আগের পর্ব দিনগুলি মোর(১), দিনগুলি মোর (২), দিনগুলি মোর(৩) দিনগুলি মোর(৪) আগের স্মৃতিচারণ ফিরে দেখা
তুষিনের বাড়িতে দুটো বড়ো বড়ো ঘর ছিল। বাইরের ঘরটায় আমার জন্যে একটা খাট, পড়ার টেবিল-চেয়ার আর দেয়াল আলমারিতে ছিল আমার বইখাতাপত্র রাখার ব্যবস্থা। ঘরদুটোর পিছনে একটা ঢাকা বারান্দা যার একদিকে একটা ছোট্ট রান্নাঘর, অপরদিকে বাথরুম। সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলে বাঁধানো কলতলায় টিউবওয়েল—কাপড় কাচা, বাসন মাজা সব কাজ হত সেই জলে। সামনের বারান্দাটা খোলা। বাড়ির সামনে আর পাশের দিকে ছোট্ট একটা বাগান, সেখানে ক’টা জবা-টগর-অপরাজিতার সঙ্গে সহাবস্থান করত বেগুন, লঙ্কা, মাচানে লাউ, কুমড়ো, বরবটি, ঝিঙে ইত্যাদি। বাগানটা পুরোপুরি ছোটো পিসেমশাইর অধীনে। তিনি অফিস থেকে ফিরে খুরপি নিয়ে বসে যেতেন গাছগুলির পরিচর্যায়। রান্নাঘরের দরজায় একটা মেনু চার্ট সাঁটানো থাকত। তাতে গোটা সপ্তাহের মেনু লিখে রাখতেন তিনি। মাঝে মাঝে একটু আধটু রদবদল যে হত না তা নয়। পিসেমশাই যতদূর মনে পড়ছে বাংলা সংবাদ পত্রিকা যুগান্তরের সিনিয়র রিপোর্টার ছিলেন। আর খুব সম্ভবত তিনি পূর্ববঙ্গের মানুষ ছিলেন, কথায় ওদিককার টান ছিল। কিন্তু ভাষাটা মিষ্টি লাগত শুনতে।
দুর্গাপুজোয় মহালয়া থেকে ভাইফোঁটার পরের দিন পর্যন্ত স্কুল বন্ধ, লম্বা ছুটি, সারাদিন বাড়িতে বন্দি। মাঝে মাঝে একটু হাঁপিয়ে উঠতাম। কিন্তু এই ছুটিটাতে তুষিনকে খুব কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম। বাড়িতে থাকতে তুষিন যখনই আসতেন, সকালে বাচ্চাদের নিয়ে আসতেন আর সন্ধে হতেই সোদপুর ফিরে যেতেন। এমনকি বড়ো পিসিমণি, মেজো পিসিমণি যখন আমাদের বাড়িতে আসতেন তখনো তাঁকে সন্ধে হতেই ফিরে যেতে হত।
সোদপুরের এই কলোনিটি সবে গড়ে উঠছে, দূরে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাড়ি। কিছু বাড়িতে লোকজন বসবাস করতে শুরু করেছে, অনেক বাড়ি এখনো নির্মীয়মাণ। তুষিন বাড়ি থেকে বিশেষ বেরোতেন না, আমারও এখানে কোনো বন্ধুবান্ধব না থাকায় স্কুল থেকে ফিরে কোথাও যেতাম না, তুষিনের সঙ্গেই গল্প করতাম। সকালে পড়াশোনা সেরে রান্নাঘরের সামনে মাটিতে বসে হাতে হাতে একটু কাজ করতে করতে তাঁর জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা শুনতাম।
একদিন তাঁর কাছে তাঁর ছোটোবেলার গল্প শুনতে চাইলাম। তুষিন হেসে বললেন, “সে তো জঙ্গলের গল্প রে, শুনবি?”
পিসতুতো বোন শিখাও এসে বসল পাশে। তিনি বলতে শুরু করলেন, “আমাদের ছোটোবেলাটা কেটেছে উত্তরপ্রদেশের কুমায়ুন জেলার নাগপানিতে। আমরা যে বাড়িটাতে থাকতাম সেটা বেশ বড়ো বাংলো বাড়ি ছিল, দরজা-জানলা কাচের। চারদিকে উঁচু কম্পাউন্ড ওয়াল দিয়ে ঘেরা। সামনে বড়ো লোহার গেট, তার ওপরে একটা লন্ঠন টাঙানো থাকত। যেদিন দাদার ফিরতে দেরি হত, মা লন্ঠনটা জ্বালিয়ে রাখতেন। দাদা মাঝে মাঝে রানিখেত যেতেন অফিসের কাজে। অনেক সময় দেরি হয়ে যেত সেখান থেকে ফিরতে। রাস্তা বলতে পাকদণ্ডী, দু-পাশে ঘন জঙ্গলে বাঘ-লেপার্ড-নেকড়ে-ভালুক, বিষাক্ত সাপ সবই ছিল। দাদা নিজের টাট্টু ঘোড়া রেবির পিঠে চড়ে চাঁদের আলো বা অন্ধকার রাতে তারার আলোয় একা পাকদণ্ডী ধরে বাড়ি ফিরতেন, পিঠে থাকত তাঁর বন্দুক, কোমরে একটা ছোরা কিংবা ভোজালি। দূরে হয়তো বাঘ ডাকছে, কিন্তু দাদা ভয় পেতেন না। ছোটো থেকেই খুব সাহসী ছিলেন দাদা। মা ভাবতেন, দূর থেকে লন্ঠনের আলো দেখে দাদা বাড়ির রাস্তা পেয়ে যাবেন। কম্পাউন্ডের ভেতরে বাগানে নানারকম ফল ও ফুলের গাছ ছিল। দাদার খুব শখ ছিল ফুলের। কত রঙের গোলাপ ফুটত—লাল, সাদা, অরেঞ্জ, গোলাপি, কালো, নীল আরো কত রঙ। তাছাড়া ফুটত থোকা থোকা ব্রাইডস বুকে, জিরেনিয়াম ডালিয়া, নার্সিসাস পপি, আরো কত মরশুমি ফুল। মার পুজোর জন্যে জবা-বেলি আরো কী কী ছিল মনেও নেই রে। ফলের গাছও ছিল অনেকরকম—আপেল, নাসপাতি, আলুবোখারা, খোবানি, কাফল—আর ছিল কয়েকটা ঝাঁকড়া রডোডেনড্রন, ঝিরঝিরে পাতা চির বা পাইনগাছ আর দেওদারগাছ। রান্নাঘরের পিছনে সবজিও হত নানারকমের। গেট থেকে বেরিয়ে ক’পা গেলেই শুরু হয়ে যেত জঙ্গল। তখনকার দিনে ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না। সন্ধে হলেই ঘরে ঘরে জ্বালিয়ে দেয়া হত সেজবাতি আর লন্ঠন। শোবার ঘর আর বসবার ঘরে ফায়ার প্লেসের কাছে চির আর দেওদারের শুকনো কাঠ রাখা থাকত শীতকালে জ্বালাবার জন্যে। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে বরফও পড়ত। তখন সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফেরার পর দাদা বসার ঘরের ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালিয়ে দিতেন। আমরা আগুনের সামনে বসতাম, দাদা আর মা বসতেন চেয়ারে। আমি আর বিলু মানে তোদের কাকু মাটিতে গালচের ওপরে। বাগান থেকে কুড়িয়ে আনা পাইনের ‘কোন’ আগুনে ফেলে দেয়া হত। একটু পরে ফট ফট করে ফাটতে থাকলেই দাদা সেগুলোকে লম্বা চিমটে দিয়ে বার করতেন আর তার ফলগুলো রোস্টেড হয়ে যেত। দারুণ খেতে লাগে, জানিস তো?”
“আমি বললাম, “ওগুলোই তো চিলগোজ়া, ছোটোবেলায় দিল্লিতে মা আমাদের কোটের পকেটে ভরে দিতেন।”
তুষিন বলতে থাকলেন, “দাদা সন্ধেবেলা আমাকে অঙ্ক ও ইংরাজি পড়াতেন, কত বই পড়তে দিতেন। ইংরাজি সাহিত্যটাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিলেন দাদা। মা বাংলা পড়তে শিখিয়েছিলেন, কিন্তু লিখতে পারতাম না। বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আমার বউদি, তোদের মার কাছে।”
কথা বলতে বলতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন চুপ করে। মন হয়তো চলে যেত সুদূর অতীতের ছোটোবেলার নাগপানিতে। আমার মতো তিনিও কি তাঁর ছোটোবেলাকে হারিয়ে কষ্ট পাচ্ছেন?
নভেম্বের মাস পড়ে গেছে। বাতাসে শীতের হালকা ছোঁয়া। বেলা তাড়াতাড়ি গড়িয়ে যায়, তাই স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধে নেমে আসত। সামনের মাসে টেস্ট পরীক্ষা, সময় বেশি নেই, স্কুলে পড়ার চাপও খুব। নতুন স্কুল, ভালো রেসাল্ট করতেই হবে। টেস্টে অ্যালাউড না হলে ফাইনাল বোর্ড পরীক্ষায় বসতে পারব না, অতএব আর গল্প নয়, শুধু পড়া।
টেস্টের মাস দুয়েক পর স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা, ফর্ম ভরা হল। আমাদের প্রত্যেকের নামের বানান এল বোর্ড থেকে, যার যা ইচ্ছে নামের বানান লিখতে পারতাম না। মার্চ মাসের প্রথমদিকেই টাইম-টেবিল এসে গেল, আর তখনই জানা গেল আমদের সেন্টার পড়েছে ভাটপাড়া গার্লস স্কুলে। সেখানে ট্রেনে যাওয়া যাবে না, বাস-পথে অনেক দূর। তুষিনকে বললাম কী করা যায়। তিনি বাপিকে সব সবিস্তারে জানালেন।
পরীক্ষার আর দিন চারেক বাকি, সকালবেলা দিদির বন্ধু ভারতীদি এসে হাজির। ভারতীদি দিদির খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ছোটোবেলা থেকে একসঙ্গে পড়াশোনা করেছেন, থাকেন ইছাপুরে। তাঁকে দেখে আমি তো অবাক। তুষিনকে প্রণাম করে বললেন, “গতকালই দীপার চিঠিতে জানতে পারলাম সবকিছু। এখান থেকে ভাটপাড়া বেশ দূর, তাই ওকে নিতে এলাম। পরীক্ষার ক’টা দিন চিনার আমাদের কাছেই থাকবে। ছোটো পিসেমশাই কই, তাঁকেও বলা দরকার। আজ তো রবিবার। তিনি বাড়ি নেই?”
তুষিন বললেন, “বাজারে গেছেন, এসে যাবেন। দুপুরে খেয়েদেয়ে বিকেলের দিকে যাবি না হয়। চিনার, তুই সবকিছু গুছিয়ে নে।”
তুষিন আর পিসেমশাইকে প্রণাম করে যখন বাড়ি থেকে বেরোলাম, তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে।
ভারতীদির মা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি প্রণাম করতেই আমার হাত ধরে বললেন, “দীপা এ-বাড়িতে কত এসেছে, তোমাকে এই প্রথম দেখলাম। চলো, ভেতরে চলো। আমি চা বসাই। তুমি চা খাবে তো?”
আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, “আমি চা খাই না।”
আমাদের বাড়িতে নিয়ম ছিল, ক্লাস টেনে উঠলে একটা রিস্ট ওয়াচ পাবে আর চা খাবার পারমিশন। বাপি আমাকে খুব সুন্দর ‘রোমার’ কোম্পানির রিস্ট ওয়াচ দিয়েছিলেন। কিন্তু চা খাওয়াটা তখনো রপ্ত করতে পারিনি।
ভারতীদির মা আমাকে একটা ছিমছাম ঘরে নিয়ে গিয়ে বললেন, “ক’টা দিন তুমি এখানেই থাকবে। ভয় করবে না তো?”
ঘরে তক্তপোষের ওপর টানটান করে পাতা বিছানা, পাশে ছোটো টেবিলের ওপর রাখা জলের গেলাস আর টেবিল ঘড়ি।
রাতে খেতে বসে ভারতীদির কাকার সঙ্গে আলাপ হল। তিনি অকৃতদার। ভারতীদির বাবা অল্প বয়েসে মারা যান। এই কাকাই এই সংসারটিকে আগলে রেখেছেন ও ভারতীদিকে কন্যা-স্নেহে মানুষ করেছিলেন। খেতে খেতে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার নাম কী?”
বললাম, “স্বপ্না।”
বললেন, “সে তো তোমার পোশাকি নাম, ডাকনাম কী?”
বললাম, “চিনার।”
আমার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “নামটার মধ্যে একটা অভিনবত্ব আছে।”
ভারতীদি একটু হেসে বললেন, “কাকামণি, ওর নামের একটা ইতিহাস আছে। দীপার কাছে শুনেছি।”
“ইন্টারেস্টিং। শুনি একটু।” বললেন কাকাবাবু।
“যতটুকু জানি বলছি। চিনার, ভুল হলে বলিস।”
ততক্ষণে আমাদের খাওয়া হয়ে গেছে। কাকামণির ঘরে খাটে জমিয়ে বসে ভারতীদি শুরু করলেন, “মেসোমশাই মানে দীপার বাবা বোধ হয় ১৯৩৮ বা ৩৯-এ ব্রিটিশ শাসিত নর্থ-ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ারে বদলি নিলেন। সেখানে প্রধানত পুখতুন, ওয়াজ়িরি ও বালোচ উপজাতিদের বাস। এরা ভীষণভাবে স্বাধীনচেতা ও দুর্ধর্ষ উপজাতি। ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীকে যখন তখন অ্যাটাক করে নাস্তানাবুদ করে রাখত। এহেন জায়গায় মেসোমশাই গেলেন ওই দেশটি দেখতে ও জাতিটিকে কাছ থেকে জানতে ও চিনতে। তাঁর পোস্টিং ছিল থালে, আর সেখান থেকে ষাট মাইল দূরে ছ’হাজার ফুট পাহাড়ের ওপরে ষোলো মাইল লম্বা বারো মাইল চওড়া মালভূমিতে ছোট্ট উপজাতীয় গ্রাম পারাচিনারে উঁচু পাঁচিলে ঘেরা দুর্গের মধ্যে মাসিমা তাঁর ছোটো ছোটো দুই ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে থাকতেন। মোটা লোহার পাতে মোড়া গেটে চব্বিশ ঘণ্টা থাকত বন্দুকধারী প্রহরী। এছাড়া আরো সেন্ট্রি থাকত যে-কোনো অ্যাটাক থেকে দুর্গের বাসিন্দাদের রক্ষা করতে। মেসোমশাই সপ্তাহান্তে আসতেন, যদি রাস্তা নিরাপদ থাকত। মাসিমা দরকারে নিজে গাড়ি চালিয়ে বাইরে যেতেন, সঙ্গে থাকত তাঁর সশস্ত্র বডিগার্ড। মাসিমার কাছেও থাকত বন্দুক এবং কোমরে থাকত কার্টিজের মালা। চিনারের জন্ম এই পারাচিনারে। তাই ওর নাম চিনার।”
আমি বললাম, “পারাচিনারের আদিনাম তুতকাই।”
কাকামণি পান খেতে খেতে বললেন, “তুমি তো সত্যিই একটি ইতিহাস।”
আমি বললাম, “আমি নই, ইতিহাস রচনা করেছিলেন আমার মা-বাপি, তাঁদের দুর্দান্ত সাহস, একটি স্বাধীনচেতা জাতীর প্রতি শ্রদ্ধা, তাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। পুখতুনদের বাপি খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন, চিনেছিলেন। সেখানকার বেশ কিছু মানুষ তাঁর বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা, স্বাধীনতার জন্যে নিরন্তর যুদ্ধ বাপিকে শ্রদ্ধাবনত করেছিল। ইতিহাস তাঁরা রচনা করেছিলেন, আমি নই। এমন মা-বাবা ক’জনের হয়?”
আমদের ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল শীলা আর অনিমা সকালে এল দেখা করতে। ওরা বলল, “চল, স্কুলে গিয়ে দিদিমণি আর স্যারদের প্রণাম করে আসি।”
ওঁদের আশীর্বাদ নিয়ে স্কুলটা একবার ঘুরে ঘুরে দেখলাম—ক্লাস-রুম, খেলার মাঠ, আমাদের বাগান। বাগানটা তখন ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে রয়েছে। এরপর আর সে স্কুলে আমার যাওয়া হয়ে ওঠেনি, সেই শেষ দেখা।
পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে, এবার দিন গুনছি কবে বাড়ি যাব। ঠিক হয়েছে, মেজো পিসিমণির ছেলে অশোকদা আমার সঙ্গে যাবে। তার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ হলেই আমরা রওনা দেব। বাড়ি যাবার আনন্দ যতটা, তুষিনের জন্যে মনকেমনও ততটাই করছিল। তাঁর কাছে কত গল্প শোনা বাকি।
পরের দিন অশোকদা চলে এল বহরমপুর থেকে। তার তিনদিন পর সন্ধেবেলায় হাওড়া স্টেশন থেকে কানপুরগামী ট্রেনে চেপে বসলাম আমরা। আমাদের দুজনেরই একা একা যাত্রা এই প্রথম। সে সময়ে ছোটো ছোটো কামরা নিয়ে একেকটা বগি হত। বাপির সঙ্গে যেখানেই গেছি, আমাদের জন্যে একটা পুরো কামরা রিসার্ভ থাকত। এই প্রথম তৃতীয় শ্রেণির কামরায় বসার অভিজ্ঞতা হল আমার। বগিটা মাঝারি সাইজ়ের, গেট দিয়ে উঠে দু-পাশে জানালার সামনে লম্বা দুটো গদিহীন কাঠের বেঞ্চ, পিছনদিকে একটা আর মাঝখানে কাঠের পার্টিশন দেয়া দুটো বেঞ্চ। রড বিহীন খোলা জানালায় কাঠের পাল্লা। জানালার পাশের বেঞ্চে চাদর বিছিয়ে রাতের শোবার ব্যবস্থা করে নিলাম আমরা। ছড়ানো ছিটানো চোদ্দ-পনেরো জন লোক নিজের সুবিধেমতো জায়গা করে নিয়েছে। তিনজন মহিলা পিছনের বেঞ্চটায় বাচ্চাদের শুইয়ে দিয়েছে। শাড়ি পরার ধরন দেখে মনে হল বিহারি বা ইউপির বাসিন্দা হবে। তাদের দু-হাত ভর্তি লাল-সবুজ রঙের কাচের চুড়ি, সিঁথিতে মোটা করে মেটে সিঁদুর, কপালে বড়ো টিপ। ট্রেনের আওয়াজে তাদের ভাষা বোঝা যাচ্ছিল না।
তুষিন সঙ্গে খাবার আর এক কুঁজো জল দিয়ে দিয়েছিলেন। রাত বাড়তে আমরাও খেয়েদেয়ে ব্যাগ মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে দেখছিলাম রাতের আকাশ কী সুন্দর। অন্ধকার চিরে ট্রেন দৌড়চ্ছে, লাইনের ধারের ঝুপসি গাছগুলোও পিছনপানে সরে সরে যাচ্ছে। মাঝরাতে একবার ঘুম ভেঙে গেল। ট্রেন দাঁড়িয়ে ছোটো একটা স্টেশনে। দূরে দূরে গ্যাস বাতি জ্বলছে, কিছু লোক দৌড়াদৌড়ি করছে, চা-ওয়ালা মাটির ভাঁড়ে চা নিয়ে হেঁকে গেল।
পরের দিন যত বেলা বাড়ছিল, জানালা দিয়ে গরম হাওয়া ‘লু’ ঝাঁপিয়ে পড়ছিল আমাদের গায়ে মাথায়। দু-পাশে রুক্ষ মাঠ আর দূর দিগন্তের গা ঘেঁষে দেখা যাচ্ছিল ধূসর পাহাড়ের সারি। দিনের বেলাটা কোনোরকমে কাটল, কিন্তু রাতের বেলাতেও অসহ্য গরমে ঘুম আসছিল না। খোলা জানালার কাছে বসে বসে তুষিনের কথাই ভাবছিলাম। অ্যালবামে তুষিনের একটা কালো-সাদা ছবি দেখেছিলাম। পায়জামা-কুর্তা পরা, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, বইখাতা বুকের কাছে ধরা। মা বলেছিলেন, ছবিটা তুষিন যখন দিল্লির হস্তিনাপুর কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়তেন, তখনকার। বোধ হয় ১৯৩৭-৩৮ সালের। তুষিনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম গ্রাজুয়েশন করলেন না কেন তিনি। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিলেন, “দাদার তখন বদলি হয়ে গিয়েছিল নর্থ-ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ারে। সেখানে সবাইকে নিয়ে যাওয়াটা সম্ভব ছিল না, নিরাপদও ছিল না। আমি, মা আর বিলুকে নিয়ে কলকাতায় চলে এলাম। বাণীপীঠে ভর্তিও হলাম, কিন্তু পড়াটা আর এগোনো গেল না রে। এই সময় কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামসে আর্মি সিগন্যাল কোরে ট্রেইনি নিচ্ছিল। দু-মাস ট্রেনিংয়ের পর চাকরি। মা, দাদা, বউদি কারুরই আপত্তি ছিল না আমার চাকরি করায়। চাকরিটা হয়ে গেল।”
বাপি যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ওয়ার ফ্রন্টে ছিলেন, তুষিন বাপির পাশে ভাইয়ের মতো দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি খুব সুন্দরী, স্মার্ট ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। আমদের বাড়িতে যখন আসতেন, বাপির কলিগদের সঙ্গে কী সহজভাবে ইংলিশে কথা বলতেন। অথচ সোদপুরে তিনি যেন এক আলাদা মানুষ। কোন অভিমানে তিনি একেবারে চুপ হয়ে গিয়েছিলেন, কেন নিজের অধিকারের জন্যে আত্মসন্মানের জন্যে রুখে দাঁড়াননি, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষ অভিভাবকের অন্যায়-অত্যাচারের সামনে কেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন তাঁকে জিজ্ঞেস করার মতো বয়স তখন আমার হয়নি, শুধু কষ্ট পেয়েছি।
পরের দিন সকাল দশটা নাগাদ আমরা পৌঁছলাম কানপুরে। কাকু আর দা’ভাই স্টেশনে এসেছিলেন। ওঁদের দেখে প্রায় ছত্রিশ ঘণ্টার ট্রেন জার্নির ধকল কোথায় উড়ে গেল। দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম ওঁদের।
ক্রমশ