আগের জাপানি গল্প এক কৃতজ্ঞ সারসের কাহিনি
কেন্টারোর মায়ের খুব অসুখ। তাই হতভাগা খুব উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে। তারা যে বড্ড গরিব। মায়ের জন্য ওষুধপথ্য কেনার সামর্থ্য তাদের নেই।
আমায় আবার কাকার কাছে হাত পাততে যেতে হবে। মনে হয় আবার তিনি আমায় সাহায্য করবেন। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কেন্টারো কাকার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হল। কাকাকে সব কথা খুলে বলতে কাকা ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বলল, “কী! আবার টাকা চাইতে এসেছিস্?”
“দয়া কর, কাকা। এবারের মত কিছু টাকা দাও, না হলে ওষুধের অভাবে মা মরেই যাবে।”
কিন্তু তার অনুরোধ, উপরোধে কাকার মন গলল না। সে তাকে ঘরের বাইরে বের করে দিল। বেচারা কেন্টারো রাস্তার ধারে একটা গাছের নীচে বসে কান্নায় ভেঙে পড়ল। না ঘুমানো পর্যন্ত সে কেঁদেই চলল।
হঠাৎ মনে হল কেউ যেন তাকে ঠেলা দিয়ে বলছে, “ছোট্ট ছেলে তুমি এখানে কী করছ?”
চোখ খুলে কেন্টারো তার সামনে এক সৌম্যদর্শন বৃদ্ধকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমার মায়ের খুব অসুখ। আমরা এত গরিব যে মায়ের সেবাযত্ন করার বা ওষুধ কেনার টাকা নেই। যদি আমি এক্ষুনি এক্ষুনি তার জন্য ওষুধ কিনতে না পারি, তাহলে মা নিশ্চিতভাবেই মারা যাবে।”
বৃদ্ধ বলল, “কেঁদো না বাছা। আমি তোমায় সাহায্য করব। এই কাঠের চটিজোড়া নাও। যখনই তুমি এটা পায়ে গলিয়ে লাফ দেবে তখনই এর মধ্যে থেকে একটা সোনার মুদ্রা বেরিয়ে আসবে। কিন্তু মনে রেখ, কখনই একসঙ্গে একটার বেশি মুদ্রা বার করবে না। কেন না তুমি যতবার লাফ দেবে ততবারই তুমি সামান্য ছোট হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর তুমি আবার আগের আকার ফিরে পাবে। কিন্তু একসঙ্গে বেশি মুদ্রা বার করলে তুমি একটা মশার মত হয়ে যাবে। কথাটা কিন্তু স্মরণে রেখ।”
বলতে বলতেই বৃদ্ধ লোকটি অদৃশ্য হয়ে গেল। একটা মৃদু ঝাঁকুনি খেয়ে কেন্টারো জেগে উঠল। “আচ্ছা আমি কী স্বপ্ন দেখছিলাম? কিন্তু তা তো মনে হচ্ছে না। ঐ তো কাঠের চটি এখানেই পড়ে রয়েছে। যাই, তাড়াতাড়ি করে বাড়ি ফিরি- তারপর এটাকে পরীক্ষা করে দেখি।”
বাড়ির উঠোনে পা দেওয়া মাত্রই সে সেই কাঠের চটিতে পা গলালো তারপর সজোরে লাফ দিল। খট্ করে একটা শব্দ হল। কেন্টারো মাটিতে পড়ে গেল। আরে, কী আশ্চর্য! সত্যিসত্যিই তো একটা স্বর্ণমুদ্রা বেরিয়ে এসেছে। আঃ, কী আনন্দ! আমি এখন খুব খুশি। এই স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে আমি এখন মায়ের জন্য চাল, ওষুধ, যা ইচ্ছে তাই কিনতে পারি। আমার মা আবার সুস্থ হয়ে উঠবে। আবার আমাদের জন্য রান্না করবে, আমায় আদর করবে। কী মজাটাই না হবে!
এদিকে হয়েছে কী কেন্টারোর এই জাদু জুতোর কথা কীভাবে যেন সমস্ত গ্রামবাসী জেনে ফেলেছে। তারা প্রত্যেকেই কেন্টারোর সৌভাগ্যে খুব আনন্দ পেল, কিন্তু তার কাকা এটা মেনে নিতে পারল না। যেভাবেই হোক জাদুচটি তাকে হস্তগত করতেই হবে। সে মনে মনে ফন্দি আঁটতে শুরু করল।
একদিন গুটিগুটি পায়ে সে কেন্টারোর বাড়ি এসে হাজির। নরম স্নেহ মাখা কন্ঠে বলল, “সুপ্রভাত ভাগ্নে, সুপ্রভাত।”
কেন্টারো তাকে সুস্বাগতম্ বলে ঘরে নিয়ে এল। কেন্টারো আর তার মা কাকাকে উপাদেয় খাবার খেতে দিল। খেতে খেতে কাকা বলল, “আহা! কী অপূর্ব স্বাদ! শুনলাম তুমি নাকি একটা জাদু চটি পেয়েছ , যেটা তোমায় স্বর্ণমুদ্রা দেয়?”
“হ্যাঁ, কাকু। এই যে, এই চটিটা আমি পেয়েছি।”
“তুমি কি এটা আমায় বিক্রি করবে? তোমার যত টাকা প্রয়োজন পাবে। হেঁ হেঁ এতদিন ধার বাবদ যেসব টাকাপয়সা নিয়েছ সেগুলোর কথাও আমরা ভুলে যাব। এখন কী করতে চাও বল?”
কাকু, এই চটি আমায় একজন দয়ালু বৃদ্ধ দিয়েছেন। আমি প্রাণ থাকতে এটা তোমায় বিক্রি করতে পারব না।”
“তাহলে অন্তত একদিনের জন্য আমায় এটা ধার দাও।”
“ না- না—কাকু আমি তো পারব না।”
অমনি কাকা তাকে এক ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে চটিজোড়া কেড়ে নিল। যাবার আগে বলে, “কেবল আজকের জন্যই এটা নিয়ে যাচ্ছি ভাগ্নে, কালই ফেরত দিয়ে যাব।”
“যেও না কাকু, দাঁড়াও! দাঁড়াও!”
চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই কেন্টারোর কাকু বাড়ি পৌঁছে গেল। বাড়ির ভেতরের উঠানে ঘাসের উপর একটা মাদুর বিছিয়ে দিল চটিটা হাতে নিয়ে ভাবতে লাগল, “এটা সত্যি সত্যি কাজে লাগবে তো? তারপর যেই সে চটিটা পায়ে গলিয়ে লাফ দিল, অবাক হয়ে দেখল সত্যি একটা সোনার মুদ্রা বেরিয়ে এসেছে।
“নিজের চোখে দেখেও এটা বিশ্বাস করতে পারছি না,” বলে সে আবার লাফ দিল, “কী সুন্দর, চক্চকে, মনোরম সব স্বর্ণমুদ্রা!”
আনন্দের আতিশয্যে কেন্টারোর কাকু লাফিয়েই চলল। তার মাদুরের উপর থরে থরে সোনার মুদ্রা জড়ো হল।
“হোঃ, হোঃ, হোঃ! আমি এখন জাপানের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। বড্ড ক্লান্তিবোধ করছি। কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিই, তারপর আবার অনেক- অনেক- অনেক বেশি লাফাব,” এই বলে সে নীচের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ ভারী অবাক হয়ে গেল।
“কী হল? স্বর্ণমুদ্রাগুলোকে তো মাদুরের চেয়েও বড় বলে মনে হচ্ছে! আরে! এখন তো দেখছি মুদ্রার স্তূপটাকে একটা সোনার পর্বতের মত দেখাচ্ছে! এ তো ফুজিয়ামার চেয়ে অনেক উঁচু!”
ভীত চকিত হয়ে সে চারধারে তাকাল, “এ কী? গাছগুলো সব আকাশকে ছুঁয়ে ফেলেছে। হা, ভগবান! এসব কী কান্ড কারখানা ঘটছে? আমি আমার বাগানের শেষ সীমানা দেখতে পাচ্ছিনা। বাড়িগুলো তো সব বিশাল আকার ধারণ করেছে।”
ঠিক তখনই কেন্টারো সেখানে উপস্থিত হল। সারাবড়ি তন্নতন্ন করে সে কাকুকে খুঁজল। না পেয়ে অবশেষে ভেতরের বাগানে গিয়ে সে অবাক হয়ে বলে, “এ তো দেখছি স্বর্ণমুদ্রার পাহাড়! কিন্তু কাকু গেল কোথায়? সে চিৎকার করে ডাকতে লাগল, “কাকু, কাকু তুমি কোথায়?”
হঠাৎ কেন্টারোর মনে একটা ভাবনার উদয় হল, “আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে যে সমস্ত স্বর্ণমুদ্রা বার করে ফেলে কাকু এখন মশার মত ক্ষুদ্র আকার ধারণ করেছে? তাই হয়তো আমি তাকে খুঁজে পাচ্ছি না।
“আচ্ছা! চটিটার উপর এটা কী? এটাকে তো ছোট্ট গুবরে পোকা বলে বোধ হচ্ছে…… হায়! হায়! কাকু…… এ তোমার কী অবস্থা হয়েছে? না- না, ওঃ কী ভয়ঙ্কর!” এই বলে আতংকে চিৎকার করে উঠল কেন্টারো।
“আমাকে বাঁচাও! আমায় রক্ষা কর! অনুগ্রহ করে আমার জন্য কিছু একটা কর।”
কিন্তু কাকুর ক্ষীণ আর্তস্বর কেন্টারোর কান পৌছল না।
“বেচারী কাকু! আমি তাকে কোন সাহায্যই করতে পারলাম না। লোভ করে তার এ কী দুর্ভাগ্যহল! হায় হায়!”
স্তূপীকৃত সোনার মুদ্রাগুলোকে একটা থলেতে পুরে কেন্টারো বাড়ি ফিরে এল। সে আর তার মা এর পরেও আরও বহুদিন সুখে কাটিয়েছিল।