প্রতিযোগিতার গল্প প্রথম স্থান-সময়ের ওপার থেকে সৌম্য ব্যানার্জি শরৎ ২০১৭

 এ প্রতিযোগিতা হয়েছিল রাজকুমার রায়চৌধুরিমশাইয়ের অসামান্য সাইফি “তাতিয়ানার মোবাইল“-এর একটা উপযুক্ত সিকোয়েল লেখবার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে। সে চ্যালেঞ্জ নিয়েছিল বেশ কিছু  তাজা কলম। প্রথম ন’টি গল্প পুরস্কৃত হয়েছে বইমেলায় আমাদের অনুষ্ঠানে। জয়ঢাক গল্প প্রতিযোগিতা ২০১৬ –প্রথম পুরস্কার

সৌম্য ব্যানার্জি

“হুম, তো ?”… কম্পিউটারের স্ক্রিন থেকে চোখটা সরিয়ে অর্ঘ্যের দিকে তাকালেন দীপ্তরূপবাবু। কম্পিউটারের মনিটরে “জয়ঢাক” নামের একটি অনলাইন বাংলা পত্রিকার পেজ ভাসছে।

     “স্যার কী মনে হল?”… অর্ঘ্যের কন্ঠে চাপা উত্তেজনা।

     “মনে হচ্ছে তুমি পড়াশুনো ছেড়ে গল্প লেখার প্ল্যান করছ , এর বেশি কিছু তো ভাবতে পারছি না”।

 স্যারের কন্ঠস্বরের শীতলতা অর্ঘ্যকে স্পর্শও করল না , “স্যার , সেটা না , এই লেখাটা পড়ে কোন সম্ভাবনা মাথায় আসছে না?”

“ যা বলবার খুলে বল অর্ঘ্য , হেঁয়ালি কোর না, আর হ্যাঁ গল্পটা খুব ভাল  শিশুসাহিত্য কিন্তু ইনকমপ্লিট , লেখক মনে হয় উপন্যাস লেখার প্ল্যানে ছিলেন ,কিন্তু মাঝপথে কাজের চাপে লেখা থামিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন , আর জয়ঢাকের লোকজন সেটাকেই এখন এনক্যাশ করছে একটা গল্প প্রতিযোগিতা নামিয়ে দিয়ে। এর মধ্যে তুমি উত্তেজক কী পেলে? আর একটা কথা, লেখকের লজিকের সাথে অনেক জায়গায় আমি একমত নই, কিন্তু এটা বাচ্চাদের জন্য লেখা তাই সেটা নিয়ে আমার কাটাছেঁড়া করতে ইচ্ছে করছে না। আর শেষ কথা হল আমি লেখক নই, এতে আমার কোন আগ্রহও নেই ।”

“স্যার, লেখক কিন্তু একজন নামী অধ্যাপক , এবং উনি বিজ্ঞানেরই লোক।”

“উফ্‌ , তাতে কী? তুমি কি গল্প প্রতিযোগিতার জন্য কোন লেখা লিখেছ?  লিখে থাকলে পাঠিয়ে দাও, আমায় বিরক্ত করছ কেন?” … একটু যেন বিরক্তই শোনালো প্রফেসর দীপ্তরূপ মুখার্জীর গলা।

প্রফেসর মুখার্জী তাঁর এই ছাত্রটিকে মারাত্মক স্নেহ করেন , হয়ত একটু অনাবশ্যক রকম বেশি মাত্রাতেই করেন , আসলে অর্ঘ্য ছেলেটা সত্যিকারের ব্রিলিয়ান্ট। স্কুল হোক বা কলেজ, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক , ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা সবেতেই দারুন নাম্বার পায় কিন্তু তার থেকেও অদ্ভুত হল ও কিন্তু পড়ার বইতে মুখ গুঁজে মুখস্ত করে নাম্বার পাওয়া ছাত্র নয়। সিলেবাসের বাইরেও ওর অগাধ পড়াশুনো , নিজের বুদ্ধিতে ছোটবেলাতেই মাঝে মধ্যে দারুণ সব মডেল বানিয়ে সকলের প্রশংসা পেত, কল্পনাপ্রবণ এই সদ্য তরুণের নামে এর মধ্যেই তিন  তিনটে পেটেন্ট রয়েছে। আর অর্ঘ্যের এই কল্পনাপ্রবণতাই অর্ঘ্যকে প্রফেসর মুখার্জীর নজরে এনেছে। প্রফেসর মুখার্জী বিশ্বাস করেন সিলেবাসের বাঁধাধরা পড়াশুনো অবশ্যই করা প্রয়োজন , কিন্তু সেখানেই থেমে থাকলে তোতা পাখির মত একই জিনিস আউড়ে যাওয়াই হবে। জীবনকে ভাল করে বুঝতে চাইলে, নতুন কিছু আবিষ্কার করতে চাইলে আগে একটা সাহসী কল্পনাপ্রবণ মন চাই, আর তা নইলে আমরা সবাই নিছক কূপমন্ডুক ! সেই কল্পনাপ্রবণ মনটাই অর্ঘ্যের আছে । কিন্তু যত দিন যাচ্ছে সেটা লাগামছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আজকেই তো… কোথাও কিছু নেই হঠাৎ ল্যাবে একটা মাইক্রোওয়েভ গ্যাজেট নিয়ে কাজ করতে করতে অর্ঘ্য দীপ্তরূপবাবুকে টেনে নিয়ে এসে একটা বাংলা ওয়েবজিন পড়াতে শুরু করল। জাস্ট কোন কোন মানে হয় না ! কত কাজ জমে আছে সেদিকে খেয়াল নেই  , গল্প পড়তে হবে !

“স্যার, আপনি কি বুঝতে পারছেন কি অসাধারণ একটা সম্ভাবনার কথা লেখা আছে গল্পটাতে !!”

“কিসের সম্ভাবনা? কোন মানে হয়? একটা ছেলেভুলোনো কল্পবিজ্ঞানের গল্প আর তুমি তাই নিয়ে খেপে যাচ্ছ? তোমার কি মনে হয় এটা কোন সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা? তুমি কি এইরকম কোন রিসেন্ট ঘটনার কথা শুনেছ? বা ড. খাসনবীশ বলে যে চরিত্র এইরকম বিষয়ে একটা পেপার লিখে নাসায় হইচই ফেলে দিয়েছেন সেইরকম কোন পেপার পড়েছ? ”

“স্যার ‘তাতিয়ানার মোবাইল’ গল্পটা হয়ত গল্পই ,কিন্তু পুরোটা নয় , এই গল্পের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সম্ভাবনাটা অসাধারণ… লেখক যেখানে থেমে গেছেন তার একটু আগে থেকে ভাবনার সূত্রটা ধরলে একটা নোবেল উইনিং কাজ হতে পারে !!”

“তুমি কি সত্যি করেই মনে করছ যে , নাসার মত সংস্থা, যার পিছনে কোটী কোটি ডলার ঢালা হচ্ছে , বিশ্বের সেরা মাথার বিজ্ঞানীরা যেখানে ভিনগ্রহে প্রাণের সন্ধানে মাথা চুলকোচ্ছে , যারা মহাকাশের  এপ্রান্ত ও প্রান্ত রকেট পাঠিয়ে ফুঁড়ে ফেলছে , তারা ভিন গ্রহের প্রাণীর পাঠানো সংকেত পাবে না, আর তুমি ঘরে বসে মোবাইল দিয়ে তা পাবে?!! এটা কি একটু বেশি রকমের কষ্ট কল্পনা হয়ে গেল না!!”

“ না স্যার আমি তা বলি নি!”

“তবে ?”

“স্যার , আপনার ওই বিজ্ঞানী পেঞ্জিয়াস আর বিজ্ঞানী উইলসনের আবিষ্কারের গল্পটা মনে আছে?”

“কোনটা বলত? ওই মাইক্রোওয়েভ রে আবিষ্কারের গল্পটা?”

“হ্যাঁ স্যার সেইটা !”

“বিপদে ফেললে , আবছা আবছা মনে পড়ছে , সেই ছাত্র জীবনে পড়া, থিওরির কচকচি ঘাঁটতে ঘাঁটতে গল্পগুলো ভুলে গেছি। ঘটনাটা আর একবার বলত!”

আরে ওই তো,১৯৬৪ সালে বিজ্ঞানী পেঞ্জিয়াস আর বিজ্ঞানী উইলসন দুজনে মিলে একটা বড় ‘হর্ন অ্যান্টেনা’তে ‘ইকো বেলুন স্যাটেলাইটে’র থেকে প্রতিফলিত হয়ে আসা রেডিও ওয়েভ নিয়ে গবেষণা করছিলেন , তারপর….

“হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়ে গেছে… আর তা করতে গিয়ে ওনারা একটা নতুন বিকিরন খুঁজে পান , যেটাকে ওনারা প্রথমে পাত্তা দেন নি , পরে ভাবেন ওটা অ্যান্টেনায় পায়রার বাসা করার ফলে তৈরি হওয়া এফেক্ট , কিন্তু কিছুতেই কোন ভাবেই ওনারা সেই রেডিও ওয়েভ এর মানে বুঝতে পারেননি , সেটা বন্ধও করতে পারেন নি , তারপর ওঁদের এক বন্ধু… যদ্দূর সম্ভব প্রফেসর বার্নার্ড এফ বার্কি ওঁদেরকে বিজ্ঞানী রবার্ট ডিকের থিওরীর কথা বলেন এবং ওনারা বুঝতে পারেন যে ওনারা বিগ ব্যাং এর মাইক্রোওয়েভ আবিষ্কার করে ফেলেছেন !!”

“একদম স্যার এটাই বলছিলাম , তবে  প্রফেসর বার্নার্ড এফ বার্কি এই নামটা জানতাম না।”

“হ্যাঁ , অনেকদিন আগে পড়েছিলাম , কিন্তু তারসাথে এই গল্পটার সম্পর্ক কি?”

“স্যার সম্পর্কটা এখানেই যে, লেখক যেটাকে ভিনগ্রহীর পাঠানো মেসেজ বলে ভাবছেন , আসলে সেটা এই পৃথিবীর বুকেই সৃষ্ট কয়েক হাজার বছর আগের এস এম এস এর মাইক্রোওয়েভ রেমনেন্ট হতে পারে, যেটা সামহাউ তাতিয়ানার মোবাইলে ডিটেকটেড হয়েছে !!”

তুমি একটা পাগল !! মোবাইল আবিষ্কার হয়েছে কবে? ইলেক্ট্রিসিটি আবিষ্কার হয়েছে কবে? ইলেক্ট্রিসিটি ছাড়া মোবাইল চলবে !! তুমি কি গল্প পড়তে পড়তে বর্তমান বিজ্ঞানের ইতিহাসটুকুও ভুলে যাচ্ছ নাকি? হাজার বছর আগের এস এম এস !! উফ্‌!!

স্যার, আপনাকে তাহলে একটা শ্লোক বলি… মানেটা আপনি বলুন

                     সংস্থাপ্য মৃন্ময়ে পাত্রে তাম্রপত্রং সুসংস্কৃতম।

                     ছাদয়েচ্ছিখিগ্রীবেন চার্দাভিঃ কাষ্টাপাংসুভিঃ।।

                     দস্তালোষ্টো নিধাত্বয়ঃ পারদাচ্ছাদিতস্ততঃ।

                     সংযোগাজ্জায়তে তেজো মিত্রাবরুণসংজিতম্‌ ।।

ওরে বাবারে , এই ছেলে তো জ্বালালে দেখছি , এখন আবার বাংলা ছেড়ে সংস্কৃত !! আচ্ছা দাঁড়া, দেখছি স্কুল লাইফে শেখা সংস্কৃত ভাষার  মেমরি ঘেঁটে তোর শ্লোকের কতটা মানে উদ্ধার করতে পারি… 

‘মাটির পাত্রে পরিষ্কার তামার পাত ময়ুরের গলার বর্ণের তরলের মধ্যে রেখে রেখে তাতে ভেজা কাঠের গুঁড়ো ভর্তি করে পারদাচ্ছাদিত দস্তার টুকরো সাজিয়ে দিলে মিত্রোবরুণ তৈরি হবে।’

কিরে কাছাকাছি গেছি?”

“একদম ঠিক স্যার, কিন্তু ভিতরের অর্থটা বুঝলেন?”

“আরে তাইতো এত প্রায় ব্যাটারির ডেস্ক্রিপশন , তুই আমায় সংস্কৃতে শোনালি ।”

“স্যার এটা আমি শোনাই নি , এটা অগস্ত্য সংহিতার  শ্লোক !! কয়েক হাজার বছর আগের এই শ্লোক স্যার ব্যাটারিকেই বর্ণনা করছে !!”

“বটে !! আমায় একটু ভাবতে দে, তুই এখন যা … হঠাৎ প্রচন্ড গম্ভীর হয়ে গেলেন দীপ্তরূপবাবু।”

অর্ঘ্য মনে মনে খুশি হয়ে উঠল। ও স্যারের এই রূপ চেনে , স্যার এখন অনেক কিছু ভাববেন , এবং এই নিয়ে পড়াশুনো শুরু করবেন । তার মানে ও স্যারকে বোঝাতে পেরেছে ও কি বলতে চায় !! প্রফেসর দীপ্তরূপ মুখার্জীর খুব নামডাক এই মোবাইল ও মাইক্রোওয়েভ নিয়ে রিসার্চের ফিল্ডে , বিদেশেও ওঁর খুবই নামডাক … দেখাই যাকনা কি হয়…

পরের দিন অর্ঘ্যের কলেজ কি একটা কারণে ছুটি ছিল… একটু দেরি করেই ঘুম থেকে ওঠার প্ল্যান ছিল ওর। মোবাইলের অ্যালার্মগুলো অফ করে দিয়েছিল।  কিন্তু বিধি বাম। সাতসকালে মোবাইলটা বেজে উঠে ওর ঘুমটা ভাঙিয়েই দিল। আননোন নাম্বার…

“ হ্যালো”… ঘুম জড়ানো তেতো গলায় ফোনটা রিসিভ করল।

 “ হ্যালো এটা কি অর্ঘ্য ব্যানার্জীর নাম্বার?”

 “হ্যাঁ, আমি অর্ঘ্য , আপনি কে বলছেন?”

 “অর্ঘ্যদা আমি তন্ময় বলছি, প্রেসিডেন্সির ফিজিক্সে অনার্সের সেকেন্ড ইয়ার । আমার কলেজের এক সিনিয়র সৌমেন্দুদার কাছ থেকে তোমার নাম্বারটা পেয়ে ফোন করলাম।”

 “ও , হ্যাঁ সৌমেন্দু আমার খুব ভাল বন্ধু , তা বল , এত সকালে ফোন করলে , কী ব্যাপার?” অর্ঘ্যের গলাটা মনে হয় একটু বিরক্তই শোনালো !

 “ এই রে , স্যরি দাদা, বিরক্ত করে ফেলেছি , আমি কি পরে ফোন করব?” একটু অপ্রতিভই শোনালো তন্ময়ের গলাটা।

“ না ঠিক আছে , বল , অসুবিধা নেই”… অর্ঘ্য এবার একটু আত্মসচেতন , তার অনিচ্ছাকৃত দুর্ব্যবহার ঢাকতে।

“ আসলে আমার বোনের মোবাইলে কয়েকটা অদ্ভুত এস এম এস এসেছে… সেই নিয়েই আমি অনেকের কাছে গেছি , তা প্রফেসর দীপ্তরূপ মুখার্জীর সাথে আমায় যোগাযোগ করতে বলেছিলেন আমার স্যার ডঃ নবারুণ খাসনবীশ , ওঁকে কন্ট্যাক্ট করতে পারছিলাম না, তখনই সৌমেন্দুদা তোমার নাম্বারটা আমায় দিয়ে বলল তুমি চাইলে সহজেই ওঁর সাথে কথা বলিয়ে দিতে পারবে , তাই উত্তেজনায় সকাল সকালই ফোনটা করে ফেলেছি!!”

ডঃ নবারুণ খাসনবীশ নামটা অর্ঘ্যের মাথায় একটা বিশাল ধাক্কা দিয়ে দিল… ওর ঘুম ছুটে গেছে… উত্তেজিত গলায় ও বলে উঠল

“তন্ময় , তোমার বোনের নাম কী?”

“তাতিয়ানা। কেন?”

“তুমি আমার বাড়ির অ্যাড্রেসটা নোট করে নাও , যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখানে চলে এস , তোমাকে নিয়ে আমি দীপ্তরূপ স্যারের বাড়ি চলে যাব।তোমার বোনের মোবাইলটা আনতে ভুলো না , আর বাড়িতে বলে দিও ব্রেকফাস্ট এবং লাঞ্চ তুমি আমার সঙ্গেই এখানে করবে।”

