দেশ ও মানুষ আগের সব পর্ব একসাথে
স্বপ্না লাহিড়ীর আরো লেখা– এক বিচিত্র যাত্রার কাহিনী , নাগজিরা, আমার গেছো ভূত, ভালু,
রামময় রামনামী
স্বপ্না লাহিড়ী
ছত্তিসগঢ়ের ধমতরি জেলার নগরি শহরের দক্ষিণে ছোট্ট গ্রাম ফারসিয়া। সেখান থেকে প্রায় ছয় কিমি দূরে সিহাবা পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসে মহানদীর মুখ্য ধারা। নদীটির উৎস ঠিক কোন জায়গাটিতে তা বলা যায় না। কারণ, অনেকগুলি পাহাড়ি নদীর প্রবল জলধারা যাদের উৎস পূর্বঘাট পর্বতমালার সিহাবা পাহাড়, একত্রিত হয়ে সৃষ্টি করেছে মহানদী। প্রাচীনকালে নদীটির নাম ছিল চিত্রোৎপলা। মহানন্দা ও নীলোৎপলা নামেও নদীটিকে জানা যেত।
মহানদী তার উৎসস্থল থেকে বেরিয়ে ছত্তিসগঢ় হয়ে ৮৫৮ কিমি পথ পার করে উড়িষ্যার পারাদ্বীপের কাছে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। এর প্রবাহপথ ধরে সৃষ্টি হয়েছে ছত্তিসগঢ় ও উড়িষ্যার পরম্পরাগত সাংস্কৃতিক বিবিধতা। এই দুই রাজ্যের সংস্কৃতিগত পার্থক্য হয়তো আছে কিন্তু তাদের জীবনদর্শন ধনী হয়েছে এই নদীটির জলধারায় সিঞ্চিত হয়ে।
মহানদীর তটবর্তী ছত্তিসগঢ়ের কিছু গ্রামে বিশেষ করে বিলাসপুর, রায়গঢ় ও রায়পুরে বাস করে রামনামী সম্প্রদায়ের মানুষগুলি। এদের গুরু-গোঁসাই ও বিশিষ্ট লোকেরা মাথায় বাঁশের তৈরি মুকুট পরেন ও তাতে রঙবেরঙের ময়ূরপঙ্খ গুঁজে রাখেন। অনেকটা রেড ইন্ডিয়ানদের মতন। রামনামী সম্প্রদায়ের নারী ও পুরুষরা তাদের গোটা শরীরে কালো রঙ দিয়ে দুটি সূচের সাহায্যে রামনাম অঙ্কিত করে (স্থানীয় ভাষায় বলে গোদমা) এবং কালো রঙ আরও গাঢ় ও পাকা করার জন্য কেরোসিন তেলের প্রদীপ জ্বালিয়ে সেই কাজলেরও মিশেল দেয়। কালো রঙ এবং ধোঁয়া নিয়ে রামনামীদের একটি প্রচলিত ‘দোহা’ উদ্ধৃত করছি ‘- धूम कुसंगति कालिख होई / लिखिय पुराण मंजू मसि सोई -‘ অর্থাৎ, ধোঁয়া এবং কালি কুসঙ্গতির প্রতীক, মানুষের জীবন ও চরিত্রকে মলিন ও কালিমাময় করে তোল। কিন্তু সেই কালি দিয়ে পুরাণের মতো পবিত্র গ্রন্থ যখন লেখা হয় তখন সেই কালিই পবিত্র হয়ে ওঠে।
রামনামীদের সর্বাঙ্গে রাম নাম অঙ্কিত করার পিছনে একটি ইতিহাস আছে। কথিত আছে, কোনও এক সময় সবর্ণ শ্রেণীর উচ্চ জাতির লোকেরা রামনামীদের মন্দিরে প্রবেশ, ভগবান রামের পূজা, রামচরিত মানস পাঠ ও হোম-যজ্ঞাদি নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে জাঞ্জগীর চাঁপা জেলার চারপারাতে এক দলিত যুবক পরসরাম ভারদ্বাজ ১৮১৯ সালের কাছাকাছি আশেপাশের দলিত জনসমূহকে সংগঠিত করে একটি আন্দোলন শুরু করেন যা কালক্রমে ভক্তি আন্দোলনের রূপ নেয়। দলগতভাবে এরা সমস্ত মন্দির ও ব্রাহ্মণ সমাজকে পরিত্যাগ করে। খুব সম্ভবত এই সময় রামনামী সম্প্রদায় স্থাপিত হয়। জন্ম-বিবাহ-মৃত্যু প্রভৃতি সমস্ত সামাজিক কাজেই ব্রাহ্মণ বর্জনীয় এদের মধ্যে। এরা মৃতদেহ মাটিতে কবর দেয় কারণ, দাহসংস্কারে ব্রাহ্মণের প্রয়োজন হয়। রামনামীদের এই ভক্তি আন্দোলন প্রায় একশো বছর ধরে চলে এবং ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে এরা রামনাম উচ্চারণ করার আইনি অধিকার পায়। এই আন্দোলন চলার সময় এদের জনসংখ্যা প্রায় এক লক্ষের মতো ছিল। এখন তা প্রায় দশ লাখ। রামনামীরা বলে তারা যে রামকে স্মরণ করে, তিনি অযোধ্যাবাসী দশরথপুত্র রাম নন। তিনি ‘নিরাকার ব্রহ্ম’-এর প্রতীক।
শরীরের কোন অংশে রামনাম উল্কি দিয়ে লেখা হয়েছে তাই দিয়ে গোটা রামনামী সমাজের লোকেরা আলাদা আলাদা নামে চিহ্নিত হয়। যারা শরীরের যেকোনও অংশে রামনাম চিত্রিত করে তাদেরকে বলা হয় রামনামী। যারা শুধু মাত্র মাথায় দুটি রামনাম লেখে, তাদেরকে বলা হয় শিরোমণি। যারা পুরো মাথায় রামনাম লেখায় তাদেরকে বলে সর্বাঙ্গ রামনামী ও যারা গোটা শরীরে রামনাম অঙ্কিত করে তাদেরকে বলা হয় নখশিখ রামনামী। এদের সন্তানদের দু’বছর বয়সের মধ্যেই শরীরে দুটি রামনাম উল্কি বা ট্যাটু করা অবশ্য কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। বাড়ির দেয়ালগুলিতে কালো রঙ দিয়ে রামনাম লেখা থাকে এবং একে অপরকে অভিবাদন রাম রাম বলে করে। মন্দিরে প্রবেশ ও রামনাম উচ্চারণ নিষিদ্ধ করাতে এরা এই অভূতপূর্ব উপায়টি অবলম্বন করে নিয়েছিল। আপাদমস্তক রামনামে চিত্রিত করে শরীরই মন্দির হয়ে উঠল। অনেকে জিভেও রামনাম লেখাল যাতে প্রতিটি কথার সাথে রামনাম উচ্চারিত হয়। নিজেদের আস্থা, বিশ্বাস ও অধিকার রক্ষার জন্য এই ছোট্ট সম্প্রদায়টি শক্তিশালী ব্রাহ্মণ সমাজের বিরুদ্ধে যে পথটি বেছে নিয়েছিল একদিন ও যে চারিত্রিক ও সাংগঠনিক দৃঢ়তা দেখিয়েছিল তার দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে খুব বিরল, খুব সম্ভবত নেই।
রামনামী সমাজের মানুষরা অনুসুচিত জাতির সতনামি, সূরজবংশী ও সদগুরু সমাজের লোকেদের থেকে নিজেদেরকে পৃথক ভাবে। কারণ, এদের জীবনের অনেকগুলি সংস্কার ব্রাহ্মণ-আশ্রিত। সতনামিরা উপবীত ধারণ করে, সূরজবংশীয়দের মধ্যে গঙ্গাস্নান, কথকথা পাঠ ও সদগুরুপন্থীদের মধ্য মুণ্ডন সংস্কার ও কণ্ঠি ধারণ তাদের ধার্মিক প্রথার অঙ্গ আর সেগুলির জন্য আজও এদেরকে ব্রাহ্মণের দ্বারস্থ হতে হয়। যদিও রামনামী ও এদের মধ্যে বিবাহ সম্বন্ধের চলন আছে।
ছত্তিসগঢ়ের অনুসুচিত জাতির একটি বড়ো অংশ গুরু ঘাসীদাসের অনুগামী। কিন্তু রামনামীরা ভক্ত কবি সন্ত রায়দাসের অনুগামী। এদের সামাজিক সমস্ত ক্রিয়াকর্মতে শুধু রামচরিত মানস পাঠ করা হয়। রামচরিত মানস পাঠ করারও একটি নিয়ম আছে। প্রতিটি পদ বা চৌপাঈয়ের আগে এবং পরে দু’বার রামনাম জুড়ে পাঠ করতে হয়। এই আস্থাবাদী সম্প্রদায়টির জীবন দর্শনও বড়ো সুন্দর। তাদের বিশ্বাস ও প্রার্থনা ‘– अर्थ न धर्म न काम-रुचि, जनि न चहौ निरबाना।। जन्म-जन्म मम राम-राम पद, यह वरदान न आना।’
এই সম্প্রদায়ের মানুষগুলির উল্কি দিয়ে চিত্রিত চেহারা, তাদের রহন-সহন, প্রায় একশো বছর ধরে চলে আসা পরম্পরাগত মেলা এবং সর্বোপরি তাদের জীবনদর্শন, দুনিয়াভরের সমাজ শাস্ত্রী ও মানব বিজ্ঞানীদের আকর্ষিত করেছে। আন্দামান দ্বীপসমূহ ও দক্ষিণ আফ্রিকার কিছু জনজাতি মাটি ও ভেষজ রঙ দিয়ে শরীর চিত্রিত করে ও পাখির রঙিন পাখা মাথায় গোঁজে। কিন্তু সেটা সাজগোজের অঙ্গ, রামনামীদের মতো ধর্ম বা ভক্তির অঙ্গ নয়।
