- আগের পর্ব দিনগুলি মোর(১), দিনগুলি মোর (২), দিনগুলি মোর(৩) দিনগুলি মোর(৪) , দিনগুলি মোর(৫) দিনগুলি মোর(৬)
- আগের স্মৃতিচারণ ফিরে দেখা
ছোটোবেলার কথা মাঝে মাঝে মনে পড়ত ঠিকই, মন খারাপও করত, কিন্তু সে বয়েসটা নতুনকে আবাহনের বয়েস, মুক্ত মনের ক্যানভাসে রঙিন ছবি আঁকার বয়েস, তাই দুঃখ দুঃখ মনটা খুশিতে আনন্দে ভরে যেতেও সময় লাগত না। ইএসডি-তে ভোর হত পিচ ঢালা রাস্তায় জওয়ান ও অফিসারদের সুষম ছন্দে লয়ে দৌড়ানোর আওয়াজে। তার সঙ্গে মিশে থাকত পাখিদের কিচিরমিচির। সেখানে আকাশ লাল করে সুর্যিঠাকুর উঁকি মারতেন পাকুড় গাছটার আড়াল থেকে। আর এখানে ভোরের সূর্য দোল খায় গঙ্গার জলে আর তার সঙ্গে মিশে যায় তানপুরার সুরে সুর বেঁধে দিদির গলায় ভৈরবী, আহির ভৈঁরো, ললিত বা বৈরাগী।
কেয়ার মাথায় সবসময় দুষ্টুবুদ্ধি খেলত, সে জয়ের বিছানার কাছে গিয়ে মন দিয়ে গলা ছেড়ে গাইত, ‘উঠো জাগ মুসাফির ভোর ভই, আব রৈন কঁহা যো সোয়থ হেয়।’ জয় বেচারা ঘুমোতে ভালবাসত, রেগেমেগে চেঁচাত ‘ফুলদি ভালো হবে না বলছি!’
কেয়া গেয়েই চলত ‘যো সোয়থ হেয় সো ব্রেকফাস্ট খোয়থ হেয়।’
এদিকে চেঁচামিচিও চলছে কেয়ার গানও চলছে। শেষকালে ঠাকুমা এসে দু’পক্ষকে সামলাতেন। একটু বেলা হলে ঠাকুমা স্নান-আহ্নিক সেরে রান্না ঘরে গিয়ে বসতেন। তারপর কত যে গল্প চলত মা আর ঠাকুমাতে! একটাই অসুবিধে, তাঁদের বসুমতী, শনিবারের চিঠি প্রভৃতি ম্যাগাজিনগুলি আসত ডাকে। তাই দিন গুনতে হত। এই কষ্ট ঘোচাতে এক ভদ্রলোক ঢাউস একটা ব্যাগভর্তি বই তাঁর সাইকেলের ক্যারিয়ারে বেঁধে আমাদের বাড়িতে আসতেন পনেরো দিন অন্তর। প্রতি কার্ডে দুটি করে বই অর্থাৎ চারটি বই, মা, ঠাকুমার দু’সপ্তাহের খোরাক। ভদ্রলোককে চা-বিস্কিট দিয়ে তাঁরা কার্পেটের ওপর বসে তাঁদের পছন্দমত বই বাছতেন। এ’রকম মোবাইল লাইব্রেরি হয়ত অন্যান্য শহরেও ছিল কারণ প্রবাসী বাঙালিদের সাহিত্যপ্রীতি সর্বজনবিদিত।
শীত এসে পড়েছে , কনকনে ঠাণ্ডা উত্তুরে বাতাসে গাছের ডালপালা পত্রহীন হবার জন্যে তৈরি হচ্ছে । বর্ষার কূলপ্লাবিনী গঙ্গা ব্রিজের নিচ দিয়ে এখন ধিমে তালে বইছে । বেলা এগারটা-বারোটা পর্যন্ত রাস্তাঘাট ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা থাকে। ট্রেনের ইঞ্জিন ফগ হর্ন বাজাতে বাজাতে চলে যায় । কলেজে ক্লাসে ফাঁকি দেবার উপায় নেই, ক’দিন বাদে বার্ষিক পরীক্ষা। ফিজিক্স কেমিস্ট্রির অথৈ জল থেকে একটু একটু করে ভেসে উঠছি ।
মনে পড়ে প্রথম দিনের কেমিস্ট্রির ক্লাস। আমাদের ক্লাসে জনা কুড়ি মেয়ের মধ্যে আমরা তিনটি বাঙালি; তপতী অণিমা ও আমি, পাশাপাশি বসি বেঞ্চে । দরজা দিয়ে ঢুকলেন মাথুর ম্যা’ম। বেঁটেখাটো চেহারা, পিছন পিছন চাপরাশি এসে দেয়ালে একটা চার্ট টাঙিয়ে দিয়ে চলে গেল। চার্টের ওপর দিকে বড়ো বড়ো করে লেখা ‘পিরিয়ডিক টেবল।’ তার নীচে খোপকাটা ঘরগুলোতে Au, Pb, CU, Hg আরও কত কী লেখা, নীচে আবার অ্যাটমিক ওয়েটও লেখা রয়েছে !
ফিসফিস করে তপতীকে জিজ্ঞেস করলাম ‘এটা কী রে, অ্যাটমেরও ওয়েট হয় নাকি?’
ও আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, ‘এখন চুপ করে শোন, পরে বুঝিয়ে দেব।’
আমার মাথা ঝিমঝিম করছে, চোখে সর্ষেফুল দেখছি। ক্লাস শেষ হলে তপতী বলল, ‘তুই কেমিস্ট্রি এর আগে পড়িসনি?’
আমি বললাম ‘না।’
একটু চুপ করে থেকে বলল, “ঠিক আছে আমি যতটা পারব তোকে বুঝিয়ে দেব, কিন্তু ভীষণ খাটতে হবে। ” বুঝলাম টিচারদের ওপর ভরসা আর নিজের ওপর আস্থা ছাড়া কোন গতি নেই। সে-সময়ে না ছিল কোচিং সেন্টার , না হত প্রাইভেট টিউশন আর সাবজেক্ট গাইড তো পাওয়াই যেত না। কাজেই গভীর জলে সাঁতার কেটে ভেসে ওঠা ছাড়া উপায় নেই। ফিজিক্সেও একই অবস্থা। পড়াতে আসতেন পার্ট টাইম লেকচারার তাম্বে স্যার। তিনি মারাঠি, আমরা তিনকন্যে তাঁকে ‘নিজের নাম বাবার নাম’ শর্টে ‘এন বি’ স্যার বলে ডাকতাম। ঝড়ের বেগে পড়িয়ে চলে যেতেন। হয়তো অন্য কোন কলেজে যাবার তাড়া থাকতো তাঁর।
একতলায় ছিল বায়োলজির লেকচার রুম ও ল্যাব। বায়োলজি পড়াতেন খেড়া ম্যা’ম। পাঞ্জাবী মহিলা, লম্বা স্লিম চেহারা, ফর্সা টকটকে রঙ আর যেমন পারসোনালিটি তেমনি ভাল পড়াতেন।
একটা মরিস গাড়ি চালিয়ে আসতেন, থিয়োরি ক্লাস শেষে প্রাকটিক্যাল ক্লাসে খানিকক্ষণ demonstrator শকুন্তলা ম্যা’ম এর সঙ্গে স্লাইড, বোন বা মিউজিয়াম স্পেসিমেন সম্বন্ধে আমাদের কিছু কিছু বুঝিয়ে চলে যেতেন। ওঁর ক্লাসে রঙিন পেন্সিল ছাড়া ঢোকা নিষেধ ছিল। উনি বোর্ডে রঙিন চক দিয়ে ছবি এঁকে পড়া বোঝাতেন, অতি জটিল বিষয়গুলিও রঙিন ছবিতে প্রাঞ্জল হয়ে উঠত।
‘বায়ো’ ল্যাবে বড় বড় জানালা ছিল, তার মাঝে মাঝে কাচের আলমারির তাকগুলোতে সাজানো থাকত ফরম্যালিনে প্রিসারভ করা মিউজিয়াম স্পেসিমেন। জানালা দিয়ে দেখা যেত নীচে স্কুলের বাস্কেট বল গ্রাউন্ডে কেয়া বল নিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। প্রায় ছ’ফুট লম্বা কেয়া অবলীলাক্রমে অন্যদের ছাপিয়ে বল ছুঁড়ে ফেলত বাস্কেটে। জানলা থেকে ফিরে বসতাম ডিসেকশন টেবিলে, সেখানে ট্রেতে হয়তো ক্লোরোফর্ম করা ব্যাঙ উপুড় হয়ে পড়ে আছে আমাদের অপেক্ষায়। মাঝে মাঝে আবার তাদের এক আধজন চারপায়ে পিন লাগানো বা পেট কাটা অবস্থাতেই লাফিয়ে মেঝেতে নেমে দৌড়ে বেড়াত আর যার ব্যাঙ সে দৌড়ত তার পেছন পেছন তাকে ধরতে।
কলেজের অন্যতম আকর্ষণ ছিল NCC। প্রত্যেক রবিবার ঝকঝকে ইউনিফর্ম পরে সকাল আটটার মধ্যে প্যারেডে ‘ফল ইন’ করতে হত, এগারটা পর্যন্ত ক্লাস চলত। একটু লেট হলে বা ইউনিফর্মে কোনও ত্রুটি থাকলে গ্রাউন্ডে রাইফেল ঘাড়ে কয়েক চক্কর দৌড়তে হত , সেটা পানিশমেন্ট। ঘণ্টাখানেক প্যারেডের পর হত ম্যাপ রিডিং , মোর্স রিডিং , ফিল্ড সারভাইভাল ট্রেনিং, অর্থাৎ এক ক্যান্টিন জল ও নামমাত্র শুকনো খাবার নিয়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সারভাইভ কী করে করবে ইত্যাদি । মাঝখানে পনেরো মিনিট ‘নাশ্তা ব্রেক।’ খাওয়াটা কিন্তু বেশ ভালো হত।
সেকেন্ড ইয়ারে শুরু হল রাইফেল শুটিং ড্রিল। দশজনের এক-একটা গ্রুপ হত, প্রত্যেকে থ্রি নট থ্রি রাইফেল আলাদা করে পেতাম প্রশিক্ষণের জন্যে।
প্রথমে আমরা শিখলাম কী করে রাইফেল ডিসম্যান্টল করে আবার রিআসেম্বল করতে হয়। কয়েক সপ্তাহ পর ‘এন সি সি’র ট্রাকে করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল শক্তি চকে, আর্মির চাঁদমারি রেঞ্জে , শুরু হল শুটিং ট্রেনিং।
বন্দুক চালানো একটু সড়গড় হবার পর দূরে মাটির টিলাতে আলাদা আলাদা করে রাখা টার্গেটে নিশানা করে শুটিং প্র্যাকটিস আরম্ভ হল। প্রত্যেকের জন্যে কম্বলের ওপর রাখা থাকত রাইফেল। আমরা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম ,আমাদের স্যর চেঁচিয়ে অর্ডার দিলেই দৌড়ে গিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে রাইফেল ডিসম্যান্টল করে আবার রিয়াসেম্বল করে টার্গেট লক্ষ করে শুট করতে হত। টার্গেট প্র্যাকটিসের সময় বলা হত ‘টার্গেট কি ছে বজে এইম করো, ফির বন্দুক থোড়া সা উপর কর কে সেন্টার মে গোলি চলাও।’ সেকেন্ডে ইয়ারে ফাইনাল শুটিং কম্পিটিশনের দিন আমি তিনটের মধ্যে তিনতেই ‘বুলস আই’তে শুট করে প্রথম হয়েছিলাম। চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল E.S.Dর মাঠের সেই দৃশ্যটি। বিরাট বড় মাঠটিতে অফিসার ও কিছু নন কমিশন্ড্ অফিসার ফ্যামিলি সহিত সার দিয়ে পাতা চেয়ারে বসেছিলেন। বলাই বাহুল্য ঠাকুমা আর মা মধ্যমণিটি হয়ে সেখানে বিরাজমান ছিলেন। দড়ি দিয়ে সে দিকটা ‘কর্ডন অফ’ করে রাখা ছিল এবং জওয়ানদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল যাতে কেউ এদিক ওদিক না যায়।
শুরু হল ‘ফ্লাইং টার্গেট’ কম্পিটিশন। প্রথমে আকাশের দিকে ছোঁড়া হল মাঝারি আকারের খালি বোতল, তারপর আপেলের পালা। অনেকেই আপেল ওপরে পৌছবার আগেই গুলির আঘাতে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে দেদার হাততালি পেলেন। বাপি মাঠের এক কোনায় দাঁড়িয়েছিলেন, কর্নেল গুপ্তে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন ‘কী লাহিড়ী সাহেব একবার চেষ্টা করে দেখবেন না কী?’
বাপি তখন সবে আর্মির অ্যাকটিভ সার্ভিস ছেড়ে MES জয়েন করেছেন। তিনি বললেন ‘করতে পারি তবে টার্গেটটা পাল্টাতে হবে। একটা ছোটো কয়েন আকাশের দিকে ছুঁড়ুন, আমি সেটাকে শুট করব।’ সেদিন যতগুলো কয়েন আকাশের দিকে ছোঁড়া হয়েছিল,বাপি প্রত্যেকটি ওপরে ওঠার আগেই গুলিবিদ্ধ করেছিলেন। গোটা মাঠ সেদিন হাততালির শব্দে ফেটে পড়েছিল ।
চাঁদমারির মাঠ থেকে বাড়ি ফিরে দৌড়ে গিয়ে বাপিকে আগে বলেছিলাম শুটিং এর কথা। বাপি কিছু না বলে আলমারি থেকে নিজের পিস্তলটা বের করে নিয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বললেন ‘বসো।’ সোজা চাঁদমারি রেঞ্জে গিয়ে শেখালেন কেমন করে পিস্তল শুট করতে হয়। কেমন করে এক হাতের সাপোর্ট নিয়ে অন্য হাতে ধরা পিস্তল একটু ওপরে করে ট্রিগার টিপতে হয়। এও বলেছিলেন পিস্তল আত্মরক্ষার জন্যে চালাবে। আমার মনে হল বাপি আমাকে সব চাইতে বড় উপহারটা দিলেন সেদিন ।
এই বয়েসে এসে আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবি, মা বাবা ও অন্যান্য গুরুজনেরা কেমন নিঃশব্দে আমাদের জীবনের দিশা নির্দেশ দিয়েছিলেন ।
ক্রমশ