড়ো একটা আলু, দাড়ি বেয়ে সমুদ্রের জল গড়িয়ে পড়ছে, বেঙ্গট কুঁজো হয়ে জলের ওপর দিয়ে একটা বাক্স ঠেলে ঠেলে চলেছে। পেছন থেকে ঢেউয়ের ধাক্কায় হ্রদের ভেতর খানিকটা জল ঢুকে এলেই বাক্সটা ওর সামনে নাচতে নাচতে ভাসতে ভাসতে চলেছে। ও গর্ব করে বাক্সের ঢাকনাটা তুলে দেখাল। ওটা আমাদের রান্নার-বাক্স। ভেতরে প্রাইমাস স্টোভ আর রান্নার বাসনকোসন যত্ন করে রাখা।
প্রবালপ্রাচীর থেকে আড়াআড়ি জল ঠেলে ওই স্বর্গের মতো দ্বীপটায় যাওয়াটা কখনো ভুলব না। যত কাছে আসছিল প্রতিমুহূর্তে ওটা একটু একটু করে বড়ো হচ্ছিল। রোদেলা বেলাভূমিতে পৌঁছেই আমি জুতোটুতো খুলে গরম বালির ওপর পায়ের আঙুলগুলো ঠেসে ধরলাম। বালির বুকে প্রথম পড়া পায়ের প্রতিটা ছাপ আমি উপভোগ করছিলাম; ছাপগুলো সৈকত থেকে গাছের গোড়া অবধি চলে গেছে। ক্রমশ মাথার ওপর গাছের ছায়া, আমি চলতে চলতে ছোট্ট দ্বীপটার কেন্দ্রে চলে এলাম। গাছের ওপরে সবুজ নারকেল ঝুলে আছে, ঘন ঝাঁকড়া ঝোপে থোকা থোকা বরফ-সাদা ফুল ফুটে ছেয়ে আছে। এত সুন্দর গন্ধ আর সম্মোহনী যে আমি প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ছিলাম। দ্বীপের ভেতরের দিকে দুটো টার্ন, যেন প্রায় পোষমানা, কাঁধের ওপরে উড়ে এল। ঠিক মেঘের মতো হালকা আর সাদা। পায়ের পাশ থেকে ছোটো গিরগিটি ছিটকে গেল; দ্বীপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাসিন্দা ছিল বড়ো বড়ো লাল রঙের সন্ন্যাসী কাঁকড়া। চতুর্দিকে হেলতে দুলতে চলেছে, পেছনে ডিমের মতো শামুকের খোল আটকে রয়েছে।
আমি সম্পূর্ণ বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। আমি হাঁটুগেঁড়ে বসে পড়লাম আর শুকনো গরম বালিতে হাতের আঙুলগুলো ঠেসে ধরলাম।
যাত্রা সম্পূর্ণ হয়েছিল। আমরা সকলে বেঁচেও ছিলাম। দক্ষিণ সমুদ্রের ছোট্ট দ্বীপটার তীর বরাবর ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। কী চমৎকার দ্বীপ! টরস্টাইন এল, বস্তাটা একপাশে ছুঁড়ে, চিত হয়ে বালির ওপরে শুয়ে পড়ল, ওপরে গাছের মাথা দুলছিল, পাখিরা উড়ছিল হালকা পালকের মতো, ঠিক আমাদের মাথার ওপরে নিঃশব্দে গোল হয়ে চক্কর কাটছিল। শিগগিরই আমরা ছজনই একসঙ্গে বালিতে শুয়ে। হারম্যান বরাবরই অতিসক্রিয়, ও একটা ছোটো গাছে উঠে এককাঁদি কচি ডাব পেড়ে আনল। আমাদের ম্যাশেট ছুরি দিয়ে ওপরটা কেটে ফেলে, বিশ্বের সবচেয়ে সুস্বাদু এবং সতেজ পানীয় গলায় ঢেলে দিলাম। মিষ্টি, ঠান্ডা ডাবের জল। প্রবাল প্রাচীরের বাইরে থাকা স্বর্গের দরজায় পাহারাদারদের থেকে একঘেয়ে গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ আসছে। “স্বর্গের দরজাটা একটু স্যাঁতসেতে”, বেঙ্গট বলল, “কিন্তু স্বর্গটা মোটামুটি যেমন ভেবেছিলাম তেমনই।”
আমরা মাটিতেই টানটান হয়ে শুয়ে নারকেলগাছের মাথার ওপর দিয়ে পশ্চিম দিকে উড়ে যাওয়া আকাশের সাদা মেঘের দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে ছিলাম। এখন আর আমরা অসহায়ের মতো ওদের অনুসরণ করছি না। আমরা এখন পলিনেশীয়ার একটা স্থির, অনড় দ্বীপে শুয়ে আছি।
আর যখন এমনি শুয়ে আছি, বাইরে একের পর এক ঢেউ ভেঙে পড়ছে প্রবালপ্রাচীরে, গোটা দিগন্ত জুড়ে কেবল আসছে -যাচ্ছে, আসছে-যাচ্ছে ।
বেঙ্গট ঠিক বলেছিল; এটাই স্বর্গ।
ক্রমশ