রাত হয়ে গেছে বলে লাইব্রেরিয়ান আমাকে তাড়া দিলেন। এতক্ষণ বইয়ের মধ্যে ডুবে ছিলাম বলে খেয়াল করিনি যে রাত সাড়ে ন’টা বেজে গেছে। লাইব্রেরি অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। সবাই যে যার মতো কাজ শেষ করে চলেও গেছে। আমার স্পেশাল পারমিশন ছিল বলেই এতক্ষণ লাইব্রেরিতে ছিলাম। যাইহোক, বেরিয়ে মেট্রো স্টেশনের দিকে দৌড় দিলাম। কাছেই রবীন্দ্র সরোবর স্টেশন। এখানে এমনিতেই কম লোক ওঠানামা করে। এখন শীতকাল বলে মনে হয় আরও কম। লাস্ট ট্রেনটা মনে হচ্ছে পেয়ে যাব। প্ল্যাটফর্ম পুরো ফাঁকা। বড় বড় ঝোলানো টিভিগুলো সারাদিন চলার পর এখন বন্ধ। চারদিক চুপচাপ। ট্রেন এলো ঠিক সময়েই।
উঠলাম। আজ ট্রেনটা যেন একটু বেশিই ফাঁকা। ট্রেন ছাড়ল। ট্রেনের ভেতর যদ্দুর চোখ গেল, দেখলাম যাত্রী বলতে আমি আর একজন মেয়ে। বয়স বেশি না, বছর তিরিশ মতন। বেশ ফর্সা, গায়ে কালো শাড়ি, কালো ব্লাউজ। একটু দূরে একটা বগিতে ছিল ও। আমাকে দেখে উঠে এল আমার কাছে।
“বসতে পারি এখানে?”
“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।”
“জানো তো, আজ আমাদেরই বয়সী একটা মেয়ে সুইসাইড করেছে মেট্রোতে!”
“ওহ!”
“আমার না এসবে ভয় লাগে। তাই তোমার পাশে চলে এলাম।”
ট্রেন চলছে। পরের স্টেশনেও কেউ উঠল না।
“কোথায় নামবে তুমি?”
“গড়িয়া। কবি নজরুল। তুমি?”
“আমি গীতাঞ্জলী স্টেশনে নামব।”
“আচ্ছা।”
টুকটাক কথা হল। মেয়েটা টিভি সিরিয়ালে অ্যাকটিং করে। ছোটখাটো রোলে। আমি টিভি বেশি দেখি না তাই চিনতে পারলাম না হয়তো। ও বলল ওদের কত স্ট্রাগল করতে হয়। আমি বললাম
“দেখো শিগগিরই তোমার স্ট্রাগল শেষ হবে, তোমার নামও সবাই জানবে।”
“তাই যেন হয়…”
কথা বলতে বলতে কখন যে ওর স্টপ চলে এসেছে, খেয়াল করিনি দুজনেই। অ্যানাউন্সমেন্ট শুনে উঠে পড়ল।
নামার সময় আমার কী মনে হল, বললাম, “আমার নাম ক্ষিতিকা, তোমার নামটা তো জানা হল না।”
ও নামতে নামতে পেছন ফিরে একটু হেসে বলল, “আমার নাম ঠিক জেনে যাবে; একটু আগেই তো তুমি বললে সবাই আমার নাম জানবে শিগগিরই।”
আমি একটু হাসলাম।
ট্রেনের দরজা বন্ধ হয়ে গেল, ও দেখলাম কিছু একটা বলল, কিন্তু ট্রেন ততক্ষণে চলতে শুরু করে দিয়েছে বলে আর শুনতে পেলাম না।
পরদিন সকালে, চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কাগজ পড়ছি। চার নম্বর পাতায় তলার দিকে একটা ছোট্ট কলামে হঠাৎ নজরটা আটকে গেল। দেখলাম
‘আবার মেট্রোতে আত্মহত্যা!’
গতকাল রাত সাড়ে আটটায় টালিগঞ্জ স্টেশনে ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন আনুমানিক তিরিশ বছরের এক তরুণী। এই দুর্ঘটনায় মেট্রো পরিষেবা প্রার চল্লিশ মিনিট বিঘ্নিত হয়। সঙ্গের পরিচয়পত্র থেকে নাম জানা গেছে কুহেলিকা ধর। পরনে ছিল কালো শাড়ি আর ব্লাউজ। আত্মহত্যার সঠিক কারণ জানা যায়নি। পরিবারের লোকজনের কাছ থেকে অনুসন্ধানে জানা গেছে যে কয়েকটি টিভি সিরিয়ালে কাজ করার পর সেরকম সাফল্য ও জনপ্রিয়তা না পেয়ে তরুণীটি সম্প্রতি মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন।’
খুব ভালো ক্ষিতিকা। তোমার রচনা প্রান্তিকের মাধ্যমে পাই। আরো ভালো লেখা।
LikeLike