গল্প-বাউণ্ডুলে পিঁপড়ে মাঠাংবুরু- প্রদীপ্ত ভক্ত-শীত ২০২০

প্রদীপ্ত ভক্তের আগের লেখা- জলেজঙ্গলে-১জলেজঙ্গলে-২, জলেজঙ্গলে-৩

মহারাজ গল্প-টল্প লেখেন না, যা দেখেন তাই। তা আমার সঙ্গে সেদিন এক মক্কেলের মোলাকাত হয়েছিল। নচ্ছারটা যদিও আমায় নানা কুকথা বলেছে, তাও বন্ধুত্বের খাতিরে ওর বলা কথাগুলো বলে গেলাম।

“এই শোন, একটা গাড়ি আসছে বুঝলি। একটু চমকাবি নাকি?”

“ইয়েস পাগলা। সন্ধে থেকে বৃষ্টি, একটা লোক নেই বাইরে যে তাড়া করব। লেজটা নেতিয়ে পড়ে আছে তখন থেকে। চল যাই।”

“দাঁড়া, আর একটু কাছে আসুক। নে, রেডি ওয়ান টু থ্রি, ঘ্যাঁক-ঘ্যাঁক-ঘৌ-ঘৌ-ঘোঁয়াওওও।”

লাল আর কালো রঙের এ নেড়িদুটো পাড়ার মস্তান কুকুর। আমার মতো নিরীহ কালো পিঁপড়ে অবধি এ দুটোকে দেখতে পারি না। আমার নাম মাঠাংবুরু। আমাদের পিঁপড়েদের দলে থাকাই নিয়ম আর মাটির নীচে কিন্তু আজকাল সুযোগ সুবিধে এত বেড়ে গেছে যে খালি মাটির নীচে থাকা আর পোষায় না মশাই, সত্যি বলতে কী। দল বেঁধে পরিশ্রম খারাপ লাগে এমন বলছি না, দিব্যি লাগে, কিন্তু আমার যে ঘুরতেও ভারি ভাল্লাগে। পিঁপড়েদের পাড়া ডিফাইন করা আছে। মাটির মধ্যে দিয়ে দিয়ে পুরো দুনিয়ার পিঁপড়েদের সঙ্গে কানেক্ট করাই যায়, কিন্তু আমরা সীমানা পেরোই না খুব একটা। একটা চিনির দানা খুঁজে নাও, হেঁইয়ো হেঁইয়ো করে সবাই মিলে নিয়ে এসো, তারপর খেয়েদেয়ে ঘুম লাগাও। এই তো কাজ, আমার আর ভাল্লাগল না।

সেবার একটা মানুষ ছেলের ঘরে ঢুকেছিলাম কত কষ্ট-মষ্ট করে মাইরি। দেওয়াল বাইলাম প্রথমে, তারপর ঘরে ঢুকে বুড়ো টিকটিকিটাকে এড়িয়ে টিউবলাইটের পাশ দিয়ে সোজা নেমে গিয়ে খাটে উঠেছিলাম। হালকা একটা সুগন্ধ পেয়েই গেছিলাম খাটে, নইলে খামোখা আমাদের মানুষের খাট-বিছানায় আগ্রহ নেই বাপু। এহ্‌, কী বলব মশাই, এই মানুষ ছেলেটার মাথায় আবার ছাগল ছাগল গন্ধ। হাঁ করে ঘুমাচ্ছিল, টের পেলো না। আমি একবার একটু টেস্ট করে দেখলাম, এ তো যেমন খারাপ গন্ধ তেমন খারাপ স্বাদ! এহ্‌, মুখটাই নষ্ট হয়ে গেল। আমাদের দলটা এগিয়ে গেছে তখন। ওহ্‌, খাজার টুকরো! আহা, তাই বলো, এটারই সুগন্ধ আসছিল। ও হ্যাঁ, আমি মানুষের ভাষা শিখে নিয়েছি। খুব কঠিন কিছু নয় তবে ভারি বোকার মতন। আমাদের জ্ঞানী পিঁপড়ে ভাষা এর থেকে ঢের বেশি এগিয়ে। এরা কত কী বলে সারাদিন ধরে, কত কী করে, কেন কিচ্ছু বোঝা যায় না।

