শতবর্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য
সৌম্যকান্তি দত্ত
(সৃজনশীল কাজ একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। পূর্বসূরীর কাছ থেকে উত্তরাধিকার তুলে নেন উত্তরসূরীর দল। আর তাই এই সময়ের তরুণ সম্পাদকরা কতটা অনুধাবন করতে চেষ্টা করেছেন লেখক-সম্পাদক সত্যজিৎ রায়কে, সে নিয়ে কয়েকজন তরুণ সম্পাদকের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম। তারই উত্তর মিলল তাঁদের মধ্যে এক তরুণ সম্পাদকের কলমে। তরুণ তুর্কি সে। এখনো তার অভিজ্ঞতার ভাঁড়ারে হয়ত অনেক জায়গা পূরণ হবার বাকি। এখনো টিন এজ-এর মিষ্টত্ব জড়িয়ে রয়েছে তার সতেজ উপস্থিতি ও কৌতুহলী মননে। তা এমন এক তরুণ ও প্রতিশ্রুতিবান পত্রিকা-সম্পাদকের মননে ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন সত্যজিৎ রায়? খুলে জানালেন বিচিত্রপত্র পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক)
“No no, I have an editor. A very good editor, but we work together you see. Here I understand each other…” ফরাসি সাংবাদিক Pierre-André Boutang’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে (১৯৮৯) একথা বলেছিলেন সত্যজিৎ রায়। হ্যাঁ, ঠিকই। যেকোন সৃষ্টিশীল কাজই মানুষকে শেখায় পরিমিতি বোধ এবং বক্তব্যের বলার ভঙ্গিটি কেমন হবে সেইটা। এক্ষেত্রে, এই দুটোই সত্যজিৎ রায়ের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে ছিল বলেই উনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজেকে একজন ‘ভাল সম্পাদক’ তকমাটা দিতে পেরেছেন। যদিও ওপরের এই বক্তব্যটি উনি ফিল্মের সম্পাদনার perspective-এ বলেছিলেন। কিন্তু, সম্পাদনা ব্যাপারটার অর্থ বোধহয় সব জায়গাতেই সমান। সে ফিল্মের আঙ্গিকেই হোক আবার লেখালিখির ক্ষেত্রেই হোক বা অন্য বিষয়ে। আমি এখানে লেখালিখির দিকটা সম্পর্কে সম্পাদক সত্যজিৎ রায়ের প্রসঙ্গে আমার একেবারেই ব্যাক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরছি। ওঁর কাজ সম্পর্কে বিশ্লেষণ করার ধৃষ্টতা আমার একেবারেই নেই।
লেখালিখির সম্পাদনা করতে গিয়ে যে সবসময় অন্যের লেখাই সম্পাদনা করতে হয় – তা কিন্তু নয়। নিজের লেখাকে সম্পাদনা করার দরকার সবার আগে। যে কেউ নিজে তার নিজের সৃষ্টিকে যতটা গভীরভাবে বুঝবেন, প্রয়োজন মত তার কাটাকুটি, সংশোধন ইত্যাদি ব্যাপারগুলো যতটা ভাল ভাবে করতে পারবেন ততটা অন্য কেউ যেচে পড়ে এসে নাক গলাবে না।
হ্যাঁ, এখন আপনার মনে হতেই পারে তাহলে আর পত্রিকা-সম্পাদকের ভূমিকাটা কী রইল? নিশ্চয়ই, পত্রিকা সম্পাদকের দায়িত্ব তো থাকবেই। তবে সেটা দ্বিতীয় পর্যায়। গোড়ার কাজটা যিনি সৃষ্টিকর্তা তাঁর ওপরেই বর্তাবে। তারপরে তো পত্রিকা-সম্পাদক রইলেনই। তো যে প্রসঙ্গে আমাকে এতগুলো শব্দ খরচ করতে হল, এবার সরাসরি সেখানে ফিরি। এই যে নিজের সৃষ্টির ওপর নিজের সম্পাদনা করার ব্যাপারটাতে সত্যজিৎ রায় ছিলেন অসাধারণ পারদর্শী, সেটার প্রমাণ আলাদা করে দেওয়া নিষ্প্রয়োজন। যারা সত্যজিৎ রায়ের কাজের সঙ্গে অল্পবিস্তর হলেও পরিচিত তারা জানেন উনি নিজে একটা লেখা লেখবার আগে কত ধরণের পড়াশুনো করতেন, যদিও হ্যাঁ, সেটা সেই লেখাটার বিষয়ভিত্তিক পড়াশুনো নিশ্চয়ই। তবে সত্যজিৎ রায়ের বিপুল বইপত্রের সংগ্রহের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে উনি প্রায় সব বিষয়েই পড়াশুনো করতেন। হয়তো ওঁকে আমরা চিনেছি মূলত ফেলু, শঙ্কুর লেখক হিসেবে কিন্তু ওঁর পড়ার ঘরের বইয়ের র্যাকে আর্থার কোনান ডোয়েল, জি কে চেস্টারটন, হেনরিক ইবসেনের নাটক যেমন রয়েছে পাশাপাশি শিবনাথ শাস্ত্রী’র ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’, উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ভ্রমণ বৃত্তান্ত কিংবা দেশবিদেশের রান্নার বই-ও কিন্তু আছে। অর্থাৎ গুরুগম্ভীর, হাস্যরস, রহস্য, ঘুরে বেড়ানো, খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি সব বিষয়ে আগ্রহ, পড়াশুনো ও সেই নিয়ে চর্চা। ‘এটা খাবো না ওটা খাবো না’ এসবের বালাই নেই – কোন কিছুতেই নাক শিঁটকানো চলবেনা। সত্যজিৎ রায় যে তাঁর জীবনের প্রথম দিক থেকেই পুরোদমে লেখালিখি করেছেন তা তো নয়, চল্লিশ বছর বয়েসে উনি ওঁর পারিবারিক পত্রিকা ‘সন্দেশ’ নতুন করে বের করতে গিয়ে লেখালিখির কাজে মন দিলেন। তাও তো গোড়ার দিকে মূলত অনুবাদের কাজটাই করেছেন। মৌলিক লেখার সূত্রপাত এর কিছুদিন বাদে। এই যে ওঁর নিজের লেখালিখি, এখানে নিজের সম্পাদনার দিকটা নিয়ে উনি কতটা ভাবতেন তার প্রমাণ ওঁর বিভিন্ন খেরোর খাতাগুলো আর অক্সফোর্ড বুক কোম্পানি থেকে কেনা ‘নোটস’ খাতাগুলো। আমরা অনেক জায়গা থেকেই জানতে পারি, সত্যজিৎ রায় প্রথমে সে লেখার একটা খসড়া করে নিতেন তারপর নিজেই নিজের মতন সংশোধনের পর সেটা তুলে দিতেন ওঁর স্ত্রী বিজয়া রায়ের হাতে। সঙ্গে থাকত পেন্সিল। বিজয়া রায়ের লেখাটা পড়া এবং তাঁর ব্যাক্তিগত সংশোধনের পর সেটি যেত পুত্র সন্দীপ রায়ের কাছে। তাঁরও পড়ার পর সত্যজিৎ রায় এই দুজনের মতের সঙ্গে নিজের মতকে ঝালিয়ে নিয়ে ফাইনাল কপি করতেন সাদা ফুলস্ক্যাপ কাগজে। লেখাটা কপি করার সময়ে মূল লেখার অনেক কিছুই বদলে যেত। তারপরে সেই লেখার সঙ্গে নিজেই ছবি এঁকে, লে-আউট সংক্রান্ত সমস্ত খুঁটিনাটি ছকে দিয়ে কাজ শেষ করতেন। যদিও এই নিজের লেখার সঙ্গে নিজেই ছবি আঁকা অর্থাৎ ইলাস্ট্রেশনের কাজটা আর লে-আউটের দিকটা উনি ওঁর শেষ জীবনে সবসময় করে উঠতে পারেননি শারীরিক অসুস্থতার জন্য।
এখন এই গোটা ব্যাপারটা গড়গড় করে আমি লিখে গেলাম যেমন সহজ ভাবে, ঠিক তেমনি কাজটা তো মোটে সহজ নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে সত্যজিৎ রায় ‘ফুল টাইম রাইটার’ ছিলেন না। লেখালিখিটা ছিল ওঁর কাছে অর্থ উপার্জনের পথ।
আর ‘সন্দেশ’ সম্পাদনাটা ছিল ওঁর কাছে একান্তই ভালবাসার জায়গা, পারিবারিক ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জায়গা। কিন্তু, সে কাজটা উনি কী অসম্ভব নিষ্ঠার সঙ্গে করে গিয়েছেন – সেটা একশো বার কেন হাজার বার বা তারও বেশিবার দেখার আর শেখার দরকার। ‘সন্দেশ’ সম্পাদনা করতে গিয়ে আর ‘সন্দেশ’ কে ওঁর ভাষাতেই “ফিড” করতে গিয়ে ওঁকে যেমন নিজের হাতে কলম তুলতে হয়েছে পাশাপাশি আবার অন্যের লেখাও সম্পাদনা করতে হয়েছে। এখানে দুটো ব্যাপার লক্ষ করতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা দেখে থাকি কোন পত্রিকার সম্পাদক তাঁর পত্রিকা সম্পাদনা করতে গিয়ে নিজের লেখালিখির ক্ষতি করেছেন বা বলা ভাল মন দিতে পারেননি সময়ের অভাবে। কিন্তু, সত্যজিৎ রায়ের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আশ্চর্যের। উনি যেমন অন্যের লেখা খুঁটিয়ে পড়তেন, তার টেকনিক্যাল দিকটা নেড়েচেড়ে দেখতেন আবার প্রয়োজনে সংশোধন করতেন এমনকি লেখককে নিজের বাড়িতে ডেকে লেখাটা নিয়ে আলোচনাও করতেন। তারপরে আবার নিজের লেখালিখি নিয়েও সময় দিতেন। এছাড়া ওঁর অন্যান্য বিপুল কাজের দিক তো ছিলই। সেদিকে আমি যাচ্ছিনা। আমি কেবল ওঁর নিজের লেখালিখি আর অন্যের লেখালিখির সম্পাদনার দিকটা নিয়েই ভাবছি। এই গোটা ব্যাপারটাকে জটায়ুর ভাষায় ‘আশ্চর্য প্রতিভা মশাই’ বলে উড়িয়ে দিতেই পারেন কিন্তু সেটা বোধহয় কাজের কথা হবেনা। বরং, এ নিয়ে বিস্তর ভাবনাচিন্তা করতে বসলে নিজের মনের খোরাক আর আত্মবিশ্বাসের জায়গাটা কিছুটা হলেও মজবুত হবে।
যাই হোক, এবার একটা ছোট্ট ঘটনার নীরিখে সম্পাদনা আর সত্যজিৎ রায়ের সম্পাদক সত্ত্বা ব্যাপারটা নিজেও বুঝি আর আপনাকে আমি কী বুঝলাম সেটা বলি।
মাধববাবু, মাধব সান্যাল পেশায় সাধারণ সরকারি কর্মচারী। নিজের রুজিরোজগারের পর বাড়তি সময়টা ভদ্রলোক নিজের লেখালিখি নিয়েই মেতে থাকেন। তাঁর স্বপ্ন একটাই, বাংলা সাহিত্যের প্রথম সারির সব পত্রপত্রিকায় তাঁর নিয়মিত লেখা বেরুবে আর সাহিত্যিক হিসেবে কিঞ্চিৎ ‘ইয়ে’ও পাবেন পাঠকসমাজে। উনি মাঝেমধ্যেই নিজের লেখা বিভিন্ন পত্রিকা আপিসে পাঠিয়ে দেন আর হা-পিত্যেশ করে বসে থাকেন কবে সেই খবরটা আসবে। দিনের-পর-দিন এহেন অবস্থা চলতেই থাকল। কিন্তু এবার বাধ সাধল মাধববাবুর ধৈর্য। দুম করে এবার হাজির হলেন পত্রিকা আপিসের সম্পাদকের কাছে। অনেক বলেকয়ে শেষমেশ সম্পাদকের ঘরে টেবিলের উলটো দিকে বসলেন মাধব সান্যাল। সম্পাদক মশাই তাঁর বাইফোকাল চশমাটা নাকের ডগায় নামিয়ে মাধববাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী চাই?”
