উপন্যাস পানডুবরা শাশ্বত কর শরৎ ২০১৯

শাশ্বত কর

অবাক কাণ্ড

গোটা মামার বাড়িটাই বিস্ময় মাখানো! যেখানে তাকাবে, সেখানেই অবাক করা কিছু ঘটছে। নয়তো তোমাকে চুপ করিয়ে দেবার মতো কিছু একটা হয়েই রয়েছে। এই ধরোই না, আমি এখন যে দাঁড়িয়ে রয়েছি দাদুতুতুদের ঘরের পাশে, আমার সামনে ফাঁকা জমিটায় অদ্ভুত সব কাণ্ড হয়ে চলেছে! অত্ত বড়ো জমিটা ভর্তি জংলা গাছ। না, একটু ভুল হল। ওখানে ওই যে একটা শুঁটকো কাঁঠাল গাছ, ওটা মামার লাগানো। বাকিগুলো জংলা। সে যাই হোক, ওখানটায় এখন জঙ্গলটা তোলপাড় হচ্ছে! নিশ্চয়ই কোনও জীবজন্তু আছে। নইলে ঢোলকলমির ঝাড়টা অমন নড়বে কেন? কচুর বনে অমন বেমক্কা তোলপাড়ই বা হবে কেন? আছে কিছু বেশ বুঝতে পারছ, কিন্তু সঠিক করে মালুম করতে পারছ না। বলো, অবাক হবে কি না?

এই জংলা জমিটা আর বাড়ির মাঝখানে তফাত টেনেছে প্রায় পাঁচ নম্বরের ফুটবলের সাইজের ঝুলন্ত লেবু্র পুরনো বাতাবিগাছটা। ফুলন্ত বাতাবির গন্ধ পেয়েছ কোনও দিন? উফ! সে যা মিষ্টি না! বাতাবির ফুল ফুটলেই ম ম করে। তখন দিদিদি খালি বলে বেড়ায়,

“বুঝলে নটি,

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া

ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া

একটি ধানের শীষের উপরে একটি শিশির বিন্দু!”

এর পাশেই একটা কাঁচা-মিঠা আমের ধামসা গাছ। গোড়ার মাটি ছেয়ে লিলির ঝাড়, আর একটা ইউক্যালিপটাস গাছ। বাবা বলে মহাক্যালিপটাস। এটাও একটা বিস্ময়। ইয়া লম্বা! ঘাড় ব্যথা হয়ে যায় দেখতে গিয়ে। মনে হয় যেন আকাশটা ঢেকে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গাছটার নিচের দিকের গা বাদামি আর উপরের দিকের গা পুরো গাওয়া ঘিয়ের রঙের। ওর গা থেকে একটা গন্ধও বেরোয়! আমি তো পাই। গরমের ছুটিতে এসেছিলাম যখন, কালবোশেখির তাণ্ডবে দুটো ডাল মড়মড়িয়ে ভেঙেছিল। চারদিকে তখন ইউক্যালিপটাসের গন্ধ। মনে হয়েছিল, ও বোধহয় ব্যথা পেয়ে গন্ধ ছড়িয়ে কাঁদছে। হতেই তো পারে, বলো! আমারও তো কত বন্ধু আছে, যারা ইশকুলে অদ্ভুত-অদ্ভুতভাবে কাঁদে। আর গাছেরও যে ব্যথা-বেদনা আছে সে তো কবেই আচার্য বসু বলে গেছেন!

সেই মহাক্যালিপটাসের গোড়ায় জড়িয়ে পেঁচিয়ে আছে পাইরেট শিপের নোঙরের মোটা মোটা কাছির মতো একটা লতা। তার এই বড়ো বড়ো ছেঁড়া ছেঁড়া পাতা। কোনওটার আবার মাথাটা মোড়ানো। দিদিদি বলে, ওটা মানিপ্ল্যান্ট। আমি বিশ্বাস করতে পারি না। আমাদেরও মানিপ্ল্যান্ট আছে। ব্যালকনিতে। লতানো বটে, কিন্তু এমন দৈত্যর মতো তো নয়। আমি ঠিক জানি এটা সেই জাদু বিনের গাছ। বেয়ে বেয়ে উঠতে পারলেই সেই দৈত্যপুরী! টেবিলের উপর সেই সোনার ডিম পাড়া মায়া মুরগি! অনেকদিন ওঠার চেষ্টাও করেছি। কিন্তু পাতা-নাতা ছিঁড়ে ধাই ধপাস হওয়া ছাড়া আর কিছুই বরাতে জোটেনি।

এখানটা থেকে এবার যদি একটু এগিয়ে যাও; না, না! গেট অবধি যেতে হবে না। তার খানিক আগেই ছোটো কৃষ্ণচূড়াগাছটার পাশে গিয়ে দাঁড়াও। খুঁজে পাচ্ছ না বুঝি? কৃষ্ণচূড়াগাছটা নামেই কিন্তু ছোটো। লম্বায় আমার মতো সতেরো জন তো হবেই! ওর পাশেই দেখো ভাঙা ভাঙা বড়ো গোল টবটায় একটা গাছ আছে। ঝিরি ঝিরি পাতাগুলো ছুঁয়ে দাও। ব্যস! দেখলে! কেমন বুজিয়ে নিল না পাতাগুলো! ও হলো লজ্জাবতী। আমার এখন আর অবাক লাগে না। বুঝে গেছি ও কেন এমনি করে। ও আসলে আমার মতো। আমিও তো অচেনা লোক দেখলে বেশ লজ্জা পাই। সবসময় হয়তো আমায় দেখে বুঝতে পারবে না, কিন্তু আমি তখনও বেশ লজ্জা পাই। ট্রেনে আসবার সময় যখন কেউ আমায় কোলে টানে, আমারও অমন গুটিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। পারি না। কিন্তু কথাও বলি না। বাবা বলেন, “বাবু, উত্তর দাও। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে তো উত্তর দিতে হয়।”

উঁহুহু বাবা! ও-ভুল আর করব না। উত্তর দিই, আর তারপর প্রশ্ন বাড়ুক—‘নাম কী খোকা, কোথায় থাকো, কোন ক্লাস, কোথায় যাচ্ছ, সেখানে কে আছে…’

উফ! বরাত খারাপ থাকলে বলা যায় না আবার ছড়াও বলতে হতে পারে! তার চে’ বাবা চুপ করে থাকি। কাচের জানলা দিয়ে বাইরে দেখি। কত কী দেখা যায়! আগে কখনও দেখিনি এমন কত কিছু! হাঁ করে তাকিয়ে থাকি। এই তো আগের বার আসার সময় দেখেছিলাম ধু ধু করছে মাঠ। বোধহয় ফসল যা ছিল কাটা হয়ে গেছে। কতক জায়গায় গরু-ছাগল-ভেড়া চরছে। আর দূরে, অনেক দূরে মাঠ আর আকাশের মাঝখানের রেখা বরাবর ধোঁয়া উঠছে। অনেকটা জায়গা থেকে। কী পোড়াচ্ছে কে জানে!

মা বলল, আগাছা পোড়াচ্ছে চাষিরা। আর বাবা বলল, নাড়া। নাড়া মানে ফসল কাটার পরে যা পড়ে থাকে সেগুলো। সে যাই পুড়ুক, দেখতে কিন্তু দারুণ লাগছে! আইসক্রিমের শেপের ধোঁয়ার নিচের দিক সাদা আর উপরের দিক কালো। খানিক উঁচুতে উঠে থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। যেন কেউ লক্ষ্মণ গণ্ডী কেটে দিয়েছে, ওর উপরে আর ওঠা মানা। তাই সে দাগের কাছে এসে সাদা ধোঁয়াগুলো মুখ ভার করে কালো হয়ে আছে।

এই ধু ধু মাঠটাই আবার শীতের সময় ভরে থাকে হলুদ ফুলে ফুলে। সেসময়ও কয়েকবার দেখেছি। কী অদ্ভুত! এই খালি তো এই ভর্তি! অবাক কাণ্ড! একবার ট্রেনটা ক্রসিংয়ের জন্যে দাঁড়িয়ে গেছিল এইরকম একটা মাঠের সামনে। কেমন সুন্দর হলুদ ঢেউ তখন ফুটে উঠেছে মাঠে! ঢেউটা একদিক থেকে উঠছে আর বয়ে বয়ে আরেকদিকে চলে যাচ্ছে। বাবা ক্যামেরায় তুলেওছিল ভিডিওটা।

ট্রেনের ভিতরেও কী কম কিছু বিস্ময়! বাঙ্ক ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঘুমোয় কত লোক! ঘাড়টা ঘুমে ন্যাতাপ্যাতা হয়ে কাঁধে ঢলে পড়ে। ট্রেনও দোলে, মাথাও দোলে। তলতলিয়ে দোলে বটে, কিন্তু পড়ে যায় না। এক খেলনাকাকু কীসব অদ্ভুত খেলনা নিয়ে ওঠে। খেলনা তো কতই দেখেছি, অমন খেলনা ওর কাছে ছাড়া আর কোত্থাও পাওয়া যায় না। কোনওটা মাটির, কোনওটা পাতার, কোনওটা কাগজের আবার কোনওটা যে ঠিক কীসের তৈরি, বুঝতেই পারি না! আর সেই খেলনাকাকু ট্রেনে উঠেই এমন সুরে গান গায়, যে গানের কথা-টথা সবটা বুঝতে না পারলেও হাসি ভুক ভুক করে বেরিয়ে আসে পেট থেকে।

আরও একজন আছেন। তাঁর কথা বলতেই হবে। তিনি তো প্রায় ম্যাজিসিয়ান! এমনিতে অবশ্য নানান মাপের চিরুনি বিক্রি করেন। একটা বড়ো চিরুনি বার করেন প্রথমে, তারপর সেটা ঘুরিয়ে আরেকটা, তারপর সে দুটোকে ঠুকে আরেকটা… এমনি করে পাঁচটা বানিয়ে তারপরে বেচেন! দেখতে দেখতে মুখটা হাঁ হয়ে যায়, আর অমনি মা মুখে বিস্কুট, নয়তো কেকের টুকরোটা ঢুকিয়ে দেয়। তাকালেই চোখ ঘুরিয়ে হাসে।

এই যে আমার মা, ইনি তো আগাগোড়া বিস্ময়ের! বাড়িতে যতক্ষণ, ততক্ষণ মায়ের রূপ একরকম, এই বকছে, ওই পড়াচ্ছে। এই এটা কোরো না ওটা কোরো না বলছে, ম্যাজিকের মতো বুঝে যাচ্ছে ইশকুলে কী কী দুষ্টুমি করেছি। কিন্তু এই মাকেই মামাবাড়ি যাবার সময় দেখো, কেমন বদলে গেছে! বকাঝকা স্টপ! বরং আদর করছে, কত গল্প বলছে মামাবাড়ির—দাদুদের ছোটোবেলার, নিজের ছোটোবেলার—কত্ত সব মজার মজার ঘটনা! মামাবাড়িতেই মাকে বেশি মানায়, জানো? কেমন সুন্দর সেজেগুজে থাকে! কোনও কিছুর জন্যে হুড়োহুড়ি করে না। বকেও না।

অবশ্য বকবেই বা কেমন করে? আম্মা, দাদানদা আছে না! ওরা তো মায়েরও মা-বাবা। তারপর আছে দিদিদি, ছোদ্দিদি, দাদুতুতু, সোনামা, মেজোদাদু, মামণি, টোকাটুলি, রাঙামানি, ছোদ্দাদা, মানি—কত্ত দাদু-দিদা আমার! ওরা সবাই মায়ের কাকু-কাকিমা আর পিসিমণি। আমাকে একটুও বকা খেতে হয় না। একটু বকলেই সব্বাই মিলে মাকে বকে দেয়।

বলছিলাম না, পুরো মামাবাড়িটাই বিস্ময়ের? কেন বলছিলাম শোনো। যদি তুমি বাইরের বড়ো লোহার গেটটা ঠেলে একবার ভিতরে ঢুকে আসো না, নিজে-নিজেই বুঝে যাবে। রাস্তার দু’ধারে শুধু বড়ো বড়ো গাছ। কৃষ্ণচূড়া, বকুল, নিম, অশোক, বোগেনভেলিয়া (বাবা বলেছে, ওর বাংলা নাম নাকি বাগান বিলাস), পেয়ারা, কাঁঠাল, কুল, লিচু আরও কত কী! আর কত্ত রকম ফুল! কত্ত সব রং! কত্ত সব পাখি তাদের ডালে ডালে! কত্ত রকম তাদের ডাক! চাও কি তুমি ভ্যাঙাতেও পার। ঠিকঠাক ভ্যাঙালেই দেখবে সেই পাখিটা উত্তর দেবে।

আরেকটা অদ্ভুত জিনিস আছে। পুকুরপাড়ে। একটা হেলে পড়া খেজুরগাছের গা থেকে একটা বট না কী অশ্বত্থগাছ। কেমন লতিয়ে-পেতিয়ে এক হয়ে গিয়ে তারপর সোজা উঠে নিজের ডালপালা মেলেছে! দীপমামা দেখিয়েছিল একদিন। ওটা আমি যত দেখি ততই অবাক হই। কেমন করে হতে পারে!

বাড়িময় শুধু ফুল আর ফুল! গোলাপ ঝাড়ে ফুল, জবা ঝোপে ফুল, লতিয়ে থাকা তরুলতায় মিষ্টি ম্যাজেন্টা রঙের ফুল, মাঠের আগাছার ঝোপে ফুল, পুকুরপাড় জুড়ে জ্যাবোর‍্যান্ডির ঝোপময় ফুল, আপন-জালা নয়নতারায় ফুল, এমনকি টবে রাখা বিচিত্র আকারের ক্যাকটাসগুলোতেও ফুল! পেয়ারা-ডালে বাঁশের টুকরোয় পেঁচানো নারকেল দড়ি থেকে অর্কিড ঝোলে, সেগুলোতে বেগুনি রঙের আর ম্যাজেন্টা রঙের ফুল। রেলের জমির জংলা গাছগুলোও সব ফুলে ফুলে ভরা। আর প্রজাপতিও কতরকম রে বাবা! আমাদের বাড়ির ওখানেও তো মাঝেমধ্যে প্রজাপতি দেখি, সে এত্ত রকম বাহারের নয়! কত্ত রকম যে তাদের রঙ! কত্ত রকম যে নকশা আঁকা ডানা! ওদের ফুলের উপর বসে মধু খাওয়ার ধরন দেখলে, আমি জানি, তুমিও অবাক হবে।

মামাবাড়ির যে পাশটায় রেললাইন, সেদিকের ফাঁকা জমিটায় পুজোর সময় কাশফুল ফোটে। কখনও কাশফুলের উপর দিয়ে হাওয়া বইতে দেখেছ? আমার তো কাশফুল ফুটলে মনে হয় যেন সার সার সান্টাক্লস এসে দাঁড়িয়ে আছে পুজো দেখবে বলে, আর হাওয়ায় তাদের ঘাড় নড়ছে দিদিদির মতো। দিদিদির ঘাড়টা এখন দেখি মাঝে মাঝে একা-একাই নড়ে! মা বলে, মায়ের ঠাম্মারও নাকি এমনি হত। আর দিদিদি তো সেই ঠাম্মারই মেয়ে। তবে তো এমনি হতেই পারে, বলো?

মা বলে, মায়ের ছোটোবেলায় নাকি বাড়িটা আরও সুন্দর ছিল। ছোদ্দিদি বলে, ছাদে উঠে উত্তর-দক্ষিণে  যতটা চোখ যায়, তার সবটা আগে নাকি এই বাড়ির সাথেই ছিল। তখন মায়ের দাদা বেঁচে ছিলেন। এখন যেখানে বাবলার ঝাড়, আগাছার বন, তখন সেখানে ফসলের ক্ষেত ছিল। আমার ভারি অবাক লাগে, তখন হত, তবে এখন হয় না কেন?

মা বলে, দাদা নাকি দেশের জন্যে লড়াই করেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী। জেলও খেটেছেন! আর স্বাধীন হবার পর হোমের সুপার ছিলেন। তারপর এই বাড়ি। সবাই বলত হোমের সাহেবের বাড়ি।

গাছগুলো কেমন ঝুঁকে আছে দেখেছ, পুকুর পাড়ে! গায়ে কতসব লতা আর লম্বা লম্বা ফল। ওগুলো তিতপটল। এখন তো দেখতে বেশ ভালোই লাগছে, সন্ধে হয়ে এলেই দেখবে ওরা কেমন বদলে যাবে! রাজ্যের অন্ধকার এসে জড়ো হবে লতাগুলোর গায়ে। থোকা থোকা অন্ধকার ঝুলবে তখন গাছ থেকে। বাবা বলে, ওগুলো নাকি ভূতের দাড়ি! হতেও পারে। বাবা খুব একটা ভুল কিছু তো বলে না!

দোতলার ল্যান্ডিংয়ের জাফরিটার ওই পারে একগাদা পাতা-নাতা দিয়ে কাঠবিড়ালি ঘর বানিয়েছে। আম্মা দুপুরে ওদের ভাত খাওয়ায়। পাঁচিলের ওপর ভাত মেখে দেওয়ার সাথে-সাথেই চারটে কাঠবিড়ালি আমড়াগাছের ডাল ঝুলে নেমে আসে। লেজ চেপে বসে সামনের দু’পায়ে ধরে সে কী ভঙ্গি খাওয়ার! আর কিচকিচিয়ে কতসব কথা! ওরা খেয়ে যাবার পর খেতে আসে একটা কুবো পাখি। আম্মা ওকে বলে ইন্সপেক্টর। তার পরে আসে একটা ডাহুক। আম্মা ওকে কোনওদিন বলে উকিলবাবু, কোনওদিন বলে লাজুকলতা, আবার কোনওদিন বলে দুয়োরানি। এদিক ওদিক দেখে কেউ ওকে খেতে দেখল কিনা। যেই কেউ কোত্থাও নেই, অমনি একটু ভাত ঠোঁটে তুলেই সরে যায়, যেন খায়নি কিছুই অথবা খাওয়াটা যেন সাংঘাতিক কিছু অপরাধ। হাবভাবগুলো দেখলে বেশ মজা লাগে। ওর খাওয়া শেষ হতে না হতেই কোত্থেকে বিড়ালটা লাফিয়ে এসে হাজির হয়, অমনি তার কী চোঁ-চাঁ ছুট! বিড়ালটার কাণ্ড দেখো, নিজে আদ্ধেক দিন কিচ্ছুটি খায় না, কিন্তু হামলে পড়ে অন্যদের খাওয়া মাটি করে। অবিশ্যি ইন্সপেক্টরের সাথে নাকি পারে না। আম্মা বলে, একেকদিন এমনি তাড়া লাগায় ইন্সপেক্টর, যে বিল্লিমাসি পালাবার পথ পায় না।

একদিন ওইখানেই তো চ্যাঁ-চ্যাঁ-চিঁইই শব্দ শুনে বাবাকে ধরে এনেছিলাম। বাবা শুনে বলল, সাপে ব্যাঙ ধরেছে। সাপ ধরলে ব্যাঙের ডাক এমনি বদলে যায়। কী আশ্চর্য! বাবা বলল, গোটা পৃথিবীটাই নাকি এমন সব আশ্চর্যে ভরা। যত বড়ো হব সব নাকি জানতে পারব। পিরামিড জানতে পারব, তুর্কমেনিস্তানের নরকের দরজা জানতে পারব, কানাডার আব্রাহাম লেকে বরফের বুদবুদ হয় জানতে পারব, ফারাফ্রার সাদা মরুভূমি জানতে পারব, ভয়ংকর ভয়ংকর সব আশ্চর্য প্রাণী, আদিবাসীদের তৈরি অদ্ভুত সব আধুনিক যন্ত্রপাতি, ওদের সভ্যতা, সব জানতে পারব। বাবার কাছে যখন শুনি, মনে হয় একবার গেলেই তো হয় উরুবাম্বা নদী উপত্যকার উপরে, আন্দিজ পর্বতে। কী যেন নাম? মাছুপিচু না কী একটা যেন! সেখানে আড়াই হাজার মিটার উঁচুতে নাকি ইনকা সভ্যতার অবাক করা সব পাথুরে দেয়াল! ইনকারা নাকি সূর্যদেবের পুজো করত। অথবা যেতে পারি সেই ইস্টার আইল্যান্ড, যেখানে কিনা আগ্নেয়গিরি ভরা উপত্যকায় ন’শোটা মোয়াই!

