গল্প-পুকুর পাড়ের বুড়ো – মনিকা ঘোষ -শীত ২০২০

বিদ্যালয়ে গ্রীষ্মের ছুটি পড়েছে আজ দিন তিনেক হল। অম্বা অষ্টম শ্রেণিতে পাঠরত। রক্তিম মুখুজ্জে আর অরুণিমা মুখুজ্জের একমাত্র মেয়ে অম্বা। দুপুরের আহারের পর মায়ের ঘরে খাটে শুয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে সে। অরুণিমাদেবী দীর্ঘদিন পর সুযোগ পেয়ে আলমারির জামাকাপড়গুলো বার করে একটু গোছগাছ করছেন। সেই মুহূর্তে অম্বার নজরে আসে যে তার মা একটি সুন্দর নকশা করা কাঠের ছোটো বাক্স খাটের উপর রাখলেন। এর আগে কোনোদিন বাক্সটি অম্বার নজরে আসেনি। কৌতূহলবশত জলে ঝাঁপ দেবার মতো ঝুপ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাক্সটার উপর। বাক্সে ছোটো একটা তালা ঝুলছে। কৌতূহল যেন আরো প্রগাঢ় হল। হাতে নিয়ে বলে, “কী সুন্দর গো মা বাক্সটা! কী আছে এতে?”

“এটা তোমার পিতামহ আমার হাতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে দিয়ে গেছেন। তাঁকে তাঁর পিতা দিয়ে যান। যাবার আগে বলে গেছেন, যদি কোনোদিন আর্থিক সাহায্যের দরকার পড়ে তাহলে এই বাক্সটা আমাদের রক্ষা করবে।” এক নিঃশ্বাসে হাতের কাপড়টা গোছাতে গোছাতে বলেন অরুণিমাদেবী।

কৌতূহল যেন আরো বেড়ে যায় অম্বার। জিজ্ঞাসা করে, “কী এমন আছে এতে মা? প্রচুর ধনরত্ন বুঝি?”

অরুণিমাদেবী হাতের কাপড়টা রেখে অম্বার কাছে এসে আদর করে বলেন, “একবার খুলেছিলাম। দেখলাম অনেকগুলো রঙবেরঙের ছোটো ছোটো পাথর। দেখে তো তেমন দামি মনে হল না।”

আগ্রহের সঙ্গে অম্বা বলে ওঠে, “কই কই, দেখি। দাও তো আমায় চাবিটা একবার খুলে দেখি।”

অম্বার আবদারে অরুণিমাদেবী চাবিটা দিলেন অম্বার হাতে। খুলে তো অম্বার সে কী আনন্দ! কত সুন্দর সুন্দর নানা আকারের লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, বেগুনি আর কমলা রঙের পাথর। মাকে বলল, “তোমার তো এগুলো বেকার লাগে। আমি তাহলে এগুলো নিয়ে খেলি?”

ঠোঁটের কোণে মুচকি হেসে অরুণিমাদেবী বললেন, “খেলো, তবে হারিও না। তোমার পিতামহের দেওয়া শেষ উপহার আমার।”

খুব খুশি হল অম্বা বাক্সটা সমেত অমন রঙবেরঙের পাথর পেয়ে। তালা খুলে ওর মধ্যে একটা চিরকুট পায় অম্বা।

“মা মা, দেখো বাক্সের মধ্যে একটা চিরকুট আছে!” উত্তেজিত হয়ে বলল অম্বা।

“হ্যাঁ, জানি। ওটা তোমার প্রপিতামহের লেখা। ওখানে তিনি নির্দেশ দিয়ে গেছেন পশ্চিমের বাগানের মেহগনি আর বটগাছগুলো যেন না কাটা হয়। ওগুলো তাঁরই হাতে লাগানো। আর্থিক অনটনের সময় এই পাথর একা নয়, এদের সাহায্যে এই গাছগুলো সাহায্য করবে। যদিও কীভাবে তা আমি বা তোমার বাবা কেউই এই হেঁয়ালি আজও বুঝিনি, তবুও একজন ভালোবাসার মানুষের স্মৃতি হিসেবে কাছে রেখেছি।” এই বলে অম্বার কৌতূহলী মনের উত্তেজনাকে কিছুটা স্তিমিত করার চেষ্টা করলেন অরুণিমাদেবী।

মুখে কিছু না বললেও মনে মনে একটু অবাকই হল অম্বা। ভাবল, পাথরগুলো দেখে দামি মনে হয় না। গাছগুলো কাটা যাবে না। তাহলে এরা একত্রে কীভাবে আর্থিক অনটনের সময় সাহায্য করবে?

ভাবতে ভাবতে বাক্সটা নিয়ে নিজের ঘরে নিয়ে যায় অম্বা। ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে খাটের পাশে টেবিলে বাক্সটা রেখে চোখ বুজে শুয়ে থাকে সে। শুয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে সে বুঝতে পারে না।

ঘুম ভাঙে বাইরে কাদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে। তাড়াতাড়ি করে উঠতে গিয়ে টেবিলে রাখা জলের গ্লাসটি পড়ে যায়। ওটাকে জায়গায় রেখে বাইরে আসে সে। এসেই দেখে বাসনওয়ালি মাসি এসে চিৎকার-চেঁচামেচি করছে ‘এই কাপড় দিয়ে এটা হবে না, ওই চাদর দিয়ে সেটা হবে না।’ মাঝে মাঝেই সে আসে মুখুজ্জে বাড়ি। পুরোনো জামাকাপড়ের বদলে বাসন দিতে। তাই বলে এত হট্টগোল? ‘উফ, আর পারা যায় না।’ মনে মনে বলে আবার ঘরে ফিরে আসে অম্বা।

এসে দেখে টেবিলে রাখা বাক্সটার ভিতরে জল পড়ে গেছে কিছুটা। মনে পড়ল, ঘুমানোর আগে পাথরগুলো একটু নেড়েচেড়ে দেখেছিল সে। তারপর বোধ হয় খোলা অবস্থাতেই বাক্সটা রেখে শুয়ে পড়ে সে। আর ঘুম থেকে তড়িঘড়ি উঠে যাবার সময় গ্লাসটি পড়ে যায়। তখনই বোধ হয় কিছুটা জল ওর মধ্যে পড়ে যায়।

যাই হোক, বাক্সটা কাছে নেয়। হাতে পাবার পর থেকে এই রঙবেরঙের পাথরগুলো দিয়ে খেলার সুযোগই পায়নি সে। সবার আগে বাক্সের ভিতরে পড়ে যাওয়া জল মুছে বাক্স আর পাথরগুলো আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এই ভেবে বাক্স থেকে পাথরগুলো একটা একটা করে বার করে টেবিলে রাখতে শুরু করে সে।

হাতের আঙুলগুলোয় কিছু রঙ লেগেছে দেখে সে। ভ্রূ কুঁচকে নাড়িয়ে চাড়িয়ে পাথরগুলো দেখতে থাকে। বুঝতে পারে যে রঙগুলো এগুলোর গা থেকেই লেগেছে। জল লেগে রঙগুলো আলগা হয়ে গেছে কিছু জায়গায়। কৌতূহলবশত সে একটা পাত্রে একটু বেশি করে জল নিয়ে এল। পাথরগুলো চুবিয়ে রাখল বেশ কিছুক্ষণ। এরপর একটা একটা করে পাথর তুলে পরিষ্কার করতে থাকে শুকনো কাপড় দিয়ে। দেখা যায় প্রতিটা পাথরের প্রকৃত রঙ সাদা। তার মধ্যে কোনোটাতে সংখ্যায় এক-দুই, কোনোটাতে দুই-তিন এইভাবে সবক’টাতে সংখ্যা লেখা। পাশাপাশি সে ওগুলো সাজাল।

নাহ্, কিছুই তো হল না। এরপর মাথায় এল, পাথরগুলো একেকটা একেক আকৃতির। প্রতিটা পাথরের কোনো এক প্রান্তে সংখ্যা লেখা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে এক থেকে শুরু করে নয় পর্যন্ত পাথরগুলো সংখ্যা দেখে দেখে পাথরের ঠিক যেখানে আগের সংখ্যাটা শেষ হয়েছে, ঠিক তার গা লাগিয়ে অপর পাথরটা বসায় যেখানে আগের শেষ হওয়া সংখ্যা রয়েছে।

এইভাবে সে একটি বৃত্ত পায়। পরবর্তী দশ-এগারো থেকে ষোলো-দশ পর্যন্ত সংখ্যা সাজিয়ে একটা ত্রিভুজ পায়। এবার সে আস্তে আস্তে বুঝতে পারে রহস্যটা। বুঝতে পারে এগুলো কিছু একটার ইঙ্গিত। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল পশ্চিমের বাগানের মেহগনিগাছের গল্প। সঙ্গে সঙ্গে ছাদে গেল। দূর থেকে বাগানটি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। ফাঁকা জায়গায় অনেকগুলো গাছ দাঁড়িয়ে আছে। খুব ভালো করে খেয়াল করে দেখল, দূর থেকে কিছু গাছ মিলে একটা বৃত্ত গঠন করেছে। তার ভিতরে কিছু গাছ মিলে একটা ত্রিভুজ গঠন করেছে। এবার অনেকটাই স্পষ্ট অম্বার কাছে ব্যাপারটা। ঘরে এসে পাথরগুলো দেখতে থাকে। আশ্চর্যের ব্যাপার, সবক’টা পাথর থেকে একদম আলাদা একটা গোল সাদা পাথর পাওয়া যায়। সেই পাথরে কোনো সংখ্যাই লেখা নেই। অম্বা বুঝতে পারে না যে পাথরটার ভূমিকা কী। অনেকবার নিজেকে প্রশ্ন করে সে। উওর পায় না। ভাবল একটু ঘুরে আসবে। মাথায় অনেক চাপ পড়ছে। ঘুরতে ঘুরতে পশ্চিমের বাগানেই এসে উপস্থিত। বাগানের মাঝের গোল বাঁধানো পুকুরের পাড়ে বসে শীতল হাওয়া গায়ে লাগিয়ে গুনগুন করতে থাকে। হঠাৎই নিজেই বলে ওঠে, “ইউরেকা!”

ছুটে চলে যায় মায়ের কাছে। গিয়ে তার অনুমান জানায়। বলে যে, কতগুলো মেহগনিগাছ একটা বৃত্ত গঠন করেছে। সেই বৃত্তের ভিতরে আবার কতগুলি মেহগনিগাছ ত্রিভুজ তৈরি করেছে। তার মধ্যে একটা পুকুর আছে। আর ওই পুকুরেই আছে রহস্য।

ইতিমধ্যে অম্বার বাবা ও-ঘরে এসে পড়েছেন। তাঁকেও সব জানানো হয়। প্রথমে অম্বার কথায় পাত্তা দেন না কেউ। পরে অম্বার পীড়াপীড়িতে ছাদে গিয়ে অম্বা তার বাবা-মাকে দেখায় মেহগনিগাছগুলো। তারপর একটু ভরসা করতে চান তাঁরা অম্বার ধারণার উপর। সকলের মনে প্রশ্ন জাগে, তবে কি ওই পুকুরে কোনো গুপ্তধন আছে? তাঁরা সিনেমায় বা গল্পের বইতে গুপ্তধনের সন্ধানের জন্য এমন ধরনের ঘটনা দেখেছেন।

পরেরদিন সুয্যিমামা মুখ দেখানোর সঙ্গে সঙ্গেই মুখুজ্জেমশাই পুকুরে নামলেন। সারা পুকুর ডুবসাঁতার দিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজলেন, কিছু বুঝতে পারলেন না।

“এমন করে কি গুপ্তধনের সন্ধান পাওয়া যায়?” একটু রাগের সুরে বিড়বিড় করতে লাগলেন মুখুজ্জেমশাই।

অম্বা বুঝতে পারে বাবার মুখের বহিঃপ্রকাশ দেখে যে বাবা খুব বিরক্ত। সেও ভাবে, ঠিকই তো। এভাবে কি গুপ্তধনের সন্ধান পাওয়া যায়? আর লোক দিয়ে পুকুরের জল সেচে ফেলে খনন করলে জানাজানি হবে। তাতে বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে।

কিছুক্ষণ পর হতাশ হয়ে ঘরে ফেরে দুজনেই।

ঘরে এসে মুখ গোমড়া করে বসে থাকে অম্বা। কিছুক্ষণ পর মনে হল, প্রপিতামহের চিঠিটা সে পড়েনি। সেটা একবার পড়তে ইচ্ছে করল তার। চিঠিটা সে অরুণিমাদেবীর কাছেই রেখে এসেছিল। মায়ের থেকে চেয়ে পড়তে চায় সে।

চিঠির শেষে লেখা—

‘ইতি,

পুকুরপাড়ের বুড়ো।’

অম্বার মাথায় প্রশ্ন আসে, পুকুরপাড়ের বুড়ো লেখা কেন? এটা কি শুধুই লোকে তাঁকে বলত বলে? সবাই জানত, বৃদ্ধ বয়সে প্রপিতামহ পুকুরপাড়ে বসে বেশিরভাগ সময় কাটাতেন। আর তার জন্য অনেকেই তাকে ব্যঙ্গ করে বলত, পুকুরপাড়ের বুড়ো।

অনেকক্ষণ ভাবার পর তার মাথায় আসে, পুকুরপাড়ে একটা বুড়ো বটগাছ আছে। তবে কি ওই গাছের গোড়াতেই রহস্য লুকিয়ে?

দৌড়ে গেল বাবাকে নিয়ে সেখানে। সঙ্গে একটা কুড়ুল। বুড়ো বটগাছের গোড়ায় খুঁড়তে খুঁড়তে একসময় টং করে একটা আওয়াজ শোনা যায়। বাপ-বেটি এ ওর দিকে চায়। বেরিয়ে আসে একটা ঘড়া। আর সেই ঘড়ায় ভর্তি সোনা, মণিমাণিক্য। চট করে নিজের গায়ের গামছা দিয়ে ঘড়াটা ঢেকে ফেলেন মুখুজ্জেমশাই। ঘরে নিয়ে আসে তারা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অম্বা। সকলে বুঝতে পারেন প্রপিতামহের দেওয়া বাক্সটার আসল রহস্য।

অলঙ্করণ:সায়ন মজুমদার

জয়ঢাকের গল্পঘর

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s