মিরাকল শব্দটা তোমরা নিশ্চয়ই শুনেছ। অভাবনীয় কোনও কিছু ঘটে গেলে আমরা বলি মিরাকল ঘটেছে। মজার ব্যাপার হল, মিরাকল যে কীভাবে ঘটে, তা কেউ জানে না। বিশ্বের সেরা জাদুকর ডেকে একবার বলো দেখি, ‘ও মশাই, একখানা মিরাকল ঘটিয়ে দেখান তো!’ আমি নিশ্চিত তিনিও ঘেমে-নেয়ে অস্থির হবেন। মিরাকল একপ্রকার জাদু, তবে কখনো-কখনো মানুষই তা ঘটিয়ে দেয়। তোমরা যখন সাহিত্যিক ও ক্রীড়া সাংবাদিক মতি নন্দীর লেখা পড়বে, তখন দেখবে ‘কোনি’ উপন্যাসের এক জায়গায় তিনি বলেছেন, মেডেল শুধুমাত্র একটা ধাতব চাকতি নয়। ওর মধ্যে আসলে একটা কথা লেখা থাকে—মানুষ সব পারে! আজ তোমাদের তেমনই একটা মিরাকলের কথা বলব। এই মিরাকল মানুষ ঘটিয়েছিল এবং তা ঘটেছিল ফুটবল মাঠে।
ফুটবল খেলাটা তো তোমরা কমবেশি সকলেই দেখেছ। অদ্ভুত সহজ একটা খেলা। জটিল নিয়মকানুনের বিশেষ বালাই নেই। এমনকি শব্দটাতেও দেখ কোনও যুক্তাক্ষরও নেই। জানো, স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে এই খেলার এক অদ্ভুত যোগাযোগ রয়েছে! শ্রীরামকৃষ্ণদেব প্রয়াত হবার পরে সব গুরুভাইরা একসঙ্গে থাকতেন। যোগাভ্যাস করতেন, ধ্যানে মগ্ন হয়ে থাকতেন। ঠান্ডা শীতের রাতে লেপ তো দূরের কথা, চাদরও থাকত না। তখন কুস্তি লড়ে শীত সইয়ে নিতেন। তেমনই এক সময়, যখন বাঙালিদের মধ্যে ধীরে ধীরে ফুটবল খেলার যুগান্তর আনতে শুরু করেছেন শ্রী নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী, বিবেকানন্দ একদিন কয়েকটি ছেলেকে দেখেন ফুটবল খেলতে। তখনও খেলাটা সম্পর্কে তেমন ধারণা তাঁর ছিল না। তিনি তাঁর সঙ্গীদের প্রশ্ন করেন, “হ্যাঁ রে, এটা কী খেলা রে?”
তারা তখন বিবেকানন্দকে ফুটবল সম্বন্ধে বলেন। শুনে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন তিনি। বলেন, “বেড়ে খেলাটা তো রে!”
স্বামীজির এহেন উত্তেজনা একটি খেলার প্রতি, এটা ঠিক হজম হয় না বাকিদের। তারা প্রশ্ন করেন, “কেন, কী এমন আছে খেলাটার মধ্যে?”
বন্ধুরা, এরপরের কথাটা লিখতে গিয়েছে হাত কেঁপে যায়। আমাদের জীবন যেন এমন চিন্তার মধ্যে দিয়ে জারিত হয়। সিমলাপাড়ার নরেন্দ্রনাথ দত্ত উত্তর দেন, “ভেবে দেখ, একটা বল জুটিয়ে এতজন একসঙ্গে খেলছে। তারা ভুলে গেছে কে তাদের ভাই, কে তাদের আপন-পর। তারা ভুলে গেছে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, কী তাদের ধর্ম। তাদের লক্ষ্য একটাই, গোল করা। একটা লক্ষ্যের পিছনে ছুটে তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। এমন সমাজেরই তো স্বপ্ন দেখি আমরা, তাই না?”
