গল্প চক্রধরের চরকি পাক সপ্তর্ষী চ্যাটার্জি শীত ২০২০

জয়ঢাক ঘাটশিলা সাহিত্য ট্রেক ২০২০র  দ্বিতীয় সেরা গল্প

সপ্তর্ষী চ্যাটার্জির আগের গল্প ঝন্টুর ঝঞ্ঝাট, রক্তসূত্র

“দেখ পচা, বাবা আমার জন্মদিনে কাল এই গাড়িটা কিনে দিয়েছে! দেখছিস কেমন আওয়াজ হয়, আলো জ্বলে? আর কী জোরে যে যায়!”

তা তো বটেই। পচা একদৃষ্টে তোতনের নতুন গাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকে। সেটা যে শুধু দেখতেই দারুণ তাই নয়, চলতে চলতে হঠাৎ করে গাড়ির দরজাটা খুলে যাচ্ছে, আলো জ্বলছে, আবার শব্দও হচ্ছে।

পচার মা তোতনদের বাড়িতে কাজ করে। তাই সে মায়ের সঙ্গে মাঝে মাঝে এ বাড়িতে আসে। আজ আসার কারণ অবশ্য বিশেষ। গতকাল ছিল তোতনের জন্মদিন। প্রায় তারই বয়সী ছেলে তোতন। অনেক খাওয়াদাওয়া, গানবাজনা, হই-হুল্লোড় এলাহি ব্যাপার হয়েছিল নাকি! বেশ কিছু খাবারদাবার বেঁচে গেছে, ফ্রিজে ছিল। সেগুলো নিতেই পচার মাকে ডাকা, সঙ্গে সেও এসেছে। হোক না বাসি, এসব ভালোমন্দ কি আর রোজ রোজ খেতে পাওয়া যায়? তোতন অ্যাত্তো অ্যাত্তো গিফট পেয়েছে। সেইসব অতি উৎসাহ নিয়ে সে পচাকে একটা একটা করে দেখাচ্ছিল। পচা কিন্তু নিজের জন্মদিনে কিচ্ছু উপহার পায় না। উপহার তো দূরস্থান, জন্মদিনটাই মনে থাকে না তার। ফি-বছর কখন জানি সেটা আসে আর চলে যায়। আর পাঁচটা দিনের মতোই। তোতনকে তাই তার একটু একটু হিংসে হয়। এখন, বিশেষ করে ওই গাড়িটার জন্য তার মন কেমন করছে। ওটা হাতে নিয়ে খেলতে খুব ইচ্ছা করছে তার। বেশি নয়, একটুখানি খেলেই না হয় ফেরত দিয়ে দেবে আবার। কিন্তু তোতন সেটা হাতছাড়া করলে তো!

এইসব ভাবনার মধ্যেই মা ডাক দেয় পচাকে। কাজ হয়ে গেছে। এবার বাড়ি ফিরতে হবে। যেতে যেতে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়িটার দিকে আরেকবার আড়চোখে তাকায়।

খেলনা গাড়িটা সত্যিই দারুণ দেখতে। যেমন ঝকঝকে সোনালি রঙ, তেমন মজবুত মসৃণ চাকা। চাবি-টাবির দরকার নেই। একবার টেনে ছেড়ে দিলেই যে-কোনো দিকে তিরবেগে ছুটে যায়। আর এতেই হয়েছে গাড়িটার মুশকিল। সে বেচারা দু-দণ্ড জিরোতেও পারে না। সেই যেদিন তোতনের বাবা তাকে চালাবার কায়দাটা দেখিয়ে দিয়েছিল, সেই থেকে শুরু হয়েছে। চলছে তো চলছেই। বাব্বা! খুদে যন্তর তোতন দিনরাত বেচারা গাড়িটাকে মেঝেতে ঘষটে ঘষটে দৌড় করাচ্ছে। দেওয়ালের দিকে, খাটের তলায়, আলমারির নীচে ঝুলকালি ভরা ভয়াল অন্ধকারে তাকে ঠেলে দিচ্ছে, ধাক্কা খাইয়ে ছিটকে ফেলছে, উলটে দিচ্ছে, আর কী এক অদ্ভুত আনন্দে হাততালি দিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে। চোখে জল এসে যায় গাড়িটার। তোতনের মাও কীরকম যেন। ছেলে খুশি আছে সেটা ভেবেই নিশ্চিন্ত, গাড়ি বলে সে যেন মানুষ নয়! ওই দেখো, তোমরাও তাই বলছ? বোঝ কাণ্ড! আহা, নাই বা হল তোমাদের মতো হাত-পাওয়ালা মানুষ। তাই বলে ব্যথাবেদনাও কি থাকতে নেই তার?

এই অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য সে মনে মনে ফন্দি আঁটতে থাকে। সুযোগও এসে যায় একদিন।

তখন সকালবেলা। তোতনের বাবা অফিসে, মা রান্নাঘরে ব্যস্ত, ছেলে বইখাতা ফেলে গাড়ি নিয়ে পড়েছে সেই থেকে। হেঁইও হেঁইও হুসসসস! ভ্রুউউ-ভররর-ভ্রুউউউম! হি হি হি হি! ধাক্কা-আ-আ-আ! দেওয়ালের দিকে সজোরে ঠেলে দিয়ে সংঘর্ষ হতেই আনন্দে লাফিয়ে হাততালি দিয়ে ওঠে তোতন। গাড়ি বেচারার দফারফা। জিভ বের করে (মানে, সেটা থাকলে বেরিয়ে আসত নির্ঘাত) সবে একটু হাঁপাচ্ছে, অমনি দ্বিতীয় অ্যাটাক। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগাল সে। বারান্দার দিকের দরজা লক্ষ্য করে ছোট্ট হাতটা যেমনি তাকে ঠেলেছে, অমনি এক ঝটকায় চাকাসুদ্ধ শরীরটা হাওয়ায় ভাসিয়ে চৌকাঠটা পেরিয়ে দমাস করে বারান্দায় পড়ল চক্রধর অর্থাৎ আমাদের এই সাধের গাড়িটি (চক্রধর নামটা ভালো না? আসলে ওর চাকাগুলো দারুণ তো, তাই এই নামটা ওর নিজেরও বেশ পছন্দের)। একতলা বাড়ির বারান্দাটা একদিকে ঢালু আর সেদিকে দেওয়ালেরই গায়ে নীচের দিকে বৃষ্টির জমা জল ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য একটা ছোট্ট নালা। চক্রধরকে আর পায় কে? তিরবেগে ঢাল বেয়ে নেমে সোজা সেই নালা দিয়ে বাইরে। মুক্তি! আহ্‌!

কিন্তু বাইরে কোথায়? ওই নালার মুখে ফিট করা পাইপ দোতলার বারান্দা থেকে সোজা চলে গেছে বড়ো রাস্তার ড্রেনের দিকে। আর কোথায় যাবে? সেই অন্ধকার পিছল পাইপ বেয়ে হুড়মুড়িয়ে নেমে গিয়ে পড়বি তো পড়, সোজা ঝপাং করে পয়ঃপ্রণালীর ময়লা জলেই পড়ল সে। ইশ! কী বাজে গন্ধ, আর কত কী আবর্জনা ভাসছে! সরু সরু কেঁচো আর নানারকম ঘিনঘিনে পোকামাকড় কিলবিল করছে চারপাশে। চক্রধর তো ছোট্ট একটা গাড়ি। তার কাছে সেসব ভিনগ্রহের ভয়ানক জীবের মতোই ঠাহর হচ্ছিল। তারা সব জলে ভাসতে ভাসতে তার কাছে এসে কেউ দেখে, কেউ শুঁকে, কেউ-বা চেখে দেখার চেষ্টা করছিল তাকে। তারপর বিশেষ সুবিধা করতে না পেরে অবশ্য অন্যদিকে ফিরে চলেও যাচ্ছিল সব। চক্রধরের অবস্থাটা ভাবো একবার! কিন্তু তাতে কী? এখন তার ওসব ভাবলে চলবে না। মন শক্ত করে চক্রধর। যা থাকে কপালে। ভাসতে ভাসতে সে সমুখপানে এগোয়। সে তো আর জলযান নয়। তাই এই জলের মধ্যে এত সুন্দর চাকা নিয়েও সে কিছু করতে পারবে না। এগোতে হবেই, যেভাবে হোক।

