গল্প -ঝিল্লি শুভ্রা ভট্টাচার্য শীত ২০১৬

golpojhilli01মিনিট খানেক থেকেই দীপুর মনে হচ্ছে কে যেন ওর পিছু নিচ্ছে। পেছন ফিরে তাকালেই ঝট করে কোথাও লুকিয়ে পড়ছে। প্রথমটা মনে হচ্ছিল মনের ভুল বোধহয়। কিন্তু বারে বারে তো ভুল হতে পারে না। তাদের পাড়ার অলিগলি হলে এতক্ষণে ব্যাটা পালিয়ে বাঁচত না। কিন্তু এই কাঁচা-পাকা রাস্তায় প্রছুর গাছপালা আর রাস্তার দুই ধারে অনেক ছোটো বড়ো পাঁচিল। কেউ চাইলেই অনায়াসে যেখানে খুশি লুকিয়ে পড়তে পারে। ধরা মুস্কিল। ধুর, যাক গে যাক। কেউ যদি ভাবে দীপুকে ফলো করবে, তাতে তার কী? তার কাছে তো আর টাকাপয়সা নেই যে ছিনতাই করে পালাবে।

আবার দু’পা যেতে না যেতেই সেই পায়ের খসখস শব্দটা। আসলে গ্রামের রাস্তা জুড়ে এতো গাছের শুকনো পাতা পড়ে রয়েছে যে হাঁটলেই শব্দ হচ্ছে। আর ঠিক এই মুহূর্তে দুপুররোদে রাস্তায় কেউ কোত্থাও নেই। দিপুর নিজের চলার শব্দটাই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে না তো বারবার?

দিন তিনেক হল দীপুরা বেড়াতে এসেছে এই গ্রামে। দীপুরা বলতে দীপু, মা আর বাবা। এটা মায়ের মামাবাড়ি। সে ছোটোবেলায় কত গল্প শুনেছে এই গ্রামের, রাঙাদাদুর। এই প্রথম তার রাঙাদাদুর বাড়ি বেড়াতে আসা। গ্রামখানা ভারী পছন্দ হয়েছে তার। এখানে আসা অবধি রোজ দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর সে এই ঝিলের পাড়ে এসে বসে। কী সুন্দর হাওয়া এখানে! চারদিক খোলামেলা। ঝিলটার নামটা তার দারুণ পছন্দ হয়েছে, ‘ঝিল্লী’। ঝিল্লীর ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া এসে মনপ্রাণ জুড়িয়ে দেয়। শহরে এই মুক্ত বাতাস কোথায়? আর এই ভরদুপুর রোদেও ঝিল্লীর ধারে বসে থাকতে একটুও কষ্ট হয় না তার।

প্রতিদিনের মতো আজ দুপুরেও ভরপেট খেয়েদেয়ে সে ঝিল্লির ধারে হাওয়া খেতে এসেছিল। এখন বেলা গড়িয়ে বিকেল হবে হবে করছে। সূর্যের তেজ এখনও গনগনে। কিন্তু বাড়ি ফেরার জন্যে কয়েক পা হাঁটতেই সেই অতিরিক্ত জোড়াপায়ের শব্দ এবং যথারীতি কারও দেখা নেই। দীপু এবার মাধ্যমিক দিয়েছে। ছোট্ট খোকাটি নয় যে কেউ তাকে ভয় দেখিয়ে পার পাবে। যেইই পিছু নিক না কেন, সে তো আর পালাতে পারেনি। এইমুহূর্তে সে কোথাও আড়ালে লুকিয়ে তার ওপর নিশ্চয়ই নজর রাখছে। সে পেছন ঘুরলেই আবার পিছু নেবে। দীপু তাকে খুঁজে বের করবেই। আর একমিনিটও সময় নষ্ট না করে সে হনহনিয়ে এগিয়ে গেল বাড়িগুলোর দিকে। এপাশ ওপাশ ঘুরে ঘুরে খুঁজতে আরম্ভ করল। এখানেই আছে কোথাও, যাবে কোথায়? হঠাৎ দারুণ চমকে দিয়ে কে যেন এক ধাক্কা দিয়ে তাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে ছুটতে লাগল।

আচমকা ধাক্কা সামলাতে না পেরে পড়ে গিয়ে সে থতমত খেয়ে গেল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সে এক লাফে উঠে দাঁড়াল। ওই যে আততায়ী ছুটে চলেছে ঝিলের দিকে। ওকে যে করেই হোক ধরতেই হবে। প্রায় প্রতিবছরই স্কুল স্পোর্টসে একশো মিটার, দুশো মিটারের দৌড় কম্পিটিশনে দীপুর ফার্স্ট অথবা সেকেন্ড প্রাইজ বাঁধা। যাকে সে ধরার জন্যে ধাওয়া করেছে তার পরনে হাল্কা হলুদ মলিন ফ্রক, আর মাথার দুই বিনুনি দুলে দুলে যেন হাওয়ার সাথে কথা বলছে। মেয়েটা তার চেয়েও জোরে ছুটছে। মেয়েটা অনেকখানি রাস্তা ছুটতে ছুটতে মাঠঘাট পেরিয়ে একটা শ্মশানে এসে পড়ল। নাছোড়বান্দা দীপু তাকে শেষমেশ ধরেই ছাড়ল। সে মেয়েটার হাত ধরে বেশ শক্ত করে মুচড়ে দিতে মেয়েটা কঁকিয়ে উঠল যন্ত্রণায়। বেশ ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করল, “তুমি আমার পিছু নিচ্ছিলে কেন হে? সাহস তো কম নয় তোমার! আমাকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দেওয়া!”

মেয়েটা কোনও জবাব দিল না। নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। দীপু আবার জোরে ধমকে উঠল। মেয়েটা হকচকিয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে। ওর চোখে মুখে ভয় ফুটে উঠেছে। গায়ের ময়লা জামাটার অনেক জায়গায় তাপ্পি দিয়ে জোড়া। বিনুনিতে আবার লালরঙের ফিতে বাঁধা হয়েছে। সে হাতটা খুব টানা-হ্যাঁচড়া করছে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্যে। এরকম মুখ বিকৃত করছে কেন? কামড়ে-টামড়ে দেবে না তো আবার! দীপুই বরং হাতটা ছেড়ে দিল। হাত ছাড়তেই মেয়েটা আবার ছুট লাগাল উল্টোপথে। ওর ছুটে চলার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই মেয়েটা ঝোপঝাড়ের মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেল।

অচেনা জায়গা, তাই বাড়ি ফিরতে একটু বেশিই দেরি হয়ে গেল। একটানা ছুটে তারা অনেকখানি দূরে চলে গেছিল। হাঁপিয়ে ওঠা শরীরটাকে বাড়ি পর্যন্ত বয়ে আনতে বেশ বেগ পেতে হল তার। আর যথারীতি বাড়ি ফিরে মায়ের একরাশ প্রশ্নের উত্তর দিতে হল। সন্ধে হয়ে যাওয়ায় খুব স্বাভাবিকই বাড়িতে সবাই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছিল। বাবা যথেষ্ট বকাঝকা করলেন। অজানা অচেনা জায়গায় যদি সে হারিয়ে যেত, তখন? বাবা মা এখনও তাকে ছোটো ভাবেন। অভিমানের সুরে সে বলল, “অচেনা জায়গা তো কী হল? আমি কি অচেনা জায়গায় নতুন স্কুলে ভর্তি হব না? আর কতদিন তোমরা আমাকে বাচ্চা ছেলে ভেবে এমন বকাবকি করবে বলতে পার?”

রাঙাদিদা দীপুকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে মান ভাঙালেন। বললেন, “কী জানো তো দাদুভাই, এটা তো গগনপুর গ্রাম, তোমাদের শহর নয়। আর এই গ্রামে সন্ধের পর কেউ বিশেষ বাড়ির বাইরে থাকে না। আর তুমি তো এখানকার রাস্তাঘাট তেমন চেনই না। সেইজন্যেই আমরা খুব চিন্তা করছিলাম। তুমি যদি ঘুরতে ঘুরতে বেশি দূরে কোথাও চলে যাও আর তারপর অন্ধকারে রাস্তা চিনে ফিরতে না পার তখন আমরা এই দুটো বুড়ো তোমাকে কোথায় খুঁজব বল তো দিকি?”

সারা সন্ধেটা নানারকম হাসিঠাট্টা করে কাটল। দুপুরে ঝিলের ধারের ব্যাপারটা দীপু বেমালুম চেপে গেল। তারপর রাতে দিদার হাতে বানানো খাবার খেয়ে অনেক রাত পর্যন্ত বাপ-ব্যাটাতে মিলে ছাদে পায়চারি করল। আর সঙ্গে বিভুমামার হাড় হিম করা ভৌতিক কাহিনি তো আছেই। মামার মুখে ভূতুড়ে গল্পগুলো একমনে শুনতে শুনতে তার তো গায়ের রোম খাড়া হয়ে ওঠে। বাবা হেসে বলেন, “বিভু, তুমি পারও বটে এতো গল্প বানাতে।”

“গল্প নয় দাদা, একদম সত্যি ঘটনা। চোখে না দেখলে বিশ্বাস হওয়ার জো নেই জানি আমি।”

তবু বাবার বিশ্বাস হয় না। গ্রামের লোকেরা নাকি এমন আষাঢ়ে গল্প আকছার বানাতে পারে। যদিও দীপুর মনেই হয় না যে মামা এমন বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলছেন। সবক’টা গল্প যেন ঘটনা হয়ে চোখের সামনে ফুটে ওঠে তার।

রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল সে। দেখল, সে ছুটে চলেছে সবুজ খেতের মাঝ বরাবর। দু’পাশে দোলা দিচ্ছে হলুদরঙের সর্ষেফুল। দীপু অনুভব করতে পারছে সেই সর্ষের কোমল স্পর্শ। এমন সময় কোথা থেকে যেন হলুদ ফ্রক পরা একটা মেয়ে তার কালো রঙের কোঁকড়ানো চুলের লম্বা দু’খানি বেণী দুলিয়ে এসে দাঁড়াল তার সামনে। তার পরনের জামাটা খুব পরিচ্ছন্ন নয়, আর নানা জায়গায় অন্য কাপড়ের তালি দিয়ে জোড়া। সে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে দীপুর দিকে। যেন মনে হল ও কিছু বলতে চায়। ওর দিকে দু’পা এগোতেই হঠাৎ সে প্রচণ্ড জোরে ঠেলা মেরে দীপুকে ফেলে দিয়ে ছুটতে আরম্ভ করল। দীপু চিৎকার করে বলতে চাইল ‘যেও না যেও না’, কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরুল না। কে যেন তাকে পেছন থেকে জাপটে ধরে আছে আর সে প্রাণপণ চেয়েও হাত পা নাড়াতে পারছে না। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুমটা ভেঙে গেল। জানালা দিয়ে ঘরে রোদ এসে পড়েছে। দীপুর হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কী ভয়ানক স্বপ্ন!

বাকিদের সঙ্গে জলখাবারে লুচি আর আলুর দম খেয়ে সে চলল বিভুমামার সঙ্গে ছিপ নিয়ে মাছ ধরতে। রাঙাদাদুদের একটা পুকুর আছে পাশের গ্রামে। রোজ সকালে সেই পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরে জেলেরা দিয়ে যায় দাদুর বাড়ি। আজ সেই পুকুরেই বিভুমামা কীভাবে ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে হয় শেখাবে তাকে। দীপু আগে কখনও মাছ ধরা দেখেনি। ছিপ দিয়ে মাছ ধরা দেখবে, এ তার বহুদিনের সাধ। পুকুরপাড়ে বসে মামা শেখাতে লাগলেন কীভাবে মাছের চার বানাতে হয়। তারপর কীভাবে কেঁচোর চার গেঁথে ছিপ ফেলে মাছের টোপ গেলার অপেক্ষায় বসে থাকতে হয় চুপচাপ। খানিক পরেও যখন মাছের দেখা পাওয়া গেল না, সে ছটফট করে উঠল।

“ও মামা, আর কতক্ষণ এরকম পাথরের মতো বসে থাকতে হবে? মাছ কই?”

“সসসসস, শব্দ করলে মাছ একদম কাছে আসবে না। তুই চুপচাপ মুখে আঙুল দিয়ে বোস, তারপর দেখ না কী হয়।”

আরও কয়েক মিনিট পেরিয়ে গেল তবুও মাছ টোপ গেলে না। ঠিক এমন সময় ছিপের তারে টান পড়ল। একটা মাছ নিশ্চয়ই টোপ গিলেছে। দীপুর আনন্দ তখন দেখে কে! সে গোল গোল চোখ করে দেখতে লাগল যে মামা কেমন মাছটা খেলিয়ে খেলিয়ে কাছে টেনে আনছে। মাছটা কাছে আসতেই মামা এক ঝটকা টান মেরে মাছটা তুলে আনল ডাঙায়। আরিব্বাস, কী পেল্লায় সাইজের একখানা কাতলামাছ! দু’জনের মুখের হাসি আর ধরে না। মাছটা প্রবল ঝটপটাচ্ছে। কিন্তু মাছটার গলায় কী যেন একটা জড়িয়ে রয়েছে মনে হচ্ছে।

“দেখো তো মামা, মাছটার গলায় কী যেন একটা জড়িয়ে-টড়িয়ে আছে মনে হচ্ছে।”

 “তাই তো দেখছি রে। দাঁড়া, উল্টে দেখি, তাইলেই বোঝা যাবে ভালোমতো।”

মামা মাছটা উল্টে দিতেই ভালোমতো বোঝা গেল গলায় লালরঙের কিছু একটা পেঁচিয়ে রয়েছে। মামা গলা থেকে সেটা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, “এই দেখ ভাগনা, তুই সাপ ভেবে ভয় পাচ্ছিস নাকি? এটা তো একটা লাল ফিতে।”

দীপুর মনে হল যেন ওর কানের খুব কাছ দিয়ে শোঁ শোঁ শব্দ করে কিছু উড়ে গেল।

সেদিন দুপুরে জমিয়ে খাওয়াদাওয়া হল। দুপুরে খেয়েদেয়ে উঠে একটু শীত শীত করছিল। তাই সে ছাদে এসে দাঁড়াল। ফেব্রুয়ারি মাস প্রায় শেষ হতে চলল। দুপুরে রোদটা তাই এখনও বেশ ভালো লাগে। যদিও বেশিক্ষণ রোদে দাঁড়ালে কুলকুল করে ঘামতে হবে। আজ আর ঝিল্লীর ধারে যেতে মন চাইছে না। কাল থেকে পর পর ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বাড়িতে কাউকে জানানো হয়নি। একটা বাচ্চা মেয়ে, হয়তো দীপুরই বয়সী, কাল ওকে পাগলের মতো দৌড় পাড়াল। সে নয় হল, কিন্তু তারপর রাতে সে কী বিচ্ছিরি স্বপ্নটাই না দেখল। আর আজকে মাছের গলার লাল ফিতেটা? এটাও কি নিছক কাকতালীয়? মামা যখন মাছের গলা থেকে লালরঙের রিবনটা খুলে তার চোখের সামনে ধরল, গলাটা যেন এক নিমেষে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছিল।

golpojhilli02যদিও রোদের তেজের জন্যে ঘরের ভেতরটা এখনও বেশ গরম, তাও সে একটা চাদর গায়ে দিয়ে শুলো। কিছুক্ষণ পরেই চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই ঝিলের পাড়, লাল কাঁচা রাস্তা, একটা হলুদ জামা পড়া মেয়ে। মেয়েটা তার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। তার শান্ত নিষ্পাপ চোখের দিকে তাকিয়ে কেন বারে বারে মনে হচ্ছে যে ও যেন কিছু বলতে চাইছে। এমন সময়ই হঠাৎ আবার প্রবল একটা ধাক্কা। মেয়েটা ছুটে চলেছে হলদে ফ্রক উড়িয়ে। দীপু আবার চিৎকার করতে পারছে না। কে যেন তার হাত-পাগুলো শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে। আর, আর গলায় কে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে দিচ্ছে একটা লাল ফিতে। সে শ্বাস নিতে পারছে না। দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে। লালরঙের ফিতেটা পাকে পাকে জড়িয়ে চেপে ধরছে তার শ্বাসনালীটা।

দীপুর চোখের পাতাদু’টো খুব ভারি হয়ে উঠেছে। চোখ খুলতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার। সেই সঙ্গে সারা গায়ে খুব ব্যাথা। কয়েকটা গুনগুন শব্দ সে শুনতে পাচ্ছে শুধু। অনেক কষ্টে ধীরে ধীরে চোখ মেলল সে। মা সস্নেহে হাত রাখলেন তার কপালে। আহ্‌, মায়ের হাতটা কী ঠাণ্ডা।

“কী রে, এখন কেমন লাগছে?”

বিভুমামার গলার আওয়াজ শুনে অনেক কষ্টে সে বলল, “মাথায় খুব ব্যাথা।”

আর সে তাকিয়ে থাকতে পারছে না। চোখদু’টো বড্ড জ্বালা করছে। তার মানে জ্বর এসেছে। এখন কত জ্বর কে জানে! কিন্তু জ্বরটা কীভাবে এল? হঠাৎ মনে পড়ল যে সে দুপুরে খেয়েদেয়ে চাদর গায়ে চড়িয়ে শুয়েছিল। তারপর… তারপর কীসব যেন দেখছিল ঘুমের মধ্যে। সেই স্বপ্নটা, সেই মেয়েটাকে সে রোজ দেখছে ঘুমের ঘোরে। আর তারপরই একটা কী যেন তার গলায় পেঁচিয়ে গেল আর একজন তাকে টানতে টানতে নিয়ে চলল। দীপু বাধা দিতে পারছিল না। কারণ, গলায় ফিতেটা খুব শক্ত হয়ে এঁটে বসছিল আর সে নিঃশ্বাস নিতেই পারছিল না। সেই অদৃশ্য শক্তি তাকে টানতে টানতে নিয়ে চলল একটা মাঠের মধ্যে দিয়ে, মাঠ পেরিয়ে শ্মশানের ভেতর দিয়ে। অনেকটা পথ গিয়ে অবশেষে থামল। তার বাঁধন খোলা হল। একটা কুঁড়েঘর। দীপুর মনে হল ঘরটার ভেতর থেকে যেন কতকগুলো গোঙানির শব্দ ভেসে আসছে। গোটা বাড়িটা হেলে পড়েছে অথচ কাঠের দরজাটা খুব মজবুত। তায় আবার বাইরে থেকে একটা হুক দিয়ে বন্ধ। সে দ্রুত হাতে দরজা খুলে সজোরে পাল্লা ঠেলে ঘরে ঢুকল।

ঘরের পেল্লায় পেন্ডুলাম ঘড়িটা ঢং ঢং করে ন’টার ঘণ্টা বাজাল। রাঙাদিদা রাতের খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। যত্ন করে দীপুকে খাইয়ে দিলেন। এখন জ্বরটা কিছুটা কম। ভাগ্যিস বাবা সঙ্গে করে কিছু মেডিসিন নিয়ে এসেছেন। নয়তো যে তল্লাটে কোবরেজি আর হেকিমি দাপটের ঠ্যালায় হোমিওপ্যাথিরও আকাল দশা সেখানে অ্যালোপ্যাথির চিন্তা, হরি! হরি! দীপুর পাছে আবার জ্বর আসে সেই ভয়ে মা খুব চ্যাঁচামেচি শুরু করে দিয়েছেন যে কালই কলকাতায় ফিরবেন। অতঃ কিম? ব্যাগ গোছগাছ চলছে জোরকদমে। দীপু ধীর পায়ে উঠে এল খাট থেকে। মামার ঘরে গিয়ে দেখল, মামা তখন আগামীকাল দীপুদের সঙ্গে করে কী কী দিয়ে দেবেন সেসব গুছিয়ে বেঁধেছেঁদে দিচ্ছেন।

“তোমার সঙ্গে আমার একটু জরুরি কথা ছিল মামা।”

এমন সময় এ ঘরে ভাগ্নেকে একদমই আশা করেননি বিভুমামা। তাই বেশ অবাক হলেন। দীপু মামাকে ঝিল্লীর ধারে ঘটা সমস্ত কথা জানাল; স্বপ্নে দেখা ঘটনাগুলোও বাদ দিল না। মামা সব শুনে খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন। এসব ঘটনা তাঁকে আগেই জানানো উচিত ছিল বলে দীপুকে মৃদু তিরস্কারও করলেন।

“সব শুনেও তুমি চুপ করে থাকবে মামা? আমাদের কি কিছুই করার নেই?”

“এসব তো তোর মনের ভুলও হতে পারে দীপু। তুই কি একটা কথাও প্রমাণ করতে পারবি?”

“প্রমাণ তো কিছুই নেই মামা। কিন্তু আমরা পুলিশের কাছে এগুলো সবিস্তারে বলতে তো পারি অন্তত।”

“পুলিশ? পুলিশ আমাদের কথা বিশ্বাসই করবে না, ধুস। কোনও প্রমাণ ছাড়া পুলিশ আমাদের কোনও সাহায্যই করবে না।”

কিছুক্ষণ দু’জনেই মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইল।

“আচ্ছা মামা, তুমি আমার কথাগুলো বিশ্বাস করেছ তো? নাকি তুমিও ভাবছ যে আমি ভুলভাল বকছি?”

মামা মৃদু হেসে সম্মতি জানালেন। “কেননা, তোর স্বপ্নে দেখা রাস্তাগুলো মিলিয়ে দেখলে আমাদের ঝিল পেরিয়ে গেরুয়া মাঠ আর তার পরের শ্মশানের সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে, জানিস? আমাদের গ্রামের সাথে অনেক প্রেতাত্মার গল্প জড়িয়ে রয়েছে। যুগ যুগ ধরে সেসব গল্প কত লোকের মুখে শুনে আসছে গ্রামবাসীরা। কিন্তু তুই যে অবিশ্বাস্য ঘটনা শোনালি, যদি সত্যিই ঘটে থাকে তবে তো তা আমার শোনা সব গল্পকে ছাপিয়ে যায় রে।”

অনেক কষ্টে পুলিশকে রাজি করানো গেছে। রাত এগারোটার সময় দু’টো মাতালের মুখে ভূতের গল্প শুনে থানার দারোগার তো মেজাজ টঙে।

“চ্যাংড়ামি পায়া হ্যায়? ইতনে রাতকো হামকো উল্লু বানাতা হ্যায়! উও আত্মা-ফাত্মা কুছ নেহি হোতা। স্রেফ বুরবক লোগোঁকি বকওয়াস।”

হাঁ জী, না জী করে শেষমেশ রা-জী দিলেন বটে, তবে ওই নিমরাজি। চুক্তি হল, শ্মশানের মাঠে যথা সময়ে ফোর্স নিয়ে চলে যাবেন। দিপু আর বিভুমামা খুব সন্তর্পণে সেই কুঁড়েবাড়িটা খুঁজে বের করল। কস্মিনকালেও কেউ শ্মশানপাড়ের এইসব পোড়ো জীর্ণ কুটীরের খোঁজখবর রাখে না। রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে বাড়িটা প্রথমে ঠাওরই করা যাচ্ছিল না। মামা চার ব্যাটারির টর্চটা অনেক বলে কয়ে দারোগার থেকে ম্যানেজ করেছে। একটু কাছে যেতে বোঝা গেল বাড়ির ভেতরে অনেকে আছে। চাপা গলার আওয়াজ আর তার সাথে কিছু গোঙানির শব্দও শোনা যাচ্ছে।

“ভেতরে যে কী চলছে বাইরে থেকে কিছুই বোঝার উপায় নেই গো মামা।”

এদিকে রাত আরও গাঢ় হচ্ছে, অথচ পুলিশের পাত্তা নেই। দরজার ফাঁক দিয়ে আলো জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ভেতরে কতজন আছে অথবা তারা সশস্ত্র কি না তার কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

এমন সময় ভট ভট শব্দ তুলে একটা মোটর সাইকেল এসে দাঁড়াল ঘরটার সামনে। দু’জন লোক নামল সাথে একটা বেশ বড়সড় বস্তা নিয়ে মনে হল। ঠিক এমন সময়েই ঘরের দরজাটা খুলে গেল। এবার ঘরের আলোয় বেশ করে দেখা গেল চারটে লোককে। ঠিক সেই মুহূর্তেই দীপুর মাথায় প্রচণ্ড জেদ চেপে গেল। সে তীরবেগে মামার হাত থেকে টর্চটা ছোঁ মেরে নিয়ে এক লাফে বাড়িটার সামনে এসে দেয়ালের আড়ালে দাঁড়াল। ঝুপ করে একটা শব্দ হল। যে লোকটা দরজার মুখেই পেছন করে দাঁড়িয়ে ছিল সে-ই সবার আগে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেল। কী হয়েছে দেখতে গিয়ে আরেকটা লোক তাকে ধরে তুলতে যেতেই দীপুর হাতের টর্চের ঘা এই লোকটারও কপালের মাঝ বরাবর আছড়ে পড়ল। দুই সাথীকে দরজার মুখে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে বাকিরা হকচকিয়ে গেল। ঘটনাটা এতো জলদি ঘটে গেল যে তাড়াতাড়িতে হাতের মস্ত বস্তাটাও নামাতে তারা ভুলে গেছিল। সেই সুযোগে মামা ভাগ্নেতে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওদের ওপর। ঘরের ভেতরে হুটোপাটি আরম্ভ হয়ে গেল। একজন পকেট থেকে একটা চাকু বের করার চেষ্টা করতেই তার হাতে পুলিশের গুলি এসে লাগল। বাকি পুলিশেরা এসে গ্রেপ্তার করল সবক’টা গুণ্ডাকে।

শ্মশানের মাঠে ওদের দেখতে না পেয়ে দারোগাসাহেবের সন্দেহ হয়। তাই খুঁজতে খুঁজতে এসে দেখেন এই কাণ্ড। ঘরের ভেতর তাকিয়ে পুলিশের চোখ কপালে। সেখানে হাতমুখ বাঁধা অবস্থায় অচৈতন্য হয়ে পড়ে রয়েছে সাত থেকে আটটা কিশোর কিশোরী। তাদের বয়স মোটামুটি বারো থেকে ষোলোর মধ্যে। দরজার সামনেই পড়েছিল সেই মোটর সাইকেল বাহিনীর নিয়ে আসা বড়ো ভারি বস্তাটা। সেটার মুখ খুলতেই বিশ্রী পচা গন্ধে সবার গা গুলিয়ে উঠল। বস্তা থেকে বেরুল একটি বাচ্চা ছেলের মৃতদেহ। বাকি বাচ্চাগুলোকে একে একে উদ্ধার করা হল। কিছুদিনের মধ্যেই এই কিডনি পাচারকারীদের পুরো গ্যাঙটা ধরা পড়ল।

দীপুর জ্বরটা কিছুতেই নামতে চাইছিল না বলে তাকে তড়িঘড়ি কলকাতায় আনা হল। হোম ফিজিশিয়ান ডক্টর রাজীব নিয়োগী জানালেন, প্যারাসমনিয়া ডিসঅর্ডারের কারণে ভুলভাল স্বপ্ন দেখা, স্বপ্নে ভয়ানক কিছু দেখে আতঙ্কে জ্বর এসে যাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি ঘটছে। অতএব এখন বেশ কিছুদিন তার বিশ্রামের প্রয়োজন। ভালো খাওয়াদাওয়া, মন ভালো রাখার জন্যে যা যা করণীয় তার লিস্ট বানিয়ে দিলেন।

দিন পনেরো সেবা শুশ্রূষা আর নিয়মিত ওষুধ সেবনের পর দীপুর শরীর এখন অনেকটাই ভালো। মাস খানেক পর সে আবার আগের মতো বন্ধুদের সাথে হৈ হৈ করে মাঠে ফুটবল খেলতে যাওয়ার পারমিশান পেয়ে গেল। উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট খুব ভালো হয়েছে। বাড়িতে সবাই খুব খুশি। বাবা খুশি হয়ে তাকে নতুন ল্যাপটপ কিনে দিলেন।

মাস দুয়েক বাদে একটা ঘটনা ঘটল। ঝিল্লীর জল থেকে দুর্গন্ধ ছড়াতে আরম্ভ করল। গগনপুর পঞ্চায়েত থেকে নির্দেশ দেওয়া হল ঝিল্লীর সমস্ত জল তুলে সংশোধন করার। সেইমতো এক বিকেলে ঝিল্লীর জলে বড়ো বড়ো জাল ফেলা হল। জালে জড়িয়ে উঠে এল দু’টো বড়ো বড়ো বস্তা। বস্তাদু’টো থেকে বেরুল দু’টো পচা গলা কঙ্কাল। তাদের একটির গায়ে জড়ানো একটুকরো হলুদ কাপড়। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় স্পষ্ট দেখা গেল সেটার গলায় ফাঁসের মতো জড়িয়ে আছে একটা লালরঙের চুলের রিবন।

ছবিঃ মৌসুমী

 জয়ঢাকের গল্প ঘর

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s