কথা থেকে কথায় চলে যাচ্ছিলাম, তাই আবারও ফিরে আসি মিরাকলের উপকূলে। এবার আমরা একটা কাট নিয়ে হাঁটব পিছন দিকে। শোনা যাচ্ছে দর্শকের চিৎকার, রেফারির বাঁশি। বিশ্বকাপ ফুটবল চলছে সুইজারল্যান্ডে।
সময়টা ১৯৫৪ সাল। বিশ্বকাপে সে-বার হাঙ্গেরির দলটা দুর্ধর্ষ। ফেরেঙ্ক পুসকাস, ককসিস, হিদেকুটি—সব তখনকার একেকজন তারকা। এ বলে আমায় দ্যাখ, তো ও বলে আমায়। বিশ্বকাপেও তারা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল। সকলে বলত ওরা নাকি টেলিপ্যাথিতে ফুটবল খেলে। ছোটোবেলা থেকে একসঙ্গে বেড়ে উঠেছে সকলে। ওরা দৌড় শুরু করার আগেই জানে কে কোথায় থাকবে। এমন একাদশের সঙ্গে পেরে ওঠা সত্যিই মুশকিল। বাস্তবেও তার অন্যথা হল না। প্রথম ম্যাচেই দক্ষিণ কোরিয়াকে নয় গোলে হারিয়ে জয়যাত্রা শুরু কর তারা। সেই যাত্রা এমন গতিতে চলল যে, কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলকে ৪-২ এবং সেমি ফাইনালে উরুগুয়েকে ৪-২ গোলে হারিয়ে খেতাব জয়ে শেষ যুদ্ধে পশ্চিম জার্মানির মুখোমুখি হল তারা। বলতে ভুলে গেছি, এই পশ্চিম জার্মানিকেই গ্রুপ লিগে ৮-৩ গোলে হারিয়েছিল পুসকাসরা।
যাই হোক, পশ্চিম জার্মানির কোচের নাম সেপ হারবারগার। জার্মানির হয়ে নিজে খেলেছেন, বিশ্বযুদ্ধেও লড়েছেন। সেই যুদ্ধে দু-বারের হারের যন্ত্রণা আর ক্ষত সমগ্র মননে আর শরীরে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তিনি। ফাইনালের আগে তাঁর হাতে তখনও দিন কয়েক সময় ছিল। তিনি ভাবতে বসলেন কী করা যায়। হাঙ্গেরির এই দলকে কীভাবে আটকাবেন তিনি? এরই মধ্যে তুমুল বৃষ্টি শুরু হল বার্নে। সে এমন বৃষ্টি, মাঠ জলকাদায় একেবারে বেহাল অবস্থা হয়ে গেল। বৃষ্টির সোঁদা গন্ধে মাতোয়ারা হওয়ার সময় বা ইচ্ছে কোনোটাই ছিল না সেপ হারবারগারের। ফাইনাল নিয়ে দুশ্চিন্তা, মনকে অন্য দিকে ফেরানোর তাগিদে তিনি ফোন করে বসলেন তাঁর বহুদিনের পুরোনো বন্ধু অ্যাডলফ ডেসলারকে।
হারবারগারের এই বন্ধুটি প্রথম জীবনে রুটি তৈরি করতেন। তারপর একসময় রাজায় রাজায় যুদ্ধের বোড়ে সাজার জন্য বিশ্বযুদ্ধে লড়তে যান। যখন ফিরে আসেন, তখন জার্মানির অর্থনীতি তলানিতে। ডেসলার ভাবতে থাকেন কী করবেন তিনি। তখন অকস্মাৎ তাঁর জুতো প্রস্তুত করার কথা মনে হয়। ডেসলালের বাবা ক্রিস্টফ একসময় জুতোর কারখানায় কাজ করতেন। ফলে জুতো সেলাইয়ের প্রাথমিক পাঠ বাবার থেকেই পেয়েছিলেন তিনি। অ্যাডলফ আর তাঁর ভাই রুডলফ দুজনে মিলে মায়ের রান্নাঘরে বসে জুতো প্রস্তুত করা শুরু করেন। একসময় যেখানে রুটি তৈরি হত, সেখানেই রুটি জোগাড়ের তাগিদের খেলাধুলার জুতোর নিঃশব্দ বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটালেন তাঁরা। কোম্পানির নাম দিলেন – Gebrüder Dassler, Sportschuhfabrik, Herzogenaurach (ডেসলার ব্রাদার্স শু ফ্যাক্টরি)। ১৯২৫ থেকেই তাঁরা ফুটবল বুট তৈরি করতে শুরু করেন। এরই মধ্যে ১৯২৮ অলিম্পিকে মিডল ডিসট্যান্স রানার লিনা র্যাডকে ডেসলারের কোম্পানির জুতো পরে সোনা জেতেন। চার বছর পর লং ডিসট্যান্সের সোনাজয়ী ডেসলার কোম্পানির জুতোর প্রশংসা করেন মুক্তকণ্ঠে। তবে ১৯৩৬ সালে অলিম্পিকের আসরে কোম্পানির নাম মুখে মুখে ছড়িয়ে দেন প্রবাদপ্রতিম অ্যাথলিট জেসি ওয়েন্স। ব্যাবসা যখন বেশ ভালোই চলছে, তখন কালো মেঘ ঘনিয়ে আসে। বিশ্বযুদ্ধের ভ্রূকুটি আবারও মন্দা ডেকে আনে অর্থনীতিতে। বন্ধ হয়ে যায় অলিম্পিক, বিশ্বকাপ ফুটবল এবং আরও অন্যান্য খেলার আসর। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক চাপানউতোর ও ব্যক্তিগত বিচ্ছেদের ফলে ১৯৪৮ সালে নতুন নাম নিয়ে অ্যাডলফ ডেসলার কোম্পানি খুলে বসেন। তাঁর চোখে তখন আবারও নতুন করে শুরু করার পরিকল্পনা। দুশ্চিন্তার বিষয় এই যে, তখন ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলছে প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থারা।
ফলে এতদিন পরে বন্ধুর টেলিফোন পেয়ে অ্যাডলফও তাঁর পরিস্থিতির কথা জানালেন। সঙ্গে এও বললেন যে, শত সমস্যার মাঝেও তিনি নতুন একধরনের বুট নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করে সফল হয়েছেন। তিনি স্টাডে স্ক্রু ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। পুরোনো দিনের চামড়ার স্টাড নয়, এই জুতোর স্ক্রু স্টাড মাঠের মাপ ও অবস্থা অনুযায়ী গঠন করে নেয়া সম্ভব। এই স্ক্রু স্টাড এতটাই লম্বা যে কাদা-মাঠেও অনায়াসে গেঁথে থাকতে পারে। একই সঙ্গে তাঁর তৈরি বুট অনেক নরম এবং আরামদায়ক; স্বয়ং জেসি ওয়েন্স একদা যার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন।
হারবারগারের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। তিনি বুঝতে পারলেন, একটা জটিল অঙ্ক মিলিয়ে ফেলেছেন অচিরেই। বন্ধুকে বলে উঠলেন, “শোনো অ্যাডি, দু-দিনের মধ্যে যেভাবেই হোক আমার অন্তত চোদ্দ জোড়া বড়ো স্টাডের ফুটবল বুট চাই।”
অ্যাডি ডেসলার কোথায় ভাবছিলেন বন্ধুর সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দেবেন, তা নয়, এমন কাজের ফিরিস্তি শুনে বেজায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। প্রথমে তিনি ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দেননি, কিন্তু সেপ নাছোড়বান্দা। ‘জুতো নিয়ে জুতোজুতি’ চালিয়ে যাওয়া থেকে একেবারেই বিরত রইলেন না তিনি। স্বাভাবিকভাবেই ডেসলার তাঁর বন্ধুর কাছে এমন আবদার সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানতে চাইলেন। উত্তরে সেপ যা জানালেন তা চমকে দেয়ার মতো। তিনি বললেন, “দেখো অ্যাডি, আমি লক্ষ করে দেখেছি হাঙ্গেরিয়ানদের কাছে ছোটো স্টাডের বুট রয়েছে—ইংলিশ মাড কেক বুট। যা বৃষ্টি হচ্ছে, তাতে ওই বুটে খেলা বেশ সমস্যার। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, ম্যাচ যত গড়াবে মাঠ তত ভারী হয়ে যাবে। তাই আমি নিশ্চিত, ওই ছোটো স্টাডের বুটে হাঙ্গেরিয়ান দাঁড়িয়েই থাকতে পারবে না, দৌড়নো তো দূরের কথা। তুমি যে-বুট তৈরি করো, তা অনেক নরম এবং আরামদায়ক। এই বৃষ্টি ভেজা মাঠে অত ভালো বুট যদি বড়ো স্টাডের হয়, তাহলে অনেক হিসেব উলটে যেতে পারে। তাই আমার ওটা চাই, এক্ষুনি চাই!”
