দশম শ্রেণি, খুলনা জিলা স্কুল, খুলনা, বাংলাদেশ। বয়স : ১৫
সাতবিলের মাঠের পাশ দিয়ে বাড়ি ফিরছিল রাখাল আর হারান। একে কার্তিকের বেলা, তারপর ওদের বেশ দেরি হয়ে গেছে পাশের ঝুমুরডিহি গ্রাম থেকে ফিরতে। ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে গেছে কিছুক্ষণ আগে। চারপাশে হালকা শীত-শীত ভাব। পথের দু’পাশের ঝোপ-ঝাড়ের উপরে জোনাকির বিন্দু-বিন্দু আলো জ্বলছে। দূর থেকে শেয়ালের দলের সমবেত ‘হুক্কা-হুয়া’ ডাক ভেসে আসছে।
রাখালরা টর্চের ক্ষীণ আলোয় পথ দেখে দ্রুত হাঁটছিল। রাখাল বয়সে একটু বড়ো, ওর বেশ সাহস আছে। কিন্তু এই আলো-আঁধারির মধ্যে ওর বছর সাতের ছোটো ভাই হারানের বুক ভয়ে ধুকপুক করছিল। বিশেষ করে সোনাঝুরি গ্রামের শেষপ্রান্তের এই জঙ্গুলে পথটুকুতে। দিনের আলোয়ও এখানে এলে গা-টা কেমন যেন ছমছম করে। এমনিতে সোনাঝুরি গ্রামটা দিনের বেলায় ছবির মতো খুব সুন্দর। কিন্তু রাত বাড়লে গ্রামের সাতবিলের মাঠের এদিকটা কেমন যেন হয়ে যায়।
বেশ কিছুক্ষণ পর রাখাল আর হারান ঠ্যাঙাখালের কাছে এসে পড়ল। আগে নাকি এই খালের ধারে ঠ্যাঙাড়ে দস্যুদের খুব উপদ্রব ছিল, তাই লোকমুখে খালের ওরকম নাম হয়ে গেছে। রাখাল সতর্কভাবে ঠ্যাঙাখালের ওপারের জঙ্গলের দিকে তাকাল। কারণ এই জঙ্গলটা ঘন হতে-হতে মিশেছে সুন্দরবনের সাথে। তাই এই সময়ে ডোরাকাটা বাঘও সামনে এসে পড়লে অবাক হওয়ার কিছুই নেই।
হঠাৎ কী যেন দেখে হারান রাখালের হাত চেপে ধরল, ভয়ে-ভয়ে বলল, “ও রাখালদা, ওডা কী?”
হারানের আঙুল দিয়ে দেখানো দিকে তাকাল রাখাল। ওদের থেকে খানিকটা দূরে মাটি থেকে দু’-তিনহাত উপরে ভাসছে একটা আগুনের গোলা। সেটা বেগুনি-নীল আভা থেকে ধীরে-ধীরে টকটকে লাল হচ্ছে, আবার আগের রং ধারণ করছে। তবে গোলাটা এক জায়গায় স্থিয় নয়। মনে হচ্ছে, ওদের দিকেই যেন ক্রমশ এগিয়ে আসছে। হারান তো ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। রাখালকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সে ভাঙা গলায় বলল, “ভূত আসতিছে রাখালদা, আমাগে ধরে ঘাড় মটকাইয়ে দেবে!”
“আরে ভীতুর ডিম, চুপ করে দাঁড়া। আমি আছি না?”
হারান থতমত খেয়ে যায়। সে শুনেছে, ওই আগুনের গোলা হলো আলেয়া। রাতেরবেলা ভূতেরা নাকি আলেয়ার রূপ ধরে এই ঠ্যাঙাখালের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। সুযোগ পেলে মানুষের ঘাড় মটকে দেয়। কিন্তু রাখাল জানে, এগুলো সত্যি নয়। অজিত স্যার সেদিন ক্লাসে বলেছিলেন, পচা কাদায় থাকা মিথেন গ্যাসের বুদ্বুদ্ বাতাসে ভাসলে আলেয়ার সৃষ্টি হয়। রাখাল আগে কখনো আলেয়া দেখেনি, তাই বেশ কৌতূহল হচ্ছিল ওর।
আলেয়াটা রাখালদের দিকে কিছুটা এগিয়ে আবার পিছিয়ে যাচ্ছে। ওর মনে হলো, আলেয়াটা তো খুব কাছেই। আরেকটু এগোলেই বোঝা যাবে জিনিসটা কী! কতসব ভাবতে-ভাবতে রাখাল নিজের অজান্তেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো আলেয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তার দু’চোখের মণিতে চকচক করছিল শুধু আলেয়ার আলোর উজ্জ্বল নড়াচড়া।
এমন দেখে হারান তো প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেল। সে কাঁদো-কাঁদোভাবে চিৎকার করে উঠল, “ওরে কারা আছ, রাখালদারে ভূতে ধরিছে! আমাগে বাঁচাও…!”
রাখাল আচমকা থেমে গেল। হারানের কান্নার শব্দে যেন ওর হুঁশ ফিরল। রাখাল প্রায় সাতবিলের মাঠ পেরিয়ে বিশাল বিলের মধ্যে চলে যাচ্ছিল আলেয়ার অলৌকিক আকর্ষণে। হারান না থাকলে রাখাল পথ হারিয়ে কোথায় যে চলে যেত…! রাখাল এক দৌড়ে হারানের কাছে চলে এল। হোক সে কোনো গ্যাসের পিণ্ড, এর মায়াজাল তো মিথ্যে নয়। রাখাল বুঝতে পারল, আলেয়া ভূত না হলেও মানুষকে পথ ভুলিয়ে নিয়ে মেরে ফেলতে পারে। যেমন সে নিজেই যাচ্ছিল একটু আগে। গ্রামের কিছু-কিছু বিশ্বাস অর্থহীন নয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাখালেরা ঠিক পথে বাড়ি ফিরতে লাগল।
খুদে স্রষ্টাদের সমস্ত কাজের লাইব্রেরি