খাজা আমার ভারি ভাল্লাগে। মিষ্টি, মাংস সবই ভাল্লাগে। আমাদের পাড়ার হুড়ুম, একবার একটা লোকের রুমালে ঢুকে পড়েছিল। ‘সদ্দি’ মোছা রুমাল। এহে-হে, বেচারি তিনদিন সমানে হেঁচেছে। যা বলছিলাম, এই খাজা-টাজা খেয়ে আমার কেমন জানি ঘুম ঘুম পেল একটু। পাবার কথা নয়, আমাদের টাইম মেনেই সব হবার কথা, গর্তে ফিরে আরামে ঘুমাব খানিক এরকমই ঠিক ছিল। তা আমি একটু অন্যরকম নাকি, আমার বুড়ো ঠাকুর্দা বলে, ভালো না সেটাই বলে, আমি বিশ্বাস করি না অবশ্য। দিব্যি হেঁইয়ো হেঁইয়ো করে কাজ করি, মানে খাবার খুঁজে দিই, তারপর সবাইকে ডাকি, একসঙ্গে খাই, ফুলের ডাঁটি দিয়ে দাঁত ব্রাশ করে ঘুমাই তাহলে? ও হ্যাঁ, আমি আসলে খাবার খুঁজতে যাবার সময় এপাড়া ওপাড়া ঘুরে-টুরে যাই। মানে হয়তো সামনে খাবার আছে কিন্তু আমি ঘুরতে ঘুরতে, কার্নিশ দিয়ে যাবার সময় ডিগবাজি খেয়ে, লাল ডেঁয়োদের সঙ্গে একটু আড্ডা মারি, তারপর যাই। রোজ এক রাস্তায় এক কাজে যেতে ভাল্লাগে? কুত্তোগুলোর কানে একটু কামড়ে দিই, বেড়ালের লেজে সুড়সুড়ি দিয়ে দিই, চড়াইটার সঙ্গে সুখদুঃখের কথা বলি। খালি মানুষগুলোর সঙ্গে কিছু কথা হয় না। ওরা যেন কেমন পানা। সারাক্ষণ হাঁই হাঁই করে চেঁচাচ্ছে, নয় কেউ-মেউ করে মারামারি করছে। আর কী বোকা, কী বোকা, আমাদের একটা কথাও বোঝে না। ‘এই চোপ’, বলল যখন সেদিন লাল মস্তান লোটন, আরে যার কথা শুরুতে বলছিলাম, সে, তাতে বোকা মানুষগুলো ভাবল আহ্লাদ করেছে বুঝি! আবার একটা কেক কিনে দিল। লোটনটাও পেজো আছে, ‘ব্যাটা কিপটে’ বলে কপাত করে খেয়ে নিল।

এইসব হরেক জিনিস দেখতে গিয়েই দেরি হয়ে যায় আমার। আমাদের দলের সবাই বলে, মাঠাংবুরু একটা কুলাঙ্গার, একটা অপদার্থ, পিঁপড়েদের নিয়মানুবর্তিতা জগৎবিখ্যাত, তার অপমান করে। আরে জগৎবিখ্যাত কারা বলছে ওই বোকা মানুষগুলো, সেটা ভুলে গেলি। ওদের কাছে ভালো সাজার কী দায় তোদের? পিঁপড়ে না গরু কে জানে বাবা! তা যেই ঘুম ভাঙল দেখি সবাই চলে গেছে আমায় ফেলে। প্রথমটা ভারি অভিমান হল। একটু কেঁদেও নিলাম, যদিও পিঁপড়েরা কাঁদে না এমনিতে, আমরা খালি ঝুমঝুম করে গান গাই। যেমন ওই গানটা তো আমার ভারি পছন্দের—

‘ঘুংটিমাটিং চিংটিমা, না দিলে কি খাচ্ছি না, ঘিজিং ঘুজিং কামরাঙা, যাচ্ছে সেপাই কামড়া না।’

