অমর মিত্রের অন্যান্য গল্পঃ তেঁতুলে শ্রীমধুসূদন, দলমা মশায়, চম্পকলাল, পিসি সরকারের ম্যাজিক, ভূত ও মানুষ, সাত রঙের পাখি, গগন বুরুর কঞ্চি ডাকাত, কাযাখ গল্প জয়ঢাক প্রকাশন থেকে অমর মিত্রের সদ্য প্রকাশিত বই->
বুনি আর রবিনবাবু
অমর মিত্র
রবিনসন ক্রুশোর ছোট্ট বন্ধু রবিনবাবু সকালে উঠে লেখাপড়া করেন। রবিনবাবুর বয়স আট। ক্লাস টু। তাঁর একটা টেবিল চেয়ার আছে। আর আছে জানালা। জানালার ওপারে একটা বাগানমতো। সেই বাগানে আমের গাছ একটি, একটি নিমগাছ, দুটি পেয়ারাগাছ। জামরুলগাছ লাগানো হয়েছে সবে। জামরুলগাছে ফল ধরতে দেরি আছে। দু-তিন বছর লাগবে। তখন রবিনবাবুর ক্লাস এইট হয়ে যাবে। অনেক বড়ো হয়ে যাবেন তিনি। সেকথা যাক। তখনকার কথা তখন হবে। বাগানে আর আছে একটি গন্ধরাজ আর জুঁই ফুলের গাছ। রবিনবাবু ইতিহাস, ভূগোল, ইংরিজি পড়তে পড়তে বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকেন একেকবার থেমে। অঙ্ক কষতে কষতে খাতা থেকে মুখ তুললে তাঁর খুব ভুল হয়ে যায়। তখন তাঁকে জানালা বন্ধ করে দিতে হয়। এখন শ্রাবণ মাস। ঝিরিঝিরি বর্ষা হয়েই যাচ্ছে। থামছে আর হচ্ছে। সারা রাত্তির খুব মেঘ ডেকেছে, আর ঝমঝম বৃষ্টি হয়ে গেছে। এখনও হচ্ছে বৃষ্টি, কিন্তু তা ঝিরিঝিরি। জানালার বাইরে বাগানের সব গাছ স্নান করে গেছে সমস্ত রাত ধরে। জুঁই ফুলের গন্ধ আসছে বাগান থেকে। রবিনবাবুকে সতেরটি নানারকম অঙ্ক কষতে হবে। যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ। কিন্তু এসব তাঁর পছন্দ নয়। যে অঙ্কে গল্প থাকে, তাই তাঁর ভালো লাগে। তিনি ক্লাস টু, কিন্তু তাঁর দিদি ক্লাস সেভেনের ঝিমিলির অঙ্ক বইয়ের গল্প তাঁর পছন্দ। সেই যে বাঁদরের তৈলাক্ত বাঁশে ওঠা, চৌবাচ্চার জল বেরিয়ে আসা, রেলগাড়ির গতিবেগ—এইরকম কত গল্প আছে। রবিনবাবু নিজের অঙ্ক না কষে দিদির অঙ্কের গল্পের ভিতর মজে যান। যেমন বাঁদরের তৈলাক্ত বাঁশে উঠতে যাওয়া। উঠে সে কী করবে? বাঁশের মাথায় উঠে কী হয়? রবিনবাবু ক’দিন আগে মায়ের কাছে সার্কাসের গল্প শুনছিলেন। আগেরদিনে সার্কাসে বাঘ-সিংহ খেলা দেখাত। বাঁদর দেখতে গিয়েছিলেন। মা বলে, আগেরদিনে সার্কাসে বাঘ, সিংহ, বাঁদর, ঘোড়া, ভল্লুক খেলা দেখাত; বাঘ উঁচু টুলের উপর উঠে বসে থাকত গালে হাত দিয়ে। কেন, গালে হাত দিয়ে কী ভাবত বাঘ?
মা মুখ টিপে হাসতে হাসতে বলেছিল, “অঙ্ক ভাবত।”
“কী অঙ্ক?”
“ওই যে বাঁদর তৈলাক্ত বাঁশের মাথায় উঠতে উঠতে নেমে আসত, সেই অঙ্ক।”
এখন আর সার্কাস আসে না। এলে রবিনবাবু দেখতে পেতেন বাঁদর কীভাবে বাঁশের মাথায় ওঠে আর বাঘ কীভাবে টুলের উপর গালে হাত দিয়ে বসে থাকে।
এই যে শ্রাবণের ঝিরিঝিরি, বাইরের বাগানে পেয়ারাগাছের ডালে বসে একটা কাক বসে ভিজেই যাচ্ছে। ওর নাম কাকসু। ওর এক ভাই আছে, তার নাম বাঁকসু। নামগুলো রবিনবাবু দিয়েছেন। সকালে বিস্কুট নিয়ে কাকসু বলেই ডাক দিলেই হয়। সাঁ করে ডানা ভাসিয়ে চলে আসবে। আর বাঁকসু যদি থাকে কাছে-পিঠে, সে ওই পেয়ারা-ডালে মনখারাপ করে বসে থাকবে। বাঁকসু বলে না ডাক দিলে আসবে না। কাক বলে কি তার মানসম্মান নেই? সে কৃপা করে রবিনবাবুর দেওয়া বিস্কুট খায়। এই যে এখন কাকসু বসে আছে, সে নেই। রবিনবাবু জানেন, সে নিশ্চয় পাশের বাড়ির জানালার সামনের আমগাছটির ওপর বসে আছে। সে ওই ভালোকাকিমার সঙ্গে আসা কুলকুলিকে দেখছে।
ভালোকাকিমা কোথায় কোন ফুলের বনে ফুলতলায় কুড়িয়ে পেয়েছে কুলকুলিকে। রবিনবাবু ওর নাম দিয়েছেন তাই। এইটুকুন বনু, শুধু ঘুমোয়। দু’দিন গিয়ে তাকে জেগে থাকতে দ্যাখেননি তিনি। কিন্তু নিজের মতো করে একটা নাম দিয়েছেন—কুলকুলি বনু। এইটুকুন হাত, এইটুকুন পা, ঘুমের ঘোরে হেসে ওঠে, হাঁই তোলে। আবার কেঁদেও ওঠে।
বাঁকসু আর আসছেই না এদিকে। সে কুলকুলি বনুর সঙ্গে ভাব জমাচ্ছে। রবিনবাবুর হঠাৎ মনে হল, ধুর, ভালো লাগছে না, যাই বনুরে দেখে আসি। যদি জেগে থাকে আলাপটা তো করে আসতে হবে। মা চা খেতে খেতে খবরের কাগজে চোখ মেলে। বাবা এখনও ঘুমিয়ে। রবিনবাবু পা টিপে টিপে দরজা দিয়ে বেরিয়ে ভিজতে ভিজতে পাশের বাড়ি। দরজা যেন খোলা রয়েছে তাঁর জন্য। ভালোকাকিমা দাঁড়িয়ে। “ওমা, রবু! এখন কেন?”
“কুলকুলিকে দেখব কাকিমা।”
“কুলকুলি!” হেসেই অস্থির ভালোকাকিমা। “আচ্ছা, ও রবু, ভিজে গেলি যে!”
“ও কিছু না।” রবিনবাবু গম্ভীর স্বরে বললেন।
তার গম্ভীরতায় কাকিমা আবার হেসে অস্থির। বলে, “দ্যাখো, কিন্তু গায়ে হাত দিয়ো না, বুঝলে রবুবাবু।”
ভালোকাকাও ঘুমিয়ে। ভালোকাকার মা, ভালোঠাকুমাও ঘুমিয়ে। রবিনবাবু কুলকুলির ঘরে গেলেন তোয়ালেতে মাথা আর খোলা হাত মুছে। খাটের উপর সে ঘুমিয়ে। খাটের সামনে রাখা চেয়ারে বসলেন তিনি। কাকিমা বলল, “বনু ঘুমোচ্ছে। তুমি বসে বসে বনু দ্যাখো।”
জানালা বন্ধ। রবিনবাবু খুলে দেবেন কি না ভাবছেন, তখন, কী আশ্চর্য, বনু জেগে উঠেছে। ওর বয়স নাকি পনেরো দিন। মা বলে। রবিনবাবু এগারো। এগারো বছর মানে ৩৬৫ দিয়ে গুণ করলে কতদিন দাঁড়াবে? অনেকদিন।
বনু সাদা ধবধবে চাদর গায়ে শুয়ে আছে। চোখ খুলে তাকায় তাঁর দিকে। চোখ পিটপিট করছে, তাঁকে দেখছে, দেখে চিনতে চাইছে। চিনবে কী করে, আগে যে তিনবার রবিনবাবু এসেছেন, তিনবারই বনু মানে কুলকুলি ঘুমিয়ে ছিল।
রবিনবাবু ডাকলেন, “হ্যালো, হাই কুলকুলি!”
সে হাসল। তারপর রবিনবাবুকে অবাক করে দিয়ে বলল, “তুমি রবুদাদা?”
“ইয়েস।” বুকে হাত দিলেন রবিনবাবু। এর আগে তো কেউ তাঁকে দাদা বলে ডাকেনি। এই প্রথম। কী সুন্দর না লাগল।
কুলকুলি বলল, “বাইরে কী হচ্ছে?”
“বিস্টি হচ্ছে কুলকুলি।”
“জানালা খুলে দাও না গো।”
“কেন? তোমার যে ঠাণ্ডা লাগবে বনু।”
“না, লাগবে না। বিস্টি কী জানি না। আমি কোনোদিন বিস্টি দেখিনি রবুদাদা।”
“আমার নাম জানলে কী করে?”
“কুলকুলি বলল, “এই যে মা বলল একটু আগে, তোমাকে ডাকল।”
“ওমা, তুমি শুনতে পেলে?”
“হ্যাঁ, রবুদাদা। জানালাটা খোলো না, বিস্টি দেখব।”
“খুলছি, কিন্তু বেশি বায়না করবে না, বুঝলে।” বলতে বলতে রবিনবাবু জানালা খুলে দিলেন। যা ভেবেছেন, ঠিক তাই। শুধু বাঁকসু নয়, কাকসুও বসে আছে তার পাশে। জানালার দিকে তাকিয়ে বনু কুলকুলি বলে, “ও মা মা, কী সুন্দর বিস্টি! জল পড়ছে আপনা-আপনি—আর ওই ওরা কারা?”
পরিচয় করিয়ে দিলেন রবিনবাবু। কাকসু আর বাঁকসু। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে খিলখিল করে হেসে ওঠে
কুলকুলি, “এই, আয় না।”
“না। আমি তোর সঙ্গে টুনটুনির পরিচয় করিয়ে দেব। এরা ভীষণ কা কা করে।”
তাই শুনে বুনু আবার হাসল। বলল, “আর ওরা ঝগড়া করবে না। আমি এসে গেছি যে। এই, ঝগড়া করবি?”
দুই দুষ্টু কাক একসঙ্গে বলে উঠল, “না না না, করব না।”
কুলকুলি বনু বলল, “ভালো কাক। ওমা, বিস্টি কোথায় গেল?”
তাই তো। বৃষ্টি নেই। ভিজে গাছগাছালির গায়ে রোদ পড়ে ঝলমল করছে সব। কী সুন্দর হয়ে গেছে সব।
কুলকুলি বলে ওঠে, “কী করে এমন হল গো?”
