বিদেশি গল্প বিড়ম্বিত মধুচন্দ্রিমা- চার্লস সি. রথওয়েল-শীত-২০২০

অমিত দেবনাথ    এর সমস্ত লেখা

মূল কাহিনি: অ্যাডভেঞ্চার অব শেরউড হোকস – অ্যান ইন্টারাপটেড হানিমুন
লেখক: চার্লস সি. রথওয়েল
অনুবাদ: অমিত দেবনাথ

বিখ্যাত অপরাধ বিশেষজ্ঞ মিঃ শেরউড হোকসের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল অদ্ভুতভাবে। এক হেমন্তকালের শেষের দিকে আমি বিকেলবেলায় বাড়ি ফিরছিলাম টুকটুক করে হাঁটতে হাঁটতে। বুচার অ্যাভিনিউর প্রায় অর্ধেকটা চলে এসেছি, হঠাৎ একটা বাড়ির খোলা দরজা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। খুবই সাধারণ একসারি বাড়ির মধ্যে একটা বাড়ির খুবই সাধারণ একটা দরজা, কিন্তু দরজা ঠকঠক করার নকারের ঠিক নীচের প্যানেলে দেখলাম চক দিয়ে লেখা আছে—

‘ঠক ঠক করবেন না, নামিয়ে রাখুন।’

অদ্ভুত তো! দেখে হাসিই পেয়ে গেল আমার। চলেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু সেই মুহূর্তেই আমার চোখে পড়ল, ছোট্ট লবির পাশের ঘরের কার্পেটের ঝালরে আগুন ধরে গেছে এবং সেই আগুনটা এগিয়ে যাচ্ছে জানালার পর্দার দিকে। এক মুহূর্তও দেরি না করে আমি ঢুকে পড়লাম বাড়িটায়, ঢুকে পড়লাম ঘরের ভেতরে আর বুট দিয়ে মাড়িয়ে নিভিয়ে দিলাম আগুন। অবাক হয়ে দেখলাম ঘরে একজন লোক রয়েছে। সে ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়াল বাস্কেট-চেয়ার থেকে। আমি ঘরে ঢুকেছি বলে একফোঁটাও অবাক হল না, বিরক্তও হল না। আমি বলতে যাচ্ছিলাম কেন ঢুকেছি, কিন্তু দেখলাম তার আগেই সে তড়বড়িয়ে বলা শুরু করেছে।

“গুড ইভনিং স্যার। না না, কোনো কৈফিয়ত দিতে হবে না। আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। বুঝতেই পারছি পনিরের ব্যাবসা করেন। বিপত্নীক। বলতে খারাপ লাগছে, আপনার বড়ো ছেলে দু-বছর আগে মারা গেছে—সম্ভবত হাম হয়েছিল। আপনার মেয়ের বিয়ে হয়েছিল একজন জহুরির সঙ্গে, কিন্তু তার অবস্থা যতটা ভালো হওয়ার কথা ছিল, ততটা হয়নি—একটু পানদোষ আছে। আরে, দাঁড়িয়ে আছেন কেন, বসুন। গতমাসে মারগেট গেছিলেন নাতিনাতনিদের নিয়ে।”

আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। তাকিয়ে রইলাম লোকটার দিকে। আশ্চর্য ব্যাপার! যে আমাকে কোনোদিনও দেখেনি, সে আমাকে এক ঝলক দেখেই আমার সম্বন্ধে এত কিছু বলে দিল!

“মানে, আপনি কী করে…”

“কী, ঠিক বললাম কি না?”

ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে উঁচুমানের হাসি উপহার দিলেন।

“আরে সাধারণ ব্যাপার। এতে কোনো তুকতাক নেই, দরকার শুধু শিক্ষিত চোখ আর যুক্তিভরা মগজ। যেমন ধরুন, আমি কী করে বুঝলাম আপনি চিজ তৈরি করেন। আরে গন্ধ পেলাম যে! আপনার ডানহাতে চকচকে হলুদ ভাব দেখেই বুঝলাম আপনি সারাবছর ধরেই পনির তৈরি করেন। আপনার ঘড়ির চেনের লকেটে রাখা ধূসর-বাদামি চুল দেখেই বোঝা যায় আপনার স্ত্রী গত হয়েছেন।”

“আর আমার ছেলে… স্বর্গত পুত্র? তার ব্যাপারটা?”

“আপনার কলার দেখে মশাই। এই কলারটা ওরই। এটা আপনার যে মাপ হওয়া উচিত, তার অর্ধেক। তার মানে আপনি এটা কেনেননি। কিন্তু এধরনের কলারের ফ্যাশনটা চালু হয়েছে দু-বছর ধরে, আর উঠতি ছেলেপুলেদের মধ্যেই এটা বেশি চালু। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে, সে এটা কিনেছিল, কিন্তু তার পরেই মারা যায়, ফলে এখন আপনিই এটা ব্যবহার করছেন। আর দু-বছর আগে কীরকম হাম হয়েছিল, মনে আছে নিশ্চয়ই?”

“বটে, বটে! আর ওই জহুরি, আমার মোদো-মাতাল জামাই আর মারগেট?”

“এ তো সোজা ব্যাপার! আপনার নাকের হাড় দেখে বুঝলাম আপনি ওই সোনালি চশমাটা খুব কমই ব্যবহার করেন, আর আপনার জামার ওই ভোঁতামার্কা বোতাম দেখেই বুঝেছি আপনি ফালতু পয়সা খরচা করে ওই সোনার প্যাশনেঁ চশমা কেনার মানুষ নন। তাহলে বোঝা যাচ্ছে এটা আপনাকে কেউ উপহার দিয়েছে। কিন্তু যে দিয়েছে, সে আপনার অভ্যেস-টভ্যেসগুলো সেরকম ভালো জানে না, কিন্তু তাও আপনাকে একটা ভালো উপহার দিতে চায়। আরো দেখুন, চশমার কাচগুলো পুরোনো আমলের। তার মানে এগুলো নতুন করে ফিট করা হয়েছে। ওই নতুন লাগানো নাকের ক্লিপগুলো দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এটা যে করেছে, সে এই ধরনের পেশায় রয়েছে এবং বিক্রি না হওয়া জিনিসগুলো কীভাবে তাড়াতাড়ি বিদেয় করবে, সেটাই ভেবেছে। নিঃসন্দেহে এ তাহলে আপনার জামাই। আর একদিকের কাচে যেরকম ঘষার দাগ পড়েছে, তাতে বোঝাই যায় হাত যথেষ্ট কেঁপেছে। মদ খেলে হাত কাঁপে, আপনি জানেন।”

“আরিব্বাস!” আমি বলে উঠলাম, “আপনি নির্ঘাত জাদুকর!”

“আর আপনার মারগেট বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারটা কীভাবে বললাম? ওই তিনটে খড়খড়ে গাধার চুল…”

“বাদ দিন গাধার চুল আর মারগেট। টেবিলের ওই টুপির নীচে কী আছে?”

লোকটা একটু হকচকিয়ে গিয়ে সিল্কের টুপিটা তুলল। তলায় রয়েছে একটা চ্যাপ্টা বোতল।

“বসবেন নাকি একটু? পান করবেন?”

আমি বসলাম। যতক্ষণ লোকটা ঘুরে ঘুরে জোগাড়যন্ত্র করছিল, আমি তাকে আর তার আশপাশটা দেখছিলাম। লোকটার বয়স চল্লিশের এধার ওধার, সময় এবং ভাগ্য তার খুব ভালো যায়নি বলেই মনে হচ্ছে। লম্বাটে মুখ, চোখদুটো বড়ো বড়ো আর গভীর, মাথার লাল চুল এত ছোটো করে ছাঁটা, যেন মনে হচ্ছে কেউ ঘাস ছাঁটা মেশিন চালিয়েছে। তাকে এক ঝলক দেখলেই মনে হয় খুবই উত্যক্ত আর জ্বালাতনে লোক, যে সারাক্ষণ তার প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধেও জেতার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। পরনে একটা ফ্রক কোট, ভাঁজে ভাঁজে কালির দাগ, জামার বোতাম বাঁকাভাবে আটকানো, আর দাগ দেখে মনে হয়, যে কিছু মুষ্টিমেয় লোক এখনো নস্যি নেয়, এ তাদেরই একজন।

আমার দিকে একটা চুরুট আর গ্লাস এগিয়ে দিয়ে লোকটা বসল চেয়ারে।

“ভালো কথা,” আমি বললাম, “আমি এই ম্যানিলা চুরুট সম্পর্কে কিছু বলতে পারি। আমাকে কয়েকদিন আগেই এর একটা পরীক্ষা করতে হয়েছিল। আমার যা ব্যাবসা, তাতে এটা অবশ্য খুবই সাধারণ…”

“পরীক্ষা? কিন্তু স্যার, মানে, আপনার মতো একজন পনিরওয়ালা…”

“কোনোদিনও ছিলাম না। আমি একজন কেমিস্ট এবং ড্রাগিস্ট, বহুদিন ধরেই।”

“কিন্তু, কিন্তু তা কী করে হয়! আপনার হলুদ দাগ, চিজের গন্ধ… এই তো, এখনো পাওয়া যাচ্ছে সেই গন্ধ, পরিষ্কার!”

“তাতে আর আশ্চর্য কী!” আমি বললাম, “আপনার তাকেই তো আধ পাউন্ড গর্গনজোলা রেখে দিয়েছেন। আর হাতের হলুদ দাগের কথা বলছেন? সারা সকাল আমি আয়োডোফর্ম মলম বানিয়েছি, দাগটা ওখান থেকেই হয়েছে।”

লোকটার মুখ ঝুলে পড়ল, আরো তিতকুটে ছাপ পড়ল সেখানে।

“কিন্তু আপনি অবশ্যই বিপত্নীক?” ব্যাকুল হয়ে বলল লোকটা।

“আবার ভুল করলেন। আর আমি কখনোই আমার স্বর্গত পুত্রের পোশাক পরিনি। কলারটা আমি নিজেই কিনেছি, আর লকেটের চুলটা নাকি রানি শার্লট-এর, আমি এটা সেল থেকে কিনেছি।”

“কিন্তু অন্ততপক্ষে আপনার মেয়ের বিয়ে তো একজন জহুরির সঙ্গে…”

“কখনো হয়নি। আমার ছেলেমেয়েই নেই। চশমা আমিই কিনেছি। বহুবছরের মধ্যেও আমি সমুদ্রতীরে যাইনি, আর এই গাধার চুলটা নির্ঘাত সকালে ব্রাশ দিয়ে জামাকাপড় ঝেড়েছিলাম, সেখান থেকেই এসেছে।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হোকস তাকিয়ে রইল আগুনের দিকে।

“কী করে হয় জানি না। তবে আমি বোধ হয় কোনোদিনই আর দক্ষতা অর্জন করে উঠতে পারব না। আমি কিন্তু চেষ্টা করি, জানেন, খুব চেষ্টা করি কিন্তু পারি না। খুবই দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার। আমি সবরকম পদ্ধতি প্রয়োগ করেছি, কিন্তু প্রায় সবসময়েই ভুল হয়েছে। এই তো, দেখুন না, আপনার ক্ষেত্রে সমস্ত তথ্যই বলছে আপনি পনিরওয়ালা এবং আপনার মেয়ের বিয়ে হয়েছে এক মাতাল জহুরির সঙ্গে।”

“নাহ্‌,” আমি বললাম, “দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, যা যা বলেছেন সবই ভুল। আপনি কি অনেকদিন ধরেই এই পেশায় আছেন?”

“বছর তিনেক।”

“আপনি কি নিজেকে প্রাইভেট ডিটেকটিভ বলেন?”

“ক্রিমিনাল প্যাথোলজিস্ট বললে আরো ভালো হয় স্যার। অপরাধের দিকে ঝোঁকটা আমার বরাবরই বেশি, মানে অপরাধ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে। বুঝতেই পারছেন, ব্যাবসা করতে গিয়ে সুবিধে করতে পারিনি, তাই বছর তিনেক ধরে এই পেশায় এসেছি।”

“মানব চরিত্র নিয়ে কিছু কিছু পড়াশোনা অবশ্য আমিও করেছি, কিন্তু অপরাধের দিকে বিশেষ কোনো ঝোঁক নেই। আপনার ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং লাগছে। তা সাফল্য-টাফল্য কীরকম পেয়েছেন? প্রচুর?”

