আয় আয় ঘুম
লেখা সৌরাংশু ছবি ঈশান মিস্ত্রি
রাত্রির সময় যখন বাড়ির শিশুটি আহার করিয়াও ঘুমাইতে চাহে না তখন দিল্লির কোনো এক অঞ্চলের স্নেহপরায়ণ পিতা এই গল্পগুলি বলিয়া তাহাকে ঘুম পাড়াইয়া থাকেন। সেই শিশুটি বড় হইয়াও হয়তো এই গল্পগুলির মিষ্টতা ভুলিতে পারিবে না। আশা করি আমার ঝিলিমিলি পাঠক-পাঠিকার নিকটও এগুলি মিষ্ট লাগিবে।
কোকিলের সঙ্গে কাকের খুব ঝগড়া হয়েছে। কোকিল কাকের বাসায় গিয়ে ডিম পেড়ে এসেছিল। কাক তার নিজের ডিমগুলোর সঙ্গে কোকিলের ডিমগুলোকেও যখন তা দিচ্ছিল, তখন কোকিল এ ডাল ও ডাল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে বেরিয়েছে। তারপর যেদিন বাচ্চাগুলোর কথা ফুটেছে, চোখ ফুটেছে সেদিনই কোকিল এসে হাজির হয়েছে হিসেব বুঝে নেবার জন্য। কাকও বুঝতে পেরেছে কোকিল আদ্যন্ত স্বার্থপর। তাই তাকে ভাগিয়ে দিয়েছে নিজেদের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে।
কোকিল শিল্পী মানুষ, সে ঠিক করে গানটাই গাইতে শিখেছে। সংসার চালানো তার ক্ষমতার অধিক। এতদিন কাকের কাঁধে বন্দুক রেখে চালিয়ে আসছিল। এখন তিনটে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে পড়েছে মুশকিলে।
সে যাই হোক। কোকিল শিল্পী মানুষ, ঠিক একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই জোগাড় করে নিয়েছে কাকাতুয়াদের অ্যাপার্টমেন্টে। কাকাতুয়া আর তোতাপাখির সেখানে হুকুম চলে। তারা অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার আগে ইন্টার্ভিউ নেয়। কোকিলেরও নিচ্ছে।
কোকিলকে কাকাতুয়া জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কী করো?”
তোতাপাখিটা, কাকাতুয়া যাই বলে, তাই রিপিট করে। সেও জিজ্ঞাসা করল, ‘হ্যাঁ হে! তুমি কী করো?’
কোকিল ভাবতেই পারেনি যে তার গান কেউ শোনেনি। তবুও যতটা সম্ভব বিনয় নিয়ে বলল, “এই একটু গানটান করি!”
কাকাতুয়া বলল, ‘ব্যাস?’ তোতাও বলল, ‘ব্যাস?’ কোকিল চমকে গিয়ে ঘাড় নাড়ল, ‘হ্যাঁ’।
কাকাতুয়া বলল, ‘আচ্ছা কর দেখি গান!’ তোতাও রিপিট করল। কোকিলের তখনই কাকের কথা মনে পড়ল। কাক সত্যিই কোকিলকে ভালোবাসত। কোকিল গান গাইলে কাক রান্নাবান্নার দিকটা দেখত। কোকিলকে গান গাইতে উৎসাহ দিত। উৎসাহ মানে জানো? কাক বলত, ‘ভালো হয়েছে, কিন্তু আরও ভালো করতে হবে!’ এটাকেই বলে উৎসাহ দেওয়া। এমন কি আর পাঁচজনকে বলতোও যে কোকিল কত ভালো গান গায়। তার তুলনায় এরা তো কিসসু জানে না।
তবু কোকিল গান ধরল, মন দিয়েই। শুরুতে আলাপ, তার পর বিস্তার, তারপর তান ধরে শেষ করল। চারিদিকে যেন বসন্ত কাল এসে গেল, গাছে পাতা ফুল দেখা দিতে শুরু করল, সোনা রোদ ঝিকমিকিয়ে উঠল এতো মধুর সুরের গান শুনে।
কোকিল গান শেষ করে চোখ খুলে দেখল, কাকাতুয়া গম্ভীর! দেখাদেখি তোতাপাখিও গম্ভীর! কাকাতুয়া নিজের ঝুঁটি চুলকে বলল, ‘মন্দ না। তবে তুমি বাপু আমাদের মোরগের কাছে গানটা ভালো করে শিখে নিও। সূর্য ঠিক ওঠার আগের মুহুর্তে, ‘কোঁক্কড় কোঁ’ করে কি দারুণ গমক দিয়ে গান ধরে! আহ!’
তোতাপাখি অত কিছু মনে করে বলতে পারল না, কিন্তু সেও বলল, ‘আহ! মোরগের কাছে ভালো করে শিখে নিও!’
কাকাতুয়া আরও বলল, ‘গিটকিরিটা আমাদের পাশের পাড়ার ধোপার গাধাটাও ভালো জানে! ওর কাছেও শিখতে পারো।’ তোতাও বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ গাধার কাছেও শিখতে পারো।’
কোকিল যারপরনায় চমকে গেল। আরও বেশি করে কাকের কথা মনে পড়ল। আহা কাকটা কোকিলকে গান গাইতে উৎসাহ দিত। উৎসাহ মানে জানো? কাক বলত, ‘ভালো হয়েছে, কিন্তু আরও ভালো করতে হবে!’ এটাকেই বলে উৎসাহ দেওয়া। এমন কি আর পাঁচজনকে বলতোও যে কোকিল কত ভালো গান গায়। মোদ্দা কথা গুণীর কদর করত। সেই তুলনায় এখানে তো…
আর কিছু মাত্র না ভেবে কোকিল কাকের কাছে গিয়ে হাজির হল, নিজের দুই ডানা দিয়ে নিজের না দেখতে পাওয়া কান ধরে বলল, ‘খুব ভুল করেছি কাক ভাই। তোমাকে ওভাবে ঠকানো আমার উচিৎ হয়নি! আসলে আমি তো সংসারের কাজটাজ পারি টারি না। কিন্তু তবুও ওটা আমার খুব অন্যায় কাজ হয়েছে!’
কাক সত্যিই কোকিলকে ভালবাসত। বাজে কাজ করলেও কোকিলের চলে যাওয়াটা সেও মেনে নিতে পারছিল না। তাই দুই ডানা দিয়ে কোকিলকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ওরে তোকে ছাড়া আমারও তো মন খারাপ হচ্ছিল। কিন্তু তুই কি একবারও বলতে পারতি না যে আমার ছানাটাকেও মানুষ করে দাও! আমি কি বারণ করতাম?’
কোকিল তখন নিজের ঠোঁট মুলে, নিজের না দেখতে পাওয়া কান মুলে বলল, ‘না কাকভাই এবার থেকে এ ভুল আর কক্ষনোও করব না।’
কাকও তখন কোকিলের তিনটে ছানাকে কোলে নিয়ে ঘরে তুলল, পিছন পিছন বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে কোকিলও এলো। বাক্সের মধ্যে অবশ্য তানপুরা টুরাই বেশি ছিল।
সে যাক কাক আর কোকিল তারপর থেকে মিলে মিশেই থাকত। কোকিলও ডিম পাড়ার সময় কাককে জানিয়ে দিত, ‘এই পূবের দিকের আদসাদা ডিমগুলো আমার কিন্তু!’ কাকও একই রকম যত্নে নিজের আর কোকিলের ডিম তা দিত। শুধু বাচ্চাগুলোর চোখ ফুটে যখন বোল ফুটত, তখন একটু যে মন খারাপ হত না তা নয়। তবে সেসব বিষয়ে কোকিল খেয়াল রাখত। বাচ্চাগুলো কোকিলের সঙ্গে সঙ্গে যাতে কাককেও ‘মা’ বলে ডাকে তা নিশ্চিত করত। ওহো নিশ্চিত মানে জানো না। তাহলে আর কি! এই অবধিই থাকুক!
ও আরেকটা কথা কোকিল আর কাকের কানে এসেছে কাকাতুয়ারা একটা মিউজিকাল ও আর্ট কলেজ খুলেছে। সত্যিকারের সঙ্গীত ও কলার শিক্ষা দেবার জন্য!