সন্ধ্যা ভট্টাচার্য গল্প প্রতিযোগিতা ২০২০
(নবম দশম স্থানের পাঁচ গল্প)
“বাবা, তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসো না!”
“কেন, কী হল রে?”
“তুমি আমার সঙ্গে বেশি সময় কাটাও না কেন?”
“তোকে যেন অনেক সময় দিতে পারি সেজন্য সময়কে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসার চেষ্টাই তো আমি করছি।”
অভীকের মনে হল, শেষের কথাগুলো বলতে বলতে বাবা যেন একটু একটু করে অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। হাত বাড়িয়ে ছোঁয়ার একটা নিষ্ফল চেষ্টা করল সে। ব্যর্থ চেষ্টায় সে একটা আর্ত চিৎকার করে উঠল, “বাবা!”
ধড়ফড় করে উঠে বসল অভীক। তাহলে কি সে স্বপ্ন দেখছিল? হ্যাঁ, স্বপ্নই দেখছিল। আজ তিনদিন হল মঙ্গল গ্রহের ‘সেন্ট্রাল ফরেস্ট’-এর এই অংশ তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেছে, কিন্তু কোথাও কোনো সংকেত বা চিহ্ন তার নজরে আসেনি। তাকে যে খুঁজে বার করতেই হবে। কারণ, আজই তার সেন্ট্রাল ফরেস্টে শেষদিন, না চাইলেও কাল সকালে তাকে ফিরে যেতেই হবে।
মঙ্গলের এই জঙ্গল পৃথিবীর সময় অনুযায়ী মাত্র দেড় শতাব্দী প্রাচীন। সম্পূর্ণ মানব সভ্যতার ইতিহাসের সামনে দেড় শতাব্দী সত্যি ক্ষুদ্র সময়। দু-হাজার কুড়ি খ্রিস্টাব্দে করোনার সংক্রমণে পৃথিবী স্বাভাবিক জীবনযাপন পুরো বদলে যায়। দু-বছরের মাথায় করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলেও পরবর্তী বছরগুলোতে একের পর এক মহামারী আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ পৃথিবীর মানুষদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। অবশেষে দু-হাজার একত্রিশ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবীর সেরা পাচঁটি মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ও কিছু শিল্পপতিদের সম্মিলিত চেষ্টায় শুরু হয় এক নতুন মিশন যার মূল লক্ষ্য ছিল মঙ্গলকে মানুষের বাসযোগ্য করে তোলা। কিন্তু শুরুটা অতটাও সহজ ছিল না। মঙ্গলে ‘টেররাফর্মিং’ করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি আবিস্কার করতেই তিন দশক পেরিয়ে যায়। এরপর পরবর্তী তিন বছরে কয়েকশো পৃথিবী সেরা বিজ্ঞানীর চেষ্টায় মহাকাশযানে করে সেই প্রযুক্তি মঙ্গলে পাঠানো সম্ভবপর হয়ে উঠে। মেশিনগুলোর সাহায্যে টেররাফর্মিং-এর মাধ্যমে সম্পূর্ণ মঙ্গল মানুষের বাসযোগ্য করে তুলতে সময় লাগে পাক্কা চব্বিশ বছর। মঙ্গলের মাটিতে প্রথম উদ্ভিদের অঙ্কুরোদগম যখন হয়, পৃথিবীর হিসেবে সময়টা ২০৮৮ খ্রিস্টাব্দ।
সেন্ট্রাল ফরেস্টে প্রবেশের অনুমতি মঙ্গলের সাধারণ জনগণের নেই। যদিও সেই অর্থে মঙ্গলে কেউ সাধারণ নয়, প্রত্যেকেই বিত্তবান। কিন্তু মঙ্গল গভর্নিং কমিটির অনুমতি ছাড়া এই ফরেস্টে কারো প্রবেশের অধিকার নেই। মঙ্গলের নিরক্ষীয় অঞ্চলে গড়ে উঠা এই রেন-ফরেস্টের আয়তন প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার যা মঙ্গলের ফুসফুস নামেও পরিচিত। মঙ্গলের অভিজ্ঞ মানুষেরা চায় না তাদের অবস্থাও পৃথিবীর মতো হোক, তাই তারা প্রকৃতি সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন।
অভীক মঙ্গলের সর্বোচ্চ বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান মার্স ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের একজন সিনিয়র উদ্ভিদ বিজ্ঞানী। মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে তার এই পদোন্নতি অনেকের কাছেই ঈর্ষার ব্যাপার। কিন্তু তাকেও সেন্ট্রাল ফরেস্টের কেন্দ্রস্থলে আসার অনুমতির জন্য নয় মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে। এই দীর্ঘ অপেক্ষার অন্যতম কারণ, ঠিক দশ বছর আগে অভীকের বাবা আর একজন বিজ্ঞানী সহ রাতারাতি জঙ্গলের এই অংশ থেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের চারজন সহকারীকে বদ্ধ উন্মাদ অবস্থায় জঙ্গল থেকে উদ্ধার করা হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত দুজন বিজ্ঞানীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
দ্বাবিংশ শতাব্দীর প্রথমে ভাগে পৃথিবীর মানুষেরা মঙ্গলে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করে। মঙ্গলের বসবাসকারী প্রত্যেকে ছিল পৃথিবীর ক্ষমতাধর ব্যক্তি। পৃথিবীর অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে তাদের হাতেই ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীতে পরিবর্তন আসে। একদল নতুন ক্ষমতাবান শ্রেণির উদ্ভব হয়। আর অনিবার্যভাবেই ত্রয়োবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে শুরু হয় ক্ষমতা দখলের নতুন লড়াই যা ইতিহাসে পৃথিবী-মঙ্গলের যুদ্ধ নামে পরিচিত। বিজ্ঞানী অগ্নিশেখর বোস এবং অভীকের বাবা কেন্দ্রীয় জঙ্গলের এক গবেষণাকেন্দ্রে এমন কিছু নিয়ে গবেষণা করছিলেন যা হয়তো এই যুদ্ধকে রোধ করতে পারত। কিন্তু দুই বিজ্ঞানী বাকি চার সহকর্মী সহ রাতারাতি হারিয়ে যান। গবেষণা কেন্দ্রের চারপাশে লাগানো অত্যাধুনিক ক্যামেরা যেগুলো ত্রিমাত্রিকভাবে দুই কিলোমিটার ব্যাসার্ধের সমস্ত কিছু রেকর্ড করতে সক্ষম, সেগুলোও সেদিন অকেজো হয়ে পড়ে। ওইদিন তাই ঠিক কী ঘটেছিল কারো পক্ষে জানা সম্ভবপর হয়নি। দুই বিজ্ঞানী ঠিক যেন হাওয়ায় কর্পূরের মতো উবে গেছেন।
