জয়ঢাকের খবরকাগজ–২০১৩ থেকে মনমতানো সমস্ত খবরের অর্কাইভ এইখানে
আজকে টুকুর দারুন মজা, মা স্কুল থেকে দু প্যাকেট চাইনিজ বিস্কুট নিয়ে এসেছে। মার কলিগ নিতা অ্যান্টি কদিন আগে চায়না ঘুরতে গেছিল। সেখানকার বিখ্যাত চাইনিজ ওয়াল দেখতে গিয়ে এক ফেরিওয়ালার কাছ থেকে এই বাড়িতে বানানো বিস্কুটগুলো কেনে। বিস্কুটে একটা কামড় লাগিয়ে নিতা অ্যান্টির এত ভাল লেগে যায় যে ওই ফেলিওয়ালার ঝুড়িতে যত বিস্কুট ছিল সব কিনে নেয় বাচ্চাদের গিফট করবে বলে।
বিস্কুটের মোড়কটা মোটেই চকচকে ছিল না। সাধারণ বাটারপেপারে মোড়া। প্যাকেট খুলে বিস্কুট দেখে টুকুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। চায়ের দোকানে কাচের শিশিতে দেখা সাধারণ বিস্কুটের মত। আর এই বিস্কুটের জন্য এত! নিতা অ্যান্টি গতকাল ফোন করে বলেছিল “টুকু চায়না থেকে তোর জন্য যা বিস্কুট এনেছি না… খেয়ে বলবি।“
বিস্কুটে কামড় দিয়ে টুকু টের পেল এটা সাধারণ বিস্কুট নয়। বাইরেটা কীরকম খড়খড়ে পোড়াপোড়া দেখতে হলে হবে কী একটা কামড় দিতেই কট করে আওয়াজ হল। তারপর মুখটা ভর্তি হয়ে গেল চকোলেটে। একদম ইয়ামি।
টুকু বিস্কুট খেতে ওস্তাদ। ওর কাকা এক বিস্কুট কোম্পানির প্রোডাক্ট ম্যানেজার। তার কাছ থেকে টুকু বিস্কুট সম্বন্ধে অনেক কিছু জেনেছে।
আজ থেকে প্রায় দশ হাজার বছর আগে চীন দেশেই নাকি বিস্কুটের জন্ম। সে সময় শুকনো চালের গুঁড়োর মণ্ডে তিল ও ফলের টুকরো মিশিয়ে আগুনে পুড়িয়ে তৈরি হত বিস্কুট। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে মধ্য ব্রোঞ্জ সভ্যতাকালিন সময়ে মেসোপটেমিয়া রাজত্বকালে আসিরিয়া শহরবাসীরা আগুনের ওপর মাটির পাত্রের গায়ে বার্লি ও ময়দার মিশ্রণ পাতলা করে ঝলসিয়ে কড়কড়ে করে খেত। সেটাই আধুনিক বিস্কুটের পূর্বপুরুষ ‘রাস্ক’। চলতি বাংলায় যাকে বলে ‘টোস্ট’ বিস্কুট।
খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ সালের এক মিশরিয় সমাধিতে প্রাপ্ত ছবি থেকে সে সময়ে বিস্কুট তৈরি হত বলে জানা গেছে। সে যুগের মানুষ দেখেছিলেন আগুনে সেঁকা মোটা মণ্ড সাধারণ রুটির তুলনায় অনেক বেশি দিন আহারযোগ্য থাকে। কালে কালে ময়দা ও বার্লির সাথে মধু মেশানো শুরু হল।বিস্কুট হয়ে উঠল আরও সুস্বাদু।
গ্রিকরা রান্নাঘরে বিস্কুট নিয়ে মাথা খাটিয়েছিল অনেক। ময়দার সাথে মধু ছাড়াও দুধ ও তেল মিশিয়ে এই সেঁকা রুটিকে করে তুলেছিল মনোহরা। রোমানদের সময় রুটির কারখানাগুলোতে ব্যাস্ততার সীমা ছিল না। এই রুটির কারখানাগুলো রোমান সৈন্যবাহিনী ও নাবিকদের জন্য তৈরি করা শুরু করেছিল এক বিশেষ ধরনের বিস্কুট। “দি সোলজার’স ব্রেড” এবং “দি সেইলরস ব্রেড” নামে পরিচিত ছিল এই বিস্কুট। কিন্তু এই বিস্কুট তৈরি করা সহজ ছিল না। অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ছিল এই বিস্কুট তৈরির পদ্ধতি। শুধুমাত্র ময়দা থেকে তৈরি হত এই বিস্কুট। প্রথমে ময়দাকে তিরিশ দিন ধরে জলে ভিজিয়ে রাখা হত। তারপর সেই হেজে যাওয়া ময়দাকে ছোট ছোট আকৃতিতে দু থেকে চারবার করে আগুনে সেঁকে তৈরি হত “দি সোলজার’স ব্রেড” এবং “দি সেইলরস ব্রেড” নামের বিস্কুট। দ্রুত নষ্ট হয়ে যাবার আশঙ্কায় কোনরকম নুন দেওয়া হত না এই রুটি বা বিস্কুটে। এমনকি দেওয়া হত না ময়দাকে ফাঁপিয়ে তোলার খামির (yeast)। জল বা আর্দ্রতার সংস্পর্শে না এলে ধাতুর পাত্রের ভেতর বছরখানেক অনায়াসে খাবার উপযোগী থাকত এই বিস্কুট।
