১
শীতকাল এলেই মনটা ভালো হয়ে যায় জগন্নাথবাবুর। ওঁর ঠাকুরদা জগমোহন বটব্যালের সেই কোন যুগের একটা সাদা পাথরের ছোটো বাটি আছে, সেই বাটিটাতে ছটাক খানেক বেশ ঝাঁঝওয়ালা ঘানি ভাঙা সর্ষের তেল সারা গায়ে ডলে ডলে মেখে, বাইরের বারান্দায় সকালের রোদে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে তারপর চান করতে ঢোকেন। চান করার জল ঠিক একচল্লিশ ডিগ্রি গরম হলেই মাথায় প্রথম মগ জলটা ঢালেন। এখনও ওসব অটোমেটিক চান মেশিনে উনি চান করেন না, তবে খবরটা সিক্রেট রাখাই বড়ো দায় ইদানীং। ওই চান করতে করতেই বাথরুমে গুনগুন করে দু-চার কলি গানও গেয়ে ফেলেন জগন্নাথবাবু মনটা ভালো রাখতে। এবারে অঘ্রাণ মাস পড়ে গেল, সর্ষের তেলের শেষ বোতলটা বেসমেন্টের আলমারি থেকে বের করে বাটিতে ঢালতে গিয়ে বুঝতে পারলেন, আর মাত্র কয়েক ফোঁটা তেল পড়ে আছে। কোনোরকমে আজকের চানটা হয়ে যাবে, কিন্তু কাল থেকে আর তেল থাকবে না।
সর্ষের তেল তৈরি পৃথিবীতে বন্ধ হয়ে গেছে তা প্রায় সত্তর বছর হয়ে গেল। শেষের দিকে তো লিটার পিছু প্রায় দেড় লক্ষ টাকা দাম হয়ে গেছিল। নেহাত জগমোহন বটব্যালের একটু বাগান করার শখ ছিল আর উনি ‘এক্স-সাত-দুই-ওয়াই’ গোত্রের নাগরিক ছিলেন বলেই আইসল্যান্ডের আন্তর্জাতিক উদ্ভিদ বিজ্ঞান সংস্থা ওঁকে পাঁচ বছরের জন্য দেড় বিঘা জমি খুব সস্তায় ভাড়া দিয়েছিল। জগমোহন বটব্যাল সেই জমিতে সারাবছর কন্ট্রোলড আবহাওয়ার সাহায্যে লাগাতার পাঁচ বছর সর্ষের চাষ করে নিজস্ব ল্যাবরেটরিতে এই সাকুল্যে একশো তিরিশ লিটার মতন তেল তৈরি করে জমিয়ে রাখতে পেরেছিলেন আজ থেকে প্রায় ষাট বছর আগে। সেই সমস্ত তেল অত্যন্ত গোপনে পিপে আর কাচের বোতলে মুখবন্ধ করে বসত বাড়ির আন্ডারগ্রাউন্ড চোরকুঠুরিতে লুকিয়ে রেখেছিলেন জগমোহনবাবু। তার থেকেই তো তাঁর বাকি জীবন ইলিশ মাছ বলে কোনও একটা মাছ ভাজা খাওয়া চলল। তাঁর ছেলে জনার্দন বটব্যাল যখন প্রায় প্রৌঢ় অবস্থায় তেলের কুঠুরির চাবি পেলেন তখন প্রায় সিকিভাগ তেল খরচা হয়ে গেছে। তা তিনিও ওই সন্ধেয় সামান্য মুড়ি ভাজা বলে কী একটা সাদা মতন মুচমুচে খাবারের সঙ্গে সর্ষের তেল মেখে খেয়ে তারপর আরও প্রায় তিরিশ বছর কাটিয়ে দিয়েছিলেন। তার এই এতকাল পরে জগন্নাথবাবু কর্তা হয়ে সামান্য একটু গায়ে মাখা, তাও শীতকালে, করে চালালেন আরও প্রায় বছর দশেক হবে। এখন আর ওসব মাছ বা মুড়ি কিছুই পাওয়া যায় না। অবশ্য কেউ কেউ চোরাগোপ্তাভাবে ধান-চাল ল্যাবরেটরিতে তৈরি করে থাকেন বলে মাঝে মাঝে খবর আসে।
জগন্নাথবাবু সেইসব মাছ বা মুড়ি খাবার জন্য তাঁর ঠাকুরদার রেখে যাওয়া দুর্লভ সর্ষের তেল তো খরচ করেননি কোনোদিন, কেবল ওই শীতকাল এলে গায়ে মাখার জন্য একটু একটু করে মাটির তলার ভাঁড়ার ঘর থেকে বার করে এতকাল চালিয়ে এসেছেন। কিন্তু এখন বুঝি সেই বিলাসিতাটুকুও ছাড়তে হবে। কথাটা ভাবতেই মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। অবশ্য তাঁর কয়েকজন প্রাক্তন সহকর্মী, বন্ধু, আত্মীয় যাদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে সৌরমণ্ডলের বাইরে ঘনিপুলুতিং গ্রহের পরীক্ষাগারে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে এবং তারা ছুটিছাটা ছাড়া পৃথিবীতে আসেই না, তারা নাকি কোত্থেকে জল-টল আর মাটি আমদানি করে সেখানে দিব্যি চাষবাস শুরু করেছে।
গতবছর পৃথিবীর শ্রাবণ মাসে হঠাৎ খুব কলমিশাক খেতে ইচ্ছে করেছিল জগন্নাথবাবুর একদিন; ছোটবেলার ইশকুলের বন্ধু হরিপদর সঙ্গে পৃথিবীর এক বিকেলে ডি-ও-টু-ও কম্যুনিকেশন পদ্ধতিতে যোগাযোগ করে একটু সুখদুঃখের গপ্পো করছিলেন। (ডায়রেক্ট অবজেক্ট টু অবজেক্ট কম্যুনিকেশন পদ্ধতিটা অবশ্য বেশিদিন চালু হয়নি, স্বয়ং জগন্নাথবাবু এই প্রজেক্টের একজন বৈজ্ঞানিক হিসেবে কাজ করেছেন কোম্পানিতে এতকাল। এই ব্যবস্থাতে মহাকাশে যেকোনও বস্তুর সঙ্গে যেকোনও বস্তুর যোগাযোগ ঘটানো খুবই সহজ, শুধু দুটির মধ্যেই ওই কোম্পানির তৈরি অত্যন্ত ছোটো মাইক্রো-চিপ বসিয়ে নিতে হবে)। তা হরিপদ কী করে যেন বুঝে গেল ছোটবেলার বন্ধু জগার কলমিশাক খাওয়ার ইচ্ছের কোথা। হতে পারে ঘনিপুলুতিং গ্রহে ডি-ও-টু-ও মেশিনটার প্রোগ্রামিংয়ে আরও নতুন কিছু ঢুকিয়েছে ওরা। পরেরদিন বিকেলে বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই তাঁর শরীরের মাইক্রো-চিপের সঙ্গে লাগানো স্ক্রিনে দেখলেন যে, একটা ক্যুরিয়ার রোবট যান একটা প্যাকে টনিয়ে এসেছে। তাকে বিদায় করে প্যাকেটটা খুলতেই আনন্দে কান্না এসেই গিয়েছিল প্রায় জগন্নাথবাবুর। নেহাত তাঁদের আগের প্রজন্ম থেকেই পৃথিবীতে মানুষ জন্মানোর পরেই মস্তিষ্কে লেজার রশ্মি প্রয়োগ করে দুঃখ, কষ্ট, কান্নার অনুভূতির কোষগুলোকে অ্যান্টি-স্পিন করিয়ে আনন্দ, উল্লাস আর হাসির কোষে পরিবর্তিত করে দেবার নিয়ম হয়েছে। জগন্নাথবাবুও তার ব্যতিক্রম নন, তাও সেদিন তাঁর একবার দুঃখ দুঃখ পেতে পেতে শেষপর্যন্ত পায়নি এই রক্ষা, নয়তো বিজ্ঞান মিথ্যে প্রমাণিত হত।
২
এবারের সর্ষের তেলের সমস্যাটা সত্যিই তাঁকে ভাবিয়ে তুলল। রোববার বিকেলের দিকে গ্যারেজ থেকে উড়ুক্কু বাক্সটা বের করে ভাবলেন একটু সমুদ্রের দিকে ঘুরে আসবেন। সবচেয়ে কাছের সমুদ্রতীর জগন্নাথবাবুর বাড়ি থেকে ছ’শো মাইলের একটু বেশিই হবে দূর, তবে এই পুরনো মডেলের উড়ুক্কু যানে যেতে বাইশ মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়। হাল ফ্যাশানের বাক্সগুলোয় এতটা রাস্তা যেতে খানিকটা কম সময় লাগে। তা ওই মিনিট দশেক সময় বেশি লাগলেও জগন্নাথ বটব্যাল পুরনো বাক্সটা আর বদলাননি। এটাতে বসবার গদিটা বেশি নরম আর সবচেয়ে বড়ো কথা হল বাক্সটার মগজ-কম্পিউটারের সঙ্গে তাঁর একটা বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। তাকে হারু নাম দিয়ে দিয়েছেন জগন্নাথবাবু। প্রথমদিন অন্যমনস্কভাবে বাক্সর চেয়ারে বসে আকাশে উড়তে উড়তে আপনমনে, ‘ও হারু, হারু-উ-উ, কেমন আছিস?’ বলে ফেলেছিলেন তিনি। সেই শুনেই কম্পিউটার বাবাজীবন স্পিকারে কী হাসি, কী হাসি! থতমত ভাবটা কাটিয়ে জগন্নাথবাবু জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কী, তোমার এত হাসির কী হল, অ্যাঁ?”
শুনে তার আবার হাসি। এবার আরও জোরে। শেষমেশ জগন্নাথবাবু গম্ভীর হয়েই বললেন, “আমাকে ছোটবেলায় ইশকুলে বন্ধুরা নাম দিয়েছিল হারু। সেই থেকে নিজে নিজে কথা বলার সময় আমি হারু বলে সেই একটা ছেলের সঙ্গে কথা বলি; তা তোমার যদি নামটা ভালো লেগে থাকে তবে কালকে নয় প্রোগ্রামিং বদলে ‘কে-ফোর-ডি’র জায়গায় হারুই করে দেব।”
কিছুক্ষণ পরে বাক্সর স্পিকার থেকে ভেসে আসে, “প্রোটোকল চেঞ্জড, নিউ লাইন অ্যাডেড, হা-রু, হা-রু।”
সেই থেকে উড়ুক্কু বাক্সটাকে আরও বেশি ভালোবেসে ফেলেছেন জগন্নাথ বটব্যাল।
৩
ভারুখুন্টির সমুদ্রসৈকতে আজ বড্ড ভিড়, চারদিকে থিকথিক করছে নতুন নতুন মডেলের সব উড়ুক্কু বাক্স। বেশ কিছুক্ষণ আকাশে চক্কর মেরে শেষে প্রায় মাইল তিনেক দূরে একটা পার্কিং লট খালি পেতেই ধীরে ধীরে সেইখানে নেমে পড়ল হারু। দরজা খোলার আগে হঠাৎ স্পিকারের ভেতর দিয়ে হারুর গলা ভেসে এল, “স্যার, আজ রাত্তিরে আমার চার্জিংয়ের ভোল্টেজটা চার দশমিক চার পয়েন্ট বাড়িয়ে দেবেন মনে করে।”
কোনোদিন হারুর মতন উড়ুক্কু বাক্সরা তাদের মালিকের কাছে কিছু চায় না, চাইতে পারেই না। প্রোগ্রামিংয়ে সেইরকম কিছু লেখা হয় না বলে। তাই হারুর মুখে একথা শুনে জগন্নাথবাবু যথেষ্ট অবাক হয়ে গেলেও মুখে কিছু বললেন না। ঘন্টা দেড়েক সি-বিচে হাঁটাহাঁটি করে আর অনেকদিন পর প্রতিবেশী বীরেশ চাটুজ্যের সঙ্গে আকস্মিকভাবে দেখা হবার পর গল্প-টল্প করে অনেকদিন পর মাথাটা একটু ফ্রেশ লাগতে শুরু করল। সন্ধের মুখে আবার হারুর কাছে এসে দরজা দিয়ে ভেতরের চেয়ারটায় বসে বেশ খুশি খুশি গলাতে বললেন, “এবার বাড়ি চলো, হারু।”
ফেরার পথে হারু পুরো চুপচাপ হয়ে নিখুঁতভাবে জগন্নাথবাবুর বাড়ির ছাদের পার্কিং গ্যারেজে ঢুকে বলল, “রাত্তিরে চার্জিংয়ের ভোল্টেজটা চার দশমিক চার পয়েন্ট বাড়ানোর কথাটা আরও একবার বলছি বলে রাগ করবেন না যেন স্যার।”
জগন্নাথবাবু হারুকে চার্জিং পয়েন্টে লাগিয়ে ওর কথামতোই ভোল্টেজ বাড়িয়ে দিয়ে নিচে নেমে গেলেন। মাথাটা যদিও আজ অনেকটা ফ্রেশ লাগছে সমুদ্রের তাজা হাওয়ায়, কিন্তু সর্ষের তেলের কথাটা বারবার মনে পড়তেই আবার খচখচ করে উঠছে। আজ রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়তে হবে, সেটা ঠিক করে সুদূর বিগতকালের একটা বাংলা গানের ফাইল খুলে চালিয়ে দিলেন সিস্টেমে। আজকাল আর বাংলা গান-টান পাওয়া যায় না, অনেক কষ্ট করে এই কয়েকটা ফাইল ওঁর দাদু জোগাড় করে রেখে দিয়েছিলেন বলে এখনও মাঝে মাঝে মন চঞ্চল থাকলে শোনেন জগন্নাথবাবু। অদ্ভুত ব্যাপার হল, এইগুলো শুনলে মন ভালো করার কিউবিকলসে না ঢুকলেও মিনিট পনেরোর মধ্যে কীরকম একটা শান্তি চলে আসে মনে। আর কাউকে না বললেও ল্যাবের সহকারী ও বন্ধু রজনী সাঁপুইকে কথাটা বলেছিলেন একদিন, তারপর রজনীও দু-চারদিন এসে শুনে গেছে তাঁর বাড়িতে কিছু গান।
গানটা শুনতে শুনতে জগন্নাথবাবু এক গ্লাস প্রোটিন সরবত খেতে থাকলেন। ঘরে গান বাজতে থাকল—
‘নীলের পরে শ্যামল সে দ্বীপ প্রবাল দিয়ে ঘেরা,
শৈল চূড়ায় নীড় বেঁধেছে সাগর-বিহঙ্গেরা…’
৪
সকালে ঘুম থেকে উঠতে অন্যদিনের চেয়ে একটু বেলাই হয়ে গেল জগন্নাথবাবুর। ওঠার পর মনটা খুব আনন্দ আনন্দ লাগছিল। একেকদিন এমন হয়। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে প্রাতরাশ খেতে বসে গেলেন। ল্যাবরেটরিতে আজ একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে, তারপর বিকেল তিনটেয় কনফারেন্স আছে হুটিনাডো স্পেস স্টেশনের বৈজ্ঞানিকদের সঙ্গে।
ছাদে গিয়ে হারুকে জাগিয়ে ভেতরে ঢুকে বসতেই ভেসে এল হারুর ধাতব স্বর, “সুপ্রভাত স্যার, শুভ জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই, দিনটা ভালো কাটুক আপনার।”
জগন্নাথবাবু ভুলেই গেছিলেন আজ, এই একুশে ফেব্রুয়ারি ওঁর জন্মদিন। হারু উড়ে গেল ছাদ থেকে ল্যাবের উদ্দেশ্যে। পায়ের দিকে নজর পড়তেই চোখে পড়ল একটা কাচের বয়াম, আর তাতে ভরা হলুদ রঙের কী একটা তরল। বয়ামটা হাতে নিতেই ফের হারুর স্পিকারে ভেসে এল, “কত নতুন মডেলের উড়ুক্কু বাক্স এসে গেছে স্টোরে, আমার চেয়েও জোরে যায় তারা। আমাকে তো বাতিল করেই দিতেন আপনি স্যার। তাই নিজের শেষটুকু দিয়ে আপনার জন্য জন্মদিনের উপহার বানিয়েছি, সর্ষের তেল। আগামীকাল থেকে আর উড়তে পারব না আমি, আজই আমাদের একসঙ্গে শেষবারের মতো আকাশে ওড়া।”
জগন্নাথবাবুর তখনই মনে হতে লাগল, ওঁর মস্তিষ্কের সবক’টা কান্নার কোষকে নিশ্চয়ই আজ থেকে ঠিক একান্ন বছর আগে উলটে দিতে ভুলে গেছিলেন নার্সিংহোমের ডাক্তার।
ছবিঃঅংশুমান
জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে