প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব , চতুর্থ পর্ব, পঞ্চম পর্ব, ষষ্ঠ পর্ব
নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী
আগের পর্বের পর
সপ্তম পর্ব
বোধিজ্ঞান লাভের পরবর্তী ঘটনা
এই সেই উরুবেলার বনভূমি। গভীর শাল বনের পাশ থেকে অবিরল ধারায় বয়ে চলেছে নৈরঞ্জনা। নদীর পশ্চিম তীরে গ্রামের শ্মশান। উত্তরে বাণিজ্যপথ। পূর্ব ও দক্ষিণ তীরে শালের বন। নদীর বয়ে চলার কুলকুল শব্দ পাথরে প্রতিফলিত হয়ে বনভূমির বাতাসে ভেসে আসছে। নিস্তব্ধ চরাচরে আর কোনো শব্দ নেই। রাত্রি শেষ প্রহর কেটে একটু পরেই ফুটবে ঊষার আলো।
এক নতুন ভোর আসছে—কিছুক্ষণ আগেই মারবিজয়ী তথাগত বোধিলাভ করেছেন। তিনি বোধিমন্ডপে বসে ভাবছিলেন, তাঁর এক সুদীর্ঘ যাত্রাপথের আজ ইতি হল। চরম বৈরাগ্য নিয়ে তিনি আজ থেকে ছয় বছর আগে সাধনায় নিমগ্ন হয়েছিলেন। অভীষ্টলাভের বিঘ্ন হচ্ছে মনে করে আরাঢ় কালাম ও রুদ্রকের আশ্রম পর্যন্ত ত্যাগ করেছিলেন। তারপর এই বনে চতুরঙ্গ সমন্বিত ব্রহ্মচর্য্য পালন করেছিলেন তিনি। পরমরুক্ষ ও পরম জুগুপ্সী হয়েছিলেন। আরও কত যে তপশ্চর্য্যা পালন করেছিলেন তা সত্যিই এক দীর্ঘ ইতিহাস।
তিনি বনভূমিতে বাস করার সময় শণের বাকল পরেছেন কখনও বা তীরিটধারী (গাছের ছাল ধারণ) হয়েছেন। আবার কখনও শবের আচ্ছাদনও অঙ্গে ধারণ করেছেন। ভিক্ষান্নও একদিন অন্তর, দুইদিন অন্তর এভাবে ধীরে ধীরে সপ্তাহ অন্তর গ্রহণ করেছেন। খাদ্য গ্রহণে কোনো বাছ বিচার করেননি। তিনি শাকভোজী হয়ে থেকেছেন, কখনও কেবল পরিত্যক্ত তরকারির খোসা খেয়ে থেকেছেন। উৎকুটিক হয়ে ক্লেশ স্বীকার করবেন বলে দিবারাত্রির সর্বক্ষণ একবারও না বসে দাঁড়িয়ে থেকেছেন। শরীরকে ক্লেশ দিতে কন্টকশয্যায়ও শুয়েছেন। এ সবই তাঁর পূর্বতপস্বিতা।
কঠোর সাধনব্রত নিয়ে তিনি স্নানাহার ত্যাগ করেছিলেন। স্নানের অভাবে তাঁর শরীরের রজঃমল তখন জমাটবদ্ধ ও চুলেও জট পাকিয়ে গেছিল। এই সময় বনভূমির গভীরে থাকা কালীন তিনি এক সময় গোময়ভোজী পর্যন্ত হয়েছিলেন। তিনি তপস্যার ক্ষতি হতে পারে মনে করে মানুষের সামনে আসেননি বহুকাল, যাতে তাঁর বিবেকবৈরাগ্য এতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এইজন্যই তখন তিনি এক সুগভীর বনভূমি থেকে অন্য গভীর বনস্থলীতে ক্রমাগত ছুটে বেরিয়েছেন। কখনও বনচারী ও কাঠুরে কিংবা গোপালকদের সামনে এসে পড়লেই সেই মুহূর্তে সেই স্থান ত্যাগ করে চলে গেছেন তিনি। তারপর তারা চলে যাবার পর তিনি সন্তর্পনে মাটিতে পড়ে থাকা সদ্য বাছুরের মল ভক্ষণ করেছেন। এইভাবে শরীরকে আরও যত নানাবিধ ক্লেশ দিয়েছেন সবই এই পরম জ্ঞানকে লাভ করার জন্য। তাঁর সেইসব আত্মনিগ্রহ ব্যর্থ হয়নি, আজ বহুকাঙ্খিত সেই বোধিজ্ঞান তাঁর করায়ত্ব।
এই মুহূর্তে তথাগতের শরীরের কোনো অনুভূতি নেই। কেবল তাঁর পূর্ণ চেতনা জেগে আছে। তিনি শরীরে কোনো রকম ক্ষুধা বা তৃষ্ণা অনুভব করছেন না, কেবল এক অপূর্ব প্রশান্তি বিরাজ করছে তাঁর শরীর মন জুড়ে। তিনি গভীর প্রশান্তিতে তাঁর সাধন আসনে বসে রইলেন, স্থান ত্যাগ করলেন না। তথাগতর দৃষ্টি সামনে স্থির। দেব ও মানুষের শিক্ষক (শাস্তা) তথাগত বুদ্ধ সৃষ্টিতত্ত্বের আদি ও অন্ত চিন্তা করতে লাগলেন। এরপর তিনি উঠে দাঁড়িয়ে ঘাসের আসন ত্যাগ করলেও বোধিমন্ডপ ত্যাগ করলেন না। মনে মনে তিনি বোধিবৃক্ষের পুজো করলেন। ‘হে মহান বৃক্ষ! তোমার কাছে আমার ঋণের শেষ নেই!’ তথাগত অপলক নেত্রে তাঁর সাধন আসনের দিকে চেয়ে আসনের প্রতিও তাঁর কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করলেন। এইভাবে এক সপ্তাহ কেটে গেল। ওই স্থান অনিমেষ চৈত্য নামে পরিচিত হয়েছে।
এরপর বোধিপালঙ্ক ও অনিমেষ চৈত্যের মাঝখানের পূর্ব পশ্চিম কোণে তিনি পায়চারি করতে লাগলেন। এইসময় তাঁর শরীর থেকে ছটি রঙের জ্যোতির ছটা বের হয়ে বনভূমি আলোকিত করে তুলল। সেই জ্যোতি দেখে বহু দেবতা তথাগতের কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে উরুবেলার সেই বনভূমিতে এসে উপস্থিত হলেন। এঁরা সকলেই মৃত সুকৃতিশালী পুণ্যাত্মারা। তাঁরা সাধনপ্রভাবে দেব শরীর লাভ করেছেন। দেবতারা ছটি রংয়ের রত্ন দিয়ে বোধিবৃক্ষের পেছেনে একটি রত্নঘর নির্মাণ করলেন। সেখানে তথাগত তাঁদের কাছে সাধন রহস্য ব্যক্ত করলেন। সেই রত্নঘরের রত্নসিংহাসনে আসীন হয়ে বুদ্ধ সুগভীর চিন্তার মাধ্যমে অভিধর্ম পিটক ও পট্ঠান নীতি নির্ধারণ করলেন। এভাবে মোট চার সপ্তাহ কেটে গেল।
একমাস পর বুদ্ধ প্রথম বনভূমির বাইরে এসে অজপাল ন্যগ্রোধ বৃক্ষের নীচে দাঁড়ালেন। বনভূমির প্রান্তে একটি সুবিশাল চারণভূমি। এখানেই একটি সুবিশাল বট বা ন্যগ্রোধ বৃক্ষের নাম হল অজপাল। এখানে মেষপালকেরা তাদের ছাগল ও ভেড়াদের চড়াতে এসে, কিছুক্ষণ বিশ্রাম করত, তাই ন্যগ্রোধ বৃক্ষটির নাম হয়েছে অজপাল। বিকেলের সোনালি আলোয় সমস্ত প্রকৃতি হাসছে। দূরে মাঠে মাঠে শীতে লাগানো যবের চারাগুলি বৈশাখের তাপে পুষ্ট হয়ে উঠেছে। শালগাছের কচি পাতাগুলি বিকেলের আলোয় ঝকমক করছে। সর্বত্র পূর্ণতার চিত্র, সর্বত্র আনন্দ, সর্বত্র শান্তি। প্রশান্ত এবং স্থির তথাগত অজপাল মূলে বসলেন।
এমন সময় একজন ব্রাহ্মণ সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিল। তথাগতের উজ্জ্বল শরীর ও শান্ত মুখমণ্ডল দেখে আকৃষ্ট হয়ে ব্রাহ্মণ দাঁড়িয়ে পড়ল। সে গর্বের সঙ্গে নিজের পরিচয় দিয়ে জানালো সে হল ব্রাহ্মণ। এবং তথাগত ব্রাহ্মণ কিনা জানতে চাইল। উত্তরে তথাগত বললেন,
”ন ব্রাহ্মণো নোম্হি ন রাজপুত্তো। ন বেস্সাযনো উদ কোচি নোম্হি।
গোত্তং পরিঞ্ঞায পুথুজ্জনানং, অকিঞ্চনো মন্ত চরামি লোকে।।”
অর্থাৎ ”আমি ব্রাহ্মণ নই, রাজপুত্রও নই, আর বৈশ্যও নই। সকল মানুষের গোত্র পরিজ্ঞাত হয়ে (প্রকৃত পরিচয় জেনে) আকিঞ্চন ও চিন্তাশীল হয়ে আমি এই পৃথিবীতে বিচরণ করি।”
ব্রাহ্মণকে প্রকৃত ব্রাহ্মণের স্বরূপ ব্যাখ্যা করে আবেগপূর্ণ কন্ঠে তিনি একটি গাথা আবৃত্তি করলেন।
”পাপ শূন্য নিষ্কলুশ, সে হয় ব্রাহ্মণ ।
নাহি আস্ফালন তার সংযত জীবন,
কালিমার বিদায়ে যার হৃদয় নির্মল-
বেদবীদ যে জনের ব্রহ্মচর্য্য হয়েছে সফল,
কখনও যার হয়নি মনের স্খলন-
ধরাধামে এমন মানবেরে কর ব্রাহ্মণত্বে বরণ।”
