কৌশানীর আগের গল্প-বন্ধু ভূত
আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগের কথা। তখন আমার ক্লাস ফোর। প্রতিবছর পুজোয় আমরা ব্যাগ কাঁধে একটা লম্বা সফরে বেরিয়ে পড়ি। সেইবার গিয়েছিলাম হিমাচল। আমরা কিন্তু একা নই, সঙ্গে ছিল আরও একটা পরিবার। ওঁদের সঙ্গে আমরা আগেও অনেক জায়গা ঘুরেছি, খুবই ভালো সম্পর্ক। তাই বেড়াতে গেলে আমরা আর দুটো নয়, একটা বড়ো পরিবারই হয়ে যাই।
পঞ্চমীর রাত্রে হাওড়া থেকে ট্রেনে চেপে শুরু হয়েছিল আমাদের সফর। পৌঁছতে তো প্রায় দু-দিন। কিন্তু ঠাট্টায়, আড্ডায় আর উত্তেজনায় সময়গুলো বেশ দ্রুতই কেটে গেল। আমরা বেড়াতে গেলে আগে থেকে রুম বুক করি না, স্পটে গিয়ে করি। কিন্তু সিমলায় আমরা অনেক রাত্রে পৌঁছব বলে রুমটা আগে থেকেই বুক করে রেখেছিলাম। আর বাবার এক বন্ধুর মারফত একজন ড্রাইভারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল। ঠিক হয়েছিল উনি আমাদের সমস্ত জায়গাগুলো ঘুরিয়ে দেখাবেন। সেইমতো উনি আমাদের একটা লিস্টও বানিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানে যেমন পপুলার স্পটগুলো ছিল তেমনই ছিল কিছু আনকোরা জায়গার নাম। লোকে সেখানে খুব একটা বেড়াতে যায় না। তবে যারা যায় তারা প্রকৃতিকে আরও কাছ থেকে দেখার সুযোগ পায়। লিস্টটা বাবা-জেঠুর দুজনেরই খুব পছন্দ হয়েছিল। আমাদের ড্রাইভারের নাম ছিল গুরুচরণ সিং। পুরো ট্যুরে আমরা সবাই ওঁকে সিংজি বলেই ডেকেছি।
কালকা স্টেশনে ট্রেন ঢুকতে তখন আর বেশি বাকি নেই। অনেক লাগেজ, তার ওপর নতুন জায়গা। সিংজি বলেছেন উনি আগে থেকেই স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকবেন যাতে আমাদের কোনও অসুবিধায় না পড়তে হয়। তাই বাবা ট্রেন ঢোকার কিছুক্ষণ আগেই ফোন করে দিল।
স্টেশনে ট্রেন থামতেই দেখি একজন মোটোসোটা চেহারার লোক পাকানো গোঁফ, মাথায় পাগড়ি, পরনে গাঢ় নীল পাজামা-পাঞ্জাবি পরে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। উনিই গুরচরণ সিং। বাবা-জেঠুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে উনি আমাদের ভারী লাগেজগুলো নামাতে সাহায্য করলেন। আমরা সবাই ট্রেন থেকে নামার পর উনি হাসি মুখে আমাদের বাকি সকলের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করলেন। উনি হিন্দিতে কথা বললেও আমাদের কারোরই সেরকম বুঝতে অসুবিধা হয়নি। এরপর কথা বলতে বলতে আমরা স্টেশনের বাইরে সিংজির গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। বড়ো একটা সুমো। সন্ধ্যা তখন নেমে গেছে, আমরা তাড়াতাড়ি করে গাড়িতে চড়ে বলসাম। শুরু হল আমাদের সিমলা ভ্রমণ। আমি বাবার সঙ্গে গাড়ির একদম সামনের সিটে সিংজির পাশে বসলাম।
যেতে যেতে শুনলাম সিমলা পৌঁছতে ঘণ্টা দুয়েক লাগবে, সেখান থেকে আমাদের হোটেল যেতে আরও কিছুক্ষণ। ঘড়ির কাঁটা ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারও ধেয়ে আসছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শীতের প্রকোপও। তাই সেভাবে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। শুধু বুঝতে পারছিলাম, আমাদের গাড়িটা যে রাস্তা দিয়ে চলছে তার পাশেই রয়েছে গভীর খাত। একটু অসাবধান হলেই আর রক্ষে থাকবে না। কিন্তু আমার এই ব্যাপারে সেরকম কোনও দুশ্চিন্তা ছিল না। কারণ, গাড়িতে বসে বাবা-জেঠুর সঙ্গে সিংজির নানান ব্যাপারে কথাবার্তা চলছিল। তখনই উনি কোনও একটা প্রসঙ্গে বললেন, প্রায় সতেরো-আঠারো বছর ধরে পাহাড়ি এলাকায় গাড়ি চালাচ্ছেন। তাই এখন নাকি উনি চোখ বন্ধ করেও গাড়ি চালাতে পারেন!
