আগের পর্ব ধনেশ, মাছরাঙা, মুনিয়া, কাজল পাখি , দোয়েল-কোকিল-ময়না বুলবুল, বকপাখি, মোনাল দেখার গল্প
পাখি দেখা – ৯
পাঁচ বউয়ের কাহিনি
অলোক গাঙ্গুলী
বেনেবউ, সোনা বউ, কালো ঘাড় বেনেবউ, সরু ঠোঁট বেনে বউ আর রাঙা বউ (Black Hooded Oriole, Indian Golden Oriole, Black Naped Oriole, Slender-billed Oriole & Maroon Oriole)। প্রথম জনের নিবাস সমতলে আর পরের দু’জন শীতের পরিযায়ী। চতুর্থ জন পাহাড়ি পাদদেশ সংলগ্ন অঞ্চলে শীতের পরিযায়ী হয়ে আসে আর শেষ জন হিমালয়ের পাকাপাকি বাসিন্দা। এইসব বউয়েরই কণ্ঠস্বর অতি সুমধুর। তাই বোধহয় শ্বশুরবাড়িতে এদের এত সমাদর। সকলেই লাজুক প্রকৃতির, কেউই সহজে জনসমক্ষে আসতে চায় না। আর একবার চোখে পড়লে আর ফেরানো যায় না। পাখিদের মধ্যে যথারীতি সুন্দরী। প্রথমে এদের একটা সহজ বর্ণনা দিয়ে আরম্ভ করি যাতে চিনতে অসুবিধে না হয়।
বেনেবউ (Black Hooded Oriole)
অনেকেই আবার একে ইষ্টিকুটুম নামেও চেনে। উজ্জ্বল সোনালি হলুদ রঙের পাখি। মাথা, গলা ও ডানা কালো, লেজও কালো, কনীনিকা লাল এবং ঠোঁট গোলাপি। পুরুষ পাখির কণ্ঠস্বর অত্যন্ত সুরেলা। আমার বাড়ির পেছনে বেলগাছে প্রায়ই দেখা যায়, কখনও একা আবার কখনও জোড়ায়। আমাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল এর ছবি লেন্সবন্দি করতে। প্রায় সবসময়ই দেখতাম গাছের পাতার আড়ালে চলে গিয়ে ডাক দিচ্ছে। একবার এক আমগাছে উড়ে এসে বসতেই ক্যামেরা তাক করে চটপট ছবিটা তুলে নিলাম। সত্যিই, এরকম উজ্জ্বল সোনালি রঙের পাখি দেখা যায় না। অল্প সময়ের জন্য চোখের সামনে ছিল। প্রাণভরে দেখে নিয়েছিলাম আর আমার মনের হার্ড ডিস্কে বন্দি করে রেখেছি।
মাঝের তিন বউয়ের ছবি আমি এখনও আমার ক্যামেরার লেন্সে বন্দি করতে পারিনি। সোনা বউ ডানা ও লেজ বাদ দিয়ে উজ্জ্বল হলুদ ও ঠোঁট গোলাপি। চোখ বরাবর কাজল টানা। কালো ঘাড় বেনেবউয়ের রঙ একইরকম উজ্জ্বল সোনালি হলুদ। কেবল চোখের ওপর একটা কালো পট্টি দু’দিক দিয়ে ঘাড়ের কাছে এসে মিলে যায়। ঠোঁট বাকিদের চেয়ে একটু মোটা এবং গোলাপি রঙের। কালো ঘাড় বেনেবউয়ের তুলনায় সরু ঠোঁট বেনেবউয়ের ঠোঁট আরও সরু আর নিচের দিকে সামান্য বাঁকানো। বাকি সবকিছুই কালো ঘাড় বেনেবউয়েরই মতন।
ভারতীয় উপমহাদেশের মানচিত্রে এই পঞ্চ পক্ষি এক বিশেষ স্থান করে নিয়েছে কেবল বোধহয় তাদের সৌন্দর্যের জন্য এবং তাদের সুরেলা কণ্ঠস্বরের জন্য। কিন্তু পঞ্চম পাখিটি রূপের দিক দিয়ে কোনও অংশে কম নয়, কেবল বর্ণের বেলায় একটু ব্যতিক্রমী বাকিদের থেকে।
২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে গিয়েছিলাম লাটপাঞ্চারে, মহানন্দা অভয়ারণ্যের উচ্চতম অংশ। অনেক প্রকারের হিমালয়ের পাখির দেখা পেয়েছিলাম সেই সফরে। তার মধ্যেই ছিল এই রূপবতী পাহাড়ি পক্ষি রাঙা বউ বা মেরুন ওরিওল। অনেকেই ভুল করে ময়না বলে মনে করতে পারে। আকার প্রায় একইরকম। চেনার উপায় হল মাথা, গলা ও ডানা পুরোপুরি কালো। বাকিটুকু চকচকে খয়েরি, লেজ সহ। আমার আগের লেখাতেই আছে যে পুরুষ পাখিরা বেশি সুন্দর হয় তাদের স্ত্রী প্রতিরূপের তুলনায়। এদের বেলাতেও তাই। স্ত্রী পাখি বেশ ফ্যাকাশে পুরুষের তুলনায়।
