টাইম মেশিন এক রাজপুরুষের গল্প মৌসুমী রায় বর্ষা ২০১৯

চিলিমিলি সাহেব– এক রাজপুরুষের গল্প

মৌসুমী রায়

ইংরেজরা আমাদের প্রায় দুশো বছর ধরে পদানত করে রেখেছিল। স্বাধীনতা পেতে আমাদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, আর অনেককিছুর বিনিময়ে আমরা আজ স্বাধীন দেশের মানুষ।
কিন্তু ভারতের মতন বিচিত্র দেশে নানা জাতি, নানা মতের মধ্যে এক শাসন কায়েম করা প্রবল সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের পক্ষে খুব সহজ ছিল না। তাদের কত জায়গায় কতরকমের নীতি নিতে হয়েছিল। অধিকাংশই কঠোর দমননীতি, অধিকাংশই তাদের হিসেব করা সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। তার মধ্যে কিছু কিছু ব্যাপার আজ এতদিন পরে ভাবতে বসলে মনে হয় আখেরে ভালোই হয়েছে। যেমন সতীদাহ প্রথা। হয়ত ইংরেজ শাসকের সমর্থন না পেলে তা উচ্ছেদ করা সহজ হত না।
আজ একজন রাজপুরুষের কথা বলতে বসেছি, যিনি সাম্রাজ্যবাদী হলেও কিছু সময় ধরে কিছু মানুষকে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা দিয়েছিলেন। তার নাম অগাস্টাস ক্লীভল্যান্ড। ক্লীভল্যান্ডকে আদিম জনজাতি সাঁওরিয়া পাহাড়িয়ারা ‘চিলিমিলি সাহেব’ নামে জানত।
সতেরো শতকের শেষের দিকের কথা। তখন ইংরেজরা সবে পলাশীর যুদ্ধ জিতে চারদিকে লুটপাট চালাচ্ছে, সঙ্গে নানা ফিকির করছে কীভাবে আরও জায়গা দখল করা যায়, কীভাবে খাজনা বাড়িয়ে নিজেদের ভাণ্ডার উপচানো যায়। সেই সময়ে সাঁওরিয়া পাহাড়িয়ারা আজকের ঝাড়খণ্ডের উত্তর-পূর্বদিকে রাজমহল পাহাড় এলাকায় বসবাস করত। সেখানে তখন গভীর অরণ্য। আর যেকোনও অরণ্যবাসী জনজাতির মতন তারাও অরণ্যের উপর নির্ভরশীল ছিল। অথবা বলা যেতে পারে তারা অরণ্যের সঙ্গে মিলেমিশে থাকত, যেভাবে মায়ের সঙ্গে থাকে তার সন্তান। তারা কদাচিৎ জঙ্গল থেকে বেরোত। জাতি হিসাবে ছিল তেজী ও স্বাধীনচেতা।
পাহাড়ের তলায় বাস করত যারা, তাদের মধ্যে ছিল জমিদার। এইসব জমিদারেরা (বর্ণ-হিন্দু ও মুসলমান) মুঘল আমলের পড়ন্ত বেলার একেকটি নৃশংস প্রতিভূ ছিল। এরা নিজের নিজের এলাকায় সর্বশক্তিমান ঈশ্বরতুল্য ছিল। সাধারণ কৃষক, নানা কায়িক পেশার সঙ্গে যুক্ত সাধারণ মানুষ ও আদিবাসীদের রক্ত চুষেই এদের বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল। পাহাড়িয়া সাঁওরিয়ারা মাঝেমাঝেই সমতলে এসে এসব জমিদারি এলাকায় লুটপাট করে যেত। তার জন্য তাদের উপর সমতলবাসীদের ছিল রাগ।
এমন সময়ে ভাগলপুর ও রাজমহল জেলার কালেক্টর হয়ে এলেন অগাস্টাস ক্লীভল্যান্ড। কিছুদিন কাজ করার পরে এলাকার সাঁওরিয়া পাহাড়িয়াদের উপরে তার নজর গেল। খুব কাছে থেকে এদের জানবার জন্য অরণ্যের গভীরে এদের বসতি এলাকায় ঘোরাঘুরি করতে শুরু করে দিলেন। উদ্দেশ্য, এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা আনা আর সাঁওরিয়াদের মতন দুর্দান্ত প্রকৃতির মানুষদের বশ মানিয়ে একটা ধনুর্ধর বাহিনী তৈরি করা, যাদের ইংরেজরা তাদের ঔপনিবেশিক দখলদারির কাজে লাগাতে পারে।
কিন্তু সাঁওরিয়াদের মধ্যে নিয়মিত যেতে যেতে আর তাদের সঙ্গে গভীরভাবে মেলামেশার সুবাদে এই তরুণ রাজপুরুষটি তাদের কাছের মানুষ হয়ে গেছিলেন। ক্লীভল্যান্ডকে এর জন্য কাউকে মারধোর করতে হয়নি, কোনও রক্তপাত ঘটাতে হয়নি। স্রেফ সহানুভূতি আর সম্মান দিয়ে এই আদিম ও দুর্দান্ত অরণ্যচারীদের তিনি হয়ে উঠেছিলেন কাছের মানুষ ‘চিলিমিলি সাহেব’। কোনও রক্ষী বা অস্ত্র ছাড়াই তিনি তাদের বসতি এলাকায় যেতেন, তাদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন। যেটা সে যুগের পক্ষে একটা বিরল ঘটনা। আজও দেশের এই আদি ভূমিপুত্র বা আদিবাসীদের সম্পর্কে আমরা বেশিরভাগ ভারতবাসীই খুব নীচু ধারণা নিয়ে থাকি। ওরা আদিম, ওদের গায়ের রঙ কালো, ওরা সবসময়ে মদ খেয়ে শুধু নাচগান করে, ওরা সরল বলে ওদের ঠকানো খুব সোজা আর ওদের মেয়েরা খুব সহজলভ্য। অথচ আজ থেকে প্রায় সোয়া দু’শো বছর আগে এক সাদা চামড়ার শাসক ওদের সঙ্গে সমানে সমানে মিশতেন, তাদের প্রাপ্য সম্মান দিয়ে তাদের নিয়ে কাজ করতেন, একথা ভাবলে খুব অবাক লাগে না?
ক্লীভল্যান্ড কী করেছিলেন সাঁওরিয়াদের জন্য?
তিনি তাদের চাষবাস শিখিয়েছিলেন। বিনামূল্যে গম ও বার্লির বীজ বিতরণ করেছিলেন। তাদের কৃষিজাত জিনিস বেচবার জন্য পাহাড়ের নিচে বাজার বসিয়েছিলেন। বাকি সমতলবাসীর আতঙ্ক সাঁওরিয়ারা সেখানে নিয়মিত আসত তাদের ফসল ও অরণ্যজাত জিনিস যেমন মধু, চামড়া, পশুমাংস ও হস্তশিল্প বিক্রি করতে। চাষবাসের জন্য কর মুকুব করে দিয়েছিলেন। এমনকি সমতলের জমিদাররাও তাদের কোনও কর বসাতে পারত না। এই কর জিনিসটাই আমাদের দেশের আদিবাসীদের চিরকাল বিভ্রান্ত করে এসেছে। তারা প্রকৃতির সন্তান, প্রকৃতিকে ততটুকুই ব্যবহার করে যতটুকু তাদের আজকের জন্য প্রয়োজন। বাকি মানুষরা প্রকৃতিকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যবহার করে, শোষণ করে, নষ্ট করে ফেলে। আদিবাসীরা তা করে না। আর এই সামান্য ব্যবহারের জন্যে কর দেওয়া? বছরে বছরে কর বাড়ানো? মানুষ খেতে পাচ্ছে না যখন, তখনও তাকে জমিদারকে বা রাজাকে কর দিতে হবে – আদিবাসীরা ধনতন্ত্রের এই যুক্তিটাই কখনও মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। তাই আমাদের দেশের ইতিহাস ঘাঁটলে অজস্র আদিবাসী বিদ্রোহের কাহিনী শোনা যাবে।
ক্লীভল্যান্ড সাহেবের সাফল্যের মূলে ছিল সাঁওরিয়াদের জন্য তাঁর অনেক ব্যক্তিগত উদ্যোগ। তিনি তাদের সঙ্গে শিকার করতে যেতেন, শতাধিক মানুষকে বসিয়ে ভোজন করাতেন, আর তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতন মিশতে পারতেন। এমনকি তিনি এদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, প্রধানদের নানা কাজে উৎসাহ দেবার জন্য মাসিক জলপানি বা স্টাইপেন্ডের প্রচলন করেছিলেন। এই সমস্ত করে ক্লীভল্যান্ড অদম্য স্বাধীনচেতা সাঁওরিয়াদের উপরে বিনা রক্তপাতে একটা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর নীতি উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল। আবার সাঁওরিয়া পাহাড়িয়াদের কাছেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন কাছের মানুষ। তারা এখনও তাদের ‘চিলিমিলি সাহেব’কে মনে করে।

এই স্বতন্ত্র রাজপুরুষের মৃত্যু হয় হঠাৎ করে মাত্র ২৯ বছর বয়সে (১৩ই জানুয়ারি, ১৭৮৪ সালে)। তাঁর নামে ভাগলপুরে রয়েছে ‘ক্লীভল্যান্ড হাউস’। সেখানে দুটি স্মৃতিমন্দির রয়েছে তাঁর নামে। একটি তৈরি করেছিল বৃটিশরা, আর অন্যটি সেখানে গড়ে দেয় স্থানীয় সাঁওরিয়ারা, তাদের চিলিমিলি সাহেবকে ভালোবেসে তাঁর স্মৃতিতে। সঙ্গে সেই স্মৃতিমন্দিরের একটি অসামান্য চিত্রণ দেয়া হল। ছবিটি এঁকেছিলেন চারলস ও’ডয়লি।

কলকাতায় সাউথ পার্ক স্ট্রিট কবরখানায় তাঁর সমাধির গায়ে রয়েছে ওয়ারেন হেস্টিংসের লেখা।
ক্লীভল্যান্ডের মৃত্যুর পরে সাঁওরিয়া পাহাড়িয়াদের নিয়ে ভাববার মতন আপনজন কেউ আর ছিল না। তাই ধীরে ধীরে সবকিছুর অবসান হয়। জমিদাররা আদিবাসীদের জমি গ্রাস করতে থাকে। জমিদার, মহাজন ও সমতলবাসীদের অত্যাচার, অবহেলা ও শোষণ বাড়তেই থাকে। তার সঙ্গে যুক্ত হয় ইংরেজদের কঠোর শাসন ও কর-ভার। সাঁওরিয়ারা পালিয়ে যায় অরণ্যের আরও গভীরে। তাদের জন্য ভাববার জন্য আজ অবধি কেউ আর আসেনি।

আমার একটি ব্যক্তিগত ধারণা হল যে বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’-এ রাজা দোবরু পান্না ও তার সম্প্রদায়ের যে বিবরণ দেওয়া হয়েছে, তারা বোধহয় এই সাঁওরিয়া পাহাড়িয়া জনজাতির মানুষ। আরণ্যকের পটভূমি পূর্ণিয়া জেলার অরণ্য। গঙ্গার দক্ষিণে ভাগলপুর আর উত্তরে পূর্ণিয়া। পূর্বে রাজমহল পাহাড় আর সান্তাল পরগণা। সেই অরণ্য আর নেই। কিন্তু সাঁওরিয়া পাহাড়িয়ারা আজও আছে। পিছিয়ে পড়া আদিম ও বিপন্ন জনজাতি হিসাবে। বিদেশি শাসকদের চাইতে দেশি মানুষরা তাদের বেশি শোষণ ও ঘৃণা করেছে। ঝাড়খণ্ডের আর সব আদিবাসীদের মতন এরাও কেউ কেউ যুগ-যুগের বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে হাতে বন্দুক তুলে মাওবাদীদের দলে নাম লিখিয়েছিল। সরকারের অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের শামিল হলেও কতটা তাদের পরিবর্তন হয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। একবছর আগে তাদের মধ্যে একজন জনি ফ্রাঙ্ক পাহাড়িয়া ফাইটার পাইলটের ট্রেনিং নিয়ে সরকারি পাইলটের লাইসেন্স পেল (ফেব্রুয়ারি, ২০১৮)।

জয়ঢাকের টাইম মেশিন সব লেখা একত্রে

2 thoughts on “টাইম মেশিন এক রাজপুরুষের গল্প মৌসুমী রায় বর্ষা ২০১৯

    1. আপনি কি মোবাইলে পড়ছেন? তাহলে মোবাইলটার ওরিয়েন্টশান চওড়া করে নিলে সাইজ বেড়ে যাবে। আঙুল দিয়ে পর্ঙুদায় টানলে অক্ষরের আকারও বেড়ে উঠবে। ডেস্কটপে পড়লে কন্ট্রোল + টিপে ধরলেই অক্ষর বড়ো হয়ে উঠবে।

      Like

Leave a comment