তবুও কেঁদে নিলাম একটু। কী করব, অমন দুম করে একা হয়ে গেলে দুঃখ হয় না? আরে এ মানুষ ছেলেটা তখন থেকে হাঁ করে ঘুমোচ্ছে দেখি। আচ্ছা, পা টিপে টিপে একবার এর কানের মধ্যে গিয়ে দেখব কী আছে? অন্ধকার গুহায় আমরা কক্ষনো ঢুকি না খাবারের সম্ভাবনা না থাকলে। তাও যাই নাকি একবার? ভিতরটা চ্যাটচ্যাটে। নাহ্‌, থাক। একটা কামড় দেব? নাহ্‌, যার মাথায় ছাগল ছাগল গন্ধ সে মানুষের স্বাদ কি ভালো হবে? এক কাজ করি, এর পকেটে ঢুকে আরাম করে আর একটু ঘুমিয়ে নিই।

আরে, এ কী! এত উঁচুতে উঠে গেলাম কখন? মেঝেটা নড়ছে! ওহ্‌, না, মানুষ ছেলেটা এগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তাই। দাঁতে সাদা ফেনা করছে আর একটা কাঠি দিয়ে ঘষছে কেন? না বাবা, পয়লা সুযোগেই এর পকেট থেকে পালাতে হবে। হয়তো থাবা দিয়ে পিষেই দিল! গুটিগুটি বেরিয়ে এসেছি। কী একটা ভালো খুশবাই আসছে না? কী বলছে? ‘বিস্কুটের কৌটোটা দাও না মা?’ বিস্কুট! আমি তো খুব খাই এগুলো। কী ভালো খেতে হয়!

গুটিশুটি মেরে মানুষ ছেলেটার পাশে বসে রইলাম। এরা আবার পিঁপড়ে দেখলেই পিঁপড়েদের মাথায় আকাশ নামিয়ে দেয়! চিন্টুলুয়ার বাবা তো এভাবেই গেল, একটু গায়ে উঠে গেছিল কী করে যেন। তারপরে চিন্টুলুয়ার মা দেখেছিল চার-পাঁচটা কিলবিলে প্রাণী, মানুষে তাদের আঙুল বলে পোষে, চিন্টুলুয়ার বাবার দিকে এগিয়ে এল আর তাদের দুটো প্রাণী ক্রমে কাছাকাছি এসে গেল আর চিন্টুলুয়ার বাবা মরে গেল।

সাবধানে সরে এসে বসলাম। এর থাবায় পড়লেই হয়েছে একেবারে। পেট ভরা থাকলে মাঠাংবুরুর মতো পিঁপড়েই হয় না। আমার পাশের দুর্গে একটা মেয়ে থাকে, ভারি ভালো পিঁপড়ে। কীরকম নরম করে তাকায়, আর গান কী চমৎকার গায়, সে কী বলব! আমি মাঝে মাঝে যাই ওদের দুর্গের ওখান দিয়ে, কিন্তু আমার কথার তরঙ্গকে স্রেফ কাটিয়ে দেয় সে। ও বুঝলে না বুঝি? আমরা তো ভালোবাসার কথা চেঁচিয়ে-মেচিয়ে বলি না কক্ষনো। ধরো আমার বউ পিঁপড়ে বা হবু বউ পিঁপড়ে অনে-এ-এক দূরে আছে। তখন একটা ফুলের পাপড়ির মধ্যে শুয়ে শুয়ে ডাক পাঠাতে হয়। আমরা যেহেতু ঝগড়াঝাঁটি করি না, মারামারিও না তাই আমাদের কথা হয় খালি কাজের, নয়তো গানের।

সত্যি বলতে এ যে আমার খুব ভালো লাগে তা নয়, মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ওই দুর্গটার সামনে গিয়ে জোরে জোরে বলি, ‘ওই মেয়ে, আমার পিঁপড়েনি হবি?’

এসব নানান কথা ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম একটু। উঠে একটু আড়মোড়া ভেঙে একটু হাঁটাহাঁটি করছি। একটা চ্যাটালো জায়গা থেকে কীসব গান আর আওয়াজ আসছে, একজন মানুষ খুব মাথা নাড়ছে। গুটিগুটি আবার ছেলেটার পকেটে গেলাম। আবার দেখি উঁচুতে উঠে গেছি ফের। কোনোমতে আঁকড়ে-মাকড়ে ঝুলে ঝুলে দেখছি। ভালো দেখতেও পাচ্ছি না নীচ অবধি, এত্তো নীচু। আবার সেই খাজার জায়গাটায় এসে গেল ছেলেটা, কিন্তু খাজার গন্ধ আর পাওয়া যাচ্ছে না। আমার আবার একটু খিদে খিদে পাচ্ছে। একটু হেঁটে হেঁটে এগিয়েছি, আরে কী বিশাল একটা গুঁতো খেলাম বাপস! আমি উলটে পড়েছি, আমার হাত-পা সব শূন্যে। ফের একপাক খেয়ে সোজা হয়েছি, কষ্ট হলেও এমন শক্ত কিছু নয়, শুনি সেই ছেলেটা বলছে, ‘ব্যাটা ফের সোজা হয়ে গেল, মেরেই দিই ব্যাটাকে।’

আরিব্বাস, বলে কী! পাঁই পাঁই করে ছুট দিলাম। কিন্তু ফের গুঁতো আর আমি উলটেছি, ছেলেটা ধরে ফেলেছে আমায়। কোথায় যাব, কী করে বাঁচব? আমি কামড়াতে পারি না, কামড়ালেও বাঁচা যায় তা নয় তাও হঠাৎ কী হল, আগেই বলেছি আমি অন্যরকম, পুরোটা বলিনি, আসলে আমি অনেক কিছু পারি মাঝে মাঝে। খুব খুব ভয় পেয়ে আমি মনে মনে চেষ্টা করলাম ওই ছেলেটার মনের সঙ্গে কন্ট্যাক্ট করতে পারি যদি, যদি কোনোভাবে ওকে আমার কথা শোনানো যায়।

‘মাঠাংবুরু বলছি, আমি মাঠাংবুরু বলছি। আমি ভালো পিঁপড়ে, আমি কামড়াই না। বন্ধু হবে? বন্ধু হবে? বন্ধু হবে?’

কতক্ষণ কেটেছে জানি না, ভাবলাম মরেই গেছি। হঠাৎ শুনতে পেলাম ছেলেটা ভাবছে, ‘আমার সঙ্গে পিঁপড়েটা কথা বলল? আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি তবে?’

তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, ‘না না, পাগল নয়, আমি মাঠাংবুরু, আমিই তোমার সঙ্গে কথা বলছিলাম। আমি পিঁপড়ে, কিন্তু আমি মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারি, ইয়ে মানে মাঝে মাঝে পারি।’

তারপর কী বলব, কতক্ষণ যে লাগল ছেলেটাকে বোঝাতে ব্যাপারটা। আগেই জানি মানুষগুলো বোকা হয়, তাই বলে এত, হ্যাঁ!

ছেলেটা ভালোই। ওর নাম বলল না। বলল, ‘আমায় মহারাজ বা মহাপ্রভু বলবি।’

তা বলা যাবে’খন। বন্ধু হয়ে গেছে আমার, দিব্যি ক’দিন ছুটি কাটিয়ে নিচ্ছি এখানে। আমার বাড়ির লোকেরা খুঁজবে হয়তো। ভাবতেই পারবে না মানুষের পকেটে করে ওদের সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। ভাবলেই হাসি পায়। মহারাজ দেখলাম লোটনদের ভারি ভয় পায়। আমি লোটনের কানে সুড়সুড়ি দিয়ে দিয়েছি টুক করে। ব্যস, ও ভয় দেখাবে কী বনবন করে নিজের লেজ নিজেই তাড়া করে গেল।

সেদিন গাড়ির ড্যাশবোর্ডে ঘুরে ঘুরে দেখছি সব আর গান গাইছি, হ্যাঁ, আমি এখন আরো সব জিনিসের নাম জেনেছি যা খাবার নয়। তা হঠাৎ দেখি একটা জলার ধারে দাঁড়িয়ে পড়ে মহারাজ পেল্লায় চেঁচামেচি লাগিয়েছে, ওদের ভাষায় গান আর কী। দুজন গাইছি বেশ নিজের মতো, দেখি একটা শিং নেড়ে হেলেদুলে সাদা গরু আসছে। আমি এমনিতে ভারি আলাপী পিঁপড়ে, আমাদের এলাকার সব্বাইকে আমি চিনি। এটা অবশ্য অন্য পাড়া। কাছে গিয়ে বললুম, “গুড মর্নিং স্নো হোয়াইটদি, খবর কী? সব ভালো তো?”

সে তো মহা ঘাবড়ে গেছে। বলছে, “সে আবার কী রে!”

হা হা হা, আমি তো এ ক’দিনে প্রচুর গল্প শুনেছি। ওই হাঁ হাঁ করে চেঁচানোটা সইতে পারলে ছেলেটা নেহাত মন্দ নয়। স্নো হোয়াইটের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আমার গানে না হলেও এই মহাপ্রভু ব্যাটার আওয়াজে তার খুবই অসুবিধে হয়েছে, গুঁতোতেই আসবে ঠিক করেছিল। আমি আবার তাকে বুঝিয়ে ঠান্ডা করি। মহা মুশকিল! যাক গে বাবা, যাই এখন।

একটা পাতার নৌকো পেয়েছি আজ এই ঝিলটার উপর। হাউস-বোট বানিয়ে ঘুমোব। একটা গুড়ের বাতাসা নিয়ে নিয়েছি, দু-দিনের জন্য নিশ্চিন্দি। ঠিক করেছি দু-দিন ঘুরে, মহারাজের বাড়িতে (ওই ব্যাটা নিজেকে মহারাজ বলে খালি) ফিরে বালিশে মাথা রাখব একদিন। একটু নলেন গুড় পিঠে দিয়ে খেয়ে ফের বাড়ি ফিরব। জলের মাঝখানটা ভারি পরিষ্কার। দিব্যি নীচ অবধি দেখা যায়। ব্যাঙ আছে একটা, সাপ আছে একটা, দুটো সাদা মাছ আছে এ পাড়ায়। মাছটার সঙ্গে গল্প হল খানিক। বেচারা ভারি ভয়ে আছে, মাঝে মাঝেই নাকি ওদের দল থেকে মাছ নেই হয়ে যায়। খাবার ভেসে আসে, খেতে যায় আর ব্যস উড়ে যায়। নেহাত ওর লোভ-টোভ একটু কম, তাই এখনো বেঁচে আছে। মাছটাকে একটা মুড়ি দিলাম, বাতাসার সঙ্গে খাব বলে এনেছিলাম। একটা মুড়িতে ওর কিছুই হবে না অবশ্য, কিন্তু মাছটা তাতেই খুশি হয়ে ডিগবাজি খেয়ে চলে গেল। উফ্‌, ঘুম ঘুম পাচ্ছে। একটু ঠ্যাঙ নাচিয়ে ঘুমিয়ে নিই। পাতাটা ভেসে যাক যেখানে খুশি।

ঘুম ভাঙল রোদ মুখে পড়তে, পাতাটা ধারে এসে আটকে আছে। এটা কোন পাড় অত চিন্তা আমরা করি না। বাতাসাটার অর্ধেক আছে এখনো, থাক গে। এখানে ঘাসের উপর শিশির আছে, সাবধানে যেতে হবে। পিছলে পড়লেই হয়েছে আর কী। হাড় ভেঙে দ হয়ে পড়ব। আরে, ওখানে ওটা কী হচ্ছে? একটা মেলা বসেছে না? এটা কোন পাড়া কে জানে। ওই কাঠপিঁপড়ে দাদাকে জিজ্ঞেস করব? এমনিতে কাঠপিঁপড়েদের আমি এড়িয়ে চলি, খুব রাগী হয় বাবা। কী দরকার, একটা রদ্দা মারলেই গেছি। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “ও দাদা, কীসের মেলা হচ্ছে গো এসময়?”