“হ্যাঁ, মানে ওই একটা বা দুটোয় একটুখানি। সেই সাংঘাতিক ‘ব্যাকগ্যামন’-এর ঘটনাটা মনে আছে? আমার তো মনে হয়, পুলিশ যদি আমার হাতে কেসটা ছেড়ে দিত, তাহলে আমিই এটার সমাধান করতে পারতাম। তারপর ধরুন, সেই বিখ্যাত চব্বিশ জন কয়েদির কেসটা বা হোক্সটন-এর নীল মুক্তো চুরির ব্যাপারটা।”

“ও হ্যাঁ, মনে আছে সেটা।”

“আমারও মনে আছে,” ভাঙা গলায় বলল হোকস, “কারণ ওই কেসটায় আমাকে মিলব্যাঙ্ক-এ কয়েকদিন জেল খাটতে হয়েছিল। কী করে বুঝব বলুন যে ওই গুন্ডাগুলো মিষ্টি কথায় আমাকে ভুলিয়ে ওদের কাজ করিয়ে নেবে?” তার গলা দিয়ে বিরক্তিতে একটা ঘোঁত ঘোঁত শব্দ বেরিয়ে এল। “তবে ওই কয়েকদিন যে জেল খেটেছিলাম, তাতে আমার লাভই হয়েছিল। আমার সঙ্গে বেশ কিছু চমৎকার অপরাধীর ভালোই দহরম-মহরম হয়ে গেছে। তাতে আমার পেশায় পরে সুবিধেই হবে।”

“আপনি কি সাধারণ পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে কাজ করেন?”

“এখনো নয়, স্যার। আমি তো স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে গেছিলাম। গিয়ে বলেছিলাম আমি ওদের সাহায্য করতে চাই। কী বলব মশাই, ওরা আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল। কেন, আমি কি ফেলনা? ওরা তো ওদের ছবির অ্যালবামটা দেখলেও আমাকে চিনতে পারত, আমার ছবি তো ওদের কাছে আছেই, ওই জেলে, মানে মিলব্যাঙ্কে যাওয়ার পর থেকেই। আমি তক্ষুনি ওখান থেকে চলে এসেছি। আমার আত্মসম্মান বলল ওখানে আমার আর থাকা উচিত নয়। ওরা বুঝতে পেরেছে যে ভবিষ্যতে আমাদের মধ্যে আর কোনোভাবেই ঘনিষ্ঠতা হবে না, যদিও আমি চেষ্টা করব যাতে ওদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করা যায়।”

এই হল আমার সঙ্গে শেরউড হোকসের প্রথম পরিচয়ের বৃত্তান্ত। আমি যখন ঘর থেকে বেরোচ্ছি, সে তার একটা কার্ড আমার হাতে দিল। কার্ডটা হুবহু নীচে তুলে দিলাম যাতে ভবিষ্যতে লোকজন দরকার পড়লে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে—

শেরউড হোকস

অপরাধ ও রহস্য বিশেষজ্ঞ

গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।

৪০৪, বুচার অ্যাভিনিউ

তারপর ওর সঙ্গে বহুবার আমার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। সেখান থেকেই আমি একটু একটু করে জানতে পেরেছি ওর কর্মপদ্ধতি। ছেলেবেলায় লেখাপড়া প্রায় কিছুই করেনি, তবে সেটা পুষিয়ে দিয়েছে পুরোনো কিছু পত্রিকা পড়ে, যেগুলোতে লেখাপড়া শেখানো হয়। প্রাণপণে মুখস্থ করেছে তিন খণ্ড বিশ্বকোষ, যেগুলো ও একজায়গায় ঘর-গেরস্থালির জিনিসপত্তর আর পিয়ানোর নিলাম হচ্ছিল, সেখান থেকে কিনেছিল। ‘গ্রহণ, বর্জন এবং সঠিক যুক্তিসম্মত চিন্তা প্রক্রিয়া’—এই ছিল তার মূলমন্ত্র। আমার ধারণা, সারাক্ষণ এই কথাগুলো আওড়ে সে বোধ হয় কোনো অদ্ভুতুড়ে তৃপ্তি পেত, যে-রকম  হয়েছিল সেই গল্পের ধর্মপ্রাণ বয়স্কা মহিলার ক্ষেত্রে।

সব মিলিয়ে কিন্তু হোকস বেশ মনোজ্ঞ এবং চিত্তাকর্ষক ব্যক্তিত্ব। ওর যে জিনিসটা সবচেয়ে নজর কাড়ে, তা হল ওর সরল মন আর উষ্ণ হৃদয়। ওর পেশাদারি জীবনটা আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি, অবশ্যই আইনের দিক থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে। একেবারে লেজেগোবরে অবস্থা। ওর কাছে যেসব মক্কেল আসত, সবক’টা ধড়িবাজ আর দু-নম্বরি। তাদের কেস নিয়ে সে দারুণ উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়ত এবং সবক’টায় গণ্ডগোল বাধাত। দেখে খুবই খারাপ লাগত আমার। ওর মক্কেলরাও করুণা করত ওকে। ওর এই হঠকারী কাজের জন্য সে বহুবার জেলে ঢুকেছে। প্রতিবারই অবশ্য মেয়াদ হয়েছে অল্পদিনের জন্যই এবং প্রতিবারই ওর বেরোনোর দিনে আমিই গিয়ে ওকে বাড়ি নিয়ে আসতাম। এ সৌভাগ্য একমাত্র আমারই হয়েছে।

ওর যেসব ঘটনা আমি লিখে রেখেছিলাম, তার মধ্যে একটা ঘটনা আমি পাঠকদের কাছে তুলে ধরছি। এটা ওর সাম্প্রতিকতম অ্যাডভেঞ্চার।

একদিন বিকেলে আমি আর হোকস একটু খানাপিনা করছি বুচার অ্যাভিনিউর ঘরে বসে ওর সর্বশেষ জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার আনন্দে, তখন আমি ওকে বলছিলাম ওর উৎসাহটা একটু কমাতে, কারণ এগুলোর প্রায় সবকটাই মিলব্যাঙ্কে গিয়ে শেষ হয়। এমন সময় এক মক্কেল এল। হোকস সঙ্গে সঙ্গেই ওর খুলি ঢাকা টুপিটা পরে নিল (সদ্য চারদিনের মেয়াদ সেরে বেরিয়েছেন কিনা)। তারপর আমরা গিয়ে বসলাম বসার ঘরে। সেখানে অপেক্ষা করছিলেন এক মহিলা—মুখ ঢাকা পুরু ক্রেপের ঘোমটায়, কিন্তু তাঁর অন্যান্য পোশাক-আশাক দেখে আদৌ কোনো শোকের চিহ্ন আছে বলে মনে হল না। তিনি আবরণটা সরাতেই হোকস কায়দাবাজি শুরু করে দিল।

“সদ্য নিউ ইয়র্ক থেকে এলেন, তাই না?”

