আত্মাহীন দেহ ‘জোম্বি’দের অবিশ্বাস্য কাহিনী
দীপঙ্কর বসু
১৯৩৬ সাল। উত্তর আমেরিকার ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের একটি দেশ ‘হাইতি’তে একদিন এক গোলা- বাড়িতে নগ্ন অবস্থায় ঘুরে বেড়াতে দেখা গেল একটি মেয়েকে। বাড়ির লোকেরা মেয়েটিকে ধরে এনে তার এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ জানতে চাইলে সে শুধু একটা কথাই বলতে লাগলো যে এটা তার নিজের বাড়ি। ডেকে আনা হল গোলা বাড়ির মালিককে। তিনি জানালেন যে মেয়েটি তার বোন যার হঠাৎ মৃত্যু হয়েছিল ১৯০৭সালে। সরকারি নথিপত্র এনে তিনি দেখালেন যে মৃত্যুর পরে বোনকে কবরও দেওয়া হয়েছিল। ডেকে আনা হল মহিলার স্বামীকে। তিনিও চিনতে পারলেন তার প্রথম স্ত্রীকে এবং সমর্থন করলেন তার শ্যালকের প্রতিটি কথা। ঘটনাটি জানা গিয়েছিল জোরা হার্সটনের লেখা একটি প্রতিবেদন থেকে। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও হাইতিতে এটা মোটেই কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। এই ধরণের মানুষকে হাইতিতে বলা হয় ‘জোম্বি ‘। ‘জোম্বি’রা হল প্রাণহীন মানুষ, যাদের চোখে থাকে মৃতের চিহ্ন, যারা চলে বিশ্রীভাবে টলতে টলতে। কথা বলে জোম্বি’রা ভাঙা গলায় ফিসফিস করে। হাইতির লোকেরা বিশ্বাস করে জোম্বি’রা হলো আত্মাহীন শরীর বা চলমান মৃত। জোরা হার্সটনের বিবরণ জানার পরেও হাইতির বাইরের মানুষরা এই চলমান মৃতদের ব্যাপারটি বিশ্বাস করে নি। ফলে এই ‘জোম্বি’দের নিয়ে অনেক কল্পবিজ্ঞান আর ভয়ের সিনেমা তৈরি হলেও এদের নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে কোনও উৎসাহ বা কৌতূহল তৈরি হয় নি। ‘জোম্বি’দের নিয়ে প্রথম সিনেমা তৈরি করেন ভিক্টর হ্যালপেরিন ১৯৩২ সালে। নাম ‘হোয়াইট জোম্বি’। এরপর ‘নাইট অফ দি লিভিং ডেড’, ‘ডন অফ দি ডেড’, ‘ওয়ার্ল্ড ওয়ার জেড’,’ ওয়ান কাট অফ দি ডেড’ ইত্যাদি অনেক জনপ্রিয় সিনেমা তৈরি হয় জোম্বিদের নিয়ে। সিনেমার দৌলতে জোম্বি শব্দটি প্রচার পেলেও এরা হয়ে ওঠে এক কল্প জগতের মানুষ।
হাইতিতে কিন্তু ১৫১২ সাল থেকেই পশ্চিম আফ্রিকার অধিবাসীদের ক্রীতদাস করে আনার সঙ্গে চলে এসেছে জোম্বিকরণের ধারা। মানুষকে জোম্বি বানানোর পদ্ধতি এসেছে ভুডু ধর্মীয় পদ্ধতি থেকে। পুরোহিত ‘বোকোর’ একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষকে ভগবানের কাছে নিবেদন করত সমাজের শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য। এরপর নিবেদন করা মানুষটির মৃত্যু হলে তাকে তাড়াতাড়ি কবর দেওয়া হত। সমবেত বিশ্বাসী মানুষেরা পরে ফিরে আসত ওই রাত্রেই একটি নির্দিষ্ট জায়গায়। জোরে জোরে ড্রাম বাজাতে বাজাতে ভগবানের নাম করে গান গাইতো তারা। তারপর গান গাইতে গাইতে শোভাযাত্রা করে যেত কবরস্থলে।
কবর খোঁড়া হত ‘বোকোর’এর নির্দেশে। ‘বোকোর’ তখন মৃতের মাথায় প্রচন্ড জোরে মারতে মারতে মৃতের নাম ধরে ডাকতো। আস্তে আস্তে মৃতের জীবন ফিরে আসতো, কিন্তু তাদের কোনও ইচ্ছাশক্তি আর ফিরে আসতো না। তখন এই চলমান মৃতকে পুরোহিতরা ব্যবহার করতো ক্রীতদাস হিসেবে। জোম্বিদের বিষয়টি বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো ১৯৭৯ থেকে ১৯৮১ এর মধ্যে পরপর তিনটি একই রকমের ঘটনা প্রকাশ পাবার পর। আমেরিকার বিজ্ঞানী ওয়েড ডেভিস এই তিনটি ঘটনার উপর ব্যাপক অনুসন্ধান চালান।অ্যাঞ্জেলিনা নারসিসে নামের এক মহিলা তার ভাই ক্লেরভিয়াসকে মৃত্যুর পর কবর দিতে দেখেছেন বলে দাবী করেন।তিনি ক্লেরভিয়াসের ‘জোম্বি’ হয়ে ফিরে আসারও প্রমাণ দেন। এর ফলে প্রমাণিত হয় ‘জোম্বি’ মহিলা বা পুরুষ যে কেউ হতে পারে। ডেভিস এইসব বিভিন্ন তথ্যের সাহায্যে প্রমাণ করেন চলমান মৃতদের প্রত্যেকটি ঘটনা সত্যি। তিনি অনুসন্ধান করে দেখলেন ‘জোম্বি’ তৈরিতে পুরোহিতরা ব্যবহার করতো এক বিষাক্ত পদার্থ। এই বিষাক্ত পদার্থ তৈরি হতো বিভিন্ন গাছগাছড়া, পাফার মাছ , সামুদ্রিক ব্যাঙ, পোকার সমন্বয়ে। এসব জিনিস থেকে তৈরি বিষাক্ত দানা ত্বকে কিংবা কোনও ক্ষতে ভালো করে ঘষে দেওয়া হতো। এর ফলে কমে যেত বিপাকীয় গতি, শরীরের তাপমাত্রা কমে যেত, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আড়ষ্ট হয়ে যেত। চোখের মণি প্রথমে ছোট হয়ে যেত তারপর আস্তে আস্তে বড় হতো। এর ফলে যদিও মানুষটির জ্ঞান থাকতো কিন্তু অবশ হয়ে যেত সারা দেহ। দেখে মনে হত না যে শরীরে প্রাণ আছে। বহু ডাক্তার তাই ভুল করে রোগীদের মৃত বলে ঘোষণা করতো। বিজ্ঞানী রয়সিন বিজ্ঞানী ডেভিসের সংগ্রহ করা বিষাক্ত পদার্থ ইঁদুর এবং বানরের দেহে প্রয়োগ করে একই ফল পেয়েছেন।
বিজ্ঞানী ডেভিস ও অন্যান্য বিজ্ঞানীদের মতে জোম্বিদের এই সাময়িক মৃত্যুর কারণ হল বিষাক্ত পদার্থের মধ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক টেট্রোডোটক্সিনের উপস্থিতি। নিউরনকে উত্তেজিত করার ব্যাপারে এই রাসায়নিকের বিশেষ ভূমিকা আছে। এই রাসায়নিক সোডিয়াম আয়নের পরিবহনে বাধা সৃষ্টি করে। এর ফলে শরীর অবশ হয়ে যায় এবং আস্তে আস্তে ঘনিয়ে আসে সাময়িক মৃত্যু। দেখা গেছে যদি চলমান মৃতদের খাবারে নুনের পরিমাণ কম দেওয়া যায় তবে জোম্বি অবস্থা চালাবার জন্য বারবার বিষাক্ত পদার্থ প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। পরীক্ষায় এটাও জানা গেছে যদি শরীরে সোডিয়ামের অভাব থাকে তবে টেট্রোডোটক্সিন শরীরে প্রবেশ করলে টিস্যু অতিরিক্ত সুবেদী হয়ে ওঠে। তবে টেট্রোডোটক্সিনের প্রভাবে মানুষের আচার আচরণে পরিবর্তন করা সম্ভব এটা অনেক বিজ্ঞানী মেনে নিলেও ,মৃতের প্রাণ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারটিতে এখনও তাঁদের সংশয় আছে। যে সব বিজ্ঞানী এটি সম্ভব বলে মনে করেন তাঁরা দুটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। সম্প্রতি বিজ্ঞান গবেষণার বিখ্যাত পত্রিকা ‘নেচার’এ ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক জন গবেষক দাবি করেছেন যে মরে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরে মৃত শুয়োরের মস্তিষ্ক এবং অন্য কিছু কোষের স্বাভাবিক কাজকর্ম ফিরিয়ে আনতে তাঁরা সক্ষম হয়েছেন। ২০১১ সালে আরেকটি ঘটনায় কেলি ড্যুয়ার নামের এক ভদ্র মহিলা জমে যাওয়া পুকুরে পড়ে মারা যান। ডাক্তাররা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করার পাঁচ ঘন্টা পরে তাঁর হৃদপিণ্ড আবার নিজে থেকেই চলতে শুরু করে। বিগত তিন বছর ধরে আমেরিকার বায়োকোয়ার্ক নামের একটি কোম্পানি চিকিৎসকদের মতে মৃত এমন ২০ জন মানুষকে পুনরায় জীবিত করা যায় কি না তা নিয়ে একটি গবেষণা প্রকল্প শুরু করেছেন। জোম্বিদের নিয়েও বিস্তর গবেষণা চলছে।আশা করা যায় ভবিষ্যতে আরও অনেক কিছু জানা যাবে ‘জোম্বিদের’ সম্বন্ধে। আর তার ফলে সিনেমা দেখে জোম্বিদের সম্পর্কে ‘নরমাংসভোজী,মহামারীতে আক্রান্ত এক ভয়ংকর মানুষ’ – এরকম যে ধারণা সাধারণ মানুষদের মধ্যে জন্মেছে তার আমূল এক পরিবর্তন হবে, এমনটাই মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।