“আরে লাল ডেঁয়ো একটা ভালো শিকার করেছে। সব্বার ফিষ্টি তাই। তা তুইও আয় না। নাচগান হবে।”

ব্যস, আমিও জমে গেলাম ওখানে। দিন পাঁচেক ফুলের মধুর নেশা করে, গান গেয়ে, কাঠে কাঠে ড্রাম পিটে কোথা দিয়ে কেটে গেল।

মেলা ফুরোতে ফের হাঁটতে বেরিয়েছি। ওই ব্যাটা মহারাজের কথা মাথা থেকেই বেরিয়ে গেছিল। তা রাস্তা ভুল হবার কিছু নেই, টুকটুক করে হাঁটছি। একটা পানকৌড়িকে বললাম একটু ডানায় নেবে কি না, পাত্তাই দিল না। যাক গে। আরে, একটা কালো গরু আসছে। ওর শিংয়ে চড়ে যাওয়া যায় কি না দেখি তো। কিন্তু এমনি বললে কাটিয়ে দিতে পারে। তাও একবার বলে দেখি। কাছে গিয়ে বলি, “এই যে ম্যাডাম কৃষ্ণকলি, আমি মাঠাংবুরু। বলছি, আমাদের পাড়াটা এখান থেকে সাত রোদের পথ আমি হাঁটলে, তুমি তোমার শিংয়ে একটু এগিয়ে দিতে পারো না?”

“কিন্তু আমি তো অতদূর যাব না। আমার গোয়াল তো কাছেই। অবশ্য তাতেও তোমার হাফ রাস্তা হয়ে যাবে। এসো।”

গল্প করতে করতে, গান গাইতে গাইতে সে রাস্তা খুব তাড়াতাড়িই ফুরিয়ে গেল। শিংয়ে বসে রাস্তাটা ভারি ভালো লাগে, উঁচু যেন পাখির মতো। আকাশে মিঠে শীত শীত রোদ। কিচকিচ করে বকবক করছে চড়াই পাখি, দূরে মাছরাঙা ডুব দিচ্ছে। একটা কুকুর লেজ উলটে শুয়ে আছে। কৃষ্ণকলির মনটা বড়ো নরম। আমায় ছাড়তে গিয়ে দেখি চোখ ছলছল করছে। আরে পাগলি, আমি একজন পিঁপড়ে, অমন মনখারাপ করে নাকি? আচ্ছা, আমি আসব মাঝে মাঝে।

তাড়াতাড়ি পা চালালাম। চারদিকে এত বন্ধু ছড়িয়ে থাকে বলেই আমার ঘরে মন টেকে না যে। সেই ব্যাটা মহারাজের খোঁজ নিতে হবে। কেমন আছে কে জানে। প্রথম মানুষ বন্ধু আমার,  আমার কথা শুনতে পেয়েছিল। আমায় আইসক্রিম খাইয়েছে, গাড়ি চড়িয়েছে। আচ্ছা, এবার আবার খিদে পাচ্ছে আমার। একটা মিষ্টির দোকান দেখছি। যাই একটু খেয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে’খন।

আহা-হা, কী সুন্দর গন্ধ, হ্যাঁ! মিষ্টির দোকানে ঢুকলে এই জন্যই মন ভালো হয়ে যায়। দোকানদারের চোখের আড়ালে দিয়ে গিয়ে একটু ছানার কুলফি খেয়ে নিলুম। আহ্‌, বেড়ে বানায় কিন্তু এটা। যাই এট্টু ঘুমিয়ে নিই বরং, তারপর যাব।

