প্রথম পাঠ, দ্বিতীয় পাঠ
প্রথম পাঠ
তারিখঃ ১৮ ই মে, ২০১৩
স্থান – কলকাতা
বিষয় – বাংলা লেখায় বানানের ব্যবহারবিধি
—————————————————————————————-
কারা ছিলেন
আলোচনাসভায় বানানের মূল ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করেন শ্রী চিত্ত ঘোষাল। হাজির ছিলেন খামখেয়ালি পত্রিকার সম্পাদক শ্রী অচিন্ত্য সুরাল, প্রাবন্ধিক ও প্রুফ সংশোধন বিশেষজ্ঞ শ্রী ফাল্গুনী ঘোষ এবং জয়ঢাক টিমের তরফে শ্রীমতী মৌসুমী রায় ভট্টাচার্য, ইমন চ্যাটার্জি, সোনা বিশ্বাস, মহাশ্বেতা, বুবকা, সত্যজিৎ, দেবজ্যোতি, বাসব ও অন্যান্যরা।
এই পাতাটা তৈরি করবার সময় আরো কিছু সংশোধন করে বিশেষ সাহায্য করেছেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়
কেন আলোচনাসভা
জয়ঢাক পত্রিকা চালাতে গিয়ে কতগুলো বিষয় লক্ষ করা গেছেঃ
ক। বিভিন্ন লেখক ও কম্পোজিটররা একই বানান বিভিন্নভাবে লিখছেন। ফলে পত্রিকার একেকটি লেখায় একই শব্দের বিভিন্ন বানান দেখা যাচ্ছে ।
খ। পাংকচুয়েশান, ফর্ম্যাটিং ও বাক্যগঠন নিয়েও একেকজন একেকরকমভাবে কাজ করছেন, ফলে গোটা পত্রিকায় নানা চেহারার সজ্জা দেখা যাচ্ছে।
গ। সহসম্পাদকমণ্ডলী ও জয়ঢাকের দলবলের অন্যান্য সদস্যদের সম্পাদকীয় কাজকর্মের দক্ষতার অভাব (যে দক্ষতা পত্রিকা পরিচালনায় উত্তরসূরী তৈরির কাজে বিশেষ প্রয়োজন)
এই বিষয়গুলো নিয়ে জয়ঢাক পরপর কিছু ওয়ার্কশপের পরিকল্পনা করেছে।
১৮ মে এই সিরিজের প্রথম সভাটা অনুষ্ঠিত হল। এর প্রধান বিষয়বস্তু ছিল ওপরের ‘ক’ চিহ্নিত বিষয়টি।
এই নোটটি কাদের জন্য
ক। জয়ঢাকের দলবল ও সহসম্পাদকদের অনেকেই দেশে-বিদেশে থাকবার দরুণ কিংবা ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে এই আলোচনাসভাতে আসতে পারেননি। এই নোটটি প্রাথমিকভাবে তাঁদের জন্য।
খ। যাঁরা নিয়মিত লেখেন বা পত্রিকা চালান এবং মনে করেন তাঁরাও উপরিউক্ত সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হচ্ছেন তাঁদের জন্যও এই নোটটা কাজে আসবে।
গ। অন্যান্য আগ্রহী পাঠকদের জন্যও এটা দেয়া হল।
বক্তব্য ও সিদ্ধান্ত
বোঝবার সারল্যের জন্য এই অংশটিকে আমরা সংক্ষিপ্ত ও সোজাসাপটা চেহারায় রেখেছি।জার্গনের ব্যবহার যথাসম্ভব কম রাখা হয়েছে। অ্যাকাডেমিক বিশেষজ্ঞদের কাছে এইজন্য অগ্রিম মার্জনাভিক্ষা করা রইল। দ্বিতীয়ত, জয়ঢাকের জন্য আসা প্রচুর কম্পোজড লেখা বিশ্লেষণ করে যে-সব ইস্যুতে বানান সবচেয়ে বেশি ভুল হয়, কেবল সে-সব ইস্যুকেই আলোচনায় স্থান দেয়া
ক। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অ্যাকাডেমির ‘আকাদেমি বানান অভিধান’ (ISBN 8186908528 9788186908525) বইটাকে অনুসরণ করুন। ওর বানানবিধি এখন পশ্চিম বাংলায় সরকার-স্বীকৃত। সাধারণ লেখকরা বানানের জন্য একাধিক বই ব্যবহার করবেন না। ওতে সংশয় বাড়ে।
খ। ভুল তিন জাতেরঃ
১। একটা হল টাইপোগ্রাফিক্যাল ভুল। যথা, বালক লিখতে বাকল লেখা। লেখার শেষে অন্তত বারদুয়েক সতর্ক সংশোধনী পাঠ এই ত্রুটিটাকে ঠিক করে দেবে। লেখা পাঠাবার আগে বারবার করে পড়বার এই প্রবণতা অধিকাংশ লিখিয়ের কাছে থেকে আমরা দেখতে পাই না। এটা করা অত্যন্ত জরুরি।
২। দ্বিতীয়টি হল যমরাজাকে জমরাজা লেখা জাতীয় ভুল। দ্বিতীয় বানানটার আদৌ কোনো স্বীকৃত ব্যবহার নেই। প্রায় কাছাকাছি উচ্চারণের দুটো বর্ণের মধ্যে কোনটা ব্যবহার করব সেটা ধরতে না পারাই এই ভুলের উৎস।
৩। তৃতীয়টাকে ঠিক ভুল বলা যাবে না। অনেক সময় একই শব্দের বিভিন্ন বানানের রূপ স্বীকৃত থাকে। সেক্ষেত্রে কোন্টি ব্যবহার করব তার ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
২ এবং ৩-এর ক্ষেত্রে সবচেয়ে সাধারণ যে ভুলগুলো বেশি বেশি করে হয় তাদের নিয়ে কিছু টিপস দেয়া হল:
১। ক্রিয়াপদে ও-কারের ব্যবহারঃ
নিয়ম ক।
ব্যবহৃত রূপ | আদর্শ রূপ | মন্তব্য |
হোত/হতো/হোতো/হত | হত | |
যাবো,খাবো/যাব,খাব | যাব,খাব |
নিয়ম খ। ক্রিয়াপদের কাল ভেদে ওকারের ব্যবহার
ক্রিয়ার কাল (Tense) | আদর্শ রূপ | ব্যাবহারিক উদাহরণ |
নিত্য বর্তমান | কর | তুমি তো রোজই বাঁদরামি কর |
বর্তমান অনুজ্ঞা (present imperative) | করো | এখন ভালো করে পড়াশোনা করো |
ভবিষ্যত অনুজ্ঞা (future imperative) | কোরো | কাল থেকে ভালো করে পড়াশোনা কোরো |
সাধারণ ভবিষ্যৎ | খাব | আমি রাতে ভাত খাব। |
বিঃদ্রঃ ‘জানা’ ক্রিয়াপদেদের জন্য ওপরের তিনটে ক্ষেত্রের চেহারাগুলো হবে জান, জানো, জেনো।
‘লেখা’ ক্রিয়াপদের জন্য হবে লেখ, লেখো, লিখো
২) কী আর কি –
(ক) সাধারণ নিয়মঃ
কি ও কী নিয়ে খানিক খেলাধুলো
কাকা-আজ শ্যামা ফাংশানে গাইবে কি?
ভাইপো-কি জানি!
কাকা-সে কী? তাহলে কি বাজাবে? কী বাজাবে? চেলো কি?
ভাইপো- চেলো কী? কোনো বিলিতি যন্ত্র নাকি?
শ্যামা-কী যে বলিস! গান গাইব না তো করবটা কী? আমি কি ঢোলটোল বাজাতে জানি নাকি?এই, খবর শুনেছিস কি?
ভাইপো- না। কী?
শ্যামা- কী যে করিস! সবই কি আমায় বলে দিতে হবে নাকি?
ভাইপো- তুই তো গেজেট! খবর তুই দিবি না তো কী? তোর বদলে কি কাকা এসব খবর দেবে?
শ্যামা- আছা শোন, বেহুলা হারমোনিয়ামের দুটো ‘কি’ ভেঙে ফেলেছে। এখন কী করে গান হবে সেই ভাব।
৩) বিশেষ্য/বিশেষণের ই-কার ও ঈ-কার
ক। বিদেশী উৎসের শব্দ হলে সবসময় ই-কার
সুফি, পিয়ালা, রাজি, জমি, গাড়ি, জলদি, হ্যাপি, নৌটংকি, খাকি, তৈরি, দেরি, কিলা, জিন্দেগি
খ। অ-তৎসম দেশি শব্দে ই-কার
কিতকিত, বুঁচি, খেঁদি, কানি, চুক্কি, ঘেঁটি, বেশি
গ। তদ্ভব শব্দে (মানে যে সব শব্দ তৎসম শব্দ থেকে এসেছে) ই-কার
পক্ষী—>পাখি, ব্যাঘ্রী–> বাঘিনি হস্তী–> হাতি
ঘ। তৎসম (মানে সংস্কৃত উৎসের শব্দ) শব্দ থেকে এলে ঈ-কার
অশ্বী, ব্যাঘ্রী, তন্বী ছাত্রী, পাত্রী
ঙ) স্ত্রীবাচক শব্দের শেষে ই-কার (এবং দন্ত্য ন)(রানি, ননদি, মেথরানি, গয়লানি)
চ) শেষে দীর্ঘ-ঈকার যুক্ত শব্দ উত্তরপদের সঙ্গে সমাসে জুড়লে ই-কার হয়ে যাবেঃ
কালী–> কালিদাস
জ। কোন ক্ষেত্রে যদি হ্রস্ব ই বা দীর্ঘ ঈ দুটোরই ব্যবহার থাকে তাহলে হ্রস্ব ই ব্যবহার গ্রহণ করতে হবে। যেমন সূচিপত্র ও সূচীপত্র। এক্ষেত্রে সূচিপত্র বানানটা ব্যবহার করব।
মনে রাখবার সূত্র
ছাত্রী পাত্রী হল কুঁজো হল চিৎ
সুফিরা পিয়ালা হাতে খেলে কিৎকিৎ
তুমি কালী মহাকালী কর্তা কালিদাস
তোমার নন্দাই হল ননদির দাস
৪। বিশেষ্য/বিশেষণের উ-কার ও ঊ-কার
এক্ষেত্রে নিয়মগুলো ই-কার, ঈ-কারের মত হবে।
৫। ঋ
ক। বিদেশি শব্দ হলেই রফলা ও হ্রস্ব ই হবে। ঋ-কার চিহ্ন হবে না
যেমনঃ খ্রিস্ট, ব্রিটিশ
খ। দেশি, তৎসম, তদ্ভব হলে ঋকার দিতে হয়।
বৃষ্টি, গৃহস্থ, বৃদ্ধি, পৃথিবী শৃগাল। (ব্যতিক্রম হল শ্রী (ও সংশ্লিষ্ট শব্দ যথা বিশ্রী, সুশ্রী) ইত্যাদি)
গ। তৃ (‘তিন’ অর্থে) যদি অন্য স্বাধীন শব্দের সঙ্গে জুড়ে যৌগিক শব্দ বানায় তাহলে তা ত-এ রফলা হ্রস্ব ই হয়ে যাবে। যেমন ত্রিনয়ন, ত্রিধারা, ত্রিভুবন, ত্রিতাপ, ত্রিযামা, ত্রিফলা
ঘ। আবার তৃ-র সঙ্গে অসম্পূর্ণ শব্দখন্ড (যা স্বাধীন শব্দ নয় এমন বর্ণগোষ্ঠী)জুড়ে শব্দ তৈরি হলে তখন র-ফলা বজায় থেকে যায়। যেমন তৃতীয়, তৃষ্ণা
ঙ। শব্দের শেষে রেফ-এর ঠিক পরে ঋকার হবে না। হবে র-ফলা ও দীর্ঘ ঈ কার—ভর্ত্রী, কর্ত্রী। কিন্তু শব্দের মধ্যে থাকলে ঋকার হবে। যেমনঃ কর্তৃপক্ষ, ভর্তৃহরি।
৬। বিশেষ্য ও বিশেষণে ও-কার
এক্ষেত্রে সমস্যাটা প্রধানত আসে, উচ্চারণগতভাবে যেসব শব্দের শেষে ও-কার আসে তাদের ক্ষেত্রে শেষে ও-কার বসবে কিনা তাই নিয়ে।
ক। এসব ক্ষেত্রে তৎসম শব্দ হলে শেষে ও-উচ্চারণ হলেও ও-কার দেব না।
যেমন ক্ষত, উৎস, বিলম্ব, লম্ব, পদ্ম
খ। সে ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রে (তদ্ভব, দেশী, বিদেশী, মিশ্র শব্দের ক্ষেত্রে) শেষে ও-উচ্চারণ হলে ও-কার দেব।
যেমন বড়ো, কালো, ছোটো, আলো, যতো, ততো।
গ। কোন কোন সময়নির্দেশক স্বাধীন শব্দের শেষে ও-কার যোগ করে উচ্চারিত হয়, যেমন কখনও, এখনও, তখনও। এগুলো আবার যুগ্ম শব্দ হলে ও-কার চিহ্ন হবে। যেমনঃ কখনো-সখনো
৭। ঐ/ ঔ না ওই/ওউ
ক) এককভাবে ব্যবহার হলে ওই, ওউ হবে।
যেমন ওই যে আকাশের গায় (ঐ যে আকাশের গায় হবে না)
খ) এক ব্যাঞ্জনবর্ণের স্বাধীন শব্দে ‘ওই’ ব্যবহার হবে। ঐকার চিহ্ন ব্যবহার হবে না। যেমনঃ কই, সই, বই, লই, খই ছই, জই, টই, নই। এগুলো অন্য শব্দ বা উপসর্গের আগে জুড়ে শব্দ তৈরি করলে সেখানেও একই রূপ বজায় থাকবে। যেমনà কইগো, সইসাবুদের বইটা লইয়া থইলা কই?
গ) সাধারণত যেসব ঐকার যুক্ত বর্ণ এককভাবে স্বাধীন শব্দ নয় তাদের ক্ষেত্রে ঐকার হয়। যেমন তৈল মেখে শৈল রায় বৈকালেতে বইঠা বায়।(দিশি শব্দ বলে বইঠা। বৈঠা নয়।)
(ঘ) ঔকারের ক্ষেত্রে উলটো রীতি। যেমনঃ গৌ, ঘৌ, ছৌ, ভৌ, মৌ। ব্যতিক্রম বউ।
৮। অং/অঃ
ক। দুটো শব্দের সন্ধির মাঝখানে অনুস্বার আসতে হলে তাতে স্বাধীনভাবে অনুস্বার বসবে। যেমন অহংকার (অহম+কার))
খ। এছাড়া বাকি ক্ষেত্রে ঙ- যুক্তাক্ষর হিসেবে বসবে—অঙ্ক, বঙ্গ, টাঙ্গা, শৃঙ্গ, ভৃঙ্গ
গ। শব্দের শেষে বিসর্গ বাদ দিতে হবেঃ যেমন প্রায়শ (প্রায়শঃ নয়), পুণঃপুণ (প্রথম পুণ-র পরে বসল কিন্তু শব্দের শেষে হওয়ায় পরেরটার শেষে বসল না।)
৯। দু একটা যুক্তাক্ষরের সাধারণ নিয়ম
১। ষত্ব বিধান অনুযায়ী ণ্ড হয়। মূর্ধন্য বর্ণের সঙ্গে ণ-ই যোগ হয়। তবে খাঁটি দেশী শব্দ, যেমন, ঠান্ডা, বা বিদেশী শব্দ, যেমন, আন্ডার, এখানে ন্ড হয়।
যেমনঃ
পাঁচগন্ডার জমিন নিয়ে
দণ্ডিগ্রামে গন্ডগোল
দণ্ডমুণ্ডকর্তা বলেন
গুন্ডা এনে মুণ্ডু খোল
হন্ডা চেপে গুন্ডা এলো
ষণ্ডামতন মূর্তি তার
গণ্ডভরা ঠান্ডা দাড়ি
দণ্ড হাতে ধুন্ধুমার
গণ্ডগোলের অন্ত হলে
গিয়ে ছাদের আন্ডারে
নুন মরিচে ধ্বংস করি
শতেক বয়েল অণ্ডরে
২। বিদেশী শব্দে ষ বাদ।
খ্রিস্ট, ডেস্টিনি, আশকারা, পুশকিন
৩।হসন্তের ব্যবহার
ধন্যাত্মক শব্দে হসন্ত হবে। নচেৎ না ব্যবহার করাই ভালো।
যেমনঃ তুই এখন চুপটি করে বস, এত ফোঁস্ফোঁস্ করিস না।
এইটি প্রাথমিক। এরপর আর একটু জটিল এলাকাদের ধরে দ্বিতীয় পাঠ। এই লিঙ্কে–>
গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। আমার বানান ভীষন ভূল হয়।
LikeLike