অর্ণব দাস
সেনবাড়িতে আজ ধুন্ধুমার কাণ্ড। বাপি, মাম, দাদু, দিদুন, পিসি, পিসাই, কাকাই, রমাদি সবার নাওয়া খাওয়া মাথায় উঠেছে। কী হয়েছে আজ?
আজ বেলা এগারোটা থেকে জোজো নিখোঁজ। গোদের ওপর বিষফোঁড়া হিসেবে জোজোকে নিজে-নিজেই খুঁজতে গিয়ে এই কিছুক্ষণ হল তোজোরও পাত্তা নেই।
সেনবাড়ির একমাত্র শিবের সলতে হল সায়ক সেন ওরফে তোজো। আর জোজো হল তার প্রাণাধিক প্রিয় একটি ল্যাব্রাডরের বাচ্চা। দু’জনে এক্কেবারে মানিকজোড়, কেউ কাউকে ছেড়ে এক মুহূর্তও থাকে না।
মণীশের কথামতো জোজোকে তোজোর কাছে আনাটা একেবারে মিরাকলের মতো কাজ করেছে। ছোটো থেকেই তোজো মহা চঞ্চল। বাড়ির জিনিসপত্র ভাঙা, দেওয়ালে নিজের অঙ্কন-প্রতিভা প্রদর্শন, দাদুর দরকারি বই ছিঁড়ে কুটিকুটি করা, দিদুনের চশমা জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দেওয়া, বাপির ল্যাপটপটা ভেঙে ভেতরটা ভালো করে দেখা, মামের সাধের অ্যান্ড্রয়েডটা অ্যাকোয়ারিয়ামে ফেলে দেওয়া, রমাদির গায়ে থুতু ছিটিয়ে দেওয়া এসব ওর কাছে জলভাত ছিল।
অর্ঘ্য আর শ্রীতমার একমাত্র ছেলে তোজোকে নিয়ে দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। দু’জনেই পেশায় ব্যাঙ্ককর্মী হওয়ায় তোজোর জন্য সময় হয়তো কম পড়ত, কিন্তু দু’জনে আপ্রাণ চেষ্টা করত ওকে কোয়ালিটি টাইম দেওয়ার। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে তোজোর দুষ্টুমি বেড়েই যাচ্ছিল। পেশায় অধ্যাপক রথীনবাবুর কড়া নির্দেশ ছিল যেন তোজোর গায়ে কেউ হাত না তোলে, কারণ তাতে শিশুমনের ওপর খুব খারাপ প্রভাব পড়ে। কিন্তু যেদিন ওর মাথাটা কতটা শক্ত সেটা বোঝার জন্য খাট থেকে মেঝেতে লাফ দিয়েছিল তোজো, সেদিন সন্ধেবেলায় আদরের নাতিকে মাথায় তিনটে স্টিচ নিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি রথীনবাবু। সেই রাতেই নিজের এক প্রিয় ছাত্র সাইকিয়াট্রিস্ট মণীশ সেনগুপ্তকে বাড়িতে ডেকে সবটা খুলে বলেন তিনি।
বার তিনেক সিটিং দেওয়ার পর মণীশ আসল ব্যাপারটা বাড়ির সবাইকে খুলে বলে। তোজো আর দশটা ছেলের থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমান ও প্রাণবন্ত। কিন্তু বাবা-মায়ের কাছে কম সময় পাওয়া, নিজের বয়সের অন্য কারোর সাথে সেরকম খেলাধূলা না করা, বেশি টিভি দেখা ইত্যাদি কারণে ওর ভেতরের অফুরন্ত এনার্জি ক্রমশ ধ্বংসাত্মক কাজের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসছিল। তোজোর মতো বাচ্চাদের ভেতরের এনার্জি যদি ঠিকমতো কাজে না লাগে তবে তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিপর্যয় ডেকে আনে। তোজোর এই এনার্জিকে ঠিকভাবে বাইরে আনার জন্য মণীশই একটা কুকুরের বাচ্চা অ্যাডপ্ট করতে বলে। এতে নাকি তোজোর সঙ্গীর অভাব ঘুচবে, খেলার সঙ্গী পাওয়া যাবে আর তার সাথে সাথে ওর মধ্যে দায়িত্ববোধ জেগে উঠবে।
