বত্রিশ নম্বর পরীক্ষা সুমন চক্রবর্তী বসন্ত ২০১৯

বত্রিশ নম্বর পরীক্ষা

সুমন চক্রবর্তী

স্কুলের বাইরে বসে হাপুস নয়নে কাঁদছে রিমি। কিচ্ছুটি ভালো লাগছেনা আজ তার। ভাবলেই বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে। একটা গোটা পাঁচ নম্বরের প্রশ্নের উত্তর লিখতে পারেনি ও। কী করে যে সময় কেটে গেল? অনেক চেষ্টা করেছে হাত চালিয়ে লেখবার, কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারেনি আর। যখন সবে ওই পাঁচ নম্বরের প্রশ্নটার উত্তর মাত্র দু-লাইন লিখেছে, শেষ ঘন্টা বেজে উঠলো। অগত্যা এখন শুধু দুঃখ করা ছাড়া আর কোনো গতি নেই।

“তুই তো তোর সাধ্য মতো চেষ্টা করেছিস,”, সান্ত্বনা দেয় রিমিকে পর্ণা। এত কাছের বন্ধু পর্ণা, কিন্তু আজ তার কথাতেও যেন নিজেকে সামলাতে পারছে না রিমি। পর্ণা আর রিমি ছোটবেলার বন্ধু। পাশাপাশিই বাড়ি দুজনের। ছোটবেলার বন্ধু হলেও রিমি পর্ণার থেকে এক ক্লাস নিচে পড়ে। সেই যখন ওদের ক্লাস ফাইভ, তখন ঠিক পরীক্ষার মুখে রিমির টাইফয়েড বাঁধল। আর পরীক্ষা দেওয়া হলো না সেবার রিমির।

“স্যার এক্সট্রা পেজ।”, স্যারের উঠে আসবার আর অপেক্ষা করতে পারে না রিমি। নিজেই লাফিয়ে গিয়ে নিয়ে আসে অতিরিক্ত পৃষ্ঠা স্যারের হাত থেকে। এখন প্রত্যেকটা মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার মধ্যে স্যার। যেরকম কাছিমের গতিসম্পন্ন, তাতে নিজে গিয়ে নিয়ে আসাটাই শ্রেয়। পরীক্ষা শেষ হতে মাত্র আর মিনিট কুড়ি বাকি। অন্যদিনের মতো এত ঢিমেতালে হাত চালালে হবে না। আজ তো ইতিহাস। বেশি করে । লিখতে হবে। এমনিতেই আজকের পরীক্ষাটা নিয়ে যা হচ্ছে, শেষ হলে বাঁচা যায়। সকাল বেলায় পরীক্ষা দিতে এসে জানতে পারে, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নাকি ফাঁস হয়ে গেছে। ফলত টালমাটাল অবস্থার মধ্যে পরীক্ষা শুরু হয় প্রায় তিনঘন্টা পর। সংসদ থেকে নতুন প্রশ্নপত্র পাঠানো হয়েছে নাকি প্রতিটি স্কুলে। অনেক লিখতে হবে আজ। গতকাল বেশ খানিকক্ষণ ধরে টানা লেখা প্র্যাকটিস করেছিল রিমি, যাতে পরীক্ষার হলে এসে হাত ব্যাথা না করে। আর করলেও যেন সেই ব্যাথাটা আগে থেকে অভ্যেস করে। নিতে পারে।

ট্রিং ট্রিং ট্রিং ট্রিং ট্রিং ট্রিং ট্রিং। আর মাত্র পনেরো মিনিট বাকি পরীক্ষার। জোরে হাত চালায় রিমি এখনো প্রায় সতেরো নম্বর উত্তর করা বাকি। অনেক কিছুই লেখার আছে কিন্তু সময়ের কাছে হার মানলে চলবে না। অনেক খেটেছে সে, তাকে সবকিছু লিখতেই হবে। জোরে জোরে হাত চালায় রিমি। নীল রঙের কালি দিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে ভরে যেতে থাকে একের পর এক সাদা পাতা। এর মধ্যেই আবার বেল বেজে ওঠে। আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। মুহূর্তের জন্য চাপে পড়ে যায় রিমি। হায় ভগবান এই প্রশ্নটা শেষের দিকে। এরপর তো আরেকটা গোটা প্রশ্ন বাকি। এই এক সমস্যা হল সাহিত্য-ভিত্তিক পরীক্ষার, একটা প্রশ্নের উত্তর একটু ভালোভাবে দিলেই, দ্বিতীয় প্রশ্নটা বাদ পড়ে যায়। তবুও যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি এই প্রশ্নের উত্তরটা শেষ করেই শেষ প্রশ্নটা লিখতে শুরু করে। কিন্তু দুটো লাইন লিখতে না লিখতেই ফাইনাল বেল বেজে ওঠো “প্লিজ স্যার, আমায় আর দুটো মিনিট সময় দিন?”, বেয়াড়া আবেদনে সাড়া না দিয়ে রিমির হাত থেকে খাতাটা কেড়ে নেন পরীক্ষা তত্বাবধায়ক। মাথায় হাত দিয়ে বিমর্ষ হয়ে বসে থাকে রিমি। এ কী হল? গোটা পাঁচটা নম্বর ছেড়ে দিতে হলো তাকে।

খাতাপত্র গোছানো হয়ে গেলে কিছুক্ষণ পর রিমির ডেস্কের সামনে ফিরে আসেন পরীক্ষার তত্ত্বাবধায়ক। বলেন, “তুমি যেটা করছ সেটা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তোমার হতাশা দেখে মনে হচ্ছে তুমি নিজের পরীক্ষা দিচ্ছ। অন্যের হয়ে পরীক্ষার উত্তর লিখে দিচ্ছ, কিন্তু একদম নিজের মতো করে। ভেরি গুড।” পাশ থেকে পর্ণা বলে, “একদম পাগলি জানেন তো স্যার মেয়েটা। ওর এখন খারাপ লাগছে যে আমি উত্তরটা জানতাম, কিন্তু ও লিখে দিতে পারল না। কিন্তু এই যে আমার মতো একটা অন্ধ মেয়েকে ও প্রতিটা পরীক্ষায় উতরে দিচ্ছে এটাই তো আমার কাছে বড় কথা। বুঝলি পাগলি।”

চুপ করে ডেস্কে নিষ্পলক নয়নে বসে রয়েছে তখন রিমি। তার মাথায় কোনো কথাই ঢুকছে না। আজ এই নিয়ে অন্য কারুর জন্যে বত্রিশ নম্বর পরীক্ষা দিলো সে। যেসব অন্ধ ছাত্র-ছাত্রীরা পরীক্ষায় লিখতে পারে না, তাদের জন্য পরীক্ষায় লিখে দেয় রিমি। তার জন্যে পর্ণার ব্যর্থতায় যেন অদ্ভুত একটা কষ্ট হচ্ছে রিমির। ঠিক যেমন নিজে পরীক্ষা দিয়ে মনঃপুত নাহলে হয়, সেরকম। এই পাঁচ নম্বরের উত্তর লিখতে না পারাতে খুব বিরক্ত লাগছে। আজ থেকে আরো তাড়াতাড়ি লেখা প্র্যাকটিস করতে হবে। কোনো পর্ণাকে যেন আর কখনো তার জন্যে পাঁচ নম্বর ছাড়তে না হয়। আসলে এদেশে তো পর্ণাদের সংখ্যাটাই বেশি আর রিমির মতো শ্রুতিলেখিকার সংখ্যা নিতান্ত কম।

অলঙ্করণঃ স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়

জয়ঢাকের গল্প ও উপন্যাস

1 thought on “বত্রিশ নম্বর পরীক্ষা সুমন চক্রবর্তী বসন্ত ২০১৯

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s