শুভময় মিশ্রের আগের লেখাঃ- দুই বুড়ির গল্প
জয়ঢাক গল্প প্রতিযোগিতা-২০১৬ পঞ্চম স্থানাধিকারী গল্প
এ প্রতিযোগিতা হয়েছিল রাজকুমার রায়চৌধুরিমশাইয়ের অসামান্য সাইফি “তাতিয়ানার মোবাইল“-এর একটা উপযুক্ত সিকোয়েল লেখবার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে। সে চ্যালেঞ্জ নিয়েছিল বেশ কিছু তাজা কলম। প্রথম ন’টি গল্প পুরস্কৃত হয়েছে বইমেলায় আমাদের অনুষ্ঠানে। প্রথম তিন আসবে পুজো সংখ্যায়। তার পরের বিজয়ীদের মধ্যে চার ও পাঁচ নম্বর বের হল এ সংখ্যাতে।
অনেকক্ষণ ল্যাপটপে কাজ করার পরে চোখ দুটো করকর করছে তাতিয়ানার, কপাল টিপটিপ করছে আর ঘাড় টনটন করছে। চোখ বন্ধ করে মাথাটা একটু এলিয়ে দিতে পারলে আরাম হত, কিন্তু উপায় নেই। এতক্ষণ বিছানায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছিল তাতিয়ানা, এবার আধশোয়া হয়ে একটু আরাম করে লেখাটাকে সাজাতে লাগল। লেখার কাজটা কালকের মধ্যে শেষ করে ডঃ গুপ্তকে দেখিয়ে নিতেই হবে। তারপর তিনি ঠিকঠাক করে দিলে পাঠিয়ে দিতে হবে এই সপ্তাহের মধ্যে। যদি বিষয়বস্তুটা কর্তৃপক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় তবে নাসার এই সেমিনারটাতে ও একটা বক্তব্য রাখার সুযোগ পাবে। বিশ্বের বিখ্যাত বিজ্ঞানী আর সেরা গবেষকদের সামনে বক্তব্য রাখার গুরুত্বই অন্যরকম। ভাবতেই উত্তেজনার চোটে যেন কিবোর্ডের ওপর হাতের চলার স্পিড বেড়ে দু’গুণ হয়ে গেল।
বালিশের কাছে পড়ে আছে বহু পুরানো একটা মোবাইল। একটা মেসেজ আসতেই বিপ শব্দ করে স্ক্রিনের আলোটা একবার জ্বলে উঠেই পুরো কালো হয়ে গেল। মরুকগে যাক; তাতিয়ানার এখন মেসেজ পড়ার সময় নেই। আর এই মোবাইলটাতে মেসেজ পড়তে গেলে অনেকটা সময় চলে যাবে। এরকম মোবাইল আজকাল আর কেউ ব্যবহার করে না, বাজারেই পাওয়া যায় না। এটা সেই মোবাইল, যেটা তাতিয়ানার বাবা তাকে কিনে দিয়েছিলেন ক্লাস টেন-এ ভালো রেজাল্ট করার জন্য; সেও তো হয়ে গেল প্রায় দশ বছর। পুরানো নোনা ধরা দেওয়ালের মতো মোবাইলটার রং চটে গিয়েছে, ছাল চামড়াও উঠে গেছে জায়গায় জায়গায়। ডিসপ্লে আর টাচ-স্ক্রিনটার অবস্থা কহতব্য নয়! টোকা মেরে, ঝাঁকুনি দিয়ে চালু করতে হয়। এটার প্রতি তাতিয়ানার একটা আলাদা রকম টান থাকায়, খুব সুন্দর একটা মোবাইল থাকা সত্ত্বেও এই সেটটা এখনও তাতিয়ানার সঙ্গী।
আজকের তাতিয়ানা হওয়ার পেছনে মোবাইলটার অনেক অবদান আছে বৈকি! এই মোবাইলটাতেই কয়েকটা অদ্ভুত ভাষায় মেসেজ এসেছিল বলে সারা পৃথিবীতে হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল, বছর দশেক আগে; বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল তাতিয়ানা। ভারতবর্ষের তাবড় পন্ডিতদের সঙ্গে নাসার বড়ো বড়ো বিজ্ঞানীরা মাথা ঘামিয়েছিলেন ঐ মেসেজের মানে বের করার জন্য। সে সব ইতিহাস শ্রী রাজকুমার রায়চৌধুরী মশায় লিখে রেখে গেছেন ‘জয়ঢাক’-এর পাতায়।
যাই হোক, এসব যখন ঘটে তখন তাতিয়ানা সবে স্কুলের শেষ ধাপে – ক্লাস টেন, এমন গুরুগম্ভীর বিষয়ের গভীরে গিয়ে বোঝার মতো বয়স নয়। ওই সময় সাধারণতঃ ছেলেমেয়েরা গবেষণার চেয়ে গল্পের খোঁজ বেশি রাখে। তাতিয়ানাও তাই করত; ই টি, এলিয়েনস, স্টার ওয়ার ইত্যাদি সিনেমা দেখে বা চ্যারিওট অফ গড, চাইল্ডহুড এন্ড, ফুট ফল, প্রফেসর শঙ্কু, বঙ্কু বাবু ইত্যাদি পড়ে যেটুকু ধারণা হতে পারে বহির্বিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব সম্পর্কে সেটুকুই সম্বল ছিল তখন। তবু মোবাইলটা তাতিয়ানার হওয়ায়, সে বিখ্যাত হয়ে পড়ে কিছু না বুঝেই। যেমনতেমন বিখ্যাত নয়, নিয়মিত ভাবে কাগজে ছবি বের হত, টিভিতে আলোচনায় তাকে ডাকা হত।
একটু বিখ্যাত হয়ে গেলে অনেকের মগজ বিগড়ে যায়। কিন্তু তাতিয়ানার তা হয়নি। বিষয়টা নিয়ে হালকা চালে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে সে রীতিমত উৎসাহী হয়ে বইপত্র, জার্নাল ইত্যাদি জোগাড় করে পড়াশুনো শুরু করে দেয়, ইন্টারনেট তো ছিলই। ওর দাদার প্রফেসর ডঃ খাসনবিশ আর নাসার বিজ্ঞানী ডঃ শ্রীনিবাসন ওকে এ ব্যাপারে খুব উৎসাহ দেন। পুরোপুরি না বুঝলেও বড়ো বড়ো গবেষক আর বিজ্ঞানীদের আলোচনা সে মন দিয়ে শুনত, বইপত্র পড়ত, চেষ্টা করত বোঝার। এইরকম আগ্রহ আর পড়াশুনোর ফল হাতেনাতে পেয়েছে তাতিয়ানা। স্কলারশিপ নিয়ে দেশের সেরা কলেজে পড়াশুনো করে তাতিয়ানা এখন গবেষণা করছে বিখ্যাত বিজ্ঞানী ডঃ গুপ্তর কাছে।
মহাবিশ্বে পৃথিবী ছাড়া কোথাও যদি বুদ্ধিমান প্রাণী থাকে, তাহলে তাদের আচার আচরণ স্বভাব চরিত্র কেমন হতে পারে, তাদের সঙ্গে ভাব বিনিময়ের মাধ্যম কী হতে পারে, কী ভাবে বোঝা যেতে পারে তারা বন্ধু না শত্রু – একেবারে নতুন ধরনের বিষয় নিয়েই তাতিয়ানার গবেষণা। এ যেন রাম জন্মানোর আগেই রামায়ণ লেখা। তবে এলিয়েন, ইউফো ইত্যাদির গুজব বা রুদ্ধশ্বাস সিনেমাগুলোর আড়ালে বিজ্ঞানীরা সত্যিকারের গবেষণা চালিয়ে গেছেন মহাবিশ্বে মানুষের দোসর খুঁজে বার করার জন্য। যত দিন গেছে, লুকিয়ে থাকা দোসরের অস্তিত্ব নিয়ে বিজ্ঞানীদের মনে ধারণা দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে। সেই সঙ্গে অজানা প্রতিবেশীর সম্বন্ধে প্রাথমিক ধ্যানধারণা তৈরির চেষ্টাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই নতুন বিষয়ের মধ্যে কসমোলজি, সাইকোলজি, বিহেভিয়ারাল সায়েন্স, সব মিলেমিশে একাকার; আর চারটে পিলারের মত ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি-অঙ্ক-বায়োলজি তো আছেই। হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন বিজ্ঞানীর মধ্যে ডঃ গুপ্ত সারা পৃথিবীতে এ বিষয়ে একজন পথিকৃৎ বলে স্বীকৃত। বছর দশেক আগে তৈরি হওয়া যোগাযোগের ভিত্তিতে বিভিন্ন মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র থেকেও অনেক সাহায্য – বিশেষ করে বইপত্র, জার্নাল খুব সহজে পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে তাতিয়ানার গবেষণা তরতরিয়ে এগোচ্ছে।
সে যাই হোক, সেদিন বিকেলের দিকে ইউনিভার্সিটিতে ডঃ গুপ্তর ঘরে বসে নাসার সেমিনারের বিষয়বস্তু নিয়ে তাতিয়ানা আলোচনা করছিল। ডঃ গুপ্ত সেমিনারের বক্তব্যটাকে কীভাবে সাজানো যেতে পারে তা আগেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। তাতিয়ানা সেই মতো একটা খসড়া বানিয়ে ফেলেছে। ডঃ গুপ্ত তাতে প্রয়োজনীয় পরিমার্জন করছিলেন। সঙ্গে মুখে মুখে সব তথ্য একপ্রস্থ ঝালিয়ে নেওয়া চলছিল সেমিনারের বক্তৃতার জন্য। তাতিয়ানা জানে, এই ধরণের সেমিনারে হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়, কত রকম পরিস্থিতি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সামাল দিতে হয়।
কথায় কথায় ডঃ গুপ্ত বললেন, “বহির্বিশ্বে বুদ্ধিমান প্রাণীর খোঁজ বের করার জন্য এতদিন ধরে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা যা যা করেছেন তার একটা সারমর্ম তৈরি করে নিয়েছ নিশ্চয়ই।”
তাতিয়ানা সম্মতি জানিয়ে বলল, “মোটামুটি তৈরি আছে স্যার, বিভিন্ন সময় মহাবিশ্বের বিভিন্ন দিকে পাঠানো রেডিও মেসেজ-এর একটা ছোট্ট বিবরণ তৈরি আছে; তাতে ‘কসমিক কল ১’, ‘কসমিক কল ২’, ‘টিন এজ মেসেজ’ ইত্যাদির কথা ছোটো ছোটো করে বলে দিয়েছি।”
ডঃ গুপ্ত মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য বললেন, “আর সবচেয়ে বিখ্যাত মেসেজটা?”
“আরাকিবো মেসেজ? বুদ্ধিমান প্রাণীর খোঁজে সৌরজগতের বাইরে মানুষের পাঠানো প্রথম মেসেজ। ওটা আলাদা করে একটু বিশদে বলব।”
“বিশদে মানে? খুব বড়ো যেন না হয়ে যায়?”
তাতিয়ানা বলল, “খুব বড়ো নয়, মেইন পয়েন্টগুলোই বলব। ফ্র্যাংক ড্রেক, কার্ল সাগানের মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের তত্ত্বাবধানে উনিশ’শো চুয়াত্তরে পাঠানো হয়েছিল মেসিয়ার-১৩ নক্ষত্রপুঞ্জ লক্ষ করে। সহজ কোড-এ অনেক তথ্য দেওয়া হয়েছিল – শূন্য থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যা, মূলতঃ হাইড্রোজেন, কার্বন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস দিয়ে তৈরি আমাদের ডি.এন.এ-র ডবল হেলিক্স গঠন, মহাবিশ্বে সৌরজগতের অবস্থান আর সংক্ষিপ্ত বিবরণ। মানুষ আড়েবহরে কতটা, কেমন দেখতে তাও ছিল। এখনও কোনও জবাবি সাড়া পাওয়া যায়নি, তাও উল্লেখ করে দেব। এত তাড়াতাড়ি উত্তর আসার কথাও নয়!”
বলেই হঠাৎ চুপ করে গেল তাতিয়ানা। অনেকটা দূর, অনেক সময় লাগবে এসব জানা ছিল, কিন্তু আজ আলোচনা করতে গিয়ে অঙ্কটা নতুন ভাবে উপলব্ধি করল সে। পৃথিবী থেকে মেসিয়ার-১৩ পঁচিশ হাজার আলোকবর্ষ দূরে আছে। তার মানে, আলোর বেগে ছুটে রেডিও মেসেজটা ওখানে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে কেউ ওটার উত্তর দিলে, উত্তরটা পৃথিবীতে পৌঁছবে পঞ্চাশ হাজার বছর পরে, মোটামুটি ৫১৯৭৪ সালে।
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ডঃ গুপ্ত হেসে বললেন, “এই পঁচিশ হাজার, পঞ্চাশ হাজার সংখ্যাগুলো মহাবিশ্বের বিশালতার তুলনায় চুনোপুঁটি নয় কি?”
এবার তাতিয়ানা সন্দেহাকুল হয়ে বলল, “স্যার, পঞ্চাশ হাজার বছর পরে কী উত্তর আসতে পারে তা নিয়ে এখন মাথা ঘামিয়ে লাভ আছে কী?”
“ঠিক এই প্রশ্নটাই উঠতে পারে সেমিনারে, উত্তরটাও ভেবে রাখা দরকার।”
ইতিমধ্যে চা এসে গেছিল। চায়ে চুমুক দিয়ে ডঃ গুপ্ত গম্ভীর হয়ে বললেন, “তাতিয়ানা, একজন গবেষক ঠিক এভাবে ভাবে না। আপেল পড়ার কারণ নিয়ে নিউটন মাথা না ঘামালেও পৃথিবীতে দিনরাত্রি হত। কিন্তু উনি গবেষণা শুরু করেছিলেন বলেই প্রায় তিনশো বছর পরে আমরা আবহাওয়ার হালচাল বোঝার জন্য কৃত্রিম উপগ্রহ ভাসিয়ে রাখতে পেরেছি। আর বৃষ্টির খবর নিয়ে একজন কৃষক চাষের পরিকল্পনা করে, ঝড়ের খোঁজ নিয়ে একজন জেলে সমুদ্রে মাছ ধরতে বেরোয়।”
চায়ে আরেকবার চুমুক দিয়ে ডঃ গুপ্ত ব্যাপারটা হালকা করার জন্য বললেন, “নিউটন কি গ্র্যাভিটি নিয়ে গবেষণার সময় ভেবেছিলেন একটা একশো মিলিয়ন ডলারের সিনেমা তৈরি হবে সেটা নিয়ে!”
একটু থেমে আবার বললেন, “তোমার কি সত্যি মনে হয় আমাদের গবেষণা অর্থহীন?”
নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছে তাতিয়ানা। এটাও বুঝে গেছে, একটা বেফাঁস মন্তব্যের জালে সে আটকে পড়েছে। ডঃ গুপ্ত এখন তার মুখ দিয়েই তার ভুল শোধরাবেন। ভাবনাগুলোকে একটু গুছিয়ে নিয়ে তাতিয়ানা বলল, “যে কোনও প্রাণীর স্বভাব-চরিত্র আচার-আচরণ তার পরিবেশ আর ডি.এন.এ-র ওপর নির্ভর করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ পাল্টাতেই পারে আর তার সঙ্গে জিন বা ডি.এন.এ-র চরিত্রও পাল্টাতে পারে। ব্যাপারটা হয়তো অল্প সময়ে বোঝা না গেলেও লম্বা সময়ে ভালোভাবে বোঝা যায়।”
“লম্বা সময় মানে কতটা সময় তাতিয়ানা?”
“তা ধরুন বেশ কয়েকশো বছর বা কয়েক হাজার বছর।”
“তোমার বলা দুটো সংখ্যার মধ্যে দশ সংখ্যাটা ঢুকে আছে, একশোও ঢুকে থাকতে পারে। কয়েকশো না কয়েক হাজার?”
“হাজার স্যার।”
“উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে পারো?”
“প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে শান্তির খোঁজে সম্রাট অশোক মানবকল্যাণ ব্রত নিয়ে সারাজীবন ব্যয় করেছিলেন। এখন শান্তির পথে চলতে চেয়ে লিঙ্কন আর গান্ধী গুলিবিদ্ধ হলেন। শান্তির পথ ছেড়ে উগ্রপন্থায় আসাটা কিন্তু একদিনে হয়নি, প্রায় আড়াই হাজার বছর লেগেছে অশোক থেকে ওসামায় আসতে। এই ধরনের স্বভাবগত পরিবর্তন আরও বেশি করে হবে সময়টা যত লম্বা হবে।”
“উদাহরণটা পুরোপুরি মানতে পারলাম না, অশোক থেকে ওসামায় আসতে আড়াই হাজার বছর লেগেছিল ঠিকই, কিন্তু চণ্ডাশোক থেকে ধর্মাশোক হতে হয়তো এক মুহূর্ত বা একদিন, বড়োজোর এক বছর লেগেছিল। সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ঠিকই, কিন্তু আরেকটা জরুরি বিষয় তোমার নজরে আসছে না।”
“স্যার, একটু আন্দাজ পেলে ভেবে বলতে পারি।”
“তুমি যে উদাহরণ দিলে তাতে একটা ফাঁক থেকে গেছে; আড়াই হাজার বছর আগে অশোকও মানুষ ছিলেন, এ যুগে মানুষই আছি। তাই পরিবর্তনগুলো বিচার করা অনেকটাই সহজ। যদি ধরে নিই মহাজাগতিক ধুলোর মধ্যে ভেসে বেড়ানো অণুজীব থেকে পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ হয়েছে, তাহলে অন্য কোনও গ্রহেও তাই হয়েছে হয়তো।”
তাতিয়ানা এই প্যানস্পার্মিয়া (Panspermia) ব্যাপারটা নিয়ে একটু পড়াশুনো করেছে; নারলিকার, বিক্রমাসিংহে, ফ্রেড হয়েল-এর মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের এই ব্যাপারে গবেষণার কথাও জানে। কিন্তু ডঃ গুপ্তর বক্তব্য সে বুঝতে পারেনি।
তাতিয়ানাকে চুপ থাকতে দেখে ডঃ গুপ্ত বললেন, “অন্য পরিবেশে যে প্রাণীরা তৈরি হবে তারা মানুষের মতোই হবেই এমন কোনও কথা নেই। এখানে নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, হাইড্রোজেন আর কার্বনের বাহুল্য একরকমভাবে কোষের গঠনকে প্রভাবিত করেছে। এমন যদি একটা গ্রহ থাকে যেখানে কার্বনের চেয়ে সিলিকনের প্রভাব বেশি বা নাইট্রোজেনের চেয়ে ক্লোরিনের তাহলে কি জোর দিয়ে বলা যায় সেখানেও ডি.এন.এ-র গঠন ডবল হেলিক্স হবে! তখন কি ওই প্রাণীর আচরণ মানুষের মতো হবে? তাই অন্য গ্রহ উপগ্রহের গঠন আর পরিবেশ আন্দাজ করে তোমায় ভাবতে হবে এখন এই সময়ে তাদের আচরণ কেমন হতে পারে, তারপরে পঞ্চাশ হাজার বছরে পরিবর্তনের হিসেব কষতে হবে। সেটাই যুক্তিযুক্ত নয় কি?”
তাতিয়ানা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, এই দিকটা তো কখনোই ভেবে দেখেনি। যত দিন যাচ্ছে, যত বিষয়টার গভীরে ঢুকছে সে, তত অবাক হয়ে যাচ্ছে এর ব্যাপ্তি দেখে।
ডঃ গুপ্ত তাঁর পরের প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন এবার, “এটা ভাবার কি কোনও কারণ আছে যে শুধু আমাদের পাঠানো মেসেজের উত্তরের জন্য আমরা অপেক্ষা করব? বিভিন্ন গবেষণা কেন্দ্রে হঠাৎ করে ধরা পড়া কিছু রেডিও সিগন্যালের গুরুত্ব নেই?”
তাতিয়ানা সম্মতি জানিয়ে তার মতামত বিশদে ব্যাখ্যা করল। এই সিগন্যালগুলো ঠিক কোথাও ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসা সিগন্যাল বা নিরন্তর চলতে থাকা মহাজাগতিক ঘটনা থেকে তৈরি গোলমাল বা নয়েজ নয়। পুরোপুরি মানে বোঝা না গেলেও তাদের গঠনগত বৈশিষ্ট্য থেকে মনে হয় সুচিন্তিত ভাবে তাদের তৈরি করা হয়েছে।
ডঃ গুপ্ত বললেন, “বিভিন্ন কারণে বিজ্ঞানীরা মনে করেন অন্য কোথাও বেড়ে ওঠা বুদ্ধিমান প্রাণীরাও পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে আগ্রহী। তারাও একইরকমভাবে সিগন্যাল পাঠিয়ে নিজের দোসর খুঁজে যাচ্ছে। আসলে মহাবিশ্বে প্রাণের হদিস বার করার চেষ্টাটা খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার চেয়েও কঠিন।”
“অন্য জগৎ থেকে আসা বুদ্ধিমান প্রাণীদের আপ্যায়নের জন্য শেষে খড়! আর লড়াই করার জন্য সূঁচ!” বলতে বলতে পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকলেন ডঃ মিত্র। ইনিও বিখ্যাত বিজ্ঞানী, মূলতঃ পদার্থবিদ্যা এঁর বিষয়। মাঝে মাঝে দুই বন্ধুতে একটু গল্প করেন; তবে সে গল্প তাতিয়ানার মত গবেষকদের কাছে গবেষণাপত্র পড়ার সমান।
দুই প্রবীণ অধ্যাপক হো হো করে হেসে উঠলেন। ডঃ গুপ্ত হাসতে হাসতে বললেন, “এই মুহূর্তে অন্য জগতের জীব নয়, অন্য বিষয়ের পন্ডিত আমাদের সামনে হাজির। তাই খড় নয়, চা বা কফি আনাতে পারি। আর আপনার সঙ্গে লড়াই করার মতো প্রশ্ন আজ তাতিয়ানার হাতে আছে।”
“ওয়াও, মনটা অনেকক্ষণ চাতকের মতো চা চা করছিল। ওয়াও সিগন্যাল কী জানো?” ডঃ মিত্র প্রশ্নটা করলেন তাতিয়ানার দিকে ঘুরে। তারপর ছদ্ম গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললেন, “অফেন্স ইস দ্য বেস্ট ডিফেন্স।”
আবার একপ্রস্থ হাসি থামলে তাতিয়ানা বলল, “যে সিগন্যালগুলোকে বুদ্ধিমান প্রাণীদের পাঠানো বলে মনে করা হয় তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত উনিশ’শো সাতাত্তরে পাওয়া ‘ওয়াও সিগন্যাল’। ওহিও ইউনিভার্সিটির ‘লম্বকর্ণ’ (Big Ear) রেডিও টেলিস্কোপ প্রায় বাহাত্তর সেকেন্ড ধরে সিগন্যালটা পেয়েছিল; সেটার সুবিন্যস্ত গঠন বিজ্ঞানীদের চমকে দিয়েছিল।”
ডঃ মিত্র প্রশ্ন করলেন, “নামটা কোথা থেকে এল জানো তো?”
তাতিয়ানা উত্তর দিল, “বিজ্ঞানী জেরি এহমান সিগন্যালটার মানে বোঝার চেষ্টা করছিলেন, হঠাৎ করেই বেশ কিছু প্যাটার্ন ওনার নজরে আসে। লাল কালিতে গোল দাগ দিয়ে তিনি আনন্দের চোটে পাশে লিখে দেন ‘ওয়াও’ (WOW)। তারপর কথাটা চালু হয়ে যায়।”
“বাঃ! এ মেয়ে তো জানে দেখছি; চালিয়ে যাও,” ডঃ মিত্র হৈ হৈ করে উঠলেন। তাতিয়ানা প্রশংসা শুনে খুশি হল। ডঃ গুপ্ত চুপচাপ ধরণের লোক, কিন্তু মুখে হালকা হাসি ফুটে ওঠায় বোঝা গেল ছাত্রীর প্রশংসা শুনে তিনিও খুশি।
আবার একপ্রস্থ চা এল। চা খেতে খেতে ডঃ মিত্র তাতিয়ানার কাজের বিষয়ে খবরাখবর নিলেন। তারপর বললেন, “চা খেয়ে গায়ের জোর বেড়ে গেছে, এবার বার কর তোমার হাতের অস্ত্র।”
ডঃ গুপ্ত মৃদু হেসে বললেন, “তাতিয়ানা সময় নিয়ে খুব চিন্তিত। রেডিও মেসেজের গতি কম হওয়ায় যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ওর পছন্দ হচ্ছে না। দেখুন আপনি সাহায্য করতে পারেন কিনা!”
“কেন? রেডিও সিগন্যালের তরঙ্গ ধর্ম ওর পছন্দ নয়? বেশ দুলকি চালে চলা, গজেন্দ্রগমন,” ডঃ মিত্র বললেন।
তাতিয়ানা বিব্রতভাবে বলল, “তা নয় স্যার, আলোর বেগে চলে রেডিও মেসেজের মহাবিশ্বের এ কোণ থেকে ও কোণে পৌঁছতে হাজার-লক্ষ-কোটি কত বছর লাগবে জানা নেই; তাই আরও বেশি গতিবেগ সম্পন্ন যোগাযোগের মাধ্যম কিছু আছে কিনা জানতে চাইছিলাম।”
“ও, হাতিতে চলবে না, ঘোড়া চাই,” মন্তব্য করলেন ডঃ মিত্র।
ডঃ গুপ্ত জুড়ে দিলেন, “চিতা হলে ভালো হয়।”
ডঃ মিত্র বললেন, “না ভাই, এখনও ঘোড়া বা চিতাকে জঙ্গল থেকে ধরা যায়নি, পোষ মানানো তো দুরের কথা!”
বিশদে বুঝিয়ে দিলেন ডঃ মিত্র। অঙ্ক বলছে, আলোর চেয়েও জোরে দৌড়তে পারে এমন কিছু থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। একদল বিজ্ঞানী ট্যাকিওন বলে একটা কণার কথা প্রথম বলেন বিশ শতকের ষাটের দশকে; তার মধ্যে দু’জন ভারতীয় বিজ্ঞানীও ছিলেন। যদিও সেই সময়ে এই ‘ট্যাকিওন’ নামটা তাঁরা ব্যবহার করেননি। একটা সময় এটা নিয়ে খুব গবেষণা হয়েছিল, কিন্তু অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করেও ট্যাকিওনের অস্তিত্ব প্রমাণ হয়নি। পরে ‘নিউট্রিনো’ নিয়েও বহু আলোচনা হয়েছে। কিন্তু তার অস্তিত্বও প্রশ্নাতীত নয়। আবার শুধু অস্তিত্ব প্রমাণ করলেই হবে না, দরকার মতো তাকে জোগাড় করে নিয়ন্ত্রিত ভাবে নির্দিষ্ট দিকে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারলে তবেই তা যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে উঠতে পারবে।
মন দিয়ে ডঃ মিত্রর কথা শুনছিল তাতিয়ানা। বারবার তার মনে হচ্ছিল মহাজাগতিক দূরত্ব আর রেডিও তরঙ্গের সীমাবদ্ধতার জন্য প্রতিবেশীকে খুঁজে পেলেও পরিচয় আদানপ্রদান সহজ হবে না। ভাব বিনিময় না হলে বন্ধু না শত্রু বোঝা যাবে কি করে!
আরও কিছুক্ষণ এটা ওটা আলোচনা করে তাতিয়ানা বাড়ি ফেরার জন্য উঠে পড়ল। ডঃ মিত্র নাসার সেমিনারের জন্য আগাম শুভেচ্ছা জানিয়ে রাখলেন। ডঃ গুপ্ত বিষয়বস্তুটা আরেকটু সাজিয়ে নিয়ে পরের দিন আবার আসতে বললেন। তাঁর এই ছাত্রীটিকে তিনি একটু বেশিই পছন্দ করেন। অকারণে নয়, তাতিয়ানার চেষ্টা, ইচ্ছে, জেদ, অধ্যবসায় ইত্যাদি সত্যিই অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি, সবচেয়ে ভালো হল পড়াশুনোর অভ্যেস।
বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে নিজের ঘরে ঢুকে ল্যাপটপ নিয়ে বসল তাতিয়ানা। আজকে যে করেই হোক কাজটা শেষ করে ফেলতে হবে। বিছানায় বসে বা আধশোয়া হয়ে ল্যাপটপে কাজ করা তার অভ্যেস। ল্যাপটপ খুলে ইন্টারনেট কানেক্ট করে কোনও জরুরি মেইল আছে কিনা দেখে নিল। তারপর যতটা লেখা হয়েছে সেটা একবার পুরো পড়ে ছোটোখাটো দু’একটা ভুল, যা নজরে এল, সেগুলো ঠিকঠাক করে নিল। লেখাটা বেশ ভালোই এগোচ্ছে সেটা নিজেই বুঝতে পারল। যেভাবেই হোক লেখাটা আজ রাত্রেই শেষ করে, কাল ডঃ গুপ্তকে দেখিয়ে নিতে হবে। ভাবনাগুলো একটু গুছিয়ে নিয়ে লেখার নতুন অংশটায় এবার হাত লাগাল তাতিয়ানা আর তরতর করে এগোতে লাগল তাতিয়ানার গবেষণাপত্র।
অনেকক্ষণ টানা টাইপ করার পরে তাতিয়ানা বুঝল চোখদুটোকে একটু বিশ্রাম দেওয়া দরকার, ঘাড়টাও টনটন করছে। পুরানো মোবাইলটায় বিপ শব্দ করে একটা মেসেজ ঢুকল বোধহয়। ল্যাপটপে ‘সেভ’ আইকনটা ক্লিক করে মোবাইলটা হাতে তুলে নিল সে। কিন্তু একবারের চেষ্টায় স্ক্রিনটা অন না হওয়ায় আবার রেখে দিল; থাকগে, পরে দেখা যাবে। ল্যাপটপের স্ক্রিনে দেখল “সেভিং ফাইল” দেখিয়ে চাকাটা ঘুরে যাচ্ছে। দু’মিনিট একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য চিৎ হয়ে শুয়ে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে লেখার পরের অংশটা ভাবতে লাগল তাতিয়ানা।
একটু পরে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে আবার লেখায় হাত লাগাতে গিয়ে দেখল তখনও ল্যাপটপের স্ক্রিনে চাকাটা ঘুরে যাচ্ছে। মাউসটা নাড়াতেই হঠাৎ করে স্ক্রিনে চলে এল ‘নট রেসপন্ডিং’। এখন অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। জোর করে ফাইলটা বন্ধ করতে গেলে যদি নতুন অংশটা সেভ না হয়! তেমন হলে ফাইলটা পরে খোলাই যাবে না ঠিকঠাক ভাবে। চাকাটা ঘুরেই যাচ্ছে, ঘুরেই যাচ্ছে।
মিনিটখানেক পরে দেখল ল্যাপটপের স্ক্রিনের ওপর একটা মেসেজ এসেছে – “কানেক্টিং টু রিমোট হোস্ট।” খুব অবাক হল তাতিয়ানা; একটু ভয়ও পেল – নতুন ধরনের ভাইরাস-টাইরাস নাকি! চেষ্টা করতে গিয়ে দেখল কিবোর্ডটাও আর কাজ করছে না। এখন চুপচাপ অপেক্ষা করা ছাড়া আর একটাই কাজ করা যায় – পাওয়ার অফ করে দেওয়া; তবে পরে ‘ফাইল রিকভারি’ না হওয়ার ভয়টা চেপে ধরল তাকে। বিনবিনে ঘাম ফুটে উঠল কপালে, ফ্যানের হাওয়াটা যেন গায়েই লাগছে না।
একটু পরে স্ক্রিনে ধীরে ধীরে একটা একটা করে চিহ্ন ফুটে উঠতে লাগল, মাঝে মাঝে ইংরেজি অক্ষর। এমন ভাইরাসের কথা কখনও শোনেনি তাতিয়ানা, ব্যাপারটা বোঝার জন্য নিরুপায় হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল সে। কিন্তু লক্ষ করে দেখল একটা প্যাটার্ন আছে চিহ্নগুলোর মধ্যে। আরও কিছুক্ষণ পরে ভুতুড়ে অক্ষরগুলো আর দেখা গেল না। তার বদলে ছাড়া ছাড়া ভাবে ইংরেজি শব্দ ফুটে উঠতে লাগল স্ক্রিনে; অর্থহীন নয়, যেন কেউ কিছু একটা বোঝাতে চাইছে। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগল তাতিয়ানা, সঙ্গে তীক্ষ্ণ নজর রাখল স্ক্রিনে।
ব্যাপারটা কিছু সময় পরে মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে গেল ওর কাছে। যার খোঁজে বিজ্ঞানীরা মাথা খুঁড়ে মরছেন বছরের পর বছর, তা আজ তাতিয়ানার নাগালের মধ্যে। এই লেখাগুলোর উৎস অন্তত পৃথিবীতে নয় – সে সম্পর্কে প্রায় নিশ্চিত হল সে। সুযোগটা কাজে লাগাতে তৎপর হল সে, সমস্ত ক্লান্তি নিমেষে উধাও হয়ে গেল। কিবোর্ডটাও ততক্ষণে কাজ করা শুরু করেছে, তাই তাতিয়ানার পক্ষে তথ্য বিনিময় করা সহজ হয়ে গেল খুব; টাইপ করে প্রশ্ন করতে লাগল বা প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগল। বহু সময় ধরে যা লেখালেখি চলল তা ছোটো করে বাংলায় লিখলে ব্যাপারটা এরকম দাঁড়ায়।
“তুমি পৃথিবীর মানুষ, আমাদের এই বার্তা বুঝতে পারছ? আমরা তোমাদের বন্ধু, তোমাদের পাঠানো মেসেজ পেয়েছি।”
“তোমরা কোথা থেকে বলছ?”
“মেসিয়ার-১৩ নক্ষত্রপুঞ্জের এক গ্রহ থেকে।”
“কী করে বুঝব তোমরা পৃথিবীর ক্ষতি করবে না?”
“বিশ্বাস করা ছাড়া তোমার কোনও উপায় নেই।”
“আমদের মেসেজ মানে কি আরাকিবো মেসেজ?”
“ঠিক তাই।”
“কিন্তু সেই মেসেজ তো ওখানে পৌঁছতেই কয়েক হাজার বছর লাগার কথা!”
“ঠিকই, কিন্তু সে হিসেব তোমাদের জন্য। আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা অন্যরকম।”
“কী তোমাদের যোগাযোগের মাধ্যম?”
“ভরহীন একরকম কণা। তোমরা তার অস্তিত্বের সম্ভাবনার কথা জানলেও তাকে ধরতে পারোনি।”
“তোমরা কী করে ধরলে?”
“সে প্রযুক্তি আমাদের জানা আছে। আমরা বহু আগেই তাকে ধরে কাজে লাগিয়েছি।”
“আমাদের পৃথিবীকে খুঁজে পেলে কী করে?”
“অনেক দিন আগেই আমরা তোমাদের খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু তোমাদের ইলেকট্রন নির্ভর প্রযুক্তির সঙ্গে মিলে যেতে পারে এমন কিছু বানাতে আমাদের একটু সময় লেগেছে।”
“এমন কিছু বানালে কী করে?”
“তোমাদের একটা মহাকাশযান অনেকদিন হল খারাপ হয়ে মহাকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তাকে আমরা কাজে লাগিয়েছি। বহুদিন তার যন্ত্রপাতি ঘাঁটাঘাঁটি করে আমরা তোমাদের প্রযুক্তি শিখেছি।”
“জানি, পায়োনিয়ার-১০, বহুদিন হল তার থেকে কোনও সংকেত আসেনি। তোমরা তাকে দখল করেছ কেন?”
“বন্ধু, ওটা খারাপ হয়ে মহাকাশে ভেসে বেড়াচ্ছিল, আমরা তাকে নিজেদের মত করে কাজে লাগিয়েছি। নতুন করে যন্ত্রপাতি লাগিয়ে তাকে আমরা আমাদের আর পৃথিবীর মাঝে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে চালু রেখেছি। এভাবেই আমরা পৃথিবীর সম্বন্ধে জেনেছি।”
“কিন্তু পায়োনিয়ার-এ পৌঁছতে তোমাদের তো অনেক দিন লাগার কথা!”
“এখানেও তোমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে আমরা। আমরা টাইম ট্রাভেল করতে পারি। ‘ওয়ার্ম হোল’ ব্যবহার করার বিজ্ঞানও আমাদের জানা। তোমরা যাকে ‘রোজেন ব্রিজ’ বল, আমরা তার ব্যবহারও জানি।”
“কীভাবে তোমাদের দেখা পাব?”
“তোমরা আমাদের দেখতে পাবে না, কারণ আলো ছাড়া তোমরা অন্ধ। আর আলো আমাদের শরীরে ধাক্কা খায় না।”
“তার মানে?”
“তোমাদের শরীর তৈরি হয় ‘ডবল হেলিক্স’ ডি.এন.এ দিয়ে, আমাদের গঠন অন্যরকম। যাকে তোমরা মেটামেটেরিয়াল বল, আমাদের শরীর তৈরি সেরকম কিছু দিয়ে। তাই তোমাদের চোখে আমরা অদৃশ্য।”
“তোমরা আমাদের দেওয়া নামগুলো জানলে কীভাবে?”
“তোমাদের যত রেডিও তরঙ্গ চারদিকে ছুটে যাচ্ছে অসংখ্য তথ্য নিয়ে, সব আমরা ধরতে পারি বুঝতে পারি। তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা জ্ঞান আমরা ছেঁকে নিয়েছি।”
“অনেকদিন আগে আমরা কিছু মেসেজ পেয়েছিলাম, পৃথিবীর অতি প্রাচীন ভাষায়। তা কি তোমাদের পাঠানো ছিল?”
“ঠিক তাই। তবে পৃথিবীতে এত রকমের ভাষা – শুরুতে আমাদের খুব অসুবিধা হত। তাছাড়া পায়োনিয়ারকে তখনও আমরা ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারিনি।”
“কিন্তু বাছাই করা কয়েকজনকে কেন?”
“তোমরা যারা অনেক বড়ো হয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেছ, যারা তার আগেই বই পড়াটাকে খুব অভ্যেস করে ফেলেছিলে, তাদের সঙ্গেই আমরা যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলাম?”
“কিন্তু কেন? তোমরা কী চাও পৃথিবীর মানুষের কাছ থেকে?”
“জ্ঞান। আমরা আলোতে অভ্যস্ত নয় বলে, যাকে তোমরা ‘বইপড়া’ বল আমরা তা পারি না। আমরা হিসেব করে দেখেছি পৃথিবীর মানুষ যত জ্ঞান লিপিবদ্ধ করেছে, তার অতি সামান্য অংশ রেডিও তরঙ্গে পাওয়া যায়। তাই আমরা বইতে থাকা জ্ঞানের ভাগ নিতে চাই।”
“এত উন্নত তোমাদের বিজ্ঞান, তবু পৃথিবীর জ্ঞান নিয়ে কী করবে তোমরা?”
“বিজ্ঞান-প্রযুক্তির জ্ঞান চাই না। আমরা চাই দর্শন, কাব্য, শিল্পের জ্ঞান – বিশেষ জ্ঞান। আমাদের ওখানে এসব চর্চা লক্ষ বছর আগে বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু প্রযুক্তির চর্চা করতে করতে আমাদের শেষ কয়েক প্রজন্ম দিশেহারা।”
“বিজ্ঞানের চর্চায় দিশেহারা কেন?”
“আমাদের কেউ অংক কষতে কষতে বইয়ের মার্জিনে দারুন সমাধান খুঁজে পাওয়ার কিন্তু জায়গার অভাবে অংকটা কষে রাখতে না পারার কথা লিখে রাখে না। আমাদের কেউ হঠাৎ নতুন কিছু দেখতে পেলে আনন্দে কাগজের ওপর ‘WOW’ লিখে রাখে না।”
“আমরা তো মনে করি বিজ্ঞানের চর্চাই একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ!”
“জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা আনন্দ দেয়, কিন্তু শুধু প্রযুক্তির চর্চা একসময় একঘেয়ে হয়ে যায়। বিজ্ঞানচর্চা থেকে আনন্দটাই আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এ ব্যাপারে তোমরাও একটু সাবধান থেকো।”
“নিশ্চয়ই বন্ধু।”
“কিন্তু জ্ঞান ভাগ করে নিতে তোমার আপত্তি নেই তো, বন্ধু?”
“কখনও থাকতে পারে না। প্রাচীন কাল থেকেই আমরা জানি জ্ঞান বা বিদ্যা কেড়ে নেওয়া যায় না, চুরি করা যায় না, দান করলে কমে যায় না।”
“পরে আবার যোগাযোগ করব। ভুলে যেও না। এখন বিদায়।”
তাতিয়ানা আর কিছু বলার আগেই স্ক্রিনে ফুটে উঠেছিল ‘রিমোট হোস্ট ডিসকানেক্টেড’। নতুন বন্ধুকে ঠিকভাবে বিদায় জানাতেও পারল না সে। কীভাবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে তাও জানা হল না।
*******
মায়ের ঠেলাঠেলিতে উঠে বসল তাতিয়ানা। নিজের খাটেই যে সে বসে আছে, সেটা বুঝে উঠতে একটু সময় লাগল তার। চোখ কচলে দেখল সামনে মা সামনে দাঁড়িয়ে, বলছেন, “কী ঘুম রে বাবা, তখন থেকে ডাকছি! চোখ মুখ ধুয়ে খাবি আয় তাড়াতাড়ি।” হুঁশ ফিরতে নিজেই মনে মনে হাসল। ল্যাপটপটার স্ক্রিন কালো হয়ে আছে, পাওয়ারের বাটনটা দপদপ করছে। পুরানো মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল। কপাল ভালো, একবারের চেষ্টাতেই কাজ করতে শুরু করল ওটা। মেসেজবক্স খুলে দেখল তিন চারটে মেসেজ এসেছে। মেসেজগুলো খুলে দেখতে শুরু করল, বিভিন্ন অদ্ভুত দেখতে চিহ্ন আর অক্ষরে ভর্তি। বুঝতে না পেরে বাধ্য হয়ে বন্ধ করার সময় বিপ শব্দ করে আবার একটা মেসেজ ঢুকল। এটা পরিস্কার ইংরেজিতে লেখা – “ফ্রেন্ড, ইট ওয়াজ নট ড্রিম। টাচ অন দিস মেসেজ টু কন্টাক্ট আস ইন ফিউচার। গুডবাই।”
জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে