- আগের পর্ব দিনগুলি মোর(১), দিনগুলি মোর (২), দিনগুলি মোর(৩) দিনগুলি মোর(৪) , দিনগুলি মোর(৫)
- আগের স্মৃতিচারণ ফিরে দেখা
বড়ো রাস্তা থেকে বাড়ি যাবার রাস্তাটা বাঁদিকে ঘুরে গেছে। ঢোকার মুখে দুটো পিলারে প্রস্তরফলকে লেখা আছে ৯, ক্লাইড রোড, কানপুর। দূর থেকে দেখা যায় বড়ো বড়ো তেঁতুল গাছের ছায়াঘেরা বাড়িটি। সামনে উঁচু গোল বারান্দার দু’দিকে ক’ধাপ সিঁড়ি। বাড়ির সামনের লোহার গেট থেকে লাল সুরকির রাস্তা, মাঝখানে একটা গোল লনের দু’পাশ দিয়ে ঘুরে বারান্দায় ওঠার সিঁড়ির কাছে এসে থেমেছে। লনের মাঝবরাবর দাঁড়িয়ে একটা লম্বা ল্যাম্পপোস্ট, সারারাত ধরে আলো জ্বালা থাকত। অর্ধচন্দ্রাকৃতি বাড়িটা দুটো ইউনিটে ভাগ করা, একটাতে আমরা থাকতাম আর পাশেরটাতে থাকতেন বাপির কলিগ মিস্টার তলওয়ার। বিরাট বড়ো কম্পাউন্ডের একদিকে তিনটে টেনিস কোর্ট, তার একটাকে ব্যাডমিন্টন কোর্ট বানিয়ে খেলার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সন্ধে হলে নেট টাঙিয়ে দুটো বড়ো বড়ো আলো জ্বালিয়ে দেয়া হত। আমাদের এবং আরও কয়েকটা পুরোনো বাংলো বাড়ি ছিল আর্মির আন্ডারে আর বাকি অংশটাতে অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির অফিসার ডাক্তার ও কর্মচারীরা থাকতেন। তাঁদের অনেকেই আসতেন ব্যাডমিন্টন খেলতে। কম্পাউন্ডের ধার ঘেঁষে রেল লাইন, যেটা গঙ্গার ওপরে ব্রিজ পেরিয়ে চলে যায় উন্নাও পেরিয়ে লখনউর দিকে। দিনে রাতে ট্রেনের যাতায়াত দেখতে খুব মজা লাগত আমাদের। ট্রেনগুলো ব্রিজের কাছ থেকে লম্বা হুইসিল বাজিয়ে চলে যেত গমগম করে। বাড়ির পাশের জায়গাটার পিছন দিয়ে নেমে গিয়েছিল একটা ইটবাঁধানো সিঁড়ি গঙ্গার ধারে যাবার জন্যে।
গরমকালে গঙ্গা শীর্ণকায়া স্বল্পতোয়া। গ্রামের লোকেরা ইজারা নিয়ে চরে তরমুজ শসা কাকড়ি লঙ্কা ঝিঙে লাগাত। বর্ষাকালে গঙ্গার জল প্রবল বেগে দুকূল ছাপিয়ে বয়ে যেত, সে-সব ক্ষেতের চিহ্নমাত্র তখন থাকত না। সকাল-সকাল লু চলার আগে আমরা ক্ষেত থেকে শসা কাকড়ি লঙ্কা নিয়ে পাড়ে বাঁধা ডিঙিতে বসে খেতে খেতে গল্প করতাম, ডিঙিটা জলের হালকা ঢেউয়ের সঙ্গে দুলতে থাকত। বেলা বাড়লে বাড়ি ফেরা।
কম্পাউন্ডের পিছনদিকটা কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা, তার মাঝখানে উঁচু পাড়ের ওপর সিমেন্ট বাঁধানো চবুতরা, সেখানে একটা বড়ো বেঞ্চ ছিল। পূর্ণিমার রাতে কত গান গল্প আড্ডার সঙ্গী হয়ে থাকত গঙ্গার ঝিকমিকে জল। নিশুতি নিস্তব্ধ রাতে তারার আলো হিরের কুঁচি হয়ে দুলত জলের বুকে।
কানপুরে গরম ও শীত দুটোই ছিল প্রচণ্ড। গরমকালে দিনে লু তো চলতই রাতেও গরম হাওয়া থেকে নিস্তার ছিল না। তখন এসি, কুলার ছিল না, আমাদের বাড়ির দরজা জানলায় ঝুলত খসখসের পর্দা, তার ওপরে লাগানো পাইপ থেকে ঝির ঝির করে জল পড়ে বাড়িটাকে স্নিগ্ধ সুবাসিত করে রাখত। রাতের বেলা পাশের খোলা জায়গায় দড়ির খাটিয়ায় তারা ভরা খোলা আকাশের নিচে ঘুম, এটা যে কী রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, যারা এ সুখটি পেয়েছে তারাই জানে। রাতে ঘুমবার আগে, বাপি নিজের খাটিয়ায় বসে তাঁর নিজের জীবনের নানারকম রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার গল্প বলতেন। বলতেন অন্ধকার নিশুতি রাতে রানিখেত নাগপানির হিংস্র ব্যাঘ্রসংকুল জঙ্গলে পাকদণ্ডি দিয়ে ঘোড়া রেবির পিঠে চড়ে মাঝ রাত্রে বাড়ি ফেরার গল্প, কখনো পায়ে হেঁটে ঘন জঙ্গলে শিকার করতে যাওয়া, কখনও বা প্রাক-স্বাধীনতার যুগের পুখতুনিস্থানের পারাচিনারে দুর্ধর্ষ পাঠান যোদ্ধাদের গোলাগুলি এড়িয়ে প্রাণ বাঁচিয়ে বাড়ি ফেরা। বাপি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মা ওয়ার ফ্রন্টে ছিলেন, কিন্তু যুদ্ধের গল্প তিনি কখনও করতেন না।
ইতিমধ্যে আমার রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে, মার্কশিট দেখে বাপি বললেন “বাঃ অঙ্কে তো ভালই করেছ। পিওর সায়েন্স নেবে তো?” আমি আঁতকে উঠে ধপ করে বাপির পায়ের কাছে বসে পড়লাম, “না বাপি আর অঙ্ক না, ওই গাদা গাদা অঙ্ক কষা আর পারব না। সায়েন্স পড়ব কিন্তু বায়োলজি নিয়ে। ইউ পি বোর্ডে ক্লাস নাইন থেকেই সায়েন্স পড়ান হয়, কাজেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম নতুন বিষয়গুলি বাগে আনতে কত শত ঘটি জল খেতে হবে আমাকে কে জানে।
জুন মাসের শেষের দিকে, কয়েক পশলা বৃষ্টি হওয়াতে লু-এর প্রকোপ অনেকটাই কম। দিনে রাত্রে আর ত্রাহিমাম অবস্থা নেই। স্কুল কলেজ খোলার মুখে। ছোটোবোন কেয়া কলেজের আ্যডমিশন ফর্ম নিয়ে এসে বলল, “এটা ভরে নিয়ে চল, আ্যডমিশন আরম্ভ হয়ে গেছে।”
আমাদের বাড়ি থেকে কলেজ হাঁটাপথে প্রায় মাইলদুয়েক। শহরের মাঝবরাবর বয়ে চলেছে একটা নহর বা ক্যানাল, কলকল করে তার জল কোন দূরপ্রান্তের ক্ষেতে পৌঁছচ্ছে কে জানে। তার ধার দিয়ে দুই বোনে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে পড়লাম বড়ো রাস্তা মল রোডে, একটু দূরেই দেখতে পেলাম স্কুলের গেট, মাথার ওপর লেখা ‘ডঃ সুরেন্দ্রনাথ সেন বালিকা বিদ্যালয়।’ পাশে ছোটো টার্নপাইক, লাল মুররম-এর রাস্তার প্রায় শেষ প্রান্তে প্রশাসণিক ভবন। ঢোকার মুখে চৌকিদারের ঘর, ডানদিকে টানা দোতলা স্কুল বিল্ডিং, তার শেষপ্রান্তে ব্যাডমিন্টন কোর্ট। বাঁদিকে বাস্কেট বলের কোর্ট এবং তারপরেই ইন্টার কলেজের বিজ্ঞান এবং কলা বিভাগ।
প্রিন্সিপ্যালের অফিসের দরজার পাশে কাঠের ফলকে নাম লেখা ‘মিস কমলা চক্রবর্তী।’ সামনে টুলে বসা পিওনের হাতে ফর্মটা পাঠালাম তাঁর কাছে। একটু পরেই ডাক এলো। ছিমছাম অফিস, টেবিলের ওপরে মোটা মোটা ফাইল রাখা, এক পাশে ফুলদানিতে রয়েছে একগুচ্ছ ফুল। মোটা একটি ফাইল নিয়ে কাজ করছিলেন তিনি। আমি যেতেই মুখ তুলে তাকালেন, সৌম্যদর্শন চেহারা। কিছু মানুষ থাকেন যাঁদের দেখলে প্রণাম করে আশীর্বাদ নিতে ইচ্ছে করে। ইনি তাঁদেরই একজন ছিলেন। কাছে গিয়ে প্রণাম করলাম, মাথায় হাত ছুঁইয়ে বললেন “বোসো।” ফর্মটা পড়তে পড়তে বললেন, “তুমি সায়েন্স নিতে চাইছো। পারবে তো? সায়েন্স তো তুমি পড়ইনি। এখানে ক্লাস নাইন থেকেই সায়েন্স বিষয়গুলি পড়ান হয়, তুমি ইন্টারে এসে সায়েন্স পড়বে? তাছাড়া হিন্দিও পড়নি, হিন্দির জায়গায় অবশ্য তুমি পেইন্টিং বা মিউজিক নিতে পারো।”
বললাম “আমি চেষ্টা করব ম্যা’ম আমাকে পারমিশন দিন।”
তিনি বললেন, “বেশ, আর হিন্দির জায়গায় কী নেবে?”
গলায় একটু সুর ছিল তাই মিউজিক নিতে চাইলাম। সেদিন কলেজে ভর্তি হবার পর মনে হল এবার সত্যি সত্যিই বড়ো হয়ে গেলাম।
এস এন সেন বালিকা বিদ্যালয় কানপুরের অগ্রণী এবং প্রাচীনতম নন মিশনারি মেয়েদের স্কুল। নারীশিক্ষার ইতিহাসে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ও তার প্রতিষ্ঠাতাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকা উচিত। এই ইতিহাসটি একটু বলি–
১৮৯৮ সাল ব্রিটিশ-শাসিত ভারতবর্ষে ভারতীয়রা ন্যূনতম সুযোগসুবিধা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। অশিক্ষা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারে আবদ্ধ সমাজে মেয়েদের অবস্থা আরও করুণ। সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, পণপ্রথার মত কূরীতিতে তারা নিগৃহীতা, অত্যাচারিতা। বিধবাবিবাহ অকল্পনীয় ছিল। মেয়েদের লেখাপড়া শেখানো সমাজে গর্হিত অপরাধ বলে চিহ্নিত হত। বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে তাঁদের জীবন কাটাতে হত। এহেন সময়ে ডঃ সুরেন্দ্র নাথ সেন তাঁর মৃত্যুপথযাত্রী মায়ের নির্দেশে নারীশিক্ষার ব্রতে ব্রতী হন। তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করা একমাত্র ডাক্তার ছিলেন কানপুর অঞ্চলে। সেখানকার মানুষদের কাছে তিনি দেবতুল্য ছিলেন। তাঁর খ্যাতি প্রতিপত্তি অর্থবল কোনটাই কম ছিল না। কানপুরে তখন বেশ কিছু ছোটো বড়ো কটন মিল চলত এবং ব্যবসায়ীরা কিছুটা শিক্ষিত ও অর্থবানও ছিলেন। ডঃ সেন তাঁর প্রভাব খাটিয়ে কয়েকটি মেয়ে নিয়ে নিজের বাড়ির আঙিনায় একটি স্কুল খুললেন। ধীরে ধীরে মেয়েদের সংখ্যা বাড়তে থাকায় ১৯১৪ সালে তিনি তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তার ওপারে একটি বিশাল জমির ওপর বড়োসড়ো একটি বিল্ডিং তৈরি করে স্কুলটি স্থানান্তরিত করেন ও নাম রাখেন অ্যাংলো ভার্নাকুলার গার্ল্স্ মিড্ল্ স্কুল। ১৯২২ সালে স্কুল বিল্ডিংটি আরও বড়ো হয়ে ওঠে এবং ১৯২৫ খৃষ্টাব্দের ৯ই মার্চ কানপুর তথা আওধের গভর্নর স্যার উইলিয়াম সিনক্লেয়ার ম্যারিস স্কুলের দ্বারোদঘাটন করেন।
এর পর প্রতিষ্ঠানটি ক্রমাগত এগিয়ে চলেছে। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে ডঃ সুরেন্দ্র নাথ সেনের সুযোগ্য পুত্র ডঃ সিদ্ধেশ্বর সেন ডিগ্রি কলেজটির স্থাপনা করেন। ১৯৫৩ সালে ও ১৯৫৭ সালে সেটি আগ্রা ইউনিভার্সিটির স্বীকৃতি পায় এবং ১৯৮৫ সালে বিভিন্ন বিষয়ে স্নাতকোত্তর পাঠক্রম আরম্ভ হয়।
ডঃ সুরেন্দ্র নাথ সেন তাঁর মৃত্যু পথযাত্রী মায়ের কাছে যে কথা দিয়েছিলেন তাঁর সুযোগ্য বংশধরেরা বিগত প্রায় একশ বছর ধরে তা প্রতিপালন করে আসছেন।
১৯৫৭ থেকে ১৯৫৯ পর্যন্ত এই দু বছর এস এন সেন বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।
(এস এন বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠান ও তার প্রতিষ্ঠাতাদের ইতিহাস গুগুলের সৌজন্যে )
ক্রমশ