মাধববাবু নিছক সরল-সাদাসিধে মানুষ। কাজেই, দ্বিধা-টিধা না করে বললেন, “আমার লেখাটার কত দূর কী রিপোর্ট, তাই জানতে এলুম। প্রায় আট-ন’ মাস তো হল।”
সম্পাদক মশাই বললেন, “তার মানে? আমি কী একা আপনার লেখা নিয়ে বসে আছি? আর পত্রিকার ‘লেখা পাঠানোর নিয়মাবলী’ অংশটা পড়েননি, সেখানে তো বলাই আছে লেখা মনোনীত হলে আমরা নিজেরাই জানাব আর কিছু না জানালে ধরে নিতে হবে লেখাটা অমনোনীত।”
“কিন্তু, আমি তো এই নিয়ে ছ-সাত বার লেখা পাঠালুম। আমার লেখা কি একেবারেই ছাপার অযোগ্য?” গাল চুলকে বললেন মাধববাবু।
সম্পাদক মশাই স্বগোতক্তি করলেন, “ছ-সাত বার কেন, ছাপার যোগ্য না হলে ছ-সাতশোবার পাঠালেও লেখা ছাপা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।”
সম্পাদক মশাইয়ের এই কঠোর বাক্য শোনার পর একটু ঘাবড়ে গেলেন মাধববাবু। কিন্তু, লেখার ফল জানার ধৈর্যের অভাবের মতই এবারে তার রাগ চেপে রাখাটা সম্ভব হল না, “শুনুন মশাই, “Truth is stranger than fiction”- মার্ক টয়েনের উক্তিটা নিশ্চয়ই জানেন…”
মাধববাবুর কথাটা শেষ না করতে দিয়েই সম্পাদক মশাই ঝড়ের গতিতে বললেন, “থামুন থামুন। আপনি তো আমার যেটা আপনাকে বলা উচিৎ সেটাই বলছেন। শুনুন, এবার আপনি আসতে পারেন। আমার অনেক কাজ আছে।”
মাধববাবু আর কালবিলম্ব না করে কেটে পড়লেন।
এই হচ্ছে আমার কল্পনা করা একটা ঘটনা। যেরকম বর্ণনা সত্যজিৎ রায়ের নিজের সঙ্গে বাস্তবে ঘটেছে কিনা আমি জানিনা, তবে ওঁর লেখা বিভিন্ন গপ্পের চরিত্রদের সঙ্গে হুবহু এরকম না হলেও, ঘটেছে। আসল কথা সম্পাদককে যে কেবল নিজের লেখা আর অপরের লেখা সম্পাদনা করতে হয় তা তো নয় – এরকম অজস্র ঘটনারও সম্মুখীন হতে হয়। আমি আমার কয়েকজন বন্ধুবান্ধব আর বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে একটা ত্রৈমাসিক কাগজ বের করি ‘বিচিত্রপত্র’ নামে। দু হাজার আঠারো সালের মে মাস থেকে এই পত্রিকার প্রকাশ শুরু হয়েছিল। ‘বিচিত্রপত্র’ নামটা শুনেই অনেকের মনে পড়ছে সত্যজিৎ রায়ের ফেলু-কাহিনি ‘গোরস্থানে সাবধান’ গল্পে জটায়ুর উল্লেখ করা পত্রিকা, যার নাম ‘বিচিত্রপত্র’।
হ্যাঁ, আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমরাও আমাদের কাগজটি বের করার সময়ে যখন নাম নিয়ে নাকাল হয়েছিলাম তখন সত্যজিৎ রায়ের কল্পনাপ্রসূত নাম থেকেই ধার করে নিজেদের পত্রিকার নাম দিয়েছিলাম ‘বিচিত্রপত্র’। ঘটনাচক্রে সে পত্রিকার দুই সম্পাদকের একজন হলাম আমি। আর তার পরেই আমি যে সম্পাদকের আদর্শটা মেনে চলার চেষ্টা করে চলেছি তিনি নিঃসন্দেহে সত্যজিৎ রায়। তাঁকে চোখে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি ঠিক কথাই কারণ আমার জন্মের সাত বছর আগে উনি চলে যান, কিন্তু তাতে কী ? তাঁর কাজ সম্পর্কে পড়াশোনা করে তো আমার তিনশো পঁয়ষট্টি দিন কাটে। কাজেই সম্পাদক হয়ে উপরের ঘটনাটার মত হুবহু না হলেও তার কাছাকাছি ঘটনার সাক্ষী হতেই হয়েছে এক-দুবার।