অভীককে শুধুমাত্র চারদিন এই জঙ্গলে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। জঙ্গলে সেরকম কোনো ভয়ংকর প্রাণী না থাকায় অভীক একাই এসেছে। উঠেছে সেই পুরোনো গবেষণা কেন্দ্রে। সম্ভাব্য যে-কোনো ধরনের বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তার সঙ্গে দুটো ড্রোনও পাঠানো হয়েছে যেগুলো সর্বক্ষণ তার ত্রিমাত্রিক ছবি সরাসরি মূল গবেষণা কেন্দ্রে পাঠাবে।
মঙ্গলের গাছপালা পৃথিবীর মতো নয়। অনেকটাই আলাদা। সবুজের তুলনায় বেগুনি, কমলা, লাল—এই তিন রঙের আধিক্য লক্ষ করা যায়। প্রথমে পৃথিবী থেকে বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা এনে লাগানো হয়েছিল। কালক্রমে মঙ্গলের মাটি ও জলবায়ুর প্রভাবে খুব দ্রুত মিউটেশনের ফলে আজকের এই রূপে এসে পৌঁছেছে। এই মিউটেশন এখানেই থেমে নেই, এখনো এই প্রক্রিয়া চলছে। তাই বছর বছর নতুন প্রজাতির গাছপালা খুঁজে পাওয়া এই গ্রহের সাধারণ ঘটনা।
অভীকের গাছেদের প্রতি ভালোবাসা পৈতৃক সূত্রে পাওয়া। ছোটোবেলা থেকেই তার বাবা তাকে চিনিয়ে দিতেন বিভিন্ন ফুল, ফল, লতা-গুল্মের গাছ। এতসব গাছের মধ্যে তার বাবার প্রিয় ছিল রামধনু ফুল। আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে ফুলটি প্রথম ফুটেছিল। তখন সে ছিল সাধারণ বেগুনি রঙের একটি ফুল। কিন্তু প্রতি পাঁচ বছরে সেই ফুলে নতুন পাঁপড়ি আর রঙের দেখা মিলল। আর আশ্চর্যজনকভাবে রঙের ক্রমগুলো ছিল রামধনুর রঙের মতো। এই তিনদিনে অনেক আকারের-বর্ণের-গন্ধের ফুলের পাশাপাশি কয়েকটি রামধনু ফুলের ঝোপও অভীকের চোখে পড়েছে। নতুন নতুন উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহ করেছে পর্যাপ্ত, কিন্তু বিজ্ঞানীদের হারিয়ে যাওয়ার পেছনে কোনো সূত্র সে আবিষ্কার করতে পারেনি।
বছর খানেক আগে অভীক প্রথম আশার আলো দেখতে পায়। নিখোঁজ হওয়ার নয় বছর পর্যন্ত সে তার বাবার পড়ার ঘর অনেকবার খুঁজে দেখেছে যদি কোনো সংকেত খুঁজে পায়, কিন্তু প্রতিবার সে ব্যর্থ হয়েছে। সেদিনও অনেক খোঁজাখুঁজির পর কিছু না পেয়ে হতাশ হয়ে চেয়ারে বসে ছিল। বাবার সঙ্গে কাটানো ছোটো ছোটো মুহূর্তগুলো মনের কোণ থেকে এক এক করে তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। এমন সময় তার চোখ পড়ল টেবিলের ওপর। বাবার বানানো ক্যামেরাটার দিকে, যদিও সেটা অসম্পূর্ণ। পুরোপুরি বানানোর আগেই তাঁকে সেন্ট্রাল ফরেস্টের গবেষণা কেন্দ্রে চলে যেতে হয়েছিল। এর আগেও ক্যামেরাটাকে অন্তত কয়েকশো বার সে দেখেছে। কিন্তু আজ তার মনে পড়ে গেল সেই দিনের একটা ছোট্ট ঘটনার কথা।
সেদিন বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। অভীকের কিচ্ছু ভালো লাগছিল না। পড়ার ঘরে এসে দেখতে পেল, বাবা একমনে কিছু একটা করছেন। অভীককে দেখতে পেয়ে তিনি বললেন, “কী রে, কিছু বলবি?”