বাবা এতকিছু জানে আর হনুমান যে দাঁত খিঁচিয়ে তাড়া করে এটা জানে না! সোনামার কাছে কিন্তু এই হনুবীররা পুরো টাইট। লিচুগাছের মাথাটায় যখন তেনারা হুপহুপিয়ে নাচেন, নয়তো লঙ্কাগাছের অথবা পেঁপেগাছের মাথা মটকান, সোনামা ‘অ্যাইই’ করে এইসান বকা দেয় না, যে দুদ্দাড় করে সব পালায়। কিন্তু এই হনুরাই বাবাকে যাকে বলে একেবারে মোক্ষম হনু-তাড়া করেছিল। সত্যি! এই তো ঠিক এইখানেই। বাবার সে কী ছুট! ঘ্যাঁক করে কী এক শব্দ করে সেই যে পাঁই পাঁই ছুটল, তারপর কোথায় যে গেল কে জানে। আর আসে না, আর আসে না, শেষে দাদানদা গিয়ে কোত্থেকে যেন নিয়ে এল। কই, দাদানদাকে তো হনুমান কিছু করল না! বাবা কি তাহলে আমার মতো ঢিল-টিল কিছু ছুড়েছিল!

এই শোনো, আমি যে মৌচাকে গুলতি দিয়ে ঢিল ছুড়েছি, সে কিন্তু এখনও কেউ জানে না, বুঝলে? আসলে ব্যাপারটা কী হয়েছে, বকুলগাছটায় তো একটা চাক হয়েছে। এই এত্ত বড়ো! ছোদ্দিদি দেখিয়ে বলেছিল, “খবদ্দার নটি! বেশি কাছে যেও না যেন, বিরক্ত করলে কিন্তু ওরা বোঁওও করে তাড়া করবে আর কামড়াবে। তখন হয় এই ভ্যাপসা গরমেও কম্বল মুড়ি, নয়তো ওই এঁদো ডোবায় ডুব। এ ছাড়া বাঁচার আর কোনও পথ পাবে না!”

শোনার পর থেকেই মনটা কেন যেন ওখানেই পড়ে আছে। কাজেই সবাই যখন খাবার টেবিলে গপ্পো করছে, গুলতি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি। বেরিয়েই দেখি দুটো বেজি আড়াআড়ি রাস্তা পার হচ্ছে। আমায় দেখে দাঁড়াল, গোল্লা গোল্লা চোখ করে দেখল। তারপর বাচ্চাদুটো আসতেই সবাই মিলে সরসরিয়ে নেমে গেল জঙ্গলে। আমিও অমনি মাটি থেকে ঢ্যালা নিয়ে গুলতি দিয়ে উপরে ছুড়লাম। লাগল না। আবার। চাকের পাশ দিয়ে কানঘেঁষা হয়ে বেরিয়ে গেল। এক চোখ বন্ধ করে তাক করলাম। এবার লাগল চাকের একটু দূরে, ওই ডালেই। তাতেই দেখি মৌমাছিগুলো চৌকন্না হয়ে গেছে। ভনভন করে উড়ছে। এদিকে আসছে কয়েকটা। ওরে বাবা! যেন মিসাইল! ছুট ছুট! একদম খাওয়ার ঘর।

যে ডোবাটার কথা ছোদ্দিদি বলেছিল, তার থেকে একটু দূরেই কয়েকটা লম্বা লম্বা তালগাছ আছে। ওখানে বাবুই পাখির বাসা ঝোলে। আমি হাঁ করে দেখি। কেমন করে বোনে এত সুন্দর বাসা! ওইটুকু তো ঠোঁট! মেজোদাদু বলে, ওরা নাকি জোনাকি দিয়ে বাসায় আলো জ্বালে!

জোনাকিও কি কম বিস্ময়ের! জোনাকি আসলে পরি। আমি ঠিক জানি। অন্ধকারে একদিন ওদের পুকুর পাড়ে আলো নিয়ে নড়াচড়া দেখেছি। যদি তুমিও দেখো না, তাহলে তোমারও অমনিই মনে হবে।

মা মায়ের দাদাকে খুব ভালোবাসে। আমাকে কত্ত গল্প বলে! মায়ের কাছে শুনে শুনে মনে হয়, দাদা থাকলে আমাকেও খুব ভালোবাসতেন। কেন নেই বললেই মা বলে, উনি নাকি আকাশে গিয়ে তারা হয়ে গেছেন। আমার মনে হয় দাদা জোনাকি হয়ে গেছেন। মা এখানে এলে দাদা জোনাকি হয়ে তাই দেখতে আসে। কেউ বুঝতে পারে না। আমি ঠিক বুঝতে পারি। ইস! যদি উনি থাকতেন, তাহলে মাকে যেমন দিয়েছিলেন, আমাকেও অমন একটা ছোটো কোদাল গড়িয়ে দিতেন। আমরা তিনজন উবু হয় বসে কোদাল দিয়ে ক্ষেতের ঢ্যালা ভাঙতাম। কী মজা হত! কিন্তু হয় কোথায়! মানুষ কেন তারা হয়ে যায় বলো তো? আসেই বা কোত্থেকে?

বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলল, ভগবান নাকি একদিন দিয়ে যান মায়ের কাছে। মা নিজের মধ্যে লুকিয়ে বড়ো করে তবে বাইরে আনেন। আর তারপর সব কাজ হয়ে গেলে, খেলার পর যেমন আমি বাড়ি আসি, মানুষও নাকি ভগবানের কাছে ফিরে যায়। উই আকাশে।

আরে! ওই লোকটা বাঁশে চড়ে আকাশের কাছে করছেটা কী! ও, বুঝেছি, প্যাণ্ডেল বানাচ্ছে। পরশু তো কালীপুজো। আমরা তো সেজন্যেই গতকাল এলাম। কিন্তু, লোকটা অদ্ভুত তো! একটা লিকলিকে বাঁশে চড়ে কেমন ঝুলে ঝুলে আরেকটা বাঁশে দড়ি বাঁধছে! কী ব্যালেন্স!

ওকে দেখে হাঁটতে হাঁটতে বাগানে ঢুকে পড়েছি। এটা আবার কী পোকা রে বাবা! লিলির পাতায় চটকে আছে! অমনিই সবুজ, শুঁয়োপোকার মতন বড়ো, কিন্তু শুঁয়ো নেই! এদিকে কতগুলো কুমড়ো পোকা উড়ছে। গুবরে পোকা ঘুরছে। ওদের সবাইকে এখন চিনি। তবুও পাখার আঁকিবুকি রঙ দেখলে অবাক লাগে।

বেলা পড়ে আসছে। ছায়া ছাইছে ইটের রাস্তায়। কৃষ্ণচূড়ার মগডালে কোকিল ডাকছে। মামাবাড়িতে সারাবছরই কোকিল ডাকে। রাতেও ডাকে।

কিন্তু বাবা ওখানে করছেটা কী? ছবি তুলছে? কানে তো ইয়ার-ফোন! দৌড়ে গিয়ে ইয়ার-ফোনটা টেনে নিয়ে কানে গুঁজলাম। বাবা হাসল। ইয়ার-ফোনে একটা ইংরিজি গান হচ্ছে। ভাঙা ভাঙা গলায় কে যেন গাইছেন, ‘হোয়াট আ ওয়ান্ডারফুল ওয়ার্ল্ড!’

 

ভম ভম ভভম

“আরি ল্লে! ঢাকি এসে গেছে তো!”

মেজোদাদুর চেঁচানি শুনে দৌড়ে বেরোতেই দেখি সত্যিই ঢাকিমামা আসছে! নীল-কালো খোপ খোপ লুঙ্গি, কলার ফাঁসা ফুল চেক শার্ট। শার্টটা যেন ঝুলছে কাঁধ থেকে। এবার যেন ঢাকিমামাকে আরও রোগা দেখাচ্ছে। চোখদুটো কেমন কোটরে ঢুকে গেছে। তেলে চুপচুপা মাথার চুল। মুখের চামড়াগুলো এতটাই বসা যে হাড্ডি বোঝা যায়। এক কাঁধে ঢাক, আর এক হাতে কমলা রঙের বিগ শপার। পিছন পিছন আসছে অভিজিৎদাদা। ওর হাতেও প্লাস্টিকের থলে। অভিজিৎদাদা হল ঢাকিমামার বড়ো ছেলে। সিক্সে, নাকি সেভেনে পড়ে। ওর সাথে আমার বেশ ভাব আছে। খেলা যাবে বেশ। ওদের দেখেই দৌড়োলাম। ঝুলন্ত ঢাকে ধপুং করে একটা চাপড় দিলাম। ঢাকিমামা ঢাকটা টেনে হাসিমুখে বলল, “বাব্বু, কব্বে এলা?”

বললাম, “পরশু।”

তিড়িং তিড়িং করে ওদের সাথে নাচতে নাচতে ঢুকছি। খুব ইচ্ছে করছে ওদের ব্যাগগুলো একবার ঘাঁটি। কী আছে নেড়েচেড়ে দেখি। চলতে চলতেই ব্যাগে উঁকি দিলাম। প্লাস্টিকের ব্যাগটায় জামাকাপড়। তা’লে বিগ শপারটায় কী? কাত হয়ে যেই না দেখতে গেছি, অমনি দেখি দাদুতুতু মায়ের নাম ধরে ডেকে উঠল, “ক্যা রে টুকাই! কী করিস! ছাওয়াল সামলা।” তারপর আমার হাতটা ধরে হাসতে হাসতে বলল, “চল, একটু বেড়িয়ে আসি।”

“আরে! এই ভরা রোদ্দুরে কোথায় চললে ছেলেটাকে নিয়ে?” সোনামার গলা।

দাদুতুতু শুনতেও পেল না। আমার হাত ধরে গেটের দিকে চলল। দাদুতুতু কোনও কোনও সময় দেখি এমন শুনতে পান না। বললাম, “দাদুতুতু, সোনামা ডাকছে।” তো কী বলল জানো? বলল, “কী! আইসক্রিম খাবি? যাচ্ছি তো, চল।”

যাচ্চলে!

লিচুতলায় যেতে না যেতেই ছোদ্দাদুর গলা পেলাম। “কী রে সেজদা, চললি কোথায়?”

দাদুতুতু এটা কিন্তু ঠিক শুনল। আমায় দেখিয়ে বলল, “এই যে! শ্রীমান ঢাকির ব্যাগে একেবারে হামলে পড়েছিল। তাই ভাবলাম একটু বেড়িয়ে নিয়ে আসি।”

মেজোদাদুও ওখানে ছিল। হাসতে হাসতে বলল, “তুই আর হামলানোর জায়গা পেলি না? শেষমেশ শ্যামচাঁদের ব্যাগ! ওখানে ওর লুঙ্গি-গামছা আর কাঁসর ছাড়া আর তো কিছুই নাই।”

বললাম, “ওই কাঁসরটাই তো দরকার।”

“কাঁসর দরকার তো ঠাকুরঘর থেকে নে না। শ্যামের ব্যাগে কেন?”

“ঠাকুর ঘরেরটা দেখা। টোল খাওয়া! ভালো না। ঢাকিমামারটা ভালো হতে পারে। বাজিয়ে দেখব।”

ছোদ্দাদু সবুজ রঙের ধ্যাদ্ধেড়ে স্কুটারটার কী একটা নাট টাইট দিচ্ছিল। রেঞ্চের ব্যাগটা সিটের উপর। সেখান থেকে হাতড়ে ছোটো রেঞ্চটা তুলে নিয়ে বাঁহাতের বুড়ো আঙুলটায় টাইট দিতে থাকলাম। ছোদ্দাদু সেদিকে দেখে হাসতে হাসতে বলল, “ঠিক কথা। বাড়িরটা তো ওর দেখা। তবে বাবু, অন্যের ব্যাগে হাত দিতে নেই, জানো? কোনও কাজের জিনিস থাকতে পারে তো!”

“কী কাজের জিনিস?”

“নাও, জ্বর সারাতে কুরিকুষ্টি! তোর আক্কেল নেই রে বিষুণ!” মেজো বলল।

ছোদ্দাদু বলল, “অনেক কিছুই থাকতে পারে। ওষুধ-বিষুধ, টাকা-পয়সা থাকতে পারে। হারিয়ে গেলে তো ওর অসুবিধা হবে, তাই না?”

ঘাড় নাড়লাম। ছোদ্দাদু এবার স্কুটারটাকে একদিকে কাত করে ধরল।

“কী করছ এটা? শুইয়ে দেবে নাকি?”

“না রে। স্টার্ট নিচ্ছিল না।”

“কাত করলে স্টার্ট নেবে? দাও আমি করি।”

“না রে, আমি আরেকটু বুড়ো হই, তখন নয় করে দিস। এই ত্তো দেখ, কাম খতম।” বলেই ডান পা দিয়ে স্টার্টারটা দু’বার নামাতেই ভম-ভম-ভভমমমম… একগাদা কালো ধোঁয়া এসে ধাক্কা খেল মেজোদাদুর মাড় দেওয়া ধপধপে পাজামায়। মেজোর সেদিকে হুঁশ নেই। স্কুটারের খকখকানির তালে তালে ঘাড় হিলাচ্ছে আর মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলছে, “ভম ভম ভবম ভম… যাবি নাকি রে, বাবু? স্কুটারে চড়ে বেড়াতে যাবি?”

এ আবার একটা জিজ্ঞেস করার কথা? আমি তো রেডিই।

সব্বার প্রথম চাপল ছোদ্দাদু। পিছনে মেজো। আর আমি সামনের পাদানিতে। দুই হাত দিয়ে হ্যান্ডেল ধরে। স্কুটার এগোল। আমি মুখে মুখে হর্ন দিলাম, “পিপ… পিপ… পিপ… পিপ…”

গেট পর্যন্ত ইটের রাস্তাটা খুব পিছলা। “ক্যা রে বিষুণ,” মেজো বলল, “আমরা আবার হড়কাবো না তো! হড়কালেই কিন্তু হক্কলে মিলে কচুবনে।”

এই রে! কচুবনে তো আবার রাজ্যের কালো মশা ভনভনাচ্ছে, চিটপিটা কাদা থ্যাকথ্যাকাচ্ছে আর ঘুটঘুটাচ্ছে অন্ধকার! আমাজনের অন্ধকার। বাপ রে!

ভাবতে ভাবতেই আমরা গ্রিল টপকে রাস্তায়। রাস্তাও তেমন উবড়-খাবড়। পিছনের সিট থেকে স্কুটারের ঝাঁকুনিতে নাচতে নাচতে কাঁপা কাঁপা গলায় মেজো বলল, “বুঝলি বাবু, এ হল ছোটনাগপুর। দস্তুরমতো মালভূমি।”

বললাম, “ধুস! ছোটনাগপুর হবে কেন? এই জায়গাটার নাম তো বল্লভপুর।”

“ঐ ত্তো! পুরটা দেখছিস না! একেবারে টিলা পুরে পুরে দিয়েছে! জয়ত্তারা! কোমরের খিল না খুলে যায়!”

ছোদ্দাদু সামনে থেকে আসা একটা সাইকেলকে আড় ভাঁজ দিয়ে পেরিয়ে গিয়ে বলল, “মালভূমি যদি দেখতে হয় বাবু, তাহলে আমার ওখানে চল। এত্ত এত্ত পাহাড়। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাইরে এলেই দেখবি পাহাড় হাঁটু গেড়ে সাহেবি কেতায় গুড মর্নিং বলছে। হাজার হাজার পাখি। হাজার হাজার গাছ। আমলকীগাছ দেখেছিস? মহুয়া? রুদ্রাক্ষ?”

“না তো!”

“তাহলে? চলে আয় বাবা-মাকে নিয়ে। দেখবি গাছের নিচে রসগোল্লার মতো পাকা আমলকী গড়াচ্ছে। টপাটপ তুলে মুখে দিলেই হল।”

“সত্যি! বাবা চেনে?”

“চেনার কী আছে? আমেদাবাদ এক্সপ্রেসে রাত্তিরবেলা চেপেই আমায় একটা ফোন লাগিয়ে দিবি। সক্কাল বেলায় ছালে নেমেই দেখবি আমি গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে।”

“মিঠিমামা বলল, তোমার ওখানে নাকি অনেক মাইন আছে। আমায় মাইনে ঢুকতে দেবে?”

“ঢুকতে দেবে মানে?” মেজো বলল, “তুই বলে কিনা ম্যানেজারের নাতি! মাথায় করে নিয়ে যাবে।”

“ছোদ্দাদু, খনিতে হিরে আছে?”

ছোদ্দাদু কিছু বলার আগেই মেজো হইহই করে বলল, “হিরে কী রে! সোনাদানা, মণি-মানিক সাত রাজার সব সম্পত্তি আছে খনির ভিতরে। গেলেই হল। বাবাকে বল, বুঝলি? টিকিট কেটে একবার ছোদ্দাদুর ওখানে চলে যেতে। গোটা ছত্তিশগড় ঘুরিয়ে দেবে…”

আরও কী কী যেন বলছিল মেজো। কানে আসছিল, কিন্তু মাথায় ঢুকছিল না। ঢুকবে কী করে? আমি তো ততক্ষণে মাথায় আলো লাগানো হেলমেট পরে কয়লা খনিতে ঢুকে পড়েছি। খনির ভিতর রেল লাইন। ছোটো ছোটো ট্রলি। তাতে কয়লার স্তূপ। আমি সেই ট্রেন চালাচ্ছি। সামনে একটা ন্যারো টার্ন। ট্রেনের লিভারটা কাত করতেই ছোদ্দাদু হাঁ হাঁ করে উঠল! “উঁহুহুহু! অমনি কোরো না, বাবু। স্কুটার পালটি খাবে!”

ওই দ্দেখ। মনের ভুলে কী কাণ্ডটাই করছিলাম! তা করছিলাম যখন তখন আরেকবার না হয় করেই দেখি। হ্যান্ডেলটায় অনেকগুলো সুইচ। খুব ইচ্ছে করল দাবাতে। হাত চুলবুল চুলবুল করল। কিন্তু যে স্পিডে যাচ্ছি ভালোমন্দ কিছু একটা হয়ে যেতে পারে ভেবে করলাম না। রাস্তা দেখতে থাকলাম।

ভাবছ নিশ্চয়ই, রাস্তায় আবার দেখার কী আছে! আছে গো আছে, অনেক কিছুই দেখার আছে। এখানে এখন রাস্তার দু’ধারেই ফাঁকা মাঠ। কোথাও ক্রিকেট খেলা চলছে তো কোথাও ব্যাডমিন্টন। আবার গরু-ছাগল-ভেড়াও চরছে। শুয়োরও চরছে। এই ত্তো গোটা তিনেক শুয়োর দেখলাম। একটা তো ঠিক বিটলের কাকার মতো। ওইরকমই মুখের ছাঁদ। আমায় দেখে মনে হল ঠিক ওরকম করেই নাকে বেঁকিয়ে ঘোঁত করল। বিটলের নামটা বিটলের না হয়ে ওর কাকার হওয়া উচিত ছিল। এত জ্বালায় না! আর যতসব বিটকেল বুদ্ধিতে মাথা ঠাসা। এইসব ভাবতে ভাবতেই মেজোর গলা কানে এল। ছোদ্দাদুকে বলছে, “ভাই রে, দাঁড়িয়ে যা।”

তাকিয়ে দেখি, সামনে থেকে প্রায় গোটা রাস্তাটা জুড়ে খড়ের লাদেন আসছে। লাদেন হল মোটর ভ্যান। এখানে সবাই মোটর ভ্যানকে লাদেনই বলে। ছোদ্দাদু স্টার্ট বন্ধ করল কি করল না, আমার মনে হল এই সিচুয়েশনে হর্ন বাজানো উচিত। হুড়মুড়িয়ে বাজাতে গেলাম। ওদিকে মেজোও বোধহয় নামতে গেল না কী একটা হল। হ্যান্ডেলটা একেবারে ল্যাগবেগিয়ে উঠল। “ও বিষুণ… ও বিষুণ…” মেজো চ্যাঁচাচ্ছে। চ্যাঁচাচ্ছে আর কাত হচ্ছে। মোজো যত কাত হচ্ছে, আমরা সবাই তত কাত হচ্ছি। বেড়ে মজা! কাত হতে হতে একদম প্রায় শেষমুহূর্তে ছোদ্দাদু কী এক কায়দায় পা নামিয়ে-টামিয়ে ব্যালান্সটা বজায় রাখল। খড়ের গাড়িটা পাশ দিয়ে বেরোতে বেরোতে শুনলাম লাদেনের ড্রাইভার খ্যাক খ্যাক করে হাসছে।

ছোদ্দাদু সানগ্লাস খুলে ফেলল চোখ থেকে। মুখটা লাল। মানে ব্যাপারটা সাংঘাতিক। চুপ থাকতে হবে।

“মেজদা, নাম।”

“নামব কী রে! এদিকে যে ঝোপ!”

