নানারঙের ইতিহাস
ঝিয়ের গল্প
১৯১৬ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় রানী সুনীতিদেবীর বেঙ্গল ডেকয়েটস অ্যান্ড টাইগারস। বইটি ইংরিজি ভাষায় লেখা হয়েছিল। সুনীতিদেবী ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতা কেশবচন্দ্র সেন-এর মেয়ে। ১৮৬৪ সালে তাঁর জন্ম হয়। ১৮৭৮ সালে কুচবিহারের রাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ-এর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। শিক্ষা ও নারীর অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে সারাজীবন কাজ করেছেন রানী সুনীতিদেবী। ১৯৩২ সালে রাঁচিতে তার মৃত্যু হয়। এবারে জয়ঢাকের পাতায় তাঁর বইটির বঙ্গানুবাদ শুরু হল। প্রতি সংখ্যায় প্রকাশিত হবে একটি করে গল্প।
সেটা ছিল বাংলার জ্যৈষ্ঠ মাস, সূর্যের প্রখর তাপে খুব তেতেপুড়ে রয়েছে পৃথিবী, নীরবে বরুণদেবের কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছে, হে দেবতা, শিগগির এসো, বর্ষায় মাঠঘাট জল-জঙ্গল আবার সজীব হয়ে উঠুক।
এত গরমেও, এক আলালের ঘরের দুলালি, এক যুবতী মেয়ে পথে বেরিয়েছিল। সে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিল। কী হয়, বাংলাদেশে মেয়েদের বিয়ের পর মেয়ে তার বাপের বাড়িতেই ফেরৎ চলে আসে, মাঝে মাঝে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে দেখা সাক্ষাৎ চলতে থাকে, তারপর মেয়ে উপযুক্ত হলে শ্বশুরবাড়ি পাকাপাকিভাবে থাকতে আসে।
এটা বাঙালিদের মধ্যে একরকম রীতিই বলা যায়, বিশেষ করে অল্পবয়েসী মেয়েদের বেলায়, যে তারা যাত্রাপথে সমস্ত গয়নাগাঁটি পরে বেরোবে। বাজুবন্ধ, বালা, চুড়ি, গলার হার, নূপুর; গয়নাগাঁটি নেই মানে হয় সে বিধবা নয়তো অত্যন্ত গরিব। আমাদের মেয়েটিও গয়নাগাঁটিতে সেজে যাচ্ছিল আর তার পরণেও ছিল দামি শাড়ি জামা। সে যে ধনীর ঘরের মেয়ে! আর সে শাশুড়ির সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে না? সুতরাং তার মা তাকে নিজের হাতে সাজিয়ে দিয়েছেন সোনার পাড় দেওয়া বেনারসী সিল্ক শাড়িতে, যেমন সুন্দর তার খোল, তেমনি অপূর্ব কারুকাজ তাতে। এর সঙ্গে মানানসই উপযুক্ত গয়না মেয়েটির হাতে, গায়ে, গলায় এবং পায়ে।
বারোজন বেহারার দল পালা করে মেয়ের পালকি বইছে। এরা তার বাপের কাছে বহুদিন থেকে কাজ করছে আর বেশ বিশ্বস্ত। একটা কাজের মেয়ে, সঙ্গে চলেছে, কখনো পালকির পাশে হেঁটে হেঁটে কখনো মেয়েটির পাশে বসে তাকে হাওয়া করতে করতে, আর একঘেয়েমি কাটাতে তার মালকিনকে মাঝে মাঝে এরকম আগেকার কোনো যাওয়ার গল্প শোনাচ্ছিল। দুজন পুরুষ কাজের লোক, দারোয়ান গোছের, যাদের সঙ্গে অস্ত্র থাকে মালিকের সম্পত্তি রক্ষা করার জন্য, এই দলে সেরকম দুজনও রয়েছে। এই হল গিয়ে গোটা দলটা। দুজন দারোয়ান পালকির দুপাশে হাতে খোলা তলোয়ার নিয়ে হেঁটে চলেছে। এরা দুজন বিশ্বস্ত শুধু নয়, বহুবারই তার প্রমাণও হয়েছে, মালিকের মেয়ের প্রাণ বাঁচানোর জন্য তারা নিজেদের জীবন দিতেও প্রস্তুত।
রাস্তাটা গ্রামদেশের বেশ শুনশান অঞ্চল দিয়ে গিয়েছে, দুপাশে ধানক্ষেত, গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে কোথাও কোথাও গ্রামের ঘরবাড়ি। এরকম একটা গ্রামের কাছে দলটা দাঁড়াল একটু, খানিকটা জিরিয়ে নিয়ে, স্নানটানও সেরে আবার দিনের পড়ে আসা রোদ মাথায় বেরিয়ে পড়ল।
এমনি করে অনেকটা পথ পেরিয়ে আসা হল। সন্ধে প্রায় নামে নামে, দিনের তাপ খানিকটা ঠান্ডা হয়ে এসেছে, এমন সময় এই দলটা গাছগাছালির ফাঁকে একটু থামল, কাছেই একটা ছোটো দিঘি। পালকি-বেহারারা জায়গাটাকে বিশ্রামের একেবারে উপযুক্ত দেখে কাজের মেয়েটিকে বলল, যাতে মালকিনকে সে বলে এইখানে তারা একটু জিরিয়ে হাতমুখ ধুয়ে জলটল খেয়ে নিলে আবার আরো দ্রুত ছুটতে পারবে।
পালকির ভেতর থেকে তক্ষুনি অনুমতি মিলে গেল। গরমটা এমনিতেই অসহ্য লাগছিল মেয়েটির, সে ভাবল বেচারা পালকি-বেহারাদের তো আরো কষ্ট, একে গরম তার ওপরে তাকে শুদ্ধু পালকির ভার বওয়া।
একটা বড়ো গাছের ছায়ায় আস্তে করে পালকি নামিয়ে রাখা হল। দারোয়ানরা একটু সরে দূরে অপেক্ষা করতে থাকল যাতে কাজের মেয়েটা পালকির পর্দা সরিয়ে দিতে পারে। গাছগাছালির ভিড়ে ঠান্ডা হাওয়া আর গাছের ছায়ায় যা হোক তাদের মালকিনের একটু তো আরাম হবে।
জায়গাটা বেশ শুনশান, তাদের দায়িত্বও রয়েছে, তো লোকেরা ঠিক করল দুদলে ভাগ হয়ে যাবে। যদি কোনো বিপদ-আপদ হয়, সেজন্য ছজন পাহারায় থাকবে, বাকি ছজন হাতমুখ ধুয়ে আসবে।
কথা ঠিক হতে না হতেই ছজন খুশি হয়ে ছুটল দিঘির দিকে। বাকিরা গাছের ছায়ায় টানটান হল, হাত-পা ছাড়িয়ে নিল, আগের দল ফিরলে তারা যাবে।
দেখতে দেখতে সময় কেটে গেল হু হু করে, অপেক্ষায় থাকা লোকেদেরও বেশ তেষ্টা পেয়েছিল, হঠাৎ তাদের মনে হল, আরে আগের লোকেরা তো বড্ডো দেরি করছে। ওরা কাজের মেয়েটিকে বলল যাতে মালকিন অনুমতি দেয়, ওরা গিয়ে বাকিদের তাড়াতাড়ি করতে বলতে পারে সেইসঙ্গে ওরাও চটপট হাতমুখ ধুয়ে ফিরে আসতে পারে। সূর্য পাটে বসতে চলেছে, সন্ধ্যা হব হব, পথে নেমে পড়া দরকার, এইবেলা দেরি করলে রাত নেমে আসবে। তরুণী মালকিন অনুমতি দিলেন, বাকি ছজনও দ্রুত দিঘির দিকে অদৃশ্য হল। দেখা গেল এদেরও অনেকক্ষণ সময় লাগছে!
কাজের মেয়েটার এবারে কেমন কেমন লাগতে থাকল, কিন্তু সে তার ভয়টা চেপেই রইল। হঠাৎ সেও উধাও হল। মালকিনকে একটিও কথা না বলে ও ঠিক করেছিল বেহারারা কী করছে দিঘিতে গিয়ে সেটা একবার নিজের চোখে দেখে আসবে। ও করল কী, একটা গাছের ওপর চড়ে গুটিগুটি একটা ঝুঁকে পড়া ডালের ওপর দিয়ে এগিয়ে দিঘির দিকে উঁকি দিল আর যা দেখল তাতে তো তার চক্ষু চড়কগাছ। কয়েকজন বেহারা পাড়ের কাছে অল্প জলের মধ্যেই মরে পড়ে আছে আর বাকিরা একদল ডাকাতের সঙ্গে প্রাণ বাঁচাতে মরণপন লড়াই করছে।
মেয়েটি যত তাড়াতাড়ি পারে পালকির কাছে ফিরে এল আর কে দেখছে কি না দেখছের তোয়াক্কা না করে পালকির দরজা হাট করে খুলে দিয়ে পাগলের মতো চেঁচাতে লাগল, “ডাকাত! ডাকাত! পালাও দিদি, পালাও! আমি নিজের চোখে দেখেছি; আমি একটা গাছে চড়ে ওপর থেকে ওদের দেখতে পেয়েছি। আমাদের কয়েকজন বেহারা মরে গেছে, আর বাকিদেরও ওরা মেরে ফেলেছে এতক্ষণে। পালাও, বাঁচতে হলে পালাও।” এই বলে পিছু ফিরে ভয়ের চোটে সে দে-দৌড় দে-দৌড়।
পালকির একলা মানুষটা ভয় আর আতঙ্কে মেশানো দুঃসংবাদটা শুনল। সে এমনতরো ডাকাত আর তাদের নিষ্ঠুর কাণ্ডখারখানার গল্প প্রায়শই শুনেছে। অল্পক্ষণের জন্য তার মনে হল, সে যদি এই দুর্বৃত্তদের হাতে পড়ে – আতঙ্কে হিম হয়ে গেল সে; কিন্তু তা অল্পক্ষণের জন্যই। তার মেয়েলি অনুভবে আর উপস্থিতবুদ্ধির জোরে সে তক্ষুনি কাজে লেগে পড়ল। দ্রুত তার ভারী রত্নবসানো পায়ের নূপুরটা খুলে ফেলল মেয়েটি। অত ভারী নূপুর পায়ে দৌড়বে কীভাবে? আর ওর যা দাম তা হয়তো ডাকাতদের খুশিও করতে পারবে না। ওগুলোকে পালকির মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে মেয়ে ঝটপট পালকির দরজা বন্ধ করে দিয়ে চারপাশের পর্দা টেনে দিল। ডাকাতরা যাতে ভাবে সে ভেতরেই আছে। পালকির ভেতর খোঁজ করলে ওদের একটু তো দেরি করানো যাবে।
এইবারে দামী শাড়িটাকে একটু গুটিয়ে কোমরে গুঁজে প্রাণ বাঁচাতে সে ছুট লাগাল। কয়েক পা যেতে না যেতেই পিছনে দুই দারোয়ানের গলা শুনে দাঁড়িয়ে গেল মেয়েটি। ওরা দুজন কাজের মেয়ের চিৎকার শুনতে পেয়েছিল, ওদের একমাত্র চিন্তা ছিল মালকিনকে নিয়ে।
বাংলাদেশে বাড়ির চাকরবাকরেরা বাড়ির মেয়েদের আদর সম্ভ্রম মিশিয়ে দিদি বলেই ডেকে থাকে। বাপের বাড়িতে যে মেয়ে দিদি, বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়িতে সেইই বৌমা, আবার নিজের বাড়িতে যে ছেলে দাদা, বিয়ে হয়ে গেলে সেইই শ্বশুরবাড়ির জামাই। তো এই দারোয়ানরাও তার ব্যতিক্রম নয়, তারা দূর থেকেই ডেকে উঠল, “দিদি, ভয় পেয়ো না। যতক্ষণ এই দেহে শ্বাস আছে আমরা তোমায় রক্ষা করব। ডাকাতরা আমাদের পেরোতে গেলে আমরা তোমার ঢাল হয়ে দাঁড়াব। তোমার কোনো ক্ষতি হতে দেব না।”
ওরা এসে যাওয়াতে আর ওদের কথা শুনে বুকে বল এল, মেয়ে এবারে আরো জোরে ছুটতে শুরু করল। কিন্তু তার নরম পা, কঠিন জমিতে, শক্ত রাস্তায় চলে অভ্যস্ত নয়, তার ইচ্ছে আর সাহস থাকা সত্ত্বেও সে বারে বারে হোঁচট খেয়ে পড়তে লাগল। বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে গাঁ-দেশে রাস্তা দিয়ে চলা বেশ কঠিন। বর্ষায় গাড়ির চাকার গভীর দাগ শুকিয়ে কাদামাটি ধুলো ধুলো হয়ে পুরু হয়ে রাস্তার ওপরে এমন জমে থাকে যে পথিকের পা অবধি তাতে ডুবে যায়। যারা রোজ চলে তাদের অবধি দ্রুত চলতে কষ্ট হয়। তো আমাদের বেচারা মেয়েটি খুব বেশিদূর যেতেও পারেনি, এর মধ্যেই পেছু ধাওয়া করা ডাকাতেরা তাকে ধরে ফেলল। সে যে পালিয়েছে, সেটা বুঝতে তাদের বেশি সময় লাগেনি আর অমনি গাছতলা থেকে তারা দৌড়ে ধাওয়া করে এসেছে। মেয়ে তো ছুটতে ছুটতেই তাদের চিৎকার শুনেছে, আর তারপরেই বুঝতে পেরেছে দারোয়ানরা মুখোমুখি হয়ে ওদের আটকেছে।
বেচারা মেয়েটি এবারে একা একা দৌড়েছে প্রাণপন, দৌড়তে দৌড়তেই তার নজরে এসেছে গাছপালার মধ্যে একটা ছোট্ট বসতি। কাঁপতে কাঁপতে সে ওইদিকে যত দ্রুত সম্ভব পা চালাল আর হাঁফাতে হাঁফাতে একটা ছোট্ট লাল রঙের পাকাবাড়ির সামনে এসে পড়ল। বাড়ির দরজা আধখোলা ছিল, সে ভেতরে এসেই কাঁদতে কাঁদতে বলল, “দরজাটা বন্ধ করে দাও। ডাকাতে আমার পিছু নিয়েছে গো!” তারপরেই ভয়ে আর অতিরিক্ত উত্তেজনায় সে মেঝের ওপর ঠাস হয়ে পড়ে গেল। বাড়ির মেয়েরা মেয়েটির কান্না শুনে দৌড়ে এসে দরজাটা দ্রুত বন্ধ করে দিয়েছিল। এমন ডাকাতের কথা সর্বত্র জানাই ছিল, আর ভয়ও পেত লোক। এবারে তারা মেয়েটির শুশ্রুষায় লাগল। মেয়েটার জ্ঞান ফিরে আসতেই সে সব ঘটনা খুলে বলল, কী বিপদে পড়েছে, আর তাদের সাহায্যের অনুরোধও করল।
বাড়ির কর্তা তক্ষুনি দূরের এক পুলিশ ফাঁড়িতে লোক মারফৎ খবর পাঠালেন শিগগির সাহায্য পাঠানোর জন্য। একটু ধাতস্থ আর থিতু হলে মেয়েটি প্রার্থনা করতে থাকল যাতে ওর সহকারীরা ঠিকমতো এসে পৌঁছতে পারে।
কিছুক্ষণ পর খবর পাওয়া গেল একটা পালকি আসছে। অন্ধকারের মধ্যেও পালকির আসাটা বেহারাদের হুমহুনা হুমহুনা হুমহুনারে হুমহুনা ডাক থেকেই বোঝা যায়। শিগগিরি পালকিটা লাল পাকাবাড়িটার সামনে এসে থামল আর বেহারারা, গলা তুলে জিজ্ঞাসা করল, ভেতরে কোনো অপরিচিত মেয়ে, ভালো শাড়ি, গয়নাগাঁটি পরা, এসে ঢুকেছে কিনা! বাড়ির ওপরের একটা জানালা থেকে বাড়ির কর্তা ওদের উত্তর করছিলেন। নীচের তলায় মেয়েটি আর তার শুশ্রুষাকারী মেয়েরা ভয়ে কাঠ হয়ে শুনছিল। পালকি-বেহারা সাজা লোকগুলো এবারে বাড়ির কর্তাকে বলল, যে তারা হল গিয়ে এক ধনী লোকের চাকরবাকর, বাবুর মেয়েকে নিয়ে শ্বশুরঘরে যাচ্ছে।
“কিন্তু,” বেশ জোরে জোরে বলছিল ওরা, “আমাদের মনিবের কন্যেটি বডডো ঝামেলার এক মেয়ে। প্রত্যেকবার তাকে শ্বশুরঘরে পাঠানোর সময় সে আমাদের বডডো ভয়-ভাবনায় ফেলে আরকি। সে তো একেবারে যেতেই চায় না, আমরা বহু কষ্ট করে তাকে নিরাপদে সেখানে পৌঁছে দিই।
নীচের তলার আতঙ্কিত শ্রোতারা কথা শুনেই বুঝল এরা আর কেউ নয় সেই ডাকাতের দল, ওরা প্রাণপনে চাইছিল পুলিশ এসে পড়ুক। ভেকধারি ডাকাতেরা আরো কিছুক্ষণ প্রশ্ন চালিয়ে গেল, যদিও বাড়ির কর্তা বারবারই তাদের বলছিল, এখানে সে নেই, ভালো হয় অন্য কোথাও খোঁজখবর করলে। শেষমেষ পালকি নিয়ে তারা বিদেয় হল। পাকাবাড়ির বাসিন্দারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য নয়।
গ্রামটা তো এত্তটুকু আর ভেকধারি পালকিবেহারারা খুব শিগগিরি চারপাশ দেখেটেখে ফিরে এল। এবারে পালকিটাকে দরজার সামনে নামিয়ে তারা চেঁচিয়ে বলল, “আমরা নিশ্চিত জানি আমাদের মালকিনটি এখানেই কোথাও লুকিয়ে আছে। আমরা বুঝে ফেলেছি, ও তোদের বাড়িতেই আছে। এই রইলাম বসে, ওকে বার করে না দেওয়া অবধি যাচ্ছি না।”
এই কথাকটা শুনে বেচারা মেয়েটি, বাড়ির কর্তার পায়ের ওপর পড়ে গেল, বললে যে সে তার মেয়ের মতো; কর্তাকে ‘বাবা’ বলে ডেকে সে আরো কাতর হয়ে বলল, তাকে যেন এই ভয়ানক ডাকাতগুলোর হাতে না তুলে দেওয়া হয়। ভালো মানুষটি ওকে আশ্বস্ত করলেন, ওকে রক্ষার দায়িত্ব তার, ওনার স্ত্রী মেয়েটিকে মেঝে থেকে তুলে ধরে জড়িয়ে ধরে বললেন, ওকে ডাকাতের হাতে তুলে দেবার চেয়ে বাকিরা বরং মারা যাবে সেও ভাল।
ডাকাতদের সঙ্গে এই টানাপোড়েন চলল প্রায় মাঝরাত অবধি। এইবারে ডাকাতেরা বলল, হয় মেয়েটিকে বার করে দে নয়তো দরজা ভেঙে বাড়িতে ঢুকব। এই চরম হুঁশিয়ারিরও কোনো উত্তর দেওয়া হল না ভেতর থেকে। ডাকাতগুলো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল তারপর দরজায় দমাদ্দম ধাক্কা দিতে আরম্ভ করল।
আতঙ্কিত মেয়েটি এবারে বাড়ির কর্ত্রীকে অনুরোধ করল তার সব গয়না খুলে ওদের দিয়েথুয়ে নিষ্কৃতি পাওয়া যাক আর সবার প্রাণরক্ষাও হোক। কর্ত্রী বললেন, এতে ওই বদমাশরা সন্তুষ্ট হবে না। তারপর তিনি মেয়েটিকে আরো একবার আশ্বস্ত করলেন, যে যাইই ঘটে ঘটুক, ওঁরা ওকে প্রাণপন রক্ষা করবে।
বলতে বলতে দরজা ভেঙে পড়ল। চিৎকার করে দেবীর নামে শপথ নিতে নিতে, হুমকি ধমকি দিতে দিতে ডাকাতেরা হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল ভেতরে। কিন্তু দরজা ধাক্কাতে আর দরজা ভাঙার চক্করে তারা এত ব্যস্ত ছিল যে খেয়ালই করেনি কখন পুলিশ এসে উপস্থিত হয়েছে। পুলিশও তাদের পেছন পেছনই ঢুকে এল। ডাকাতেরা সক্কলে ধরা পড়ল; তারা তাদের অপরাধ কবুল করল, এমনকি পালকি বেহারাদের খুনের দায়ও স্বীকার করল। এবং সম্ভবত দুজন দারোয়ানেরও। তারা দুজন যে বাঘের মতো লড়াই করেছিল তাও তারা জোর দিয়েই স্বীকার গেল।
এই দুই একনিষ্ঠ ভৃত্যের শরীরদুটো পাওয়া গেল – ক্ষতবিক্ষত হয়ে রাস্তার ধারে পড়ে আছে, একান্ত অনুগত থেকে মালিকের মেয়ের সম্ভ্রম রক্ষা করে গেছে তারা। মালিক যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে এদের দাহের ব্যবস্থা করলেন।
কাজের মেয়েটিকে অকুস্থলের কাছেই পাওয়া গেল, সে একটা গাছের ডালপালার আড়ালে লুকিয়ে ছিল। সে ডাকাতদের সঙ্গে দারোয়ানদের লড়াই, তার মালকিনের পালানো, ডাকাতদের তার পিছু ধাওয়া করা, সবটাই দেখেছিল। সবাই বাড়ি ফিরে যাবার পর, কখনো অবসর সময়ে কাজের মেয়েটি মাঝে মাঝে তাদের এই অভিযানের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করত।
এই ছোটো গল্পটা আসলে একটা সত্যি ঘটনা আর এটা প্রমাণ করে বাংলাদেশে পুরোনো দিনে যাতায়াতটা কত কঠিন আর বিপদের ছিল। পালকি চড়ে যাতায়াতটা এখন অনেক জায়গাতেই অতীত। এখন সমস্ত রাজ্য রেলপথ দিয়ে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। যেখানে এখনও রেলপথ হয়ে ওঠেনি সেখানে ভালো ভালো রাস্তা হয়েছে, পুলিশি ব্যবস্থাও আরো ভালো হয়েছে ফলে যাতায়াতের পথে বিপদ আপদও কমে গেছে।
জয়ঢাকের টাইম মেশিন সব লেখা একত্রে