অজপাল বৃক্ষমূল থেকে তথাগত এলেন মুচলিন্দ বা মুচকুন্দ চাঁপা বৃক্ষমূলে। এমন সময় শুরু হল বৈশাখের ভয়ানক ঝড় ও বৃষ্টি। সেই দুর্যোগ সাতদিন স্থায়ী হয়েছিল। তথাগত নির্বিকার চিত্তে বৃক্ষমূলে বসে রইলেন। পুষ্পিত চাঁপা ফুলের অপূর্ব সৌরভে গাছটিতে সাপেরা আশ্রয় নিয়েছিল। ভগবানের শরীরকে ঝড়জলের হাত থেকে রক্ষা করতে নাগলোক থেকে নাগরাজ স্বয়ং সেই মুচলিন্দ গাছের বেদীমূলে এসে উপস্থিত হন। নাগরাজ সাতটি পাকে ভগবানের শরীর জড়িয়ে ধরে তাঁকে প্রতিকূল পরিবেশ থেকে রক্ষা করতে লাগলেন। তথাগতও প্রশান্ত মনে নাগরাজের আশ্রয়ে ধ্যানসুখে বিরাজ করতে লাগলেন। সাতদিন পরে দুর্যোগ কেটে আবার রোদ উঠল। নাগরাজ তখন বুদ্ধের শরীর ছেড়ে তাঁর চরণে প্রণাম জানিয়ে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিলেন।
বুদ্ধ এরপর এলেন একটি রাজায়তন বা ক্ষীরকুল গাছের নীচে। সেখানেও তিনি এক সপ্তাহ ধ্যানলগ্ন রইলেন। এই সময় কদাকার দর্শন মার আবার তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল। পরাজিত হয়ে মার হীনবল হয়েছে, তবুও সে এখনও একেবারে হাল ছেড়ে দেয়নি। সে বলল,
”তথাগত আপনি এখন কী করবেন? যা চেয়েছিলেন, সেই বোধিজ্ঞান তো আপনি লাভ করেছেন! ধ্যানসুখও লাভ করেছেন। এখন সাধারণের মত খাদ্য গ্রহণ করে দিনযাপন করে কেনই বা বেঁচে থাকবেন? এখনই হল পরিনির্বাণের প্রকৃত সময়! আপনি মৃত্যুকে বেছে নিন। দয়া করে পরিনির্বাণ লাভ করুন!”
বুদ্ধ চোখ মেলে চাইলেন। সঙ্গে সঙ্গে পাপী মার তার চোখ নামিয়ে নিল। সে জোড় হাত করে তথাগতের মৃত্যু কামনা করছে। বুদ্ধ উত্তর দিলেন, ”হে পাপী মার! তথাগত এখন নির্বাণলাভ করবেন না। তাঁর শিষ্য ভিক্ষুরা যতদিন না শান্ত দান্ত, বিনীত বিশারদ ও বহুশ্রুত না হবেন, যতদিন না বুদ্ধের ধর্ম ও সংঘের প্রতিষ্ঠা হবে ও তা প্রসারলাভ করবে ততদিন তথাগত পরিনির্বাণপ্রাপ্ত হবেন না।”
বুদ্ধ অনেকদিন পর উপলব্ধি করলেন, এবার শরীর রক্ষার জন্য তাঁর অবশ্যই কিছু খাদ্যগ্রহণ করা প্রয়োজন। বুদ্ধ খাদ্যের কথা ভাবতেই সেই রাজায়তন বা ক্ষীরকুল গাছটি উৎকৃষ্ট পাকা ফলে ভরে উঠল। হলুদ রংয়ের সেই সুমিষ্ট ফলের গন্ধে তথাগত অনেকদিন পরে প্রথম ক্ষুধা অনুভব করলেন। তাঁর মনে মুখ ধোবার ইচ্ছে জাগল এবং তাঁর ইচ্ছে তক্ষুণি কার্যে পরিণত হল। বলা হয়, দেবরাজ ইন্দ্র এই সময় তাঁর জন্য হরীতকী ও দাঁত মাজার জন্য নাগলতার দন্তকাষ্ঠ নিয়ে আসেন। মুখ ধোবার জন্য স্বর্গের অনবতপ্ত সরোবর থেকে একপাত্র জলও আসে। সেই জল বেশি গরমও নয়, কিংবা বেশি ঠাণ্ডাও নয়। বুদ্ধ দাঁত মেজে ও মুখ ধুয়ে আবার সেই বৃক্ষমূলে এসে বসলেন।
একটু দূরে বাণিজ্যপথটি ধরে তখন বহু গো-শকট যাচ্ছিল। গরুরগাড়িগুলির সামনে সামনে দুজন যুবক পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছেন। তাঁদের নাম হল ত্রপুষ ও ভল্লিক। তাঁরা উৎকল দেশের বণিক। তাঁদের সঙ্গে পণ্য নিয়ে চলেছে পাঁচশো গো-শকট। তাঁরা উরুবেলার এই বাণিজ্যপথ ধরে যাবেন মধ্যদেশ। তাঁদের শকটগুলি ছিল নানাধরণের খাদ্য সামগ্রীতে ভরা। গুড়, মধু, যবের ছাতু, মন্থের লাড্ডু, ঘি, ননী, চর্বি, তেল, আটা বা গোধূমচূর্ণ এইসব ছিল তাদের পণ্য।
বুদ্ধের জন্য খাদ্য সংগ্রহে আগ্রহী পরলোকগত দৈবশক্তিসম্পন্ন বিদেহী আত্মাদের দল এসে তাঁদের শকটগুলি ঘিরে ফেলল। কেউ কিছু বুঝতে পারল না তবে, হঠাৎ শকটগুলি টেনে নিয়ে চলা বলদেরা পথ চলা বন্ধ করে ফেলল। সমস্ত শকটগুলি যেখানে ছিল সেখানেই স্থির হয়ে থেমে গেল। শকট থেমে যেতে ত্রপুষ ও ভল্লিক তাঁদের ঘোড়া থেকে নেমে এলেন। কী হয়েছে? তাঁরা বুঝতে পারছেন না। শকট চালকেরাও সকলে অবাক হয়েছে। বলদেরা তাড়না করলেও এতটুকু এগিয়ে যাচ্ছে না। তখন এক একটি গাড়িকে অনেকে মিলে ঠেলে নিয়ে যেতে লাগল। তখনই নতুন উপদ্রব শুরু হল, শকটের চাকাগুলি হঠাৎ মাটিতে বসে যেতে শুরু করল। গাড়ি ঠেলে তোলার পরিশ্রমে সকলেই তখন পরিশ্রান্ত। এই অদ্ভুত ঘটনায় সবাই বিভ্রান্তও হয়েছেন।
এ কী অসম্ভব ঘটনা! কোনো আদিভৌতিক রহস্যময় ঘটনাই মনে করল সকলে। শকট চালকেরা কেউ বলল এখনই এখানে ভূমিপুজো ও যজ্ঞ করা দরকার, কেউ বলল গ্রাম থেকে আরও লোকজন সংগ্রহ করে গাড়িগুলি ঠেলে নিয়ে এগিয়ে যাওয়াই বিধেয়। অসহায় হয়ে সাহায্যের জন্য এদিক ওদিক তাকাতে গিয়ে ত্রপুষ ও ভল্লিক দুজনেরই চোখে পড়ল দূরে একটি রাজায়তন বৃক্ষের নীচে একজন শ্রমণ বসে আছেন। তাঁর অপরূপ পবিত্র রূপ দেখে তাঁরা চমকে উঠলেন। শ্রমণের সমস্ত শরীর থেকে যেন জ্যোতি বিচ্ছুরিত বের হচ্ছে।
ত্রপুষ শ্রমণকে দেখিয়ে ভল্লিককে বললেন, ”এসো! ওই শ্রমণকে কিছু খাদ্য দান করে আমাদের সমস্যা তাঁকে জানিয়ে আসি। ওঁর কৃপায় হয়তো আমরা সমস্যামুক্ত হতে পারি। শ্রমণকে দেখেই একজন শ্রেষ্ঠ সাধক বলেই মনে হচ্ছে।”
ত্রপুষের কথায় খুশি হয়ে ভল্লিক সমর্থন জানালো। তাঁরা দুজন মধু সহযোগে ভাজা যবচূর্ণের (যবের ছাতুর) মণ্ড বা মধুপিণ্ড, ও মন্থের লাড্ডু, একটি কাঁচা শালপাতায় নিয়ে বুদ্ধের সামনে এসে প্রণাম করে বলল, ”প্রভু অনুগ্রহ করে আমাদের চিরস্থায়ী মঙ্গলের জন্য আপনি এই দান গ্রহণ করুন!”
বুদ্ধ আগেই পায়েস খাবার পর সুজাতার দেওয়া সোনার পাত্রটি নৈরঞ্জনা নদীতে বিসর্জন দিয়েছিলেন। তারপর থেকে তিনি আর ভিক্ষা সংগ্রহ করেননি, তাঁর কাছে এখন আর কোনো ভিক্ষাপাত্র নেই। তিনি হাতে ভিক্ষা গ্রহণ করতে চাইলেন না, কারণ তথাগতগণ পূর্বাপর জন্মকাল থেকে কখনও হাতে ভিক্ষা গ্রহণ করেন না। তিনি এই কথা ভাবার সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে দেবতারা চারটি মূল্যবান মণিময় ধাতুর পাত্র নিয়ে তাঁর সামনে উপস্থিত হলেন। ত্রপুষ এবং ভল্লিক দেখলেন হঠাৎ শূন্য থেকে সোনালী আভাযুক্ত চারটি ধাতুপাত্র এসে শ্রমণের সামনে ভাসমান হল। কিন্তু শ্রমণ সেগুলি গ্রহণ করলেন না। সেগুলি তখন আবার শূন্যেই অদৃশ্য হল।
দেবতারা বুঝলেন বুদ্ধ মূল্যবান ভিক্ষাপাত্র গ্রহণে অনিচ্ছুক। এবার তাঁরা চারটি কালো কষ্টিপাথরের ভিক্ষাপাত্র নিয়ে উপস্থিত হলেন। তখন তথাগত প্রসন্ন হয়ে পাত্রগুলি নিয়ে পরপর তাঁর হাতের উপর রাখতেই তাঁর ইচ্ছাতে পাত্রগুলি পরস্পর জুড়ে গিয়ে একটিমাত্র পাত্রে পরিণত হল। কেবল পাত্রটির নীচে চারটি সুস্পষ্ট রেখা থেকে গেল, যা থেকে বোঝা যায় পাত্রগুলি সংযুক্ত হয়েছে।
এই অলৌকিক ঘটনা দেখে ত্রপুষ ও ভল্লিক বিস্মিত ও হতবাক হয়ে গেলেন। তাঁরা বার বার বুদ্ধের চরণে প্রণাম জানিয়ে কিছুটা দূরে জোড়হাতে বসে রইল। বুদ্ধ এবার ভিক্ষাপাত্রে খাদ্য নিয়ে খাদ্যগ্রহণ করলেন এবং এরপর তাঁদের দুজনকে দানফল ব্যাখ্যা করলেন। ভল্লিক ও ত্রপুষ বুদ্ধের শিষ্য হতে চাইলেন। তাঁদের প্রার্থনায় সম্মতি জানিয়ে বুদ্ধ তাঁদের বুদ্ধ ও ধর্মের শরণ নিতে বললেন। তখনও সংঘের প্রতিষ্ঠা হয়নি। এই দুজনই হলেন বুদ্ধের প্রথম দ্বিবাচিক উপাসক। তাঁরা সংসারী, প্রব্রজ্যিত নন, তাই তাঁরা হলেন বুদ্ধের ধর্মের প্রথম উপাসক।
বুদ্ধকে তাঁরা বললেন, ”প্রভু! আপনার কিছু নিদর্শন আমাদের দয়া করে দিন। যাতে দেশে ফিরে আমরা পুজো করতে পারি।”
বুদ্ধ তখন তাঁর মাথায় আঙুল চালিয়ে কয়েকগাছি ঝরে পড়া মাথার চুল হাতে পেলেন। তিনি সেই কেশধাতু তখন তাঁদের দুজনকে দান করলেন।
সেইবার অভিনব লাভদায়ক বাণিজ্য হল ত্রপুষ ও ভল্লিকের। দেশে ফিরে গিয়ে তাঁরা বুদ্ধের কেশধাতুর উপর একটি চৈত্য নির্মান করালেন, এবং সেই চৈত্যটিকে সামনে রেখে উৎকল দেশে একটি সুবিশাল মন্দির নির্মাণ করালেন।
ত্রপুষ-রা ফিরে যেতে বুদ্ধ আবার চংক্রমণ করতে করতে বনভূমির কাছে অজপাল বৃক্ষমূলে গিয়ে বসলেন। তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেন। তিনি ভাবতে লাগলেন, ”এত কঠোর সাধনা করে যে ধর্ম আয়ত্ব করলাম, তা কি কেবল এই দুজন উপাসকদের মত সাধারণ মানুষদের জন্য? যারা কেবল নিজেদের সংসারের লাভ ক্ষতির বিবেচনা করবে? ছোটো ছোটো লাভের সার্থকতা পাবার জন্যই কেবল ধর্মের আশ্রয় নেবে? নিঃস্বার্থ মনে ধর্মের এই সুগভীর তত্ত্ব তবে কারা গ্রহণ করবে? এই ধর্ম প্রকৃত আগ্রহীদের জন্য, যারা পরমজ্ঞান লাভ করতে প্রকৃতই ব্যাকূল। কিন্তু তেমন মানুষেরা কোথায়? বেশিরভাগ মানুষই তো স্বার্থ আর ব্যক্তিগত চাহিদার বাইরে আর কিছুই চায় না? তাহলে কাদের জন্য আমি এই ধর্ম প্রচার করব? কারা এই ধর্মের পালনকারী হবে? কারাই বা আগ্রহী হবে? মানুষ কষ্ট সহিষ্ণু নয়, তারা হল ‘আলায়ারাম’, ‘আলায়রত’, ও ‘আলয়সম্মোদিত’। তাদের পক্ষে ‘ইদ্প্রত্যয়তা প্রতীত-সমুৎপাদ’, এই তত্বস্থান দর্শন করা দুষ্কর। আমি ধর্ম উপদেশ করলে এরা কি আমার এই ত্যাগের মহিমায় আলোকিত ধর্মের দর্শন গ্রহণ করতে পারবে?”
তথাগত বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন। তিনি ঠিক করলেন তিনি আর ধর্মপ্রচার করবেন না। তথাগতের মন বুঝতে পেরে ব্রহ্মা ও বৃহস্পতি ভয় পেয়ে গেলেন। এই ধর্ম পৃথিবীর মানুষকে শান্তির পথ দেখাবে, আলোর পথ দেখাবে। তথাগত তা থেকে বিরত হলে, পৃথিবী রসাতলে যাবে। ব্রহ্মা তথাগতর সামনে প্রণাম জানিয়ে দাঁড়ালেন। বলতে লাগলেন, ”সুগত! আপনি ধর্ম উপদেশ করুন! মানুষ এই ধর্ম শুনতে না পেলে অধঃপাতে যাবে। আপনার ধর্মের প্রকৃত শিষ্য অবশ্যই আপনি পাবেন। বলে ব্রহ্মা একটি গাথা রচনা করলেন,
”পুবদিক আলো করে উরুবেলা মাঝে-
এসেছেন নবীন-রবি সন্ন্যাসীর সাজে।
উন্মোচিত ধরায় আজ অমৃতের দ্বার
জন্ম-জরা-মৃত্যু তিনি করেন উদ্ধার।
সর্বজ্ঞ এ বীতশোক নির্মল বদনে
ধর্মবচনে রত হন পরম যতনে।
সুচিন্তিত ধর্ম যিনি করেন শ্রবণ-
পাপ তাপ দূরে যায়, হরষিত মন।”
ব্রহ্মার কথায় জগতের উপর করুণাবশত বুদ্ধ, ধ্যান ভঙ্গ করে চোখ মেলে চাইলেন। তিনি উপলব্ধি করলেন জগতে বিভিন্ন ধরণের মানুষ বর্তমান। যেমন বাহ্যিকভাবে ভিন্ন ভিন্ন জাতির মানুষ আছে, তেমন অন্তরের দিক থেকেও মানুষের প্রকৃতি উচ্চ, নীচ এবং মধ্যম হয়ে থাকে। যেমন প্রস্ফুটিত পদ্মের মধ্যে কিছু পদ্ম জলতলের উপরে, জলের সীমায়, কিংবা জল থেকে খানিকটা উপরে থাকে তেমন মানুষের আত্মাও মোহে আবৃত, আবিষ্ট এবং মোহমুক্ত হয়। তিনি এই ধারণা উপলব্ধি করে সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি ধর্মপ্রচার করবেন। মনস্থির করে ব্রহ্মাকে বললেন,
‘আমার ধর্মের যে শ্রদ্ধাশীল জন
ধর্ম তারই, এই কথা শোনো দিয়া মন।
অনুক্ষণ প্রচারিব সুভাষিত ধর্ম।
পৃথিবীতে আমার এই পালনীয় কর্ম।
ভক্তি, জ্ঞান, বিশ্বাসে অটল যে রবে
জন্ম জরা মৃত্যুদুঃখ নাশ তার হবে।
পাপ জিনি শ্রদ্ধাভরে ধর্মের লালন
হৃদয় অমৃত সে-ই করবে পালন।”
ধর্মচক্র প্রবর্তন
তথাগত ধর্ম প্রচার করবেন, কিন্তু সবার আগে কাকে এই ধর্মের বিষয়ে জানাবেন? কে হবেন এই ধর্মের গুণগ্রাহী? তথাগত প্রাথমিকভাবে এই চিন্তা করতে লাগলেন। তখন তাঁর সবার আগে মনে পড়ে গেল আরাড় কালামের কথা। তিনি দক্ষ, মেধাবী এবং সুপন্ডিত। তিনি বহুকাল ধরে সাধনরত, এবং একজন পবিত্র ও নির্মল হৃদয় ব্যক্তি। সুতরাং এই ধর্মগ্রহণের উপযুক্ত। নেপথ্য থেকে একজন দেবতা তথাগতকে জানালেন,
‘প্রভু! একসপ্তাহ আগে আরাড় কালাম দেহত্যাগ করেছেন।’
তথাগতও জ্ঞানদৃষ্টিতে সেই খবর জানতে পারলেন। তখন তিনি ভাবতে লাগলেন আরাড় কালাম ছাড়া এমন আর কে আছেন যিনি দ্রুত এই ধর্ম উপলব্ধি করতে পারবেন? তিনি এরপর রুদ্রক রামপুত্রের নাম ভাবলেন। তিনিও দীর্ঘকালের সাধক এবং মেধাবী, তিনি এই ধর্মের একজন শ্রদ্ধাশীল অনুগামী হতে পারেন, কিন্তু জ্ঞানদর্শনের মাধ্যমে জানতে পারলেন রুদ্রকও গতরাতে দেহত্যাগ করেছেন। তথাগত এরপর মনে করলেন পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুদের। তাঁরা একসময় সকলেই তাঁর অনেক সেবাযত্ন করেছিলেন। তাঁরাও দীর্ঘদিন ধরে সাধন অভ্যাস করছেন। তাঁদের এই ধর্ম গ্রহণের উপযুক্ত মনে করলেন তথাগত। তিনি এবার জ্ঞানদৃষ্টিতে দেখতে চাইলেন পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুরা এখন কোথায় অবস্থান করছেন। বুদ্ধ তখন বিশুদ্ধ লোকাতীত দৃষ্টিতে দেখতে পেলেন তাঁরা অর্থাৎ কৌণ্ডণ্য, ভদ্রজিৎ, মহানাম, অশ্বজিৎ ও বপ্প এখন বারাণসীর কাছে ঋষিপত্তন-মৃগদাবে আছেন এবং সেখানে থেকেই তাঁরা সাধন অভ্যাস করছেন।
বোধিজ্ঞানলাভের অষ্টম সপ্তাহ। বুদ্ধ বারাণসী যাত্রা করলেন। তাঁর হৃদয়ে অমৃতের খনি, তিনি পেরিয়ে চলেছেন, দীর্ঘ পথ। সারাদিন পায়ে হেঁটে যেখানে থামেন, রাতে সেখানেই একটি গাছের নীচে কিংবা মন্দিরে বা পাহাড়ের গুহায় কাটিয়ে আবার ভোর হলেই পথ চলেছেন বুদ্ধ। যাত্রাপথে কোনো গৃহস্থবাড়ি থেকে যা ভিক্ষায় পাওয়া যায় সেই অন্নই গ্রহণ করছেন তিনি। তাঁর শরীর মনে এক অপূর্ব তেজ ও শক্তির বিকাশ হয়েছে। যেন কোটি সূর্যের সমান মহান শক্তি জেগে উঠেছে তাঁর শরীরের অণু পরমাণুতে। পথশ্রমের ক্লান্তি তাঁকে স্পর্শ করছে না। একজন আজীবক পরিব্রাজক তাঁর সঙ্গে সকালে ভিক্ষায় বেরিয়েছিল। বুদ্ধের অপূর্ব তেজদীপ্ত শরীর ও নিরাসক্ত আচরণ তাঁকে বিস্মিত করেছে। সে বহুদিন ধরে সাধনা করেও এতটুকু অগ্রসর হতে পারেনি। শারীরিক নিগ্রহ চালিয়ে চালিয়ে সে দেহ মনে ক্লান্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বুদ্ধকে দেখে সে ভাবল তিনিও বোধহয় আজীবক শ্রেনীরই একজন সাধক হবেন। আজীবক পরিব্রাজকটির নাম উপক। সে বুদ্ধকে বলল,
”তুমি কোথায় চলেছ? তোমার দেহের কান্তি দেখছি অসাধারণ উজ্জ্বল, অথচ তোমার সঙ্গে থেকে দেখলাম তুমি সারাদিন প্রায় কিছুই আহার করো না। বন্ধো! তোমার শাস্তা (শিক্ষক) কে? তাঁর অধীনে কী ধরণের ধর্মসাধনা তুমি করছ?”
উত্তরে বুদ্ধ বললেন,
”সকলের বিভু আমি, সর্ববিদ হয়েছি এখন,
কোন ধর্মে নহি লিপ্ত, ছিন্ন মম সকল বন্ধন।
সর্বজ্ঞ সর্বত্যাগী, তৃষ্ণাক্ষয়ে বিমুক্ত-মানস,
বল তবে আজীবক! কারে আমি করিব উদ্দেশ,
স্বয়ম্ভু হইয়া নিজে গুরুরূপে করিব নির্দেশ?
আচার্য্য নাহিক মোর, নাহি গুরু, নাহি উপাধ্যায়,
সদৃশ যে কেহ নাই, প্রতিদ্বন্দী মম এ ধরায়।
আব্রহ্মভূবন-মাঝে কোথা আছে হেন কোন জন,
প্রতিযোগী প্রতিদ্বন্দী, যুঝিবারে লোকাতীত রণ।
অর্হৎ আমি যে বিশ্বে, আমি হই শাস্তা অনুত্তর,
সম্যক সম্বুদ্ধ আমি, শীতিভূত, নির্বৃত অন্তর।
ধর্মচক্র প্রবর্তিতে চলিয়াছি কাশীর নগর,
অন্ধবিশ্বে বাজাইয়া অমৃতদুন্দুভি নিরন্তর।”
– (প্রজ্ঞালোক মহাস্থবির)
বুদ্ধের কথা উপকের বিশ্বাসযোগ্য মনে হল না। সে বলল, “বন্ধু! তুমি যেভাবে নিজের পরিচয় দিচ্ছ, তাতে তুমি কি মনে করো তুমি অনন্তজিন হবার যোগ্য?”
বুদ্ধ বললেন, ”জিন অর্থাৎ বিজয়ী। আমি রিপুবিজয় করেছি তাই আমি জিন। আমি বাসনা জয় করেছি, তাই আমি জিন। আমি পাপধর্মের উপর জয়লাভ করেছি, তাই আমি জিন!”
বুদ্ধের কথায় উপক কর্ণপাতই করল না। সে অবজ্ঞাভরে বলল, ”তাই হবে বন্ধু!” এই কথা বলে সে তাড়াতাড়ি সেই স্থান ছেড়ে চলে গেল। আমরা পরবর্তীকালে বুদ্ধের অবজ্ঞাকারী আজীবক সম্প্রদায়ভুক্ত এই উপককে দেখতে পাই যে সে চিরকালের জন্য আজীবক ব্রত ছেড়ে আবার সংসারে ফিরে গেছে এবং বিবাহ করে স্ত্রীপুত্র নিয়ে ঘোরতর সংসারী হয়েছে। অনেক পরে অসুস্থ অবস্থায় সে বুদ্ধের শরণাগত একজন উপাসক হয়েছিল।
বারাণসী পৌঁছে বহুপথ হেঁটে অবশেষে মৃগদাব বনে উপস্থিত হলেন বুদ্ধ। এই বন রাজার কর্মীকদের তত্ত্বাবধানে সংরক্ষিত হয়। এখানে প্রচুর চিতল হরিণ ও ময়ূর আছে, রাজার প্রয়োজনে কেবল এদের শিকার করা হয়। সাধারণদের জন্য প্রাণী শিকার এই বনে নিষিদ্ধ। এই বনের শান্ত পরিবেশে আজীবক ও শ্রমণেরা নিশ্চিন্তে সাধনা করেন।
বুদ্ধকে দূর থেকে তাঁদের দিকে আসতে দেখতে পেলেন পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুরা। তখন তাঁরা পরস্পর বুদ্ধকে নিয়ে আলোচনা করতে লাগলেন। কৌণ্ডণ্য বললেন, ”ওই দেখ সাধনভ্রষ্ট সেই শ্রমণ গৌতম আসছেন এদিকে! সাবধান! তোমরা কেউ তাঁকে অভিবাদন করবে না, আর কেউ উঠে গিয়ে পাত্র-চীবরও ওঁর হাত থেকে নেবে না। কেবল ওইখানে একটা আসন পেতে রাখো। যদি এখানে উনি বসতে চান, বসতে পারেন।”
কিন্তু যতই বুদ্ধ তাঁদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন ততই ভিক্ষুরা তাঁর প্রতি প্রবল আকৃষ্ট হতে লাগলেন। তাঁদের মনে পড়তে লাগল রাজপুত্র সিদ্ধার্থের অমলিন বিশুদ্ধ চরিত্রের কথা। একসময় তাঁরা বহুবছর একসঙ্গে কাটিয়েছিলেন। রাজপুত্র হলেও সিদ্ধার্থের ব্যবহারে এতটুকু ঔদ্ধত্য ছিল না। তাঁর আচরণ ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ, হৃদয় ছিল মহান! তাঁরা সেই সব অতীতের কথা মনে করে নিজেদের মনে প্রবল এক ধরণের টান অনুভব করতে লাগলেন। বুদ্ধের ধীর ও প্রত্যয়ী শরীর ভঙ্গিমা আর উজ্জ্বল আভাযুক্ত জ্যোতির্ময় দেহবর্ণ তাঁদের ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ মোহাবিষ্ট করে তুলল। বুদ্ধ কাছে আসতেই সকলে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে একসঙ্গে অভিবাদন করলেন। তাঁকে বসতে দিলেন ও তাঁর পাত্র-চীবর গ্রহণ করলেন। তারপর তাঁর পা ধোবার জন্য জল ও পা রাখার পিঁড়ি দিলেন। বুদ্ধ আসনে বসে পা ধুলেন।
তখন ভিক্ষুরা তাকে মিত্র গৌতম! এই নামে সম্বোধন করলেন। বুদ্ধ তাঁদের বললেন, ”আমাকে মিত্র বলো না, আমাকে আর নাম উচ্চারণ করে সম্বোধনও করো না। আমি অমৃত অধিগত করেছি, আর আজ তা তোমাদের দান করতে বহুদূর পথ পেরিয়ে এখানে এসেছি। আমি এক নতুন ধর্ম এই জগতে নিয়ে এসেছি। সেই ধর্মোপদেশ দিচ্ছি, তোমরা গ্রহণ করো।”
কৌণ্ডণ্য বললেন, ”সে কি গৌতম! আপনি সেই কঠোর বিহার, কঠোর আচার পালন করেও যা আয়ত্ব করতে পারলেন না, আজ বাহুল্যময় জীবন অবলম্বন করে সব দুষ্করচর্চা ছেড়ে দিয়ে আপনি কি বলতে চান আপনি আর্য্যজ্ঞানদর্শন ও আর্য্য অতীন্দ্রিয় ধর্ম আয়ত্ত করেছেন?”
বুদ্ধ বললেন, ”তথাগত কখনও বাহুল্যময় জীবন অবলম্বন করেননি। তিনি সাক্ষাত সম্যকসম্বুদ্ধ। আমি তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি গ্রহণ করো।”
বুদ্ধ বলতে লাগলেন, ”ভিক্ষুরা প্রব্রজিত কখনও দুই অন্ত অনুশীলন করবে না। প্রথম কাম চরিতার্থ করা, বা কাম সুখের প্রতি অনুরক্তি। যা গ্রাম্য ও সাধারণের সেব্য। দ্বিতীয় আত্মনিগ্রহ বা দুষ্করচর্চা। যা হীন ও অনর্থযুক্ত। হে ভিক্ষুগণ, এই দুই অন্তের অনুগামী না হয়ে তথাগত মধ্যম প্রতিপাদের কথা বলেন। যা সম্বোধ ও নির্বাণের অভিমুখে সংবর্তিত হয়।” এই সময় তথাগত যে উপদেশ দেন তাকেই বৌদ্ধধর্মে বলা হয় ধর্মচক্র। বুদ্ধ তাঁর অমৃতময় কন্ঠে বলতে লাগলেন।
”হে ভিক্ষুগণ! জগতে চারটি সত্য আছে। প্রথম হল জগত দুঃখময়। বারবার জন্মলাভ দুঃখময়, রোগ ও তার জন্য শোক দুঃখময়, জরা বা বার্ধক্য দুঃখময় এবং মৃত্যু দুঃখময়। দ্বিতীয় হল বিষয় তৃষ্ণা। এই বিষয় তৃষ্ণাই দুঃখ উৎপত্তির মূল কারণ। তৃতীয় দুঃখ থেকে মুক্তিলাভের উপায় আছে, আর তা হল, বিষয়তৃষ্ণা সমূলে উৎপাটন অর্থাৎ দুঃখনিবৃত্তি। চতুর্থ হল দুঃখ নিবৃত্তির উপায় বা পথ দুঃখ নিবৃত্তির অষ্টাঙ্গিক পথ আছে। এই হল জগতের চতুরার্য্য সত্য।
তথাগত যে মধ্যম প্রতিপদের কথা বলেন তা-ই হল আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ। অর্থাৎ সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক আজীব, সম্যক ব্যায়াম, সম্যক স্মৃতি, ও সম্যক সমাধি। আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গই হল দুঃখনিরোধগামিনী প্রতিপদ আর্যসত্য। এই সত্যে আমি সুবিশুদ্ধ হয়ে দেবলোক, মারলোক, ব্রহ্মলোক জয় করে সম্যক সম্বোধি লাভ করেছি। আমার বিমুক্তি অচলা, এই আমার শেষ জন্ম, আমার আর পুনর্জন্মের সম্ভবনা নেই।”
তথাগতের এই বিবৃতি দানের সময় শ্রদ্ধেয় কৌণ্ডণ্যের বিরজ বিমল ধর্মচক্ষু উৎপন্ন হল। ধর্মচক্র প্রবর্তিত হলে পৃথিবী কম্পিত হল। দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করলেন। তথাগত উদাত্ত স্বরে বললেন,
”কৌণ্ডণ্য সত্য জ্ঞাত হয়েছে।” সেই থেকে কৌণ্ডণ্য জ্ঞাত-কৌণ্ডণ্য নামে পরিচিত হলেন।
কৌণ্ডণ্য তথাগতর কাছে উপসম্পদা প্রার্থনা করলেন। এভাবে বাকিরাও উপসম্পদা প্রার্থনা করলেন এবং তা প্রাপ্ত হলেন। বুদ্ধ তাদের সকলের মধ্যে সারাদিনের ভিক্ষান্ন ভাগ করে আবার তাঁদের উপদেশ দিতে লাগলেন। সারাদিন ধরে তাঁরা ধর্ম শ্রবণ করে চললেন, এইভাবেই সকলের সময় কাটতে লাগল। এইভাবে অনাসক্ত ও নির্মল হৃদয় ভিক্ষুরা সহজেই বুদ্ধ প্রবর্তিত ধর্মে পারদর্শী হয়ে উঠলেন, এবং অবশেষে বুদ্ধ এবং পাঁচজন ভিক্ষু অর্থাৎ তাঁরা ছয়জন জগতে প্রথম অর্হত হলেন। অর্থাৎ সাধনায় সর্বোচ্চ অভীষ্ট লাভ করলেন।
ক্রমশ