“ডানদিকে নাম না!” ছোদ্দাদু একটু জোরেই বলল। আমার দিকে চেয়ে বলল, “তুমিও নেমে ওদিকে মেজোর পাশে দাঁড়াও।”

চুপচাপ নেমে দাঁড়ালাম। ছোদ্দাদুও ডান পাশ দিয়ে বেরিয়ে আলগোছে বাঁ পাটা বার করে আনল।

“এ হে হে! বিষুণ! একেবারে মাখামাখি তো রে! অ্যাহ্‌!”

হাসি পাচ্ছে। চাপার চেষ্টা করছি। হাসি চাপতে গিয়ে মুখটা হাঁ হয়ে যাচ্ছে।

মেজো ওদিকে বলেই চলেছে, “কী করিস! এত বড়ো হয়ে গেলি, ছোটোবেলার অভ্যেস এখনও গেল না!”

আর পারছি না! হাঁ করে হাসি চাপতে চাপতে গালে ব্যথা করছে। ছোদ্দাদুর পাটা দেখলেই হাসি পাচ্ছে। সাদা পাজামার নিচটা পুরো ডিপ ব্রাউন। কোলাপুরি স্যান্ডেলেরও রঙ বদলে গেছে। সবখানে গোবর একেবারে চ্যাটকা প্যাটকা। ছোদ্দাদু তুম্বো মুখে চুপচাপ ঘাসে পা রগড়াচ্ছে।

মেজো হাসছে। হাসতে হাসতে বলছে, “ভালোই হল রে, বিষুণ। ভগবান যা করেন ভালোর জন্যেই করেন। এই দেখ না, তিনদিন ধরে চান করিস না, ওদিকে বাড়িতে এত বড়ো একটা পুজো। দেখ, মা কেমন শুদ্ধ করে নিলেন। গোবর অতি পবিত্র রে!”

“বাজে কথা বলিস না, মেজদা! চান করব না কেন?”

“রাগ করিস না, ভাই। তোকে তো ছোটো থেকেই দেখছি। জলের সাথে রিপালসিভ রিলেশন। হাইড্রোফোবিক নেচার। তোকে চান করাতে দিদিরা তো ফেলই, বাপিও কোনও কোনওদিন গলদঘর্ম হত।”

“সে তো তোদের জন্য। তোরা পুকুরে চোবাতিস তো আমায়।”

“একথা তুই বলতে পারলি, বিষুণ! তুই আমাদের কত আদরের ভাই!”

“আদর, না হাতি। আদরের ঠেলায় প্রাণ যায় যায়। সাঁতার শেখানোর নামে তুই একবার চোবাস তো চপল একবার ঠাসে।”

“তা তুমি অমন নাদন গোপাল হলে আর কী করা!”

আমি হাঁ করে দু’জনের কথা শুনছি। হঠাৎ মনে হওয়ায় চেঁচিয়ে বলে উঠলাম, “পুজোয় গোবর লাগবে না?”

মেজো হাউমাউ করে উঠল, “রাইট! লাগবেই তো। বিষুণ, সাধা লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে নেই রে। খানিকটা একটা প্যাকেটে নিয়ে নে। নির্লোভ নিঃস্বার্থ গরুর নির্ভেজাল গোময় রে ভাই।”

“দশকর্মায় গেলেই পাওয়া যাবে।” গম্ভীর গলায় ছোদ্দাদু উত্তর দিল।

“আরে ধুর! ও তো প্রিজার্ভড গোময়। গোরুর না ঘোড়ার, তাও সন্দেহ আছে। যা ভেজালের দিনকাল! আর এ হল একদম আগমার্কা! একেবারে পারফেক্ট নিষ্কাম কর্ম। হোলি কাউডাং। চেটকেছিসই তো! তবে আর ঘেন্না কীসের? খানিকটা নিয়েই নে না, ভাই আমার!”

“এটাও যে গরুর, বুঝছ কী করে? ষাঁড় বা মোষেরও তো হতে পারে।”

“আরে না রে! আমি শত প্রতিশত নিশ্চিন্ত এটা খাঁটি গোময়। আরে ওই কালো গরুটাকে দেখছিস না, থেকে থেকে লেজটা কেমন মোচড়াচ্ছে? আমি নিশ্চিত, ওই খানিক আগে আমাদের জন্যে এটা দিয়ে গেছে।”

“যা খুশি বলছ তো একদম!”

“না রে ভাই, ঠাট্টা করছি না। একে বলে পারসেপশন। সবার ভালো থাকে না। আমার আছে। যাক গে, তুই যখন নিবিই না, ম্যানেজারি মানে বাঁধছে, তখন আমিই নিই। জীবনে বড়ো হতে হলে মান বিসর্জন করতে হয় রে। নাতিটা বলল, সে কথাটা শুনব না! ও তো শিশু। শিশু মানেই যিশু। জেসাস ক্রাইস্ট। তাঁর আদেশ মানব না! এ হতে পারে! কভি নেহি! দাঁড়া, আমিই নিয়ে নিচ্ছি।” এই না বলে মেজো একটা কাঠি নিয়ে ঝোপটায় ঝুঁকল। দেখাদেখি আমিও ঝুঁকলাম। ওই ত্তো ঝোপের মাঝখানে সেই দুর্লভ। অনেকটা ছড়ানো। মেজো কানে কানে বলল, “সেমি সলিড টেক্সচার।” তার একদিকটায় ছোদ্দাদুর পা হড়কানোর ছাপ। পাশের জংলা পাতাগুলোয় গোবরের পবিত্র ছিটে। ছোদ্দাদু হ্যাণ্ডেলের ব্যাগটা থেকে একটা পলিব্যাগ বের করে উলটে ধরল। কাঠিতে করে চামচে মাখন তোলার মতো পবিত্র গোবর উঠল। তিনবার। তারপর প্লাস্টিক বন্ধ হয়ে ঢুকে গেল টুল-বক্সে।

ফের স্কুটার চলল। বাজার ঘুরে এটা সেটা কেনা হল। তারপর ব্যাগ বোঝাই করে বাড়ির পথে।

সবই হল। কেবল ছোদ্দাদু বড্ড গম্ভীর হয়ে গেলেন। কোনও কথা বললেন না আর। এমনকি স্বর্ণময়ীতে যখন আমি আর মেজো আইসক্রিম খেলাম, তখনও খেল না।

আইসক্রিম খেল না যখন, তা হলেই বোঝো ব্যাপারটা কত গম্ভীর!

 

তোকে ছুঁই তোকে ছুঁই তোকেই ছুঁই

ফিরে এসেই দেখি, আরিব্বাস! ঠাকুর এসে গেছে। কী সুন্দর হয়েছে! আসমানি রঙ। প্রতিবারই অবশ্য এই রঙেরই হয়। গ্যারেজের পাশে রঙ্গনগাছটার পাশের শানের চাতালে রেখেছে। ওখান থেকেই ঠাকুর বরণ হবে। সন্ধেবেলা। এর মধ্যে সব মাসিরা মিলে পঞ্চগুঁড়ি দিয়ে মায়ের জলচৌকি আসনে আলপনা আঁকবে, তার উপরে কুশাসন পাতা হবে, তারপর মাকে ঘরে নিয়ে সেই আসনে বসানো হবে। দাদানদা দূরে দাঁড়িয়ে দেখবে আর, ‘ডানদিকে, উঁহু, একটু সামনে,’ এইসব বলতে থাকবে যাতে ঠাকুর ঠিক মাঝামাঝি বসেন। সব জানি। সব আমার মুখস্থ। প্রত্যেকবার দেখি তো!

প্রত্যেকবার এই লোকটাই ঠাকুর দিয়ে যান। পাঁচ নাকি সাত মাইল দূরের কুমোরপাড়া থেকে সক্কাল সক্কাল ঘাড়ে করে বয়ে আনেন। এবছর দেখছি ভ্যানে এনেছেন। বোধহয় শরীরটা খারাপ। চোখমুখ দেখে তো তেমনই লাগছে। দাদুতুতু কী যেন কথা বলছে ওর সাথে। লোকটা ফতুয়ার বুক পকেটে হাত ঢুকিয়ে ভাঁজ করা কী একটা কাগজ দিল যেন। আর সেটা পড়েই দাদুতুতু ফিচিক ফিচিক হাসতে শুরু করল। ব্যাপারটা ঠিক কী হচ্ছে জানতেই হবে। যেই না দৌড়ে গেলাম, অমনি দাদুতুতু কাগজটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “পড় তো।”

ওমা! এ তো একটা রসিদ! বাঁকা বাঁকা হরফে কী যেন লেখা!

মা জহুরা মিৎশিল্পালয়
আদি কুমোর পাড়া, ভাতুড়ি কদমতলা,
পোস্টঃ বল্লভপুর
প্রোঃ শ্রী জয়নেতাই পাল (শম্ভু)

(বিঃ দ্রঃ ইখানে সব কালের ঠাকুর পিত্তিমা পাওয়া যায়। চার পুরুষের অভিজ্ঞ মিৎশিল্পী দ্বারা অডারের পিতিমা অতি যত্ন সহকারে পোস্তুত করা হইয়া থাকে)
বিবরণঃ বল্লভপুরের সাহেবের বাড়ির কালী পিতিমা
শ্যামা কালী মুত্তি
ডাকের সাজ লইয়া মূল্যঃ ৮৫০ টাকা
লিভার খরচঃ ২২৫ টাকা
টোটাল খরচঃ ১০৭৫টাকা

যা ভেবেছি তাই। হুঁ হুঁ বাবা! আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া যাবে? ঠিক বুঝেছি, লোকটার শরীর খারাপ। এবার তো পরিষ্কার লোকটার লিভারের ব্যামো হয়েছে। লিভারের ওষুধের দাম বাবদ ২২৫ টাকা লিখে দিয়েছে তাই। দাদুতুতুকে কথাটা বলতেই আবার হেসে উঠল। দাদানদা বাগানে একা একা হাঁটছিল। এসে বলল, “কী হল রে বাবলু? এত হাসছিস কেন?”

“এই দেখো না!”

দাদানদা কাগজটা পড়ে মুচকি হাসল। তারপর লোকটাকে ডেকে বলল, “কী ব্যাপার? ভ্যানে এত লাগল?”

“আইজ্ঞা, ইরমই তো লেয়।”

“ও। ঠিক আছে, দাঁড়াও, দিচ্ছি।”

দাদানদা ভিতরে গেল। দাদুতুতু হাসি থামিয়ে আমায় বলল, “লিভার খরচ মানে লিভারের ওষুধের দাম না রে, লিভার খরচ মানে হল নেওয়ার খরচ। মানে ঠাকুর নিয়ে আসার খরচ। কলোকোয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ। বুঝলি?”

বুঝলেই কী, আর না বুঝলেই কী? আমি তো চললাম খেলতে।

ঠাকুর আনার ভ্যানটা দাঁড়িয়ে। গোল ঢাপসা ভোঁপুটা ডানদিকের হ্যান্ডেল থেকে ডাকছে। যাই, একবার বাজাই। ভোকু-ভোকু-ভোকুউউউ করে বাজালাম। একবার, দু’বার, তিনবারের বার বাজাতেই দূর থেকে একটা টুউউক টুইইই করে মিষ্টি আওয়াজ শুনলাম। আরে! এ যে দেখি একটা টুরটুরে হলুদ পাখি! পুকুরপাড়ের কদম গাছটার ডাল থেকে শিস দিচ্ছে! ওটাকে ধরব। পা টিপে টিপে নেমে গেলাম বাগানে। আস্তে আস্তে গাছটার কাছে যেই না গেছি অমনি হুউউউস! ধুত্তোর! রাগের ঠেলায় একটা ঢ্যালা কুড়িয়ে দিলাম ছুড়ে। গাছের ডালে লেগে সেটা ধুলো হয়ে ছড়িয়ে গেল।

ফিরতে গিয়েই দেখি পিছনে অভিজিৎদাদা। হাতে একটা মড়া ডালের লাঠি। এই ত্তো এল, এর মধ্যেই চান-টান সেরে নতুন জামা-টামা পরে রেডি! মাথা থেকে সর্ষের তেল চোঁয়াচ্ছে। বলতেই হাতের তেলো দিয়ে মুছে নিল। বললাম, “এত তেল মেখেছ কেন?”

“বাবা দিয়ে দিয়েছে। নতুন টিউকলের জলে ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে তো, তাই।” বলেই হাতের লাঠিটা দিয়ে মাটির উপরে একটা ছোট্ট গর্ত খোঁচাতে থাকল। খোঁচাতে খোঁচাতেই মুখটা তুলে বলল, “তুমি একা একা এখানে বেড়াও কেন?”

“কেন? এখানে একা একা বেড়ালে কী হবে?”

চট করে কিছু না বলে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশ দেখে নিয়ে অভিজিৎদাদা বলল, “না বাবা, থাক।”

“থাক কেন? ও অভিজিৎদাদা, বলো না কী হয়েছে!”

“তোমার শুনে কাজ নেই।”

একথা শোনার পর আর কেউ না শুনে থাকতে পারে? ‘বলো না, আরে বলো না’ ঘ্যানাতে শুরু করলাম। খানিক বাদে বড়ো মানুষের মতো গলাটা গম্ভীর করে অভিজিৎদাদা বলল, “বলতে পারি, কিন্তু রাতে ভয় পেয়ে ঘুম না এলে আমার নামে দোষ দিবে না তো?”

“কেন দোষ দেব? আমিই তো তোমায় বলতে বলছি। তুমি তো বলতে চাইছই না। কেউ জিজ্ঞেস করলে আমি সেকথাই বলব। কিন্তু ঘুম আসবে না কেন গো? খুব ভয়ের কথা?”

“হুম!”

এই ত্তো চাই! নতুন উত্তেজনায় সঙ্গে সঙ্গে বললাম, “বলো তাহলে!”

“বলছি শোনো। দুপুরবেলা জানো তো পুকুরপাড়ে একা একা কোনও দিন আসতে নাই? পানডুবরা আসে।”

বলার ধরনটা এমন ছিল যে আমারও গাটা ছমছম করে উঠল। যদিও কোনও দিন অমন জিনিসের নামও শুনিনি, তবে বেশ বুঝতে পারছি সাংঘাতিক কিছু হবে। তবুও ঢোঁক চিপে বললাম, “পানডুবরা কী গো, অভিজিৎদাদা?”

চোখ গোল্লা গোল্লা করে অভিজিৎদাদা বলল, “সে কি! তুমি জানো না?”

“না তো।”

অভিজিৎদাদা বিজ্ঞের মতো একটা হাসি হেসে বলল, “জানবেই বা কেমন করে? শহরে তো আর পুকুর নাই। কাজেই পানডুবরাও নাই।”

“সেটা কী একবার বলো না!”

“সি একরকমের দত্যি। জলদত্যি।”

“জলদত্যি!”

“হ্যাঁ! জল দিয়েই হাত-পা সব বানানো। ইয়া লম্বা। জলের মুখ, জলের দাঁত। জলের হাতে ইয়া বড়ো বড়ো জলের নখ!”

“বাবা!”

“হুঁ হুঁ! এমনি এমনি কি আর তোমাকে আসতে বারণ করছি?”

“সব পুকুরেই পানডুবরা থাকে?”

“সব জলে থাকে। কোনও জলায় যদি তিনজন মানুষ জলে ডুবে মরে যায়, তাহলে তিনজনের আত্মা মিলে গিয়ে একটা পানডুবরা তৈরি হয়। তারপর ফাঁকা দুপুরে যদি কেউ পুকুরঘাটে আসে তাহলে তাকে লোভ দেখায়। যেকোনও রূপ ধরতে পারে! পাখি, মাছ, মানুষ… স-ব!”

“তারপর, তারপর!”

“তারপর আর কী! সেই লোভে লোভে জলে পা দিলেই ব্যস!”

ঢোঁক গিলে বললাম, “ব্যস কী?”

“কী আবার? পা ধরে টেনে নিয়ে যাবে জলার ভিতর পানডুবরার দেশে!”

“কেন?”

“বা রে! দলে লোক বাড়াতে হবে না! জলের ভিতরে ঢুকে লোকটা মরে যাবে, আর আত্মাটা বন্দি হয়ে থেকে যাবে পানডুবরার দেশে।”

খানিকক্ষণ আর কিছু বলতে পারলাম না। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, “অভিজিৎদাদা, তুমি যে বললে পানডুবরা যেকোনও রূপ নিতে পারে, তাহলে যে পাখিটাকে দেখে আমি এখানে দৌড়ে এলাম সেটাও পানডুবরা হতে পারে?”

“হতেই পারে!”

“কিন্তু এই পুকুরে তো কেউ মারা যায়নি, অভিজিৎদাদা!”

“সি তুমি কেমন করে জানছ?”

“আমায় তো কেউ বলেনি!”

“তুমি ছোটো বলে নাও বলতে পারে। তাছাড়া এত পুরনো পুকুর, অনেক আগেও তো মরতে পারে। অনেক অনেক আগে। তাহলে তো ইখানের কারও জানার কথা লয়!”

“সে অবশ্য হতে পারে।”

“আর যদি ধরো তা লাও হয়, তাও পানডুবরার পক্ষে সব সম্ভব। আশেপাশের অন্য কোনও জলা থেকেও মাটির তলার জল বেয়ে এখানে আসতে পারে।”

“অন্য জায়গা থেকে এখানে আসবে কেন?”

“তুমি মামার বাড়ি এসেছ কেন?”

“বেড়াতে।”

“পানডুবরাও জল দিয়ে বেড়াতে পারে। যেখানে কাউকে পেল অমনি তাকে ধরে নিয়ে মাটির তলা দিয়ে সোজা চলে গেল চালতের বিল।”

“চালতের বিল আবার কোথায়?”

“ও বাবা! তুমি চালতের বিলও জানো না? তোমাদের বাড়ির উই দিকে। রেল লাইন পার করে খানিকটা গেলেই। বিরাট বিল। আমি ঠিক জানি, ওই বিলে পানডুবরা আছেই। পানডুবরা আছে, শাঁখচুন্নি আছে। পেত্নি আছে, মামদো আছে। এমনকি বেম্মদত্যিও আছে! সব আছে।”

“আমি তবে সেখানে এখন যাব না বাবা! তুমি কোনও দিন দেখেছ, অভিজিৎদাদা?”

“কী?”

“পানডুবরা।”

“না। তবে আমার নানি দেখেছে। আমার ভাইকে একবার দেখিয়েওছে।”

“কোথায়?”

“নানি দেখেছে মধুপুরে। নানিদের বাড়ি ছিল তো সেখানে। অনেক বাচ্চাকে হাওয়া করে দিয়েছিল পানডুবরা। আমার নানিকেও দিত। পারেনি।”

“কেন? পারেনি কেন?”

“নানির গলায় পীরবাবার তাবিজ ছিল না!”

“ঘটনাটা কী হয়েছিল?”

“আমার নানিও তোমার মতো দুপুরবেলা একা একা ঘুরে বেড়াত। তো একদিন দেখে কী, একটা বুড়ি পুকুরপাড়ে থলেটা নামিয়ে রেখে জলে নেমে গেল। আর চক্ষের নিমেষে সাঁতরে চলে গেল মধ্যিখানে! আর সেখান থেকে নানিকে ইশারা করে ডাকল।”

“ওরে বাবা!”

“নানি তো তাকে ঠিক চিনেছে। চিনবে না? তার যে নাক-মুখ-চুল-সব জায়গা থেকে জল পড়ছিল!”

“সে তো ডুব দিলে সব্বার হয়!”

“সেরকম না। অন্যরকম। গলে গলে জল পড়ছিল।”

“সেরকম কী করে হয়?”

“বিশ্বাস করছ না তো? দেখো।”

“না, না! বিশ্বাস করছি তো। দেখো কেমন আমার লোম খাড়া হয়ে গেছে! তোমার ভাই কী দেখেছিল বলো না!”

“শোনো। যে বাড়িটায় আমরা থাকি না, তার একটু পরেই একটা জঙ্গল। আর সেই জঙ্গলের ঠিক মাঝখানে আছে একটা অন্ধকার পুকুর। দিনের বেলাতেও গাছের ছায়ায় অন্ধকার! তার জলটাও কালো! সেই আঁধার পুকুরের ওই পাড়ে ডাইনিবুড়ির ঘর।”

“ডাইনিবুড়ি?”