দীপ্তরূপবাবুর বাড়ি পৌঁছে তন্ময় সব কিছু বলল। জয়ঢাকে বের হওয়া গোটা গল্পটা আসলে সত্যি ঘটনাই , শুধু শেষটুকু ছাড়া। তাই গল্পটা ওইরকম হঠাৎ করে শেষ করে দিতে লেখক বাধ্য হয়েছেন । কারণ এটা গল্প নয় সত্যি এবং এর শেষ এখনও হয়নি !! আস্তে আস্তে গোটা ব্যাপারটা অর্ঘ্যের কাছে পরিষ্কার হল। প্রফেসর খাসনবীশ ছিলেন প্রফেসর দীপ্তরূপ মুখার্জীর জুনিয়র। অনেক বছর ওঁদের সরাসরি যোগাযোগ নেই । দীপ্তরূপবাবুও নবারুনের পদবি ভুলে গেছেন … আসলে উনি প্রফেসর খাসনবীশকে ‘নবা’ বলে ডাকতেন, সেই ডাকনামটুকুই স্মৃতিতে আছে। প্রফেসর খাসনবীশকে নাসা ডেকে নিলেও উনি তাতিয়ানার দাদা তন্ময়ের সাথে যোগাযোগটা রেখেই গেছেন, উনিই তন্ময়কে ‘দীপ্তদা’র কথা বলেন। দীপ্তরূপবাবু যে মাইক্রোওয়েভ নিয়ে গবেষণা করছেন এবং মোবাইল কমিউনিকেশন সিস্টেম আসলে মাইক্রোওয়েভের উপরেই নির্ভরশীল , তা উনিই তন্ময়কে বোঝান। শেষে বলেন, উনি নাসাতেই ওঁদের আরেক কমন বন্ধুর কাছে শুনেছেন প্রফেসর মুখার্জী এখন নাকি কলকাতাতেই আছেন; তাই তন্ময়ের এই খোঁজ। তবে প্রফেসর খাসনবীশের পেপারটা প্রচন্ড বিতর্কিত হওয়ায় শেষ মূহুর্তে প্রথমসারীর জার্নালগুলো ছাপবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয় , ফলে ওঁর লেখাটা দীপ্তরূপবাবুর চোখে পড়েনি। আর তাতিয়ানার খবরটাও কোন অজ্ঞাত কারণে প্রথমসারির বাংলা খবরের চ্যানেল বা কাগজগুলোও এড়িয়ে গেছে… হয়ত বিতর্ক এড়ানোর জন্যেই। কি ভাগ্যিস জয়ঢাকে ওই গল্পটা লেখা হয়ে বেড়িয়েছিল।

তন্ময়ের মুখ থেকে সমস্তটা শুনে এবং মেসজগুলো দেখে দীপ্তরূপবাবু  তন্ময়ের হাত থেকে মোবাইলটা প্রায় কেড়ে নিয়ে নিজের পার্সোনাল ল্যাবে ঢুকে গেলেন , পিছন পিছন ওরা দুজনেও ঢুকল ! তন্ময় মারাত্মক রকম ভয় পেয়ে গেল যখন দেখল তিনি অত্যন্ত নির্মম ভাবে অবলীলায় মোবাইলটার প্রত্যেকটা পার্টস আলাদা করে ফেলছেন এবং তার সার্কিটগুলো পরীক্ষা করছেন। একে বোনের অনেক সাধের মোবাইল , তার উপরে এত সব ইম্পর্টেন্ট মেসেজ আছে মোবাইলটায় !! যদিও এর সমস্ত ডেটা অর্ঘ্য আগেই ওর মোবাইলে সেভ করে নিয়েছে , তন্ময়ও নিজের কম্পিউটারে কপি করে রেখেছে, তবুও , মোবাইলটা যদি তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে !! তন্ময়ের গলা শুকিয়ে আসছিল।

ওর ভয়টা অর্ঘ্য আঁচ করতে পেরেছিল । ও মুচকি হেসে ফিসফিস করে বলল

“ ভয় পেও না তন্ময় , তোমার মোবাইলের কোন ক্ষতি হবে না , উনি মোবাইল টেকনোলজির প্রথমসারির একজন বিজ্ঞানী। ভারতে উনি আসার পরেই মোবাইলের এই জয়জয়কার শুরু হয়েছে…” অর্ঘ্য হয়ত আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই স্যার বলে উঠলেন

“অর্ঘ্য , ইউ আর রাইট!!” চাপা উত্তেজনা স্যারের গলায়! শিগগির আমার আর তোমার মোবাইলটা নিয়ে এস !!

অর্ঘ্য নিজের আর স্যারের মোবাইলটা এনে দিতেই  স্যার প্রথমে সেই মোবাইল দুটোও খুলে ফেললেন। তারপর বেশ কয়েকটা সার্কিটে সামান্য কিছু অদলবদল করে মোবাইল সেট দুটো অন করলেন… পুরো ম্যাজিক !! পরপর বেশ কিছু মেসেজ এসে ঢুকল ওই মোবাইল দুটোতেও ,এর মধ্যে তাতিয়ানার মোবাইলে আসা মেসেজও আছে। সবই অজানা সব চিহ্ন । তন্ময় অবাক হয়ে দেখল প্রফেসর মুখার্জী অর্ঘ্যকে জড়িয়ে ধরেছেন তাঁর দুচোখে জল , অর্ঘ্যও প্রায় নাচছে… তন্ময় কিছুই বুঝতে পারছে না, ওর এখনও ভয় করছে কারণ তাতিয়ানার মোবাইলটা স্যার এখনো জোড়েননি !!

ওরা তিনজন এখন প্রফেসর দীপ্তরূপ মুখার্জীর বসার ঘরে , একটু আগে স্কাইপেতে প্রফেসর খাসনবীশের সঙ্গেও কথা হয়েছে ওদের।প্রায় বেশীরভাগই টেকনিকাল শব্দ , তন্ময় বেশীটাই বোঝেনি , অর্ঘ্যও যে সবটা বুঝেছে তা নয় । তবে তন্ময় আপাতত নিশ্চিন্ত কারণ তাতিয়ানার মোবাইল আপাত ভাবে ঠিকই আছে বলে মনে হচ্ছে , কোন ডেটাও লস হয়নি। প্রথম কথা বলল ও-ই…

“ স্যার আমি কিছুই বুঝতে পারছি না , একটু বুঝিয়ে দেবেন?”

“ আমি নই , বোঝাবে অর্ঘ্য , কারণ মেইন কন্সেপ্টটা ওই আমার মাথায় ঢুকিয়েছে। আমি তো ভাবতেও পারিনি  এটা, পাত্তাই দিতে চাইনি ওকে !!”

অর্ঘ্য মৃদু হেসে বলতে শুরু করল –“ আসলে বুঝলে তন্ময়, মানব সভ্যতার সঠিক ইতিহাসটা আজও আবছা , তবে খুব সম্ভব এক এক  সময়ে এক একটা সভ্যতা গড়ে উঠেছে তারপর কোন কারণে তা ধ্বংস হয়েছে এবং পৃথিবীর ইতিহাসে এরপর একটা করে অন্ধকার যুগ এসেছে, যখন আগের সেই সমস্ত আবিষ্কার নষ্ট হয়ে গেছে , তথ্য প্রমাণ লুপ্ত হয়েছে। মানুষ আবার কেঁচে গন্ডুষ করে একই জিনিস নতুন করে আবিষ্কার করেছে , হয়ত রূপটা একটু পাল্টেছে কিন্তু মোটের উপর কন্সেপ্টগুলো একই। তুমি যদি অগস্ত্য সংহিতা পড়, সেখানে তুমি দেখবে তাতে ব্যাটারির বর্ণনা দেওয়া আছে, বাল্মীকির রামায়নে রাবণের পুষ্পক রথের বর্ণনার সাথে আধুনিক হেলিকপ্টারের বেশ মিল পাবে, এগুলো হয়ত নিছকই কাকতালীয় নয়।

এখন তুমি নিশ্চয়ই জান, মোবাইলে আমরা যে কথা বলি , বা এস এম এস পাঠাই তা আসলে কিছু বিশেষ উপায়ে মাইক্রোওয়েভে পরিবর্তন করা হয় এবং যে মোবাইলে আমরা সেটা রিসিভ করি , তা আবার সেই মাইক্রোওয়েভকে ছবি বা শব্দে রূপান্তরিত করে। মাইক্রোওয়েভের মত রেডিও ওয়েভ সময়ের সাথে এনার্জি লস করতে থাকবে এবং তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য বাড়তে থাকবে , কিন্তু প্রকৃতি থেকে সহজে মুছে যাবে না। এবার ধর বহু বছর পর এমন কোন যন্ত্র , যা ওই অতি লো এনার্জির রেডিও ওয়েভকে ডিটেক্ট করতে পারবে  তা দিয়ে আমরা চাইলে আজ সকালে তোমার আমার ফোনের কথোপকথন কে রিজেনারেট করতে পারব, ঠিক কিনা?”