রবিনবাবু বললেন, “মেঘের জল ফুরিয়ে গেছে বুনি, তাই সুয্যি মুখ বের করতে পেরেছে।”
“সুয্যি কী গো?”
“চাঁদ-সুয্যি দুই মামা। জগতে আলো দেয় সুয্যি, আর চাঁদ তার আলো নিয়ে রাতে হাসে।”
“জগত কী গো রবুদাদা?”
“তুমি যে জগতে এসেছ বুনি কুলকুলি।”
বুনি তার ছোট্ট দুই হাতে তালি দিল। “জগত, জগত, জগত, জগত!”
রবিনবাবু এবার গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি তো ফুলতলা থেকে এলে বুনু সোনা?”
“কী জানি, আমার মনে নেই।”
“আমি তোমাকে আমাদের বাগানের ফুল চিনিয়ে দেব। ফুলের কী সুন্দর বাস হয়!”
“দিয়ো গো। ফুলের বাস কেমন গো?”
রবিনবাবু বললেন, “ফুলের বাস আসছে তো জানলা দিয়ে, গন্ধরাজ আর জুঁই ফুলের।”
“কী মিষ্টি, কী মিষ্টি! এই, মিষ্টি কী গো?”
রবিনবাবু গম্ভীর। “জগতে কত মিষ্টি ফুলের গন্ধ আছে।”
“এই রবুদাদা, জগত কেমন বলো না গো।”
রবিনবাবু বললেন, “জগতে কী না হয়। বাঁদরে শুধু তৈলাক্ত বাঁশে উঠতে চায়, আর তা দেখে বাঘ-সিংহ গালে হাত দিয়ে ভাবে।”
“এ বাবা, তাই! বাঁদর কেমন গো?”
“মানুষের মতো। শুধু গায়ে লোম আছে আর একটা লেজ আছে।”
“তাই?” বনু কুলকুলি গালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগল।
“কী হল, ও বুনি?”
“কিছু না গো। আমি বাঁদর দেখব।”
“দেখাব আমি, আসুক এদিকে।” রবিনবাবু বললেন।
“না। আমি এখনই দেখব।”
“দেখাব বুনি-সোনা, বায়না করে না।”
ছোট্ট কুলকুলি বলল, “না, আমাকে বাঁদর দেখাও।”
ইস, কী বিপদে পড়ল সে। এ দেখি আচ্ছা বায়নাবাজ বনু! পনেরো দিন বয়স, এর ভিতরে বাঁদরের বায়না করে। ফুল-পাখি-রোদ-বৃষ্টি দেখে এখন বাঁদর দেখতে চায়। কী করবেন রবিনবাবু, এদিক ওদিক দেখে খবরের ঘরের কোণের কাগজের স্তূপ থেকে একটি কাগজ নিয়ে লম্বা করে পাকিয়ে নিয়ে প্যান্টের পিছনে লাগিয়ে নিয়ে মেঝের উপর হুপ করে এক লাফ দিলেন। আর তাই দেখে হাততালি দিল বনু, “চিনেছি চিনেছি, ফুলতলায় দেখেছি! এই বাঁদর, কলা খাবি?”
এতে রবিনবাবু খুব উৎসাহ পেলেন। আবার লাফ দিলেন, হুপ। আর লাফ দেখে পনেরো দিনের কুলকুলি হেসে কুটিপাটি। ফোকলা গালে হাসছে সে। চোখ মেলেছে। নতুন চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে সব। আর হাসছে। জগত জগত, জগত যে ফুলতলার মতো। বাগানের ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে এই ঘরে। দরজায় ভালোকাকিমা এসে দাঁড়িয়েছে। “কাণ্ড দ্যাখো, বুনিকে বাঁদর খেলা দেখাছে তার রবুদাদা! ছোট্ট মেয়ে হাসছে তাই।”
ছবি: রাহুল মজুমদার
জয়ঢাকের সমস্ত গল্প ও উপন্যাস