“হ্যাঁ! আগে কিন্তু সে মানুষ ছিল। তখন তাকে আমরা ভালোই চিনতাম। সরু, হ্যাংলা মতন। সব দাঁত পড়ে গেছে, কিন্তু মাথাভর্তি কালো চুল। ছোট্ট ছোট্ট তিনটে নাতনিও ছিল।”

“আর কেউ ছিল না? ছেলেমেয়ে?”

“না। আর সবাই মরে গেছে।”

“কীভাবে?”

“কেউ জানে না। তারপর শোনোই না। সব ঠিকই চলছিল। একদিন হল কী, পূর্ণিমার রাতে খুব জোরে জোরে শেয়াল ডাকল। ডাকল না যেন কাঁদল! পরদিন সবাই দেখল বুড়ির তিন নাতনি মরে নীল হয়ে গেছে। একসাথে! কেউ বলল সাপে কেটেছে, তো কেউ বলল সাপে নয়, ওই বুড়িই ওদের খেয়েছে!”

“ধুর! সে আবার হয় নাকি? নিজের নাতনিকে কেউ খায়!”

“এজন্যেই তো তোমাকে বলছিলাম না। গ্রামে এমন অনেক কিছুই হয় যা শহরে থাকলে বিশ্বাস হয় না, বুঝলে?”

“বুঝেছি, বুঝেছি। তারপর বলো।”

“তারপর আর কী? ওদিকে যাওয়াই আমরা প্রায় বন্ধ করে দিলাম। দুপুরে আর রাতে তো একদমই না।”

“কেউ যেতে না?”

“কেউ না, কেবল একজন ছাড়া। সে হলো আমার ভাই। বনে জঙ্গলে ঘুরত সারাক্ষণ। তারপর নানি ওকে দেখাল। পরপর দু’দিন। সেই দেখে ভয়ে ভায়ের আমার একা একা ঘোরা পুরো বন্ধ।”

“কী দেখাল?”

“ঠিক দুপুরবেলা, যখন চারদিক খুব শান্ত, তখন ওই বুড়ি একটা কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘাটে আসে। জলে নামে। তারপর কার সাথে যেন কথা বলে। অথচ কাউকে দেখা যায় না। তারপর গলা জলে নেমে ঝুপ করে ডুব দেয় আর অনেক্ষণ পরে অনেক দূরে ভুস করে ভেসে ওঠে। তখন তারও চুল গলে গলে জল হয়ে পড়ে।”

“ওরে বাবা!”

“তবে আর বলছি কী! নানি বলে, ও নাকি ডুব দিয়ে পানডুবরার কাছে যায়। সবার খবর দেয়।”

“বাপ রে!”

“তাই তো বলছি, একা একা জলের কাছে কখনও এসো না। শুধু জলের কাছে কেন, খোলা মাঠে, রেল লাইনের ধারে কোত্থাও দুপুরবেলা একা একা যেতে নেই।”

“সেখানেও কি পানডুবরা?”

“না না, সেখানে অন্য সব। পানডুবরা তো কেবল পানির দেশে।”

“তুমিও যাও না?”

“আমিও যাই না। যদিও ওরা আমার কিছুই করতে পারবে না।” বলেই জামার ভিতরে হাত দিয়ে একটা তাবিজ বার করে দেখাল। তারপর বলল, “তবুও যাই না।”

এইসব কথা হতে হতেই দোতলার ব্যালকনি থেকে দিদিদির গলা পেলাম। ডাকছে। বলছে, “বাবু, পুকুরধারে কেন? পুকুরধারে যেতে নেই তো! উঠোনে এসে দাদার সাথে গল্প করো।”

অভিজিৎদাদা চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “শুনলে তো? দাদিও জানে! এবার বিশ্বাস হল তো?”

উঠোনের দিকে আসতে আসতে, তিড়িং তিড়িং নাচতে নাচতে, হাওয়ার পিঠে ভাসতে ভাসতে আরেকবার পুকুরের দিকে তাকালাম। জলটা কেমন যেন লালচে লালচে লাগছে না! হাওয়া নেই, তবুও কেমন ছোটো ছোটো ঢেউ উঠছে না! কোথায় যেন সেই হলুদ পাখিটাও ডাকছে না—টুউউক, টুউউইই, টুউউক, টুউইইই…! নাকি বলছে, তোকে ছুঁইইই… তোকে ছুঁইইই… তোকেই ছুঁইইই!

 

ওরে বাবা! যা ব্বাবা!

আজকের খাওয়াটা জব্বর। মামণি আর রাঙামানি রেঁধেছে। পুষ্প-পোলাও, মাখা মাখা পনির আর লাল ডিম। লাল ডিম বলে মা। ছোট্টবেলা থেকে পছন্দ করে। কাজেই এখানে এলেই মামণি রান্নাও করে। অবশ্য মা একা নয়, আমিও খুব ভালোবাসি। দাদানদাও ভালোবাসে। মেজোও ভালোবাসে। ছোদ্দাদুও ভালোবাসে। রুবাই, তাতাই, দীপমামা সব্বাই ভালোবাসে। তাই তো সবাই মিলে খাবার টেবিলে অনেকক্ষণ ধরে স্বাদ করে খায় আর গপ্পো করে। গপ্পো করে আর হাসাহাসি করে। বাপ রে, কী আওয়াজ তখন হাসির!

এবেলা বাড়ির রান্না। সন্ধে থেকে রাঁধবে রান্নাদিদি। সন্ধেবেলা বরণ আছে না! তার জন্যে তৈরি হওয়া আছে না! বরণডালা সাজানো আছে, পঞ্চগুঁড়ির আলপনা দেওয়া আছে, চাঁদোয়া টাঙানো আছে, চন্দন বাটা আছে, প্রদীপ ভেজানো আছে, বেলপাতা দুব্বো আলাদা করা আছে, তারপর কালকে সকাল থেকে ভোগ রান্না আছে! কত্ত রকম মাছ হবে, জানো? কত্ত রকম ভাজা হবে, জানো? কত্ত রকম শাক? কত্ত রকম ডাল? জানো? সারারাত কালীপুজো। সেজন্যে সারাদিন কত্ত কত্ত কাজ সবার!

এই ত্তো দেখে এলাম ছোদ্দিদি বরণডালা সাজাচ্ছে। চালের গুঁড়োয় লাল হলুদ সাদা পাঁপড়িওয়ালা পদ্মফুলের মতো দেখতে শ্রী বানাচ্ছে। দুটো। ওদের একজনের ডাক নাম নেচুনি আর একজনের পেচুনি। ছোদ্দিদি বলেছে।

যেখানটায় বরণ হবে, সেখানে এখন তুলি হাতে আলপনা দিচ্ছে দাদুতুতু। এবার তাতামাসি আসেনি। পরীক্ষা আছে শুনলাম টোকাটুলির কাছে। না হলে দাদুতুর সাথে ঠিক আলপনা দিত। এহ্‌! দেখো, দাদুতুতু কেমন থেবড়ে বসেছে মাটিতে! সাদা পাঞ্জাবিতে সাদা খড়িমাটি শুকিয়ে চড়চড়া। এ বেলা কিছু না! অথচ আমার গায়ে একটু মাটি কাদা লাগলেই মা তারস্বরে চেঁচাবে, ‘বাবুউউ!’ অমনি অন্যরাও হাসবে।

ও কী রে বাবা! বুঝে গেল নাকি! নইলে ডাকে কেন? বড়োদের কত্ত ক্ষমতা! নইলে ভাবো, মনে মনে ভেবেছি, আর অমনি দাদুতুতু ডেকে উঠেছে! “বাবু, এদিকে শুনে যা।”

গিয়ে বললাম, “কী? বলো।”

“আলপনা দিবি?”

যাক বাবা! যা ভাবছিলাম তা নয়। বললাম, “দেব তো। তুলি দাও।”

এখন আমার কাছেও একটা ছোটো তুলি। ভাঙা কাপে আধভর্তি খড়ি গোলা। দাদুতুতু বলেছে তুলসিতলায় আলপনা দিতে।

আমার আবার ভাই কাজ নিয়ে হাঁ করে বসে থাকতে ভাল্লাগে না। কাজেই ফটাফট টাস্ক কমপ্লিট। একটা পেঁচা, একটা গণেশ ঠাকুর, আর একটা মুষকরাজ। কতক্ষণ লাগে!

তুলি আর কাপটা হ্যান্ড-ওভার করতেই দাদুতুতু অবাক। “এত জলদি হয়ে গেল! চল তো দেখি।”

“বাহ্‌! দারুণ এঁকেছিস তো! দেখ টুটুল!”

টুটুল হল মেজোর মেয়ে। আমার মাসি। দেখেই, ‘বাহ্‌ বাবু! কী দারুণ! কী দারুণ!’ বলে চেঁচাল। প্রশংসা শুনে-টুনে একটু একটু লজ্জা-লজ্জাও হতে শুরু করল। তক্ষুনি দাদুতুতু বলল, “পারসেপশনটা দেখ! কী দারুণ অবজারভেশন। পারফেকশনটা একটু কম, তাও এই বয়েসে ঠিকই আছে। ফাস্ক্লাস! তবে বাবু, যা আঁকবি, একটু ধৈর্য নিয়ে করবি। মনের ভিতর যে ছবিটা ফুটছে সেটাকে বাইরে আনা তো ভীষণ কঠিন কাজ! কাজেই যত ধীরে ধীরে যত্ন নিয়ে করবি, ততই ফুটবে। আর আলপনা হল মিলের খেলা, বুঝলি?”

আরে! কালকের সেই হলদে পাখিটা না! রইল পড়ে আলপনা বোঝা আর রইল পড়ে রঙের ব্রাশ। আমি তো চললাম পাখি দেখতে।

ছুট, ছুট! সে পাখিও কম উড়নচণ্ডী নাকি! এ-ডাল সে-ডাল ঘুরে ঘুরে, ফুড়ড়ড় ফুড়ড় উড়ে উড়ে, কেমন এক সুরে শিস দিতে দিতে বসল গিয়ে সেই পুকুরপাড়ে কদমগাছের ‘হ’-এর মতো হেলে পড়া ডালটায়। বাগান দিয়ে নামতে গিয়ে শুনি পিছন থেকে বাবা ‘বেলো! বেলো!’ করে ডাকছে। ডাকুক গে! আগে আমায় দেখতে হবে এই পাখিটাই পানডুবরা কি না! কদমের ডাল পিছলে জলে সেঁধোয় কি না!

হুড়মুড় করে নেমে গেলাম। যাহ্‌! পাখিটা তো আর নেই! কোথায় গেল? উড়েই গেল, নাকি জলেই গেল! এই না ভেবে যেই না জলের দিকে তাকিয়েছি, ওরে বাবা! গা কেমন শিউরে উঠল। বুকের ভিতর ধড়ড়ম ধড়ড়ম ড্রাম বাজল। জলের ভিতর থেকে টুপ করে মাথা তুলল কুচকুচে এক কালো পাখি! আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল ক’বার আর তারপর ঝুপ করে ডুব দিল। ভুউস করে ফের ভেসে উঠল উইই দূরে! আর অমনি পিঠে যেন কার হাত পড়ল।

ভয়ে চেঁচিয়ে উঠতেই শুনি হ্যা হ্যা করে দীপমামা হাসছে। দীপমামার পিছনে বাবা। বাবা বলল, “কী রে বেলো, অমনি ধুধধুড়িয়ে নেমে এলি যে!”

আঙুল দিয়ে জলের পাখিটাকে দেখালাম। সেটা তখনও সেই একই কসরত দেখাচ্ছে। বাবা দেখে বলল, “ওই পাখিটা? ও তো ডুব দিয়ে মাছ ধরে খায়। ওর নাম পানকৌড়ি।”

“পানকৌড়ি না বাবা! পানডুবরা! ওটা পানডুবরা!”
“কী?” দীপমামা ভুরু কোঁচকাল।
বাবা কপাল কুঁচকে বলল, “পানডুবরা! ওই নাম তুই শুনলি কোথায়?”
“অভিজিৎদাদার কাছে। তুমিও শুনেছ?”
“শুনেছি। তবে তোর অভিজিৎদাদার সাথে কাছে নয়। বিট্টু সাউয়ের কাছে।”
“বিট্টু সাউ কে গো?”
“বিট্টু সাউ ক্লাস ফাইভের একটা ছেলে। আমার আগের স্কুলে পড়ত।”
“কী বলেছিল বিট্টু সাউ?”
“বলব, তবে বেলোভূষণ, আগে তোমাকে বলতে হবে তু্মি কী শুনেছ।”
“না, আগে তুমি বলো।”
“উঁহু বেলোসুন্দর, ওটি তো হবে না। আগে নিজের পেটটা খোলসা করো। তারপর আমি বলব।”
আমি জানি বাবা বরাবর এমন নাছোড়বান্দা। না শুনে ছাড়বেই না। কাজেই আমাকেই আগে বলতে হল।
সব শুনে বাবা বলল, “আমার শোনাটাও অবশ্য অনেকটা তোর মতনই। বিট্টু বলেছিল, পানডুবরা হল জলের ভূত। যদি কোনও জলায় পরপর অনেক মানুষ…”
“অনেক না বাবা, তিনজন।”
“তিনজন? বিট্টু তো বলেছিল অনেক! যাই হোক, ডুবে যায় যদি তো তাদের সবার আত্মা মিলে পানডুবরা হয়ে যায়।”
“আর সবার ঘাড় মটকায়।” দীপমামা বলল, “যত্তসব গ্যাঁজা।”
“এসব নিয়ে ঠাট্টা কোরো না, মামা।”
“বেশ, তাই না হয় হল।” বাবা বলল, “তা বলে তুই অমন করে ধুধধুড়িয়ে নামলি কেন? ওই পাখিটাকে দেখতে?”
“আরে, ওই পাখিটাই তো পানডুবরা! ওরা তো রূপ বদলাতে পারে। অভিজিৎদাদা তো বলেইছিল!”
“আর তুমি সেটা পরীক্ষা করতে এসেছিলে?” দীপমামা ভ্যাঙচাল, “এহ্‌! এক্কেবারে মূর্তিমান হোমস!”
বাবা হেসে বলল, “তা অবশ্য গোয়েন্দাগিরির শখ ছোটোবেলায় একটু আধটু হয়। সবারই। আমাদেরও ছিল।”
“তোমাদেরও মানে? বাবা, তোমরাও গোয়েন্দাগিরি করেছ?”
“করেছি না তো কী!”
“বলো না, বলো না কী হয়েছিল।”
“বলছি, দাঁড়া। আগে চল পরিষ্কার জায়গায় গিয়ে বসি। এখানে বড্ড মশা।”
দীপমামা বলল, “গোয়েন্দাগিরির গল্প তো, দাঁড়াও, একটা জায়গায় নিয়ে যাই তোমাদের, চলো।”
এবার দীপমামা চলছে আগে আগে। বেশ ক্যাপ্টেন ক্যাপ্টেন ভঙ্গি। পুকুরটাকে ডাইনে রেখে একটা টার্ন নিয়েই একটা ন্যাজ-মোটা ধুমসো বেড়ালকে এমন ছেই ছেই করল যেন ক্যাপ্টেন হ্যাডক। খ্যাঁকানি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “থাউজ্যান্ড অ্যান্ড থাউজ্যান্ডস অফ ব্লু ব্লিস্টারিং বার্নাকলস!” তারপর বাবলাগাছের বন বাঁয়ে ফেলে, শুকনো পাতায় মচড় মচড় আওয়াজ তুলে, পোড়া পার্থেনিয়ামের ঝোপ পায়ে দলে আমরা পৌঁছলাম একদম পশ্চিম পাশের পাঁচিলটার কাছে। এখানে পরপর অনেকগুলো আমগাছ। মোটা মোটা নিচু নিচু ডাল। একটায় তুলে বসিয়ে দিল আমায়। তারপর নিজেও তড়াক করে আরেকটা ডালে উঠে বাবাকে বলল, “এবার তোমার গ্যাঁজাখুরি কাহিনি বলো দাদা।”

বাবা দীপমামার ঠাট্টাটায় আমল না দিয়ে বলল, “বাহ্‌! বেড়ে জায়গা তো রে দীপ! বাড়িটা এখান থেকে বেশ দেখাচ্ছে। রেল লাইনটাও পরিষ্কার। পুকুরটাও চোখে আসছে। বাহ্‌!”

সত্যিই গোটা বাড়িটা চোখে আসছে। ওই ত্তো মনমামা আর মিঠিমামাকে দেখা যাচ্ছে বদ্দাদার সমাধি মন্দিরটায়। মনমামা আর মিঠিমামা হল ছোদ্দাদার ছেলে। ওদের চেঁচিয়ে ডাকলাম। ওরাও উত্তর দিল। বললাম, “চলে এসো। বাবা গল্প বলবে।”

ব্যস। দু’মিনিটের মধ্যে ওরাও হাজির। মনমামা বাবাকে বলল, “কী ব্যাপার, দাদা? জঙ্গলের ভিতর কাহানি শোনাচ্ছ!”

দীপমামা বলল, “জঙ্গল কোথায় রে!”

“জঙ্গলই তো। মচ্ছর কাটছে।”

“মশা কোথায় নেই রে? মশা আর আরশোলা হল সবচেয়ে টিকাও প্রাণী, বুঝলি? সব জায়গায়, সবখানে ওরা আছে। কাজেই মশা দেখে জঙ্গল না প্যালেস বলা যাবে না।”

মিঠিমামা ওদের কথাবার্তা শুনে অদ্ভুতভাবে হেঁউ হেঁউ করে হাসছিল। হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল, “জায়গাটা কিন্তু ফাস্ক্লাস!”

মনমামা আর ওদের কথায় পাত্তা না দিয়ে বাবাকে বলল, “দাদা, কাহানি বলবে বললে?”

“হ্যাঁ রে! বলব তো। আমার ছোটোবেলার গোয়েন্দাগিরির গল্প বলব।”

“তুমি গোয়েন্দা!” মিঠিমামা আবার ওই বিটকেল হাসিটা হাসতে শুরু করল।

“হ্যাঁ রে আমি, অবশ্য আমি একা নই, আমরা মানে একটা দল বলতে পারিস।”

বাবা পাদুটো তুলে গাছের মোটা কাণ্ডটায় হেলান দিয়ে বসে গল্পটা বলতে শুরু করতে যাবে, তক্ষুনি আমি কী দেখলাম জানো? দেখলাম, সেই পানকৌড়িটা তড়াক করে পুকুর থেকে উঠে উড়ে এল এইদিকে! এসে বসল আমাদের সামনের গাছটার ডালে। আর তখুনিই একটা মশা আমার নাকে সুড়সুড়ি দিতে শুরু করল। হাতের তেলোয় নাকটা ঘষে নিয়ে ফের তাকিয়েই দেখি, যাহ্‌! পানকৌড়িটা আর নেই। তার বদলে ওই একই জায়গায় বসে আছে সেই হলুদ পাখিটা! যা ব্বাবা!

গোয়েন্দা বাবাদাস

“আমরা তখন ফাইভ-সিক্সে পড়ি।” একটা মড়া আমপাতার শির থেকে পাতাদুটো আলাদা করতে করতে বাবা বলছিল, “ইশকুল যেতাম হেঁটে। সবাই মিলে। দল বেঁধে হইহই করতে করতে। তো সেই রাস্তায় ছিল একটা বাগানবাড়ি। অনেকটা এই তোদের বাড়ির মতোই। না, আরও খানিকটা বড়োই হবে বোধহয়। যাই হোক, সেই বাগানের পাশ দিয়ে চলে গেছে বুড়ো মানুষের দাঁতের মতো পিচরাস্তা। আরেক পাশে মস্ত পুকুরের পাড়ে সারসার তাল-সুপুরি। শাল-সেগুনের বন। এইয়া বড়ো বড়ো সব শালপাতা নিচে পড়ে থাকত। বাগানের ভিতর দিয়ে ছিল একটা পায়ে চলা পথ। সেটা শর্টকাট। আমরা অবশ্য সে-পথে সাধারণত যেতাম না।”

“কেন? শর্টকাট নিতে না কেন?”

“কারণ, রাস্তাটা ছিল আগাছা আর জঙ্গলের রাজত্ব। কাজেই পোকামাকড়, সাপখোপের আড্ডা। বাড়ি থেকে তাই কড়া বারণ ছিল। ওই বাগানবাড়িটা কাদের ছিল জানিস?”

“কাদের?”