ব্যুৎপত্তিগতভাবে বিস্কুট নামটা এসেছে ল্যাটিন শব্দ বিস-কোটাস থেকে। যার অর্থ দুবার স্যাঁকা। ইউরোপে বিস্কুটের বহুল ব্যবহার শুরু হয় মধ্যযুগে। পঞ্চম শতক থেকে পনেরোশ শতক পর্যন্ত, অর্থাৎ রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে ইউরোপে নবজাগরণ শুরু পর্যন্ত বিস্কুট নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে। ১৫৭৭ সালের উত্তর আমেরিকার আটলান্টিক মহাসমুদ্রের এক অভিযাত্রী স্যার মার্টিন ফ্রবিশের লেখনী থেকে জানা যায় যে সে সময় নাবিকদের দৈনন্দিন খাবার ছিল এক পাউন্ড বিস্কুট ও এক গ্যালন বিয়ার। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে গ্রিক রন্ধনপ্রণালীর বইতে ও বিজ্ঞাপনে বিস্কুটকে বলা হত ‘ডাইপাইরন’ – দুবার স্যাঁকা। তারও আগের বিবরণে বিস্কুটকে বলা হয়েছে ‘ডাইপাইরিটেস আরটস’ – দুবার ঝলসানো রুটি।
জাহাজে বিস্কুটভোজ
বিস্কুটের সবচাইতে মজাটা হল এটা স্যাঁকা বা ঝলসানোর সময় এটার আকৃতির কোন পরিবর্তন ঘটে না। তাই সেই আদিকাল থেকে বিস্কুটকে আকর্ষণীয় করে তুলতে ময়দার তালকে বিভিন্ন আকার দেওয়া হত। নানাধরনের সামাজিক ও ধর্মীও অনুষ্ঠানে বিস্কুট নানা রকম মনোগ্রাহী রূপে পরিবেশিত হত। ষোলশ শতাব্দীতে সিডার ও চেস্টনাট কাঠের বাসনের বহুল ব্যবহার শুরু হয় ইউরোপে। সে সময় কাঠের ছাঁচ থেকে তৈরি বিভিন্ন আকৃতির বিস্কুট বাজারজাত করতে শুরু করে পাউরুটি কারখানাগুলি। সে সময় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ‘স্টার অফ বেথলহেম’ আকৃতির বিস্কুটের উপস্থিতি ছিল অবশ্যম্ভাবী। ইউরোপের বিবাহ অনুষ্ঠানে বিবাহিত দম্পতির প্রথমে একটি বিস্কুটের ওপর চুম্বন প্রথা হয়ে দাঁড়ায়। বড়দিনে ক্রি্সমাস ট্রিতে বিস্কুট ঝোলানো এরকমই একটি প্রথার অঙ্গ।
পনে্রোশ শতাব্দীতে ইউরোপে নবজাগরণের হাত ধরে চিনির জন-ব্যবহার শুরু হয় ইউরোপসহ বিশ্ব জুড়ে। প্রথম দিকে অত্যধিক মুল্যের কারণে চিনি ছিল বিলাস উপকরণ। ধীরে ধীরে দাম সাধারণ মানুষের নাগালে চলে এলে মধুর ব্যবহার কমতে থাকে ও চিনি ঢুকে পরে হেঁসেলে। পাল্টে যেতে থাকে রন্ধনপ্রণালী। ক্রমশ রুটি তথা বিস্কুটের কারখানাগুলোও বিস্কুট তৈরির মণ্ডে মধুর পরিবর্তে চিনি দিতে শুরু করে। মেশাতে শুরু করে শুকনো ফলের টুকরো। বদলাতে শুরু করে বিস্কুটের স্বাদ।
কাকাও গাছের ফলের বীজ ঝলসিয়ে তৈরি চকোলেট বিস্কুটের জগতে আবার পরিবর্তন নিয়ে এল সতেরশ শতাব্দীতে। বিস্কুটে মিশেল ঘটল চকোলেটের। মিশ্রণে পরিবর্তন ঘটিয়ে কারখানাগুলো নান স্বাদের ও আকৃতির বিস্কুট পেশ করতে শুরু করল।
আঠারোশো শতাব্দীতে বিস্কুটের জগতে ফরাসিরা বিপ্লব ঘটিয়ে দিল ছোট ছোট চুলাতে বিস্কুট বানিয়ে। ময়দার সাথে ডিম ও চিনির মিশ্রণ একেবারে অল্প তাপে সেঁকে তৈরি হল কুড়মুড়ে কুকিজ। তার ওপর চকোলেট , ক্রিম , জেলি ও শুকনো ফলের প্রলেপে বাজারে হাজির হয়ে ‘পেটিট ফোর’ নামের এই কুকি বিস্কুট বিশ্ব জুড়ে হইচই ফেলে দিল খাদ্যরসিকদের মধ্যে।
উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিক থেকেই ব্রিটিশদের দেখাদেখি তাদের অধিকৃত দেশগুলিতে সকালে দুপুরে চা পানের অভ্যাস অনেকে করে ফেলেছেন। চায়ের সাথে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিস্কুট। সমস্ত অনুকূল পারিপার্শ্বিকে ভর করে শিল্পবিপ্লবের হাত ধরে ব্রিটেনের বিস্কুট শিল্প দ্রুত বেড়ে উঠতে লাগল। প্রচুর বিস্কুট কারখানা গড়ে উঠল সেখানে। আর এই বিস্কুট কারখানাগুলো থেকে শুধু ব্রিটিশ কলোনিগুলোতেই নয় সমস্ত বিশ্বে বিস্কুট সরবরাহ শুরু হল। প্রচুর উৎপাদন ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে ১৮৪০ সালে বিশ্বের বাজারে বিস্কুট শিল্পে প্রায় একা রাজত্ব করতে শুরু করল গ্রেট ব্রিটেনের ‘ইংলিশ বিস্কুট’। বিশ্বের বাজারে চাহিদা দেখে ইউরোপের অন্যান্য দেশ যেমন ইটালি, বেলজিয়াম, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড তাদের দেশেও বিস্কুট কারখানা বানাতে শুরু করল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বড় বড় বিস্কুট কোম্পানিগুলো মূলত সৈনিক ও যুদ্ধে আহতদের জন্য ‘ওয়ার ব্রেড’ নামের বিস্কুট বানাতে শুরু করল আর বিস্কুট পুষ্টিগত খাদ্য হিসেবে প্রচার পেল। বিভিন্ন পরিচয়ের বিস্কুট আসতে শুরু করল বাজারে।
১৮৬১ তে এল ‘গারিবাল্ডি’, ১৮৮৫তে ‘ক্রিমক্র্যাকার’, ১৮৯২তে ‘ডাইজেস্টিভ’,১৯৩৮ সালে ‘চকোলেট চিপ’, ১৯০৮এ ‘কাস্টার্ড ক্রিম’, ১৯১০ সালে ‘বার্বোনস’, ১৯৮৬ তে হবনবস…
টুকুর কাকার থেকে জানা ‘ডেভন ফ্ল্যাট’ বিস্কুটের রেসিপি নিচে দেওয়া হল। (ডেভন হল দক্ষিণ –পশ্চিম ইংল্যান্ডের একটি অঞ্চল। হালকা এই বিস্কুট চায়ের সাথে খুব মজাদার।)
প্রয়োজনীয় উপাদান
২২৫ গ্রাম ময়দা, এক চিমটে নুন, ১০০ গ্রাম মিহি চিনি, ১০০ এম এল ক্রিম, ১টা ফেটানো ডিম, ১টেবিল চামচ দুধ,
বানানোর পদ্ধতি
একটা বাটিতে ময়দা, নুন , চিনি, ক্রিম , ফেটানো ডিম ও দুধ ভাল করে মেশাতে হবে। তারপর মিশ্রিত ময়দাটিকে একটা উল্টানো থালায় খানিক শুকনো ময়দা ছড়িয়ে তার ওপর রুটির মত চ্যাপ্টা করে (৮ মিলিমিটার মত পুরু হলে ভাল হয়) বিছাতে হবে। এরপর সবসুদ্ধু ফ্রিজে আধঘণ্টা মত রাখতে হবে। এবার রুটির মত করে রাখা ময়দার মিশ্রণটিকে গোল গোল বিস্কুটের মত করে কাটতে হবে। কোন কৌটোর ঢাকনা বা বড় পাইপের টুকরো দিয়ে এক মাপে কাটা যেতে পারে মণ্ডটিকে। এবার বেকিং জালিতে রেখে গোল গোল মণ্ডর টুকরোগুলো ২২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় আট মিনিট বা যতক্ষণ না হালকা বাদামী রং হচ্ছে ততক্ষণ নিভু নিভু আগুনে সেঁকলেই পাওয়া যাবে ‘ডেভন ফ্ল্যাট’ বিস্কুট। মনে রাখতে হবে বিস্কুট তৈরি হয়ে গেলে গরম পাত্রটিকে আগুন থেকে সরিয়ে রাখতে হবে। এবং যতক্ষণ না পাত্রটি নিজে থেকে পুরোপুরি ঠাণ্ডা হচ্ছে ততক্ষণ বিস্কুট সরাতে গেলেই বিস্কুট ভেঙে যাবে।
তাহলে হয়ে যাক এক রাউন্ড বিস্কুট!
ছবি – সংগৃহীত