যেমন কথা তেমন কাজ। একটা ছোট্ট তুলোর বলের মতো ল্যাবের বাচ্চা এনে তোজোর সামনে রাখতেই ম্যাজিক। প্রথমটা একটু চমকে গিয়েছিল তোজো। মিনিট পাঁচেক পর ভয়ে ভয়ে কুকুরের বাচ্চাটার গায়ে হাত রাখতেই সে কুঁইকুঁই করে তার হাত চেটে দিল। আর মিনিট কুড়ির মাথায় সটান তোজোর কোলে সিঁধিয়ে গেল সে।
সেই থেকে দু’জনের গলায় গলায় বন্ধুত্ব। জোজো নামটাও তোজোরই দেওয়া। তোজোর বেস্ট ফ্রেন্ড জোজো। মণীশের কথা অনুযায়ী প্রথম থেকেই জোজোর দেখাশোনার ভার তোজোকেই দেওয়া হল। শুধু স্নান করানোটা কখনও তার দাদুভাই তো কখনও বাপি, কখনও বা মাম সামলেছে। বাকি সব দায়িত্ব অদ্ভুতভাবে নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছে তোজো।
মণীশের পরামর্শ মিরাকলের মতো কাজ করেছে। এখন তোজোর বেশিরভাগ সময়টাই কাটে জোজোকে ঘিরে। স্কুলে যাওয়ার সময় জোজোকে হামি দেওয়া আর স্কুল থেকে ফিরেই আগে জোজোকে কোলে তুলে আদর করা ডেলি রুটিন। আগে জোজোকে আদর করা তারপর অন্যকিছু।
আর জোজোটাও হয়েছে তোজোর তেমনি ন্যাওটা। সারাক্ষণ খালি ওর কাছেই ঘুরঘুর করে। দু’জনে একসাথে খেলা করে, টিভি দেখে, একসাথে খেতে বসে, এমনকি একসাথে ঘুমায়ও। জোজোর নিজের বিছানা থাকা সত্বেও সে রাত্রে সেই তোজোর কোলের কাছেই শোয়। আর শীতকালে তো কথাই নেই। তোজোর লেপের ভেতর থেকে ওকে বের করাই যাবে না।
এহেন অবস্থায় জোজোর নিখোঁজ হওয়াটা সেনবাড়িতে যে ধুন্ধুমার কাণ্ড বাধিয়ে তুলবে তাতে আর সন্দেহ কী?
আজ সেই জামশেদপুর থেকে তোজোর পিসি আর পিসাই এসেছেন ওদের বাড়িতে। দুপুরে সবাই ছাদে জড়ো হয়ে জমাটি আড্ডা দিচ্ছিল। রমাদি হয়তো ভুল করে বাড়ির পেছনের দরজাটা খুলে রেখেছিল। আর তাতেই বিপত্তি।
সারাদিন বাড়ির ভেতরে থেকে থেকে হয়তো জোজোর বাইরের পৃথিবী দেখার ইচ্ছেটা চাগাড় দিয়ে উঠেছিল। তাই সে বাইরের জগত পরিদর্শনে বেরিয়েছে। কিন্তু এটা যে সেনবাড়িতে ভূমিকম্প তৈরি করবে সেটা সে বেচারা বোঝেনি। জোজো যে বাড়িতে নেই সেটা প্রথম আবিষ্কার করে তোজো নিজেই।
সবার আড্ডার মাঝে জোজোর থাকা উচিত, এটা ভেবে সে রমাদিকে সঙ্গে করে ছাদ থেকে নিচে নেমে আসে। কিন্তু গোটা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও জোজোকে না পেয়ে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দেয়।
রমাদিকে ওপরে গিয়ে খবরটা দিতে হয়নি। তোজোর চিৎকারই সবাইকে নিচে নিয়ে আসে। জোজো নিখোঁজ সেটা বোঝার পর একসাথে বাপি, দাদু, কাকাই, পিসাই আর মা তাকে খুঁজতে বাইরে বেরিয়ে যান।
দিদুন তোজোকে শান্ত করবেন কী, তিনি নিজেই থেকে থেকে উপরের দিকে মুখ করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠছেন, “ঠাকুর, রক্ষে করো ঠাকুর। জোজোটার যেন কিছু না হয় ঠাকুর।”
আধঘণ্টা চিৎকার করার পর তোজো এবারে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। এর মধ্যে সে একবার পেছনের দরজা দিয়ে নিজেই বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু রমাদির তৎপরতায় তার সে উদ্দেশ্য সফল হয়নি। অবশ্য তার জন্য রমাদির হাতে আর গালে বেশ কয়েকটা আঁচড়ের দাগ এখনও জ্বলজ্বল করছে।