অর্ঘ্যের কথায় তাল দিতে তন্ময় ঘাড় নাড়ল , আর অর্ঘ্য আবার শুরু করার আগেই প্রফেসর মুখার্জী মুখ খুললেন, “আমি ঠিক এইখান থেকেই শুরু করেছিলাম , প্রথমে তাতিয়ানার মোবাইলটা ভাল করে পরীক্ষা করতে গিয়ে খেয়াল করলাম ওতে এমন একটি ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট আছে যাতে খুব লো এনার্জি মাইক্রোওয়েভকে মোবাইলের ব্যাটারির থেকে এনার্জি দিয়ে হাই এনার্জিতে কনভার্ট করা সম্ভব। হয়ত এটা মোবাইল কোম্পানিটির কোন ভবিষ্যত ব্যবসায়িক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা অল্প কিছু সেট-এ এই সার্কিটটা বসিয়েছে , বা এটা হয়ত নিছক একটা টেকনিকাল গোলযোগ যা কাকতালীয় ভাবে এই সেটের মধ্যে ওই সার্কিটটা তৈরি করে ফেলেছে। আমি সাথে সাথে আমার আর অর্ঘ্যের মোবাইলে ওইরকম একটি সার্কিট তৈরি করে দিই , আর তাতেই বেশ কয়েকটা মেসেজ পাই !!

“মানে বলতে চাইছেন আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে মোবাইল ছিল?? যাতে সাসানিড ,প্রাচীন গ্রিক এইসব ভাষায় এস এম এস চালাচালি হত?? !!”

“কেন, সেটা সত্যি হলে ক্ষতি কি?”

“না ক্ষতি কিছু নেই , কিন্তু সে ক্ষেত্রে ওই মহাকাশের মানচিত্রের মত ছবিটা কীসের?”

উত্তরে অর্ঘ্য বলল  “তুমি বোধ হয় জান , আগেকার দিনে নাবিকরা আকাশের তারা দেখে জাহাজের গতিপথ ও সমুদ্রের বুকে নিজেদের অবস্থান নির্ণয় করত , হতে পারে হয়ত সেই সময়ে এই একইরকম ভাবে লোকজন তাদের অবস্থান একে অন্যকে জানাত , হয়ত নিছক দেখা করার জন্যই , যেমন আজ সকালে আমি তোমায় আমার বাড়ির ঠিকানা বললাম।”

 হঠাৎ স্যারের মোবাইলে আবার দু তিনটে এস এম এস এল , স্যার মোবাইলটা তুলে  সেটা দেখলেন , তারপর অর্ঘ্য আর তন্ময়ের উত্তেজনায় থমথম করতে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠে বললেন , আরে সব এস এম এসই কি সময়ের ওই পার থেকে আসবে নাকি ? কিছু এস এম এস সমুদ্রের ওই পার থেকেও আসে … নবা মেসেজ করে জানাল ও নাসায় রেজিগনেশন দিয়ে চলে আসছে , আমার সাথে এক সঙ্গে কাজ করবে একটা ‘লো এনার্জি টু হাইএনার্জি মাইক্রো ওয়েভ অ্যামপ্লিফায়ার’ বানানোর জন্য।

তন্ময় বলে উঠল স্যার আমাকে সঙ্গে নেবেনতো ??!!

“নিশ্চয়ই… !!” বলে স্যার একগাল হেসে তাকালেন দুটো উজ্জ্বল মুখের ভবিষ্যত বিজ্ঞানীর দিকে।

যদিও অর্ঘ্য তখন মনে মনে ভাবছে এই গোটা ঘটনাটা যদি একটু সাজিয়ে গুছিয়ে লিখে জয়ঢাকে পাঠানো যায় তাহলে কি ওরা ছাপবে? দেখাই যাক !!

গ্রাফিক্‌স্‌ঃ ইন্দ্রশেখর

জয়ঢাক ২০১৬ গল্প প্রতিযোগিতায় পুরস্কারপ্রাপ্ত আরো গল্পঃ

ভিনগ্রহীদের হাতের পুতুল ,  দূর আকাশের দোসর , বন্ধু ,  আথেনিকার আগন্তুক

জয়ঢাকি গল্প-উপন্যাসের লাইব্রেরি এইখানে

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s