আয় আয় ঘুম
লেখা সৌরাংশু ছবি ঈশান মিস্ত্রি
রাত্রির সময় যখন বাড়ির শিশুটি আহার করিয়াও ঘুমাইতে চাহে না তখন দিল্লির কোনো এক অঞ্চলের স্নেহপরায়ণ পিতা এই গল্পগুলি বলিয়া তাহাকে ঘুম পাড়াইয়া থাকেন। সেই শিশুটি বড় হইয়াও হয়তো এই গল্পগুলির মিষ্টতা ভুলিতে পারিবে না। আশা করি আমার ঝিলিমিলি পাঠক-পাঠিকার নিকটও এগুলি মিষ্ট লাগিবে।
সৌরাংশু
আমাদের ছোট্ট শুঁয়োপোকাটি
একটা শুঁয়োপোকা ডিম ফুটে বেরোবার পরপরই দুড়ুম করে পাতা ছিঁড়ে পড়ে গেল ঘাসের উপর। ঘাসের উপর ছিল ইঁদুরদের আনাগোনা। একটা কান-উঁচু কালো রঙের ইঁদুরকে দেখল আমাদের শুঁয়োপোকাটা। ভয়ের চোটে খচ মচ করে দুটো দুব্বোঘাসের মাথায় চড়ে কোনরকমে বাঁচল সে।
কিন্তু ইঁদুর থেকে বাঁচলেই তো হল না! সামনের বটগাছটার উপর ছিল একটা ছাইছাই কাক। সে খালি হৈচৈ করে আর খাইখাই করে। শুঁয়োপোকাটাকে ঘাসের উপর নড়তে চড়তে দেখেই সেই খচমচিয়ে ডানা ঝাপটে উড়ে এল। কিন্তু ঠিক ঠোঁটে তোলার আগের মুহুর্তেই দেখল, আমাদের ছোট্ট শুঁয়োপোকাটা ‘খুঁ’ ‘খুঁ’ করে কাঁদছে।
ছাইছাই কাক হৈচৈ করলেও তার মনে দয়ামায়া ছিল। তাই ছাইছাই কাক আমাদের ছোট্ট শুঁয়োপোকাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে র্যা? কাঁদছিস কেন তুই?’
ছোট্ট শুঁয়োপোকাটার খুব একলা লাগছিল। এমন সময় উপর থেকে কালো মেঘের মতো একটা বিশশাল কাককে উড়ে আসতে দেখে সে বুঝেই গেছিল, এই পৃথিবীতে তার প্রাণ এভাবেই বন্ধুহীন হয়ে চলে যাবে। তাই মনের দুঃখে কাঁদার মতো কিছু একটা হচ্ছিল তার। মনের ভিতরটায় বড় কষ্ট। কিন্তু কান্না কী সেটা সে বুঝত না।
ছাইছাই কাক কিন্তু সেটা বুঝতে পেরেই আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘ইসসস, মন খারাপ হয়েছে? তোর কোন বন্ধু নেই?’ ছোট্ট শুঁয়োপোকা তখনও কোন বন্ধু দেখেনি। তাই ছলছলে চোখ তুলে মাথা নাড়ল সে।
ছাইছাই কাকেরও মনে দুঃখ হল, তবে সে বলল, ‘দ্যাখ, আমি তোর বন্ধু হতে পারতুম। কিন্তু আমার আবার খাইখাই আর হৈচৈ না করলে চলে না। তুই বরং শনিবারের বাজারে বন্ধু খুঁজে নিস। না পেলে আমি তোর বন্ধু হব এক দুদিন নাহয়।’
সেদিনটা ছিল বুধবার। শনিবার আসতে বহুত দেরি। তাই বাজারের অপেক্ষা না করে সে বন্ধু খুঁজতে গেলো। পার্কের যে ঘাসজমি, সেখানে প্রচুর ইঁদুরের গর্ত। কালো কালো দামড়া দামড়া গেছো, মেঠো ইঁদুররা মস্তানি মেরে বেরায়। অসাবধানে একবার গর্তে পড়ে গেলেই কাণ্ড করবে।
আমাদের ছোট্ট শুঁয়োপোকার তো ভয়ডর নেই। কারণ তার বন্ধুও নেই আর কেউ বলেই নি ভয় কেন হবে। তাই সে পার্কের ঘাসজমির সবথেকে বড় গর্তটা বেয়ে নেমে চলে গেল ইঁদুরদের খাসমহলে।
ইঁদুরদের সর্দার ছিল একটা সাদা রঙের পেটমোট্টা আধচোখো জাম্বো মেঠো ইঁদুর। সে খালি ভসভসিয়ে ঘুমোতো আর ঘুম ভাঙলেই হুকুম চালাতো। আমাদের ছোট্ট শুঁয়োপোকাটা যখন সর্দারের সিংহাসনের সামনে সন্তর্পণে নামল, তখন সর্দার ভসভসিয়ে ঘুমোচ্ছে, আর বাদ বাকী ইঁদুরগুলো বিশাল অন্ধকার জায়গা জুড়ে ছুটে চলেছে। শুঁয়োপোকাটা ছোট্ট ছিল, সে ভয়ডর জানত না। তাই সে হঠাৎ গলা তুলে জিজ্ঞাসা করল, ‘এই তোমরা আমার বন্ধু হবে?’
ব্যাস ভসভসানো সর্দার হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়ল। আর দৌড়বাজ ইঁদুরগুলো খপ করে দৌড় থামিয়ে সক্কলে মিলে শুঁয়োপোকাটার দিকে মাথা তুলে তাকিয়ে থাকল, সামনের দুপা তুলে।
সর্দার ছিল মহা দাপুটে। সে গর্জন করে বলল, ‘এই থামলি কেন র্যা? শীতকাল আসছে না? থেমে গেলে ভাঁড়ারে খাবার মজুত করবে কে শুনি? আমি?’ সেই শুনেই সব কটা ইঁদুর আবার হুড়মুড়িয়ে ছুটতে শুরু করল।
সর্দার দাপুটে হলেও তার মনে দয়ামায়া ছিল। তাই তার বাকি থাকা চোখটা তুলে আমাদের ছোট্ট শুঁয়োপোকাটার দিকে তাকিয়ে সেটাকে টিপে বলল, ‘দেখছিস তো আমরা সবাই এখন ব্যস্ত। তুই বরং শীতকালের পরে আসিস। তখন আমি তোর বন্ধু হব এক দুদিন নাহয়!’
কিন্তু তখন ছিল সবে শরৎকাল। আমাদের ছোট্ট শুঁয়োপোকাটা ছোট্ট হলেও সে শরৎকাল আর শীতকাল বুঝত। তাই সে চলে গেল মাঠের ধারের আলপথ বেয়ে পাশের ব্যালকনির কাছে। যেখানে ডেঁয়ো পিঁপড়েদের দল লাইন দিয়ে ছুটে চলেছে।
একটু উঁচু মতো ঢিপির উপর উঠে সে গলা তুলে জিজ্ঞাসা করল, ‘এই তোমরা আমার বন্ধু হবে?’ কিন্তু ইঁদুরদের মতোই পিঁপড়েদেরও দাঁড়াবার সময় ছিল না। আর তারা শুনতেও পেল না। খালি ঢিবির নীচ থেকে একটা বড়সড় তেলাকুচো পোকা গলা বাড়িয়ে বলল, ‘ওরে তুই কে রে? পিঁপড়েগুলোকে জ্বালাস নে। ওদের রানিমশাই জানতে পারলে সব্বনাশের সীমা থাকবে না।’
আমাদের ছোট্ট শুঁয়োপোকাটা ছোট্ট হলেও সব্বনাশের সীমা সম্পর্কে একটা অস্পষ্ট ধারণা রাখত। তাই সে আবার গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেল সামনের ফুলগাছগুলোর দিকে।
শরতের সোনা রোদে সেখানে শিউলি ফুল ফুটে রয়েছে। তারই একটা গাছের নিচে দেখল, একটা ইয়াব্বড় তারই মতো দেখতে কিছু, ডানা মুড়ে ঝিমুচ্ছে। আমাদের ছোট্ট শুঁয়োপোকাটা তার কাছাকাছি আসতেই সে ডানা খুলে উঠে দাঁড়াল। আহা কি সুন্দর তার ডানা। লাল আর কালোয় নকশি কাটা। মাঝে মাঝে আবার সুন্দর সাদা সাদা ছিট ছিট। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমার নাম ওঙ্কারনাথ প্রজাপতি। এই গাছটায় আমার ইস্কুল। তোর নাম কী?’
ছোট্ট শুঁয়োপোকাটা সেই যে গাছ থেকে পড়ে গেছিল কিনা। তাই তার নামকরণ হয়নি। কিন্তু ওঙ্কারনাথ বলল ঘাবড়াবার কিছু নেই। আর স্কুলে ভর্তি করে দিল। আমাদের ছোট্ট শুঁয়োপোকাটা গাছ বেয়ে উপরের ডালের কাছে পৌঁছতেই একটা লম্বু শুঁয়োপোকা আর একটা পেটমোট্টা শুঁয়োপোকা ওকে স্বাগত জানাল। লম্বু বলল তার নাম অমিতাভ পঁচপন। আর মোট্টু বলল সে খরাজ মুখোটি। তারপর তারা দুজন আদর করে ছোট্ট শুঁয়োপোকাকে বেশ দশ বারোটা পাতার একটা ডালে থাকতে দিল। শুঁয়োপোকাটা সারাদিন সারারাত ধরে পাতা খেয়ে ইয়াম্মোট্টা আর লম্বু হয়ে গেল। তারপর রবিবারের বাজারে বাকি শুঁয়োপোকাগুলোর মতো নিজের লালা জড়িয়ে পিউপায় ঘুমোতে চলে গেল।
শেষে একদিন বসন্ত কালে পিউপার জাল ছিঁড়ে প্রজাপতি হয়ে বেরিয়ে এল। আর দেখল তার বন্ধুরাও প্রজাপতি হয়ে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে।
ও হ্যাঁ। সে তো আর ছোট্ট শুঁয়োপোকাটি নেই আর। তাই সে জানে যে বাকি প্রজাপতিগুলো তার বন্ধু। আর সেই ছাই ছাই কাকটাও একদিন এসে ওঙ্কারনাথের কাছে গার্জেন হিসাবে ছোট্ট প্রজাপতির নাম লিখিয়ে দিয়ে গেছে। নামটিও ভারী সুন্দর তার। তাই তার হলুদ আর বেগুনি রঙের ছিটকাটা ডানা মেলে উড়তে উড়তে নিজের নামটা মনে মনে বারবার বলে উঠল সে।
Khub bhalo legeche.anja lekha dui i
LikeLike