দুই
প্রায় সোয়া একঘণ্টা পর শ্রীতমার কোলে করে শ্রীমান জোজো বাড়ি ফিরলেন। বাড়ি ফিরতেই রমাদি জিজ্ঞাসা করল, “দিদিমণি, জোজো কতদূর গিয়েছিল যে এত সময় লাগল? তোমাদের এত দেরি দেখে আমরা তো ভেবেই অস্থির।”
জোজোকে কোলে আদর করতে করতেই শ্রীতমা উত্তর দিল, “আর বোলো না রমাদি। বদমাশটাকে রাস্তায় একা দেখে একজন কোলে তুলে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরছিলেন আর একে ওকে জিজ্ঞাসা করছিলেন যে এটা তাদের কি না। আমাদের বাইরে যেতে দেরি হয়েছিল। ততক্ষণ তিনি খানিক এদিক ওদিক খুঁজে ওর বাড়ির কোনও লোক খুঁজে না পেয়ে ওকে কোলে করে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছিলেন। ভাগ্যিস অর্ঘ্যকে রাস্তায় একজন বলল যে এক ভদ্রলোক কোলে একটা কুকুরের বাচ্চা নিয়ে সবাইকে তার মালিকের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করছেন। ওই ঝিল পাড়ের বিবেকানন্দ পার্কের কাছ থেকে ভদ্রলোককে আমরা পেয়েছি।”
“তা ভালো বাপু যে জোজো কোনও ছেলেধরার হাতে পড়েনি। ঠাকুর রক্ষা করেছেন।” কথাটা বলে অর্ঘ্যর মা রমলাদেবী এগিয়ে এসে জোজোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
“আহ্ মা, ওটা ছেলেধরা হবে কী করে? জোজো কি মানুষ যে ওকে ছেলেধরায় ধরবে?”
ছোটো ছেলে অর্পণের কথায় নিজের ভুলটা বুঝলেন রমলা। তারপর বললেন, “না মানে, ঠিক ছেলেধরা নয়, ওই যে টিভিতে দেখায় না যে বাড়ির কুকুর চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে! ওই ওদের কথা বলছিলুম আর কী।”
এতক্ষণে রথীনবাবু মুখ খুললেন, “আচ্ছা ঠিক আছে, আগে তোজোকে ডাক দেখি। বেচারা এতক্ষণে কেঁদে কেঁদে নিজের কী হাল যে বানিয়েছে কে জানে।”
“বাবা, তোজোকে আমি ওপর থেকে নিয়ে আসছি।”
কথাটা বলে অর্ঘ্য ওপরে গেলেন তোজোকে আনতে। কিন্তু পাঁচ মিনিট পরেই উদভ্রান্তের মতো নিচে নেমে এসে বললেন, “বাবা, তোজো ওপরে কোথাও নেই!”
“সর্বনাশ করেছে। তাহলে কি…” মুখের কথাটা শেষ না করেই রমাদি ছুটল পেছনের দরজার দিকে। এর আগেও তোজো ঝোঁকের বশে পেছনের দরজা খুলে একাই জোজোকে খুঁজতে যেতে চেয়েছিল। তখনকার মতো সে আটকেছে, কিন্তু এখন?
রমাদি যা ভেবেছিল ঠিক তাই হয়েছে। তোজোকে ওপরের ঘরে রেখে সে আর তনিমা দিদিমণি নিচে কিচেনে এসেছিল তোজোর ফেভারিট পাস্তা বানাতে। তনিমা দিদিমণিকে ওপরেই থাকতে বলেছিল, কিন্তু তিনি নিজে হাতে তোজোর পাস্তা বানাবেন বলে নিচে এলেন। তাছাড়া তোজোও কেঁদে কেঁদে তখন একটু ঘুমিয়েছিল। ঘুম ভেঙে কখন যে সে চুপিচুপি নিচে নেমে পেছনের দরজা খুলে জোজোকে খুঁজতে বেরিয়ে গিয়েছে সেটা তারা জানতেই পারেনি।
জোজোকে রমাদির কোলে দিয়ে এবার সবাই ছুটল তোজোকে খুঁজতে। তবে বেশিদূর যেতে হল না। বাড়ির পেছনের রাস্তার বাঁকটা ঘুরেই তোজোর সাথে দেখা। গোটা গায়ে কালিঝুলি মাখা তোজোকে দেখে সবার ধড়ে প্রাণ ফিরল। কিন্তু এ কী? তোজোর কোলে ওগুলো কী?
একগাল হাসি নিয়ে, গায়ে কালিঝুলি মেখে কোলে দুটো দেশি কুকুরের বাচ্চা নিয়ে তোজো গুটিগুটি পায়ে বাড়ির দিকেই ফিরছিল। আরেকটা বাঁক ঘুরলেই বাড়ি, কিন্তু তার আগেই সবাইকে সামনে দেখে তোজোর হাসিটা আরও চওড়া হল। শ্রীতমার দিকে তাকিয়ে সে বলল, “মাম, এই দেখো জোজোটাকে পেয়েছি। আর দেখো, এটা ওর বন্ধু। আমি দু’জনকেই নিয়ে এলাম। জোজোটা কী বদমাশ হয়েছে দেখো। গোটা গায়ে ধুলো মেখেছে।”
অর্ঘ্য কী একটা বলতেই যাচ্ছিলেন, কিন্তু রথীনবাবু ইশারায় মানা করে বললেন, “আগে ওকে বাড়ি নিয়ে চল। তারপর যা হবে দেখা যাবে।”
বাড়ি ফিরে জোজোকে দেখে তোজোর কান্না আর ধরে না। ততক্ষণে এটা তার কাছে স্পষ্ট যে তার কোলের বাচ্চাগুলোর কেউ জোজো কিংবা তার বন্ধু নয়।
এরপর বাড়িতে রীতিমতো গোলটেবিল বৈঠক বসে গেল। রমাদি আর দিদুন চুপ করে বসে থাকলেন। তোজো আর রথীনবাবু বাচ্চাগুলোকে বাড়িতে রাখার পক্ষে। বাড়ির আর সবার মতে ওই কুকুরে বাচ্চাদুটোকে তোজো যেখান থেকে এনেছে সেখানেই দিয়ে আসা উচিত।
বেশ কিছুক্ষণ পর রথীনবাবু বুঝতে পারলেন যে তোজোর দিদুনও বাড়ির অন্য সবার পক্ষে। শেষমেশ তিনিও যখন হাল ছেড়ে দেবেন ভাবছেন তখন বোমাটা ফাটাল তোজো নিজেই। এতক্ষণ সে অনুনয়-বিনয়, রাগ, জেদ সব অস্ত্র প্রয়োগ করেছে। এবারে সে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতেই সে বলে উঠল, “ওদেরকে কেন ফেলে দিয়ে আসবে তোমরা? ওদের মাম রাস্তায় মরে পড়ে আছে। একটা গাড়ি ওদের মামকে আর ওদের একটা ভাইকে চাপা দিয়ে দিয়েছে। ওদের বাপিও নেই। তাই তো আমি ওদের রাস্তা থেকে কোলে করে নিয়ে এলাম। আমি জানি তো যে ওরা জোজো বা জোজোর কেউ নয়। তাও নিয়ে এলাম। জোজোর তো মাম, বাপি, দাদু, দিদুন, কাকাই সব আছে। ওদের তো কেউ নেই। ওদের রাস্তায় ফেলে দিলে কে ওদের খেয়াল রাখবে? ওরা তো মরেই যাবে।”
কথাটা শেষ করেই তোজো ওই কুকুরের বাচ্চাদুটোকে কোলে তুলে নিয়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করল।
সবাই বাকরুদ্ধ। সবার চোখে জল। তাঁদের সবার আদরের তোজো কখন যে এত বড়ো হয়ে গিয়েছে সেটা কেউ বুঝতেই পারেননি। শ্রীতমা দৌড়ে গিয়ে তোজোকে জড়িয়ে ধরলেন। “কেউ ওদের কোথাও দিয়ে আসবে না বাবু। আমি কথা দিচ্ছি, জোজো যেমন আছে ওরাও থাকবে। তুমি আর কেঁদো না সোনা আমার।”
মায়ের আশ্বাসবাণীতে তোজো কান্না থামিয়ে জল চোখেই মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তাহলে চলো, ওদের স্নান করিয়ে পরিষ্কার করে দিই।”
সেই থেকে ওরা তিনজনেই থেকে গেল সেনবাড়িতে। জোজোর সাথে মিলিয়ে তোজো ওদের নাম দিয়েছে মোজো আর লোজো।
অলঙ্করণ শিমুল
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস
Bah bah darun! Khub Bhalo hoyeche. Notun kore JoJo adrishyo. Ei jaygaya pore ki hasi pelo..রমাদির গায়ে থুতু ছিটিয়ে দেওয়া 😁😁
LikeLike