“না স্যার, আমি ক্যাম্বারওয়েল থেকে আসছি।”

“কিন্তু আপনার দস্তানার বোতামে তো আমেরিকার ছাপ আছে। ওসব জিনিস তো এখানে পাওয়া যায় না।”

“ওগুলো আমার বোন গতবার কানাডা থেকে এনে দিয়েছে।”

খুবই হতাশ হয়ে হোকস চেয়ারে বসলেন, “আপনি কি আমার পরামর্শ চান ম্যাডাম?”

“হ্যাঁ, স্যার। আমি পুলিশের রিপোর্টে আপনার কথা পড়েছি, তাই ভাবলাম, অন্য সবাই তো ফেল করেছে, যদি আপনি পারেন।”

মহিলা সাদা ফ্যাকাশে মুখে আমাদের দিকে তাকিয়ে ফোঁপাতে লাগলেন। বড়ো মর্মস্পর্শী সেই কান্না। মহিলার বয়স বছর তিরিশ, দেখতে সুশ্রী, উচ্চারণ শুনলেই বোঝা যায় ক্যাম্বারওয়েলের বাসিন্দা।

“আমার নাম ব্যাগওয়ার্দি, মারিয়ন ব্যাগওয়ার্দি। তিন সপ্তাহ আগে বিয়ে হয়েছে ক্যাম্বারওয়েলের বাড়িতে। স্বামীর নাম মিঃ আর্থার ব্যাগওয়ার্দি। ঘুরে ঘুরে চায়ের ব্যাবসা করতেন।”

“করতেন বললেন কেন মিসেস ব্যাগওয়ার্দি? আপনার স্বামী বেঁচে নেই?”

“জানি না স্যার, সত্যিই জানি না। শুধু এইটুকু জানি যে বিয়ের দিনই তিনি উধাও হয়ে গেছেন। তাঁকে আর দেখিওনি, তাঁর কথা শুনিওনি।”

“তেমন অস্বাভাবিক নয় ঘটনাটা।” শুকনো গলায় বললেন হোকস, “আপনি কি অন্য কিছু ভাবছেন, গোলমেলে কিছু? এরকম কি আপনার মনে হচ্ছে যে ব্যাপারটা আগে থেকেই সাজানো এবং ইচ্ছাকৃত? ভুল বুঝবেন না আশা করি।”

“না স্যার, কখনোই নয়। উনি খুব চমৎকার মানুষ ছিলেন। ওঁর উধাও হওয়াটা এমনই আশ্চর্যের যে আমি কী করব, কার কাছে যাব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। জানেন স্যার, আমার চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন মানুষটা!” মহিলা আমাদের দিকে তাকালেন সম্পূর্ণ হতাশ মুখে।

“অদ্ভুত তো!” বলল হোকস, “পুরো ব্যাপারটা খুলে বলুন।”

“উনি উধাও হয়েছেন বারোই ফেব্রুয়ারি রাত পৌনে আটটার সময়। আচ্ছা স্যার, প্রথম থেকে বলছি, না হলে আপনি বুঝতে পারবেন না। সেদিনই আমাদের বিয়ে হয়েছে, খুবই ছিমছাম বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিল সেটা। তারপর আমরা চলে গেলাম আমার মায়ের বাড়িতে, জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে পোশাক পরে তৈরি হয়ে গেলাম। তারপর একটা গাড়ি ভাড়া করে ধীরেসুস্থে শহরে গিয়ে ল্যাক-এর হোটেলে উঠলাম সেদিনটা সেখানে থেকে পরেরদিন ভোরবেলা ফোক্সটন যাব বলে।”

“এক মিনিট। আপনার স্বামীর চেহারার একটা বর্ণনা দিন তো।”

“ছোটোখাটো আর ছিপছিপে, খুবই চমৎকার চেহারা। গাঢ় রঙ, কালো চোখ, আর একটা চোখ, ইয়ে, বাঁ-চোখটা একটু ট্যারা, তবে খুব নজর না করলে বোঝা যায় না।”

“কোনদিকে ট্যারা? ভেতরের দিকে না বাইরের দিকে?”

“বাইরের দিকে। এতে স্যার ওঁকে কিন্তু খুব সুন্দর লাগে, অনেকটা কবি কবি ভাব। যাই হোক, যা বলছিলাম। আমরা ল্যাকের হোটেলে উঠলাম সাড়ে ছ’টা নাগাদ, গিয়ে ডিনার করে নিলাম। তারপর সেদিনের রাতটা খুব চমৎকার ছিল বলে আর্থার বলল একটু হাঁটতে যাবে। তখন আমরা ওপরে গেলাম জামাকাপড় পরব বলে, আর তখনই সে, সে, সে অদৃশ্য হয়ে গেল।”

মিসেস ব্যাগওয়ার্দি আবার কাঁদতে শুরু করলেন একটা আগে থেকেই চুপচুপে ভেজা রুমালে মুখ ঢেকে।

“শান্ত হোন ম্যাডাম।” বলল হোকস নরম গলায়। “কীভাবে তিনি উধাও হলেন? দরজা দিয়ে? জানালা দিয়ে? নাকি চিমনি দিয়ে?”

“না না না,” কাঁদতে কাদতেই বললেন মহিলা, “আমার টিনের ট্রাঙ্কের ওপর বসেছিল মানুষটা, আর সেখানে বসে বসেই উধাও হয়ে গেল।”

“ট্রাঙ্কের ভেতরে?”

“না না। হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।”

“আপনি তখন কী করছিলেন?”

“আমি ওর দিকে তাকিয়ে অলস্টারটা পরছিলাম।”

হোকস হেলান দিয়ে বসে বড়ো এক টিপ নস্যি নিল। “গোলমেলে কেস মনে হচ্ছে, চেসমোর। তখন আপনার কাছে টাকাপয়সা কীরকম ছিল ম্যাডাম?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“কুড়ি পাউন্ড ছিল হানিমুনের জন্য, কিন্তু সে তো আমার বাক্সে ছিল। আর উধাও হওয়ার আগে আর্থারের কাছে কয়েকটা শিলিং ছিল।”

“আপনি বললেন তখন পৌনে আটটা বাজে।” বলল হোকস দারুণ পালিশ করা গলায়, “ডিনার করেছিলেন তার কতক্ষণ আগে, ঘণ্টা খানেক?”

“হ্যাঁ স্যার, তবে তার আগে আমরা পুডিং-এর অর্ডার দিয়েছিলাম, তাই একটু দেরি হয়েছিল।”

“পুডিং?”

“হ্যাঁ স্যার, আপেলের পুডিং। আমার স্বামীর বরাবরের পছন্দের জিনিস, তাই আমরা তিনটের অর্ডার দিয়েছিলাম। প্রত্যেকের জন্য একটা করে।”

“ও। তাহলে দুজনে দুটো খেলেন, আরেকটা প্লেটে রয়ে গেল?”

“না।”

“তাহলে ওটা অর্ধেক করেছিলেন?”

“না। আমরা একটা করেই খেয়েছিলাম।”

“ও, তাহলে ওটা কি ওয়েটার সরিয়ে দিয়েছিল?”

“না না, তাও নয়।”

“তাহলে ব্যাপারটা কী?”

“সে তো আমি জানি না।” হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে বললেন মিসেস ব্যাগওয়ার্দি।

“আপনি জানেন না? ডিশও নেই, খানওনি, কোথাও কেউ নিয়েও যায়নি, তাহলে গেল কোথায়?”

মহিলা রুমালে মুখ ঢেকে ফোঁপাতে লাগলেন।

“এটাও উধাও হয়ে গেছে।”

চমকে উঠল হোকস; শিস দিয়ে উঠল বিস্ময়ে।

“আমি ওটার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম, আর ওটাও হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।”

“আর আপনি ওটা দেখেনওনি?”

“হ্যাঁ স্যার, দেখেছি। তাই জানি আর্থারও বেঁচে আছে। ওটা আমার কাছে তিনদিন পর ফিরে এসেছে পোস্টে। ওপরে ওর হাতেই ঠিকানা লেখা ছিল।”

মিসেস ব্যাগওয়ার্দি টিস্যু পেপারে মোড়া একটা ছোটো পার্সেল খুলতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটা বড়ো আর ময়লা খাম। খামের ওপরে পোস্ট অফিসের ছাপ মারা। খামের ভেতরে রয়েছে খানিকটা চটচটে হলুদরঙা আপেলের পুডিং।

আমরা দুজনেই পরীক্ষা করে দেখতে লাগলাম জিনিসটা। হোকস পকেট থেকে বার করে আনল তার অব্যর্থ আতস কাচটা। আমরা দুজনেই শুঁকে দেখলাম সেটা, এমনকি হাত দিয়েও দেখলাম।

“ব্যাপারটা মোটেই ভালো ঠেকছে না চেসমোর।” গম্ভীর গলায় বলল হোকস, “খামটা ভালো করে দেখলেই বুঝবে ভদ্রলোক যে শুধু সেই সময়ে ঠিকঠাকই ছিলেন তাই নয়, তিনি রীতিমতো ব্যাপারটা উপভোগই করছিলেন। এমনকি তিনি পাইপ খাচ্ছিলেন সেই সময়ে।”

“বলো কী? বুঝলে কী করে?”

“হাতের লেখাটা দেখো। বিপদে থাকলে কারোর হাতের লেখা এমন ঝকঝকে হয়? তিনি বেশ ছড়িয়ে বসে অনেক সময় নিয়ে লিখেছেন এবং শুধু তাই নয়, ভালো করে খেয়াল করলে দেখবে ওই ‘—ওয়ার্দি’ লেখাটার ওপরে গোটা ছয়েক বাদামি ছোপ। ওটা হয়েছে পাইপের ছাই পড়ে, সামান্য পুড়েও গেছে কাগজটা। তাহলে বুঝতেই পারছ, আমাদের এমন একজন ধড়িবাজ লোকের মোকাবিলা করতে হবে, যে তার ব্যক্তিগত স্বার্থে এই মহিলাকে বিয়ে করেই ছেড়ে দিয়েছে।”

পরেরদিন আমরা ল্যাকের হোটেলে গেলাম মিসেস ব্যাগওয়ার্দির সঙ্গে দেখা করার জন্য। অ্যাপয়েন্টমেন্ট করাই ছিল। একেবারে তৃতীয় শ্রেণির হোটেল একটা, ব্লটার স্ট্রিটের শেষ মাথায়। এর মালিক অবশ্য আমাদের দেখে ঠিকঠাক অভ্যর্থনা করল না।

“আপনাদের মতলবটা কী বলুন তো?” আমাদের মুখের ওপরেই প্রশ্নটা ছুড়ে দিল সে। “সকালে পুলিশ, বিকেলে পুলিশ, তাড়িয়ে পারা যাচ্ছে না।”

হোকস সবিনয়ে বলল যে আমরা পুলিশ নই।

“সে আপনাদের দেখেই বুঝেছি। এই চেহারায় পুলিশ হয় না। কিন্তু দেখে তো মনে হচ্ছে গত সপ্তাহে খালাস পেয়েছেন! মাথায় এক্কেবারে নিউ-গেট মার্কা চুলের ছাঁট। হ্যাঁ, এই যে, আপনাকে বলছি। অ্যায় টম, ইধার আও। এই দুই হতভাগাকে দোতলার সতেরো নম্বর ঘরে নিয়ে যাও। আর হ্যাঁ, তোয়ালেগুলোর দিকে নজর রাখবে।”

এটা একটা ছোট্ট চৌকোনা সাদামাটা ঘর। ওয়ারড্রোব নেই, লোহার খাটে কোনো ঝালর নেই। আমরা যতক্ষণ ঘরে ছিলাম, সারাক্ষণ টম নজর রাখল আমাদের ওপরে। মিসেস ব্যাগওয়ার্দি আমাদের পুরো অদৃশ্য হওয়ার ব্যাপারটা অভিনয় করে দেখালেন। দেখালেন খাটের পাশের সেই টিনের বাক্সটা, যার ওপরে বসে আর্থার চুরুট খাচ্ছিলেন, আর সেই সময় তিনি বন্ধ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে পোশাক পরছিলেন।

“ওর টাইয়ে একটা হিরের পিন আটকানো ছিল। আর্থার সবসময় এসব পরতে ভালোবাসত। ওটা গ্যাসের আলোতে এমন ঝলসাচ্ছিল যে আমি ওকে বললামও সেটা, আর তার পরেই ও উধাও হয়ে গেল।”

“আপনি তখন কী করলেন?”