দিন দুয়েকের মধ্যে সেপের কাছে পৌঁছে গেল চোদ্দ জোড়া বুট। আর বৃষ্টিভেজা মাঠে ওই বুটই পার্থক্য গড়ে দিল ফাইনালে। আজকের ইতিহাসে যে ফাইনালের নাম ‘মিরাকেল ইন বার্ন’।
বুটের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সেদিন ম্যাচ শুরুর আট মিনিটের মধ্যেই ২-০ গোলে এগিয়ে গেল হাঙ্গেরি। গত দু-ম্যাচ চোট পেয়ে বসে থাকা পুসকাস এবং চিবোর শুরুতেই গোল করলেন। ধারাভাষ্য দিচ্ছিলেন হেবারট সিমারম্যান। জার্মান এই মানুষটিও বলে উঠলেন, “পুসকাসের সঙ্গে খেলতে পারার সৌভাগ্য পশ্চিম জার্মানির হল, এই ভেবেই খুশি থাকা উচিত তাদের। ঈশ্বর দর্শন হয়ে গেছে এবং সেই ঈশ্বরের নাম ফেরেঙ্ক পুসকাস।”
কিন্তু জার্মান রক্ত! হিটলারের মতো ঘৃণ্য, নরহত্যাকারীর শাসনে থেকেছে তারা। একদা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মার খেয়ে ভেঙে যাওয়া দেশটা, ইহুদি বিদ্বেষী ফুয়েরারের শাসনে বিশ্বত্রাস হয়ে উঠেছিল। যাই হোক, প্রথমার্ধেই দু-গোল শোধ করে দিল জার্মানি। চোট নিয়ে খেলা পুসকাসকে ঘিরে ফেলল তারা। সাপ্লাই লাইন বন্ধ হয়ে গেল। আর বৃষ্টিসিক্ত মাঠে হাঙ্গেরির দৌড় সেপ হারবারগারের পরিকল্পনামতো স্তিমিত হতে শুরু করল।
দ্বিতীয়ার্ধে অতিমানব হয়ে উঠলেন জার্মান গোলকিপার টুরেক। কিন্তু আসল প্রভেদ হয়ে গেল সেই বুটের আদলে। খেলা যত গড়াল, মাঠ হয়ে উঠল ভারী। ইংরেজ বুটের ছোটো স্টাড আর কঠিন গড়ন সেই ভারী মাঠে একেবারে অচল হয়ে গেল। আর ঠিক সেখানেই খেলাটা ধরে নিল সেপ হারবারগারের পশ্চিম জার্মানি। ম্যাচের ৮৪ মিনিটে জয়সূচক গোল করে দিলেন হেলমুট রান। বিশ্বজয় করল পশ্চিম জার্মানি; হিটলারের দেওয়া কলঙ্ক কিছুটা মুছে আবার বিশ্ব মানচিত্রে উঠে এল তারা।
তবে এই গল্পের শেষ কিন্তু এখানেই নয়। সেদিন সেপ হারবারগার তার বন্ধুকে আরও একটি কথা বলেছিলেন টেলিফোনে—“শোনো অ্যাডি, এখন তুমি ভাবছ যে সেপ কী পাগলামো শুরু করল। তবে এই ম্যাচ যদি আমরা জিতে ফিরি, তবে তোমার জুতোর কোম্পানিও সারা বিশ্বে রাজ করবে। লোকের মুখে মুখে ফিরবে তোমার কথা।”
‘বার্নের বিস্ময়’-এর ফলে সেদিনের অ্যাডি ডেসলার হয়ে উঠলেন আজকের ‘অ্যাডিডাস’-এর প্রতিষ্ঠাতা। অ্যাডিডাসের ফুল ফর্ম জানো তো তোমরা?—অল ডে আই ড্রিম অ্যাবাউট স্পোর্টস।
এও কিন্তু একরকমের মিরাকল। তাই না?
স্মরণীয় যাঁরা সব এপিসোড একত্রে