বইপড়া-গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘জুরাসিক গ্রহ’- রিভিউ করলেন স্রবন্তী চট্টোপাধ্যায়-বসন্ত২০২৩

বই : জুরাসিক গ্রহ
লেখক: গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
প্রকাশক : আলোকবর্ষ ও সুচেতনা
মুদ্রিত মূল্য : ১৫০ টাকা
প্রতিক্রিয়া : স্রবন্তী চট্টোপাধ্যায়

boipora84

কল্পবিজ্ঞান আদতে কী, তা নিয়ে নানা জনের নানা মত। তবে লেখক ও অধ্যাপক পলাশ বরণ পাল এ ব্যাপারে খুব যথাযথ এক সংজ্ঞা দিয়েছেন, কল্পবিজ্ঞানে কল্পনা যেমন থাকবে, তেমন বিজ্ঞানটাও সঠিক হওয়া দরকার, তার জন্য খুব বাহুল্যের প্রয়োজন নেই, সহজ সাধারণ সবার বোঝার মত বিজ্ঞান, কিন্তু তা বিজ্ঞান হওয়া আবশ্যক। গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়ের জুরাসিক গ্রহ  বইটি এই সংজ্ঞা অনুযায়ী একটি অসাধারণ কল্পবিজ্ঞানের গল্পের সংকলন। বইটিতে মোট সাতটি গল্প আছে – জুরাসিক গ্রহ, জেনেটিক কোড, অপারেশন ফ্রিডম, নতুন পৃথিবী, অয়স, গয়না রহস্য আর পাসওয়ার্ড। সব কটি গল্পই যে কল্পবিজ্ঞানের এমনটা অবশ্য নয়, তবে সব গল্পগুলিতেই এক বৈজ্ঞানিকোচিত বিজ্ঞান ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে।

প্রথম গল্প জুরাসিক গ্রহ। কয়েকজন মহাকাশযাত্রী সৌরজগতের বাইরে ওডিন নামে একটা গ্রহে অভিযান করতে যাচ্ছে, সেই দলে রয়েছে নানা বিষয়ের বৈজ্ঞানিকরা, সেই গ্রহের বেশ কিছু চরিত্র অনেকটা পৃথিবীর মতো, অন্তত দূর থেকে দেখলে তাই মনে হয়। সেখানে সবুজ আছে আর সেই সবুজ যে ক্লোরোফিলের তা বর্ণালী বা স্পেকট্রাম বিশ্লেষণ করে বোঝা যাচ্ছে। সেই গ্রহের মাটিতে নামা নিয়ে প্রাথমিক দ্বিধা কাটিয়ে উঠে তারা সেই গ্রহে নামে, আর তারপর তাদের নানা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়।

দ্বিতীয় গল্প জেনেটিক কোড। ঘটনাস্থল ক্ষত্রপ নামে এক গ্রহ। সেখানে পৃথিবী থেকে এক সময় বেশ কিছু মানুষ গিয়ে থাকোতে শুরু করেছিল। জাবাজ নামের এক মহাকাশদস্যু এই গ্রহকে খুব অন্যায়ভাবে কব্জা করে তার সর্বেসর্বা সম্রাট হয়ে বসেছে, অকারণে অনেক নিরীহ মানুষকে সে হত্যা করেছে। সেই গ্রহের মানুষরা পৃথিবী বা আর কোনও গ্রহ থেকে সাহায্য প্রার্থনা করারও কোন সুযোগ পাচ্ছে না। বেশ কিছু বৈজ্ঞানিকের পরিবার বা প্রিয়জনদের পণবন্দী করে তাদেরকে সে বাধ্য করেছে তার হয়ে কাজ করতে। এই অবস্থায় খুব অপ্রত্যাশিতভাবে একজন বৈজ্ঞানিক, যিনি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে কাজ করতেন, তিনি সেই সম্রাটের ওপর ঘোষিতভাবে আস্থা স্থাপন করে তার দলে যোগ দিলেন। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র তাতে খুব অবাক হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি আরও অবাক হলেন এক বছর পর তাঁর মাস্টারমশাইয়ের কাছ থেকে দেখা করার ডাক পেয়ে। করা নিরাপত্তার ঘেরাটোপের মধ্যে থেকে বৈজ্ঞানিক মাস্টারমশাই তাঁর প্রিয় ছাত্রকে যে পদ্ধতিতে ক্ষত্রপকে রক্ষা করার জন্য কিছু নির্দেশ দিলেন তা অভাবনীয়। তার জন্য এই গল্পটি অবশ্যপাঠ্য।

