গল্প মিতুল আর কর্তাদাদুর পুতুলরা অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় শরৎ ২০১৭

অরিন্দমের আগের গল্প —ডোরা মারের ছবি

।।এক।।

কর্তাদাদুর ঘরে ঢুকতেই বড়ো আলনাটায় ঝুলিয়ে রাখা পুতুলগুলোর মধ্যে প্রথম সেই গালপাট্টাওয়ালা, উর্দিপরা পুতুলটা নড়ে উঠল, “ব-আদব ব-মুলায়েজা হোশিয়ার, আজবপুর-নরেশ, শাহনশাহকে শাহানশাহ…”

অমনি লালপাড় গরদ পরা বৌমণি পুতুলটার নথ নড়ে উঠল, “আহ্‌, থাম না বাপু, ও আমাদের মিতুল এয়েচে যে!”

রাজার পোষাক পরা পুতুলটা, যেটার একটা দিক নড়াচড়া করে না আজকাল, সেটা গম্ভীর গলায় মিতুলকে বলল, “তা এখন ইশকুলে না গিয়ে এখানে কেন হে হেতমপুর-নরেশ?”

মিতুল ঠোঁট উল্টে বলল, “মেলাতে একটা পুতুলনাচের দল এসেছে। আজকে প্রথম পালা ‘দাতা কর্ণের উপাখ্যান’। তারপর রাতে ‘আলিবাবা চল্লিশ চোর’।”

রাজার মুখ আরও গম্ভীর হল, “ডেকয়েটস! সমূলে বিনাশ করব দুর্বৃত্তদের।”

রানিমার হঠাৎ লম্বা শ্বাস পড়ল একটা, “সে দিন কি আর আসবে আমাদের!”

কর্তাদাদুর ঘরটা জুড়ে পুতুল, মুখোশ, বাজনা, ছবির ছড়াছড়ি। ঘরে ঢুকতেই একটা লম্বা আলনার মতো ফ্রেমে সারি সারি পুতুলেরা দাঁড়িয়ে। তার ঠিক পেছনে একটা বিশাল কালো পালিশ করা টেবিলে ঝুঁকে বসে সারাদিন বই পড়েন কর্তাদাদু। কিন্তু তাঁকে কখনও কথা বলতে শোনেনি মিতুল গত কয়েক মাসে। এদিকে দেয়ালে একটা হরিণের মাথা, একটা বাঘের মাথা টাঙানো থাকলেও বাকি জায়গাজুড়ে নানা মাপের, নানা দেশের মুখোশ, দোতারা, একতারা, আরও নানারকম তারের যন্ত্র, ছবিতে ভর্তি। নিতাই কাকা, যে নাকি বাড়িটার আর কর্তাদাদুর দেখাশোনা করে সে একদম মানা করে দিয়েছে ভাড়াটেরা কেউ যেন কর্তাদাদুর ঘরের ছায়াও মাড়াবার চেষ্টা না করে। তবুও দুপুরের দিকে ইশকুল থেকে টিফিনে ভাত খেতে এসে মিতুল একবার এখানটা চুপিচুপি ঘুরে যায়। কারণ, সে জানে এই সময়টা বামুনমাসি একতলায় রান্নাঘরে বসে ঝিমোয়, নয় ছাদে গিয়ে চুল শুকোয়। নিতাইকাকা ঠিক এই সময়টাতেই নিজের বাড়ি যায় ভাত খেতে। আর কর্তাদাদু টেবিলে ঝুঁকে বসে বসে আসলে ঝিমোয়। মিতুল অবশ্য কোনও জিনিসে হাত দেবার চেষ্টাও করে না। তবুও অন্যান্য দিন এখানে পা দিলেই মিতুলের মনে হয় জাদুর জগতে চলে এসেছে সে। ইশকুলে কখনও অঙ্ক না পারার কষ্ট, কখনও স্রেফ ভাতে ভাত খেয়ে ওঠার কষ্ট এগুলো তাকে আর তেমন স্পর্শ করে না তখন।

কিন্তু আজ রাজার অকেজো হাতের কথা মনে পড়াতে মিতুলেরও মনটা খারাপ করে এল, বৈশাখ মাসে যেমন হঠাৎ কালো হয়ে আসে আকাশ, গাছগুলো যেমন বেড়ালের মতো থম মেরে ওত পেতে থাকে ঠিক সময়ে ভর হওয়া গুণিনের মতো দুলতে শুরু করবে বলে।

