স্কুলে অন্য কারও কথা ফেললেও ফেলতে পারি, কিন্তু হেড-স্যারের কথা কখনোই ফেলতে পারি না। সেই হেড-স্যারই সেদিন আমার কাছে দড়াম করে একটা বিকট অনুরোধ করে বসলেন। বললেন, ‘‘পরিমিতি, আজ তুমি একটু ক্লাস টেনের সেভেনথ পিরিয়ডটা নিও। অঙ্ক ক্লাস। আজ তনয়-স্যার একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাবেন। তোমার তো ফ্রি পিরিয়ড।”
এটা আবার কেমন আবদার! অঙ্ক ক্লাস নেব আমি! ওহ্, আপনাদের তো আমার পরিচয়টাই দেওয়া হয়নি। আমি পরিমিতি সেনগুপ্ত। আমার বাবা প্রোজ্জ্বল সেনগুপ্ত ছিলেন তাঁর সময়ের নামকরা অঙ্কের শিক্ষক। তাই নিছকই শখ করে মেয়ের নাম রেখে বসলেন পরিমিতি। তখন তো আর বোঝেননি অঙ্ক নিয়েই মেয়ে তাঁর মুখ ডোবাবে। বাবা ভেবেছিলেন আমাকে বিশাল বড়ো অঙ্কের স্কলার তৈরি করবেন। কিন্তু আমি বাবার স্বপ্ন ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছি। আমি এখন বিদ্যাভূষণ বিদ্যালয়ে ইতিহাস পড়াই।
যাই হোক, আমি তো হেড-স্যারের দিকে অদ্ভুতভাবে তাকালাম। আমতা আমতা করে বললাম, “স-স্যার, ম-মানে যদি অন্য কোনও ক্লাস দিতেন তা-তাহলে আমি নিতাম, কিন্তু অঙ্ক? সত্যি বলব স্যার, অঙ্ক আমি পারি না। ওরা যদি কোনও অসুবিধা নিয়ে আসে, তাহলে আমি কী করে সাহায্য করব বলুন?”
হেড-স্যার বললেন, ‘‘তাতে কী হয়েছে? তুমি শুধু ওদের কাছে বসো। ওদের বলো ওদের যা কাজ বাকি আছে সেগুলো যেন শেষ করে নেয়। তুমি দেখো কেউ যেন দুষ্টুমি না করে।”
হেড-স্যারের কথা অমান্য করতে না পেরে অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঘাড়টা একদিকে কাত করে বললাম, “আচ্ছা স্যার।”
এরপর থেকে একটা ক্লাসেও আমি মনোযোগ দিয়ে পড়াতে পারলাম না। ছাত্রছাত্রীগুলোকে একটু করে কাজ দিয়ে অঙ্কের বিভিন্ন ফর্মুলা মনে করার চেষ্টা করছি। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে তাহলে কী উত্তর দেব? একবছরও হয়নি আমি এই স্কুলে এসেছি। তাতেই স্কুলে আমার রেপুটেশন অনেক ভালো। আমার শান্ত স্বভাবের জন্য প্রত্যেকটা স্টুডেন্ট এবং টিচার আমাকে ভালোবাসে।
আমার অন্যমনস্কতাকে লক্ষ করে একটা মেয়ে বলল, ‘‘ম্যাম, কী হয়েছে আপনার? আপনাকে আজ অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে!”
আমি ওকে বললাম, ‘‘কই, না তো!” ওর কাছে গিয়ে বললাম, ‘‘একটা কথা বল তো, রেক্ট্যাঙ্গেলের পেরিমিটারের ফর্মুলাটা কী রে?”
মেয়েটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘ও, এ তো খুব সোজা। টু ইনটু লেনথ প্লাস ব্রেদ। কিন্তু এই হিস্ট্রি ক্লাসে আপনি আমাকে অঙ্কের ফর্মুলা জিজ্ঞেস করছেন কেন?”
মেয়েটার সামনে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গেল। ও হয়তো ভাবল এই ধেড়ে ম্যাডামটা পেরিমিটারের ফর্মুলা জানে না অথচ নাম আবার পরিমিতি। ছোটবেলায় আমার বন্ধুরা এমনকি টিচারাও ঠাট্টা করে বলতেন, ‘তোর বাবা শখ করে তোর নাম রেখেছিলেন বটে। সেই নামের মিনিমাম মর্যাদাটুকু রাখলি না? চল্লিশের বেশি তো পাস না। বার্থ সার্টিফিকেট এনে নামটা পালটে নে।’
আমার অঙ্কের কীর্তিকলাপ দেখে বাবা খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। একদিন তো দুঃখ করে বলেও ছিলেন আমার মাকে, “ওগো সুনন্দা, মেয়ের নামটা সত্যিই পালটাতে হবে। এমন অঙ্কে দিগগজ মেয়ে যে রাস্তায় বেরোলেই ওর নাম নিয়ে সবাই ঠাট্টা করে। ভস্মে ঘি ঢাললাম গো।”
মা তখন বলেছিলেন, ‘‘কেন গো, একটা বিষয়ে খারাপ বলে আমার মেয়েকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য কেন করছ? ও তো বাকি বিষয়গুলোতে নব্বইয়ের উপর পায়।”
কথাটা ঘুরিয়ে মেয়েটাকে বললাম, ‘‘আরে এমনি হঠাৎ করে মাথায় পেরিমিটারের কথা চলে এল তাই। ও কিছু না। যেটুকু পড়ালাম আজ, সেটুকু পড়ে বল কোনও সমস্যা আছে কি না।”
অবশেষে সিক্সথ পিরিয়ড শেষ হয়ে সেভেনথ পিরিয়ড শুরু হওয়ার ঘণ্টা বাজল। আমার বুক ধড়ফড় করছে। টিচার্স রুম থেকে কয়েকটা খাতা নিয়ে ক্লাস টেনের দিকে এগোলাম। মনে হল ছোটবেলার মতো আবার যুদ্ধক্ষেত্রে যাচ্ছি। কেন বাবা আবার এই শাস্তি? ক্লাস টেনের গণ্ডি পার হওয়ার পরেই তো অঙ্কের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছিলাম। আবার সেই দুঃস্বপ্নের অঙ্কমুখো হতে হবে ভেবেই কেমন লাগছে। এতদিন বন্ধুবান্ধব এবং টিচারদের কাছে অঙ্কের জন্য ফেসলস হয়েছে। আজ কি তাহলে স্টুডেন্টদের সামনেও তাই হবে? কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে তো কিচ্ছুটি বলতে পারব না। কেন রে অঙ্ক, তোর কোন পাকাধানে মই দিয়েছিলাম আমি? তোকে তো অন্যান্য বিষয়গুলোর মতো বন্ধু করতে চেয়েছিলাম। কত প্র্যাকটিস করতাম তোকে। তুইই তো মাথায় ঢুকতিস না। আমার বন্ধু হতিস না, আমার কী দোষ?
এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ক্লাসে ঢুকলাম। সবাই সমবেত সংগীতে বলল, ‘‘গুড আফটারনুন ম্যাম।”
“গুড আফটারনুন। প্লিজ টেক ইওর সিট স্টুডেন্টস।” একটু ভয়ে ভয়েই আমি বললাম। স্টুডেন্টগুলোর সম্মান, শ্রদ্ধা, ভক্তি উথলে পড়ছে।
একটু পরেই টের পাবে ম্যাডাম অঙ্কের দিকপাল। বললাম, ‘‘স্টুডেন্টস, তোমাদের যা পেন্ডিং কাজ পড়ে আছে অঙ্কের সেগুলো করো। কেই কাউকে ডিস্টার্ব কোরো না। আমার কিছু টেস্ট কপি দেখা বাকি আছে সেগুলো আমি দেখব। তোমরা নিজের কাজ করো।”
সবাইকে কাজ করতে বসিয়ে আমি নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ক্লাসে শুধু ফার্স্ট বেঞ্চে বসা ক্লাসের ফার্স্ট বয় সুস্মিত বসে বসে অঙ্ক করছে। বাকিগুলোর মধ্যে কেউ কেউ গল্পে মত্ত। কেউ কেউ পেপার ছিঁড়ে খেলা করছে, কেউ কেউ কাটাকুটি খেলছে আবার কেউ কেউ একটা লাইন লিখে বসে আছে। ক’দিন পর বোর্ডস দেবে, কারও হুঁশ আছে? সুস্মিতের উপরেই আমাদের সব টিচারের আশা। আরও দু-তিনটে আছে, তবে আজ সেগুলো আসেনি স্কুলে।
মন দিয়ে বসে ছেলেটা অঙ্ক করছে দেখেও ভালো লাগে। আমারও ইচ্ছা ছিল সকলে আমার দিকে তাকিয়ে বলুক, বাব্বা, মেয়েটা কী সুন্দর অঙ্ক করে। সে আর হল কই? স্কুলে অঙ্ক ক্লাসের দিনগুলো আবার মনে পড়ছে খুব। একটা অঙ্ক নিয়ে বসে থাকতাম তো বসেই থাকতাম। মিলত আর না। অনেক পরিশ্রম করেছিলাম। কিন্তু ওই যে অঙ্কের আমার সঙ্গে সাত জন্মের শত্রুতা। কিছুতেই বন্ধু আমার হল না।
“ম্যাম, ও ম্যাম!” সুস্মিত ডাকল।
আমি এইসব ভাবতে ভাবতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম। সুস্মিতের ডাক শুনে নড়েচড়ে বসলাম।
“হ্যাঁ বলো, কী হয়েছে? কোনও সমস্যা?” আমি বললাম।
“হ্যাঁ, ম্যাম। ত্রিকোণমিতির একটা অঙ্ক কিছুতেই মেলাতে পারছি না। কোন ফর্মুলায় করব বুঝে উঠতে পারছি না। আপনি যদি একটু…”
এই কেলো করেছে রে! কাকে দিল রাজার পাট? এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম। সম্মানহানি হয়ে যাবে এবার। আমি বললাম, “দেখো সুস্মিত, তোমাদের সিলেবাস তো ঠিক আমি জানি না। কাল তনয়-স্যার এলে না-হয় ওঁকেই জিজ্ঞেস করো।”
সুস্মিত বলল, ‘‘ম্যাম, আপনি একবার দেখে নিন না। আমি অনেকভাবেই করে দেখার চেষ্টা করলাম, মিলছে না।”
আমি খাতাটা নিজের দিকে ঘুরিয়েই থমকে গেলাম। বাপ রে, কী বাজে দেখতে অঙ্কটাকে! খুব খটমট! সুস্মিত দু-লাইন করেছে। আমি ওর পেনটা নিলাম। পেনটা এদিক সেদিক নাড়িয়ে চিবোতে যাব অমনি মনে পড়ল এটা আমার পেন নয়। হঠাৎ কী যেন হল! আমার হাতটা খাতাটার উপর চলে গেল। দিলাম ওই ফর্মুলা বসিয়ে ‘জয় মা’ বলে। তরতর করে করে দিলাম। নিজেও জানি না কী করলাম। ও মা, অবাক কাণ্ড! অঙ্কটা মিলে গেছে!
সেটা বুঝে ওঠার আগেই সুস্মিত চেঁচিয়ে উঠল, ‘‘ম্যাম, মিলে গেছে। মিলে গেছে। এইতো আপনি পারলেন! কী ভালো অঙ্ক করেন আপনি! এত ভেবেও পারছিলাম না আমি।”
অনেক পরে ব্যাপারটা বুঝলাম আমি। এতদিন পর একটা অঙ্ক মিলেছে আমার হাতে। মনটা খুশিতে পাগল হয়ে গেল। সুস্মিতের দিকে হেসে তাকালাম। ও সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে, ‘‘দ্যাখ, ম্যাম আমার অঙ্কটা মিলিয়ে দিল।”
কী করে পারলাম আমি? আমার পারার তো কথা নয়। স্কুলে বড়োজোর দু-তিনটে ত্রিকোণমিতির অঙ্ক করতে পারতাম কুড়িটার মধ্যে।
হঠাৎ বেল পড়ে গেল। আমি খাতাগুলো নিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে ভাবতে লাগলাম অঙ্ক কি তাহলে একদিনের জন্য আমার বন্ধু হল? বন্ধুদের সামনে কিংবা টিচারদের সামনে আমার প্রেস্টিজ না বাঁচাক, আমার স্টুডেন্টদের সামনে তো আমার প্রেস্টিজ বাঁচাল। এটাই তো আমার সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি। হয়তো কোথাও অঙ্কের জন্য মনে জায়গা আছে বলেই অঙ্কটা পারলাম। আচ্ছা, অঙ্ক কি আমার বন্ধু হতে চাইত? আমারই প্র্যাকটিসের ঘাটতি ছিল? কে জানে? কিন্তু আজ থেকে অঙ্ককে কখনও শত্রু বলব না। ‘অঙ্ক, আজ থেকে তুই আমার বন্ধু হলি।’ বলতে বলতে টিচার্স রুমের দিকে এগোলাম।