“কবি নবকৃষ্ণ দের। নাম শুনেছিস নিশ্চয়ই! টেক্সট বুকে হয়তো পড়েওছিস। সেই বিখ্যাত কবির মামার বাড়ি। ওই বাড়িতেই কবির শৈশব কেটেছিল। ওখানে বসেই বহু বিখ্যাত কবিতা লেখেন উনি। তখন তো আর এমন ঝোপ-জঙ্গল ছিল না। বরং নাকি ছিল ধ্যাদ্ধেড়ে তেপান্তর। সেখানে দুপুরের ঠা ঠা রোদে বটের ছায়ায় এসে বসত তৃষ্ণার্ত পথিক। মাথার উপর দিয়ে ‘মেঘ হ’ ‘মেঘ হ’ ডাকতে ডাকতে উড়ে যেত চাতক। আর কবি বাগানে কোনও গাছের নিচে বসে হয়তো দেখতেন তালপুকুরে নাইতে নেমেছে হাঁসের দল, গাছের ডালে লম্বা ন্যাজ ঝুলিয়ে নাচ জুড়েছে ফিঙে আর দূর দিয়ে পালকি কাঁধে হেঁটে চলেছে খেটো ধুতি উদোম গা বেহারারা। বোল উঠছে হুমনা হুউউমনা! এই সব টুকরো স্মৃতিই পরে হয়তো কবিতা হয়ে ফুটে উঠেছে।”

“তোমরা সেই বাড়িটা দেখেছ?” মনমামা প্রশ্নটা করল।

“দেখেছি মানে? সেই বাড়ি নিয়েই তো গল্প রে! আগেই বললাম না, কড়া বারণ ছিল ওই পথে যাবার? সেই বারণটাই কাল হল। বন্ধুরা মিলে একদিন ঠিক করলাম ওই পথেই যেতে হবে। কী আছে ভালো করে দেখতে হবে। দিনে-দুপুরে আবার কীসের ভয়! যেমন ভাবনা তেমন কাজ। তারপর থেকে সে রাস্তাতেই চলল আমাদের যাতায়াত।”

“কিছু দেখলে নাকি?” দীপমামা বলল।

“দেখলাম তো। নাম না জানা গাদাগুচ্ছের গাছ দেখলাম। রঙবেরঙের প্রজাপতি, পাখি, কাঠবেড়ালি এমনকি গোসাপ অবধিও দেখলাম।”

“আর?”

“আর দেখলাম ভাঙা ভাঙা পাঁচিলের ওই পাড়ে ছায়া ছায়া পুরনো এক বাড়ি। কেমন যেন রহস্যময়।”

“রহস্যময় কেন?”

“আসলে জায়গাটা কেমন নিঝুম। ছমছমে। লোকজনের আনাগোনাও তো প্রায় নেই বললেই চলে। আর বাড়িটাও যেন ঘুমন্তপুরী। ছায়া ঘন হতে হতে প্রায় অন্ধকার ঘিরে রেখেছে পুরনো বাড়িটাকে। লাগোয়া ডোবাটায় গাদা গাদা তাল পড়ে ভেসে ভেসে আছে।”

“কেউ নেয় না?” মনমামা প্রশ্ন করল।

“কেউ না। কাউকেই তো দেখা যায় না। পাশ দিয়ে গেলে কেবল মাঝে মাঝে ঘড়ঘড় ঘড়ঘড় শব্দ পাওয়া যায়।”

“কীসের শব্দ?” আমি জানতে চাইলাম।

“কে জানে! এইসব কিছু মিলিয়েই তো রহস্যময় লাগত। যাই হোক, আমরা তো ওই পথেই যাতায়াত করতে থাকলাম। ওই বাড়ির কাছটুকু ছেড়ে বাকি পথটা হইহই করে এ-গাছের ডাল ভেঙে। ওর পিছনে তাড়া করে খেলাধুলো চলত। কেবল বাড়িটার কাছে এলেই আমাদের সবার চোখ পড়ে থাকত কেবল সেই দিকেই। সেভাবেই একদিন দেখে ফেললাম লোকটাকে।”

“কোন লোকটা?”

“নেড়া মাথা একটা লোক। কেঁদো বাঘের মতো গায়ে খাবলা খাবলা মাংস। একটা খেটো ধুতি পরা, কাঁধে একটা গামছা। দুই হাতে ভারী একটা বস্তা টেনে নিয়ে আসছে বাড়ির দিক থেকে। থপথপ করে হাঁটতে হাঁটতে লোকটা ডোবার দিকটায় গেল। তারপর বাঁশঝাড়ের আড়ালে গেল হারিয়ে। আর দেখতে পেলাম না। হঠাৎ যেন একটা বাচ্চার কান্না শুনতে পেলাম।”

“তারপর?” জিজ্ঞাসা করলাম।

“স্বাভাবিক কৌতূহল চাগাড় দিল আমাদের। আমরা যেখানটায় দাঁড়িয়ে সেখানে পাঁচিল পুরো ভাঙা। কেবল বাঁশ দিয়ে বেড়া দেয়া। দুরুদুরু বুকে সেই বাঁশের বাতার বেড়া গলে ঢুকে পড়লাম। চললাম পা টিপে টিপে। কিন্তু তাতে আর হল কী! মাটিভর্তি তো মড়া পাতা! পা টিপে টিপে চললেও পা ফেলার তালে তালে মড়ড়-মড়ড় খড়ড়-খড়ড় শব্দ হতে লাগল। তখন তমাল বলল, ‘সবাই হামাগুড়ি দিয়ে চল।’ তাইতে খানিক কাজ দিল। আওয়াজটা কমল। বাইরের আওয়াজ কমল বটে, তবে তারপর যা যা দেখলাম তাতে উত্তেজনায় বুকের ভিতরে আওয়াজ বেড়ে গেল।”

“কী দেখলে!” এবার মিঠিমামা বলে উঠল।

“বাঁশঝাড়টার ঠিক পিছনেই ডোবার পাড়ে একটা উঁচু ঘর। অনেকটা উঁচু। একটাই ঘর। হদ্দ পুরনো। গোটা গায়ে শ্যাওলা, গাছের শিকড়। মাটি থেকে ধাপে ধাপে চারটে সিঁড়ি। তারপর কাঠের দরজা। উঁচু হয়ে আরেকটু যেই না দেখতে গেছি, অমনি সেই দরজা ঠেলে বেরিয়ে এল সেই নেড়া পাষণ্ড!”

“সে কি!”

“তা নইলে আর বলছি কী! বুকের ভিতরে তখন ধমাদ্ধম ঘা! একে ইশকুল ছুটি হয়েছে অনেকক্ষণ। দেরি হলে বাড়িতে প্যাঁদানির ভয়। তারপর ওই নেড়া ভীমসেনের কাছে ধরা পড়ার ভয়। একেবারে সিঁটিয়ে দম আটকে ঘাপটি মেরে রইলাম।

“সে ব্যাটা নেমে এল। হাতে তখনও বস্তাটা। তবে খালি। বুঝলাম, ওই ঘরটার ভিতরে বস্তাটা খালি করে এসেছে। কী ছিল? গুপ্তধন? ডাকাতির দ্রব্য? নাকি আর কিছু?

“লোকটা নেমে এসে দুই হাত মাথার উপর তুলে অনেকটা বেঁকে গিয়ে হাউমাউ করে আড়মোড়া ভাঙল। তারপর ‘এ সিয়া মাইয়া, আরে হো সিয়া মাইয়া হামার’ করে হেঁড়ে গলায় কী একটা গান গাইতে গাইতে ডোবার পাড় ধরে বাড়ির দিকে চলে গেল।

“তার গলার আওয়াজ মিলিয়ে যেতেই একে একে আমরাও বেরিয়ে এলাম। তারপর ছুট, ছুট! এক্কেবারে বড়ো রাস্তায় পড়ে তারপর থামলাম। তমাল হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘কী বুঝলি বল তো।’

“অনুপম বলল, ‘কী আবার? লোকটা ডেঞ্জারাস!’

“কৌশিক বলল, ‘সে তো বটেই। কিন্তু বস্তাটায় কী ছিল বল তো।’

“কী আবার?’ আমি বললাম, ‘গুপ্তধন-টুপ্তধন নিশ্চয়ই।’

“জয়ন্ত বিজ্ঞের মতো বলল, ‘তোর মুণ্ডু! গুপ্তধন কেউ অমনি করে খোলা রাখে?’

“তমাল বলল, ‘সে রাখতেই পারে। দামি জিনিস যত লোকের চোখের সামনে ফেলে রাখবে, ঠিক করে রাখতে জানলে ততই নিরাপদ। কেউ দেখলে ভাবতেও পারবে না। এটা একটা খুব ভালো টেকনিক। তবে ভাই, এই জায়গাটায় আমি জয়ন্তর সাথে একমত। বস্তায় আর যাই হোক, গুপ্তধন ছিল না।’

“বললাম, ‘কেন?’

“তমাল বলল, ‘বস্তাটা যেভাবে নিচ্ছিল লোকটা তাতে বোঝা যায় বেশ ভারী ছিল। অত ভারী সাধারণত গুপ্তধন হয় না। তাছাড়া লোকটা যখন বস্তাটা নিয়ে যাচ্ছিল, তোরা কি একটা চিৎকার শুনেছিলি?’

“শুনেছিলাম তো। বাচ্চা ছেলের কান্নার মতো।’

“তমাল খানিক চুপ করে থেকে বলল, ‘আমার মনে হয় বস্তায় গুপ্তধন ছিল না বটে, তবে ধন আসার চাবিকাঠি ছিল।’

“পরিষ্কার করে বল না যা বলবি!’ কৌশিক বলে উঠল।

“বলছি। আমার মনে হয় বস্তায় কোনও বাচ্চা ছেলে ছিল। এ ব্যাটা নির্ঘাত ছেলেধরা। আর ওই ঘরটা হল গুমঘর।’

“কী সাংঘাতিক!’

“তবে আর বলছি কী! কিন্তু শোন, জেনে যখন গেছি ওই ছেলেটাকে কিন্তু আমরা উদ্ধার করব। এটাই হবে আমাদের ফার্স্ট কেস। রাজী?’

“রাজী, রাজী। কিন্তু কেমন করে?’

“কেমন করে আবার? প্ল্যান করে! আমার মাথায় একটা প্ল্যান আছে। শোন…’’

বাবা দম নেওয়ার জন্য খানিক থামল। আমার আর তর সইছিল না। বাবার হাতে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম, “তারপর কী হল? বলো না, তারপর কী হল!”

“কী আবার?” বাবা বলে চলল, “তমালের প্ল্যান অ্যাপ্রুভ হল। পরদিন ইশকুল ছুটির পর জিনিসপত্তর নিয়ে আমরা আবার জুটলাম সেখানে।”

“কী জিনিসপত্তর?” দীপমামা জিজ্ঞেস করল।

“কী আবার? মোটা দু’গাছা দড়ি, একটা তিন সেলের টর্চ, মোটা দুটো লাঠি আর একটা পেনসিল কাটা ছুরি, এই ত্তো।”

“তারপর?”

“তারপর আমরা আস্তে আস্তে সেই ঘরটার কাছে পৌঁছে দেখলাম দরজাটা আদ্ধেক খোলা। মানে এখান থেকে কেউ বেরিয়েছে। তমাল আগে আগে টর্চ হাতে উঠল। পিছনে আমরা সবাই। বন্ধ পাল্লাটায় একটা জোর ঠেলা দিতেই সেটা একটা অনিচ্ছার শব্দ করে খুলে গেল। ভিতরটা অন্ধকার। টর্চটা জ্বালল তমাল। মাকড়শার জাল জমে জমে একেবারে কালো। তারপর ঘরটার মেঝের দিকে তাকাতেই আমরা হাঁ! তমাল ফিসফিস করে বলল, ‘দেখলি তো? আমার অনুমানটাই ঠিক। এখানেই গুম করেছিল ছেলেটাকে!’

“সায় দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। কারণ, ঘরটার মাঝামাঝি একটা বেদি। আর বেদিটার মাঝামাঝি একটা চওড়া গর্ত। তমাল টর্চ জ্বালিয়ে দেখাল গর্তের নিচটায় জঙ্গল। জঙ্গলের মাঝখানের লতাপাতাগুলো তখনও বসা। যেন ভারী কিছু ফেলা হয়েছিল। ঘরের মেঝেতে ভাঙা মাটির বাসনকোসন, আর একটা জলের কুঁজো। তমাল পুরো ব্যাপারটা এমনভাবে বুঝিয়ে দিল আমাদের যে আমরা পুরো বিশ্বাস করলাম যে এটাই ছেলেধরাটার গুমঘর।

“ওদিকে জয়ন্ত হঠাৎ ছাদের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওটা কী!’

“তাকাতেই দেখলাম, অন্ধকারে কী যেন জ্বলছে! তমাল সেদিকে টর্চটা জ্বালাতেই সেই জ্বলন্ত জিনিসটা ইয়াব্বড় একটা বাদুড়ের রূপ নিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে ফড়ফড়িয়ে তেড়ে এল আমাদের দিকে। অমনি আমরাও রাম চিল্লানি। শুধু কি চিল্লানি! সেই ছোটো জায়গায় বাঁচতে গিয়ে একজন আরেকজনের ঘাড়ে পড়ে টাল সামলাতে না পেরে সবাই মিলে একেবারে সিঁড়ি থেকে মাটিতে। একেবারে কুমড়ো গড়াগড়ি!

“তমাল সামলে নিয়েই বলল, ‘এই চুপ চুপ!’

“আর চুপ! ততক্ষণে এ ওকে দোষারোপের পালা শুরু হয়ে গেছে। কৌশিক জয়ন্তকে দুষছে, জয়ন্ত আমাকে, আমি অনুপমকে। চিল্লামিল্লি, হল্লা…

“যতক্ষণে আমাদের হুঁশ ফিরেছে, ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে। কালকের সেই নেড়া পাষণ্ড ততক্ষণে ‘আরে হোয়! কওন হ্যায় রে! কওন হ্যায় রে!’ বলতে বলতে এসে জুটেছে।

“এসেই আমাদের দেখে অবাক হয়ে বলছে, ‘কা রে বাবুয়া? কা হৈল বা?’ তারপর গামছা দিয়ে নেড়া মুণ্ডিটা মুছে নিয়ে গম্ভীর গলায় রাষ্ট্রভাষায় বলছে, ‘তুমলোগ হিঁয়া পর ক্যায়া কর রহে হো? ভাগো হিঁয়া সে! ভাগো! বরনা…’

“বরনা ক্যায়া পালোয়ানজি?’ তমাল পারফেক্ট গোয়েন্দার মতো প্রশ্ন ঝেড়েছে।

“বরনা বহোত বুরা হোগা!’

“বুরা তো তোমার হোগা পালোয়ানজি!’ কৌশিক বলতে শুরু করেছে, ‘আমরা যে সবকিছু জেনে গেছি।’

“কা জেনেছো, খোকাবাবু?’

“কৌশিককে থামিয়ে তমাল বলে উঠেছে, ‘তুমি যে ছেলেদের ধরে এনে এই ঘরের সুড়ঙ্গে আটকে রাখো আর তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে মুক্তিপণ চাও সেসব আমরা জেনে গেছি।’

“তমালের কাছ থেকে কথাগুলো শুনে সে পালোয়ান প্রথমটায় থম মেরে গেল। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘কোন ঘরে বললে খোকাবাবু?’

“এই তো, এই ঘরে। মাঝখানের সুড়ঙ্গটায়। আর একটা পোষা রক্তচোষা বাদুড়ও আছে তোমার। সব জেনে গেছি।’

“সেই শুনে কোথায় ভয় খাবে, তা না, সেই নেড়া ভীম হো হো হা হা করে বিকটভাবে হেসে উঠল। সে হাসি আর থামেই না তার। হাসে আর বলে, ‘ফির বোলো খোকাবাবু, ফির বোলো…’ তারপর বোধহয় সাঙ্গপাঙ্গদের ডাকতে শুরু করল, ‘আরে হো লছমন, আরে হো ভাউ, আরে হিঁয়া আও। দেখো ইয়ে ননহে জাসুস লোগো নে ক্যায়া কুছ ঢুন্ডা! আরে হো লছমন, হো ভাউ…’

“তার ডাক শুনে আরও দুই টিক্কিধারী মুষ্টন্ডা এসে জুটল। সব শুনে তারাও হাসতে শুরু করল। শেষে, ওই যার নাম লছমন, সে বলল, ‘আরে বাবুয়া, ইয়ে গুমঘর নাহি হায় রে!’

“তো ক্যায়া হ্যায়?’ তমাল চেঁচিয়ে উঠল।

“আরে ইয়ে তো খাটা পায়খানা হ্যায়!’ বলেই তিনজনের সে কী হাসি!

“আমরা তো ততক্ষণে চুপ। প্রথম কেসটার শেষে এমনি বেরোলে মন যেমন হওয়ার আমাদেরও ততক্ষণে তাই। গোদের উপর বিষফোঁড়া নেড়ামুণ্ডিগুলোর দাঁত ঝোলানো গা জ্বালানো হাসি। তমাল তবুও নাছোড়বান্দার মতো প্রশ্ন করেছিল, ‘তুমি বস্তা নিয়ে ওখানে কী করো?’

“মুখ কাঁচুমাচু করে পাষণ্ড নেড়া ভীম উত্তর দিয়েছিল, ‘হাতি গুম করি, জাসুসসাব।’

“কী অপমান, ভাব!”

“অপমান বলে অপমান!” দীপমামা হাসতে হাসতে বলল, “তবে দাদা, গোয়েন্দাগিরিটা কিন্তু ইউনিক। ক’টা গোয়েন্দা বলো এত খেটেখুটে খাটা পায়খানা বার করতে পারে?”

মিঠিমামা সেই বিচ্ছিরি খেউ খেউ হাসিটা হেসে শেষমেশ প্রশ্ন করল, “কিন্তু দাদা, সেই বাচ্চার কান্না?”

“সে কান্না তো আমরা পরে আরও শুনেছি। একদিন শব্দ লক্ষ্য করে তাকিয়ে দেখি কী ওই তালগাছগুলোর ডগে কতগুলো শকুনের বাচ্চা অমনি করে চেঁচাচ্ছে! কপাল। বুঝলি? কপাল। এই যদি আগে দেখতাম, তা হলে কি আর অমনি করে হ্যাল্লাসের পাত্র হতে হত?”

বাবার গপ্পো শেষ হতেই শুনি রুবাই ডাকছে, “সবাই খেতে চলে এসো। বাবু, চলে আয়।”

আমি ‘আসছি’ বলে উত্তর দিতে দিতেই দেখলাম কী, হলুদ পাখিটা মাথার উপর থেকে ‘পিক পিক’ করে ডেকে উড়ে গেল। পিক পিকই করল তো? নাকি ঠিক ঠিক বলল? নাকি খিক খিক করে হেসে গেল? নাহ্‌! একথাটা আর বাবাকে বলা যাবে না। যদি শোনে একটা পাখিও বাবাদের ব্যাপারটায় হেসে গেছে, বলা যায় না দুঃখও পেতে পারে।

প্রাণায়ামং কৃত্বা

আমি তো দেরি করেই ঘুম থেকে উঠি। কী করি, বিছানা ছাড়তেই মন চায় না। ঠেলা-গুঁতোয় উঠে পড়তে হলেও বালিশটাকে কোলে নিয়ে চোখ বুজে খানিকক্ষণ আলিস্যি করি। কী আরাম!

অবিশ্যি আজ কালীপুজো। সকাল সকাল তাই উঠতেই হত। মা ডেকে দিল। উঠে ব্রাশটা হাতে নিয়ে রুবাইয়ের সাথে বেরোলাম। রুবাই খুব শান্ত। ওকে আমার মতোই লাগে। যদিও ও মায়ের পরেই, তবুও ওকে মাসি আমি বলি না। তাতাইকেও তো বলি না। তাতাইয়ের সাথেও খুব জমে আমার। তাতাই অনেক খেলনা বার করে দেয়। আবার ঝগড়াও হয়। আমি, রুবাই, তাতাই একসাথে খেলি, কার্টুন দেখি, ঘুরে বেড়াই, অনেক গল্প করি।

এই যেমন এখন গোটা বাড়িটা চক্কর কাটছি। রুবাই আমায় দেখাচ্ছে কোথায় ওরা খেলত, কোথায় ছিল খপর খপর দাঁত বার করা ভূতের মাঠ, কেমন করে ওদের পিছন পিছন পাহারা দিয়ে সারা মাঠ ঘুরে বেড়াত পোষা কুকুর বাঘা—সব। এসব বলতে বলতেই ও জানো তো সেই মজার খেলাটার কথাটা বলল।

ব্যাপারটা হল কী, উঠোনের যেখানটায় এখন টিউবওয়েল, সেখানটায় আগে একটা নালা ছিল। সেখানেই ওরা তিন বোন মিলে রাম-লক্ষ্মণ রাম-লক্ষ্মণ খেলত। মা রাম। রুবাই সীতা। আর তাতাই লক্ষ্মণ। সবার কিন্তু নেড়া মাথা। গরমের ছুটি চলছে কিনা! নেড়া মুণ্ডিতে লাল লাল খোপ কাটা গামছা, সীতা-মাতার বিনোদ বেণী।

তো খেলা চলছে, খেলা চলছে। নিরালার তপোবন। লক্ষ্মণ ফল টুকিয়ে আনছে, ফুল নিয়ে আসছে। মালা গেঁথে ধুলো মশলায় রান্না করে সীতা-মাতার সময় কাটছে। এমন সময় আম্মার বাজখাঁই হাঁক! আম্মা নাকি তখন সারা সময় পেল্লায় রেগে থাকত। সে যাই হোক, ডাক তো পড়েছে। সেই শুনে তপোবনে তরাস তরাস! ইজের পরা রাম সেই শুনে মাটি থেকে কঞ্চির ধনুক তুলে কাঁধে ঝুলিয়ে সীতাকে গম্ভীর গলায় বলে উঠেছে, “চলো সীতা, অন্য বনে যাই। এখানে বড্ড রাক্ষসীর উপদ্রব।”

“তার মানে মা আম্মাকে রাক্ষসী বলল! আম্মা কিছু বলল না?”