কর্তাদাদুদের অবস্থা যে এককালে খুব ভালো ছিল তা এই ইট-সুরকির ইমারত, এই কড়ি-বরগাওয়ালা বাড়িটা দেখলেই বোঝা যায়। বাড়িটার মাঝখানে একটা বিশাল উঠোন, যার একদিকে ঠাকুরদালান, অন্যদিকে কাজের লোকেদের থাকার জায়গা। বাকি দুইদিকের একদিকটা বারমহল, যেখানে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে বাবা এই গ্রামে এসে উঠেছে। পাশাপাশি আরও ক’ঘর ভাড়াটে আছে। বাবা একটা ছোটো দোকান দিয়েছে দীঘিটার পাড়ে বড়ো রাস্তার ধারে। কষ্টেসৃষ্টে চলে যাচ্ছে তাদের।

পুতুলগুলো যে কথা বলে সেকথা ও মাকে একদিন বলবার চেষ্টা করেছিল। মা জিরে বাটতে বাটতেই এমনভাবে, “তাই বুঝি?” বলেই আবার বাটনা বাটতে লাগল, যে মিতুল ঠিক বুঝে গেল, যে একথা কেউ বিশ্বাস করবে না। কুছ পরোয়া নেই। তাতে বরং ভালোই হয়েছে। কর্তাদাদুর পুতুলেরা আর মিতুল নিজেদের মধ্যে অসংকোচে আলাপচারিতা চালিয়ে যায়।

।।দুই।।

ভরত কলা নিকেতনের প্রোঃ, নট-সম্রাট, বাদ্যবিশারদ (এগুলো সব সাইনবোর্ডে লেথা আছে) শ্রী সুদর্শন নায়েক ওরফে সুদর্শন ওস্তাদের বকবক করে মাথা ধরে যাচ্ছে ক’দিন। গ্রামের একটি বাচ্চা, নাম শ্রী গদাধর রক্ষিত, টাইম বে-টাইমে ইশকুল পালিয়ে মেলার তাঁবুতে এসে হাজির হচ্ছে। তার হাজার হাজার প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ওস্তাদের কাজকম্ম মাথায় উঠেছে। অবশ্য কুমোর, সার্কাসওয়ালা, ম্যাজিসিয়ান, পুতুলনাচওয়ালা বা যাত্রাপার্টির লোকেদের এরকম অভিজ্ঞতা হয়েই থাকে। কিন্তু সুদর্শন ওস্তাদ সবিস্ময়ে আবিষ্কার করলেন যে ছেলেটিকে তাঁর ভালোও লাগছে। কথা একটু বেশি বলে বটে, কিন্তু গল্প একবার শুনে মোটামুটি সুন্দর বলে যেতে পারে। দাতা কর্ণ, বেদেনি মলুয়া, শিব আর কুচনী… কোনও গল্পেই তার অরুচি নেই। তাছাড়া তার নিজের অনেক গল্পও আছে বলার। সে যেন এক পুতুলের দেশ থেকেই আসে প্রতিদিন, আজকাল ওস্তাদের এরকম মনে হয়।

তা অনেকদিন বাদে এমন মনোযোগী শ্রোতা পেয়ে দুই হাতে দস্তানার মতো দুটো পুতুল পরে নিয়ে সুদর্শন পুতুল নাচিয়ে দেখাতে থাকে, “এই দেখ, এটা হল গে তোমার বেনে পুতুল। আর বারে ইন্দাসে পালস পোলিও টীকার জন্য গান বেঁধেছিলাম, বলক-বাবুরা টাকাও দিয়েছিল।”

তাঁবুর ভেতরে বাঁশের তেকাঠায় টাঙানো আছে তারের পুতুল। এদের মাথায় আর হাতের তার দিয়ে নাড়ানো-চাড়ানো যায়। মাটির মাথা, কাঠের হাত। এদের পায়ের জায়গায় কাপড়ের লুঙ্গি বা শাড়ি। পালার জন্য এই পুতুলরা নাচে। ওস্তাদের ভাগনে আর ভাগনেবৌ পর্দার পেছনে দাঁড়িয়ে নাচায় সেইসব পুতুল। কখনও কখনও ওস্তাদও হাত লাগায়।

সুদর্শন ওস্তাদ আরও একরকমের পুতুলের গল্প শোনায়। ডাং পুতুল, সে নাকি আরও প্রাচীন, আরও এলাহি ব্যাপার। একটা পালা করতে যজ্ঞিবাড়ির মতো লোক লাগে। ওস্তাদ যখন মিতুলের মতো ছোটো ছিল, তখন সে ডাংয়ের পুতুলও নাকি বানাতে শিখেছিল। বড়ো ওস্তাদের কাছে।

এসব গল্পগাছা করতে করতে গদাধর রক্ষিত ঘুচে গিয়ে মিতুল নামটাও জানা হয়ে যায় ওস্তাদের। আর এসব গল্প গিয়ে কর্তাবাবুর পুতুলদের কাছে উগরে দেয় মিতুল, “জান, আজকে না… আচ্ছা, রাজা, একদিন তোমাকে ওস্তাদের কাছে নিয়ে যেতে পারি, যদি হাতটা সে ঠিক করে দেয়?”

রাজা সিরিয়াস মুখ করে বলেছে, “আচ্ছা, সে হবে’খন। আমার হাতি রঙ্গলালকে সাজিয়ে রাখতে বলি তবে।”

মিতুল দমে গেছিল। হাতি আবার কোথায়! রাজাও নিশ্চয়ই কর্তাদাদুর মতো বুড়ো হয়ে গিয়েছে আর ভুল বকছে, যেমন তার নিজের দাদু। ভগমানের কাছে চলে যাবার ক’দিন আগেও সকাল থেকে রোদের তাতে বসে থাকত আর মাঝে মাঝে নিজের মনেই বলে উঠত, “কচে বারো।” মা মুখ টিপে হাসত।

যাক গে, রাজা যদি হাতি ছাড়া এক পা না নড়ে, মিতুলের কিছু করার নেই। আর মিতুলের সাথে যাওয়া, সে ভারি মুশকিল। রাজার আলনা-ফ্রেম এত উঁচুতে, মিতুলের সাধ্য কি তাকে নামায়! তাছাড়া সিঁড়ি দিয়ে নেমে, উঠোন পার করে, বারমহলের রোয়াকের দরজা দিয়ে রাস্তায়। সে অনেকটা পথ। কারও চোখে পড়লে? বাবা যদি দেখে তাহলে তো ছাল ছাড়িয়ে নেবে। নাহ্‌, রাজার ডাক্তার দেখানো তার দ্বারা আর হল না। মেলার দিনগুলো একটার পর একটা পার হয়ে যেতে থাকে।

।।তিন।।

কিন্তু সুযোগ যে একদিন এভাবে এসে যাবে মিতুল ভাবতেও পারেনি। হলই বা মেলার শেষদিন।

সেদিন দুপুরে বাবা দোকানের মাল কিনতে শহরে গিয়েছে। বামুনমাসি সকালেই কর্তাদাদুর খাবার ঢাকা দিয়ে অক্ষয়দাদার জিম্মা করে গিয়েছে বিশালাক্ষী মন্দিরে পুজো দিতে। পাশেই তার সইয়ের ঘর। ফিরতে বিকেল পেরিয়ে যাবে। অক্ষয়দাদাও সুযোগ বুঝে দুপুরবেলায় খিড়কি দিকের বটতলায় তাস পিটতে লেগেছে।

মিতুল টিফিনের সময় বাড়ি এসেই দেখে, এই হচ্ছে সুবর্ণসুযোগ। সন্তর্পণে একটা মোড়া নিয়ে এসে তার ওপরে দাঁড়িয়ে রাজাকে নামায়। রাজা ফিসফিস করে বলে, “হচ্ছেটা কী দোস্ত?”

মিতুল ঠোঁটে আঙুল রেখে ফিসফিসিয়েই বলে, “চুপ, ডাক্তার। বলেছিলাম না!”

তারপর রাজাকে একটা গামছা দিয়ে ঢেকে পিঠের ওপর তোলে। আহা বেচারা, হাতিঘোড়া নেই, হাঁটারও অভ্যেস নেই, এই ভালো। তারপর নিজের একবুক গুমগুম শব্দ শুনতে শুনতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে, উঠোন পার করে, রোয়াক দিয়ে বেরিয়ে আস্তে আস্তে ফটক, তারপর পাকা রাস্তায় উঠেই এক ছুট।

গ্রামের ডাকপিওন মানিককাকা সাইকেলের ঘন্টি বাজিয়ে আসছিল। কিন্তু গামছায় মুখ-মাথা-পিঠ ঢাকা এক কুঁজো বুড়োর ব্যাপারে তার কোনও আগ্রহ না থাকায় মিতুল বেঁচে গেল।

।।চার।।

মেলা ভেঙে গিয়েছে। ব্যাপারীরা দোকানপাট তুলে, জিনিসপত্তর ট্রাঙ্কে, বাক্সয় পুরে ভ্যান-রিক্সার সাথে দরাদরি করছে। যাদের ভালো বিক্রি হয়েছে তারা কেউ কেউ মাটাডোর ভাড়া করে এনেছে।

সুদর্শন ওস্তাদ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁর সাধের পুতুলদের বাক্সবন্দী করছেন। ভাগনা-বৌ তিনটে ইঁটের উনুনে কী একটা রান্না করছে। আজ রাতের খাওয়া খেয়ে বিশ্রাম। পরেরদিন ভোরে বেরিয়ে পড়া আছে পরের মেলার মাঠে। মিতুলকে দেখে তার মুখে ঠিক হাসি ফুটে উঠল না। ওঠার কথাও না।

কিন্তু রাজাকে দেখামাত্র সুদর্শন নায়েকের যা মুখের ভাব হল, তা দেখে মিতুলের তো আক্কেলগুড়ুম।

“একে তুমি কোথায় পেলে মিতুলবাবু?”

“কেন, এই তো কর্তাবাবুর ঘরের পুতুল। শুধু হাতটা নাড়াতে পারে না বলে ঠিকঠাক রাজত্বি করতে পারছে না।”

“এই রাজা তোমার বন্ধু? তোমার সাথে কথা বলে?”

“হুঁ।”

সুদর্শন ওস্তাদ আর কিছু বলে না। কোনওমতে রাজার জামার সেলাই খুলে কাঁধ আর হাতের জোড়টা দেখিয়ে মিতুলকে বলল, “এইরকম রাজার চিকিত্সা স্রেফ দু’জন জানে এই তল্লাটে। বুঝলে? এক, এই আমি আর দু’নম্বর, যিনি এই রাজাকে তয়ের করেছেন।”

মিতুল খেয়াল করল, রাজার হাত কাঁধ থেকে ওপর-নিচ, ডাইনে বাঁয়ে, চারদিকেই ঘোরে। হাতে তরোয়ালটা থাকলে এতক্ষণে বোধহয় সবাইকে কচুকাটা করা শুরু করে দিত রাজা। স্রেফ নেই বলেই হয়তো মরা মাছের মতো চুপ করে থাকল।

বাঁধা-ছাঁদা দেখবার জন্য ওস্তাদের ডাক আসছে ঘন ঘন। কিন্তু ওস্তাদের সেদিকে আর মন নেই। পড়ে আসা দিনের আলোয় এক দরদি চিকিত্সক এক প্রাচীন রাজার পরিচর্যা করতে থাকলেন। কাঠের কাজ শেষ করে রাজার হাতের ঘোরানো নির্ভুল করা হল। নতুন রঙ, বার্নিশের প্রলেপ পড়ল মুখে। সেলাই পড়ল ছেঁড়া আচকানে। প্রাচীন তাজের নিচে কিছু নতুন চুলের টুকরো বসিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলেন একবার। তারপর একটা রাংতার তরবারি রাজার হাতে বসিয়ে দিয়ে ডান্ডাটি ধরে দাঁড়িয়ে পড়লেন নিজে।

মুগ্ধ মিতুল দেখল, রাজা খোলা তরোয়াল হাতে ছুটে যাচ্ছেন প্রান্তর থেকে প্রান্তর দস্যুদলের মোকাবিলা করতে। ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে এসেছে। বাড়ি বাড়ি শাঁখের আওয়াজও শোনা যাচ্ছে না আর। ওস্তাদের ভাগনা আর ভাগনাবৌয়ের মুখদুটিই শুধু বাইরের আঁধারের চেয়ে কালো মনে হল মিতুলের।

সুদর্শন ওস্তাদ বললেন, “চল মিতুলবাবু, এইবারে আরেকটি দরকারি কাজ সেরে আসি। ডাক্তারিটি করলুম, ভিজিট নিতে হবে না?”

মিতুল চিন্তায় পড়ে। পয়সার কথা তো সে ভাবেইনি। সর্দিকাশি হলে মা বাসকপাতা খাওয়ায়, পেট গড়বড় করলে গাঁদালপাতার ঝোল। বাবা তো প্রায়ই বলে, কথায় কথায় ডাক্তারের কাছে যাব, আমাদের কি সে পয়সা আছে?

ওস্তাদ হা হা করে হেসে বলে, “রাজার ডাক্তারির ফিস দেবে রাজার বাবা, যে রাজাকে বানিয়েছে। তুমি চিন্তা করছ কেন গো, মিতুলবাবু?”

।।পাঁচ।।

বাড়ির কাছাকাছি এসে তারা দেখে অনেক লোকের  জটলা। হাঁকডাক, লন্ঠন, লাঠিহাতে নিতাইকাকা, পোস্টমাস্টারবাবু, বাবা, আরও অনেক লোক, যাদের সবাইকে সেও চেনে না।

ফটক পেরিয়ে ভেতরে আসতেই শুকনো পাতার আওয়াজে এদিকে ফিরে তাকাল সবাই। আর তারপরেই বাবা দৌড়ে এসে আচ্ছা করে যেই দু-তিন ঘা দিয়েছে, অমনি মা এসে তাকে আড়াল করল কোনওমতে।

ততক্ষণে ওস্তাদ বাকিদের নিজের পরিচয় দিয়ে ফেলেছে। তার বিনীতভাব, গলার কন্ঠি এইসব দেখেই ভাগ্যে লোকে তাকেও পিটতে শুরু করেনি। ও মা, ওস্তাদ বলে কিনা, আমি বেণীবাবুর সাথে দেখা করব!

মিতুল তো থ। সে জানে বেণীবাবু মানে বেণীমাধব দে বিশ্বাস হচ্ছেন কর্তাবাবু। বাড়ির লোক, পাড়ার লোক, গ্রামের সকলের কর্তাবাবু। লোকটা বলে কী? তাছাড়া মিতুল ভাবে, কর্তাবাবু তো কোনও কথাই বলেন না। চেয়ারে অমনি ঝুঁকে বসেই থাকেন সারাদিন। কথাবার্তাটা হবে কীভাবে?”

“নিতাই, ওকে আসতে দাও।”

তিনতলা থেকে একটা গম্ভীর আওয়াজ এসে সব আলোচনা থামিয়ে দিল। মিতুল তো প্রায় মাটিতেই বসে পড়ে আর কি! বামুনমাসি আর অক্ষয়দাদা কর্তবাবুকে ধরে ধরে বারান্দায় নিয়ে এসেছে।

ভিড় নিমেষে ফর্সা। নিতাইকাকা সসম্ভ্রমে ওস্তাদকে তিনতলায় নিয়ে যাচ্ছে। মিতুলও সাথে যাবে বলে পা বাড়াতেই বাবা ক্যাঁক করে মিতুলের ঘেঁটি ধরেছে, “এই, তুই আবার কোথা চললি?”

ওস্তাদ বাবাকে জোড়হাতে বলল, “কর্তা, আজ ওরে আসতে দ্যান। ওর জন্যিই আমার গুরুদর্শন হল এতকাল পরে।”

।।ছয়।।

তেতলার ঘরের একশো ওয়াটের আলোয় রানিমা, সেপাই, পাত্র-মিত্র সবাই যেন চাপা উত্তেজনায় ছটফট করছে। মিতুলের দম আটকে আসছে। ওস্তাদ এসব কিছুকে আমল না দিয়ে রাজাকে তাদের আলনায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে সোজা কর্তাদাদুর পায়ের কাছে গিয়ে বসল। হাত ধরে টেনে বসাল মিতুলকেও।

“বড় পুন্যিমান ছেলেটি, কর্তা। এর জন্যি আপনি এখানে আছেন জানতে পারলাম।”

কর্তাদাদু একবার স্মিতহাস্যে দেখলেন মিতুলকে। তারপর বললেন, “ভালো আছ সুদর্শন? প্রায় পঞ্চাশ বছর বাদে দেখলাম তোমায়, কী বল?”

“তা হবে, কর্তা। প্রথম আপনাকে দেখি হাঁসখালিতে। তখন আমি দশ বছরেরটি। আপনার কাছে চার-পাঁচবছর, তারপর পনেরোতে দাশু অধিকারীর যাত্রার দলে। তারপর কতদিন কেটে গেল। এই আসছে ফাগুনে আমার ষাট পুরবে।”

মিতুলের দিকে তাকিয়ে বলে, “তখন কর্তাবাবু সা-জোয়ান। ঘোড়ায় চড়ে হাঁসখালি তালুকের আদায়পত্র দেখেন, কিন্ত দেশবিদেশের পুতুলের শখ। কিনে আনানো, নিজে বানানো… আমি ছোটটি তাঁর ফাই-ফরমাস খাটি, আবার পুতুলের বিদ্যের সাগরেদি করি। ওই সবদিক ঘোরানো হাতের কায়দা তো কর্তাবাবু নিজে মাথা খাটিয়ে বানালেন।”

“বুঝলেন কর্তা, আমি রাজাকে দেখেই চিনে ফেলেছি। এ আমার কর্তাবাবুর কাজ না হয়ে যায় না। সেই কাজ আপনার কাছেই শিখেছি। তাই বলি, এগবারটি গুরুদর্শন করে আসি। চলে এলাম, ছোঁড়ার পিছুপিছু।”

“খুব ভালো করেছ, সুদর্শন।”

“কর্তা, দাশু অধিকারীর যাত্রার দল ছেড়ে দিয়ে যখন নিজের পুতুল করলাম, একবার গেছিলাম হাঁসখালিতে। কিন্তু গাঁ-ঘর সব পাল্টে গিয়েছে। আপনার হদিশও কেউ দিতে পারলেনি।”

“পারবে কী করে? আমরা তো তালুকের স্বত্ত্ব বেচে দিয়ে নিজ মৌজা, এই হেতমপুরে চলে এসেছিলাম। তা দে বিশ্বাসদের এখন যা দেখছ, এইই বাকি আছে। তোমার দল কেমন চলছে তাই বল।”

“কর্তা, এসবের দিন গিয়েছে। তাও শীতের শুরুতে, চাষের কাজ শেষ হলি আমরা বেরিয়ে পড়ি মেলা থেকে মেলায়। ভাগনা আর ভাগনাবৌ তারের পুতলার নাচ দেয়, আমি দু’হাতের তিন আঙুলে ধরে দুটো বেনীপুতুলের হাতে তালি দিয়ে গান গেয়ে লোক ডাকি। ডাংপুতুল নিয়ে নাচ আর দেখাতে পারি নে। কোমর, হাঁটু জবাব দিয়েছে কর্তা । আর তিন-চারজনের ছোটো দলে সে নাচ হয়ও না ঠিক। আর দেখবেই বা কে? লোকে সন্ধে হলি আজকাল টিভি দ্যাখে, সিরিয়াল।”

“এ ছেলেটা কিন্তু খুব বাঁশ-বুদ্ধি আছে কর্তা, চটপট তুলে নেয়।”

কর্তাদাদু হেসে বলেন, “তাই দেখছি। আগ্রহও আছে। বেশ। ওরে ছোঁড়া, বামুনমাসিকে বল বেশি করে চাল নিতে, ও আজ এখানেই খাবে। তুইও এখানে খাবি, বুঝলি? তোর মাকে বলে আয়।”

রান্নাঘরে ব্যঞ্জনের সুগন্ধ উঠেছিল খুব। ফুর্তির চড়কগাছ হয়ে বেরোতে গিয়ে মিতুলের সাথে চোখাচোখি হল রাজার। মিতুল স্পষ্ট দেখল, রাজা চোখ মটকাল।

অলংকরণঃ জয়ন্ত বিশ্বাস

জয়ঢাকের গল্পঘর   

3 thoughts on “গল্প মিতুল আর কর্তাদাদুর পুতুলরা অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় শরৎ ২০১৭

  1. অসম্ভব সুন্দর একটি গল্প পড়লাম। মনে পড়ে গেল আমাদের আলমারিতে একটি চিনামাটির মেম পুতুল ছিল। তার বাজু থেকে বাকিটা চিনামাটির। কিন্তু উপরের অংশ কাপরের। আর কাঠের গূঁড়ো ঠাসা।হাত পা সব ঘোরানো যেত। পা দুটোও তাই। পুতুলটিকে বহু দিন আর দেখি নি। গল্পটা স্মৃতি ফিরিয়ে দিল। তোলপার করে খুজতে হবে আমার ঠাকুমার ওই অমূল্য পুতুলটিকে

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s