(১)
“বিট্টু-উ-উ!”
প্রবল এক চিৎকারে কেঁপে উঠল আমাদের পাড়া।
ও কী? ঘাবড়ে গেলেন নাকি? না না, ঘাবড়াবেন না, ঘাবড়াবেন না; ওটা বিট্টুর বাবার চিৎকার। বিট্টু কে? বলছি।
আমি পাপাই। আমার বাড়ির দুটো বাড়ি পরে বিট্টুদের বাড়ি। পাড়ার কারোরই সকালবেলায় অ্যালার্ম দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। তার কারণ, প্রতিদিন সকালে বিট্টুর বাবার চিৎকারে প্রত্যেকের ঘুম ভাঙতে বাধ্য। চিৎকারের একটাই কারণ, বিট্টুর দুষ্টুমি।
বিট্টু ওরফে সৌগত দত্ত আমার সঙ্গে এক ক্লাসে পড়ে। একবছর নষ্ট না হলে তার এখন ক্লাস এইটে পড়ার কথা ছিল। পড়াশোনায় মনোযোগের ব্যাপারে যাই করুক না কেন, দুষ্টুমির ব্যাপারে বিট্টু কখনো কার্পণ্য করে না। এত অনায়াস দক্ষতায়, এত সহজাত পারদর্শীতায় সে তার কাজগুলি, না মানে অকাজগুলি সম্পন্ন করে যে মনে হয়, এমন সক্ষমতা পরীক্ষার খাতায় দেখালে সুমিতকাকু মানে বিট্টুর বাবার প্রেশারটা একশো আশি বাই একশো হত না। ক্লাস টিচারের বসার জায়গায় আঠা ঢেলে দেওয়া থেকে শুরু করে, তার কীর্তিকলাপের একের পর এক ফিরিস্তি দিতে আরম্ভ করলে কোথায় গিয়ে যে শেষ করব, তার ইয়ত্তা নেই।
যেমন ধরুন, পাকড়াশিবাবুর কথাই বলি প্রথমে। ভদ্রলোক এমনিতে ভালো, অমনিতেও ভালো। কাজ করতেন সরকারি স্কুলে, এখন অবশ্য অবসর নিয়েছেন চাকরি থেকে। তবে বাড়িতে বাংলা পড়ান বেশ কয়েকজন ছাত্রকে। শুধু তাঁর নামটা কিঞ্চিৎ অদ্ভুত, গোবর্ধন। বিট্টুর কৃপায় তাঁর সাধের পিতৃদত্ত নামটি হয়ে গেল গোবর-স্যার। একথা তাঁর কানে যাওয়ায় তিনি বিট্টুকে একদিন কান মুলে দেন। ফলস্বরূপ বল লেগে তার বাড়ির চারটে কাচ ভাঙল। কর্ণাকর্ষণের সময় তাঁর ভৃত্য যদু পাশে দাঁড়িয়ে খ্যাক খ্যাক করে হাসছিল। ফলে যদুবংশ ধ্বংস হওয়া তো অবশ্যম্ভাবী, সেও বাদ গেল না। গুলতির এক টিপে তার কপালে একটি চন্দ্রমুখী আলু জন্ম নিল। পাকড়াশিবাবু তার পর থেকে বিট্টুকে আর ঘাঁটান না।
প্রদীপ বর্মণের পোষা কুকুর ভেলোর সঙ্গে বিট্টুর যে কীসের শত্রুতা তা স্বয়ং ঈশ্বরই জানেন। কী কারণে সে একদিন বিট্টুকে দেখে দাঁত খিঁচিয়েছিল। প্রতিশোধস্বরূপ কালীপুজোর দিন তার ল্যাজে তারা বাতি বেঁধে দিল শ্রীমান সৌগত দত্ত। সে কুকুরের ল্যাজ সেই থেকে তার দু-পায়ের ফাঁকেই সেঁধিয়ে গেছে, মানে ল্যাজেগোবরে অবস্থা যাকে বলে।
এহেন প্রতিভাবানের সান্নিধ্য পেলে কোন বাবা আর সুস্থ থাকতে পারেন? ফলস্বরূপ, মোড়ের ওষুধের দোকানে প্রায় দেখা যায় বিট্টুর বাবা বলছেন, ‘প্রেশারের ওষুধটা দাও ভাই, শেষ হয়ে গেছে।’ আর কখনো দেখা হলেই বিট্টুর বাবা আমার বাবাকে বলেন, ‘ছেলেকে নিয়ে আমার দুশ্চিন্তার শেষ নেই মশাই। কী যে করি। আর ভালো লাগে না, ধুত্তোর।’
(২)
এক শনিবারের বিকেলে বাবা আমাকে বিকেলে সাইক্লিং শেখাতে নিয়ে বেরিয়েছেন। মাঝে মাঝেই আমায় ছেড়ে দিচ্ছেন, নড়বড়ো করছে, হাত-পা কাঁপছে, ‘এই পড়ে যাব, এই পড়ে গেলাম’ এমন মনে হচ্ছে, তবুও সামলে নিচ্ছি। ভারসাম্যটা প্রায় এসে গেছে, এটা দেখেই বাবা মাঝে মাঝে বলে উঠছেন, “খুব ভালো, এই তো পারছিস। ধরে থাক, স্টেডি, বি স্টেডি। পড়ে যাবি মনে হলেই পা-টা দিয়ে সামলা। এই তো, ভেরি গুড।”
হঠাৎ বিট্টুর বাবার সঙ্গে দেখা। রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে হনহন করে কোথায় যেন যাচ্ছেন। বাবাকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন। তারপর মুখে বেশ চিন্তার ছাপ এনে বললেন, “আর পারছি না। কী বলি বলুন তো! ছেলের স্কুল থেকে ডেকে পাঠিয়েছে।”
আমাদের স্কুলে সপ্তম শ্রেণি অবধি শনিবার ছুটি থাকে, কিন্তু অষ্টম শ্রেণি থেকে সেটা হাফ ডে হয়ে যায়। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ যেটা, তা হল, কোনো অভিযোগ বা ছাত্রছাত্রীর বাবা-মায়েদের সঙ্গে আলোচনা করতে হলে শনিবার বিকেলটাকেই বেছে নেওয়া হয় সব ক্লাসের ক্ষেত্রেই।
সুমিতকাকুর কথা শুনে, তথা অবস্থা দেখে বোধ হয় বাবাও কিছুটা চিন্তিত গলায় বলে উঠলেন, “সে কি! স্কুল থেকে ডেকে পাঠাল কেন?”
বিট্টুর বাবাও তাঁর স্বভাবসিদ্ধ রাগত স্বরে বলতে শুরু করলেন, “আর কেন। ছেলের পড়াশোনা করতে ভালো লাগে না তাই। সারাক্ষণ যত রাজ্যের বজ্জাতি করে যাচ্ছে আর হাড় জ্বালিয়ে শেষ করছে সকলের। নাহ্, এবার আর কিছু করার নেই। ভাবছি ওকে বোর্ডিং স্কুলেই পাঠিয়ে দেব। বাড়িতেও একপ্রস্থ কথা বলেছি এই ব্যাপারটা নিয়ে।”
বাবা এই কথা শুনে বেশ বিস্মিত হয়ে গেলেন। ছোটো থেকেই দেখে আসছি, আমার বাবা বোর্ডিং স্কুলের বিষয়ে চিরকালই একটা অনীহা পোষণ করেন। বাবা-মার থেকে দূরে গিয়ে পড়াশোনা, এটা যেন কেমন তাঁর ইচ্ছের বাইরে। হয়তো নিজে একটা সময় বোর্ডিং স্কুলে ছিলেন বলেই এমনটা মনে করেন।
সুমিতকাকুর কথা শুনে বাবা বেশ প্রতিবাদী স্বরে বলে উঠলেন, “কী বলছেন! নিজের একমাত্র ছেলেকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেবেন? তার চেয়ে ওকে বই পড়া অভ্যেস করান না। ভালো বই পড়তে শুরু করলে দুষ্টুমি বা এই যে চঞ্চলতা, এটা নিশ্চিতভাবে কমে যাবে।”
এই কথা শুনে বিট্টুর বাবার চোখগুলো বেশ গোলগোল হয়ে উঠল। ওই চোখে নতুন পথের দিশার ছাপ যতটা না ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল অবাক হওয়া। তারপর বেশ অবিশ্বাসীর ঢংয়ে বলে উঠলেন, “কী বলছেন মশাই! যে ছেলে একটুকরো কাগজ পড়ে না, সে পড়বে গল্পের বই! হাসালেন।”
বিট্টুর বাবার নিরস্ত ভাব দেখে আমার বাবা কিন্তু দমলেন না। বরং বেশ জোরের সঙ্গেই বলে উঠলেন, “আরে দেখুন না চেষ্টা করে। আমি কিন্তু আমার ছেলের ক্ষেত্রে এইভাবেই পড়ায় মন এনেছি।”
বিট্টুর বাবা এবার আমার দিকে তাকালেন। আমি শ্রী পাপাইকুমার অবশ্য এর আগের কথাটা শুনেই নীল ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশে ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে’ কি না তা দেখতে শুরু করেছিলাম। একথা সত্যি যে বই পড়ার নেশাটা বাবাই ধরিয়েছেন, আর আমার পড়ায় মনও এসেছে তার ফলে। কিন্তু বিট্টুর উপর এই দাওয়াই কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে আমার বেশ সন্দেহ ছিল। ফলে সুমিতকাকু যতই আমার দিকে দেখুন না কেন পরীক্ষাগারে সাফল্য এনে দেওয়া গিনিপিগ ভেবে আমি আর ভুলেও ওদিকে তাকাচ্ছি না।
আমার থেকে কোনো ইতিবাচক অভিব্যক্তি না পেয়েই হয়তো সুমিতকাকু নিজেই ভুরু কুঁচকে কী যেন ভাবলেন। তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী বই পড়াব বলুন।”
বাবা উত্তর দিলেন, “বড়ো বড়ো মানুষদের বই। যেমন ধরুন, ‘ছোটোদের বিবেকানন্দ’ এই বইটা ভালো হবে। জানেন তো, বিবেকানন্দ নিজেও প্রচণ্ড দুষ্টু ছিলেন ছেলেবেলায়। তখন সেই দুষ্টুমি আর অবাধ্যতা ভীষণ বেড়ে যেত, তখন তাঁর মা তাঁকে ধরে মাথায় জল ঢালতেন আর ‘শিব শিব’ বলতেন। তা বলা মাত্রই নাকি ছোট্টো বিলে শান্ত হয়ে যেত।”
বিট্টুর বাবা প্রায় বলতে যাচ্ছিলেন, যে আমার স্ত্রী শিবের উপোস রেখেও কিছু করে উঠতে পারেননি, বোধ হয় বাবার মতের সর্বজনগ্রাহ্য বিশ্বাসযোগ্যতার ফলেই কিছু বললেন না।
আমি কিন্তু বেশ কল্পনা করা চেষ্টা করছিলাম, যে ‘ব’ দিয়ে বিবেকানন্দ আর বিট্টু দুটো যতই হোক না কেন, ও ছেলেকে আমি চিনি। বিবেকানন্দের লাঠি হাতে পার্বত্য পথের যে ছবিটা আমাদের বাড়ির দেওয়ালে রয়েছে, কিছুতেই বিট্টুকে সে জায়গায় কল্পনা করতে পারলাম না। বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠল, লাঠি হাতে সুমিতকাকু ছুটছেন বিট্টুর পিছনে। যাই হোক, বাবার মত মেনে নিয়েই তিনি বললেন, “আপনি যখন বলছেন, তখন দেখি চেষ্টা করে।” তারপর হাঁটার গতি সামান্য স্লথ করে ইস্কুলের দিকে চলে গিয়েছিলেন।
তাঁর প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গেই আমি বাবাকে চেপে ধরলাম, “বাবা, এত সহজে বিট্টুর পড়ায় মন এসে যাবে, আর সব দুষ্টুমি বন্ধ হয়ে যাবে?”
বাবা আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে অল্প মজা করেই বললেন, “কেন, তোরও তো এভাবেই পড়ায় মন এসেছে, নাকি?”
আমি এবার তীব্র আপত্তি জানিয়ে বললাম, “আমি মোটেই বিট্টুর মতো অমন দুষ্টু ছিলাম না।”
বাবা ঈষৎ হাসলেন। তারপর নেমে যাওয়া চশমাটা উপরে উঠিয়ে বললেন, “তা ঠিক, তুই কখনোই অতটা দুষ্টু ছিলিস না। কিন্তু এই পদ্ধতিটার মূলে কী রয়েছে জানিস? মনকে শান্ত করে তোলা। মন শান্ত হলে দুষ্টুমি আপনিই থেমে যাবে।”
(৩)
সেদিন এই অবধিই কথা হয়েছিল। সাইকেল শেখায় আবার আমি লেগে পড়েছিলাম। বাড়ি ফিরে পড়া আর অন্যান্য কাজের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে ভুলেই গিয়েছিলাম এই ব্যাপারটা।
সোমবার স্কুল বন্ধ ছিল একটি পরব উপলক্ষ্যে, ফলে দু-দিনের ছুটিতে জেঠুর বাড়িও ঘুরে এলাম আমরা তিনজনে। মনে পড়ল, যখন মঙ্গলবার গিয়ে স্কুলে গিয়ে বিট্টুর দেখা পেলাম। কিন্তু এ কোন বিট্টু! ক্রমাগত ধারালো দুটি চোখ দিয়ে ‘এরপর কোন অকাজটি করা যায়’ এহেন ফন্দি কষতে থাকা ছেলেটি কোন এক আশ্চর্য উপায়ে গায়েব হয়ে গিয়েছে। তার বদলে যে এসে উপস্থিত হয়ে বা বলা চলে আবির্ভূত হয়েছে, তাকে আমি অন্তত চিনি না।
দেখতে দেখতে আরো কয়েকটা দিন কেটে গেল। আমরা বিস্মিত হয়ে দেখলাম যে প্রতিদিন বিট্টু স্কুলে ঠিক সময়ে এসেছে এবং কোনো শাস্তিও পায়নি। শুধু তাই নয়, সবথেকে বড়ো কথা, ক্লাসে চুপচাপ থেকেছে, পড়া শুনেছে। এমনকি পরিতোষ-স্যার ক্লাসে, ‘সমানুপাতের বারো নম্বর অঙ্কের প্রশ্নটির উত্তর কে পারবে’ জানতে চাওয়ায় বিট্টু যখন হাত তুলল, তিনি তো প্রথমেই খাবি খেলেন। তারপর সামলে নিয়ে বলেছেন, “সৌগত, তোমার শরীর-টরির ঠিক আছে তো বাবা?”
জবাবে বিট্টু শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছে। আমরা এমনটাও শুনেছিলাম যে বাংলার শিক্ষক অমিয়বাবু নাকি স্টাফ রুমে বলেছেন, “সৌগতর দুষ্টুমি ছাড়া ক্লাসটা ঠিক জমছে না।”
আমরা নিজেরাই বেশ কয়েকবার বিট্টুকে টিফিন টাইমে স্বপ্রবৃত্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “হ্যাঁ রে বিট্টু, সব ঠিক আছে তো? কাকু কি কোনো কারণে তোকে খুব বকাবকি করেছেন? তাই তুই এত চুপচাপ হয়ে গেছিস? আমাদের তো বলতে পারিস, আমরা তো তোর বন্ধু।”
স্মিত স্বরে বিট্টু উত্তর দিয়েছে, “বাবা তো আমাকে আর বকে না। বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল।”
এই কথা শুনে বলাই বাহুল্য, আমাদের প্রায় বেঞ্চ থেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু বিট্টুর কথাটা যে অতিরঞ্জিত নয়, তার প্রমাণ ধীরে ধীরে পেতে লাগলাম। যত সময় যেতে লাগল, তার শান্ত ব্যবহার আমাদের বেশ ভাবিয়ে তুলল। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, বেশ কয়েকদিন কেটে যাওয়ার পরেও বিট্টুর বাবার কোনোপ্রকার চিৎকার শুনতে পেলাম না। এমনকি পাড়ার লোকেদেরও আজকাল রীতিমতো অ্যালার্ম দিয়ে শুতে যেতে হল। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, কোনো এক অভূতপূর্ব উপায়ে বিট্টু পালটে গেছে। তবে দামাল ঝড়ের আগে প্রকৃতি যে বড়ো বেশি শান্ত হয়ে যায়, এই কথাটা বোধ হয় আমরা একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম।
(৪)
এক রবিবার সকালে বাবা বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। আমি ইতিহাস বইটা খুলে পড়ায় মন বসানোর চেষ্টা করছিলাম। এমন সময় বিট্টুর বাবার খুশি মেশানো কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম বাইরে থেকে। বাবাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, “আপনি তো জিনিয়াস মশাই! সেদিন সন্ধেবেলায় মিত্র লাইব্রেরি থেকে ‘ছোটোদের বিবেকানন্দ’ বইটা কিনে ছেলের হাতে দিয়েছিলাম। সে তো বেশ কয়েকদিন ধরে ওই বই মুখে করেই বসে আছে। দুষ্টুমি এক্কেবারে বন্ধ।”
আমার বাবা সুমিতকাকুর কথা শুনে হেসে বললেন, “তা আপনাকে গতকাল ক্লাবের দুর্গাপুজোর মিটিংয়ে দেখতে পেলাম না কেন?”
বিট্টুর বাবা উত্তর দিলেন, “আর বলবেন না। জামাটা গলিয়ে যেই না বাড়ির বাইরে পা রেখেছি, গিন্নি এসে বাধ সাধলেন। আসলে গড়িয়াহাটে জামাকাপড়ের ভালো সেল দিচ্ছে না? তাই কেনাকাটায় তাকে সাহায্য করতে হবে।” এরপর একটু থেমে লাজুক স্বরে বললেন, “তবে নিজের জন্য একটা বেশ ভালো মিল্ক হোয়াইট শার্ট কিনেছি। মানে, অন্যদের জন্যও কেনাকাটা করেছি, তবে শার্টটা এমন মনে ধরে গেল…”
সুমিতকাকুকে এতটা তৃপ্ত আমি শেষ কবে দেখেছি তা মনে পড়ল না। বাবাও দেখলাম, “তা বেশ, তা বেশ।” বলে প্রশ্ন করলেন, “এখন কোনদিকে চললেন?”
সুমিতকাকু জানালেন, “এখন একটু বাজারের দিকে যাচ্ছি আলকাতরা কিনতে। বিট্টুই কিছুদিন আগে টিনের চালটা ফুটো করে দিয়েছিল। তাই পিচের চটের উপর আলকাতরার প্রলেপ দিয়ে দেব। সেইজন্যই কমলের দোকানে যাচ্ছি, ফেরার পথে মুদিখানাটাও ঘুরে আসব।”
একথা বলে বিট্টুর বাবা বাজারের পথে পা বাড়ানো মাত্রই কী মনে হওয়ায় আবার ফিরে এলেন। তারপর একগাল হেসে বাবাকে বললেন, “ওহো, আপনাকে তো বলতেই ভুলে গেছি, ছেলে এখন নিজের কাজ নিজেই করছে, বইখাতাও গুছিয়ে রাখছে। পড়াশোনাটাও তো মন দিয়ে করছে দেখছি বেশ কয়েকদিন ধরে। আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ জানাব, তা সত্যিই জানি না।”
বাবা বললেন, “কিছুই বলতে হবে না, আপনি সাবধানে যান। বাজারের দিকের রাস্তাটা খুঁড়েছে, খেয়াল রাখবেন।”
সুমিতকাকু বিদায় জানিয়ে চলে যাওয়ার পর বাবা আরামকেদারায় গা এলিয়ে দিলেন। তাঁর মুখে প্রসন্ন হাসি, আর আমার মুখে বাবার জন্য প্রচ্ছন্ন গর্ব।
তবে বাবার হাসি আর আমার গর্ব, কোনোটাই বেশিদিন স্থায়ী হয়নি কারণ দু-দিন বাদেই বিট্টুর বাবার গলি কাঁপানো চিৎকার শুনে আমরা প্রথমে কিছুটা থতমত খেয়ে গেলাম। তারপর আতঙ্কিত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে দুদ্দাড় করে নেমে বিট্টুদের বাড়ির অভিমুখে দৌড়লাম। আমার বাবার উৎকণ্ঠা আমার চেয়েও যে বেশি, তা তাঁর মুখ দেখেই বুঝতে পারছিলাম। ওদের বাড়ি পৌঁছানো মাত্রই আমার বাবাকে দেখে বিট্টুর বাবা ছেলের প্রতি শেষ রাগটুকু প্রকাশ করে বললেন, “দেখুন দেখুন, আমার ভয়ংকর গুণধর ছেলের কীর্তিটা একবার দেখুন!”
আমরা দেখলাম, আর দেখে বুঝতে পারলাম না ওটাকে কীর্তি বলব না কলাপ! বিট্টুর বাবার হাতে ধরা তাঁর গড়িয়াহাটের সেলে কেনা সাধের মিল্ক হোয়াইট শার্টের উপর আলকাতরার লম্বা কালো দাগ!
বাবা বিস্মিত হয়ে বিট্টুকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এটা, এটা তুই কী করেছিস বিট্টু? নতুন জামাটায় ওইভাবে দাগ কেটেছিস! কেন?”
বিট্টু গর্বের সঙ্গে উত্তর দিল, “বা রে! বিবেকানন্দই তো বলেছেন, জগতে যখন এসেছিস, তখন একটা দাগ রেখে যা। আমি ভাবলাম সাদা জামার উপর আলকাতরার দিয়ে ভালো দাগ হবে, তাই…”
অলঙ্করণ:মৌসুমী রায়