টাইম মেশিন-অকৃতজ্ঞ চাকর-সুনীতি দেবী-ভাষান্তর শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়-বসন্ত ২০২৩

আগের এপিসোড- ঝিয়ের গল্প্‌ ডাকাতের কবলে, প্রাণ বাঁচাল ভালুকে, অকারণে, দুই চিনা ডাকাত , পাঞ্জাবী ডাকাত

timemachinePunjabi Dacoit

বোস পদবিধারী এক ধনী জমিদার থাকতেন লখনউতে। বাংলা থেকে ওখানে গিয়ে জমিজিরেত কিনে ওখানেই ভাষা শিক্ষা আরম্ভ করেন তিনি যতদিন না হিন্দুস্থানিদের মতো উর্দু বলতে পারেন। ভদ্রলোক এতটাই স্থানীয়দের মতো হয়ে উঠলেন যে ব্যাবসার কাজে কলকাতা এলে নিজেকে মনে হত বাইরের লোক আর বাংলাতে আগন্তুক।

ওঁর স্ত্রী ছিলেন প্রতিবন্ধী আর বয়েস যত বাড়তে লাগল ওঁকে নিয়ে ভদ্রলোককে চিকিৎসা এবং ওষুধের জন্য ঘনঘন কলকাতা আসতে হত। ওঁদের একমাত্র সন্তান ওঁদের মেয়ে আর সে-ই ছিল সারা বাড়ির নয়নের মণি। বাড়ির দ্বিতীয় জনপ্রিয় প্রাণীটি ছিল রাম, একটি বাচ্চা ছেলে, যদিও সে বাড়ির চাকর তবু তাকে বাড়ির ছেলের মতোই দেখা হত আর বোস-কর্তাগিন্নি দুজনেই ওকে বেশ পছন্দ করতেন।

যখন সে আরও ছোটো, রামকে বোসবাবুর কাছারিতে কাজে নেওয়া হয়েছিল। বাপ-মা মরা ছেলে, চটপটে আর বুদ্ধিমান, ফলে জমিদার পিতৃস্নেহে ছেলেটাকে পালন করতে লাগলেন, তাকে পড়তে লিখতে শেখালেন। মাস্টারমশাইরাও রামের বুদ্ধির তারিফ করত, ফলে মালিকের প্রশ্রয়ে তাকে একের পর এক বিষয় শেখানো হতে লাগল। ক্রমে সে যখন যথেষ্ট বড়ো হল, তাকে আরও শিক্ষিত ও ওয়াকিবহাল করে তোলা হল, বিশেষত জমিদারির কাজকর্মে। লেখাপড়ার শেষে তাকে বিশেষ আস্থাভাজন কেরানি ও ক্যাশিয়ার হিসেবে নিয়োগ করা হল এবং ক্রমে জমিদার নিজে যতটা জানতেন, বোসবাবুর টাকাপয়সার যাবতীয় ব্যাপার সেও ততটাই জেনে গেল। এহেন ধনীবাবুটি যখনই তাঁর জমিদারিতে যেতেন, রাম সঙ্গে যেত। আদায়ের সময় অফিসে টাকাকড়ি রামই গুনেগেঁথে ক্যাশ বাক্স-বন্দি করত। প্রায়ই তার হাত দিয়ে হাজার হাজার টাকার আদানপ্রদান হত, ফলে সে জানত কখন কোন মুহূর্তে ক্যাশ বাক্সে কত টাকা আছে।

একবার কোনও বছরে বোসবাবু তাঁর বিশ্বস্ত রামকে নিয়ে জমিদারি পরিদর্শনে গেছেন খাজনা আদায়ের জন্য। অনেকেরই অনেকদিনের খাজনা বকেয়া ছিল, তারা অনেকেই স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি টাকাপয়সা সঙ্গে এনেছিল। সেসবই ক্যাশ বাক্সে বন্ধ করে রামের সামনেই বোসবাবু গিন্নিকে ডেকে বললেন পরদিন টাকাটা উনি ব্যাঙ্কে জমা করে দেবেন। ক্যাশ বাক্সটা রোজ রাতে জমিদারের খাটের পাশে টেবিলের ওপরে রাখা হত।

বোসবাবু লখনউয়ের বাড়িটা পেল্লায় আর সবসময় ভর্তি কেননা বোসগিন্নি লোকজন ভালোবাসেন বলে বাড়ি জুড়ে আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব লেগেই থাকত। কর্তা-গিন্নি ওপরে দক্ষিণের একখানা বড়ো ঘরে শুতেন। সেখানা আবার লাগোয়া একটা বড়ো ঘরের সঙ্গে। দরজাটা সেদিকেই খুলত। শোবার ঘরে আসবাব বলতে দুটি খাট আর তার মাঝে একখানা টেবিল, ক্যাশ বাক্স ও লন্ঠন রাখার জন্য।

জমিদার যেদিন ফিরলেন, জমিদারগিন্নির সে-রাতে ঘুম আসছিল না। তিনি অসুস্থ ছিলেন, রাত জেগে প্রহর গুনছিলেন। লন্ঠনের আলোয় ঘুমন্ত জমিদারের অবয়ব, খাটের মাথার কাছে দেয়ালে ঝোলা খোলা তলোয়ার আর ঘরের সাদা চুনকাম করা ফাঁকা দেয়াল দেখা যাচ্ছিল। বোসগিন্নি বিছানাতে জেগেই ছিলেন, পাশের লাগোয়া ঘরের দরজায় একটা আওয়াজ শুনলেন। শব্দটা ফের হতেই তিনি উৎকর্ণ হলেন। কেউ দরজাটা খুলল আর বন্ধ করল। বোসগিন্নি স্থির হয়ে আবারও শুনতে লাগলেন, খেয়াল করতে থাকলেন। আবার কেউ দরজাটা খুলল এবং বন্ধ করল, তারপর আবার, বার বার। গিন্নি বুঝে গেলেন কাজটা করা হচ্ছে ভেতরের লোকেরা ঘুমিয়ে পড়েছে কি না সেটা নিশ্চিত হবার জন্যে। তিনি একেবারে কাঠ হয়ে পড়ে রইলেন।

এইবারে দরজাটা হাট হয়ে খুলল আর রাম এসে ঘরে ঢুকল এবং আলতো করে দরজা বন্ধ করল। বোসগিন্নি ওকে ঢুকতে দেখে প্রথমেই যা ভাবলেন তা হল, নির্ঘাত কোনও খারাপ খবর নিয়ে এসেছে আর তিনি প্রায় জিজ্ঞাসা করেই ফেলছিলেন, কী ব্যাপার। কিন্তু ওর চোরের মতো চুপিচুপি আসাতে গিন্নি ঘুমের ভান করে দেখছিলেন আর ভাবছিলেন, দেখাই যাক। ও বিছানার দিকে পা টিপে টিপে এগোতে গিন্নিমা চোখ বন্ধ করে রইলেন যেন সত্যি-সত্যিই ঘুমোচ্ছেন। রাম বিছানার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল, ওঁকেই দেখছিল সম্ভবত। গিন্নিমার ভয় ভয় করছিল। সমস্ত শক্তি আর মনের জোর একত্র করে তিনি চোখ বুজেই রইলেন এবং চেষ্টা করলেন যাতে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক থাকে। যখন মনে হচ্ছিল, আর তিনি পারবেন না, ক্ষমতার সীমায় পৌঁছে গেছেন, তখনই রাম তার বিছানার পাশ থেকে সরে গেল।

চোখের পাতার ফাঁক দিয়ে তিনি দেখলেন রাম গুটিশুটি নিঃশব্দে টেবিলের কাছে পৌঁছেছে এবং ক্যাশ বাক্সটা নেড়েচেড়ে দেখছে। তারপর সে আবার গিন্নিমার বিছানার পাশে এসে কাশল। গিন্নিমা আবারও চুপ করে ঘুমের ভান করে স্থির হয়ে রইলেন। এবারে সে ঘুরে মনিবের বিছানার কাছে গেল। এখানে সে খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়াল, তারপর দেওয়াল থেকে তলোয়ারটা নামাল। জমিদার গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন দেখে তলোয়ারটা খুলতে খুলতে রাম মুচকি হাসল যেন সবই ঠিকঠাক আছে। সে ডানহাতে তলোয়ার বাগিয়ে একবার চালিয়ে দেখে নিল। তারপর ঠোঁটে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে জমিদারের মশারিটা বাঁহাতে তুলে ধরল।

গিন্নিমা পরিষ্কার বুঝে গিয়েছিলেন, ওর উদ্দেশ্য খুন করে টাকাপয়সা হাতানো, ফলে এবারে তিনি হঠাৎ চিল-চিৎকার করে উঠলেন সাহায্যের জন্যে। তার গলার প্রথম চিৎকারের চোটেই রাম তলোয়ার ফেলে ঘর থেকে পালিয়ে গেল। গিন্নিমার গলা ফাটিয়ে চিৎকার, ‘খুন খুন! বাঁচাও!’ শুনে জমিদারের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল আর যতক্ষণে তিনি ধাতস্থ হয়ে সবটা বুঝতে পারলেন ততক্ষণে রাম বাড়ি ছেড়ে পগারপার।

সকাল হলে পুলিশে খবর দেওয়া হল, জমিদার রামকে ধরার জন্য মোটা টাকা পুরস্কার ঘোষণা করলেন। পুলিশ লখনউয়ে এবং তার আশেপাশে খুঁজল, রামের আত্মীয়স্বজন যে গ্রামে থাকে সেখানেও খোঁজ করল, কিন্তু কেউই রামের ব্যাপারে কিছু জানত না আর তারপর তার কথা আর কখনও লখনউতে শোনা যায়নি।

বেশ কয়েক বছর বাদে বৃদ্ধ জমিদার মারা গেলেন এবং তাঁর শেষ কথা ছিল এরকম—‘আমি জানতে চেয়েছিলাম বেচারা রামটার কী হল!’

অনাথ বাচ্চা ছেলেটার প্রতি স্নেহ তিনি ভুলতে পারেননি কখনও আর প্রকৃতপক্ষে ওর বিশ্বাসঘাতকতাও তিনি ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।

জয়ঢাকের টাইম মেশিন সব লেখা একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s