রুবাই বলল, “বলবে না তো কী? কোনও ছাড়ান-ছুড়ান নাই! পিঠেও গদাম গদাম দিল। আমাদের ছোটোবেলায় জানিস, একজন দুষ্টুমি করলে অমনি করে তিন বোনকেই গদাম গদাম খেতে হত। মা বলত, ভালো হলেও তিনজনের সমান ভাগ, মন্দ হলেও তাই। জানিস বাবু, আমার হত জ্বালা! দিদি আর তাতাই সারাক্ষণ দুষ্টুমি করত, সারাক্ষণ! আর ওদের জন্য আমি কিছু না করেও সাজা পেতাম।”

বলতে বলতেই রুবাই গেটের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, “ওই দেখ বাবু, ঠাকুরমশাই এসে গেছে। চল, তাড়াতাড়ি চান করে নিই। চণ্ডীপুজো শুরু হয়ে যাবে।” বলেই বাড়ির দিকে ছুট।

ও আমাকে ছুটে হারাবে, তা আবার হয়? আমি হলাম গিয়ে চ্যাম্পিয়ন রানার! কাজেই দে দৌড়। ওকে হারিয়ে মায়ের কাছে আগে পৌঁছে বললাম, “মা চান করিয়ে দাও, চণ্ডীপুজো শুরু হয়ে যাবে!”

তো মায়ের আক্কেল দেখো! সবার সামনে গাল টিপে দিয়ে বলল, “ওলে আমাল ছোনা লে!”

চান-টান আমার সব সারা। নতুন পাঞ্জাবি পরাও সারা। নিচে গিয়ে দেখি, হল ঘরে চণ্ডীপুজো শুরু হয়েছে। দেয়ালের দিকে জলচৌকির উপরে শাড়ি দিয়ে ঠাকুর বানানো হয়েছে। ঘটের উপর শীষডাব। ঠাকুরমশাই মন্ত্র পড়ছে। সুরটা দারুণ। শুনতে খুব ভালো লাগছে। সবাই যে যার কাজ করছে। কেউ পুজো দেখছে। তাতাই পুষ্পপাত্র সাজাচ্ছে। টোকাটুলি চন্দন বাটছে। দু’রকম—শ্বেত চন্দন আর রক্ত চন্দন। মিমি রক্তচন্দন একটা পিতলের থালায় লেপছে। শুকিয়ে গেলে রাতে কালীপুজোয় লাগবে। আমি কাছে যেতেই দুটো আঙুল দিয়ে গালে লাগিয়ে দিল। যা, এখানে বসবই না।

মেজো বসে আছে দোতলার সিঁড়ির দিকটায়। আমি যেতেই আমায় ইশারায় ডাকল। কাছে যেতেই কানে কানে বলল, “ঠাকুরমশাইয়ের মুখটা দেখ।”

তাকিয়ে দেখি, ঠাকুরমশাই মন্ত্র পড়ছেন। টকটকে লাল ধুতির কোঁচা পায়ের নিচে গোঁজা, গলায় ঝুলছে লাল টকটকে উত্তরীয়। মাথা চকচকে করছে। আর চকচকে মাথা থেকে দুটো পেল্লায় জুলপি একদম হনু অবধি নেমে আছে। কপালে লম্বা লাল টিপ। চোখদুটো আদ্ধেক খোলা আর আদ্ধেক বন্ধ। ঠাকুরমশাই গমগমিয়ে বললেন ‘…প্রাণায়ামং কৃত্বা…’ বলেই ডানদিকের নাকে আঙুল চেপে সে কী লম্বা শ্বাস! তারপর ঝটকা দিয়ে দম বন্ধ। খানিক পর ফোঁওওস করে বাঁ নাক দিয়ে হাওয়া বেরোল। সঙ্গে খানিক সর্দির ছিটে। খোঁচা খোঁচা গোঁফে টুকরো টুকরো জলবিন্দু। তারপর আবার আঙুল দিয়ে বাঁ নাক চাপলেন। অমনি মেজোও আমার পাঁজরের গোড়ায় খোঁচা দিল। তাকিয়ে দেখি মেজো মুচকি মুচকি হাসছে। আমারও কেন যেন বেদম হাসি পাচ্ছে। কী জানি কেন পেট ফাঁপরে হাসি উঠে আসছে। চাপার চেষ্টা করছি। মুখটা খুলে যাচ্ছে আপনে আপ। হাসি চাপতে গেলে যে আমার আবার মুখটা হাঁ হয়ে যায়!

বেশিক্ষণ হাসি চাপতে পারব না বুঝে হাঁ মুখে উঠোনে নেমে এলাম। লিচুতলায় ছোদ্দিদি গোবর দিয়ে একটা পুতুল বানাচ্ছে। অলক্ষ্মী পুতুল। সন্ধেবেলায় তো মহালক্ষ্মীপুজো। তখন আগে কুলো বাজিয়ে অলক্ষ্মী বিদায় হবে।

অভিজিৎদাদা একটা ইয়াব্বড় কচুপাতা কেটে এনেছে। রাতে দীপাবলি হবে তো। তখন ওই পাতায় একশো আটটা প্রদীপ জ্বলবে। ওফ! কী দারুণ দেখতে হয় না তখন!

সব্বাই যে যার কাজ করছে। কেবল বাবা কানে ইয়ার-প্লাগ গুঁজে বাগানে পায়চারি করছে। আরে! বাবার মাথার উপর লিচুগাছটায় সেই হলুদ পাখিটা না! হ্যাঁ, ওইই তো! ওই যাহ্‌! ফের উড়ে গেল।

“এই, এই কোথায় যাস? ওই, ওই কোথায় যাস?”

ছুট লাগালাম।

পুকুরপাড়ে গিয়ে পাখিটা ফের হারিয়ে গেল আর আমি যা দেখলাম তাতে আমার গলা ভয়ে কাঠ হয়ে গেল! পুকুরের ওই পাড়ে একটা কাঁথা! আর জলের উপর একটা সাদা চুলের মাথা! চুল গলে গলে জল পড়ছে!

“পানডুবরা! পানডুবরা!” চেঁচাতে চেঁচাতে বাড়ির দিকে ছুটলাম।

লিচুগাছের নিচে ছোদ্দিদি খপ করে হাতটা ধরে বলল, “কী হয়েছে, নটি? কী হয়েছে? এত ছুটছ কেন?”

হাঁপাতে হাঁপাতে কথাটা বলতেই, “চল তো দেখি” বলে ছোদ্দিদি আমায় নিয়ে চলল পুকুরপাড়ে। গিয়ে দেখি যাহ্‌! কিচ্ছু তো নেই! সব ভোঁ ভা। না না, আছে তো! ওই ত্তো পুকুরপাড়ে সেই কাঁথাটা আছে। দেখো দেখো বলতে বলতেই পাড় ঘেঁষে ফের মাথাটা উঠল। আমি ছোদ্দিদির হাতটা শক্ত করে ধরলাম।

ছোদ্দিদি বলল, “ধুস! ও পানডুবরা হতে যাবে কেন? ও তো লালের বউ!” বলেই তাকে ডেকে বলল, “ও বউ! এই দেখ আমাদের নটি তোমায় দেখে কেমন ভয় পেয়েছে!”

সেও কী যেন একটা বলল কিন্তু আমি তা ভালো করে শুনতে পেলাম না। শুনব কেমন করে? আমি তো ততক্ষণে সেখান থেকে ধাঁ। ধাঁ হব না? একে লজ্জা পেয়েছি, তায় একটা মনার্ক আমার নাকের ডগায় এসে তুড়ুং তুড়ুং নাচ দেখিয়ে ডাকল যে! তুমি চেনো তো মনার্ক? তা হলে নিশ্চয়ই জানো যে ওরা আসলে আমেরিকার বাসিন্দা। একটা ডালে হাজার হাজার মনার্ক ফুলের মতো ঝোলে। ওরা আবার পরিযায়ী, জানো তো? মানে শীত পড়লেই দেশে দেশে উড়ে বেড়ায়। আমাদের এখানেও তো শীত পড়তে শুরু করছে। তা হলেই বোঝো, যদি এখান থেকেও চলে যায়! তখন? কাজেই ওর অমন তুড়ুং তুড়ুং নাচ, ওই রঙ দেখেও আর আমি দাঁড়িয়ে কথা শুনতে পারি?

ছোদ্দিদি ডাকতেই থাকল, ডাকতেই থাকল। চেঁচিয়ে বললাম, “তুমি যাও, আমি তিতলিটাকে ধরেই আসছি।”

তিতলিটাও উড়নচণ্ডী কম না। নাচতে নাচতে একবার গোলাপে বসল তো একবার জবায়, এই লিলিতে বসে তো ওই গিয়ে বসল ক্যাকটাসে। এক্কেবারে আমার মতন। একজায়গায় থাকতেই পারে না। সবাই বলে, আমার পায়ে নাকি চাকা লাগানো আছে। তাই নাকি একখানে দাঁড়াতেই পারি না।

উড়তে উড়তে বাগান পেরোল। ডালিমগাছটায় বসল। তিন-চারবার ধরার জন্যে লাফালাম। একবার প্রায় ধরেই ফেলেছিলাম, তবুও পারলাম না। হাতে বাদামি রঙ লেগে গেল। ও তারপর উড়তে উড়তে ফের হাজির হল কদমতলায়। তারপর পুকুরের দিকে নেমে গিয়ে জংলা ফুলগুলোয় বসতে লাগল। ছোদ্দিদি আর নেই। লালের বউও চলে গেছে।

হাঁপিয়ে গেছি। এখানটায় বরং একটু বসি।

বসতে না বসতেই মাথার উপর দিয়ে উড়ে মনার্কটা পিছনে চলে গেল। লাফিয়েও ধরতে পেলাম না। যাক গে। আমি এখানটায়ই বসি। আবার নিশ্চয়ই আসবে। তখন ধরব। হড়বড় করলে কি আর তিতলি ধরা যায়? আর এখানে বসতেও আমার আর কোনও ভয় নেই। আমি বুঝে গেছি, পানডুবরা-টুবরা বলে কিছু হয় না। যদিও হয় তবে সে হল লালের বউ। ছোদ্দিদির চেনা। কাজেই নো চিন্তা।

মনার্ক, মনাদিদি আর হলদে পাখি আম্মা

এবার তোমায় যা শোনাব, সে বিশ্বাস করা বা না করা গোটাটাই তোমার ইচ্ছে। এত কথা জানার পরেও বাপু যদি তোমার লাগে যে আমি মিথ্যে বলতে পারি, তো তবে তাই ভেবো! আমি আর কী করতে পারি? আমি তোমায় এটুকুই বলতে পারি যে, সে কথাগুলো ভাবলেও আমার সারা গায়ে রোম খাড়া হয়ে যায়। এই যেমন এখন হচ্ছে। কী বলছ? কী কথা? বলছি, বলছি। বলব বলেই তো আসা, নাকি!

শোনো। আমি তো সেই পুকুরপাড়েই বসে আছি। বেশ খানিকক্ষণ কেটেও গেছে। মনার্কটা আর আসেইনি! কাজেই উঠব উঠব ভাবছি। এমন সময় পিছনে একটা আওয়াজ পেয়েই ফিরে দেখি কিনা হলদে-বাদামি ফুলো ফুলো ফ্রকের এক দিদি। টুকটুকে ফর্সা। মাথার দু’পাশে দুই ঝুটি। অ্যান্টেনা। এই বড়ো বড়ো কাজলপরা চোখ। সাদা চোখের মধ্যিখানে কুচকুচে কালো বল। মাঝখানে পুঁচকি নীলচে তারা। দিদিকে আগে তো দেখিনি!

“দেখিসনি কী রে! তুই দেখি বেশ মিথ্যে বলিস!”

“কোথায় মিথ্যে বললাম! কিছুই তো বলিনি আমি!”

“অ্যাই মিথ্যুক! তুই এইমাত্র মনে মনে বললি না আমায় কখনও দেখিসনি? বললি কি না বল!”

“তুমি মনের কথা শুনতে পাও!”

“হাঁদারাম, অত জোরে জোরে মনের ভেতর কথা বললে সবাই শুনতে পায়।”

বললাম, “হ্যাঁ বলেছি। কিন্তু সে মিথ্যে হবে কেন? আমি তো সত্যিই তোমাকে আগে কখনও দেখিনি।”

“সাধে ভাই তোকে হাঁদারাম বললাম? আমারই পিছন পিছন এতক্ষণ ছুটলি, আমারই খোঁজে এখানে বসে রইলি, আর আমাকেই বলছিস দেখিসনি! পারিস বটে।”

“তোমার পিছন পিছন মানে? এই দাঁড়াও, তুমি কি মনার্ক?”

খিলখিল করে হাসতে হাসতে দিদি বললে, “হ্যাঁ রে হাঁদা, তাই।” তারপর আমার মাথাটা নেড়ে দিয়ে বললে, “ভাই আমার, এখন যেন আর আমায় মনার্ক বলিস না। বরং বলিস মনাদিদি। কেমন?”

অবাক হয়ে ঘাড় নাড়লাম।

মনাদিদি বলল, “অমন হাঁ করে দেখছিস কেন রে? এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না? এই দেখ।” বলেই কিনা মনাদিদি দৌড়োল। দৌড়তে দৌড়তে তুড়ুক করে দিল এক ছোট্ট লাফ। আর কী বলব! লাফিয়ে উঠেই মনাদিদি হয়ে গেল সেই মনার্কটা। মনাদিদির ঝুঁটিদুটো হয়ে গেল মনার্কের শুঁড়। ফড়ফড়িয়ে উড়ে গেল উই ছোট্ট ক্ষেতটার কাছে। সেখানে ফজুদাদুর লাগানো রাই-সর্ষের গাছে হলুদ হলুদ ফুল। এ-ফুল থেকে ও-ফুল তুড়তুড়িয়ে উড়ে, জ্যাবোরান্ডির হলুদ ফুলগুলোয় ঘুরে, রংবিরঙ্গি পাখাদুটো জুড়ে আমার সামনে এসে তুড়ুং করে আবার হয়ে গেল মনাদিদি! আমি তো হাঁ!

দিদি বলল, “বিশ্বাস হল, বুদ্ধুরাম? এই দেখ, গায়ে আমার এখনও সর্ষে ফুলের রেণু।”

“সত্যিই তো! অবাক কাণ্ড!”

“অবাক কী রে? তুইও তো পারিস। চাইলেই পারিস।”

“ধুত! কী যে বলো! আমি আবার এসব কেমন করে পারব?”

“এহ্‌! সবজান্তা একেবারে! আরে হাঁদা, তোর গুণ আছে বলেই না আমায় দেখতে পাস! বৌদিদিমণিকে দেখতে পাস। আর কেউ পায়?”

“বৌদিদিমণি আবার কে?”

“সে কী! দু’দিন ধরে তার দেখা পেলি, এদিক ওদিক দৌড়োলি, আর এখন চিনতেই পারছিস না? দাঁড়া ডাকি। বৌদিদিমণি! ও বৌদিদিমণি! একবারটি শুনে যাও! দেখো, এই হাঁদাটা বলছে তোমায় নাকি চেনেই না!”

“দেখো, বারবার যদি অমনি করে হাঁদা হাঁদা বলো, তা হলে আমি চললাম।”

যেই না বলা, অমনি মনাদিদি আমার গালটা টিপে দিয়ে বলল, “ও সোনা ভাই! রাগ করিস না। ও তো আমার আদরের ডাক। সেও বুঝিস না! আচ্ছা দাঁড়া, তোকে একটা জিনিস দিই।”

বলেই করলে কী, নিজের হাতদুটো ঘাসে আর রঙ্গনগাছের পাতায় বুলিয়ে নাড়ু পাকানোর মতো করে আকাশে ঘুরিয়ে আমার হাতের তেলোয় একটা সাদা বলের মতো কী যেন রাখল।

“কী গো এটা?”

“কী আবার! শিশির!”

“এত ঠাট্টা করো কেন তুমি? শিশির এমনি হয়?”

“হ্যাঁ রে ভাই, যেমনি চাইবি তেমনি হয়। কেবল চাইতে জানতে হয়। গাছের পাতায়, ঘাসের ডগে যে শিশিরকণা জমে, তাকে হাতে নিয়ে সুয্যিমামাকে ডাকতে হয়। সুয্যিমামা কিরণ বুলিয়ে দিলেই, ব্যস। যেমনটি চাইবি ঠিক তেমনি।”

“ধুস! আমায় ছোটো পেয়ে যা খুশি বোঝাচ্ছ?”

“বিশ্বাস করছিস না তো? তবে গোলকটাকে আলোয় দেখ।”

কিছুই হবে না জানি, তবুও যদি হয়, সেই লোভে লোভে বলখানা সূর্যের দিকে ধরলাম। আরিব্বাস! সত্যিই তো! বলভর্তি রামধনু! আর সাতরঙের মধ্যিখানে কী যেন একটা টলটল টলটল করছে।

“তুমি এটা আমায় দিয়ে দিলে, মনাদিদি?”

“ভাই পেয়েই দিয়ে দিলি, মনা? কই, আমি যে এত করে চাই তাও তো দিস না!”

কে কথা বলে? কদমগাছের বড়ো বড়ো পাতার পিছন থেকে কে অমনি করে কথা বলে! ভয় পেয়ে দিদির গা ঘেঁষে দাঁড়ালাম। দিদি বলল, “বেরিয়ে এসো না, বৌদিদিমণি! ভাইটা আমার ভয় পায় তো!”

“বাবা, বাবা! ভাই যেন আর কারও হয় না! তাও যদি আপনার হত!”

“আপনারই তো।” এই না বলে মনাদিদি আমায় কাছে টেনে নিলে। আর অমনি পাতার ফোঁকর থেকে সেই হলুদ পাখিটা উড়ে এসেই ঝুপ করে দিল এক লাফ। আরি বাবা! এ কী! এ যে হলুদ শাড়ি পরা আম্মা!

বললাম, “ও মনাদিদি, এ তো আমার আম্মা!”

“আম্মা নয় রে ভাই, এ আমাদের বৌদিদিমণি।”

“কী মুশকিল! এ তো অবিকল আম্মার মতো! তুমি ঠিক করে দেখো!”

“সে নয় বাপু তুমি আমায় আম্মাই বোলো।” সেই হলুদ পাখি আম্মা বলল।

সেই শুনে মনাদিদি বলল, “সে কেমন করে হবে? ও তো আমার ভাই! আর তুমি হলে আমার দিদি। কাজেই তুমি ওর আম্মা হবে কেমন করে?”

“আরে হলেই হল। আমাদের এখানে কী আর বয়স বলে কিছু আছে নাকি! যেমন বয়স নেই, তেমন সম্পর্কেরও কোনও নাম নেই। যেমনি খুশি পাতিয়ে নিলেই হল।”

“তা হলে তাই থাক। বেশ ভাই, তুই বৌদিদিমণিকে না হয় আম্মাই ডাকিস, কেমন?”

কী যে হচ্ছে কে জানে! ঘাড় নাড়লাম। আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি অমনি করে পাখি বনে রং বদলে বদলে ওড়ো কেন?”

“নইলে তোমার চোখে পড়ব কেমন করে?”

“কেন? আমার চোখে পড়তে হবে কেন?”

“ও মা! চোখে পড়তে হবে না! তবে তোমায় দলে নেব কেমন করে?”

“আমি তোমার দলে যাব কেন?”

“তুমি তো এমনি-এমনিই আমাদের দলে। কেবল তোমাকে মনে করিয়ে দিতে আসা।”

“ধুস! আমি কি তোমাদের মতো উড়তে পারি নাকি?”

“নাই বা পারলে উড়তে। কিন্তু কত কী দেখতে পারো! সেই বা কম গুণের নাকি? আমাদের ওখানে তো একেকজনের একেক গুণ। তোমার মতো গুণ তবুও কারুর নেই।”

“তোমাদের ওখানে মানে, কোথায়?”

“কেন? ওই তো ওইখানে।”

যে জায়গাটা দেখাল তাতে আমার বুকের ভিতর ধক করে কী একটা লাফিয়ে উঠল। চেঁচিয়ে বললাম, “বুঝেছি বুঝেছি, তুমি আসলে পানডুবরা। আমায় ধরতে এসেছ!”

“ধুত হাঁদারাম! পানডুবরা কেন হবে? বৌদিদিমণিকে বড়োজোর পানকৌড়ি বলতে পারিস। পানডুবরা তো অন্যজন।”

“তবে? কেমন ধরেছি? পানডুবরা আছে কি না? বলেছিলাম না, আছে। ঠিক আছে। সব্বাইকে জলে টানে। তোমরা হলে তার লোক। আমায় এবার ধরে নিতে এসেছ। আমি ঠিক বুঝেছি।”

“ঘোড়ার ডিম বুঝেছিস। পানডুবরা সবাইকে টানতে যাবে কেন? তার বুঝি লোক কম পড়েছে? তিনি কেবল সেই লোকদেরই কাছে টানেন, যাদের কিনা বিশেষ কিছু গুণ আছে। তাও যদি সে সে-রাজ্যে থাকতে না চায়, তবে ফেরতও দিয়ে যায়। কাউকে আটকে রাখবে কেন? সে তো আমাদের রাজ্যের সবচে’ ভালো রাজা।”

“পানডুবরা তোমাদের রাজা?”

“হ্যাঁ! এতে অবাক হবার মতো কী আছে?”

“পানডুবরা সত্যি সত্যি তিনজন মানুষের আত্মা দিয়ে বনা?”

“আরে না না। সেগুলো সব গপ্পোকথা। আসল কথাটা অন্য।”

“কী সে কথা? বলো না, আম্মা!”

“বলছি রে বাবা, বলছি। আসলে আমাদের রাজ্যটা তো অন্য রাজ্য থেকে আলাদা, যাতে চট করে কেউ সেখানে যাওয়ার কথা ভাবতেও না পারে সেজন্যে এসব গপ্প। আসলে এই রাজ্য থেকে সেখানে কেবল সেই মানুষদেরকেই নিয়ে যাওয়া হয় যাদের কিছু না কিছু সুন্দর গুণ থাকে।”

“কেন?’

“কেন আবার? যাতে বাইরের ধুলো-হাওয়ায় তাদের গুণগুলো নষ্ট হয়ে না যায়, সেজন্য!”

“গুণ কি কোনও খাবার, যে নষ্ট হবে?”

“হ্যাঁ রে ভাই, হয়।” মনাদিদি বলল, “এই দেখ না, তুই যে এখন আমায় দেখতে পাচ্ছিস, কথা কইছিস, বড়ো হলেই তোর সে গুণের উপর এমন ধুলো জমবে যে আর আমায় চিনতেই পারবি না। তোর চারপাশে উড়ে উড়ে বেড়াব, তবুও চোখ তুলে দেখবি না। একটিবারও আর ডাকবি না।”

মনাদিদির গলাটা কাঁপছে। বোধহয় কান্না পাচ্ছে। কী যে বলে না! আমারও কষ্টে গলাটা ব্যথা করছে। মনাদিদি হাতের পিছনে চোখ মুছল। এ বাবা! হাতে লেগে থাকা সর্ষের রেণু চোখের জলে মাখামাখি। গালের উপর সোনার গুঁড়ো।

আম্মা বলল, “সেজন্যেই তো গুণবান-গুণবতীদের নিয়ে যাওয়া হয় সে-রাজ্যে। তবে জানো তো, যাদের দুষ্টু মন, তারাও খোঁজে সেই দেশ।”

“কেন?”

“কেন আবার? ভালো কিছু যে তারা সইতে পারে না!”

“তাহলে!”

“তাহলেও কিচ্ছু না।” একগাল মিষ্টি হেসে আম্মা বলল, “রাজা পানডুবরা আছেন না! যাতে কেউ খোঁজ করতে না চায়, সেজন্যেই তো অমন ভয়ের কথা ছড়িয়ে দেয়া। ভয়ের ঢেউ যাতে কম না হয়, সেজন্যেই তো মাঝে মাঝে আমরা আসি।”

“দুপুরবেলা?”

“সব দুপুরে নয়। লোক থাকলে দেখে ফেলবে না! যখন দুপুর ফাঁকা হয়ে যায়, উখান থেকে ইখান আবার ইখান থেকে উখান সরসরিয়ে বাতাস বয়ে যায়, গাছে গাছে পাতায় পাতায় শব্দ ফোটে, ঠিক তক্ষুনি হয় ঘুঘু, না হয় কোকিল ডাকে। ওদের ডাক শুনলেই আমরা বেরিয়ে আসি।”

হাঁ করে শুনছিলাম। এবার জিজ্ঞেস করলাম, “তোমাদের দেশে অনেক সুন্দর সুন্দর গুণ আছে?”

“অনেক অনেক! তুমি যা যা ভাবতে পারো, তার সবকিছু আছে। এই দেখো না, গত সপ্তাহেই একজন এল। অদ্ভুত ছবি আঁকে।”

“এ আর এমন কী! আমিও আঁকতে পারি।”

“সে তো পারোই। কিন্তু শুধু আঁকা নয়, এ যে জীবন্ত ছবি!”

“মানে?”

“মানে ও ছবি আঁকার পর যখনই ‘যাও তো’ বলে, অমনি সব আঁকা ছবি জ্যান্ত হয়ে চলে বেড়ায়।”

“যাহ্‌! তাই আবার হয়!”

“হয় বলেই না বলছি!”

“ভাই, এতেই অবাক হচ্ছিস, আরও কত কী আছে জানিস! কেউ এমনিই জীবন্ত গান গায়, কেউ ঘুমের মধ্যে ভবিষ্যতের ছবি দেখে, কেউ জ্বলন্ত আগুন গপ করে গিলে নেয়, কেউ হাওয়া থেকে কী জানি কী ধরে আটকে রেখে কাজে লাগায়, কেউ মাটিতে ঢ্যালা পুঁতে দিলেও সেখান থেকে আম-কাঁঠালের গাছ গজায়, কেউ জীবজন্তুর ভাষা বোঝে তো কেউ ফুলে গন্ধ ভরে, কেউ জলের উপর হাঁটে তো কেউ শিমুল তুলোর মতো বাতাসে ওড়ে। কেউ হাওয়ার বেগে ছোটে তো কেউ আবার গাছের মতো চুপ। কেবল আঙুল নেড়েই জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলে।”

“টেলিকিনেসিস!”

“তুই চল না ভাই, আরও কত কী দেখতে পাবি!”

“না বাবা!”

“কেন?”

“ভেবো না যেন ভয় পেয়েছি। আসলে কাউকে তো বলা হয়নি। না বলে তো আমি আবার কোথাও যাই না কিনা। তাই।”

“সে কি রে! এই না আমায় আম্মা বললি! তবে! আমি তো জানলুম।”

“তুমি তো আর সত্যি সত্যি আম্মা নও!”

“ধুত বোকা! আমি তো সত্যিই তোর আম্মা! বেশ চল। আমিও যাচ্ছি তোদের সাথে।”

“সত্যি?”

“সত্যি, সত্যি, সত্যি।”

“বেশ। তবে চলো।”

যেই না বলা, অমনি আমার হাতদুটো দু’জনে ধরল। তারপর তুড়ুক করে একটা লাফ দিয়েই শুরু করল উড়তে। উড়তে উড়তে চলল পুকুরের মধ্যিখানে। জলের কোলে আমাদের ছায়া ফুটল। দু’পাশে মনাদিদি আর আম্মা। মধ্যিখানে আমি। কিন্তু বিশ্বাস করো, সে আমি আমি নই!

জলের মধ্যে যার ছবি মাঝখানে, সে এক ল্যাজ নাচুনে ছোট্ট দোয়েল!

কেমন করে হল ভাবতে-ভাবতেই ঝুপ্পুস করে সেঁধোলাম এক্কেবারে জলের ভিতর!

জলের নিচে আকাশ, নাকি মাটির উপর জল!

সেঁধোলাম তো সেঁধোলাম। হুউউস করে জল দু’পাশ থেকে কেটে যাচ্ছে। পুকুরটা এত ডিপ বাইরে থেকে তো বুঝিনি! নামছি তো নামছিই! রঙবেরঙের বেলুনের মতো, রঙিন কাগজের শিকলির মতো কত কী সব চারদিক থেকে তুড়বুড়ুক তুড়বুড়ুক করে ভেসে ভেসে গেল! অমনি কতগুলো সি-হর্স এসে আমাদের ঘিরে ঘিরে তুলুং তুলুং নাচ জুড়ল। দুটো লেদারব্যাক টার্টল ইয়াব্বড় খোলস পিঠে নিয়ে হাত-পা ছেদরে সাঁতরে সাঁতরে এগোতে এগোতে মুখ ঘুরিয়ে ‘কেমন আছ, কেমন আছ’ বলল। উত্তর দিতে যাব, এমন সময় দেখি সার্ডিনের মতো একটা ছোট্ট ছোট্ট মাছের ঝাঁক উল্কার মতো স্পিডে সাঁতরাচ্ছে। সাঁতরাচ্ছে আর মুহূর্তে মুহূর্তে ঝাঁকের আকার বদলাচ্ছে। এই বর্শা তো এই মুগুর! এইসব জড়ো হয়ে পিরামিড, তো ওই পিরামিড ভেঙে ছত্রকার! তারপর হুউশ করে ঢুকে গেল পাথরের খাঁজে। অমনি দেখি, আরে আশেপাশে যে পরপর ডুবন্ত পাহাড়! পাহাড়ের খাঁজে তুলতুলে অ্যানিমোনির আঙুল কেমন তিলিমিলি করে দুলছে! আঙুলের খাঁজে খাঁজে লুকোচুরি খেলছে কত্ত ক্লাউন ফিশ! কী তাদের বাহার!

জানি। তুমি এবার কী ভাবছ। ভাবছ তো মিথ্যে বলছি? পুকুরে আবার সি-হর্স? কিন্তু তুমি বিশ্বাস না করলেও আমার কিচ্ছুটি করবার নেই গো। যা দেখেছি, আগাগোড়া তাইই বলছি। আমিও কি কম অবাক হয়েছিলাম! কী নেই সে তল্লাটে! পাঁচ আঙুলে, ছয় আঙুলে স্টার ফিশ, গোলাপি আলোর মতো জেলি ফিশ, কমলা গায়ে কালো ডোরাকাটা ডোরাকাটা লেজের টাইগার ফিশ। স-অ-ব! সি-সার্পেন্ট (অবশ্য ওগুলো লম্বা লম্বা অর ফিশও হতে পারে কিন্তু), মোরে ইল, ইয়াব্বড় রাক্ষুসে ইলেকট্রিক ইল, দাঁত বার করা ধুমসো ধুমসো  সিল (তাদের কারও কারও আবার হাতির মতো শুঁড়), আট-ঠেঙে অক্টোপাস, সুন্দরী ডলফিন, তারপর ইয়াব্বড় ব্লু হোয়েল! স-অ-অ-ব! সত্যি! সব দেখলাম!

একেকটা জায়গায় যেন তাদের সভা বসেছে। থ্যাবড়া পাথরের মঞ্চে যেন ডলফিন লেজে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে। কোথাও আবার কাঁকড়ার দল দাঁড়া ফুলিয়ে পাঞ্জা লড়ছে। একটা ব্যারাকুডাকে দেখে তো মনে হল ছোটো ছোটো ছানাপোনাদের পড়াচ্ছে। ব্যস্তসমস্তভাবে প্রচুর সার্ডিনকে দেখলাম অফিস দৌড়োচ্ছে! সবথেকে আশ্চর্যের ব্যাপার, কোত্থেকে ওর মধ্যে হাজির হল ইয়াব্বড় এক পাকা কাতল! তার নাকে জ্বলজ্বল করছে নোলক। গায়ে যেন শ্যাওলার কোট। আমার কাছে এসে বলল, “ওয়েলকাম হোম, বেলো!”

সঙ্গে সঙ্গে আর সবাই তাদের বুক-পাখনা হাতের মতো করে নাড়তে শুরু করল।

হাঁ করে ওদের সবাইকে দেখতে দেখতেই নামতে লাগলাম। আরও নিচে, আরও নিচে।

একসময় ভুস করে বেরিয়ে গেলাম জল থেকে। হ্যাঁ গো! উপরে চেয়ে দেখি, মাথার উপর জলের আকাশ। আর আমার চারপাশে তুলতুলে সব মেঘ। গায়ে হাত দিতেই তাদের সে কী খিলখিল হাসি! বলে, “এই, কী করছ! কাতুকুতু লাগে যে! অমন করে হাত দিও না। আমরা যে বেশ সুড়সুড়ি সইতে পারি না। গলে যাব যে!”

পিকপিক করে মিহি সুরে বলে আর এ ওর গায়ে হাসতে হাসতে গড়ায়। গড়াতে গড়াতে দুয়ে মিলে হয়ে যায় একটাই মেঘ! কেমন মজা!

শুধু মেঘ? কতরকম যে পাখি সে আর তোমায় কী বলি। লাল, বেগুনি, ছাই-ছাই, জামরঙা—কত্ত! কারোর নাম জানি না। কোনওদিন দেখিইনি এমন সব পাখি। ওরা করল কী, আমাদের ঘিরে সব্বাই মিলে ঘুরে ঘুরে এরোপ্লেনের মতো নামতে লাগল।

আম্মা একটা পাখিকে ডেকে বলল, “ও শ্যামা! আমার সাথে কে বল দেখি।”

শ্যামা তখন উড়তে উড়তে হাসতে হাসতে জবাব দিল, “জানি গো, জানি। ওই তো ও-বাড়ির দস্যি ছেলে।”

আমি দস্যি! যাও, মুখপুড়ি শ্যামা! তোমার সাথে কথা নেই।

আমার মুখে বুঝি মনের ভাব ফুটে উঠে থাকবে। নইলে শ্যামা তার কথা বদলে নেবে কেন? মুহূর্তে বলে কিনা, “না না! দস্যি কোথায়, বালাই ষাট! ও তো আমি ঠাট্টা করে বললাম। ও আসলে সোওনা ছেলে। কুচুমনা ভালো ছেলে।”

এমন করে কথা বলতে বলতেই আমরা মেঘের দেশ, পাখির দেশ, মৌমাছির দেশ, তিতলির দেশ পার হয়ে টুপ করে নেমে পড়লাম মাটিতে। ওমা! নামতেই দেখি আর সব পাখিগুলোও নেমে পড়ল! আর নামতেই তারা হয়ে গেল একেকজন মানুষ!

আরও আশ্চর্যের কথা কী, সেই যে সেই শ্যামা পাখি, সে কিনা নেমে নেমেই হয়ে গেল সোনামা! ডেকে বলল, “কী রে বাবু! কেমন লাগছে এখানে এসে?”

এবার আমার একটু রাগও হল। সবাই সব জানে, তবুও কই আমায় তো আগে বলেনি!

মনাদিদি বলল, “চল ভাই, তোকে সব দেখিয়ে আনি।” বলেই আরও কী কী সব নাম ধরে ডাকতে শুরু করল।

আরিব্বাস! ডাকতে না ডাকতেই পিলপিল করে হাজির হয়ে গেল আমার সব বন্ধুরা! এটা কেমন করে হল? আমায় দেখে সবাই খুশি। আমিও খুব খুশি।

সবাই মিলে তখন সে কী খেলা! এই লুকোচুরি তো ওই কুমিরডাঙা। ‘কুমির তোমার জলকে নেমেছি!’ বলে পা বাড়ালেই কোত্থেকে পায়ের নিচে জল চলে আসে! তারপর হাঁচড়ে-পাঁচড়ে ডাঙায় উঠে হাঁপাই।

মন ভরে খেলার পরে সব্বাই মিলে গেলাম একটা বাগানে। সেখানে কত্ত ফুল! ফুলের কাছে যদি জিজ্ঞেস করো, ‘তোমার নাম কী?’ অমনি মিষ্টি একটা হালকা স্বরে জবাব দেবে, ‘আমার নাম গাঁদা’, ‘আমি অপরাজিতা গো’, ‘আমি হলাম ঘেঁটু’, ‘আমি তো কলাবতী।’ কী মজা বলো তো!

গোটা বাগানটা জুড়ে খেলার দুনিয়া। আর একটা কেমন বিকেল বিকেল আলো। আমরা কত খেললাম সেখানে সে আর কী বলি। তারপর যেই না ঢং করে ঘন্টা বাজল অমনি সবাই চুপ।

সত্যি গো! একদম ইশকুলের মতন ঘন্টা! বাজলও ঠিক টিফিন শেষের ওয়ার্নিংয়ের মতো! যেই না থামলাম, অমনি মনাদিদি বলল, “এই হাঁদা! এখানে কী আর ওরকম কোনও বাধা আছে নাকি! খেল!”

অমনি ফের খেলা শুরু। খেলতে খেলতে যখন পা দুখতে শুরু করল, তখন মনাদিদি বলল, “ভাই রে! আজ তবে এটুকুই থাক। কেমন? এখন চল, তোদের সভায় নিয়ে যাই।”

“সভা মানে রাজসভায়? মানে পানডুবরার কাছে?”

আমি আর কী ভয় পাব! দেখি আমার বন্ধুরাই সবাই ভয়ে জড়সড়। বিট্টু তো ভ্যাঁ করে কেঁদেই ফেলল। ও অবশ্য বরাবরই এরকম। ওর শার্পনার নিয়েছিলাম বলে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে ম্যামের কাছে এমনি বকুনি খাইয়েছিল যে আজও মনে আছে। সুযোগ পেয়েই ওকে ঝেড়ে দিলাম। “বাচ্চাদের মতো কাঁদিস না তো বিট্টু!”

মনাদিদি বলল, “এত ভয় পাওয়ার কী আছে? তোমরা তো সব্বাই বীরপুরুষ। আর রাজামশাইও তো বাঘ-ভাল্লুক নন। দত্যিদানোও নন।”

আমি বললাম, “এই দেখ, আমি তো ভয় পাচ্ছি না!”

আমার পরপরই ভোলা, লাল্টু, বুদ্ধু, চাঙ্কু, নীলু, ছক্কু, নেড়ু সব্বাই বলে উঠল, “আমরাও ভয় পাচ্ছি না।”

“তবে চল, আমরা সবাই চলি রাজসভায়।” এই না বলে মনাদিদি পাশের কলাগাছ থেকে একটু খানিক পাতা ছিঁড়ে নিল গুটিয়ে। তারপর তার সরু দিকটা মুখে পুরে দিল একটা ফুঁ। তাজ্জব! অমনি একটা ভোঁওওপ করে জোর শব্দ উঠল। আর কী বলি তোমায়, কোত্থেকে আরও কত মনাদিদি এসে হাজির হল! সব্বার হাত ধরে নিয়ে চলল সামনের দিকে।

চলতে চলতে খানিক বাদে গাছপালার মাথা ফুঁড়ে উঠে এল এক মস্ত বাড়ির চুড়ো। কেমন বলব, ঠিক অনেকটা জোড়াসাঁকোয় রবিঠাকুরের বাড়ির মতন। না না, আরও বড়ো। আরও অনেক বড়ো। বাড়ির ছাতের কোনায় কোনায় পরি। মার্বেলের।

যেই না আমরা সেই বাড়ির সামনে ফুলে ভরা বাগানের কাছে গেলাম, কী বলব রে ভাই, অমনি সব পরিগুলো ডানা মেলে উড়ে এল। সত্যি! ছাতের পরিরা এল, বাগানের ফোয়ারায় যে নীলপরি কলসে করে জল ঢালছিল, সেও এল উড়ে।

পরিরা সব উড়তে উড়তে ঘুরতে ঘুরতে বলতে থাকল, “সুস্বাগতম! সুস্বাগতম!” বলল আর সবার হাতে দুটি করে উপহার দিল। তার মধ্যে একটা লাল গোলাপ, আর একটা ফুরররর বাঁশি।

কত আর বলি! যত এগোতে থাকি, ততই এমন সব কাণ্ড ঘটতে থাকে যে আমাদের অবাক হবার আর শেষ থাকে না। শেষটায় আমরা সব্বাই বিশ্বাস করলাম, যে এখানে সবকিছুই জীবন্ত। গাছ, ফুল, পাতা, ধুলো, শিশির, মেঘ, পরি—স-অ-ব।

পানডুবরা

তারপর সেই মনাদিদিরা আমাদের নিয়ে এল দরবার কক্ষে। সেখানে ঢুকেই তো চোখ ছানাবড়া! কীসের দরবার কক্ষ! এ তো আমাদের ইশকুলের অ্যাসেম্বলি হল! কীসব হচ্ছে!

ভাবতে না ভাবতেই দেখি ক্লাসের নাম লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল সব আন্টিরা। আর তাদের পিছনে এসে দাঁড়াল সব ম্যাম। সব্বাই যে যার লাইনে দাঁড়াতে হবে নাকি! হুড়োহুড়ি করে লাইন লাগাতে যেতেই মনাদিদি হাত টেনে বলল, “ধুস! এখানে কি কেউ নিয়ম মানে রে হাঁদা! দাঁড়া চুপ করে।”

আমি বললাম, “দেখছ না আন্টিরা কেমন প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়েছে!”

“দাঁড়িয়েছে তো দাঁড়িয়েছে। ওটা ওদের কাজ। তুই এখানে দাঁড়া তো!”

তো কী আর করি। পাশে তাকিয়ে দেখি শান। ও ওর ইশকুল নিয়ে খুব বড়াই করত। আজ এখানে পেলাম যখন ওকে একবার দেখিয়েই দিই আমাদের ইশকুলটা কেমন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে ডেকে বললাম, “এই দেখ! এই হোঁদল! এই দেখ। এই হল আমাদের ইশকুল। বুঝলি?”

শুনে ওর কী হাসি! হাসতে হাসতে যেন দশ নম্বুরি ফুটবল মার্কা পেটটাই ফাটিয়ে ফেলবে। শেষে বলল, “ধুর! তোর ইশকুল হবে কেন রে? এটা তো আমার ইশকুল। দেখছিস না ওই যে আমাদের ম্যাম দাঁড়িয়ে আছে!”

ব্যস। ধুন্ধুমার! টাইফুন! হয় হুদহুদ, না হয় আয়লা! নিদেন লায়লা তো হবেই! হবে না! এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে। তাদের সব্বার দাবি, এ হল তার নিজের ইশকুল। পষ্ট তাদের ম্যামদের দিদিমণিদের দেখা যাচ্ছে, অথচ সে নিজে ছাড়া আর কেউ মানছে না। মানছে না তো মানছেই না, উলটে নিজের বলে দাবি করছে। তুমুল অস্তিত্ব সংকট। প্রথমে বোঝানো, কাজ না দেওয়ায় ঠেলাঠেলি, ফেল পড়ায় চুল খামচানো, নাক খাবলানো, আভরণ আকর্ষণ সেরে যখন কোস্তাকুস্তিতে টার্ন নেব নেব করছে, তক্ষুনি মনাদিদিরা ফের তাদের ওই পাতার ভেঁপুটি ফুঁকল। আর অমনি কোত্থেকে বুটিবুটি চুড়িদার লম্বা লম্বা আন্টিরা এসে সব্বাইকে আলাদা করে দিল। তারপর ফুড়ুত করে চকরাবকরা ফড়িং হয়ে তুলুক তুলুক মাথা নাড়িয়ে কোথায় গেল উড়ে। আর অমনি আমাদের সব্বার সামনে একটু দূরে উপরদিকে একটা ঝাড়বাতি উঠল জ্বলে। তাকিয়ে দেখি, সেই ঝাড়বাতির নিচে এক সিংহাসন। আর সিংহাসনে কে বসে আছে জানো? আমাদের প্রিন্সিপাল ম্যাম!

মনে হল জুজুদাদার মতো বলি, ‘হা গোবিন্দ! হা মুকুন্দ! এই জন্যেই প্রিন্সিপাল ম্যামের ঘরের পাশে এত বড়ো পুকুর! কতদিন দেখেছি, অথচ বুঝতেই পারিনি প্রিন্সিপাল ম্যাম আসলে পানডুবরা! বুঝলাম তো বুঝলাম এমন জায়গায় এসে! এবার তো নির্ঘাত আমার মুণ্ডু যাবে!’

“ও বিট্টু!”

বিট্টুকে ডাক দিতেই দেখি ও একটা আঙুল ঠোঁটের উপর রেখে চুপ দেখাচ্ছে আর আরেকটা হাত দিয়ে প্রিন্সিপাল ম্যামের দিকে ঠাওরাচ্ছে।

ফিসফিসিয়ে বললাম, “বিট্টু! এবার কী হবে রে! আমাদের আর বাড়ি ফেরা হবে না। মা-বাবা সব্বাই কাঁদবে রে!”

বলতে না বলতেই চোখ ভেঙে জল পড়তে লাগল। ওদিকে বিট্টুরও দু’গাল ভেসে যাচ্ছে। তবুও মুখে কোনও কথা নেই। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি সব্বাই কাঁদছে। এমনকি অমন ডাকাবুকো ভোমলাটারও চোখে জল!

গমগমে আওয়াজ তুলে প্রিন্সিপাল ম্যাম এবার বলে উঠলেন, “তোমরা যে যা দেখছ, সব্বাই ঠিক দেখছ। তোমাদের সব্বার স্যার-ম্যামরা এখানে আছেন। এবার চুপটি করে শান্ত বাচ্চা হয়ে আমার কথা শোনো, আমি সবকিছু তোমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছি।”

যেই না বলা, অমনি মাদার আন্টিরা কোত্থেকে এসে ফটাফট চেয়ার-টেবিল সাজিয়ে দিয়ে গেল। আমরা সবাই বসলাম। তখন দেখি ক্যান্টিনের আন্টি আসছে। হাতে তার, উল্লুস! ভ্যানিলা আইসক্রিম! স্ট্রবেরি টপিংস! সব্বাইকে দিল।

ম্যাম বলছেন, “তোমরা খাও। খেতে খেতেই শোনো আমি কী বলছি।”

বাহ্‌, বাহ্‌! এ তো দারুণ কথা।

কিন্তু না। দারুণত্ব বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। নিদারুণ ব্যাপার সব ঘটতে শুরু করল আশেপাশে। হঠাৎ করে নাকি বিপ্লবের আইসক্রিমে ভূমিকা চামচ বসিয়ে খেয়ে নিয়েছে। ওদের হাঁই-কাইয়ের ফাঁকে তাল বুঝে ঐশীর আইসক্রিমে চাটন দিয়েছে সায়ন্তন। সায়ন্তনেরটায় সৌনক। হু হু করে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ছে চাটন রোগ। যে যারটা পারছে চেটে দিচ্ছে, কেড়ে নিচ্ছে। নালিশ, ধোলাই, খামচাখামচি, শেষপর্যন্ত আইসক্রিম ছোড়াছুড়ি চলছে। কমপ্লিট প্যান্ডিমোনিয়াম।

ওহ্‌! একদম মোক্ষম সময়ে প্রিন্সিপাল ম্যাম তাঁর সিগনেচার ধমক ‘অ্যা-অ্যা-ই’ ঝেড়েছেন। সব চুপ। ম্যাম বলছেন, “এরকম করলে কাউকে বাড়ি যেতে দেব না। সন্ধে পর্যন্ত আটকে রাখব। ফাঁকা ইশকুলে একা থাকতে হবে, বুঝেছ?”

ব্যস! আগুনে ফ্রিজের জল। সব বিলকুল ঠাণ্ডা।

ম্যাম এবার বলছেন, “শোনো, তোমাদের এখানে আনা হয়েছে তার একটা কারণ আছে।”

কারণটা আর না বললেও চলবে, মনে মনে ভাবলাম, তোমার দলটা আসলে ভারী করবে, তাই না?

ম্যাম কিন্তু বলে চলেছেন, “আসলে জানো, এই যে জায়গাটা দেখছ, এ হল ভালো গুণের রাজ্য। আমাদের সব্বার তো কিছু না কিছু ভালো গুণ থাকে, তাই না? যত বড়ো হই তত সেই গুণগুলোয় ধুলো পড়তে থাকে। ব্যবহার না করলে জানো তো জিনিসপত্র কেমন নষ্ট হয়ে যায়?”

“হ্যাঁ, ম্যাম।” সবাই একসাথে বলে উঠল। তারপরেই দেখি ভূমিকা দাঁড়িয়ে পড়ে, “জানো ম্যাম, আমার না…” যেই না বলতে শুরু করেছে অমনি ম্যাম, “নিশ্চয়ই শুনব। কিন্তু আমার কথাটা আগে শেষ হোক, কেমন?”

বেশ হয়েছে। সবসময় কথার মধ্যিখানে কথা বলা। এবার বোঝ ঠেলা।

ম্যাম বলে চলেছেন, “সেই দারুণ দারুণ সব গুণগুলো যাতে হারিয়ে না যায়, সেজন্যে এই রাজ্যে তার ছাপ নিয়ে আমরা জমিয়ে রাখি। জীবন্ত ছাপ। যাতে বড়ো হয়ে গেলে আর যদি নিজের ভিতর গুণটা খুঁজে না পাওয়া যায়, তবে এখানে এলেই ফেরত পাবে।”

“মানে গুণের ক্লোন করো?” আমি বলে উঠলাম।

“কতকটা তাই। ভালো কি না বলো? বড়ো হবার পর যখন দরকার চলে এলে, নিজের গুণ নিয়ে-টিয়ে আবার চলে গেলে।”

“সে তো ভালোই। কিন্তু আসব কেমন করে?”

“কেন, এখন যেমন করে এলে, তেমন করে! কেবল চুপ করে খানিকটা সময় সব ভুলে নিজের ভিতরে ঢুকে পড়তে হবে। তাইলেই এখানে আসা যাবে। আরও উপায় অবশ্য আছে। সে তোমাদের দিদিরা শিখিয়ে দেবে। কেমন?”

“সব ঠিক আছে, ম্যাম,” বিট্টু বলল, “কিন্তু এখানে সব স্যার-ম্যামরা আছেন কেন?”

“সে কী কথা! কার ভিতর কোন গুণটা ভালো আছে, সে স্যার-ম্যামরা ছাড়া আর কে ভালো জানবে?”

“কেন? আমরা তো নিজেরাই জানি।”

“না, বিট্টু। নিজেরা পুরোটা জানি না। আসলে তো আমরা সবাই আপনভোলা। সেই যে হনুমানকে ঋষিমশাই অভিশাপ দিয়েছিলেন না, নিজের শক্তির কথা ভুলে যেতে, সেই তখন থেকে। আমরা সবাই তো তারই বংশধর না, বলো! তুমি তো বইয়ে পড়েছ সব। পড়নি?”

বিট্টু হেসে ফেলল। আমি জানি ও কেন হাসছে। ও নির্ঘাত দেখতে পাচ্ছে সবার পিছনে একটা করে লেজ পেঁচিয়ে-পুঁচিয়ে মাথার উপর তিড়িমিড়ি করছে। এমনকি প্রি… না বাবা থাক, বলব না।

ম্যাম বললেন, “স্যার-ম্যামরাই তাই তোমাদের গুণের সঠিক খবর জানেন। ওঁরাই তো তোমাদের সেই গুণের গাছ এখানে পুঁতবেন, তাতে জল দেবেন, সার দেবেন, গোড়ার মাটি আলগা করে দেবেন…”

বিট্টু হাসি থামিয়ে ফেলল হঠাৎ। তারপর মুখটা কাঁচুমাচু করে বলল, “সঙ্গে কানমলা দেবেন, পেট মুচড়ে দেবেন, চাঁদিতে গাঁট্টা দেবেন… অমল স্যারের গাঁট্টা, টাকায় মেলে আটটা।”

প্রিন্সিপাল ম্যাম এবার হেসে ফেললেন। হেসে বললেন, “তুমি জানো বিট্টু, কত বড়ো বড়ো মানুষ এখানে গাঁট্টা আর কানমলা খুঁজতে আসে! কেউ খুঁজে পায়, কেউ পায় না। তুমি তোমার এই গাঁট্টার স্মৃতিটারও একটা গাছ পুঁতে যেও, কেমন! দেখবে যখন অনেক বড়ো হয়ে যাবে, তখন আবার এই স্মৃতিটা ফিরে পেতে ইচ্ছে করবে হয়তো তোমার।”

বলেই কী যেন ভেবে ঘড়ি দেখলেন। তারপর বললেন, “তাহলে সোনারা, আর তো দেরি করা যাবে না।” মাদার আন্টিদের বললেন, “ওদের এবার জিনিসগুলো দিয়ে দাও।”

মাদার আন্টিরা আমাদের সবাইকে একটা করে খুরপি আর একটা করে জল দেয়ার ঝাঁঝরি দিল। প্রিন্সিপাল ম্যাম বললেন, “এবার তোমরা বাগানে চলো।”

দিদিদের আঙুল ধরে মিছিল চলল বাগানে। বাগান বলে বাগান! ঝকঝকে তকতকে। মাটির বাড়ির দাওয়ার মতো এক্কেবারে নিকোনো। আর সে কী অদ্ভুত সব গাছ! কোনও গাছের পাশ দিয়ে গেলে জিগলিপাফের লোড়ি শোনা যায় তো কোনওটার পাতা নড়লে ‘এসেছে শরৎ হিমের পরশ…’ কবিতা। আবার কোনও গাছ যেন হাতে আঁকা! পাতা আঁকা, ফুল আঁকা, ডালপালা সব আঁকা! অথচ নড়ছে, হাওয়া দিচ্ছে। আবার দেখি, একটা গাছ থেকে তার একটা শাখা হাত ঘুরে বল করার মতো করে ফল ছুড়ছে। অমনি আরেকটা গাছের ডাল সেটাকে উড়িয়ে দিল ব্যাটের মতো! একটা গাছের পাশ দিয়ে যাবার সময় দাঁড়িয়ে গেলাম। দেখি, পাতাগুলো নড়ছে আর ফিসফিস করে আওয়াজ হচ্ছে। ভালো করে শুনে দেখি কে যেন রিপভ্যানের গল্প বলছে। কোনও গাছ খিলখিলিয়ে হাসছে, কোনওটা ছিঁচকাঁদুনির মতো এই হাসছে তো ঐ গোমড়া হচ্ছে। আবার তারপরই ফ্যাঁচফেঁচিয়ে কাঁদছে।

মনাদিদি আমাদের নিয়ে গেল বাগানের একটা দিকে। সেখানে কেউ যেন মাটিটা কুপিয়ে রেখেছে। ঝুরো মাটি। মনাদিদি বলল, “ভাই রে, এবার তোর গুণের গাছটা এখানে পুঁতে দে। প্রথমে খুরপিটা দিয়ে মাটিটা একটু আলগা কর, তারপর গাছটা পুঁতে ঝাঁঝরি দিয়ে জল দে।”

“কিন্তু পুঁতব যে গাছ কই? আমার কী গুণ আছে তাই তো জানি না! সে গুণের আবার গাছ পাব কোথায়?”

“এই তো সোনা, তোমার গাছ আমার কাছে।”

চেনা গলা শুনে তাকিয়ে দেখি, ওরে বাবা! এ যে মিতা ম্যাডাম!

“এ কী বয়! ভয় কীসের? তোমার প্রোগ্রেস রিপোর্টে মনে নেই আমি লিখে দিয়েছিলাম, ‘স্যমন্তক ইজ অ্যান প্লেজান্ট, ওবিডিয়েন্ট অ্যান্ড সিন্সিয়ার বয়! হিজ পারফরম্যান্স ইজ এক্সেলেন্ট’, সে কি এমনি এমনি? ঐ গুণগুলো ছাড়াও তুমি কার্টুন স্ট্রিপ তৈরি করতে পার, ছড়া লিখতে পার, কল্পনায় কত কী দেখতে পার, গান করতে পার, দুষ্টুমি করতে পার, সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতে পার। কত কী পার। আমি সবকিছু মিশিয়ে এই দেখ কেমন একটা গাছের চারা বানিয়েছি। এইটা তুমি পুঁতে দিও, কেমন?”

মাথা নেড়ে হাত বাড়িয়ে ম্যামের কাছ থেকে গাছটা নিতে যেতেই হাতের মুঠো থেকে মনাদিদির দেয়া সেই শিশির গোলকটা পড়ে গেল। মনাদিদি সেটা কুড়িয়ে পকেটে ঢুকিয়ে দিল। তারপর খুরপিটা হাতে দিয়ে বাঁহাতটা আমার মাথায় বোলাতে বোলাতে চেয়ে রইল মুখের দিকে। খানিক পরে বলল, “ভাই রে, আমায় ভুলে যাবি না তো?”

এমন করে কেউ বলে? শক্ত হতে পারি, কিন্তু তাই বলে আমার কান্না পায় না বুঝি?

কোনও কথা বললাম না। খুরপি দিয়ে মাটি সরিয়ে চারাটা দিলাম পুঁতে। তারপর ঝাঁঝরি দিয়ে জল দিতে দিতে শুনি প্রিন্সিপাল ম্যাম একটা ছড়া বলছেন। একবার, দু’বার, তিনবার… পাক্কা সাতবার। আমার ছড়াটা মুখস্থ হয়ে গেল।

ম্যাম বললেন, “তাহলে আমাদের কাজ এখনকার মতো শেষ। এখানে আবার আসতে চাইলে ফাঁকা বাগানে, নয়তো চাঁদনি রাতে চাঁদের দিকে চেয়ে ছড়া বললেই পৌঁছে যাবে এখানে। মাঝে মাঝে এসো কিন্তু। নইলে কিন্তু গাছ বড়ো হবে না। ভালো থেকো সবাই। বড়ো হয়ো। ভালো মানুষ হয়ো। এখন আমি আসি, কেমন?”

শেষ কথাটা বলেই ম্যাডাম গেলেন মিলিয়ে। মনাদিদি আমার হাতটা ধরে বলল, “ভাই, আমায় ভুলিস না যেন। তোকে তো আমি বড্ড ভালোবাসি। দেখিস, তোর পাশে পাশেই উড়ব। চিনতে পারবি তো ভাই তখন দিদিকে?”

উত্তর দেব কী? কান্নায় তো গলাটা বুজে আছে। ঘাড়টা নিচু হয়ে আছে। মাথাটা জোর করে তুলে তাকিয়ে দেখি, মনাদিদি ঝরঝর করে কাঁদছে। আর ওর চোখের থেকে জল তো নয়, বেরিয়ে আসছে ইয়াব্বড় জলের গোলা! আর সেই গোলা থ্যাপাত করে পড়ল আমার মুখে।

জামার হাতায় মুখ মুছে দেখি, আরে! মনাদিদি কোথায়, এ যে আমার মা! মাই তো কাঁদছে! কাঁদছে আর আঁজলা করে আমার চোখে জল ছেটাচ্ছে। আরি! এ বাগানও তো সে বাগানটা নয়! এ তো মামাবাড়ির পুকুরপাড়ের সেই কদমগাছ! একটা মনার্ক উড়ে যাচ্ছে সর্ষে ক্ষেতের দিকে। পাখায় তার হলুদ রেণু আর… আর… চোখের কোলে একবিন্দু জল!

“মনাদিদিইই,” বলে উঠতে যেতেই হাতে ধরা খুরপিটা পড়ল মাটিতে।

ফজুকাকা বলল, “ইটা আবার জুটালা কুত্থিকে?”

খুরপিটা দেখেই পকেটে হাত দিলাম। শিশিরের গোলকটাও আছে। “মনাদিদিইই,” বলে ছুটলাম সর্ষে ক্ষেতের দিকে। কিন্তু সেখানে তখন মনাদিদি আর নেই।

মা ছুটে এসে কোলে তুলে নিয়ে চলল ঘরে। আমি চেঁচাচ্ছি, “মা, মা, নামাও নামাও, সবাই দেখছে যে!”

তা মা কি কোনওদিন কোনও কথা শোনে?

অলঙ্করণঃ মৌসুমী

 জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

11 thoughts on “উপন্যাস পানডুবরা শাশ্বত কর শরৎ ২০১৯

  1. Ekdom chobir moto dekhte pelam purota. Chotobela ta ekdom erokom e chilo. Sopno tao chena chena laglo ☺️ bhari sundor

    Like

  2. অলঙ্করণ যাঁর হাতে, সেই মৌসুমীকেও অনেক ধন্যবাদ! ভারি সুন্দর এঁকেছেন!

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s