উৎসর্গ পত্র
তন্ময় বিশ্বাস
“রোল নম্বর ফর্টি সিক্স… মার্কস সেভেন্টিন। হা হা হা! এদিকে আয়।”
মাথা নিচু করে পরেশবাবুর দিকে এগোল ছেলেটা। চোখটা বড্ড ভারী ভারী ঠেকছে আজ তার। এবারেও পাশ মার্ক পেরনো গেল না তাহলে। এই হাফ-ইয়ার্লিতেই যদি এই অবস্থা হয় তবে অ্যানুয়ালে গিয়ে কী হবে! ভাবতেই গা শিউরে ওঠে তার। পরেশবাবু বাড়ি ফেরার পথে বাবার দোকানে চাল-ডাল কিনতে মাঝে-মাঝেই ঢুঁ মারেন। বাবা যদি জানতে পারেন, তবে? সে কী করবে তখন? অজানা আশঙ্কায় শিউরে উঠে সাদা শার্টের কোণটা আচমকাই খামচে ধরে ও।
“কী রে, কথা কানে যায়নি? আয় বলছি এদিকে!” সপাং করে বেতটা মেঝেতে আছড়ে ফেলেন পরেশবাবু।
ওর মনে হয় যেন ওর পিঠেই বেতটা মারা হল। আর সেই সঙ্গে খান খান হয়ে গেল তার সমস্ত আত্মবিশ্বাস, তেজ–সবকিছু। ইতিহাসে যে ও বরাবরই কাঁচা। সাল-তারিখ মনে রাখতে গেলে মাথা ঝিমঝিম করে। রাজ্যের সীমানা বলতে গেলে সব তালগোল পাকিয়ে যায়। গত অ্যানুয়ালে তাও পাশ মার্কটুকু হয়েছিল। কিন্তু এবার…
একটার পর একটা বেত পড়তে থাকে হাতে, পায়ে, পিঠে। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে করতে শেষে চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে ওর। ক্লাসসুদ্ধ ছেলে সভয়ে দেখতে থাকে এই ঘটনা।
সে-বছর পরেশবাবু রিটায়ার করার পর তাঁর জায়গায় জয়েন করেন জীবকবাবু। ইতিহাস ক্লাসে গুটিয়ে বসে থাকা সেই ছেলেটা তাঁর গল্প বলে বলে পড়ানোর ঢঙে আকৃষ্ট না হয়ে পারে না। পড়ানোর সময় তাঁর হাতে বইও থাকে না। আস্তে আস্তে তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রতি এক অজানা আকর্ষণ বোধ করতে থাকে সে। অফ পিরিয়ডে জীবকবাবুর সঙ্গে প্রায়ই দেখা যেত তাকে। তাঁর উৎসাহেই একে একে গ্ৰ্যাজুয়েশন, পোস্ট গ্ৰ্যাজুয়েশন, ডক্টরেটের পর এই শতাব্দী প্রাচীন কলেজে অধ্যাপনা। জীবকবাবু না থাকলে আজ সে…
‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে…’ মোবাইলের রিংটোনে আচমকা চটকা ভাঙে ডঃ অনীশ মাইতির। ওপ্রান্তে পাবলিশারের গদগদ কণ্ঠ, “’স্যার, প্রুফ চেকিং হয়ে গেছে। আর কোনও এডিটিং করতে হবে যদি মনে হয়, বলুন। ফাইলটা পাঠিয়ে দেব। যতই হোক, ইন্ডিয়ায় সিন্ধুসভ্যতা নিয়ে এত ডিটেলে আপনিই প্রথম কাজ করলেন। আমারও একটা দায়িত্ব আছে বৈকি।”
“না, আর কিছু লাগবে না।” বলেই আবার থমকালেন ডঃ মাইতি, “ও হ্যাঁ, উৎসর্গ পত্রে শ্রী জীবক বসুর আগে শ্রী পরেশনাথ দত্ত নামটা অ্যাড করে দেবেন প্লিজ।”
অলঙ্করণঃ অংশুমান