তৃষ্ণা বসাকের আগের গল্প- শিবাই পণ্ডিতের ই টোল
তৃষ্ণা বসাক
১
পাপন যেতে যেতে থমকে গেল। বাড়ি থেকে বৈরাতিগুড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয় যেতে পনেরো মিনিটও লাগে না। কিন্তু পাপন সেটা যায় আধঘণ্টা ধরে। কারণ, সে ঘুরে ঘুরে শালবাড়ি চা-বাগানের পাশ দিয়ে যায়, যেখানে সে একটা ছোট্ট নালা আবিষ্কার করেছে, আর তার নাম দিয়েছে চিলাই নদী। বাড়িতে ঠাকুমা দিনরাত বলে যে নদীর কথা। চিলাই নদীর ধারে সুনামগঞ্জ জেলার রাঙাফুলিয়া গ্রামে নাকি তাদের বাড়ি ছিল।
“ছিল কেন ঠাকমা, এখন নাই?” পাপন বাড়িতে কথা বলার সময় বাঙাল ভাষায় কথা বলে। বাইরে এখানকার ভাষা। তবে বাবা বলে এখানকার ভাষা তো পুব-বাংলারই ভাষা।
ঠাকুমা এর জবাব দেয় না, কেবল কাঁদে। মা এসে বলে, এখন এটাই তাদের বাড়ি।
পাপন যেন জানে না এটা বাড়ি নয়, এটা কোয়ার্টার। বাবা বৈরাতিগুড়ি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার। তার বদলির চাকরি, আবার অন্য জায়গায় চলে যেতে হবে ওপর থেকে অর্ডার এলে। ওপর মানে কোন ওপর? আকাশের কাছাকাছি কোনও জায়গা? পাপন জানে না। শুধু জানে তখন এই স্কুল নয়, অন্য স্কুলে পড়তে হবে তাকে। এই স্কুল ছেড়ে যেতে হবে। তার চেয়েও বেশি, এই চিলাই নদীকে ছেড়ে যেতে হবে।
আজ যেতে যেতে দেখল চিলাই নদীর ওপর একটুকরো মেঘ। পাপন তার টিনের সুটকেসটা পাশে রেখে মেঘটাকে আদর করল। সে জানে এটা চেরাপুঞ্জির মেঘ। কারণ, কাল ভূগোল স্যারকে সুনামগঞ্জের কথা বলতে স্যার এককথায় বলে দিল ওটা তো মেঘালয়ের গা ঘেঁষে। আর মেঘালয় হচ্ছে মেঘের আলয়, সেখানেই তো মৌসিনরাম চেরাপুঞ্জি। বলতে বলতে অজয় স্যারের চোখদুটো কতদূরে চলে গেছিল। মনে হচ্ছিল, স্যার নিছক ভূগোলের গল্প বলছেন না, স্যার নিজেই ওই জায়গায় ছিলেন।
পাপন এমনিতে খুব লাজুক, বাইরের লোকের সঙ্গে কিছু বলতে পারে না। বাড়ির লোকের সঙ্গেও না। সে কেবল নদী-পাহাড়, মাছ-পাখি এদের সঙ্গে মিশতে পারে। এদের সঙ্গে কথা বলার জন্যেই সে এত তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বেরোয়। সাতসকালে চান করে মাকে বলে, “ভাত দাও, ভাত দাও।”
মা রান্নাঘর থেকে বলে, “হায় হায়, এখনও ঝোল নামেনি মনা। কী দিয়া খাবি?”
পাপন ভেজা চুলে চিরুনি চালাতে চালাতে বলে, “ভাজি-পোড়া যা আছে দাও।”
বলেই সে টেবিলে বসে পড়ে। নিজেই প্লাস্টিকের ফুলকাটা ম্যাট পাতে, যাতে গরম ভাতের থালার তাপ লেগে ডাইনিং টেবিলটা নষ্ট হয়ে না যায়। টেবিলটা মাস দুয়েক হল কিনেছে বাবা। কেনেনি, বানিয়েছে। ফালাকাটা থেকে ফিরছিল, সেখানে রাস্তার ধারে একটা কাঠের দোকানে দেখে পছন্দ হয়ে গেছে, তাই বানাতে দিয়ে এসেছে। মা খুব রাগ করেছে, বেকার পয়সা নষ্ট নাকি, কেউই খাবে না ওখানে বসে। না ঠাকুমা, না দাদু। হলও তাই। ওরা দু’জনেই রান্নাঘরে পিঁড়ি পেতে খায়, বাধ্য হয়ে মাকেও ওখানে বসে খেতে হয়। টেবিলে খাওয়ার মধ্যে দু’জন, বাবা আর পাপন। বোন তো এই ন’মাস বয়স। বাবার খুব অসুবিধে হত টেবিল ছাড়া। হসপিটাল থেকে একটু ফাঁক পেয়ে এসে চট করে খেয়ে যেতে হয়, তাও পেশেন্ট পার্টি বাড়ি অবধি এসে ডাকাডাকি করে, উঁচুতে বসলেই সুবিধে। পাপনের বেশ লাগে। মারও সুবিধে হয়েছে নিশ্চয়ই। নিচু হয়ে হয়ে খাবার দিতে হয় না।
আজ পাপন টেবিলে বসতে মা গরম ভাতে মাসকলাইয়ের ডাল আর গন্ধপাতার বড়া এনে দিল, একধারে গন্ধরাজ লেবু। পাপনের মনে পড়ল, আজ বৃহস্পতিবার, নিরামিষ তো। ভালোই হল, মাছের কাঁটা বাছতে হল না। চট করে খেয়ে ব্যাগ নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল। বেরোবার আগে চুপি চুপি হরলিক্সের বোতলটা নিতে ভুলল না। এর মধ্যে একটা চিংড়ি আর একটা ছোট্ট ফলুই আছে। পরশু বাবা বাজার থেকে অনেক মাছ এনেছিল। তার মধ্যে এ-দুটো তখনও লাফাচ্ছিল। সে চুপিচুপি সরিয়ে কাচের বোতলে রেখেছে। তার মনে হয়েছে, যে নদীটার নাম সে রেখেছে, তাকে কিছু উপহার দেওয়া দরকার। কয়েকমাস আগে বোনের অন্নপ্রাশন হল তো। সেখানে দেখল বোনের নাম দেওয়া হল, অনেক উপহার পেল সে। নদী বলে কি মানুষ নয়?
অন্যদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে সে যায়, এক মিনিটও যাতে নষ্ট না হয়। আজ হরলিক্সের বোতলে রাখা মাছটার জন্যে সে আস্তে আস্তে চলছিল। শালবাড়ি চা-বাগানের গেটের সামনে এসে সে ডানদিকে ঘুরে গেল। গেটের সামনে কী ভিড়! একদল কাজ সেরে বেরিয়ে আসছে, আরেক দল ঢুকছে। কিন্তু এর ডানদিকে কোনও জনমানুষ নেই। কয়েকটা শিমুলগাছ ছাড়া ছাড়া দাঁড়িয়ে। আর রোগা নদীটা তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে। পাপন টিনের সুটকেস আর বোতলটা সাবধানে নামিয়ে রেখে প্রথমে নদীর বুকে দোল খাওয়া মেঘটাকে আদর করল। তার কোনও সন্দেহই নেই, এটা চেরাপুঞ্জি থেকে সরাসরি এসেছে। তার মনে হওয়ার কারণ আছে। বোনের অন্নপ্রাশনের সময় ঠাকুমার খুব মনখারাপ। এদেশে তাদের আত্মীয় কই? কাদের নিয়ে আমোদ-আহ্লাদ করা যাবে? “শুধু তো তর মায়ের মামা থাকে। সেই আসব গুষ্টি নিয়া। তর বাবার পেশেন্ট পার্টি আসব। তর সাথীরা আসব। আমাগো কেউ নাই এ-দ্যাশে।”
পাপন বিচলিত হয়ে বলেছিল, “আমারে কও কারে কারে দাওয়াত দিতে লাগব, ছুইটা গিয়া দিয়া আসুম।”
ঠাকুমা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, “কী যে কস মনা? সে দ্যাশে তর যাওনের উপায় কই? যুদ্ধ লাগসে।”
কারও নাম বলেনি ঠাকুমা, ঠিকানাও দেয়নি, কিন্তু পাপনের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গিয়েছিল। এখানে মাথার ওপর যে আকাশ আছে, সুনামগঞ্জের মাথার ওপরও নিশ্চয় একই আকাশ, যে হাওয়াটা বইছে, সেটাও এক, যে সূর্যটা আলো দিচ্ছে, সে তো ওখানেও ওঠে। অজয় স্যার বলেছে পুবের দিকের লোকের কাছে সূর্য আগে যায়। তাহলে তো একই সূর্য ওখানে ডিউটি সেরে এখানে আসে। সে তাই চিলাই নদীর ধারে গিয়ে চিৎকার করে সবাইকে বলেছিল, “সূর্য-চাঁদ-তারা-মেঘ-আকাশ-বাতাস, সবাইকে দাওয়াত দিচ্ছি। আমার বোনের মুখেভাত। সবাই কিন্তু আসবা। নইলে ঠাকুমার খুব মনখারাপ হবে।”
সেই ডাক হয়তো একটু দেরিতে পৌঁছেছে সবার কাছে, কিংবা সবাই এত ব্যস্ত, সময়ে আসতে পারেনি। কিন্তু এসেছে ঠিকই। আনন্দে ঝলমল করে পাপনের মুখ। সে ফলুই আর চিংড়ি মাছদুটো ছেড়ে দেয় জলে। জলের নিচে লাল-নীল ছোটো ছোটো নুড়ি-পাথরগুলো হেসে ওঠে ওদের দেখে। পাশের কোয়ার্টারের সোনাপিসি, সোনা ছেত্রীর মতো যেন বলে, ‘ওয়েলকাম ওয়েলকাম!’
২
“মা, তুমি নল রাজার গড় গেছ?”
রান্না করতে করতে ছায়া জানালা দিয়ে তাকায় মাঝে মাঝে। সামনের সোনা ছেত্রীর কোয়ার্টারের সামনের একচিলতে জমি বড়ো বড়ো গাঁদায় ঝলমল করছে, আরও কত রঙবেরঙের মরশুমি ফুলের গাছ। এই গ্রামীণ হাসপাতালের নার্স সোনা দার্জিলিংয়ের মেয়ে। ছোটো কোয়ার্টারটা কী সুন্দর সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছে। তাকালেই মন ভালো হয়ে যায়। এমনিতে মন ভালো নেই ছায়ার। বাবা, মা, ভাইদের কোনও খবর পাচ্ছে না, তার ওপর ছোটো ভাই মিন্টু, সে নাকি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। ছায়া দেখে এসেছে তাকে, ভারি নরম এক কিশোর, সে যুদ্ধ করছে, ভাবতেও অবাক লাগে ছায়ার। পাপনের বাবা রেডিওতে খবর পায়, সাংঘাতিক যুদ্ধ চলছে পাকিস্তান আর মুক্তিবাহিনীর। ইন্ডিয়া নাকি খুব সাহায্য করছে। এই প্রচণ্ড শীতে কোথায় রয়েছে তার ভাই, প্রাণে বেঁচে আছে তো? কথাটা মাথায় আসতেই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে ছায়ার।
জানালার ওপাশ থেকে পাপন প্রশ্ন করছিল, মাকে কাঁদতে দেখে সে একটু থমকে যায়। মনখারাপের কারণ অনুমান করতে পারে সে। বলে, “ছোটমামুর কিছু হইব না। যা জোর গায়ে। ও মা, তুমি নল রাজার গড় দেখেছ?”
ছায়া চোখ মুছে বলে, “সে কুথায়?”
“চিলাপাতা জঙ্গলে, বানিয়া নদীর ধারে। মঙ্গল বলেছে আমাকে নিয়ে যাবে একদিন।”
মঙ্গল সুইপার রামপ্রসাদ সর্দারের ছেলে। ছায়া আঁতকে উঠে বলে, “একদম না। এই দ্যাশে আমাদের কেউ নাই। হারায়ে গেলে…”
সে আর কিছু বলার আগেই পাপন ছুটে যায় সামনের রাস্তায়। একটা ভ্যান মেন গেট দিয়ে ঢুকে হসপিটালের দিকে যাচ্ছে। রান্নাঘর থেকে দেখেও বুঝতে পারে ছায়া, আবার কোনও মার্ডার কেস। যেরকম ভিড় হয়ে গেল নিমেষে। সে চেঁচায়, “যাইস না। অইসব দেখতে নাই তর।”
তারপর অস্থির হয়ে পড়ে। একদম ভালো লাগে না। হসপিটালের গায়ে কোয়ার্টার। সারাদিন খুনখারাপির কেস আসে। বেশিরভাগই ভায়ে ভায়ে জমি নিয়ে খুনোখুনি, ডাকাতির কেস আসে। বাঁচে না কেউই। মাঝখান থেকে পাপন এইসব দেখে।
এরাও বাঁচল না। দুইভাই হেঁসো চালিয়েছিল একে অপরের ওপর। একজনের মুণ্ডু ঝুলছিল, অন্যজনের পেটের নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে গিয়েছিল। সেই দেখে পাপনের জ্বর এল খুব। ছায়া ভয় পেয়ে ওর বাবাকে ডাকতে পাঠাল হসপিটাল থেকে। ডাক্তার সীতেশ লাহিড়ী, মানে পাপনের বাবা এসে ওষুধ দিলেন। তখন ছটফটানি কমল একটু। ঘুমিয়ে পড়ল পাপন। অনেক রাতে ঘুম ভেঙে সে দেখল বাবা-মা ঘুমোয়নি তখনও। মার মুখ ঝলমল করছে। বাবা বলছে, “১৬ ডিসেম্বরটা স্মরণীয় দিন হয়ে রইল ইতিহাসে।”
পাপন ভাবল, কেন? এই দিনটার কথা পড়েনি তো ইতিহাসে। মা বলছে, “ঠিক শুনছ তো? পাকিস্তান হাইরা গেছে ইন্ডিয়া আর মুক্তিবাহিনীর কাছে? মিন্টু বাইচা আছে তো?”
“না তো কী? এদিকে আবার কী কাণ্ড দেখো। যে দু’ভাই মারপিট করে মরল, তাদের ছোটটার বউ আগে থেকে ভর্তি ছিল, তার মেয়ে হয়েছে। ভাবো একবার? একদিকে মৃত্যু, অন্যদিকে জীবন।”
মা অস্ফুটে বলল, “কীসের মধ্যে আইসা পড়ল একটা বাচ্চা। কে অরে দেখব, কে নাম থুইব?”
পাপন উত্তেজনায় উঠে বসে বিছানায়। তার মনে হয় নাম রাখাটাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে দরকারি কাজ বুঝি! সে দুর্বল কিন্তু দৃঢ় গলায় বলে, “এইডা একটা কথা হইল! অর নাম থাক মুক্তিবাহিনী।”
অলঙ্করণঃ মৌসুমী