“না, মানে তুমি ক’দিনের জন্য যাচ্ছ?” একটু ইতস্তত করে অভীক।
ছেলের দিকে স্নেহভরা দৃষ্টিতে তাকান ডঃ দাস। অভীকের যখন দুই বছর বয়স তখন তার মাতৃবিয়োগ ঘটে। কিন্তু ডঃ দাস ছেলেকে মায়ের অভাব কখনো বুঝতে দেননি। তাই অভীক একটা দিনও বাবাকে ছেড়ে থাকতে চাইত না।
“তুই চিন্তা করিস না, খুব তাড়াতাড়ি আমি ফিরে আসব। তাছাড়া তুইও তো এখন বড়ো হয়ে গেছিস।”
কথাগুলো বলে ঠোঁটের কোনায় হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে তোলার ব্যর্থ চেষ্টা করেন ডঃ দাস। এরপর কিছুটা সময় পুরো ঘর জুড়ে এক নিস্তব্ধতা। বাইরের বৃষ্টির শব্দ সেই নিস্তব্ধতাকে যেন আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল।
ডঃ দাস পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বললেন, “এদিকে আয়। দেখ কী বানাচ্ছি। এটা দেখ।” বলে টেবিলে রাখা অসম্পূর্ণ ক্যামেরাটার দিকে দেখালেন। “তুই তো জানিস এখানকার প্রত্যেকটা যন্ত্র স্যাটেলাইটের সঙ্গে যুক্ত। মঙ্গল সরকার সবকিছুর উপর নজর রেখেছে, তাদের চোখ এড়িয়ে কোনো কিছু এখানে সম্ভব নয়। তাই দেখ, আমি বানিয়েছি দুটো ক্যামেরা। এগুলো দুই কিমি ব্যাসার্ধের সমস্ত কিছু ত্রিমাত্রিকভাবে রেকর্ড করতে সক্ষম। পাশাপাশি আমি এগুলো এমনভাবে বানিয়েছি যে এগুলো একটানা বারো বছর ধরে সবকিছু রেকর্ড করতে পারবে আর এগুলো অফলাইন থেকেই কাজ করে যাবে।”
“কিন্তু বাবা, হঠাৎ করে এগুলো বানালে কেন?” প্রশ্ন করে অভীক।
“তুই তো জানিস রামধনু ফুল আমার কত পছন্দের। আগামী দশ বছরে ফুলগুলো তাদের সাত রঙের চক্র সম্পন্ন করবে। আর সেন্ট্রাল ফরেস্ট হল এই ফুলের সবথেকে বড়ো সংগ্রহশালা। সেন্ট্রাল ফরেস্টের বাইরে অনেক জায়গায় এই ফুলের চাষ করা হলেও প্রত্যেক জায়গায় মানুষের হাতের ছোঁয়া থাকে। কিন্তু আমি চাই প্রকৃতি কীভাবে এদের বড়ো করে তোলে সেই মুহূর্তগুলো ক্যামেরায় ধরে রাখতে।”
বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনছিল অভীক। কথাগুলো শেষ হতেই সে তার বাবাকে প্রশ্ন করল, “কিন্তু বাবা, দশ বছর পর ক্যামেরাগুলো কে নিয়ে আসবে?”
অভীকের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ডঃ দাস বললেন, “কে আবার? তুই! তুই যখন বড়ো উদ্ভিদ বিজ্ঞানী হবি, তখন তো তোর যাওয়া আসা লেগেই থাকবে সেন্ট্রাল ফরেস্টে।”
কথাটা বাবা ঠিকই বলেছিল। মনে মনে চিন্তা করে অভীক। কিন্তু সেন্ট্রাল ফরেস্টের অন্যান্য অংশে আসা যাওয়া থাকলেও কেন্দ্রীয় অংশে এই প্রথমবারের জন্য আসা।
সেই দিনের ঘটনার কিছুদিন পরেই বাবাকে চলে যেতে হয়েছিল সেন্ট্রাল ফরেস্টের সেই গবেষণাকেন্দ্রে। আর একটা ক্যামেরা অসম্পূর্ণভাবেই পড়ে ছিল তাঁর টেবিলে।
সেদিন টেবিলে রাখা ক্যামেরাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অভীকের মনে পড়ে গেল বাবার সেই কথাটা, ‘দুটো ক্যামেরা।’ তাহলে আরেকটা নিশ্চয়ই বাবা সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। অন্ধকারের মাঝে যেন আশার আলো দেখতে পেল অভীক।
এই তিনদিনে অনেকগুলো রামধনু ফুলের ঝোপের সন্ধান পেয়েছে অভীক। সেগুলোর আশেপাশের জঙ্গলের প্রতিটা ইঞ্চি খুঁজেও ক্যামেরার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি সে। আজও প্রায় দুপুর অবধি খোঁজাখুঁজির পর ব্যর্থ হয়ে সবুজে বেগুনি মেশানো ঘাসের উপর বসে পড়ল অভীক। তাহলে সত্যি কি তাকে খালি হাতে ফিরে যেতে হবে? চারদিনে কেন্দ্রীয় গবেষণাকেন্দ্রর চারদিক খুঁজে দেখল সে। কিন্তু তার প্রাপ্তি শুধুই হতাশা। মাথার উপরে সূর্য দিগন্তের দিকে ঢলে পড়েছে, আর কিছুক্ষণের মধ্যে সূর্য অস্ত যাবে। আর এর সঙ্গেই অভীকের শেষ আশা মিলিয়ে যাবে অন্ধকারে।
উঠে দাঁড়াল অভীক। শেষবারের মতো চারদিকের জঙ্গলের দিকে তাকাল সে। পড়ন্ত সূর্যের আলোতে ঘন গাছের সারির ফাঁক দিকে পূর্বদিকের জঙ্গলে একটা রামধনু আভা দেখা যাচ্ছে। তিনদিনে সে যতগুলো রামধনু ফুলের ঝোপের দেখা পেয়েছে, এর রূপ যেন তাদের সবগুলোকে ছাপিয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি সেদিকে হাঁটতে শুরু করল অভীক। হাঁটতে গিয়ে তার মনে একটা খটকা লাগল। এতক্ষণ সে যে জায়গাটায় বসে ছিল সেই জায়গাটা কেউ যেন কম্পাস দিয়ে নিখুঁতভাবে বৃত্তকারে বানিয়েছে। কিন্তু এখন এতকিছু ভাবার সময় তার নেই।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সে পৌঁছে গেল ঝোপটার কাছে। একে ঝোপ না বলে বাগানই বলা যায়। ফুলগুলো যেন আশেপাশের পুরো জঙ্গলটাকে আলো করে রেখেছে। এটাই তার কাছে শেষ সুযোগ। ঈশ্বরের নাম নিয়ে আশেপাশের জঙ্গল তন্নতন্ন করে খুঁজতে শুরু করে অভীক। ঘণ্টা খানেকের চেষ্টায় একটা বড়ো গাছের কোটরে সে তার বাবার বানানো ক্যামেরাটা খুঁজে পায়।
ক্যামেরা সঙ্গে করে অভীক যখন গবেষণা কেন্দ্রে ফিরল তখন মঙ্গলের পাখিরাও এক এক করে ঘরে ফিরছিল।
রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করে অভীক যখন নিজের ঘরে এল তখন রাত দশটা। ক্যামেরাটা এমনভাবে তৈরি যে এখনো সচল আছে। ক্যামেরার স্ক্রিনে আঙুল ছোঁয়াতেই ফুটে উঠল সেই ফুল-বাগানের ছবি। কিন্তু অভীকের আসল উদ্দেশ্য হল বাবার অন্তর্ধান রহস্যের প্রকৃত সত্যিটা জানা। তাই সে মেনুতে গিয়ে সেই দিনের ভিডিও চালাল যেদিন ডঃ দাস প্রথমবার এই গবেষণাকেন্দ্রে এসেছিলেন। খুঁজে খুঁজে অভীক তার বাবার ছবির উপর আঙুল দিয়ে একটা বৃত্ত আঁকল। এরপর সর্বক্ষণ ক্যামেরার ফোকাস গিয়ে পড়ল তার বাবার উপর। ক্যামেরায় ডঃ দাসের প্রতিটা পদক্ষেপের চিত্র ভেসে উঠতে থাকল, শুধুমাত্র গবেষণা কেন্দ্রের ভেতরের ছবিগুলো ছাড়া। কারণ, গবেষণা কেন্দ্রের চারপাশে এমন ডিভাইস বসানো থাকে যেন কেউ বাইরে থেকে তরঙ্গের মাধ্যমেও ভেতরের কোনো কিছু রেকর্ড করতে না পারে।
প্রথম কয়েকদিন স্বাভাবিকভাবেই কাটলো। সপ্তমদিনে বিকেলে দুজন বিজ্ঞানী একবার জঙ্গলের দিকে গিয়েছিলেন। জঙ্গলের ফাঁকামতো একটা জায়গায় দুই বিজ্ঞানী এসে দাঁড়ালেন। ডঃ বোস প্রথমে বললেন, “এই জায়গা এক্সপেরিমেন্টের জন্য একদম ঠিকঠাক। আগামীকাল থেকে এখানে মেশিনটা বসানোর কাজ শুরু করা হবে।”
“কিন্তু আপনি কি নিশ্চিত, এটা একদম ঠিকঠাক কাজ করবে?” ডঃ দাস দ্বিধান্বিতভাবে প্রশ্ন করলেন।
“এসব কী বলছ অনির্বাণ! তুমি তো নিজের চোখেই দেখলে চার-চারটা ধাপের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শেষ করেই আমরা শেষ ধাপে এসে পৌঁছেছি।”
“তবু ভয় হচ্ছিল, সেন্ট্রাল ফরেস্টের দক্ষিণ-পূর্বদিকে প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ বাস করে, তাদের কোনো ক্ষতি হবে না তো?”
“কিচ্ছুটি হবে না।” আশ্বস্ত করার সুরে বললেন ডঃ বোস। “আমার এই যন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য হল মানুষের মন থেকে ‘সেভেন ডেডলি সিন’ মুছে ফেলে শিশুর মতো পবিত্র করে তোলা। এই যন্ত্রের মাধ্যমে আমি এমন এক তরঙ্গ ছড়িয়ে দেব যা মানুষের মস্তিষ্কের খারাপ দিকগুলো প্রশমিত করে দেবে। আর মঙ্গল কর্তৃপক্ষ সর্বপ্রথম দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে পরীক্ষা চালাতে বলছে। জানোই তো, মঙ্গল সরকারের মতে তুলনামূলক কম বিত্তবান হওয়ায় ওই অঞ্চলের অপরাধ প্রবণতা সর্বোচ্চ।”
“তবু মনটা কেমন যেন করছে ডঃ বোস।”
“তুমি ওসব নিয়ে একদম চিন্তা কোরো না। তুমি আজন্ম এখানকার বাসিন্দা, তাই কখনো জীবনের রূঢ় সত্যগুলো অনুভব করোনি। কিন্তু আমার বেড়ে ওঠা পৃথিবীতে, আমি দেখেছি কীভাবে লোকেরা একটুকরো রুটির জন্য লড়াই করে। আমি দেখেছি কীভাবে নরপিশাচরা একজন মায়ের কোল থেকে তার বাচ্চাকে কেড়ে নিয়ে যায়। বারো ঘণ্টা কাজ করেও একজন পিতা ছেলেমেয়েদের মুখে শুধুমাত্র দু-মুঠো খাবার তুলে দিতে পারে, কিন্তু অসুস্থ সন্তানের চিকিৎসা করাতে না পেরে নীরবে কাঁদে।” কথাগুলো বলতে বলতে ডঃ বোসের চোখে জল চলে আসে। তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে ডঃ দাসকে প্রশ্ন করেন, “তুমি যে টাইম মেশিন বানাচ্ছিলে তার কাজ কতদূর?”
“আপনি তো জানেন এসব ব্যাপারে হয় শূন্য, নয়তো একশো শতাংশ। মাঝামাঝির কোনো জায়গা নেই। আমি কোনো জিনিসকে অতীত কিংবা ভবিষ্যতে পাঠাতে সক্ষম হলেও তাদেরকে স্টেবল রাখতে পারছি না। প্রতিবার ভৌত গঠন ভেঙে যাচ্ছে। ধরুন, একটা আপেলকে পাঁচ মিনিট ভবিষ্যতে পাঠালাম। পাঁচ মিনিট পর সেটা এসে পৌঁছনোর পর তাকে আর আপেল বলে চেনা যাচ্ছে না। মৌলগুলো এক থাকলেও জিনিসটা পুরো পালটে যাচ্ছে।” ব্যর্থতায় মাথাটা নীচু হয়ে এল ডঃ দাসের।
“আমি কি দেখতে পারি?”
“অবশ্যই। মেশিনটা আমার সঙ্গেই থাকে।” বলে একটা বড়ো রুবিক কিউবের মতো জিনিস নিজের সাইড ব্যাগ থেকে বের করে ডঃ বোসের হাতে দিলেন ডঃ দাস।
কিছুক্ষণ দেখে মুচকি হেসে ফেরত দিলেন ডঃ বোস।
এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু এই ঘটনার দুদিন পরে যা যা ঘটেছিল তা দেখে অভীক রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। হৃদস্পন্দন এতটাই বেড়ে গেল যে তার মনে হচ্ছে সে পাগল হয়ে যাবে। শেষের পরিণতি দেখে তার চোখ বেয়ে নিঃশব্দে নেমে এল অশ্রুধারা।
ডঃ বোসের মেশিন সেট-আপে দুদিন চলে গেল। ডঃ বোস, ডঃ দাস আর তাদের চারজন সহকারী সবাই প্রস্তুত সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য। মঙ্গল সরকারের উচ্চপদস্থ কর্তারাও সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি ত্রিমাত্রিক ভিডিও কলের মাধ্যমে সরাসরি দেখছেন।
পুরো প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার ঠিক প্রাক মুহূর্তে হঠাৎ করে সব যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেল। সকলে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। কিন্তু ডঃ বোস নিরুত্তাপ। তিনি বললেন, “অনির্বাণ, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এদিকে এসো। তাড়াতাড়ি যোগাযোগ ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে। ততক্ষণ একটা মজার জিনিস দেখো।”
চারজন সহকারী একটু দূরেই দাড়িয়ে ছিল। ডঃ বোস মেশিনটার স্ক্রিনে কিছু নির্দেশ দিচ্ছিলেন, ডঃ দাস সেদিকেই তাকিয়ে ছিলেন। ডঃ বোসের কার্যকলাপ দেখে তিনি অবাক হয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকালেন। পুরো ব্যাপারটা যখন বুঝতে পারলেন তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। চারজন সহকারীর আচরণে কেমন একটা অদ্ভুত ভাব। হঠাৎ করে যেন তাদের সমস্ত মানবীয় গুণ লোপ পেয়ে গেছে। সকলে নিরীহ বন্যজন্তুদের মতো আচরণ করতে লাগল। তারপর তারা দৌড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল গভীর জঙ্গলে।
ডঃ বোসের চোখে ফুটে উঠল একটা হিংস্র হাসি। “তুমি এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমার উদ্দেশ্য? আমি পরিকল্পনা করে সকল যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিন্ন করে দিয়েছি। আমার এই যন্ত্র শুধু কিছু ‘সেভেন ডেডলি সিন’ ধ্বংস করার জন্য বানাইনি। মানুষের সকল মানবিক অস্তিত্ব মুছে দিতে সক্ষম আমার এই যন্ত্র। আর কোনোদিন পৃথিবী-মঙ্গলের যুদ্ধ হবে না। কারণ, এই সৌরজগতের সবার জন্য আমি হব একমাত্র ঈশ্বর।”
ডঃ দাসের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে এল। “যে পৃথিবী আপনাকে বড়ো করেছে, যে মঙ্গল আপনাকে গবেষণা করার সুযোগ দিয়েছে, আপনি তাদের সঙ্গে এমনটা কীভাবে করতে পারেন?”
ডঃ বোসের চোখদুটো যেন জ্বলে উঠল। আক্রোশের সঙ্গে বলতে লাগলেন, “মঙ্গল আমাকে কী দিয়েছে? কিচ্ছু না। পৃথিবী থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে এসে মঙ্গলকে সাজিয়ে তুলেছে। পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ শুষে নিয়ে তাকে ছুড়ে ফেলেছে চরম দারিদ্রতায়। পৃথিবীকে করে তুলেছে নরকের থেকেও ভয়ানক।”
“কিন্তু পৃথিবীর লোকেরা আপনার নিজের। তারা কী দোষ করল?” মিনতির সুরে বললেন ডঃ অনির্বাণ দাস।
এবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন ডঃ বোস, “তুমিও বোকাই রয়ে গেলে অনির্বাণ। তারা মঙ্গলের লোকেদের প্রচ্ছন্নভাবে সাহায্য করেছে। আর নতুন করে কিছু সৃষ্টির জন্য ধ্বংসের প্রয়োজন। এটা আমার কথা নয়, হাজার বছর ধরে পৃথিবীর মহাজ্ঞানী লোকেরাই বলে আসছে। এখন একমাত্র আমি হব এই দুই দুনিয়ার ভগবান।”
ডঃ বোসের সহকারী হওয়ার দরুন ডঃ দাস জানেন, মেশিনটা নতুন করে চালাতে পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড সময় দরকার। তিনি ঠান্ডা মাথায় নিজের কর্তব্য স্থির করে কাঁধের ব্যাগ থেকে বের করলেন তার অসম্পূর্ণ টাইম মেশিন। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে ডঃ বোস প্রথমটায় খেয়াল করেননি।
ডঃ দাস তাঁর টাইম মেশিনটা চালু করতে করতে বললেন, “আমি জানি মানুষেরা সবকাজ হয়তো ঠিক করে না। তারা অনেক অন্যায় করে, কিন্তু হাজার হাজার বছরে মানুষ যা কিছু শিখেছে আপনি একদিনে তা ধ্বংস করতে পারবেন না। আমি আশাবাদী, মানুষেরা একদিন শান্তি প্রতিষ্ঠা করবেই। কারণ, আশা হল মানুষের বেঁচে থাকার সবথেকে বড়ো অনুপ্রেরণা।”
“তুমি এরকম করতে পারো না দাস!” রাগে, আক্রোশে অগ্নিশেখর বোস পাগলের মতো ছুটে গেলেন ডঃ দাসের দিকে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
“তোকে বিদায় জানাতে পারলাম না অভীক, তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস।” ভেজা গলায় বললেন ডঃ দাস। তাঁর গাল বেয়ে দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। আর এরপরেই একটা বিদ্যুতের ঝলক দেখা গেল। ডঃ দাসকে কেন্দ্র করে ডঃ বোস এবং তাঁর মেশিন সহ বৃত্তাকারে আশেপাশের সকল জিনিস মুহূর্তে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
পুরো ঘটনাটা দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল অভীক। ধীরে ধীরে তার চোখ থেকে নেমে এল জলের ধারা। সে আপন মনে বলল, “বাবা, আমি জানি না তুমি কোথায় কোন সময়ে হারিয়ে গেলে। কিন্তু তুমি আমার মনে চিরকাল বেঁচে থাকবে।”
পরেরদিন ভোরে গবেষণা কেন্দ্র থেকে চলে আসার আগে অভীক আরো একবার সেই রামধনু ফুলের বাগানে গেল। ফুলগুলোর সাত রঙের চক্র সম্পূর্ণ হয়েছে। সেখান থেকে কিছু ফুল তুলে নিল অভীক। গতকাল সে এই বৃত্তাকার তৃণভূমির অর্থ বুঝতে পারেনি। আজ বুঝতে পারছে, এখানে যা ঘটেছে তা না ঘটলে হয়তো মানব সভ্যতা হারিয়ে যেত এই সৌরজগতের বুক থেকে। হাঁটু গেড়ে বসে ফুলগুলো নিয়ে সেই তৃণভূমির ঠিক মাঝখানে রাখল অভীক। জঙ্গলের বুক চিরে আসা সূর্যের প্রথম কিরণ এসে পড়ল ফুলগুলোর উপর।
অলঙ্করণ: স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস