ছড়ার পাতা শোনো! শোনো! শোনো! রোয়াল্ড ডাহ্‌ল কৌশিক ভট্টাচার্য শীত ২০১৮

কৌশিক ভট্টাচার্য  র সমস্ত ছড়া একত্রে

শোনো! শোনো! শোনো!

(Roald Dahl-এর লেখা Attention Please! Attention Please! অবলম্বনে। এটি আক্ষরিক অনুবাদ নয়।) 

কৌশিক ভট্টাচার্য

শোনো, শোনো মন দিয়ে, শোনো! শোনো! শোনো!
কান যেন খাড়া থাকে, কথা নয় কোনো!
এক মনে শুনে চল, না হেঁচে, না কেশে
আনমনা যদি হও, পস্তাবে শেষে।
বোর হয়ে যদি আজ ঘুমে পড় ঢুলে
বলব যা, কোনো দিন যাও যদি ভুলে
কত কী যে হতে পারে আমরা তো জানি,
জান নিয়ে, প্রাণ নিয়ে দড়ি-টানাটানি!
বিশ্বাস হল না তো, পেল জোর হাসি?
ভেবেছো “বিপদে আমি কখনো কি ফাঁসি?
হো-হো-হো-হো, হি-হি-হি-হি, কক্ষনো নয়!”
হলো হাসি? বলি তবে, শোনো কী কী হয়!
হেদুয়ার আশেপাশে কখনো কি থেকেছ? 
যদি থাকো, মধুলিকা চাকীকে কি দেখেছ?
ক্লাস ওয়ানেতে পড়ে, নিবেদিতা স্কুলেতে
চোখা মুখ, মাথা ভরা ঝাঁকড়ানো চুলেতে,
ছোটোখাটো চেহারাটা, রোগাপানা, প্যাংলা,
সব তার ভালো,  শুধু লোভি বড় — হ্যাংলা! 
গরমের ছুটিতে সে চড়ে রেলগাড়িতে
ফালাকাটা চলে গেল ঠাকুমার বাড়িতে।
মা ও বাবা দিয়ে এল, থাকবে না সাথেতে
দুজনেই ব্যস্ত যে,  কত কাজ হাতেতে!
মধুলিকা পুরো ছুটি  ফালাকাটা থাকবে
একা, তাই ঠামি তাকে সাবধানে রাখবে।
মস্তিতে দিন যাবে ঠাকুমার বাসাতে
বাবা নেই, আরও নেই ঘ্যানঘ্যানে মা সাথে,
খুব খুশি মধুলিকা, মন শুধু আহারে
এটা খায়, সেটা খায়, সব খায় যা পারে।
দ্বিতীয় দিনটি এলো, ঠামি যেন বিপাকে —
দুপুরে খাওয়ার পরে বলে মধুলিকাকে,
“বুড়ি হলে হাঁটাচলা বড় বেশি সাজা রে,
তবু যাই, দেখে আসি, মেলে কী কী বাজারে।”
চুপিচুপি বলি শোনো, ঠামি যাবে যেখানে
একসাথে জড়ো হয়ে পাঁচ বুড়ি সেখানে
সিরিয়াল দেখে বসে, আর করে গল্প
কার বৌ কত বাজে, গুণে কত অল্প,
ছোট মুখে চোপা করে, মুখে বড় শব্দ।
দিন ছিলো ভালো আগে, কিলে হতো জব্দ।
ধরো তুমি মার দিলে, ধরো দিলে শাসিয়ে
মামলাতে তোমাকেই দেবে ওরা ফাঁসিয়ে
জড়ো হয়ে রোজ তাই প্যাঁচ কষে বুড়িরা
কারণে বা অকারণে ভোগে যাতে ছুঁড়িরা।
ঠামি তো উধাও হল, বাড়ি থেকে বাইরে
মধুলিকা বসে ভাবে আরো কী কী খাই রে!
একা কিনা, পেট তাই ফের কথা কয়েছে!
ভাবে, দেখি,খুঁজে দেখি, খাদ্য কী রয়েছে!
এই ভেবে যেই না সে আলমারি খুলেছে
টস টস জিভে জল, লোভে সব ভুলেছে!
শিশি ভরা কী কী সব? টফি নাকি মিষ্টি? 
লালরঙা, নীল রঙা — অপরূপ সৃষ্টি —
কোনোটা সবুজ পারা, কোনোটা বা বাদামি,
“সব খাবো এক্ষুনি, ফেলে রাখা গাধামি।
বড়োরা তো আজেবাজে বলে যায় কত কী!
‘লোভে পাপ’ মনে রাখা — জরুরি  সে অত কী?”
মধুলিকা ভাবে, “আজ  কে আমাকে  রুখবে?  
হি! হি! হি! হি! একে একে সব পেটে ঢুকবে!”
একটা সে চেটে খেল, জিভে দাঁতে জড়িয়ে
আহা, আহা, কী যে ভালো! মন দিল ভরিয়ে!
ব্যাস! সেই খাওয়া শুরু! খাচ্ছে তো খাচ্ছে!
দশ, বিশ, ত্রিশখানা — সব পেটে যাচ্ছে।
মধুলিকা খেয়ে চলে, নেই কোনো ক্লান্তি
“আঃ, এটা শেষ নাকি? এইবারে শান্তি!”
শান্তি কী? শোনো, শোনো, উঠেছে সে দাঁড়িয়ে
মনে হলো কেউ যেন দিলো তাকে নাড়িয়ে।
মাথা ঘোরে ঝিম ঝিম, ভারী ভারী লাগছে।
পেটে যেন নড়েচড়ে কোনো কিছু জাগছে।  
মধুলিকা চেয়েছিল শুধু পেট ভরাতে 
বলেনি তো কেউ তাকে কী যে আছে বরাতে!
কেউ তো বলে নি তাকে ঠামির এই বাড়িতে
হাজারো ওষুধ রাখা বড় আলমারিতে
জানে না সে ঠামি কেন শীর্ণ ও খিন্ন!
কেন জানো? ছিলো তাঁর কোষ্ঠকাঠিন্য।
বড় বড় বয়ামেরা যত ছিল  তাকেতে,
যত  শিশি বোতলেরা খাঁজে খাঁজে, ফাঁকেতে  
ঝকঝকে, তকতকে, ঝড়তি ও পরতি —
সব ছিলো কড়া কড়া জোলাপেতে  ভর্তি।
ছোটো ছোটো বোমা তারা —  লাফিয়ে ও ঝাঁপিয়ে 
অন্ত্রতে ঢুকে দিত ঠামিকেও কাঁপিয়ে
সবচেয়ে গোদা বোমা — বোতলেতে পোরা সে
পরমাণু বোমা সেটা — চকোলেটে মোড়া সে
চেয়ে সেটা দেখলেও পেট ভরে বায়ুতে
সাড়া জাগে অন্ত্রতে, সাড়া জাগে পায়ুতে।
পেটে এসে নিমেষে সে শোরগোল লাগাবে
দেহ থেকে যত পটি ঘাড় ধরে ভাগাবে।
কোষ্ঠ না সাফ হলে সাত দিবারাত্র
খেত ঠামি একবার, আধখানা মাত্র !
সেই ডোজে পেটে যদি হাড়মাস জাগবে
এতগুলো খেলে বলো, কী’রকম লাগবে?  
পেট যেন নড়েচড়ে গুড়গুড় আওয়াজে
জঙ্গলে বাঘ যেন গান গায় রেওয়াজে
আগ্নেয়গিরি জাগে পায়ু ফুঁড়ে দাপটে
সাঁই সাঁই ঝোড়ো হাওয়া ভাঙে ঘর ঝাপটে।
গতিবেগ কত সেটা কেবা আর মাপছে?
গুম গুম শব্দতে ফালাকাটা কাঁপছে।
ধুলোঝড়ে, পথে যারা, সক্কলে অন্ধ,
পড়শিরা কান চেপে, ভয়ে কথা বন্ধ
ঠোকাঠুকি সকলেরই দন্তের পাটিতে
মেঝে কাঁপে, ঘর কাঁপে — ধ্বসে পড়ে মাটিতে।  
মধুলিকা ঘেমে ভাবে এরপরে হবে কী?
বোমা হয়ে ফেটে পেট শরীরেতে রবে কি? 
দুপুর ফুরিয়ে আসে, বেলা যায় গড়িয়ে
ঠামি আসে অবশেষে, দেঁতো হাসি ছড়িয়ে 
সমবেত শাশুড়িরা প্ল্যান যা যা করেছে
বৌ-গুলো জানে কি যে এবারেতে মরেছে!
ব্যাঁকা হেসে যেই ঠামি ঠ্যাং ঘরে রেখেছে
ওষুধের বাক্সটা পায়ে তার ঠেকেছে।
“একি, এটা খালি কেন? সব গেছে ফুরিয়ে?
দিনেতে ডাকাতি নাকি? নাকি স্রেফ চুরি এ?”
পারছে না মধুলিকা জোরে কথা কইতে,
নাড়িভুঁড়ি পেটে যেন চাইছে না রইতে  
থেমে থেমে বলে, “পেটে এত ব্যথা করছে 
হাড়-মাস সব, ঠামি,  ফেটে যেন ঝরছে!” 
ঠাকুমা বলেন, “দেখি, এদিকেতে তাকা রে!
তাই বলি, বাক্সটা ফাঁকা কেন আকারে?
ওষুধের গোলা যত সব পেটে ভরেছিস?
একটাও নেই বাকি? তুই, বেটি, মরেছিস!”
তক্ষুনি ফোনে শুরু ঠাকুমার বকুনি,
“হাসপাতালেতে যাব, গাড়ি চাই এখুনি।
চণ্ডীতলার মোড়ে, কানাগলি ছাড়িয়ে
বাঁদিকেতে জোড়া বুড়ো বটগাছ দাঁড়িয়ে
আরো ক-পা হেঁটে বেনেপুকুরের পাড়েতে  
নীল-সাদা কোঠাবাড়ি রাস্তার ধারেতে
দেয়ালে দাগানো আছে নম্বর — দু’শ ছয়। 
না, না, না, না, এক্ষুনি! দেরি নয়! দেরি নয়!”
পেটে নল, পিঠে নল, সারাদেহে জড়ানো।
করিডোরে, কেবিনেতে কেমিক্যাল ছড়ানো।
আ হা হা, বোলো না “আর শুনব না, চললাম!”
হাসপাতালের কথা — নাই বা সে বললাম।
বলছি না ডাক্তারে আর কী কী করল।
“মধুলিকা শেষাশেষি বাঁচল না মরল?”
সেটাই আসল কথা! রুদ্ধশ্বাসেতে
সক্কলে জড়ো তার বিছানার পাশেতে
ডাক্তার ও নার্সেরা ঘিরে তাকে দাঁড়িয়ে
পারবে কি? পারবে কি? দিতে ওকে সারিয়ে?
“গেলো! গেলো! ঐ গেলো!” বলে তারা চেঁচিয়ে
“গ্যাঁজলা উঠেছে ওই দাঁতমুখ খেঁচিয়ে!
সর্ষের ফুল চোখে এইবারে ভাসবে।
পটল তোলার পালা দু মিনিটে আসবে!”
“তাই নাকি? বটে! বটে!” মধুলিকা ভাবল
অক্ষিপটল তার একটু কি কাঁপল?
চোখ টিপে — মিছে কথা নয় একরত্তি
বললো সে, “মনে হয় বেঁচে যাব সত্যি!”
বেঁচে গেল মধুলিকা, ফিরে এল বাড়িতে,
প্রথমে ঠামির কাছে, তারপরে গাড়িতে
ফালাকাটা থেকে ক্রমে দক্ষিণবঙ্গে
অবশেষে হেদুয়াতে — মা-বাবার সঙ্গে।
আরে, আরে, ভেবেছো কী? শেষ হল গল্প?
শোনো, শোনো, শেষ নয়, ঝামেলা কি অল্প?
বিষ যদি এত বেশি দেহে কারো ঢুকবে
রক্তের কণিকারা কী করে তা রুখবে?
মধুলিকা বেচারির ভাগ্যটা মন্দ
জোলাপেরা দেহে তার খুঁড়ে খানাখন্দ
মিশে গেল কোষে-কোষে, মাংসে ও হাড়েতে,
মগজেতে, হাতে-পায়ে, পেটে-পিঠে-ঘাড়েতে
ক্রোমোসোমে এঁটে থাকা অণুগুলো খুলিয়ে
মধুলিকা বেচারির জিন দিলো ঘুলিয়ে।
সেই থেকে, জানো কী তা? দিনে সাত ঘন্টা
জোর করে — ভালো যদি না-ও লাগে মনটা —
বসে থাকে মধুলিকা, বসে থাকে ভাইরে
সেইখানে, ভালো নাম যার “বড় বাইরে”।
মনে রেখো — মধুলিকা — এখনো সে ভুগছে,
দিনে সে সতেরবার টয়লেটে ঢুকছে।
টিভি নেই, খেলা নেই, দিনগুলো নষ্ট
ভেবে দ্যাখো, বেচারির কতখানি কষ্ট!
তাই বলি — ঠাট্টা না — কথা দাও তাহলে
খাবে না অজানা কিছু মা-বাবা-কে না বলে!

জয়ঢাকের ছড়া লাইব্রেরি

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s