এর পরেই তৃতীয় গল্প অপারেশন ফ্রিডম। এই গল্পটি আগের গল্পের সিক্যুয়েল। গল্পের শুরু হচ্ছে যমজ দুই ভাইবোনের কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে এবং বোঝা যাচ্ছে যে এই ভাইটি ক্ষত্রপ স্পেস অ্যাকাডেমির সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিবান ক্যাডেট ছিল, জাবাজের আক্রমণে যেবার অনেক নিরীহ মানুষ মারা যায়, সেই একই আক্রমণে এই ভাইটিরও সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। এমন সময় অকুস্থলে এক আগন্তুকের প্রবেশ, যিনি এই ভাইটির জন্য একটি পত্র নিয়ে এসেছেন, সেই পত্রটি পাঠিয়েছেন একজন কম্যান্ডার যিনি মাতৃস্নেহে এই দুই অনাথ ভাইবোনকে বড় করেছিলেন এবং জাবাজের সেই ভয়ানক আক্রমণের পর থেকে যাঁর সঙ্গে আর ওদের যোগাযোগ হয় নি। তিনি বেঁচে আছেন কি না তা পর্যন্ত ওরা জানত না এতদিন। এরপর জানা যায় ঐ বার্তাবাহী আগন্তুক হলেন আগের গল্পের সেই বৈজ্ঞানিকের প্রিয় ছাত্রটি। এরপর অনেক ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে ঘটনাবহুল গল্পটি এগোতে থাকে। এবং সেই বৈজ্ঞানিক মাস্টারমশাইয়ের ক্ষত্রপকে জাবাজের হাত থেকে মুক্ত করার পরিকল্পনা শেষ অবধি সফল হয় কি না তা না জানা পর্যন্ত গল্পটি রুদ্ধশ্বাসে পড়ে যেতে হয়। এই গল্পে ওয়ার্মহোলের ধারণাকে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তা বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। আর সামান্যতম যোগাযোগের মধ্যে দিয়েও বৈজ্ঞানিকরা পরস্পরের মন বা ভাবনাকে যেভাবে বুঝে একটা বিরাট পরিকল্পনাকে সফল আকার দেওয়ার পথে এগিয়ে নিয়ে যান তা সত্যিই অভাবনীয়।

চতুর্থ গল্প নতুন পৃথিবী। এতে মঙ্গল গ্রহে বাস করা মানুষদের পৃথিবীকে দেখতে আসার গল্প বলা হয়েছে। সরাসরি কোন যুদ্ধের বর্ণনা ছাড়াও যুদ্ধের ভয়াবহতাকে যেভাবে দেখানো হয়েছে তা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য।

পঞ্চম গল্প অয়স। এটি কল্পবিজ্ঞানের পাশাপাশি কিছুটা speculative fiction-ও বটে। তাম্রযুগ থেকে লৌহযুগে পদার্পণ করার পথ খুব সরল অথচ সুন্দর এক আখ্যানের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে এই গল্পে।

ষষ্ঠ গল্প গয়না রহস্য। গল্পের নাম থেকে বোঝা যায় এটি একটি রহস্য কাহিনী। এক গ্যালারিতে কয়েকদিন ধরে এক গয়নার দোকানের গয়না প্রদর্শনী চলছিল, সেই প্রদর্শনী যখন প্রায় শেষের দিকে, সেই সময় কিছু গয়না হঠাৎ চুরি হয়ে যায়। সিসিটিভি ফুটেজ থেকেও সঠিক বোঝা যায় না অপরাধী কে, আর তার চেয়েও বড় সমস্যা চুরি করা গয়নাগুলো গেল কোথায়? ‘প্রবলেম সলভার’ বাপ্পা মাথা খাটিয়ে এই চুরির মাহাত্ম্য হাতেনাতে ধরে ফেলে। যে বৈজ্ঞানিক উপায়ে গয়নাগুলোকে লোপাট করা হয়েছিল তার উদ্ঘাটন এই গল্পে এক অন্য মাত্রা যোগ করে। 

সপ্তম এবং সর্বশেষ গল্প পাসওয়ার্ড। এও আরেক রহস্যকাহিনী যেখানে এক অফিসের একটি বিশেষ কম্পিউটার খোলার প্রভূত প্রয়োজন দেখা দেয়, অথচ সেই কম্পিউটার যিনি খুলতেন তিনি ভয়ানক অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। এমতাবস্থায় প্রবলেম সলভার বাপ্পা বুদ্ধি খাটিয়ে  সেই পাসওয়ার্ড উদ্ধার করে দেয়। রহস্য গল্প হলেও এই গল্পে পর্যায় সারণীর ধারণা যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, তা সত্যিই অসাধারণ।

বিজ্ঞানমনস্ক পাঠক ছাড়াও যারা মাথা খাটাতে ভালোবাসে সেই সব পাঠকদের জন্য এই বইটি এক অসামান্য সংকলন। আরও একটা উল্লেখ করার মতো বিষয় হল বয়স নির্বিশেষে এই বইটি সকল পাঠকের কাছে সমান উপজীব্য হওয়ার ক্ষমতা রাখে। 

 বই পড়া সম্পূর্ণ লাইব্রেরি