টাইম মেশিন নিউগেট ক্যালেন্ডার-গসেলিন অনুঃ ইন্দ্রশেখর শরৎ ২০১৮

নিউগেট ক্যালেন্ডার আগের পর্বগুলো

সার গসেলিন ডেনভিল

চোরডাকাতের মধ্যে অনেকেরই বুকে দুর্দম সাহস থাকে। কিন্তু তাই বলে দেশের রাজাকে রাস্তায় ধরে ডাকাতি? উঁহু। ইতিহাসে তার বেশি উদাহরণ নেই। ব্যতিক্রম সার গসেলিন ডেনভিল। এবারে তাঁর গল্প।

ইয়র্কশায়ারের উত্তরদিকে একটা ছোটো গঞ্জ শহর ছিল। তার নাম নর্থ অ্যালেরটন। এই শহরের এক সম্মানিত রইসের ঘরে গসেলিনের জন্ম। তার পরিবারের ঐতিহ্য বেশ পুরোনো। স্বয়ং রাজা উইলিয়াম দ্য কংকারারের সঙ্গী হয়ে তাদের সে-দেশে আসা। রাজা তাদের উত্তর ইংল্যাণ্ডে প্রচুর ভু-সম্পত্তিও দান করেছিলেন। তাই নিয়ে ভারী সুখেশান্তিতে তারা অনেক পুরুষ ধরে বসবাস করে আসছিল। কিন্তু তাতে ছেদ পড়ল গসেলিনের সময়ে এসে।

গসেলিনের বাবা ছেলেকে মানুষ করবার জন্য কম চেষ্টা করেননি। তাকে কেমব্রিজের পিটার্স কলেজে পড়াতে পাঠিয়েছিলেন অনেক খরচ-খর্চা করে। সেখানে গিয়ে শুরুর দিকে গসেলিন বেজায় মন দিয়ে পড়াশোনার সাধনা শুরু করে দেয়। তবে সে ছিল কেবল তার বাবার চোখে ধুলো দেবার কায়দা। হলও ঠিক তাই। ছেলের রকম দেখে বাবা বেজায় খুশি। ঠিক করলেন, এমন যার পড়াশোনায় মন তাকে  পাদ্রি হলেই মানাবে ভালো। সে ভারী পবিত্র জীবন।

শুনে ছেলে এক কথায় রাজি। বাবাও তখন ভাবলেন, আহা, এরপর তো খালি ভগবানের নামটাম করেই জীবন কাটাবে, এখন খানিক নয় কম বয়সে আনন্দফূর্তি করে নিক। এই ভেবে বাবা তাকে দুহাতে টাকাপয়সা দিতে শুরু করলেন।

এইটেই ছিল গসেলিনের আসল মতলব। বাবার অতুল ঐশ্বর্যের নাগাল পাওয়া। সেই উদ্দেশ্যেই তার অত পড়াশোনার ছল। এরপর থেকে বাবা তাকে বিশ্বাস করে টাকাপয়সা দেয়, আর সে তাই নিয়ে  খারাপ কাজকর্মে দুহাতে তা উড়িয়ে দেয়।    

এ-সব খবর তো আর চাপা থাকে না বেশিদিন! গসেলিনের বাবাও একদিন ঠিক খবর পেয়ে গেলেন ছেলে তাঁর ভারী খারাপ মানুষ হয়ে গেছে। তাঁর দেয়া টাকাপয়সা হাতে পেয়ে সে রাজ্যের দুষ্কর্ম করে বেড়াচ্ছে তাই নিয়ে। শুনে তিনি তো দুঃখে কিছুদিন বাদে মারাই গেলেন।

এইবার আর গসেলিনকে পায় কে! বাবার সব সম্পত্তি তার হাতে এসেছে। তার আয় বছরে বারোশ পাউন্ড। যে সময়ের কথা বলছি তখন সে-টাকা ছোটোখাটো রাজার সম্পত্তির সমান।

সেই নিয়ে দুহাতে টাকা উড়িয়ে এবারে ফূর্তির বান ডাকল গসেলিনের জীবনে। রাজদরবারে সেলামি দিয়ে সে নিজের জন্য নাইট উপাধিও কিনে নিল। হয়ে গেল সার গসেলিন। ইয়ার-বন্ধুদের নিয়ে দু’হাতে জলের মত টাকা উড়িয়ে চলল সে তারপর। বাবার টাকা আর নাইট উপাধি এই দুয়ের শক্তি তখন তার সঙ্গে। কে তাকে বাধা দেবে? কিছুদিনের মধ্যেই ছোটোভাই রবার্টকেও দলে টানল সে। তারপর দুই ভাই মিলে বেদম ফূর্তিতে বাবার সব সম্পত্তি ফুঁকে দিল কয়েক বছরের মধ্যে।

এইবার গরিবির পালা। দু’বেলা ভালোমত খাবারটুকুও আর জোটে না গসেলিনের। পরিশ্রম করে যে টাকা রোজগার করবে সে শিক্ষাও তার নেই, ইচ্ছেও নেই। তার চাই শুধু ভালো ভাহালো খাবার, পোশাক, চাই আরাম আর ফূর্তির জীবন। কিন্তু তার জন্য তখন আর টাকার জোগাড় হবে কোত্থেকে?

সমস্যাটায় পড়ে তার সমাধান বের করে ফেলতে এক মুহূর্ত ভাবল না গসেলিন। যার একটা ঘোড়া আছে, গায়ে শক্তি, বুকে সাহস আর হাতে তলোয়ার আছে তার আবার টাকার অভাব কী? অতএব কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল সার গসেলিন আর রবার্ট হাইওয়ের ডাকাত হয়েছে।

তাদের সাহস ছিল দেখবার মত। তেমনি তলোয়ারের হাত। প্রথমে কিছুদিন ছোটোখাটো ডাকাতি আর খুনখারাবি করে হাত পাকিয়ে নিল তারা। তারপর নামল আসল খেলায়। এমন ডাকাতি করতে হবে যাতে একসঙ্গে অনেক টাকা পাওয়া যায়। অতএব খুঁজেপেতে এইবার শিকার হিসেবে তারা বেছে নিল এক বড়োসড়ো মানুষকে।

তখন ইংল্যান্ড আর স্কটল্যাণ্ডে বেদম যুদ্ধবিগ্রহ চলছে। দুই দেশই খৃস্টান। তারা নিজেদের মধ্যে এভাবে মারামারি করছে দেখে খৃস্টানদের বড়োপুরুত পোপ করলেন কি, দুজন কার্ডিনালকে পাঠালেন ইংল্যাণ্ডে। তাঁদের ওপর দায়িত্ব পড়ল ইংল্যাণ্ডের রাজা দ্বিতীয় এডওয়ার্ডকে বুঝিয়েসুজিয়ে সে-যুদ্ধ বন্ধ করা।

স্বয়ং পোপের দূত। সে তো চাট্টিখানি কথা নয়। খবরটা পেয়েই সার গসেলিন বুঝে ফেলল, এদের সঙ্গে ভালো ধনরত্ন থাকবেই থাকবে। অতএব তার দল এবার তাক করল দুই কার্ডিনালকে। ইতিমধ্যে তার ফন্দির কথা জানতে পেরে দলে এসে ভিড়েছে আরো দুই কুখ্যাত ডাকাত। তাদের নাম মিডলটন আর শেলবি। এমন শিকারের খবরে কার না লোভ হবে!

যথাসময়ে দুই কার্ডিনালের ক্যারাভানে গসেলিন হানা দিল। তারপর তাঁদের সর্বস্ব লুটপাট করে বেজায় বড়োলোক হয়ে গেল তারা।

বেচারা মিডলটন অবশ্য অতটা ভাগ্যবান ছিল না। লুটের মাল ভাগাভাগির সময় ভাগে কম টাকা পেতে তার ভারী গোঁসা হল। তবে গসেলিনের মুখের ওপর সে-কথা বলে ঝগড়া করে এমন সাহস তার নেই। তাই সে গোমড়া মুখে মানে মানে দল ছেড়ে সড়ে পড়ল। মতলব করল, এবার একাএকাই ডাকাতির ব্যাবসাটা চালা্বে।

তবে সে তো আর গসেলিনের মত বুদ্ধিমান বা ভাগ্যবান ছিল না! ফলে কিছুদিন যেতে না যেতেই ধরা পড়ে গেল বেচারা। তাকে শেকলে বেঁধে লণ্ডনে এনে ফাঁসিকাঠে লটকে দিল রাজার লোক।

ওদিকে গসেলিনের প্রতাপ তখন বেড়েই চলেহে। দেশে হাহাকার পড়ে গেছে তার অত্যাচারে। দলে সে তখন বেজায় ভারী। রাজ্যের চোরডাকাত এসে তার চারপাশে জড়ো হয়ে রীতিমত একটা সৈন্যদলই গড়ে তুলেছে বলা যায়। তার ভয়ে হাইওয়ে দিয়ে গাড়িঘোড়ার চলাচল বন্ধ হবার জোগাড় হয়েছে।

