শতবর্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য
‘তবু মনের বয়স বাড়তে দিয়ো না’
পৃথা কুণ্ডু
ছোট্ট মেয়েটা প্রথমবার নেচেছিল স্কুলের ফাংশনে, ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’ গানের সঙ্গে। তখন কতই বয়স হবে তার, চার কিংবা পাঁচ। কে গাইছেন, গানটার মানে কী – এসব বোঝার বয়স তার হয়নি। তবু দোলা লেগেছিল তার কচি হাত-পায়ে, লেগেছিল মনেও। ছোটবেলার সেই ভাললাগা পরে গড়াল ‘পালকি চলে’র পথ ধরে, ‘ও নদীরে’র জলতরঙ্গে আর ‘ফুলেশ্বরী ফুলেশ্বরী’র মোহে, আরও অনেক, অনেক গানের টানে। কিন্তু শিশুবেলার সেই প্রথম ভালোলাগার মিষ্টি আবেশ তো ভোলার নয়। সেই মেয়েটি আজ মা, তার পাঁচ বছরের মেয়েকে সে ওই গানের তালে তালেই নাচতে শেখায়।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুর আর কণ্ঠের জাদুতে মুগ্ধ পাঁচ প্রজন্মের বাঙালি। এ নিয়ে আর নতুন করে কিছু বলার নেই। কিন্তু তিনি যে শুধুই যৌবনের রঙিন উচ্ছ্বাস আর প্রৌঢ় বয়সে ‘ফিরে দেখা’র আশ্রয় নন, ছোটদের জন্যও যে অনেকখানি ভরে রেখেছিলেন তাঁর গানের ডালি – সেকথা ‘বড়’ হয়ে যাবার পর আমরা কেমন ভুলে যাই! অথচ বাংলায় সর্বকালের সেরা ‘ছোটদের গান’ এর তালিকায় উপরের দিকেই থাকবে ‘ছেলেবেলার গল্প শোনার দিনগুলো’, ‘ঘুম যায় ওই চাঁদ মেঘপরীদের সাথে’, ‘এক যে ছিল দুষ্টু ছেলে’, ‘কে যাবে কে যাবে’ বা ‘হরিদাসের বুলবুল ভাজা’র মত গান।
মজার কথা হল, এরকম কিছু কিছু গানের মানে ছোটদের কাছে একরকম, আবার বড়দের কাছে হয়ত আলাদা। নিলাম ওয়ালা গানটার কথাই ধরা যাক। প্রথম দিকের লাইনগুলো মা-বোন বউদিদের জন্য; কিন্তু তারপর
‘গোমড়ামুখে ছোট্ট খুকি ফেলছ কেন চোখের জল
আমি তোমায় দিতে পারি ঝুমঝুমি আর খেলার বল।’
এমন আদর করে গাওয়া কথা গুলো শুনলে যে কোন বাচ্চার ঠোঁট ফোলা ঘুচে গিয়ে মুখে হাসি ফুটবে। শেষে ‘ছ’আনাতে দুনিয়া বেচি আমার দামই অজানা’ – বলে ওই টান – বড়রা এর যা খুশি মানে করুন, ছোটদের কাছে এ তো হ্যামলিনের বাঁশি ওয়ালার ডাক।
ভাবলে এমন অনেক গানের কথা মনে পড়ে। ‘অবাক পৃথিবী’ ছবিতে ‘এক যে ছিল দুষ্টু ছেলে’ গানটার দৃশ্য বাইরে থেকে দেখলে একরকম – গান গেয়ে গেয়ে স্কুলের বাচ্চাদের বিদ্যাসাগর, নেতাজি সুভাষ- এঁদের জীবন কথা বলে অনুপ্রাণিত করা হচ্ছে, তারাও কোরাসে গাইছে । আবার ভেতরে বসে স্কুলের বড় বড় কর্তাব্যক্তিরা সেই গান শুনছেন – তাঁদের কাছে সে গানের মানে দাঁড়াচ্ছে অন্যরকম। ‘শূর্পনখার নাক কাটা যায়’ গানটি সম্বন্ধেও এ কথা বলা যায়। কথাগুলো মজার, সুরটাও মনকাড়া – আর গায়নের তো তুলনাই নেই। বাচ্চারা মনের আনন্দে কোরাস গাইতে থাকে শেষে, আর কচিদের গানে সমাজের দুর্নীতির এমন ছালছাড়ানো চেহারাটা বেরিয়ে পড়তে দেখে ‘বড়’রা আর সহ্য করতে পারেন না, হল ছেড়ে বেরিয়ে যান।
