গল্প মনার বাগান শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ষা ২০২০

শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরো গল্প  শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমস্ত লেখা

শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়

তুতুন ইস্কুলে চলে গেলেই চারতলার ঘর লাগোয়া বারান্দায় নেমে আসে মনা। নেমে আসে কেননা ঘর থেকে বারান্দাটা একটু নিচে। তিন-চার ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে। সিঁড়ি পেরোতে একটু কষ্ট হয়, ছোটো ছোটো পায়ে লাফ দিয়ে নামতে হয় ওকে। আর বারান্দা তো নয় একটা ছোটোখাটো জঙ্গল। রেলিংয়ের ধারে একটা আধহাত পুঁচকে বেসিন। মা কলটা খুলেই রাখে প্যাঁচ একটুখানি আলগা করে। নিচে একটা টিনের কৌটো বসানো। ওটা ভরে জল উপচে একটা ডোঙা মতো জিনিস দিয়ে নিচে মেঝেতে দু-চারটে গাছের গোড়া ঘুরে বারান্দার কোনায় একটা পাইপ বেয়ে সোজা মাটিতে। মা বলে কৌটোর জল পাখিদের জন্য। পাখিদের জল তেষ্টা পেলে এসে ঠোঁট ডুবিয়ে জল খেয়ে যাবে। মনা দেখেওছে। মা জানে না, মনাও লুকিয়ে লুকিয়ে ঠোঁট ডুবিয়ে পাখিদের মতো ওই জল খেয়েছে কতবার!

বাড়িটা তার চারপাশের পাঁচিল থেকে হাত বিশেক তফাতে হওয়ায় সেখানেও বেশ কিছু গাছ। জলটা পড়ে মাটিতে। মাটি শুষে নেয়। গাছেদের জলের অভাব হয় না। মাটি থেকে চারতলা অবধি দুটো গাছ উঠে এসেছে। বারান্দার একপাশে তো জামগাছটার ডালপালা ঝুঁকে একেবারে গভীর জঙ্গল। পাতা পড়ে সেখানে মেঝে দেখা যায় না। লুকোচুরি খেলতে খুব মজা। রেলিং বরাবর মাটির বড়ো ছড়ানো গামলাতে ঘৃতকুমারী, চাইনিজ মানিপ্ল্যান্ট, সন্ধ্যামালতী, গাঁদা আর বেলফুলের গাছ লাগানো। গাছগুলো বড়ো হয়ে গামলাকে ঢেকে ফেলেছে প্রায়। জামগাছের উলটোদিকে এক পেল্লায় নিমগাছ। বারান্দার ওপরে অর্ধেক ঢেকে ফেলেছে। ফাঁকে ফাঁকে আকাশটাকে নীল জাফরির মতো দেখায়। ঘাড় উঁচু করে সেই ফাঁক দিয়ে মনা দেখে। মেঘ ভেসে ভেসে চলেছে।

মনার বাইরে যাওয়া বারণ। তুতুন যতক্ষণ বাড়িতে থাকে সে ওর আশেপাশেই থাকে। পড়ার টেবিলের কাছে বা বিছানায়। আরও ছোটো ছিল যখন, একা একা বারান্দাতেও আসা যেত না। তখন সারাদিন তুতুনের ঘরের জানালার কাছেই বসে থাকত। জানালা থেকে বাইরের গেট, তার ওপাশেই রাস্তা পরিষ্কার দেখা যায়। ইস্কুলের গাড়ি ওখান থেকে তুতুনকে নিয়ে চলে যায় ধাঁ করে; আবার ঠিক সওয়া চারটে বাজলেই উলটোমুখে সেই গাড়িটাই ফিরে এসে গেটের সামনে দাঁড়ায়। তুতুন লাফ দিয়ে নেমে ছুটে ঢুকে পড়ে বাড়িতে। মনাও লাফাতে লাফাতে জানালা ছেড়ে চলে আসে ফ্ল্যাটের দরজার কাছে। তুতুন এসেই একবার কোলে নেবে ওকে। স্কুলের সামনে হিন্দুস্তানি দোকান থেকে একটাকার ছোলা, একটাকার বাদাম কিনে আনে। দু’জনে মিলে কুট কুট করে খায়। মা তখন খুব তাড়া দেয়! “তুতুন, স্কুল ড্রেস খোলো।” “তুতুন, হাতমুখ ধোও।” “তুতুন, খেয়ে নাও।” “তুতুন, এখন বাদাম খেও না।” রোজই পরপর বলে যায় মা। ওদের মুখস্থ হয়ে গেছে। মা বলার আগেই ওরা ফিসফিস করে এ ওকে এই কথাগুলোই আগেভাগে বলে আর তার পরক্ষণেই মা সেই কথাগুলোই আবার বললে ওরা হেসে কুটিপাটি। মা চোখ পাকিয়ে বলে, “এতে হাসার কী হল? অ্যাঁ?”

ইদানীং মনা বাইরে আসার সুযোগ পেয়েছে। আর তাতেই তার দুনিয়া অনেকটা খুলে গেছে। ওই মাটি থেকে আকাশ অবধি। সকালে মা ফল কেটে দেয় ছোটো ছোটো করে—আপেল, কলা, পেয়ারা। বারান্দায় মাঝে মাঝে নিমফল পড়ে থাকে। একলা সেখানে বেড়াবার সময় নিমফল ও মুখে দিয়ে দেখেছে, একটু মিষ্টি মিষ্টি, হাকুচ তেতো মোটেই নয়। মা অবশ্য জানে না। লুকিয়ে-লুকিয়েই খায়। আর গরমের সময় পশ্চিমের কোনায় পাতার ওপরে জাম পড়ে থাকে। বেগুনি রং ছিতরে থাকে মেঝের ওপর, পাতার ওপর। খুউব মিষ্টি ফল। মনার মুখ বেগুনি রং হয়ে যায়। মা বুঝতে পারে, কিছু বলে না।

সেদিন বারান্দায় এসে দেখে দলে দলে পিঁপড়েরা চলেছে। রেলিংয়ের পাঁচ ইঞ্চি পুরু তিন ফুট উঁচু পাঁচিলে দু-চারটে করে ইট ফাঁকা ফাঁকা করে গাঁথা। তার ওপরে টানা দু-সারি কাঁটাতার। তারের ওপর দিয়েই পিঁপড়েদের লাইন। কোথায় চলেছে। সকলেই লাল রংয়ের। মনা জানে ওদের সকলেই শ্রমিক পিঁপড়ে। ভয়ানক ব্যস্ত থাকে সারাটা দিন। খাবার খোঁজো, বাসা ঠিক করো, ডিম সামলাও, বাচ্চাদের খাওয়াও, বড়ো করো। কম ঝক্কির কাজ! বাপ রে। ছোটোখাটো পিঁপড়ের দল মুখে করে সাদা সাদা দানা নিয়ে যাচ্ছে। বেশ লাগে দেখতে। ওগুলো ফলের দানা বা ফুলের রেণু হবে বোধহয়। অনেকটা গিয়ে রেলিংয়ের এক কোনায় ফেলে দিয়ে চলে আসছে। রেলিংয়ের একটা ফাটলের মাঝখান দিয়ে একদল এসে সেই দানাগুলো মুখে করে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে। মনা চুপ করে বসে লক্ষ করে। ভীষণ ব্যস্ততা পিঁপড়ের সারিতে। এই পিঁপড়েগুলোর ডানা নেই। একদল আবার খালি হাতে থুড়ি খালি মুখে ফেরত যাবার সময় উলটোদিকের পিঁপড়েগুলোকে থামিয়ে কী যেন বলছে। খুব মিহি স্বরে। প্রায় শোনা যায় না। শুনলেও মনা বুঝতে পারত না কী বলছে। ও তো আর পিঁপড়েদের ভাষা বোঝে না! তবে আন্দাজ করতে পারে। কথাগুলো হয়তো এরকম—

“ওহ্‌, আর কত খাবার আছে রে?”

“আছে এখনও আরও খানিকটা।”

“সেই সকাল থেকে শুরু করেছি। শেষ আর হয় না।”

“হ্যাঁ। তবে এইবেলা অনেকটা দানা পাওয়া গেছে। গুছিয়ে ঘরে তুলতে অবে। রানিমার ডিম দেবার সময় হল কিনা!”

“তা ঠিক বলেছিস। ওদিকে বৃষ্টি শুরু হলে তো মুশকিল।”

“হুঁ। তার আগেই কাজ হাসিল করে ফেলতে হবে।”

“সর্দার কী বলছিল রে?”

“কখন?”

“ওই যে যখন দানা ফেলে এদিকপানে আসছিলি।”

“আরে বলিস না। দানা নামিয়ে ফেরার সময় একটু দাঁড়িয়ে কথা বলছি আরেক বন্ধুর সঙ্গে, সর্দার এসে এই মারে তো সেই মারে!”

“বা রে! একটু দু’দণ্ড কথাও বলা যাবে না সুখদুঃখের!”

“না। ওর খালি কাজ কাজ আর কাজ। নিজে তো কুটোটি নাড়বে না। খালি ফরফর করে উড়ে বেড়াবে। আর ছড়ি ঘোরাবে।”

মনা দেখল এই পিঁপড়েগুলোর থেকে একটু বড়ো একটা মোটা মাথাওয়ালা লাল পিঁপড়ে এদিকেই আসছে জামগাছতলা থেকে। আন্দাজ করল ও, এই সেই সর্দার। ও খুব হাত-পা নেড়ে এই পিঁপড়ে দুটোকে বলতে চাইল, শিগগির কেটে পড়ো। ওই যে সর্দার আসছে। কিন্তু ওর কথা বুঝতে পারলে তো। দুটো পিঁপড়েই খালি মুখে হাত-পা শুঁড় তুলে খুব কলকল করছে। যেন ফ্যাক ফ্যাক করে হাসছেও। দেখতে দেখতে সর্দার এসে পড়ল ওদের দু’জনের কাছে। আশেপাশে যেন একটা হুড়দোড় শুরু হয়ে গেল। ধীরে ধীরে ঢিমে তালে যারা আসছিল, তারা খুব দ্রুত, ব্যস্তসমস্ত হয়ে দৌড়োতে শুরু করল। কেউ এদিকে, কেউ বিপরীত দিকে। গপ্প করা পিঁপড়ে দুটো কেমন ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে। সর্দারকে দেখে হাত-পা অবশ। সর্দার খুব গলা ফাটিয়ে বকছিল। মনা ওর গলা স্পষ্ট শুনতে পেল। মনে হয় এরকম কথা বলছিল—

“এখানে দাঁড়িয়ে খোশগল্প হচ্ছে?”

“কত কাজ বাকি পড়ে আছে, সে খেয়াল আছে তোমাদের?”

“আমি যেন আর দাঁড়াতে না দেখি। পাজি কোথাকার!”

মনার খুব রাগ হল। পাজি ওরা? না এই সর্দার? একটু ভালো করে কথা বললে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হত?

পিঁপড়ে দুটো মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছিল। মনার খুব কষ্ট হল দেখে। কী করে কী করে ভাবতে ভাবতে একটা আইডিয়া খেলে গেল মাথায়। তুতুন আধখানা বিস্কুট না খেয়ে ফেলে দিয়েছিল বাস্কেটের পাশে। ও ছুট্টে গিয়ে ওইটে নিয়ে এসে অপেক্ষা করতে লাগল কখন আবার সেই পিঁপড়ে দুটো আসে। সর্দার কাছেপিঠে নেই। খানিক পরেই ও দেখতে পেল ওদের একজনের মুখে সাদা দানা, অন্যজন খালি মুখ। মনা বিস্কুটটা গুঁড়ো করে ফাটলের খুব কাছে ছড়িয়ে দিল। অমনি পিঁপড়েদের মধ্যে আবার একপ্রস্থ হৈ হৈ শুরু হয়ে গেল। তারপর সে এক দেখার দৃশ্য। অনেকে মিলে বিস্কুটের গুঁড়ো ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু কেউই এগোচ্ছে না, মুখে করে তুলছেও না। ব্যাপারটা কী? মনে মনে ভাবল মনা। ভাবতে-ভাবতেই দেখল আগের দেখা সেই পিঁপড়ে দুটো এবারে বিস্কুটের গুঁড়োর খুব কাছে গিয়ে কীসব দেখল ঘুরে ঘুরে, তারপর সবার দিকে তাকিয়ে হাত তুলে কী একটা ইশারা করতেই সকলে মিলে দুড়দাড় করে একটা একটা কণা তুলে ফাটলে সেঁধিয়ে যেতে লাগল। খুব চটপট কাজ হচ্ছে। ফাটলটা একেবারে কাছেই। ফাটলের ভেতরেই ওদের বাসা। মনা দেখতে পেল একটা পিঁপড়ে হাত তুলে ওকে কিছু বলছে। ও মুখ নামাতেই পিঁপড়েটার কথা শুনতে পেল। এবার বুঝতেও পারল কী বলছে।

“বন্ধু, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।”

মনা আশ্চর্য হয়ে গেল! ও কী করে বুঝতে পারছে পিঁপড়েটার কথা?

পিঁপড়েটা যেন শুনতে পেল ওর আশ্চর্য হওয়া। একগাল হেসে বলল, “আমরা আমাদের মধ্যে কথা বলার সময় সাঙ্কেতিক ভাষায় কথা বলি, যাতে অন্য কেউ শুনতে পেলেও বুঝতে না পারে, আর যারা আমাদের বন্ধু হয়, তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় আমরা সহজেই তাদের মন পড়ে নিয়ে আমাদের ভাষা বোঝার পথ করে দিই। তুমি যেহেতু আমাদের বন্ধু তাই তোমাকে আমাদের কথা শুনতে দিতে বাধা নেই।”

মনা ভারি খুশি হল। এতদিনে দুপুরবেলা গল্প করার বন্ধু পাওয়া গেল। তুতুন ছাড়া আর কার সঙ্গেই বা সে কথা বলে! পাখিরা শুধু হাসে, শিস দেয়, জল খায়, তারপর উড়ে যায়। হাসিখুশি থাকে। কিন্তু কথা-টথা বিশেষ বলে না। খুব স্বাধীনচেতা। যেখানে খুশি উড়ে চলে যেতে পারে। পিঁপড়েদের মতো অত দলে দলে থাকে না। থাকলেও কেউ কেউ এমন ঝগড়া করে! যা হোক, বিস্কুটটা দিতে পেরে মনার মনটা আজ খুব ভালো হয়ে গেল।

“আজ না হোক কাল বিষ্টি আসবে।” পিঁপড়েটা বলল।

ওর নাম ভোলা। শুনে মনা আশ্চর্য হল, “এমনই নাম হয় তোমাদের?”

“না, তা ঠিক নয়। আসলে আমরা যেখানে থাকি সেরকম লোকেদের নামের মতোই নিজেদের নাম করে নিই, যাতে বন্ধুদের বুঝতে অসুবিধে না হয়। ধরো মাদ্রাজে যে পিঁপড়েরা আছে তাদের নাম কিন্তু আবার মুরুগন বা আন্না কিংবা মিনাম্মা আবার পাঞ্জাবে তাদের নাম মনপ্রীত, পরমজিৎ অথবা গুরদয়াল এরকম।”

মনা বেশ আশ্চর্য হল। এমন কথা জানা ছিল না। কেউই কি জানে? পিঁপড়েদের বন্ধুরা ছাড়া? মনে তো হয় না। বিকেল হয়ে আসছিল। পিঁপড়েদের সংখ্যাও কমে আসছে ওদের খাবার ভাণ্ডার নিশ্চয়ই পূর্ণ হয়ে এসেছে এতক্ষণে। মনার দেওয়া আধখানা বিস্কুটের সামান্য একটু গুঁড়ো পড়ে আছে। আর সাত-আটবার যাতায়াত করলেই ওটুকুও শেষ হয়ে যাবে। তুতুনের আসার সময় হয়ে গেল। আজ তুতুনকে পিঁপড়েদের বন্ধু হবার গল্পটা বলতে হবে। মনার আর তর সইছে না।

কলিং বেলটা বাজতেই মনা দৌড়ে ঘরের ভেতর চলে এল, দরজার সামনে এসে লাফালাফি আরম্ভ করে দিল। মা এসে দরজা খুলতেই পিঠে ব্যাগ নিয়ে মেরুন ফ্রক আর সাদা জামা পরা তুতুন ঝুঁটি দুলিয়ে এসে মনাকে কোলে তুলে নিয়ে পিঠে হাত বোলাতে লাগল। মনা মুখ উঁচিয়ে লেজ তুলে চুপটি করে তুতুনের কোলে শুয়ে রইল। মা একটু হেসে বলল, “কাঠবিড়ালি তো নয়, তুতুনের ছোটো বোন যেন!”

ছবি মৌসুমী

জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s