“আমি চমকে গেছিলাম মিঃ হোকস, তবে ঘাবড়াইনি। আমি আর্থারের নাম ধরে ডাকলাম, বললাম এরকম দুষ্টুমি না করতে, লুকিয়ে না থেকে বেরিয়ে আসতে, কিন্তু এও ভাবছিলাম, এই ঘরে ও কোথায় লুকোবে? এখানে তো ওর লুকোনোর মতো জায়গাই নেই।”

“ওরা বলছিল,” টম ছোকরা বলল উদ্ধত গলায়, “ওই লোকটা ‘মুর অ্যান্ড বার্গেস’-এ শখের অভিনয় করে, ওরা এসব অভিনয় করতে পারে।”

“ওদের এত সাহস যে আমার স্বামীর নামে এসব কথা রটায়!” মিসেস ব্যাগওয়ার্দি রেগে গেলেন। “আমি ওকে কখনোই এসব করতে দেখিনি। মজা করার জন্য কখনো কখনো একটু আধটু থট রিডিং করত বটে, তবে আমাদের বিয়ের দিনেই ওসব ভোজবাজি করবে—আমি বিশ্বাস করি না। এ কথাটা বলা খুবই খারাপ হয়েছে।”

হোকসকে হঠাৎ যেরকম চাঙ্গা দেখলাম, এরকম আর কখনো দেখিনি। সারা ঘরের দেয়াল, মেঝে, চিমনি, বিছানা, হাতমুখ ধোয়ার জায়গা এমন যত্নের সঙ্গে সে পরীক্ষা করতে শুরু করল, যেন ডাক্তার যক্ষ্মার রোগী দেখছে। যতক্ষণ এসব চলল, আমরা দূরে দাঁড়িয়ে দেখলাম সশ্রদ্ধচিত্তে। আতস কাচের মতোই সে একটা কম্পাস নিয়ে এসেছিল। সেটাকে ঘরের বিভিন্ন জায়গায় রেখে কাঁটার নড়াচড়া দেখল। মনে হচ্ছিল সে বেশ কিছু তথ্য পেয়ে গেছে এর মধ্যেই। তার হাবভাব দেখেই সেটা বুঝতে পারছিলাম, কারণ মাঝে মাঝেই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছিল ‘যা ভেবেছিলাম! যা ভয় পাচ্ছিলাম!’ গোছের কথাগুলো। তারপর জানালার কাছে গিয়ে কাঠের ফ্রেমগুলো পরীক্ষা করল ইঞ্চি ইঞ্চি করে। তারপর দারুণ একটা বিজয়ীর হাসি দেখা গেল তার মুখে। সে ঘুরে তাকাল মহিলার দিকে।

“আপনার স্বামীর হাতে কোনো আংটি ছিল?”

“হ্যাঁ।”

“বর্মের মতো তৃতীয় আঙুলে পরতেন?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ।”

হুস করে একটা শ্বাস বেরিয়ে এল হোকসের মুখ থেকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস।

“আপনাকে ম্যাডাম আর একটিমাত্রই প্রশ্ন করব। আপনার স্বামীর কি কোনো বড়ো ছাতা ছিল?”

“ওর সঙ্গে প্রায়ই বড়ো ছাতা থাকত, বেশিরভাগ লোক ঘোরাঘুরি করতে গেলে যেরকম রাখে।”

“যেদিন উধাও হলেন, সেদিন কি তাঁর সঙ্গে ছাতাটা ছিল?”

মিসেস ব্যাগওয়ার্দি একটু থমকে গেলেন। তারপর বললেন, “ছিল মনে হয়। তবে স্যার আমি নিশ্চিত নই। ভালো করে খেয়াল করিনি।”

“ধন্যবাদ ম্যাডাম।” বলল হোকস শান্ত গলায়, “তবে আমি নিশ্চিত। আর আপনার স্বামীকে তিনদিনের মধ্যে এনে হাজির করব, কথা দিচ্ছি।”

আমাদের এর পরের গন্তব্যস্থল হল একটা গাড়ি ভাড়া করে ক্যাম্বারওয়েলের দিকে যাত্রা করা। হোকসের ইচ্ছে সেখানে গিয়ে টিনের ট্রাঙ্ক সহ মিঃ ব্যাগওয়ার্দির আর যা যা জিনিস মিসেস ব্যাগওয়ার্দি স্ত্রী হিসেবে পেয়েছেন, সেগুলো দেখা।

যাত্রাপথে একটা অত্যন্ত আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। মিসেস ব্যাগওয়ার্দি আর আমি বসে ছিলাম পেছনের সিটে, আমাদের মুখোমুখি সিটে হোকস। ওর বুক পকেট থেকে আতস কাচটা বেরিয়ে মার্চের সূর্যালোকে ঝলসাচ্ছিল। আমি আর মিসেস ব্যাগওয়ার্দি, দুজনেরই চোখে পড়েছিল ব্যাপারটা। হঠাৎই মিসেস ব্যাগওয়ার্দি বলে উঠলেন, “আচ্ছা, মিঃ হোকস আমাদের সঙ্গে এলেন না কেন? অথচ আমাকে যে বললেন আমার স্বামীর জামাকাপড়গুলো দেখবেন?”