‘ধিতাং ধিতাং বোলে’ আর ‘পালকি চলে’র মতই ছোটদের জন্য হেমন্ত-সলিল জুটির আর একটি অসামান্য গান ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ ছবিতে ব্যবহৃত ‘আমার এ হরিদাসের বুলবুল ভাজা’ – যার শুরুতেই শোনা যায় ‘বড়’দের জগতের সমস্তরকম ভেদাভেদ ভুলিয়ে, সব ছোটদের আপন করে নেওয়া ডাক-
ওরে নরে হরে শঙ্কু রে রামা শামা খেঁদি বুচি আয় ছুটে আয়
ওরে জগা মাধা ভজা কে খাবি আমার ভাজা দাঁতে শান দিয়ে ছুটে আয় –
এই যে সবাই মিলে ভাগ করে খাওয়ার আনন্দ, তাতেই রাস্তার ফেরিওয়ালার সামান্য উপকরণ হয় ওঠে সাত রাজার ধন মানিক, আর এ আনন্দ কেবল ছোটদের জন্য –
আমার এই বুলবুল দানা, নিতে কারো নেই কো মানা
সোনাদানার গরবে এ যায় না কেনা –
… আমার এই বুলবুল ভাজা এ শুধু ছোটদের খোঁজা।’
একই মেজাজের আর একটি গান, তাঁর নিজের সুরে, আরও বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ ছবিতে – ‘হরিদাসের বুলবুলভাজা টাটকা তাজা খেতে মজা’। এই ছবিতে সুরকার হেমন্ত দু রকম সুরে ব্যবহার করেছিলেন গানটি – একবার নিজের গলায়, আর একবার তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায়। সেই সঙ্গে এ ছবির আর একটি গান ‘ওরে মন তল্পি তল্পা নিয়ে এবার কেটে পড়ো’ – বাউল সুরের আদলে ডানপিটে কিশোরদের দুষ্টুমির অনুষঙ্গে নির্মল হাসির খোরাক হয়ে ওঠে। ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যাণ্ট’ ছবিতে ‘ক রয়েছেন কলকাতায়’ গানটি ছোটদের সঙ্গে মিশে হুল্লোড়ে মেতে ওঠা এক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সবুজ মনের ছোঁয়ায় অমলিন, আবার সে যখন শিশুদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তখনকার বেদনা-আবহে মনে দাগ কেটে যায় ‘তোমাদের নতুন কুঁড়ির নতুন মেলায়’ গানটি।
এর পাশাপাশি মনে পড়ে ‘সোনার খাঁচা’ ছবির ‘যা রে যা উড়ে রাজার কুমার’, ‘জয়’ ছবির ‘ও আমার ছোট্ট বন্ধুরা’, ‘সূর্যতপা’ ছবিতে ‘কে যাবে কে যাবে’, ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যাণ্ট’ ছবিতে ‘ক রয়েছেন কলকাতায়’, ‘চেনা অচেনা’ ছবিতে গানের মাধ্যমে শিশুদের কাছে তুলে ধরা যিশুখ্রিস্টের গল্প – ‘শোন শোন তোমরা সবাই গল্প শোন’-র মত আরও অনেক গান। তাঁর সুরে তাঁরই ভাই অমল মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘টগবগ টগ বগ ঘোড়া ছুটিয়ে’ আর ‘চুপ চুপ লক্ষ্মীটি’, আর কন্যা রানু মুখোপাধ্যায়ের গলায় ‘লাল ঝুঁটি কাকাতুয়া’ আর ‘শোন শোন শোন মজার কথা ভাই’ – এগুলো তো ছোটদের গানের দুনিয়ায় মাইলফলক হয়ে আছে। আজও এইচএমভির ক্যাসেট বা সিডিতে যে ‘ছোটদের রামায়ণ’ বা ‘বুদ্ধু ভুতুম’ বাজিয়ে স্কুলের অনুষ্ঠানে নাচে কচিকাঁচার দল – সেখানেও সূত্রধরের কণ্ঠটি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের। হিন্দিতে তাঁর ছোটবেলার গান বা ছোটদের গানের সংখ্যা খুব বেশি নয়, তবু তাঁর গাওয়া ‘ভলা থা কিতনা অপনা বচপন’ আর তাঁর সুরে ‘আও বাচ্চো তুমহে দিখায়েঁ’-এর কথা বলতে হয় অবশ্যই।
আর একটি গানের কথা না বললেই নয় – শ্রাবন্তী মজুমদারের সঙ্গে ডুয়েটে বাবা-মেয়ের সেই বিখ্যাত গান, ‘আয় খুকু আয়’। ছেলেবেলার দিন ফেলে এসে বড় হয়ে যাওয়া অনেকের মনে আজও ঢেউ তোলে বাবার গলায় ‘মিষ্টি সে পিছুডাক’- ‘এ হাতটা ভালো করে ধর এখুনি/ হারানো সে দিনে চল চলে যাই/ ছোট্টবেলা তোর ফিরিয়ে আনি।’ খোকা হোক বা খুকু – সে বড় হয়ে যাবার পর, জীবনের জটিলতায় ক্লান্ত হতে হতে, কোন এক সময় ছোটবেলার দিনগুলোয় মনে মনে ফিরে যাবার জন্য এই গানের ভেলায় ভাসাই যায়।
ভারতবিখ্যাত এই মানুষটির মনের মধ্যেও কোথাও যেন লুকিয়ে ছিল এক অনন্ত ছেলেমানুষ। যাঁর এক ডাকে লতা মঙ্গেশকর, গীতা দত্তের মত শিল্পী এসে গলা দেন মরুতীর্থ হিংলাজ-এর কোরাসে, সেই মানুষটি আবার মফস্বলের এক জলসায় এলাকার এক শিশুশিল্পীর গান ভালো লাগায় তার কাছে আবদার করেন, ‘আমার সাথে ডুয়েট গাইবি? আর একবার একটি শিশু তাঁকে দেখে ‘হেমন্ত, হেমন্ত’ বলে ডেকে ওঠায় মজা করে বলেন, ‘কী কপাল আমার, তোরাও নাম ধরে ডাকিস!’ তাঁর এক ছাত্রী বন্দনা সিংহের ছোটবেলার স্মৃতিতে এখনও অমলিন অন্য সবার ‘হিংসে’ কুড়িয়ে তাঁর কোলের কাছে বসার জায়গাটি দখল করতে পারার অধিকার। নিজে নোটেশন লিখতে না পারায় তাঁর খাতায় লিখে দিতেন শিক্ষক নিজে। বিশাল গোঁফ নেই, বয়সও খুব বেশি নয়, রাগী গম্ভীর মুখের বদলে মিষ্টি হাসি – এমন মানুষকে ক্লাস সিক্সের ছাত্রী ‘মাস্টারমশাই’ বলতে না চাওয়ায় তিনিই হেসে ছাড়পত্র দিয়েছিলেন, ‘তাহলে দাদা-ই বলিস’। ছোটরা তাঁকে চেনে ‘পালকি চলে’র জন্য – একথা বলতে শেষজীবনেও বড় আনন্দ পেতেন তিনি। আর একবার রবীন্দ্রসদনে বাবা-মার হাত ছাড়িয়ে একটি শিশু চারদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল – ‘হেমন্ত কোথায়? হেমন্ত কোথায়?’ তার সামনে এসে জানতে চাইলেন তিনি নিজে, ‘কোন হেমন্তকে খুঁজছ?’ শিশুর উত্তর, ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’র হেমন্ত! এ গান কোনভাবেই ‘ছোটদের’ বলা যায় না। কিন্তু কে জানে কোন মায়াবলে ওই সরল শিশুটির কাছে এ গান হয়তো বয়ে এনেছিল ঘুমপাড়ানি সুরের স্নিগ্ধতা। আজীবন হেমন্ত মনে রেখেছিলেন সেই ছোট্ট ছেলেটিকে। এ বছর ১৬ জুন পূর্ণ হতে চলেছে তাঁর শতবর্ষ, আর সেই ছেলেটিও আজ কত বড় হয়ে কোথায় আছে কে জানে। সুরের তো আর বয়স বাড়ে না, আর সারল্যেরও।
যাঁদের ছোটবেলা ভরে থাকত এমন সব চিরসবুজ সুরে, তাঁদের জীবন এগিয়ে গেছে আজ বহু বহু বছরের পার। কিন্তু সেই গানেরই কথায় তো আছে ‘বয়স বাড়ে বাড়ুক, তবু মনের বয়স বাড়তে দিয়ো না।’ আজ যারা ছোট, তারাও যেন একটু স্বাদ পায় তাদের মা-বাবা-দাদু-ঠাকুমাদের সেই সুরেলা শৈশবের- এটুকু আশা কি তাঁদের কাছে আমরা করতে পারি না?