এহেন দল নিয়ে তখন সে তার কাজকর্মের পরিধি বাড়িয়ে তুলছিল এবারে। শুধু নির্জন হাইওয়ে নয়। তার ডাকাতের দল এখন শহরবাজারেও ঢুকে আসে দিব্যি। মানুষজনের ঘরবাড়ি, চার্চ, সন্ন্যাসিনীদের হস্টেল, কিছুই ছাড় পায় না তার হাত থেকে। ভগবানকেও ভয় নেই তার মোটে। চার্চে ঢুকে ঠাকুরদেবতার দামী জিনিসপত্রও তুলে নিয়ে যায় হাসতে হাসতে। 

খুনজখম করতেও ভারী ফূর্তি হত তার। অনেক সময় ডাকাতি করতে এসে সব জিনিসপত্র বিনা কষ্টে হাতে পেয়ে গেলেও শুধুই মজা করবার জন্য মানুষজনের গলা কেটে ফূর্তি দেখানো তার নেশার মত হয়ে উঠছিল আস্তে আস্তে। যেন ডাকাতিটা একটা ভারী মজার শিকার অভিযান। সেখানে মানুষরাই বনের জন্তু। তাদের নাহক খুন করে গসেলিনের আনন্দ।

তার এইরকম কারণ নিষ্ঠুরতা আর পাপের টাকায় আনন্দফূর্তির জীবন শিল্পী-সাহিত্যকদেরও নাড়া দিয়েছিল। শ্যাডওয়েল নামে এক নাট্যকার তাঁর বিখ্যাত নাটক ‘দ্য লিবার্টাইন’ লিখে ফেলেছিলেন সার গসেলিনের জীবনকে অবলম্বন করে।

এর কিছুদিন বাদে বাকিংহ্যামশায়ারের মার্লো আর ‘হেনলে আপন টেমস’-এর মাঝখানের রাস্তায় এক ডমিনিকান পাদ্রি গসেলিনের পাল্লায় পড়েন। সামান্যই সোনা ছিল পাদ্রির সঙ্গে। গসেলিন সেটা কেড়েকুড়ে নেবার পর হঠাৎ তার মাথায় উদ্ভট এক খেয়াল চাপল। সামনের একটা বড়ো গাছ দেখিয়ে সে পাদ্রিকে বলল, “ওঠো ওর ওপরে। তারপর গাছের ডালে দাঁড়িয়ে আমাদের খানিক ধর্মপ্রচার করে শোনাও তো!”   

পাদ্রি তো ভগবানের চাকর। ভয়ডরের বালাই তাঁর নেই। পাপীতাপীদের ধর্মের কথা বলবার একটা সুযোগ পেলেই কোমর বেঁধে নামেন। কাজেই তিনি আর দেরি করলেন না। কোমর বেঁধে গাছে চড়ে তার এক মোটা ডালের ওপর দাঁড়িয়ে একটা লম্বা বক্তৃতা দিয়ে ফেললেন। সেই অসাধারণ বক্তৃতা বডলিয়ান লাইব্রেরিতে আজও জমা করা আছে।

বক্তৃতা শুনে গসেলিনের হঠাৎ কী যে হল, সে একগাল হেসে বলে, “দারুণ বলেছ পাদ্রিবাবা। তোমার তো বখশিস পাওয়া উচিত।”

এই বলে বন্ধুদের অবাক করে দিয়ে পাদ্রিকে তার টাকা তো সে ফেরৎ দিলই, তার ওপরে সবার থেকে চাঁদা তুলে আরও খানিক টাকা তাকে উপহার দিয়ে বিদেয় করল।

এই শুনে যদি সবাই ভাবে যে এবার গসলিন লক্ষ্মী হল, তাহলে খুব ভুল করবে। সে ছিল তার একটা মুহূর্তের খেলা শুধু। আর সেইসঙ্গে সে এটাও বুঝে ফেলেছিল, পাদ্রি সাজলে, কারো সন্দেহ না জাগিয়ে লোকের কাছে পৌঁছোনো অনেক সহজ।

অতএব এর কিছুদিন বাদেই গসেলিনের নবরূপে আক্রমণ ঘটল। যার তার ওপর নয়। স্বয়ং দেশের রাজার ওপর। একদিন গসেলিনের কাছে খবর এল রাজা দ্বিতীয় এডওয়ার্ড চলেছেন উত্তর ইংল্যাণ্ডের দিকে। রাজত্বের খবরদারি করতে। দেশের রাজা। তাঁর আর ভয় কীসের? কাজেই সঙ্গে নিয়েছেন মাত্র চল্লিশজন সেপাই।

খবর পেয়েই গসেলিন করল কী, গাদা গাদা পাদ্রির পোশাক বানিয়ে দলের সব ডাকাতকে পাদ্রি সাজাল। তারপর বিরাট একটা দল নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল রাস্তায়, কখন রাজা আসে সেই আশায়।

রাজা দ্বিতীয় এডোয়ার্ড যেই চলতে চলতে নরউইচের কাছে এসেছেন অমনি গসেলিনের পাদ্রিডাকাতের দলও জঙ্গল ছেড়ে পথে উঠে রাজার ক্যারাভানের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। একসঙ্গে অতজন পাদ্রি দেখলে কার না কৌতুহল হয়। রাজারও হল। তিনি তাঁর দলবলকে বললেন, “থাম দেখি! ব্যাপারটা কী তার একটু খোঁজ নিই। এত পাদ্রি একসংগে যায় কোথা?”

রাজার দল থামতেই তো পাদ্রিদের বিরাট দল তাঁকে এসে ঘিরে ফেলেছে। তারপর রাজার সামনে নীচু হয়ে বসে একটা প্রণাম ঠুকল গসেলিন।

রাজা বললেন, “ব্যাপার কী হে ফাদার? ধর্মযুদ্ধে চললে নাকি?”

গসেলিন হেসে ভারী মধুর গলায় বলল, “আজ্ঞে না মহারাজ। ধর্মকর্ম নয়। যুদ্ধবিগ্রহও নয়। অন্য কাজ আছে। কিছু টাকাপয়সার দরকার। তা আপনি আর আপনার দলবল যদি কাছে যা আছে সেটুকু দয়া করে আমাদের দান করেন, তো ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করবেন।”

ততক্ষণে চারপাশের কয়েকশো পাদ্রির আলখাল্লার আড়াল থেকে ঢালতলোয়ার বেরিয়ে এসেছে। দেখে রাজা বুঝলেন আজ আর রক্ষা নেই। এ সাক্ষাত গসেলিনের দল। তাঁর সঙ্গে মাত্র চল্লিশটা লোক। সেই নিয়ে এতগুলো ডাকাতের হামলা আটকানো যাবে না।

কী আর করেন! তখন ডাকাতের সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে হল দেশের রাজাকে। আর সেই ফাঁকে গসেলিনের দলবল, রাজা আর তাঁর আমী্র-ওমরাদের পকেট উলটে দেখে ঝেরেঝুরে শেষ কপর্দকটা অবধি বের করে নিয়ে একগাল হেসে রাজাকে সেলাম করে ফের জঙ্গলে মিলিয়ে গেল।

এহেন হেনস্থা হয়ে এইবারে রাজা যে ক্ষেপে উঠবেন তা তো বলাই বাহুল্য। রেগে দশখানা হয়ে ইংল্যাণ্ডের মহারাজ হুকুম দিলে, এই বদমাশের মুণ্ডু আমার চাই। যত টাকা লাগে পুরস্কার ঘোষণা করা হোক।

টাকার অঙ্ক শুনে দেশের লোকজনের তাক লেগে গেল।  চারপাশে শুরু হল ধরপাকড়। হাতের কাছে যে চোরডাকাত পাচ্ছে লোকজন, তাই ধরে নিয়ে গিয়ে রাজার দরবারে পেশ করে বলে, “এই যে গসেলিন। এবার টাকা দাও!”

প্রায় ষাটজন নকল গসেলিনকে এভাবে রাজার কাছে ধরে নিয়ে গিয়েছিল তখন লোকজন। ওদিকে আসল গসেলিনের দৌরাত্ম্য রাজার ডাকাতির পর থেকে যেন চতুর্গুণ হয়েছে। তেমনি তার প্রতিপত্তি। স্বয়ং রাজাকে ডাকাতি যে করতে পারে তাকে আর বাধা দেবে কে?

এবারে একদিন তারা ঠিক করল, উত্তর ইংল্যাণ্ডের ডারহামের বিশপের বাড়ি লুঠ করবে। সেখানে নাকি অনেক সোনাদানা আছে। 

ক’দিনের মধ্যেই ডিউকের বাড়ি গিয়ে সদলবলে ডাকাতি সারল তারা। তারপর ঠিক করল এইখানেই খানিক ফূর্তি করে নেয়া যাক ফেরবার আগে। যা ভাবা তাই কাজ! এবারে বাড়ির জিনিসপত্র মহাস্ফূর্তিতে ভেঙে, পুড়িয়ে, দল বেঁধে সে নামল বিশপের বাড়ির মাটির তলাকার মদের কুঠুরিতে। সেখানে যত দামী দামি মদ ছিল তার খানিক পেট পুরে খেয়ে বাকি পিপেগুলো উলটে দিয়ে মদের নদী বইয়ে তার দলবলের তখন কী ফূর্তি!

কিন্তু সব মানুষেরই সৌভাগ্যের দিন কখনো না কখনো শেষ হয়। গসেলিনও তার ব্যতিক্রম ছিল না। তার কপালে কাল ঘনিয়ে এসেছিল এর কিছুদিন বাদে ইয়র্কশায়ারে শুরু হওয়া একটা ঘটনায়। সেখানে এক পান্থশালায় ভারী সুন্দর এক মেয়ের সঙ্গে ভাব হয়ে গেছিল গসেলিনের। তাকে না দেখে মোটে থাকতে পারে না সে। ফলে ইয়র্কশায়ারের সেই পান্থশালাতে তার ঘনঘন যাতায়াত শুরু হয়েছিল বন্ধুবান্ধব নিয়ে। তাদের হইহুল্লোড়ের ঠেলায় অন্য লোকজন পান্থশালার ধার ঘেঁষে না মোটে।

তবে মেয়েটার বাড়ির লোকজন কিন্তু অন্যকিছু ভাবছিলেন। প্রথম প্রথম তো গসেলিনের ভয়ে কিছু বলেননি তাঁরা। মুখ বুঁজেই থেকেছিলেন। কিন্তু তারপর যখন দেখলেন ডাকাতের পাল্লায় পড়ে মেয়েটার ভারী বিপদ, তখন তাঁরা ঠিক করলেন আর মুখ বুঁজে থাকা নয়।

একদিন রাত্রে গসেলিন যখন তার দলবল নিয়ে সেই মেয়ের সঙ্গে ভোজ খেতে এসেছে, তখন সে মেয়ের বাড়ির লোক চুপিচুপি বের হয়ে গিয়ে সটান শহরের শেরিফের কাছে হাজির।

গসেলিন তাঁর শহরের পান্থশালায় এসে জুড়ে বসেছে শুনে শেরিফ তো আনন্দে আত্মহারা। ধরতে পারলে অতগুলো পুরস্কারের টাকা মিলবে। চাইকি রাজার অন্য অনুগ্রহও মিলে যেতে পারে অক্লেশে।

তবে গসেলিনের দল মোটেই তুচ্ছতাছিল্য করবার মত নয়। সাবধানে না এগোলে উলটে নিজের প্রাণ যাবার ভয়। শেরিফ তাই প্রায় সাতশো সেনার দল জোগাড় করে নিয়ে চললেন গসেলিন অভিযানে।

হঠাৎ পান্থশালার বাইরে সৈন্যদের হানা হতে ঘাবড়ে গিয়েছিল গসেলিন। পালাতে গিয়েছিল বাড়ির পেছনের দরজা দিয়েও। কিন্তু সেদিকে মুখ বাড়িয়েই সে টের পায় তিরধনুক উঁচিয়ে সেখানেও  অন্ধকারে থানা দিয়ে রয়েছে শেরিফের সেনারা।

গসেলিন বুঝল সেদিন আর নিস্তার নেই তার। অমনি তার হাতে উঠে এল তলোয়ার আর গলায় যুদ্ধের হুঙ্কার। বিনাযুদ্ধে প্রাণ সে দেবে না, তা সে শত্রুর দলবল যতই বড়ো হোক না কেন!

সেই যুদ্ধে হা-ক্লান্ত হয়ে ধরা পড়বার আগে গসেলিনের ছোট্টো দলের সঙ্গে লড়াইতে দুশো সেপাইয়ের প্রাণ গিয়েহিল। তবেই বোঝো কী সাংঘাতিক যুদ্ধবাজ ছিল এই ডাকাত!

ধরা পড়বার পরের ব্যাপারটা অবশ্য সংক্ষিপ্ত। গসেলিনকে বেজায় কড়া পাহারায় শেকলে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হল ইয়র্কে। সে-যুগে চোরডাকাতের বিচারটিচার বিশেষ হত না। অতএব ইয়র্কে পৌঁছে, হাজার লোকের জয়ধ্বনির মধ্যে গসেলিনকে সদলবলে ফাঁসি দিয়ে দেয়া হল খোলা আকাশের নীচে, একটা ভিড়ে ভরা বাজারের লোকজনের সামনে।

আর এমনিভাবেই শেষ হয়ে গেল এক অন্ধকার মহাবীরের জীবন। নিজের দেশের রাজাকেও যে পাদ্রি সেজে ভুলিয়ে ডাকাতি করে সর্বস্বান্ত করতে পেছপা হয়নি।

জয়ঢাকের টাইম মেশিন সব লেখা একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s