তিনি আমার দিকে তাকালেন। দেখলাম তাঁর চোখে কেমন ঘোর ঘোর ভাব। আমি বোকার মতো হাসলাম। অবাক হয়েছিলাম অবশ্যই। “কী বলছেন ম্যাডাম! ভালো করে তাকিয়ে দেখুন, মিঃ হোকস আমাদের সামনেই বসে আছেন।”

মহিলা তাকালেন ঠিকই, কিন্তু মনে হল না কিছু দেখলেন বলে।

“কোথায়? কেউ তো নেই।” বললেন তিনি।

মনে হল তিনি ভেবেছেন আমি ঠাট্টা করলাম তাঁর সঙ্গে। তার পরেই আমি বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা। কাচের ঝলসানিতে তাঁর ঘোর লেগে গেছে সম্মোহনের মতো। হোকস আর আমি মাথা নাড়লাম। একটু পরেই অবশ্য তাঁর ঘোর কেটে গেল, তিনি আবার আমাদের সঙ্গে গল্পগুজব করতে লাগলেন আগের মতোই, যেন কিছুই হয়নি।

মিঃ ব্যাগওয়ার্দির জামাকাপড় থেকে হোকস অনেক কিছু বার করে ফেলল। প্রতিটি ভাঁজ থেকে সে শঠতা আর প্রবঞ্চনার উদাহরণ বার করতে লাগল একের পর এক।

“এ লোক কোনো সাধারণ বদমাশ নয় চেসমোর, এই দেখো কী পেয়েছি।”

সেটা একটা ছোট্ট পেতলের বাটির মতো, মহারানির মাথার ছাপ পরিপাটি করে কেটে আটকানো হয়েছে।

“অন্ধকার রাত্তিরে মাতাল কোচোয়ানের কাছে এটা প্রায় আধ সভরিনের সমান। আর এই ওভারকোটটা খেয়াল করো। দেখো, এর ডান বগলের ঠিক নিচেই লম্বা একটা ফালি আর চোরাপকেট। আর ওই চপ্পলগুলো… বড়ো রকমের ধান্দাবাজির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সোলটা দেখলেই বুঝবে লোকটার পা টিপে টিপে হাঁটার অভ্যেস। লোকটা দেখছি পাজির পা ঝাড়া!”

সেই রাত্তিরে হোকসের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলার সময় দেখলাম ও খুব চুপচাপ হয়ে গেছে এবং রহস্যময় আচরণ করছে, বড়ো বড়ো ঔপন্যাসিক এবং গোয়েন্দারা যেরকম করে থাকে। একটা ব্যাপারে আমরা দুজনেই একমত যে উধাও হওয়ার সময় মিসেস ব্যাগওয়ার্দি সাময়িকভাবে সম্মোহিত হয়েছিলেন সম্ভবত তাঁর স্বামীর টাইয়ের হিরের ঝলকানিতে এবং সেই সময়েই তাঁর স্বামী তাঁর অলক্ষ্যে কেটে পড়েছেন। কিন্তু কীভাবে? হোটেলের লোকেরা বলছে তিনি কোনোভাবেই সিঁড়ি দিয়ে নামেননি।

হোকস আমার হাঁটুতে টোকা মেরে বলল, “লোকটা দোতলায় ছাতা নিয়ে কী করছিল?”

“ছাতা নিয়ে যেতেই পারে। কী হয় তাতে?” আমি প্রতিবাদ করলাম।

“কী হয় তাতে? কিস্যু বোঝোনি! ও ছাতাটাকে প্যারাস্যুটের মতো ব্যবহার করেছে! আমি জানালার গোবরাটে ওর বুট আর আংটির ছাপ দেখেছি। ও ওখান দিয়ে উঠে নীচের আস্তাবলের উঠোনে ভেসে ভেসে নেমেছে, অন্ধকারে কেউ দেখতে পায়নি।”

পরদিন বিকেলে ডাক পেয়ে আমি বুচার অ্যাভিনিউর ঘরে গিয়ে দেখি জরাজীর্ণ চেহারার এক কোচোয়ান টুপির ওপর মাথা রেখে আগুনের পাশে ঘুমোচ্ছে। এটা হোকস।

“খুব ধকল গেছে আজ, বুঝলে।” বলল সে, “সকাল থেকে এই নিয়ে তিন নম্বর ছদ্মবেশ ধরলাম।”

“কাজ কিছু হল?”

“প্রচুর। লোকটাকে হাতের মুঠোয় এনে ফেলেছি, কাল সকালেই ধরব। ও ভাবছে কাল দুপুরের জাহাজে অ্যান্টওয়ার্প যাবে, কিন্তু সেটি হচ্ছে না।”

“তুমি ওকে দেখেছ নাকি?”

“এখনো দেখিনি। কিন্তু তুমি কি জানো, ওর আরেকটা বউ আছে, বাচ্চাকাচ্চাও আছে? আমি ওদের দেখেছি। এই তো, কমার্শিয়াল রোডে ছোট্ট চমৎকার বাড়ি আর দোকান, জার্মান ইস্ট বিক্রি করে। নামটা অবশ্য আলাদা, বুঝতেই পারছ। ওর প্যান্টের বোতাম থেকেই ধরলাম ওকে। কালকেই একখানা কেটে নিয়েছিলাম, মনে আছে নিশ্চয়ই? দর্জির খোঁজও পেয়েছি। সেখানে অবশ্য ওর নাম হল অগাস্টাস বুন্দেলমান। খেয়াল করে দেখো, সইটাও একরকম। ওর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে কী জানতে পারলাম জানো? ওর স্বামীর প্রিয় খাবার হচ্ছে আপেলের পুডিং! তাহলে সবকিছু মিলে যাচ্ছে কি না? এবার চাঁদুকে ধরবই ধরব!”

“কালকে তাহলে কীভাবে কাজটা করবে? খুব সাবধান হোকস, কোনো ভুল যেন না হয়।”

“আরে না, কোনো ভয় নেই। কালকে আমি খালাসি সেজে সেন্ট ক্যাথরিন জাহাজঘাটায় যাব। মিসেস ব্যাগওয়ার্দি সেখানে যাবেন তাকে চিনিয়ে দেওয়ার জন্য, আর ডেকে পা রাখলেই ব্যাটাকে ক্যাঁক করে ধরব।”

“বেশ। আমার শুভেচ্ছা রইল। তাহলে কাল রাত্তিরে আসছি সব খবর শোনার জন্য।”

খবর অবশ্য পেলাম। সাতটার সময় একজন পুলিশ দোকানে এসে আমাকে একটা চিরকুট দিল। সাংঘাতিক জরুরি। তাতে লেখা—‘এক্ষুনি এসে আমাকে বাঁচাও! জামিন চাই।’

হোকসকে পেলাম একেবারে বিধ্বস্ত অবস্থায়। তার খালাসির ছদ্মবেশ এতই আসলের মতো যে পুলিশ বিশ্বাসই করছে না যে সে আসল খালাসি নয়। ফরাসি হলে আমরা এতক্ষণ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কেঁদে ভাসিয়ে দিতাম।

“এ কী, হোকস, এরকম কী করে হল?”

“আমার কপালটাই খারাপ।” গোঙাতে গোঙাতে বলল সে, “জাহাজে মিসেস ব্যাগওয়ার্দি আসেইনি। তখন জাহাজ প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। লোকটা পাটাতন দিয়ে উঠছে। কিছু একটা করতে হবে, আমি লোকটাকে ধরলাম। সে সবকিছু অস্বীকার করল। আমি ওকে টানতে টানতে ডাঙায় নামালাম। বিচ্ছিরি হইচই শুরু হয়ে গেল তখন। জাহাজ ছেড়ে দিল। তখন আমরা হাতাহাতি করছি আর দুজনেই দুজনের নামে বলছি। তখন ওকে সবাই ছেড়ে দিল ওর চেহারা দেখে, কিন্তু বিশ্বাসই করতে চায় না যে আমি খালাসি নই। এখন, এখন তো আর জামিন পাব না, রাত হয়ে গেছে। তুমি এক কাজ করো চেসমোর, তুমি গিয়ে মিসেস ব্যাগওয়ার্দিকে ডেকে নিয়ে এসো। উনি বোঝালে যদি কাজ হয়।”

ওখান থেকে বেরিয়ে আমি ক্যাম্বারওয়েল গেলাম। একটা ছটফটে ঝি আমাকে ভেতরে নিয়ে গেল। গিয়ে যা দেখলাম, তা চোখে দেখেও প্রত্যয় হয় না। স্বামী-স্ত্রীর পুনর্মিলন হয়েছে। তারা হাতে হাত ধরে আগুনের সামনে বসে আছে!

“ছি ছি, এ কী করলেন আপনারা!” আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, “এখানে বসে আরাম করছেন, আর যে লোকটা আপনাকে, হ্যাঁ মশাই, আপনাকে অ্যান্টওয়ার্পের জাহাজ থেকে টেনে নামাল, পাপের পথ থেকে ফিরিয়ে আনল, সে এখন খড়ের গাদায় শুয়ে গোঙাচ্ছে!”

আমার ভাষাটা একটু খটোমটো হলেও কাজ হল কিন্তু। মিসেস ব্যাগওয়ার্দি হকচকিয়ে গিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। “কীসব বলছেন স্যার? বেচারা আর্থার বলে এইমাত্র হাসপাতাল থেকে ফিরল!”

“বটে!” আমি বললাম, “তা সে তো নিজের দোষেই হাসপাতালে গেছে। হোকসের সঙ্গে মারপিট করা তো ওর উচিত হয়নি। জাহাজ থেকে সুড়সুড় করে নেমে এলেই হত!”

“জাহাজ থেকে! কী বলছেন?” মিসেস ব্যাগওয়ার্দি স্তম্ভিত হলেন।

তারপর পুরো ব্যাপারটা শুনলাম। মিঃ ব্যাগওয়ার্দি উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলেন, আমি বসে বসে ঠান্ডা মাথায় শুনলাম, আমার জন্যও, হোকসের জন্যও। তিনি আদৌ মিঃ বুন্দেলমান নন এবং কোনোদিন ছিলেনও না। তাঁর সেই অদৃশ্য হওয়ার দিনটিতে তিনি খেয়ালই করেননি যে তাঁর স্ত্রীর সাময়িকভাবে ঘোর লেগেছে। তিনি ধীরেসুস্থেই সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে অপেক্ষা করছিলেন তাঁর স্ত্রীর জন্য। সে সময় আচমকা একটা হ্যানসম এসে তাঁকে ধাক্কা মারলে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। তক্ষুনি তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেই ধাক্কার ফলে তাঁর মাথায় এমনই চোট লেগেছিল যে তিন সপ্তাহ ধরে তাঁর যে শুধু বাকশক্তিই লোপ পেয়েছিল তাই নয়, তিনি যে কাগজে লিখে কিছু বোঝাবেন, সেটাও পারছিলেন না। এমনকি তিনি তাঁর নামঠিকানাও বলতে পারছিলেন না।

“কিন্তু আপেলের পুডিং-এর ব্যাপারটা কী?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

তিনি একটু ইতস্তত করলেন। তারপর বললেন যে আপেলের পুডিং যেহেতু তাঁর খুবই পছন্দের, তাই তিনি ওটা ডিশ থেকে তুলে একটা বড়ো খামে ভরেছিলেন, যেটা তাঁর পকেটেই ছিল, পরে খাবেন বলে। তাঁর ধারণা, ধাক্কার সময় ঝাঁকুনির চোটে তাঁর পকেট থেকে ওটা ছিটকে পড়ে রাস্তায়, পরে কোনো সহৃদয় ব্যক্তি ওটা কুড়িয়ে পেয়ে, যেহেতু খামের ওপরে আগেই নামঠিকানা এবং ডাকটিকিট মারা ছিল, ডাকবাক্সে ফেলে দেন।

“খুবই খারাপ ব্যাপার হল এটা। না না, আপনাদের জন্য নয়, আমার বন্ধুর জন্য।” আমি বললাম, “বেচারা এত খেটেখুটে প্যারাশ্যুট আর প্যান্টের বোতামের রহস্য ভেদ করল, তারপর রহস্যের কিনারা করতে করতে জার্মান ইস্টের দোকান অবধি চলে গেল, আর তার পরিণতি কিনা এই! যাই হোক, শুভ রাত্রি! আপনারা ভালো থাকুন। আমি যাই, হাজতখানায় গিয়ে ওকে সব বুঝিয়ে আসি। চললাম।”

হোকস এখনো জেলেই আছে। আশা করি সামনের সপ্তাহের শেষদিকটায় ওকে ছাড়িয়ে আনতে পারব।

জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s