এতক্ষণ যাও-বা একটু আধটু আলো দেখতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু তারপর আর সেটাও পেলাম না। চারদিকে কুপকুপে অন্ধকার। কৌতূহলের বশে এর কারণ জানতে চাইলাম সিংজির কাছে। উনি হেসে বললেন যে ওখানকার লোকেরা সবাই খুব তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে। আবার ওদের ঘুমও ভাঙে খুব জলদি। সূর্য ওঠার আগেই ওরা উঠে পড়ে যে যার কাজে লেগে যায়।
এসব আরও নানান কথা শুনতে শুনতে আমারা হোটেলের সামনে এসে পৌঁছলাম। তখন প্রায় মাঝরাত। শুনশান রাস্তাঘাট, অন্ধকার যেন গ্রাস করছে।
বাবা, জেঠু আর সিংজি হোটেলের ভিতর গিয়ে ঢুকল। সবকিছু একবার দেখে নিয়ে তারপর আমাদের নিয়ে যাবে। আমরা গাড়িতেই বসে রইলাম। এরপর প্রায় বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। তাও ওদের দেখা নেই। মা-জেঠিমাকে এবার একটু চিন্তিতই লাগছিল।
ঠিক তখনই ওঁদের তিনজনকে দেখতে পেলাম। ওঁদের মুখগুলো দেখে আমার খুব খটকা লাগল। বাবা যখন খুব রেগে যায় তখন বাবার মুখটা ওরকম হয়ে যায়। কাছে আসতেই ঠাম্মা জানতে চাইল এত দেরি করার কারণ কী। জেঠু ভীষণ গম্ভীরভাবে বলল, “ওরা বলছে আমাদের নামে নাকি কোনও বুকিং নেই।”
বুঝতে বাকি রইল না ওরা মিথ্যা কথা বলছে। আসলে আমাদের আগেই টাকা দেওয়া হয়ে গেছিল। সেই সঙ্গে পাকাপাকি কথাও হয়ে গেছিল। যদিও সব ঘটনা শোনার পর আমাদের কারও মুখেই কোনও কথা সরল না।
ঠিক এমন সময়ই সিংজি বলে উঠলেন, “এত রাতে এরকম নির্জন জায়গায় হোটেল পাওয়া খুব মুশকিলের ব্যাপার। আমার বাড়ি এখান থেকে তো বেশি দূরে নয়। যদি আপনাদের অসুবিধা না থাকে তাহলে আজকের রাতটা আমার বাড়িতে গিয়েই কাটাতে পারেন।”
আর কোনও উপায় না থাকায় অতঃপর আমরা রাজি হয়ে গেলাম। উনি গাড়ি স্টার্ট দিলেন। মিনিট পনেরো পর ওঁর বাড়ির সামনে গাড়ি থামল।
সত্যি কথা বলতে সেদিন আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। খালি মনে হচ্ছিল, শেষকালে একজন ড্রাইভারের বাড়ি গিয়ে থাকতে হবে! সেই বাড়ি হবেই-বা কীরকম? নিশ্চয়ই আমাদের সবাইকে একটা ঘরের মধ্যে ঘেঁষাঘেঁষি করে শুতে হবে।
গিয়ে দেখলাম সিংজির দোতলা একখানা বাড়ি। পাহাড়ি এলাকার বাড়িগুলো যেমন হয় ঠিক তেমনই। আশেপাশে কয়েকটা ঝাউগাছ আছে বটে, কিন্তু রাতের অন্ধকারে তা ঠিক ভূতের মতো দেখাচ্ছে। গাড়ির হেড লাইটটা জ্বালিয়ে সমস্ত লাগেজগুলো নিয়ে আমরা বাড়িটার ভিতর ঢুকলাম। নীচের তলায় অবশ্য কোনও থাকবার জায়গা নেই, ওখানে গাড়ি রাখা হয়। সিঁড়ি বেয়ে আমরা উপরে উঠে এলাম।
চারটে ঘর। যার মধ্যে দুটো বেডরুম, একটা বৈঠকখানা আর একটা রান্নাঘর। অল্প জিনিসপত্র তাও খুব সুন্দর করে গোছানো। টেবিলে কয়েকটা বইও দেখতে পেলাম। সযত্নে রাখা একটা গিটারও চোখে পড়ল। পরে জেনেছি, ওটা ওঁর মেয়ে বাজাত। একটা দুর্ঘটনায় সে কয়েক বছর আগে মারা গেছে। শুনে কষ্ট হয়েছিল খুব। কিন্তু সেদিন আর বেশি কিছু দেখতে পারলাম না। বড়োরা খুব তাড়া দিচ্ছিল তাড়াতাড়ি করে হাতমুখ ধুয়ে ঘুমিয়ে পড়ার জন্য। বলা বাহুল্য, খাবার আমরা গাড়িতেই খেয়ে নিয়েছিলাম।
যাতে আমাদের শুতে কোনও অসুবিধা না হয়, সিংজি নতুন চাদর, বালিশ কভার সব দিয়ে দিলেন। সঙ্গে ওঁর সদ্য কেনা কম্বলটাও। আর বলে গেলেন, যদি আমাদের কোনোরকম অসুবিধা হয় তাহলে যেন তৎক্ষণাৎ আমরা ওঁকে জানাই। এই বলে উনি সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন।
সেদিন খুব জানতে ইচ্ছা করছিল, সিংজি শোবেন কোথায়। কারণ, আমারা তো তখন ওঁর ঘরে শুয়েছিলাম। ভাবলাম বাবাকে একবার জিজ্ঞাসা করি। পরমুহূর্তে মনে হল, বাবা তো আজ খুব রেগে আছে, যদি বকুনি দেয়! তাই আর গেলাম না। এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম
“এইবার ওঠ রে, সাতটা বাজে। আর একটু পরেই তো আমাদের বেরোতে হবে।”
মায়ের ডাকে ঘুমটা ভাঙল। পাশের ঘরে গিয়ে দেখি বাবা, জেঠু আর সিংজি আড্ডায় মজে। আমায় দেখে সিংজি বললেন, “গুড মর্নিং। নিন্দ ক্যায়সা হুয়া?”
আমিও হেসে বললাম, “আচ্ছা হুয়া। খুব ভালো ঘুমিয়েছি।”
এরপর উনি বাড়ির বারান্দায় নিয়ে গেলেন আমাকে। এতক্ষণ লক্ষই করিনি ব্যাক ব্যালকানি আছে যে। আমি ছুটে সেখানে চলে গেলাম।
বাড়ির পিছনটাতে একটা বড়ো সবুজ মাঠ। যেখানে সারি দিয়ে চাষ হচ্ছে স্ট্রবেরি আর আপেলের। আর তার ঠিক পরে ঝাউয়ের বিশাল জঙ্গল। বারান্দা থেকেই দেখা যাচ্ছিল দূরে বরফে ঢাকা পাহাড়গুলো। পাহাড়ের চূড়ার উপর সূর্যের আলো পড়ায় ঠিক সোনার মতো চিকচিক করছিল। অদ্ভুত মুগ্ধতা।
সিংজি আমাকে এবার জিজ্ঞাস করলেন, “কলকাতা, না সিমলা—কোনটা ভালো?”
আমি হেসে বললাম, “সিমলা।”
এরপর সিংজি একটু দুঃখের সঙ্গে বললেন, “সিমলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর জলবায়ু কলকাতার থেকে অনেক বেশি স্নিগ্ধ আর মনোরমও বটে। কিন্তু এখানকার সুযোগ সুবিধা কলকাতার তুলনায় অনেক কম। এখানে বাচ্চাদের পড়াশোনার জন্য কয়েক কিলোমিটার উঁচু পাহাড়ে চড়তে হয়। তাই কলেজে যাওয়া তো দূরের কথা, হাইস্কুলেই খুব কম ছেলেমেয়ে ভর্তি হতে পারে। কলকাতার মতো এখানে বড়ো কারখানা বা অফিসও নেই। ডাক্তারি ব্যবস্থাও সেরকম নয়। তবে হ্যাঁ, আমাদের এখানে এত গাছপালা হওয়ার সুবাদে দূষণ খুবই কম।” আরও বললেন, “আমি এখানকার একটা অনাথ আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত। সাধ্যমতো চেষ্টা করি ওই মা-বাবা হারা বাচ্চাগুলোর জন্য কিছু করার। ফুলের মতো মুখগুলোয় একটু হাসি ফোটানোর।”
আমি মন দিয়ে ওঁর কথা শুনছিলাম। ঠিক করে ফেললাম, বড়ো হয়ে এই পাহাড়ি এলাকার মানুষদের জন্য কিছু একটা করব। মনের ইচ্ছাটা সেদিন সিংজিকে বলেও ফেলেছিলাম। তাতে উনি খুশি হয়ে বলেছিলেন, “নিশ্চয়ই, তোমার মতো মানুষদেরই তো দরকার।”
ওইদিনই সকালে বাবার কাছে জেনেছিলাম যে সিংজি আমাদের অসুবিধার কথা ভেবে ওঁর ঘরগুলো আমাদের ছেড়ে দিয়ে কাল রাতে ওই ঠান্ডায় নিজের গাড়িতে শুয়েছেন।
এই কথাগুলো শোনার পর ওঁর প্রতি শ্রদ্ধা আমার আরও বেড়ে গেল। ইস্! কালকে না বুঝেই এইরকম একটা হৃদয়বান মানুষকে কেবলই ড্রাইভার ভেবে কী ভুলটাই না করেছি। সিংজিই সেদিন আমাকে তাঁর কাজের মাধ্যমে শিখিয়ে দিলেন কোনও মানুষকে কখনোই তার পেশা দিয়ে বিচার করতে নেই। মানুষকে বিচার করতে হয় তার কাজ আর ব্যবহার দেখে।
এরপর ওখান থেকে বেরোনোর আগে সিংজি আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন নিজের বাগানের এক পেটি আপেল। কী যে মিষ্টি আর রসালো সেই আপেল, তা বলে বোঝাতে পারব না! এরপর পুরো ট্যুরে ওঁর কাছ থেকে অনেক গল্প শুনেছি। সবই ওঁর নিজের জীবনের কাহিনি। সে-সব শুনে বুঝতে বাকি রইল না যে মানুষটা খুব গুণী, আর পরোপকারীও বটে।
জানি না সিংজির সঙ্গে আর কখনও দেখা হবে কি না, কিন্তু ওঁর সঙ্গে কাটানো ওই কয়েকটা দিন আমি সারাজীবন মনে রাখব।
আপনি ভালো থাকবেন গুরুচরণ সিং।
অলঙ্করণ- অস্মিতা পৈতণ্ডী
খুব ভালো লেগেছে কৌশানি। অপূর্ব লেখার হাত তোমার। একেবারে ঝরঝরে।😊
LikeLike