আরেকটা কথা এ প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ল। আমার ইস্কুলের বাংলার একজন কড়া শিক্ষিকা ছিলেন, নাম জয়শ্রী মুখোপাধ্যায়। তাঁর ইংরেজি নামের শর্টনেম করে J.M. Mam বলতাম। ওঁর ক্লাস করতে আমার বেশ ভালই লাগত। আর ছেলেবেলা থেকেই অজস্র গপ্পের বই গিলে খাবার দরুন বাংলা ভাষার প্রতি একটা দুর্বলতা ছিলই। ‘মাতৃভাষার প্রতি দুর্বলতা’ – চিরাচরিত এই বাক্যটার নানাদিক বোঝার ব্যাপারটা তখনও সেভাবে অনুভব করেনি। এই অজস্র গপ্পের বই পড়ার কারণে আমার মধ্যে একটা চাপা গর্বের বিষয় ছিল –‘আমি বোধহয় বাংলাটা ক্লাসের অন্য বন্ধুদের থেকে কিছুটা ভালই জানি।’ এটা কারো কারোকে বলেও ফেলতাম। অবশ্যই বড়দের। ওমনি তারা ভাববাচ্যে ‘আরে এসব ছেলেমানুষী কথাবার্তা’ বলে দিব্যি উড়িয়ে দিতেন। সে দুঃখ এখনও ভুলিনি।
আর ভাবব নাই বা কেন? এটা সত্যি যে, ক্লাসের অন্য ছাত্রদের তুলনায় পরীক্ষায় বাংলা বিষয়ে বেশিরভাগ সময়ে আমার নাম্বারই থাকত সবচেয়ে বেশি। কাজেই একটা আত্মবিশ্বাসের জায়গা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বাকি বিষয়গুলোর নাম্বার বলে লজ্জা পেতে চাই না। যাই হোক, এমনই একবার ইউনিট টেস্টের রেজাল্ট হাতে নিয়ে J.M. Mam ক্লাসে ঢুকলেন। নাম ডেকে সবার হাতে খাতা দিচ্ছেন, বেশিরভাগেরই মুখে একটা চিন্তার ছাপ। কিন্তু, আমি বেশ ফুরফুরে মেজাজে বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করছি কখন আমার নাম ডাকা হবে। খানিক বাদে আমার নাম ডাকা হল, খাতা হাতে পেয়ে আমার চক্ষু চড়কগাছ ! এ কী, তিরিশে সাড়ে সাত ! J.M. Ma’m আমার নাম ধরে বললেন, “শোনো, তোমার কী ধারণা হয়েছে বলো তো? কঠিন কঠিন ভাষা দিলেই কি ভালো সাহিত্য রচনা করা যায়?”
আমি কী বলব ভেবে পাচ্ছি না। চুপ করে হাতে খাতা নিয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে। আসলে তখন আমি খুব বাংলা আধুনিক কবিতা পড়ছি। আর কালের নিয়মে বাংলা আধুনিক কবিতার এই একনিষ্ঠ পাঠকই কিনা এখন আর কবিতা সেভাবে পড়েই না ! সে যাক গে। সেদিন বাংলার সেই শিক্ষিকা আমাকে যে ওই কথাটি বললেন তা আজ বেশ কয়েকবছর পরেও আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করছি। আর দ্বিতীয়বার যাঁর কাছে বা বলা ভাল যে পরিবারের কাছে আমি এই শিক্ষা পেয়ে এসেছি তাঁরা হলেন রায় পরিবার আর বিশেষ করে সত্যজিৎ রায় তো বটেই। ওঁদের লেখালিখি, বলার ভঙ্গী, ভাষা এসব থেকে আমি শিখছি, হ্যাঁ ‘সহজ কথা সহজ করে বলা আর কঠিন কথাও সহজ করে বলা’ – এই ব্যাপারটাকে যেদিন পুরোপুরি রপ্ত করে ফেলতে পারব সেদিনই আমি একজন সম্পূর্ণ সম্পাদকও হতে পারব। যেটা সত্যজিৎ রায়ের মধ্যে একশো শতাংশ ছিল। ধুস, আমি তো মশাই ধর তক্তা মার পেরেক করে কাজ চালিয়ে নেওয়া লোক। সুন্দর ভাবে, সঠিক ভাবে, সুদক্ষতায় যেদিন সম্পাদনার খুঁটিনাটি শিখতে পারব, জানব সেদিনই আমার সত্যজিৎ চর্চা সফল। বাদবাকিটা আপনাদের না হয় সহ্য করে নিতেই হল। করবেন ?
—————————————–
সম্পাদকীয় সংযোজনঃ সাধারণত অনেকেরই পুরো লেখা পড়বার অবসর থাকে না। যাঁরা কষ্ট করে এই লেখাটার শেষ অবধি এসে পৌঁছেছেন তাঁদের তাই একটা পুরস্কার দেয়া উচিত। নীচের ছবিটায় ক্লিক করলে হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত সন্দেশ পত্রিকার ১৯১৩ থেকে ১৯২৬ ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৯৩১ থেকে ১৯৩৫ সাল অবধি প্রকাশিত সন্দেশ পত্রিকার সমস্ত কপি পাবেন। ছবির ক্লিক আপনার যন্ত্রে কাজ না করলে এই লিঙ্কটা কপি করে ব্রাউজারে পেস্ট করতে পারেনঃ https://bit.ly/oldsandesh
পড়লাম । ভালো লাগলো খুব। আর সম্পাদক মশাই এর উপহার তো লা জবাব !
LikeLike