লাটপাঞ্চারের মহানন্দা অভয়ারণ্যে যেদিন প্রবেশ করেছি, সেদিন দুপুর থেকেই আকাশ বেশ মেঘাচ্ছন্ন। মাঝেমধ্যে দুয়েক ফোঁটা বৃষ্টিও হচ্ছে। নিজেকে বৃষ্টি থেকে রক্ষা করার থেকে আমার দামি ক্যামেরাকে আগে ছাতার আড়ালে করে নিয়েছি। হঠাৎ দেখি আমার গাইড বিকাশ চিৎকার করে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ও আমার প্যান্টের দিকে ইঙ্গিত করল। তাকিয়ে দেখি তরতর করে এক জোঁক মহাশয় আমার প্যান্ট বেয়ে ওপরের দিকে উঠে চলেছেন। বিকাশ তাড়াতাড়ি একটা কাঠি যোগাড় করে এনে জোঁকটাকে কাঠিতে তুলে পাশেই এক ডোবাতে ফেলে দিল। যাক, এবারকার মতো এক রক্তচোষার হাত থেকে রেহাই পাওয়া গেল। আবার পাখিদের দিকে মনোনিবেশ করা যেতে পারে।
আকাশে মেঘের জন্য পরিবেশ অন্ধকার। আলো যথেষ্ট কম। ঘড়ির কাঁটা প্রায় পাঁচটা ছুঁই ছুঁই। আর একটু পরেই অন্ধকার নেমে আসবে এমনিতেই। বিকাশ এবং আমার গাড়ির চালক ইতিমধ্যেই তাড়া দিতে শুরু করেছে। প্রায় সকলেই ফিরে গিয়েছে। আর বেশিক্ষণ এই জঙ্গলে থাকা মোটেই নিরাপদ নয়। কিন্তু এসবের মাঝেই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল এই সুন্দরী পক্ষি। আর কি একে ফেলে যেতে পারি? দেখি দূর থেকে তেড়ে আসছে বন রক্ষী। হাতের ইশারায় ওকে থামতে ইঙ্গিত করলাম। ও বুঝল যে এখানে হাতে ক্যামেরা নিয়ে পক্ষি-প্রেমিকেরাই এসে থাকে। আমি বুঝতে পারছি যে বনরক্ষী সহ আর বাকি দু’জনেরা আশেপাশে লক্ষ রাখছে। আমি আমার ক্যামেরার লেন্স জায়গামতো নিয়ে এসে চটপট বেশ কয়েকবার শাটার টিপে চললাম। ঠিক করে দেখারও সু্যোগ পেলাম না যে ছবি কীরকম এল। এটুকু জানি যে এই পাখি রাঙা বউ ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।
এমনই দুর্ভাগ্য যে সেদিন সন্ধেবেলায় হোমস্টেতে ফিরে এসে ক্যামেরায় তোলা পাখিদের ছবিগুলো আর দেখার সু্যোগই পেলাম না। এমন ঝড়বৃষ্টি শুরু হল যে পাঁচ ঘণ্টা ধরে একইভাবে চলল সেই তাণ্ডব। বহু ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছিল সেই রাতে। বহু গাছ উপড়ে পড়েছিল। তাতে হয়তো বাসা ছিল অনেক পাখিদের। সেই সময়টা তখন পাখিদের প্রজননের সময়। আমি সত্যিই ভীষণ ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলাম পাখিদের চিন্তায়। পরে অবশ্য আমাকে বিকাশ ফোনে জানিয়েছিল যে পাখিরা সব ঠিকই আছে।
পরেরদিন শিলিগুড়ি পৌঁছে সন্ধেবেলায় ছবি দেখার সু্যোগ পেলাম। রাঙা বউকে চাক্ষুষ বেশিক্ষণ দেখার সু্যোগ হয়নি। আমার তোলা ছবিতেই প্রাণভরে দেখে নিলাম।
আমার পরম সৌভাগ্য যে এই পাঁচ বউকে স্বচক্ষে দর্শন করতে পেরেছি আর তাদের মধ্যে অন্তত দুই বউয়ের ছবি আমার সংগ্রহে রয়েছে। বেনেবউ এখনও আসে আমার দ্বারে, আর প্রত্যেকদিন ভোরবেলা থেকেই গান শোনাতে থাকে। এই গান পুরনো হওয়ার নয়। যতক্ষণ বাজে ততক্ষণ মন খুব আনন্দে থাকে। আর গাইয়ের দেখা পেলে তো কথাই নেই। আবার হিমালয় সফরে কখনও গেলে রাঙা বউকে কাছ থেকে খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যাব। বারবার দেখতে ইচ্ছে করে এই সুন্দরী পাখিদের।
শীর্ষচিত্রঃ বেনে বৌ ও রাঙা বৌ। (ছবি: লেখক)