রামনামী সমাজের মানুষদের খুব কম জনের কাছেই কৃষিযোগ্য জমি আছে। জীবনধারণের জন্য এরা বেশিরভাগই দিনমজুরির কাজ করে অথবা কয়লা খাদান, ছুই খাদান বা অন্যান্য খাদানে কাজ করে। রাজনৈতিক সংরক্ষণ ও অন্যান্য যোজনার অন্তর্গত সুবিধা যতটা অনুসুচিত জাতির সতনামী, সূরজবংশীয় বা সদগুরুপন্থীরা পেয়েছে এই সমাজের মানুষগুলি এতদিন তা থেকে বঞ্চিত ছিল। তবে এখন তারা এই সুবিধাগুলি পেতে শুরু করেছে।
রামনামী সমাজের দুটি প্রমুখ ধার্মিক পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। একটি চৈত্রমাসের রামনবমীতে বিশাল সন্ত সমাগমের মেলা ও দ্বিতীয়টি পৌষমাসের একাদশী থেকে ত্রয়োদশী পর্যন্ত তিন দিবসীয় বার্ষিক মেলা।
রায়গঢ় জেলার অন্তর্গত ঐতিহাসিক শহর সারংগড়-এর পথের পাশে একটি ছোট্ট গ্রাম গোড়ম। এর থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত গ্রাম ওড়কাকন। এই গ্রামটি রামনামী সম্প্রদায়ের একটি প্রমুখ ধর্মস্থান। চৈত্র রামনবমীর ধার্মিক মেলা ওড়কাকনে আয়োজিত হয়। মেলার প্রারম্ভে পূর্ব-নির্ধারিত জায়গায় ময়দানের মাঝখানে রামনাম লেখা একটি স্মারক-স্তম্ভ পোঁতা হয়। প্রথমে এই স্তম্ভটির পূজা হয় ও তার পর মেলা শুরু হয়। স্মারক-স্তম্ভটির চারদিকে গোল করে ঘিরে প্রথমে গোঁসাই সন্ত, বিশিষ্ট ভক্তগণ ও গ্রামপ্রধানদের তাঁবু বা ‘চালনি’ লাগানো হয়। তারপরে থাকে বাইরে থেকে আসা ব্যবসায়ীদের তাঁবু এবং সর্বশেষে বৃত্তাকারে থাকে গ্রাম থেকে আসা সমাজের সাধারণ মানুষদের চালনি। তাঁবুগুলির ওপর থেকে নিচে ও ভিতর থেকে বাইরে পর্যন্ত কালো রঙ দিয়ে রামনাম লেখা থাকে।
এই মেলাতে সামাজিক বিষয় ও বিবাদ প্রভৃতির ওপর সামুহিক নির্ণয় নেবার প্রথা আজও চলে আসছে। সামুহিক বিবাহও এখানে সম্পন্ন হয়। প্রতিটি বিবাহ পন্থের রেজিস্টারে পঞ্জিকৃত হয় ও নবদম্পতিদের সার্টিফিকেটও দেয়া হয়। পৌষমাসের তিন দিবসীয় বার্ষিক মেলাতে নির্ণয় নেয়া হয় যে আগামী মেলাটি কোন গ্রামে আয়োজিত হবে। গ্রামের প্রতিনিধিরা নিজের নিজের গ্রামের পক্ষ থেকে সমাজপ্রধানদের কাছে আবেদন জমা করেন সেখানে মেলা আয়োজিত করার জন্য। যে গ্রাম সবচাইতে বেশি নারিকেল ভেট দেয় সেই গ্রামকেই এই দায়িত্ব দেয়া হয়। বার্ষিক মেলা মহানদীর তটবর্তী গ্রামে আয়োজিত হয়। এদের গণতান্ত্রিক বিধিবিধানের পরম্পরা শত বৎসর ধরে আজও চলে আসছে।
দুপুরের পর থেকে মেলা মুখর হয়ে ওঠে জনসমাগমে। গোঁসাই, সন্ত ও ভক্তগণ এক পায়ে ঘুঙুর বেঁধে রামনাম গাইতে থাকেন ও তার সাথে চলতে থাকে রামচরিত মানস পাঠ। মেলার ক’টা দিন দুপুর থেকে ভোররাত পর্যন্ত দিক-দিগন্তে ধ্বনিত হতে থাকে সমবেত কণ্ঠের পবিত্র রামনাম। ছত্তিসগঢ়-এর আকাশ বাতাস, মাটি, নদী-নালা, অরণ্য-পর্বত রামময় হয়ে ওঠে।
মেলা শেষ হয়ে গেলে স্মারক-স্তম্ভটি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে রামনামের স্মৃতিচিহ্ন রূপে।