কিছুদূর যাবার পর সে দেখে পাশে কিছু একটা ভেসে যাচ্ছে। আড়চোখে চায়। ওমা! একটা কাগজের নৌকা! কোনো বাচ্চা ছেলের কম্মো নির্ঘাত। জলের তোড়ে উঠছে নামছে দুলকি চালে। চক্রধর স্রোতের টানে ভেসে ওটার গায়ে ধাক্কা লাগাতেই বনবন করে নৌকাটা একপাক ঘুরে যায়। ‘বাবা গো’ বলে ওঠে যেন কাগুজে পানসি। চক্রধর মুখ টিপে হেসে সেটাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যায় বীরদর্পে। একটা পলিথিনের প্যাকেট প্রায় আটকে যাচ্ছিল তার সামনের দিকে, আঁতকে উঠে কোনোমতে সেটাকে এড়ায় চক্রধর। এই প্লাস্টিকের ব্যাগ একটা ভয়ানক বস্তু। চারপাশে জমে জমে স্তূপ হয়ে আছে, আর মানুষদের আক্কেল দেখো! নালায় যদি এইসব ফেলা হয়, তাহলে ময়লা জল যাবে কী করে? এইসব ভাবতে ভাবতে আরো কিছুদূর যেতে একটা স্রোতের শব্দ কানে আসে তার (ধরেই নাও চক্রধর শুনতে পায়, আর শুনতে পেলে একটা কান তো নিশ্চয়ই আছে তার! নাকি?)। যত এগোয় আওয়াজটা বাড়তে থাকে, কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারে না সেটা কীসের শব্দ! হঠাৎ একটা বাঁক, আর সেই বাঁক ঘুরতেই… বাপ রে! আরো একটা পয়ঃপ্রণালীর জল এসে মিশছে এখানে, আর সেখানে একটা ধাপ থেকে জল লাফিয়ে নামছে নীচে আরো প্রশস্ত ড্রেনে। এ যেন ঠিক কোনো জলপ্রপাত! চক্রধর আসল বা নকল ঝরনা কিছুই দেখেনি কোনোদিন। তার কাছে ব্যপারটা আনকোরা এবং বেশ উপভোগ্যও বটে। খাড়া স্রোত বেয়ে সে নীচে নামল, উত্তেজনায় যেন চিৎকারই করে ফেলল একবার। তীব্র গতির উত্তাল জলরাশির সাদা ফেনার মধ্যে ভুস করে ডুবে গেল। পরক্ষণেই আবার কালো জলের উপর ভেসে উঠল টলমল করে, ফের তরতরিয়ে ছুটে চলল সেই প্রবাহের প্রবল টানে।

দু-পাশে ইট দিয়ে বাঁধানো ঢালু হয়ে আসা পাড়, তার মাঝখান দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নিকাশি নালা, তারই মধ্যে ভাসমান চক্রধর দিব্যি চেয়ে দেখে শহরের দৃশ্য। সবাই ব্যস্ত যে যার মতো। সাইকেল, মোটরবাইক, কয়েকটা সত্যিকারের মোটর গাড়িও চোখে পড়ল। তবে চক্রধরের মতো সুন্দর তারা কেউই নয়। যদিও নালার নোংরা জলে সেই জৌলুস একটু হলেও কমেছে এখন।

এবার একটা ছোটো গলির মধ্যে দিয়ে বইছে নালাটা। চারপাশে ছোটো ছোটো ঝুপড়ির মতো বাড়ি, ময়লা জামাকাপড় পরা ছেলের দল খেলছে নিজেদের মধ্যে। তোতনের সঙ্গে এদের বেশভূষা বা খেলনায় কোনোই মিল নেই। যেন অন্য জগতের শিশু এরা। কাগজের মণ্ড পাকিয়ে প্লাস্টিক আর দড়ি দিয়ে বাঁধা একটা বল নিয়ে লোফালুফি খেলছিল সবাই। হঠাৎ একজনের হাত থেকে ছিটকে বলটা এসে পড়ল সোজা চক্রধরের সামনে। আবার সেই প্লাস্টিক! ব্যস। রাস্তা আটকে গেল। একটা ছেলে দৌড়ে এল। পিছন থেকে কয়েকজনের চিৎকার শোনা গেল, ‘যা পচা, বলটা তুই তুলে নিয়ে আয়। তুই ছুড়েছিস, তুইই আনবি। যা!’

পচা ড্রেনের পাড়ে উবু হয়ে বসে নীচু হয়।

“আরিব্বাস! সেই গাড়িটা না!” কথাগুলো বেশ চাপা স্বরে বলল পচা। আস্তে বলাই ভালো। ওর বন্ধুরা দেখতে পেলে হয়তো কেড়েকুড়ে নিয়ে নেবে। ওর চেহারা যেমন রোগাভোগা তেমনি ছোট্টখাট্টো। আর দুর্বলদের উপর জোরজুলুম তো সবসময়েই একটু বেশি হয়ে থাকে। চুপচাপ গাড়িটা হাতে নিয়েই পকেটে চালান করল সে। পিছন থেকে ততক্ষণে আবার হাঁকডাক শুরু হয়েছে, ‘কী রে পচা, ড্রেনের মধ্যে সাঁতার কাটছিস নাকি এতক্ষণ? হ্যা হ্যা হ্যা! জলদি আয়!’

ভেজা বলটা তুলে নিয়ে জল ঝেড়ে জবাব দেয় পচা, “এই তো আসছি, দাঁড়া।”

চক্রধর তার পকেটে চুপচাপ বসে অপেক্ষা করতে থাকে এক নতুন অজানা ভবিষ্যতের।

খেলা শেষে বাড়ি ফিরে পকেট থেকে সন্তর্পণে গাড়িটা বের করে পচা। সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, হাত বোলায় তার গায়ে। গাড়িটা নোংরা হয়ে আছে। ড্রেনে পড়ে ছিল। তাই তো! একছুটে সে কলপাড়ে যায়, শ্যাওলা ধরা কয়েকটা ইট পাতা রয়েছে সেখানে। এক হাত দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে হাতল চেপে পাম্প করতে থাকে টিউবওয়েল। আরেক হাতে গাড়িটাকে ধুতে থাকে। বাহ্‌, বেশ ভালো লাগছে চক্রধরের। এত যত্নআত্তি পাবে, কল্পনাতেও ছিল না তার।

গাড়িটা পচা যেদিন প্রথম দেখেছিল সেই থেকেই তার এটা হাতে নেওয়ার শখ। বাড়ি ফিরে মাকে একবার বলেওছিল সেটা। মা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়েছিল। এত দামি গাড়ি কিনে দেওয়ার বায়নাটা একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে সেটা অচিরেই পচা বুঝে গেছিল। কিন্তু মনের মধ্যে থাকা সুপ্ত বাসনাটা তো মরেনি। আজ এভাবে সেটা অকল্পনীয়ভাবে সত্যি হয়ে যাবে সে ভাবতেও পারেনি। সেই গাড়ি আজ তার হাতে! যত খুশি খেলতে পারবে। আহা!

সন্ধে হয় হয়। টিমটিমে বাল্বের আলোয় প্রাইমারি স্কুল থেকে দেওয়া বইগুলো নিয়ে পড়তে বসে পচা। কিন্তু মন বসে না। পাশে হাতের মুঠোয় লুকিয়ে রাখে গাড়িটা। নাড়াচাড়া করে।

রাত বাড়ে। পচার বাবা বাড়ি ফেরে। মায়ের সঙ্গে কথা বলছে। এইবার কেমন যেন একটু ভয় ভয় করতে থাকে পচার। গাড়িটা দেখে ফেললে তাকে আবার চোর ভাববে না তো ওরা? তার মা-বাবা গরিব হতে পারে, কিন্তু প্রচণ্ড আদর্শবান। সে আজ অবধি কখনো কোনো অসৎ কাজ করতে দেখেনি তাদের। সেখানে যদি তার হাতে এত দামি একটা খেলনা গাড়ি দেখতে পায়! নাহ্‌, এটাকে যেভাবেই হোক মা-বাবার নজর এড়িয়ে লুকিয়ে রাখতেই হবে।

রাতে বিছানায় শুয়েও আশঙ্কা আর উৎকণ্ঠায় পচার ঘুম আসে না। কান পেতে মা-বাবার কথাবার্তা শোনে সে। শহরের যে কারখানাটায় তার বাবা কাজ করে, সেখানে গোলমাল লেগেই থাকে প্রায়। মালিক মাইনে দেয় না ঠিকমতো। মজদুর ইউনিয়ন না কীসব আছে, পচার বাবা নাকি সেখানে প্রায়ই প্রতিবাদ করে।

পচা শুনছিল, তার বাবা বলছে মাকে, “ওই ইউনিয়নের লিডার বসন্তবাবু আসলে মালিকদের সঙ্গেই হাত মিলিয়ে রেখেছেন, জানো? টাকাপয়সা মালপত্র নিয়ে ভিতরে যত যা অনিয়ম বেনিয়ম চলে সেসব জেনেবুঝেও ওরা স্রেফ টাকার লোভে মুখ বন্ধ করে থাকে। আজ আমাকেও ওরা ডেকেছিল, কিছু টাকা নিয়ে চুপ থাকতে বলল। আমাদের অভাব আছে জানি। পচার লেখাপড়া, তোমার দিনরাত এই লোকেদের বাড়িতে পরিশ্রম। কিন্তু ওই টাকা আমি নিতে পারলাম না গো। আমার আরো কত ভাইবন্ধু তো এরকমই আধপেটা খেয়ে আছে। আমিও থাকতে পারব ঠিক। কিন্তু অন্যায় করে অসৎ পথে কিচ্ছু নেব না। তার জন্য যা-ই সহ্য করতে হোক না কেন! আমি ঠিক করিনি বলো?”

পচার মা বলে ওঠে, “একদম ঠিক করেছ। আমি চাই আমাদের পচাও যেন বড়ো হয়ে তোমার মতোই হয়। নিজের কথা ভাবার আগে যেন বাকিদের কথা ভাবে। আমাদের অভাব ও ঘোচাতে পারুক বা না পারুক, মানুষের মতো মানুষ যেন হয়।”

পচার বুকটা কি কেঁপে উঠল অজান্তেই? কেমন একটা চাপা কষ্ট হচ্ছে যেন। বালিশের নীচে মুঠোর মধ্যে লুকানো চক্রধর অনুভব করে তার গায়ে এতক্ষণ চেপে থাকা কচি আঙুলগুলো যেন শিথিল হয়ে আসে একটু। সে যেন পচার মনের কথা শুনতে পায়। ও বলছে, ‘আমি তোকে চুরি করে আনিনি ঠিকই, কিন্তু তুই তো আর সত্যি আমার নোস। আর আমি তো জানি তুই কোথা থেকে এসেছিস। আজ তোকে পেয়েছি বটে, তবে কাল তোকে আবার ফেরত দিয়ে আসব তোতনের কাছে। ও বেচারা তোর শোকে নিশ্চয়ই কান্নাকাটি করছে আজ সারাদিন।’

কথাটা মিথ্যে নয়। গাড়িটা ওভাবে হাত থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাওয়ার পর কীভাবে নিমেষের মধ্যে উধাও হয়ে গেল তোতন বুঝেই উঠতে পারেনি মোটেও। ব্যাপারটায় ধাতস্থ হতেই খানিক সময় লেগে গেছিল। তারপরেই শুরু হয়েছে তারস্বরে কান্না। তার মা ছুটে এসেছে আওয়াজ শুনে। ছেলে অক্ষত আছে দেখে সে কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছে বটে, কিন্তু নতুন কেনা খেলনা গাড়ি হারিয়ে গেছে শুনে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছে। ভালো করে খুঁজে দেখা হয়েছে ঘর-বারান্দা, কিন্তু গাড়ির খোঁজ মেলেনি। তোতনের বিলাপও অব্যহত। শেষে রাতে বাবা যখন প্রতিশ্রুতি দিল আবার ওরকমই একটা গাড়ি কিনে এনে দেবে, তখন তার একটু শান্তি।

পরদিন সকালে পচা মায়ের সঙ্গে তোতনদের বাড়ি যাওয়ার বায়না ধরল। আবদার শুনে তার মা একটু অবাক হল। এত ঘনঘন তো কোনোদিন যেতে চায় না ওখানে! অবশ্য দিনটা রবিবার। স্কুল ছুটি। তাই খুব একটা আপত্তিও করেনি সে।

ও-বাড়ি গিয়েই পচা মায়ের কাছ থেকে টুক করে সরে সিঁড়ি দিয়ে উঠে তোতনের ঘরের কাছে পৌঁছে গেল। দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাল। নাহ্‌, আপাতত কেউ নেই। তোতন নীচে ব্রেকফাস্ট সারছে ও দেখে নিয়েছে এর মধ্যেই। মাও বাসন-টাসন মেজে উপরে আসতে আরো খানিকক্ষণ। এই সুযোগ। পচা পা টিপে টিপে ঢুকল। চুপিচুপি গাড়িটা রেখে বেরিয়ে আসার প্ল্যান করছে, ঠিক তখনই সামনে এসে পড়ল তোতনের মা। এই যাহ্‌! ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তার হাত থেকে খসে পড়ল চক্রধর।

“এ কী! এই গাড়িটা এখানে ছিল? মানে! তুই, তুই চুরি করে পালাচ্ছিলি? হতভাগা!” তোতনের মা হুঙ্কার দিয়ে উঠল।

থরথর করে কেঁপে ওঠে পচা। দু-চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চায় তার। তার মাও ছুটে এসেছে চিৎকার শুনে। আওয়াজ শুনে দুদ্দাড়িয়ে উঠে এসেছে তোতনও। গাড়িটা দেখেই সে সবকিছু ভুলে সোল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটা মাটি থেকে তুলে নেয়। পচার দিকে একবার ফিরেও তাকায় না। তোতনের মা তখনো ভর্ৎসনা করে চলেছে পচাকে। তার মা শুধু একবার আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করে, “দিদি, ও কিন্তু কাল এ বাড়িতে আসেনি। আমি জানি। আজই বরং…”

তোতনের মা সেই কথা থামিয়ে দ্বিগুণ জোরে চেঁচিয়ে ওঠে, “আবার ছেলের হয়ে ওকালতি করছ? ছিঃ! কোথায় ওকে শাসন করবে, তা নয়! এটুকু বয়সেই এই?” ইত্যাদি…

চক্রধরের ভারি খারাপ লাগে। আহা, বেচারা পচা তো তাকে ফেরত দিতেই এসেছিল! চুরি তো করেইনি। সে তো নিজেই স্বেচ্ছায় লাফিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। নাহ্‌, এর একটা বিহিত করতেই হবে।

তোতন গাড়ির গায়ের কয়েকটা সুইচ নিয়ে খুটখাট করছিল। আলোটা জ্বলছে না কেন? গতকাল জল লেগে গাড়িটার যন্ত্রপাতি একটু বিগড়ে গিয়েছিল হয়তো। আচমকা একটা শব্দ করে তার হাত থেকে ছিটকে মাটিতে পড়ল গাড়িটা। আর পড়তেই তার একটা দরজার পাল্লা ভেঙে খসে পড়ল পাশে।

চক্রধরের লেগেছে বেশ। কিন্তু তার প্ল্যান ছিল অন্যরকম। আর হলও ঠিক সেটাই।

গাড়ি ভাঙতেই তোতন চমকে গিয়ে এক মুহূর্ত থমকে ফের কাঁদতে আরম্ভ করল। ঠিক তখুনি মুশকিল আসান হয়ে হুড়মুড় করে ঘরে প্রবেশ তোতনের বাবার। হাতে একটা আনকোরা নতুন সোনালি গাড়ি। অবিকল চক্রধরের মতো। ছেলেকে প্রমিস করেছিলেন যে! অমনি যেন ম্যাজিক। চক্রধরকে হেলায় ফেলে তোতন মুহূর্তে টান দেয় নতুন গাড়িতে। চাইতেই যদি নতুন মিলে যায়, তবে আর পুরনো নিয়ে কাজ কী? আর সবচেয়ে অবাক করা কাণ্ড হল, তোতনের মা চক্রধরকে মাটি থেকে তুলে এগিয়ে দিল পচার হাতে! পচার মাকে বললে, “নাহ্‌, আমারই ভুল গো। আসলে হঠাৎ ওভাবে ওকে দেখে আমার মাথাতেই ছিল না, কাল তো পচা এ বাড়িতে আসেইনি। আর গাড়িটা হারিয়েছে কাল, ঠিকই তো!” বলে পচার দিকে ঘুরে তার মাথায় হাত রেখে বলে, “বকেছি বলে আমার উপর রাগ করিস না। আপাতত এই গাড়িটা তুইই নে। তোতন তো নতুন গাড়ি পেয়ে আর এটা নিয়ে খেলবেই না জানি। তবে পরে আমি নতুন আরেকটা খেলনা তোকে কিনে দেব, কেমন?”

জলভরা চোখে পচা পরম মমতায় চক্রধরকে আঁকড়ে ধরে বুকে। নতুন গাড়ি আসুক বা না আসুক, এই প্রিয় গাড়িটাকে সে নিজের কাছে রাখতে পারবে, এটা ভেবেই খুশিতে তার দু-চোখ ভরে ওঠে। চক্রধরেরও ইচ্ছে করে আনন্দে লাফিয়ে উঠতে। সে তো এমনটাই চেয়েছিল মনে মনে। তার ঝলমলে আলোটা নিজে থেকেই জ্বলে ওঠে একবার।

 অলঙ্করণ: শিমূল সরকার

জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s