গল্প-শতবর্ষ পরে-যূথিকা আচার্য- শীত ২০২০

সন্ধ্যা ভট্টাচার্য গল্প প্রতিযোগিতা ২০২০
(নবম দশম স্থানের পাঁচ গল্প)

জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে ভাবছিল বুন্টি, মাকে জানানো কি ঠিক হবে? পঞ্চু যেমন বলল তেমনটাই যদি হয় তো বড়ো বিপদ। দু-চারদিন আগে পঞ্চুর বলা কথাটা এখনো ওর মাথায় ঘুরঘুর করছে। ইন্টারস্পেসিস! মাকে কষ্ট দিতে চায় না বুন্টি, কিন্তু ওর বেস্ট ফ্রেন্ডের কথা শুনে মা যদি বলে ওর সঙ্গে আর মেশা যাবে না, তাহলে! লাজুর সঙ্গে আর কথা বলতে পারবে না, ভাবলেও কান্না পাচ্ছে ওর। ব্যাকপ্যাকটা পিঠে নিয়ে ও বলল, “মা আমি বেরোচ্ছি।”

স্টাডি রুম থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরোলেন সুলেখা, “টিফিনটা নিয়েছিস?”

“হুম, নিয়েছি। তুমি বেরোনোর সময় কী বলবে বলেছিলে যে?”

“ও হ্যাঁ! ভালো মনে করালি। আজকে যাওয়ার সময় শিউলিকে একটু জিজ্ঞাসা করিস তো, যে ওদের ওখানে মাটি আপাতত ঠিক আছে কি না। মেয়েটা দু-হপ্তা আগে বলছিল যে ও আর কয়েকজন নাকি খুব দুর্বল বোধ করছে। যাওয়ার সময় একটু শুনিস ওরা কেমন আছে।”

“কেন মা, মাটিতে আবার ক্যালসিয়াম কম হল নাকি?”

“হ্যাঁ রে, সেইরকমই। আমি ক্যালসিয়াম ফার্টিলাইজার মিশিয়ে দিয়েছি অবশ্য। এতদিনে সবার ভালো হয়ে ওঠার কথা।”

“আচ্ছা, কোন শিউলি বললে না তো।”

“ওহ্ সরি, শিউলি।”

“ঠিক আছে।”

মাকে টাটা করল বুন্টি। সত্যি, মাকে দেখে মাঝে মাঝে হাসিই পায় তার। এত পুরোনো পুরোনো হাজারখানা জিনিস মনে রাখে অথচ ছোটো ছোটো সোজা জিনিসগুলো বেমালুম ভুলে যায়।

বুনিটির মা সুলেখা মিত্র পুরাতত্ত্ব গবেষক। পুরোনো মানব সভ্যতা নিয়ে গবেষণা করছেন।

বিকেলবেলা স্কুল থেকে ফিরে নুডলস খেতে খেতে ও ঠিক করল, মাকে সত্যি কথাটা বলে দেওয়াই ভালো। মা বকুনি দিলে দিক, কিন্তু নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডের কথা লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না আর।

সুলেখা তাঁর স্টাডি রুমে মন দিয়ে একটা থিসিস পড়ছিলেন। বুন্টি সেখানে গিয়ে তাঁকে বলল, “আচ্ছা মা, তুমি যে বলো একশো বছর আগে মানুষ নাকি ভাবত যে পশুপাখি ও গাছেরা কথা বলতে পারে না। এটা কি সত্যি ?”

সুলেখা বললেন, “হ্যাঁ রে বুন্টি, না হলে আর বলছি কী? মানুষ, গাছপালা আর পশুপাখিদের সঙ্গে কথা বলতে শিখেছে মাত্র একশো বছর আগে। তার আগে মানুষ ওদের বলত ‘অবোলা’, মানে যাদের বুলি নেই।”

অবোলা! বুন্টি শুনে হেসেই কুটিপাটি। হি হি হি… কী বোকা ছিল মানুষগুলো। ওদের বাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ঝগড়ুটে চালতা-২ গাছটা দিনরাত সুযোগ পেলেই বোকাসোকা ভালো মানুষ আম-১৯-এর সঙ্গে ঝগড়া করে। ইচ্ছে করলে ওদের ঝগড়া রীতিমতো লাইভ পড়া যায়। তারপর মনে করো রাস্তার ওপাশের বাড়িতে থাকা উমনো-ঝুমনো। লোমওয়ালা ছোট্ট কুকুরটা তার দিকে দেখলেই বলে, “হ্যালো, হ্যালো, কেমন আছ? খেলবে নাকি?” এরা অবোলা হয় কী করে?

মা সুন্দর গল্পের মতো বললেন, “জানিস বুন্টি, ২০৩০ সালের ঘটনা। জাপানি বিজ্ঞানী ম্যাডাম হিরিকো নিশিমাতো তাঁর ল্যাবরেটরিতে বসে কাজ করছিলেন সদ্য নির্মিত ‘টক টু মি’ নামের যন্ত্রটি নিয়ে। তখনকার দিনের হিসেবে সে যন্ত্রটি ছিল যুগান্তকারী। কোমায় থাকা বা অচেতন অবস্থায় থাকা মানুষের ব্রেইন ওয়েভ বা চিন্তা তরঙ্গকে গ্রহণ করে পাঠযোগ্য ভাষায় রূপান্তরিত করত ‘টক টু মি’। ছোট্ট একটা রিমোটের মতো দেখতে যন্ত্রটি টার্গেটের দিকে তাক করে একটি বোতাম টিপে দিলেই হয়ে গেল। অচেতন মানুষটির মনে কী চলছে তা পরিষ্কার জানা যাবে। স্ক্রিনে ফুটে উঠবে সাদাকালো অক্ষর।

“এর ঠিক পনেরো বছর পরে মার্কিন বিজ্ঞানী কার্ল জনসন ‘টক টু মি’-র আপডেটেড ভার্সন তৈরি করছিলেন। কাজ করতে করতে তিনি হঠাৎ দেখলেন যে বোতাম টিপে জীবিত যে-কোনো বস্তুর দিকে তাক করলেই স্ক্রিনে টুকটুক করে ভেসে উঠছে শব্দমালা। প্রথমে কার্ল ভেবেছিলেন যে ব্যাপারটা নিছক অ্যাক্সিডেন্ট। হয়তো যন্ত্রে কোনো গণ্ডগোল হয়েছে। কিন্তু বেশ কয়েকবার পরীক্ষা করার পর তিনি চমকে গেলেন। না, কোনো ভুল নেই, জড়ো বস্তু অর্থাৎ টেবল, চেয়ার, সোফা সেট বা ফুলদানির দিকে তাক করলে কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু কার্লের পোষ্য বেড়ালটির দিকে তাক করতেই ‘টক টু মি’-র স্ক্রিনে আলো জ্বলে উঠল। দেখা গেল, বেড়াল-বাবাজী অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলছেন যে, ‘ও আবার কী! নতুন খেলনা নাকি? তা আমার দিকে তাক করে ধরেছ কী মনে করে? আর পারি না বাপু তোমাদের নিয়ে। আদিখ্যেতা!”

বুন্টি আনন্দে হাততালি দিয়ে বলল, “কী মজা! কী মজা! তারপর কী হল?”

“ব্যাপারটা ধীরে ধীরে কার্লের কাছে নেশার মতো হয়ে দাঁড়াল। নদীর জলে ভাসতে থাকা প্যাঁকপ্যাঁকে হাঁস, মর্নিং ওয়াকে বেরোনো কুকুর, ছোটো ছোটো পোকামাকড়—সবারই মনের কথা জানিয়ে দিচ্ছে ওই খুদে যন্ত্র। একদিন জাস্ট মজা করেই কার্ল রিমোটটিকে তাক করেছিলেন একখানা বহু পুরোনো ওকগাছের দিকে। তিনি কিছু আশা করেননি। এমনিই মজার ছলে করা। এরপরই এল অবাক হওয়ার পালা। উদ্ভিদের ক্ষেত্রে একটু বেশি সময় লাগছে ঠিকই, কিন্তু ‘টক টু মি’-র স্ক্রিনে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে দুর্বোধ্য সংকেতের মতো ভাঙা ভাঙা ইংরিজি শব্দ। কালের বিস্ময়ের সীমা পরিসীমা কিছুই রইল না। বোঝা গেল যে আর একটু খাটাখাটনি করলেই ‘টক টু মি’ উদ্ভিদদের ভাষা বুঝতে সক্ষম হবে। কয়েক বছরের চেষ্টায় তাও হয়ে গেল। পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন কনফারেন্সে লক্ষ লক্ষ মানুষ অবাক হয়ে দেখল যে পশুরা তো বটেই, এমনকি গাছেরাও কথা বলতে পারে। তারা ব্যথা পেলে কাঁদে, আনন্দে হাসে, পারিপার্শ্বিক থেকে শেখে, প্রয়োজনে একে অপরকে সাবধান করে। প্রিয়জনের মৃত্যুতে তারাও হাহাকার করে কাঁদেও।

“বলাই বাহুল্য, মানুষ খানিকটা বিহ্বল হয়ে গেল। উদ্ভিদের চেতনা রয়েছে একথা সবাই জানত, কিন্তু সেই চেতনা যে এতখানি শক্তিশালী তা জানার পর জনমানসে প্রতিক্রিয়া যা হল তা দেখার মতো। সমাজের এক অংশ প্রশ্ন তুলল যে এরপর তো গাছ বা গাছের কোনো অংশই খাওয়া সম্ভব নয়। সে যে প্রাণীহত্যার মতোই পাপ হবে তাহলে। মজার ব্যাপার হল এই যে, এমন সমস্যার সমাধান দিল গাছেরা স্বয়ং। পৃথিবীর প্রতিটি অংশ থেকে বৃদ্ধ গাছেরাই পরামর্শ দিল, খাদ্য হিসেবে গ্রহণে পাপ নেই বাছারা। খাদ্যশৃঙ্খল তো প্রকৃতি মায়ের নিজের হাতের সৃষ্টি। ভারসাম্য বজায় রাখতে হলে খাদ্যশৃঙ্খল তো মেনে চলতেই হবে। তবে অকারণে হত্যা কোরো না। প্রাণী বা উদ্ভিদ কাউকেই নয়।”

একটানা বলে সুলেখা থামলেন।

বুন্টি আবার বলল, “আচ্ছা মা, মানুষ কি আগে অন্যরকম ছিল?”

সুলেখা ভারী গলায় বললেন, “হ্যাঁ রে সোনা। তখনকার পৃথিবী, তখনকার মানুষ সবকিছু অন্যরকম ছিল। আমরা চিন্তাও করতে পারব না। সবসময় একে অপরের ক্ষতি করতে চাইত তখন মানুষ। দেশে দেশে যুদ্ধ, মারামারি লেগেই থাকত সবসময়।”

“তারপর?”

“তারপর মানুষের মধ্যেই কয়েকজন, যাদের মধ্যে শুভবুদ্ধি তখনো অবশিষ্ট ছিল, অনুরোধ করল মহীরূহদের, তারা যেন আমাদের পথ দেখান। এ নিয়ে অবশ্য প্রথমে নানা মুনির নানা মত ছিল। কিন্তু বছর পাঁচেকের মধ্যেই সবাই লক্ষ করল যে, উদ্ভিদদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার পর পৃথিবীতে অপরাধের সংখ্যা নিজে নিজেই কমে যাচ্ছে। পশুপাখি-উদ্ভিদদের সঙ্গে মিশে মানুষ একসময় লজ্জা পেল নিজেদের স্বার্থপরতায়। যেমন ভালো মানুষের সঙ্গে মিশলে দুষ্টু লোকও ধীরে ধীরে ভালো হয়ে যায়, এও যেন ঠিক তেমনি। মানুষের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হল কে কত ভালো হতে পারে সেই নিয়ে। পৃথিবীর সব দেশে জেলখানাগুলি বন্ধ হতে শুরু করল একে একে। অপরাধীই নেই তো জেলখানা দিয়ে হবে কী! জেলখানাগুলির জায়গায় গড়ে উঠল বিদ্যালয় এবং চিকিৎসা ভবন। গাছেদের সংস্পর্শে এসে মানুষ বুঝল যে ধর্মের চাইতেও অনেক বেশি প্রয়োজন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের। লোভ, কাম ও হিংসা কমে যাওয়াতে পৃথিবীর জনসংখ্যা, দূষণ, গণহত্যা, যুদ্ধ সবকিছু কম হল ধীরে ধীরে।

“আবার দেখ, উদ্ভিদদের ব্যাপারে আরো বেশ কিছু মজার জিনিসও জানা গেল। যেমন ধর, এতদিন সবাই ভেবেছিল গাছেরা অবোলা, অর্থাৎ তাদের বুলি নেই। ‘টক টু মি’-র ব্যবহারে জানা গেল যে তারা আসলে টেলিপ্যাথিক ভাষায় যোগাযোগ করে। শিকড়ের মাধ্যমে প্রাইমারি কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক তৈরি করে তারা। এছাড়া কাণ্ড, পাতা ও শাখাপ্রশাখার মাধ্যমেও তারা ভাব বিনিময় করতে সক্ষম। আমাদের যেমন পঞ্চেন্দ্রিয় রয়েছে—চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক—গাছেদের রয়েছে শুধুই স্পর্শ। তারা স্পর্শের মাধ্যমেই সব দেখে, শোনে এবং বোঝে। গাছেদের ভাষার নাম দেওয়া হল ‘আর্বোলিং’ (ল্যাটিন ভাষায় ‘আৰ্বোরা’ মানে উদ্ভিদ এবং ‘লিঙ্গুয়া’ মানে ভাষা অর্থাৎ ল্যাঙ্গুয়েজ)। ‘টক টু মি’-র সেটিংসে গিয়ে পছন্দমতো ভাষা সিলেক্ট করে নিলেই হল। ওই যন্ত্রটি যেমন পশুপাখিদের ভাষার ট্রান্সলেশনে সক্ষম, তেমনি সে আর্বোলিংকেও ব্যবহারকারীর প্রয়োজনমতো বাংলা, স্প্যানিশ, ইংরিজি বা অন্য যে-কোনো ভাষায় ট্রান্সলেট করে দেয়।

“অবশ্য সবকিছু কি আর ট্রান্সলেট করা যায়? যেমন মনে কর, গাছেদের নাম। না না, শিমূল, আম, পলাশ সেসব নামের কথা বলছি না। সেসব তো মানুষের দেওয়া নাম। গাছেদের আসল নামের কথা বলছি, মানে যে নামে তারা একে অপরকে চেনে। আমাদের যেমন অমল, শ্যামল, উইলিয়াম, সারা। তোর নাম বুন্টি, আমার নাম সুলেখা, তেমন নাম। জানা গেল যে প্রত্যেকটা গাছেরও তেমনি নিজস্ব নাম রয়েছে। হ্যাঁ, এটা একটা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার যে সেই নাম উচ্চারণ করার মতো ক্ষমতা কোনো স্বাভাবিক মানুষের নেই আর কখনো হবে বলেও মনে হয় না।”

মার কথা শুনে বুন্টি দুই ঝুঁটিওয়ালা ছোট্ট মুণ্ডু নাড়িয়ে বিজ্ঞের মতো বলল, “ঠিক কথা, ঠিক কথা। এটা আমি জানি।”

“কী জানিস?”

“গাছেদের আসল নাম বড়ো কঠিন।”

সুলেখা ঠোঁট চেপে হাসলেন। “আচ্ছা বল তো, আমাদের পাড়ার গার্ডিয়ান, মানে যে বটগাছ রয়েছেন তার আসল নাম কী?”

বুন্টি বলল, “থামো, লিখে দেখাচ্ছি। বলতে পারব না।”

রুল টানা খাতায় গোটা গোটা অক্ষরে যত্ন করে সে লিখল ‘শ্রী ক্ৰহ্মগৌক্রোঞ্চকৃমস্গম’

“বাহ্, একদম একশোয় একশো!”

বুন্টি চোখদুটো বড়ো বড়ো করে বলল, “আমি কাঞ্চন-২-এরও আসল নাম জানি।”

“কী করে জানলি?”

“ও আমাকে নিজেই বলেছে।”

“লিখে দেখা তো দেখি।”

বুন্টি আবার লিখল ‘শ্রীমতী গ্রিনুত্রিংক্রিসক্রিনদৃ’

সুলেখা অবাক হয়ে বললেন, “বাবা বুন্টি! তুই তো দেখি সত্যিই অনেক কিছু শিখে গেছিস।”

বুন্টি বলল, “তারপর? তারপর কী হল বলো।”

“হ্যাঁ, যেমন বলছিলাম। বুঝতেই তো পারছিস যে গাছেদের নামগুলো ভারি কঠিন। উচ্চারণ করা তো দূরের কথা, শুনলেই কান-মাথা ঝিমঝিম করে। সেইজন্য তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে মানুষ ঠিক করল অত কঠিন নামের বদলে সোজা নম্বর সিস্টেম রাখলেই সবার সুবিধে হয়। এক পাড়াতে তিনটে আমগাছ রইলে তাদের নাম হল বয়সানুক্রমে আম-১, আম-২ আর আম-৩। যে গাছের যত কম বয়স, তার পাশে তত বড়ো সংখ্যা।

“গাছেরা তো একথা শুনে হেসে প্রায় মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। তারা জানাল যে উদ্ভিদদের চোখে মানব সভ্যতা নিতান্তই শিশু। সামান্য নাম যারা মনে রাখতে পারে না, তারা বাচ্চা নয়তো আর কী! কাজেই আমাদের মারামারি, হানাহানি, দেশে দেশে ঝগড়াঝাঁটি কোনো কিছুতেই তারা অবাক বা বিরক্ত কিছুই হয় না। যে-কোনো নতুন সভ্যতার শুরুতেই নাকি অমনটাই হয়। পরে যত সভ্যতা পুরোনো হয় ততই জীব বোঝে যে জীবনের আসল উদ্দেশ্য হল বস্তুর স্বার্থে একের আত্মত্যাগ।

“ত্যাগের বাণী একমাত্র উদ্ভিদের মুখেই শোভা পায়। ছোট্টো এতটুকুনি ঘাস থেকে শুরু করে গ্রহের সবচাইতে বড়ো মহীরূহটিও বাঁচে একমাত্র পরের উপকারের জন্য। বাঁচার মতো বাঁচা তো তাকেই বলে। উদ্ভিদের দল নিজেরাই এগিয়ে এসে কথা বলল রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে। প্রাচীন, প্রবৃদ্ধ উপদেষ্টাদের পরামর্শে পৃথিবীতে পরিবর্তন এল খুব দ্রুত। একশো বছর আগে যেখানে দেশে দেশে যুদ্ধ হত খনিজ বা খাদ্যের ওপর অধিকার নিয়ে, সেখানে এখন রাষ্ট্রনায়করা নিজেদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা করেন কে কাকে কত বেশি সাহায্য করবে তাই নিয়ে। খবরের কাগজে খুললেই চোখে পড়ে মৈত্রীর সংবাদ। সবাই গাছেদের মতো হওয়ার চেষ্টা করছে। প্রত্যেকটি দেশে সসম্মানে রাষ্ট্রনায়কদের প্রধান উপদেষ্টার স্থান দেওয়া হল সেই দেশের প্রাচীনতম বৃক্ষটিকে। তাদের নাম হল রাষ্ট্রপিতা।”

বুন্টি বলল, “আচ্ছা মা, আর্বোলিং কি খুব কঠিন ভাষা? কিন্তু তুমি যে বলো গাছেরা খুব সহজ সরল। তাহলে ওদের ভাষা এত কঠিন হল কেন? রাষ্ট্রপিতাদের লেখা কয়েকটা গান তো আমিও পড়েছি। কিছু বুঝতে পারিনি।”

সুলেখা বুঝিয়ে বললেন, “দেখ বুন্টি, আর্বোলিং যে খুব কঠিন ভাষা তা কিন্তু নয়। উদ্ভিদদের ভাষা সংকেত নির্ভর। এইধরনের ভাষার ক্ষেত্রে ‘কী বলা হচ্ছে’-র থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ‘কীভাবে বলা হচ্ছে’। খানিকটা মন্ত্রোচ্চারণের মতো বলতে পারিস। আর গাছেদের সহজ সরল হওয়ার ব্যাপারে বলব যে সহজ হওয়া মানেই যে সে জটিলতা বোঝে না, তা কিন্তু নয়। বরং উল্টোটাই সত্যি। দেখবি যে মানুষ যত গভীরভাবে জ্ঞানার্জন করে সে ততই সরল স্বভাবের হয়। গাছেদেরও ঠিক তেমনি। পার্থক্য শুধু একটাই যে অত জ্ঞান লাভের জন্য মানুষকে চরম পরিশ্রম করতে হয়, কিন্তু লক্ষ কোটি বছরের ইভোলিউশনের ফলে উদ্ভিদেরা ভীষণ কম সময়ে এবং পরিশ্রমে সেই একই প্রজ্ঞা অর্জন করতে পারে।”

“কিন্তু রাষ্ট্রপিতাদের গানগুলো অত কঠিন কেন?”

“মনে রাখিস, তুই কিন্তু অনুবাদ পড়ছিস। ‘টক টু মি’ যা অনুবাদ করছে, সেটুকুই জানতে পারছি আমরা। শুধুমাত্র অনুবাদ শুনে একটা ভাষাকে বিচার করা কি ঠিক? তুইই বল।”

বুন্টি মাথা নীচু করে একটা পেনের ঢাকনি চিবোচ্ছিল। মনে মনে ভাবছে, মাকে বলব কি বলব না। মা যদি বকে? আবার ভাবছে, মা তো উদ্ভিদদের এত ভালোবাসে। মা নিশ্চয় বুঝবে।

সুলেখা আড়োচোখে দেখলেন মেয়েকে। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছেন যে বুন্টি আসলে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু যে-কোনো কারণেই হোক বলতে ভয় বা লজ্জা পাচ্ছে। তিনি বুন্টিকে কোলে বসিয়ে বললেন, “হ্যাঁ রে, তুই তো অনেকগুলো প্রশ্ন করলি। এবার আমি একটা প্রশ্ন করি। কী হয়েছে বল তো? এত কিছু জানতে চাইছিস আজ! কিছু দুষ্টুমি করেছিস কোথাও বুঝি?”

বুন্টি মার গলা জড়িয়ে বলল, “শোনো না মা, তোমাকে চুপিচুপি একটা কথা বলব। আমার না, একজন বেস্ট ফ্রেন্ড হয়েছে।”

সুলেখা চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন, “বাহ্‌, তাই নাকি! সে তো খুব ভালো কথা। তা আগে বলিসনি কেন? কী নাম শুনি তোর বেস্ট ফ্রেন্ডের।”

বুন্টি লাজুক মুখে বলল, “নাম বললে তুমি বকবে না তো?”

“সে কি! বকব কেন!”

“মানে আমাদের ক্লাস মনিটর পঞ্চু বলছিল যে ইন্টারস্পেসিস বন্ধু বানানো মোটেই ভালো জিনিস নয়। ওর মা বলেছে যে অন্য জাতের সঙ্গে নাকি বন্ধুত্ব করতে নেই।”

সুলেখা মনে মনে ভাবলেন, কিছু মানুষ সত্যিই কখনো বদলাবে না। জাত-পাত-বিদ্বেষের বিষ মানুষের মন থেকে মিটবে কবে কে জানে। তিনি বললেন, “ইন্টারস্পেসিস! হুমম। নট ব্যাড। তা তোমার বন্ধুটি কে? রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার?”

বুন্টি ফিক করে হেসে বলল, “যাহ্, ওর নাম লাজু। পুরো নাম লজ্জাবতী-৩৮০, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।”

“বাহ্, দারুণ তো! অত্তটুকুনি ছোট্ট গাছের সঙ্গে তোর বন্ধুত্ব হল কী করে শুনি? দেখিস বাপু, সাবধানে মেলামেশা করিস। আদর করতে গিয়ে যেন মাড়িয়ে দিও না তোমার বেস্ট ফ্রেন্ডকে।”

“মা, তুমি রাগ করোনি তো?”

মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে সুলেখা বললেন, “দূর বোকা, রাগ করব কেন? বরং খুশি হয়েছি। ট্রিজ আর ফার বেটার দ্যান পিপল। বুঝলি!”

বুন্টি মাকে জড়িয়ে ধরে চকাস করে চুমো খেল। “বাট মাই মাম্মি ইজ দ্য বেস্ট!”

অলঙ্করণ: স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s