আরে বাপ রে, পেল্লায় ঘুমিয়েছি দেখছি, রোদ নেই আর। তবে খাবারের অভাব নেই, অনেকগুলো মিষ্টি হয়ে গেছে থালায় থালায়। আমাদের চিকরিপিং যদি এখানে এসে পড়ত, খাবার ফেলে কোথাও যেতই না। ব্যাটা খাবার পেলে আর কিছুই চায় না। খেয়ে মুখ মুছে দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম। রাস্তায় গাড়িগুলো ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে বেরিয়ে যাচ্ছে, একটু খেয়াল করে হাঁটতে হবে। চাপা না পড়ে যাই আবার।

‘ঝুঝুমঝুম ঝুঝুমঝুম টগবগাবগরে যাচ্ছি আমি মাঠাংবুরু, পিঁপড়েরাজা রে।’

গান গাইতে গাইতে যাচ্ছি। ক্রমে রোদ এল। আরে, একটা কাঠবিড়ালি না! “ও কত্তা, বাদাম-টাদাম জুটল?”

কাঠবিড়ালি পিড়িক পিড়িক করে তাকিয়ে, লেজে ভর দিয়ে একটা বাদাম খেতে খেতে বলল, “হুঁ হুঁ। চলবে নাকি?”

“না ভায়া, তুমি খাও। আমার আজ পেট ভরা আছে। তা এবারে বাদামের মরশুম কেমন হে? বর্ষায় তো সব ভাসিয়ে দিল এবার, পেলে রসদ?”

“আর বোলো না ভায়া। এই হতভাগা মানুষগুলোর জন্য এই অবস্থা। এত বোকা কী করে হয় কে জানে বাবা, গাছ-টাছ কেটে একাকার, আজকাল আবার লম্বা লম্বা কী বসিয়েছে…”

“টাওয়ার। টাওয়ার বলে ওগুলোকে।”

“আরে হ্যাঁ রে বাবা, ওই টাওয়ারের চক্করে পড়লে বুঝবি। সোজা পরপার হয়ে যাবি। ওই কোনোরকমে দুটো কচুরির আলুর দম জোগাড় হয়েছে। আসলে ফাস্ট ফুড খেয়ে তোদের বৌদির আবার গেঁটে বাত হয়েছে, তাই কচুরি খাচ্ছি না আজকাল আমরা।”

“এ হে, তাহলে তো খুবই মুশকিল হে। সাবধানে থেকো। আসি তবে, হ্যাঁ? মাঠাংবুরুকে মনে রেখো।”

তারপর অনেক গাড়ি, বাস, রোল-চাউমিন পেরিয়ে আমাদের পাড়ার কাছে এলাম। লোটন যথারীতি বদামি করছে। ল্যাজে সুড়সুড়ি দিতে পারতাম, থাক, পরে হবে। মহাপ্রভুটি দেখেনি আমায়, উপুড় হয়ে হাঁ করে ঘুমুচ্ছে। খ্যা খ্যা, আমি একটা লাফ মেরে নাকের উপর উঠে হুইইই বলে চমকে দিয়েছি। ধড়ফড় করে উঠে বসেছে। খ্যা খ্যা, খৌ খৌ। তারপর আর কী? দু-মক্কেলে পেল্লায় আড্ডা হল, গল্প হল। সব অবশ্য বলা যাবে না, কিন্তু এই যে লেখাটা মহাপ্রভু লিখছে, এটা আমি পাশে বসে বললাম বলেই না? মাঠাংবুরু নামে এক পিঁপড়ে গল্প না হলে লোকে জানবে কী করে?

আমি আপাতত যাব আমার দুর্গে ফেরত। ওই পিঁপড়েনিটার জন্য মনখারাপ করছে একটু। দেখে আসি একবার। তারপর আবার বেরিয়ে পড়ব। মহাপ্রভুর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েই গেল যখন, আবার কথা হবে সবার সঙ্গে, আমার অ্যাডভেঞ্চারের গল্পের সঙ্গে।

অলঙ্করণ:অংশুমান দাশ

1 thought on “গল্প-বাউণ্ডুলে পিঁপড়ে মাঠাংবুরু- প্রদীপ্ত ভক্ত-শীত ২০২০

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s