বিদেশী গল্প-ইংরিজি জোর বরাত-শিয়ার্লাক স্ট্যানলি জ্যাক রুবিনস্টাইন। অনুবাদ অমিত দেবনাথ শীত ২০১৮

অমিত দেবনাথ    এর সমস্ত লেখা

 

“শিয়ার লাক এগেন” (Sheer Luck Again) প্যারোডিটির লেখক ব্রিটিশ আইনজীবী, ঐতিহাসিক ও লেখক “স্ট্যানলি জ্যাক রুবিনস্টাইন” (Stanley Jack Rubinstein)(১৮৯০-১৯৭৫)। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় “দি ডিটেকটিভ ম্যাগাজিন” (The Detective Magazine)-এ, ১৯২৩ সালে। এখানে গোয়েন্দার নাম “শিয়ার্লাক কোম্বস” (Sheerlauk Combs) এবং সহকারীর নাম “হোয়াটসন” (Whatson)।

জোর বরাত – শিয়ার্লাক !

অনুবাদঃ অমিত দেবনাথ

বেশ কিছুদিন হল আমার সঙ্গে শিয়ার্লাক কোম্বসের দেখা হয়নি। কী আর বলব, আমার স্ত্রী তাকে মোটে পছন্দ করে না। কাজেই একদিন আমি যখন আবার সেই সুপরিচিত বেকার স্ট্রিটের বাসার দরজায় করাঘাত করছিলাম, তখন – সত্যি কথাই বলব – আমার হাত পা কাঁপছিল।

“চলে এসো!” উচ্চকন্ঠ শোনা গেল আমার শ্রদ্ধেয় বন্ধুর। এবং আমি হাতল ঘোরাতে না ঘোরাতেই আবার শোনা গেল তার গলা, “হোয়াটসনের প্রত্যাবর্তন! স্বাগতম, স্বাগতম!”

“জানলে তুমি কী করে আমি যে এটা?” উত্তেজনার চোটে কথাবার্তা তালগোল পাকিয়ে গেল আমার।

“একদম সোজা ব্যাপার”, বলল সে, “তোমার মাথার তেলের গন্ধ। তোমার সঙ্গে শেষ যখন দেখা হয়েছিল, তারপর আমি দেড়শোরও বেশি চুলের তেলের স্বাদ আর গন্ধ নিয়ে একটা ছোট মনোগ্রাফ লিখেছি। কাজেই আমি এখন ইচ্ছে করলে এক মাইল দূর থেকেও তোমার পছন্দসই ব্র্যান্ডের তেলের গন্ধ বলে দিতে পারব।”

ওর আশ্চর্য উপলব্ধি করার ক্ষমতায় একটুও মরচে পড়েনি দেখছি। ওকে ভাল ভাল প্রশংসাবাক্যে ভরিয়ে দিতে যাচ্ছি, কোম্বস হাত তুলে আমায় থামিয়ে দিল।

“যথেষ্ট হয়েছে”, বলল সে, “আমি আজ পর্যন্ত তোমায় মিথ্যে বলিনি।ব্যাপারটা হল, তুমি যখন আসছিলে, তখনই আমি জানলা দিয়ে তোমায় দেখেছি।”

ওর পয়েন্ট কমে যেতে পারে জেনেও কী সরলভাবে কথাটা বলল কোম্বস! অসাধারণ মানুষ! আমি এমনভাবে ওর দিকে তাকালাম যে, কেউ দেখলে ভাবত শ্রদ্ধা নয়, আমি বোধহয় ওকে পুজোই করছি।

“একটা কাজে এলাম”, আমি বললাম।

“জানি”, বলল কোম্বস।

“জানো? কী করে?” আমি বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলাম।

“তুমিই তো এই মাত্র বললে”, বলল কোম্বস, “বেশ জরুরি বিষয়।”

“দারুণ”, বিশেষণটা বেরিয়েই গেল মুখ দিয়ে। “কী করে জানলে?”

কোম্বসের উত্তর তার অসামান্য যুক্তির মতোই মানানসই।

“যখন কোনও সাধারণ ফিটফাট মানুষ টাই না পরেই রাস্তায় বেরোয়, তখন বুঝতে হবে তার তাড়া আছে। তোমার মতো একজন বিশ্বকুঁড়ে যখন তাড়াহুড়ো করছে, তখন বুঝতে হবে তুমি উত্তেজিত। তোমার মতো মেজাজের মানুষও যখন উত্তেজিত, তাহলে ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। ধাপে ধাপে অঙ্ক কষার মতো ব্যাপার, হোয়াটসন, বিয়োগ অঙ্ক। একদম সোজা। তোমার আবার একটু প্রাথমিক স্তরের অঙ্ক-টঙ্ক নিয়ে বসা দরকার, মাথাটাকে সাফ করে দেয়। যা বুঝলাম, তোমার কিছু খোওয়া গেছে।”

কয়েক মুহূর্তের জন্য আমি কোনও কথাই বলতে পারলাম না।

“কী করে বুঝলে?” এটুকুই বলতে পারলাম শুধু।

“তোমার মতো একজন শিক্ষিত মানুষ যে ভাবে শ্বাস নিচ্ছে, তাতে বোঝাই যাচ্ছে, তোমার রুমালটা গেছে।”

মানুষটার জীবন সম্পর্কে ধারণা – সত্যি, চোখে পড়ার মত।

“তোমার সম্পর্কে আমি আরও কিছু কথা বলতে পারি”, বলল সে।

“বল।” মানুষটা কীভাবে বলে এত কিছু, সেটা শোনাও একটা অভিজ্ঞতা বটে!

“তুমি সেফটি রেজার দিয়ে দাড়ি কামিয়েছ”, বলল সে।

সত্যি কথা। বিয়ের সময় বউ দিয়েছিল এটা, কয়েক মাস আগে বলেছে ওটা ব্যবহার করতে।

“কীভাবে যে এত সব বল, জানি না”, আমি বললাম।

“ভায়া হোয়াটসন, বিয়ের আগের দিনগুলোতে তুমি দাড়ি কামাতে গেলে গাল কাটতেই, রোজকার ব্যাপার ছিল সেটা। কিন্তু এখন তোমার গাল, থুতনি – কোনও জায়গাতেই একটাও কাটাকুটি নেই। তার মানে এখন আর তোমার ক্ষুর নিয়ে রোজকার ধস্তাধস্তি করতে হয় না। তোমার ঝকঝকে মুখ দেখেই বুঝলাম তুমি কামানোটা ছাড়োনি, আর তোমার হাত দেখে মনে হচ্ছে সেগুলো আগের মতো খুব ধীরস্থির অবস্থায় নেই। কিছু মনে কোরো না ভায়া, তুমি মদ্যপান করেছ।”

আমি দুহাতে মুখ ঢেকে ফেললাম।

“শপথ করে বলছি, এতে আমার কোনও দোষ নেই”, আমি বললাম।

“ওসব পরে হবে”, কোম্বস ঠান্ডা গলায় বলল, “আগে শুনি ব্যাপারটা কী। যতটা সম্ভব ছোট করে বলবে। হাতে বেশি সময় নেই। সুগার কিং-এর হারানো পিয়ানোলা-র কেসটায় অনেক বেশি সময় নিয়ে নিয়েছে। আরও দু’তিনটে জরুরি কেস আছে।”

তার চোখে এমন একটা বিষণ্ণ আবছায়া নেমে এল, একইসঙ্গে তার পরস্পর জোড়া আঙুলের ডগাগুলো মাঝে মাঝে এমন ঝাঁকি মেরে উঠতে লাগল যে, যে কেউ দেখলে ভাববে লোকটা অক্কা পেয়েছে।

আমি গলা খাঁকরে শুরু করলাম।

“গতকাল রাত্তিরে আমি ডিনার করার পর আমার স্টাডিরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিই।”

“বটে!” বলে উঠল কোম্বস, “তার মানে তুমি ভয় পাচ্ছিলে। কাকে? কেন? কী ব্যাপারে? না না, অস্বীকার কোরো না, তোমার মুখটা লাল হয়ে গেছে।”

“মানে – দেখতেই পাচ্ছ –” আমার কথা আটকে গেল।

“কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না”, বলল কোম্বস অধৈর্যের গলায়। “আমি একজন গোয়েন্দা – ব্লাডহাউন্ড কুকুরের মতো – কোনও বাবাজি নই।”

“বেশ। দেখ, স্বীকার করে নেওয়াই ভাল – আমার স্ত্রী নিরামিষাশী হয়ে গেছে, আর –”

“আর তোমার স্ত্রী তোমাকে ডিনারে যা দিয়েছিল, তাতে তোমার পেট ভরেনি, কাজেই তুমি দিনের বেলায় যে স্যান্ডউইচগুলো কিনে এনেছিলে, সেগুলো স্টাডিরুমে বসে গিলেছ। ঠিক বলছি?” জিজ্ঞেস করল সে।

“হ্যাঁ, ঠিক – তুমি বরাবরই ঠিক বল”, আমি বললাম। “প্রায় তোমার কথা অনুযায়ীই চলছি। স্যান্ডউইচ খাওয়ার পর, আমি – ইয়ে – ফ্লাস্কে যা ছিল, তাও খেয়ে ডেস্কের তালাটা খুললাম। যার জন্য খুলছিলাম, সেটা আমি বহুবার ভেবেছি করব, কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনওবারই করে উঠতে পারিনি।”

“বলে যাও”, বলল কোম্বস। “ইন্টারেস্টিং লাগছে।”

“আমার ইচ্ছে ছিল সেই সব কাগজপত্রগুলো একটু নেড়েচেড়ে দেখব, যেগুলোতে তোমার – সেই সঙ্গে আমারও – বিভিন্ন অভিযানের কথা আমি লিখে রেখেছিলাম, ভেবেছিলাম সেখান থেকে আরেকখানা বেছে নিয়ে পাঠকের কাছে ছাড়ব।”

কোম্বসের ভুরুজোড়া নেচে উঠল।

“বরাবরকার শর্তেই তো?” বলল কোম্বস বেপরোয়া গলায়, “রয়্যালটির তিরিশ শতাংশ তোমার, আর বাকিটা – ইয়ে – আমার?”

 “নিশ্চয়ই। তাতে তো আপত্তির কিছু নেই”, আমি চেষ্টা করছিলাম আমার গলা শান্ত রাখার, “কিন্তু তা আর সম্ভব নয়।”

 “কেন নয় শুনি?” ক্যারকেরে গলায় বলে উঠল কোম্বস।

 “কারণ কাগজপত্রগুলো সব চুরি হয়ে গেছে।”

 “কী? তবে রে”, চেঁচিয়ে উঠল কোম্বস, সিট ছেড়ে লাফিয়ে উঠেই দুটো হাত বাড়িয়ে তেড়ে এল আমার দিকে।

আমি প্রায় ভেবেই ফেলেছিলাম আমার মরণের ঘন্টা বেজে গেছে। কিন্তু আমি ভুল ভেবেছিলাম, কারণ আমার ওপর না ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার মাথার ওপরে দেওয়ালে ঝুলতে থাকা চেলোটাকে ছিনিয়ে নিয়ে সারা ঘর জুড়ে লাফাতে আর নাচতে লাগল কোম্বস, সাথে চলতে লাগল উদ্দাম বাজনা – এই চড়ায় যাচ্ছে, এই খাদে নামছে, এই সুরে, এই বেসুরে – সারা ঘরের দেওয়াল ফুঁড়ে যেন বেরোচ্ছে সেই বন্য সঙ্গীত সেই অসামান্য যন্ত্রের থেকে, যে যন্ত্রটি সে উপহার পেয়েছিল শ্যাম্পুর রাজার কাছ থেকে, তাঁর একটা ছোটখাটো কাজ করে দেওয়ার জন্য। প্রথম দিকে তার হাত দিয়ে যন্ত্র থেকে উন্মত্তের মতো সুর বেরোচ্ছিল, কিন্তু সে যত হাঁপিয়ে পড়ছিল, ততই সেই সুর হয়ে উঠছিল ভয়ংকর, তারপর একসময়, সেই সাংঘাতিক সুরধুনীর মাঝখানেই, সে সেই মহামূল্যবান যন্ত্রটা ছুঁড়ে ফেলে দিল বাজে কাগজের ঝুড়িতে – যে যন্ত্রটা তাকে দিয়েছিলেন – ও হ্যাঁ, এইমাত্র বললাম – তারপর নিজেকেও ছুঁড়ে ফেলে দিল আরামকেদারায়।

তখন আর ওর ফোঁপানির শক্তি ছিল না, কিন্তু ফোঁপাচ্ছিল সে, এরকম কান্না আমি এর আগে আর মাত্র একবারই শুনেছিলাম, যখন আমরা সুলতানার ছদ্মবেশে বাদলাদ-এর সুলতানের হারেমে ঢুকেছিলাম, তাঁর খপ্পর থেকে এক অভিজাত মহিলাকে উদ্ধার করে আনার জন্য।

এখন তার আবেগটা অনেক কমে এসেছে।

“হোয়াটসন”, বলল সে, “সময়ে হয়ত আমি সব ভুলে যাব, কিন্তু তোমাকে কোনও দিন ক্ষমা করতে পারব না। আমি তোমার ওপর ভরসা করেছিলাম, ভেবেছিলাম তুমি আমার বসওয়েল হবে। যাই হোক, চোখের জলকে আমি ঘৃণা করি। আমি দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। শক্ত হতে হবে। এবার সব কিছু খুলে বল। এখনও হয়ত কাগজগুলো উদ্ধারের সময় আছে।” বলেই আবার শিবনেত্র হয়ে পড়ল কোম্বস, শুনতে লাগল একেবারে গা-ছাড়া ভাবে – সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর পক্ষপাতহীন কেসগুলোর ক্ষেত্রেই সে এরকম গা-ছাড়া ভাব দেখায়।

“স্টাডির দরজা বন্ধ করে”, আমি বললাম, “আমি ভেতর থেকে সমস্ত কাগজপত্র বার করে ভাল করে পড়ে সেগুলোকে টেবিলের দুপাশে দুরকমভাবে সাজালাম। বাঁদিকে রাখলাম সেগুলো, যেগুলোতে আমরা ততটা সফল হইনি – ইয়ে, যতটা হওয়া উচিত ছিল। যেমন ধর, তোমার মনে আছে সেই সাত চিবুকওয়ালা মহিলার রহস্যময় অন্তর্ধানের কথা?”

“কেন, খুঁজে তো বার করেছিলাম মহিলাকে, তবে চিবুকগুলো পাইনি”, বলল কোম্বস। “মনে পড়েছে। যে সার্কাসে মহিলা খেলা দেখাত, সেই সার্কাসের মালিক চিবুক ছাড়া মহিলাকে নিতে অস্বীকার করেছিল, তা-ও মনে আছে। বলে যাও।”

“আর ডানদিকে রেখেছি”, আমি বললাম, “সেই সব কেস, যেগুলোর কথা এবারে জনসমক্ষে আনাই যায়।”

“তারপর?”

“আমি দুটো ফুলস্ক্যাপ খাম নিলাম”, আমি বললাম, “তার একটায় তোমার ঠিকানা লিখলাম, আরেকটায় প্রকাশকের। সেই পিঠগুলো রাখলাম টেবিলের নিচের দিকে মুখ করে –”

“বলে যাও, শুনছি”, বলল কোম্বস।

“তারপর সেগুলো এমনভাবে ওলটপালট করে দিলাম, যেন সেগুলো ডমিনোস। তাহলে দেখ, আমি কিন্তু সিদ্ধান্ত নিইনি যে সেগুলো সরাসরি প্রকাশকের কাছে পাঠাব, নাকি তোমার কাছে পাঠাব – পড়ে দেখে, দরকার হলে ঠিকঠাক করে দেওয়ার জন্য। আমি জানতাম যে ব্যস্ত না থাকলে তুমি ওগুলো আবার আমার কাছেই পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু ভয় পাচ্ছিলাম, এই ভরা বাজারে তুমি এতই ব্যস্ত থাকবে যে হয়ত ওগুলো দেখতেই ভুলে যাবে।”

“ঠিকই বলেছ”, বলল কোম্বস, “ভুলেই যেতাম।”

“তাই আমি ঠিক করলাম বেছে নিতে হবে। যে কোনও একটা খামের মুখ ঘুরিয়ে দেখব এতে কোন ঠিকানা লেখা, যেটা থাকবে সেটাতেই পাঠাব। আমি তাই করতে যাচ্ছি, হঠাৎই ম্যান্টলস শেলফে রাখা ঘড়িটার দিকে আমার চোখ পড়ে যায়।”

“তখন কটা বাজে?” জিজ্ঞেস করল কোম্বস। “এটা জরুরি।”

“তখন বাজে ১০.২৩”, আমি বললাম, “দেখ ভায়া, নিরামিষ খেয়ে খেয়ে আমার সহনশক্তি বলতে আর কিছু নেই। সংক্ষেপে, আমি আমার টুপি, কোট আর ছাতা নিয়ে ছুটে গেলাম ডিউক অব এডিনবরা কর্নারে, আমার – ইয়ে – ফ্লাস্কটা ভরার জন্য।”

“আহা, খাসা!” বলে ফেলেছিল কোম্বস, পরক্ষণেই লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে সেটা চাপা দিয়ে বলল, “দরজা বন্ধ করেছিলে?”

“সদর দরজা বন্ধ করেছিলাম, স্টাডির দরজাটা করিনি”, আমি বললাম। “কিন্তু হলফ করে বলতে পারি, দশ মিনিটের বেশি বাইরে থাকিনি। কারণ ওরা ১০.৩০ মিনিট হলেই বাইরে বার করে দেয় – ইয়ে, দরজা বন্ধ করে দেয় আরকি। আর যেহেতু কোনও রাস্তা পেরোতে হয়নি, কাজেই উল্টে পড়ার ভয়ও ছিল না।” সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে কেন যে কথাটা বললাম, জানি না।

“যখন তুমি ফিরলে, সদর দরজা খোলা ছিল?” জিজ্ঞেস করল কোম্বস।

“না না, যেরকম রেখে গেছিলাম, সব সেরকমই ছিল। আমি ল্যাচ কি দিয়ে দরজা খুলে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে স্টাডিতে গিয়ে দেখলাম সব কাগজপত্র আর খাম উধাও।”

“সর্বনাশের মাথায় ঘা!” চেঁচিয়ে উঠল কোম্বস, দেখলাম ওর কপালে বড় বড় ঘামের বিন্দু ফুটে উঠেছে, “তুমি এইসব দারুণ শক্তিশালী অস্ত্রশস্ত্র আমার শত্রুদের হাতে তুলে দিয়েছ।”

“জানি তো”, আমি বললাম, “কিন্তু আমার আর কি করার ছিল?”

“চল”, উঠে দাঁড়াল কোম্বস। “হাতে একদম সময় নেই। কোনও শত্রুপক্ষের কাজ বোঝাই যাচ্ছে। বহুদিন ধরেই ওরা আমার নজরে আছে। এক ফোঁটা সাহস নেই, শুধু পাকা ধানে মই দিতে ওস্তাদ। চল, ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যাক।”

কোম্বসের ভাবার আগে এবং এই কথাটুকু লিখতে যতক্ষণ সময় লাগে, তার আগেই দেখলাম আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ট্যাক্সি ডাকছি।

“কোথায় যাবেন?” ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল।

আমি ঠিকানা বললাম।

“গাড়িতে অত তেল নেই”, ড্রাইভার চলে যাচ্ছিল।

“বাজে কথা বলছ জর্জ ব্লারনি, তুমি ভালই জান সেটা”, বলল কোম্বস ঠান্ডা গলায়।

“আমার নাম ধরে ডাকে কে রে? আরে, এ যে মিঃ শিয়ার্লাক কোম্বস! উঠে পড়ুন, উঠে পড়ুন! কি সৌভাগ্য! আমি খেয়াল করিনি স্যার, কিছু মনে করবেন না!”

গাড়ি চলতে লাগল হ্যাম্পস্টেড হিথ-এর দিকে, কোম্বস হেলান দিয়ে বসল এক কোনায়, কপালে দারুণ ভ্রুকুটি। গভীর ভাবে ভাবছিল কিছু, এটা তারই লক্ষণ।

“কোনও সিদ্ধান্তে এলে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

 “এখনও না”, বলল কোম্বস। “সমস্ত তথ্য না জেনে সিদ্ধান্তে আসা গুরুতর অন্যায়। তাছাড়া, এতে সময়ও নষ্ট হয়। তুমি কি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে জানিয়েছ?”

“আমি এমন কাজ করব তুমি ভাবলে কি করে?” আমি তীক্ষ্ণ গলায় বললাম, “এরকম করার অর্থই তো তোমার ওপর আস্থা না রাখা।”

“আরে, আমি ওদের গোয়েন্দা বিভাগের কথা বলছি না, বলছি ওদের হারানো-প্রাপ্তি অফিসের কথা।” তার গলা উদাস হয়ে গেল, “আমরা এসে গেছি। পয়সাকড়ি আছে, হোয়াটসন? তাহলে দিয়ে দাও, আমি আবার পয়সার ব্যাগটা ফেলে এসেছি।”

আমি ভাড়া মিটিয়ে দিতে ড্রাইভার টুপিতে হাত ছুঁইয়ে চোখ টিপল।

আপনি ভেবেছিলেন আমাকে থামাবেন”, বলল সে, “কিন্তু দেখতেই পাচ্ছেন, আমি এখনও খেলে যাচ্ছি। দিনের বেলায় এরকম খেলাই যায়, দিনে ডাকাতি যাকে বলে। লাইসেন্স আছে তো, কাজেই আপনি আমাকে ছুঁতেও পারবেন না। গুড ডে, মিঃ কোম্বস!”

চলে গেল ড্রাইভার।

“ব্যাটা মহা বদমাশ”, বলল কোম্বস। “ও যে কি সাংঘাতিক বাংলো-ভাঙিয়ে, ভাবতে পারবে না। তোমার মনে আছে সেই – যারা কমার্শিয়াল ট্রাভেলার, তাদের তেলের স্টোভের সেই কেসটা – এ ব্যাটা সেই ঘটনার মূল পান্ডা ছিল।”

“মনে আছে বইকি”, আমি বললাম।

আমার বাড়িটা সাধারণ তিনতলা, এগারো ধাপ সিঁড়ি নেমেছে পেছনের দিকের দরজায়, সেটা খুললেই একটা ছোট সরু জায়গা, যেখানকার শান বাঁধানো মেঝের নিচে কয়লা রাখার জায়গা। বাড়ির পেছনের দিকে কোনও বেরোনোর জায়গা নেই, আর পেছনের দিকের জানলা দিয়ে শুধু রিজেন্টস খাল দেখা যায়, এই খাল আর আমার বাড়ির মাঝখানে রয়েছে একটা সরু পথ – নৌকো টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

 চার ধাপ পাথরের সিঁড়ি ভেঙে সামনের দরজার চাবি ঘোরাতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ভয় লাগল। ভয় লাগল, কারণ সিয়াম-এর সেই ব্যাংক ডাকাতির কিনারা করার পর থেকেই কোম্বস এ বাড়িতে আর পা দেয়নি। আমার স্ত্রী জানতে পেরেছে যে ডাকাত ধরেছে কোম্বস, এবং ওই দলে তার এক তুতো ভাইও ছিল। দেশে ফেরার বদলে সে এখনও জেল খাটছে ওখানে।

 কোম্বসেরও বোধহয় মনে পড়ে গেছিল কথাটা একইসঙ্গে, কারণ ও-ও দেখলাম ফিসফিস করে বলল, “মনে রাখবে, আমি হলাম কলের মিস্ত্রি।”

বাড়ির ভেতর ঢুকেই আমার স্ত্রীর মুখোমুখি হয়ে গেলাম।

 “এ হল কলের মিস্ত্রি, ডিয়ার”, আমি বললাম, “ও ওর – ইয়ে – শ্বাসনালীর সমস্যা নিয়ে আমার কাছে এসেছে।” তারপর সোজা উঠে গেলাম তিনতলায় আমার স্টাডিতে, যেটা বাড়ির সামনের দিকে।

আমি ভেবেছিলাম কোম্বস বোধহয় আমার এই প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের জন্য আমার খুব প্রশংসা করবে, ও বাবা, তার বদলে দরজা বন্ধ করেই গালাগালি শুরু করল। “বোকা, গাধা, মাথামোটা! আমি এখানে সারাই করতে এসেছি, সারাই হতে আসিনি! সারা বাড়ির ভেতরে বাইরে আমাকে ভাল করে এখন পরীক্ষা চালাতে হবে। তোমার রোগীরা কি হামাগুড়ি দিয়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায়?” তারপর সে দরজার কাছে গিয়ে সেটার চাবি আটকে দিল।

“এবার তদন্ত শুরু করতে হবে”, সে বলল, “কাজের লোকদের ডাকো, ওদের দিয়েই শুরু করা যাক।”

“দুঃখিত”, আমি বললাম, “কাজের লোক নেই।”

কোম্বসের ভুরু কুঁচকে গেল।

      “প্রথমেই আমি চাইছিলাম না তোমার স্ত্রীকে সন্দেহ করতে, কিন্তু তুমি যা বললে, তাতে আর তো বিকল্প নেই।”

“ওর হয়ে আমিই উত্তরটা দিয়ে দিচ্ছি”, আমি বললাম, “সেদিন ও সারা সন্ধ্যে সিনেমায় ছিল, ও এসব ব্যাপারের কিছুই জানে না, আর জানাটা ঠিকও হবে না। মনে রেখো, ও যদি একবারের জন্যও সন্দেহ করে তুমি আসলে কে, তাহলে কিন্তু তক্ষুনি ওর মায়ের কাছে চলে যাবে।”

 “তাহলে তুমি ওর কাছে বলবে না যে আমি কে?” জানতে চাইল কোম্বস।

“এখন তো নয়ই”, আমি বললাম। কোম্বস কাঁধ ঝাঁকাল।

“কোম ভুস ভুলেজ”, নিখুঁত উচ্চারণে আওড়ালো কোম্বস। “তোমাদের – বিবাহিত লোকদের দেখে শ্রদ্ধা হয়।”

 তারপর হাঁটু গেড়ে বসে, সে তার মাপার ফিতে আর একটা বড় চৌকোনা আতস কাচ বার করল।

“কাল রাত থেকে কিন্তু কোনও কিছুতেই আর হাত দেওয়া হয়নি”, আমি বললাম। “ওই হল ডেস্ক, আর এই হল টেবিল।” তারপর যা যা দরকার, সবই দেখিয়ে দিলাম।

 আশ্চর্য!” এতক্ষণ সারা ঘরে হামাগুড়ি দিচ্ছিল কোম্বস, হঠাৎ থেমে তার নোটবইতে একটা বড়সড় জিজ্ঞাসার চিহ্ন বসিয়ে দিল।

“এই যে!” হঠাৎ একটা চিৎকার ছেড়ে সে কার্পেটের ওপর ঝুঁকে পড়ল। “টাটকা কাদা।”

“এই সেরেছে! এটা এখানে এল কি করে?” আমি লজ্জিত গলায় বললাম, “গত রাত্তিরে তো আমি ডিনারের আগেই বুটটা ছেড়েছিলাম, তারপর তো আর আসিনি।”

 “তুমি যখন ডিউক অব এডিনবরা থেকে ফিরেছ, তখনই নিশ্চয়ই পায়ে পায়ে চলে এসেছে”, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল কোম্বস।

আমি চুপ করে মাথা নামিয়ে নিলাম।

অনুসন্ধানপর্ব সমাধা করে কোম্বস আরামকেদারায় বসে পাইপ ধরিয়ে ধোঁয়ার কুন্ডলির মধ্যে ডুবে গেল।

আচমকা লাফ দিয়ে উঠে কোম্বস ছুটে গেল ঘরের অন্যপ্রান্তে টেলিফোনটার দিকে, তারপর শুনলাম সে মুখ দিয়ে টেলিফোনের রিং-এর মতো আওয়াজ বার করছে।

“তোমার বউকে গিয়ে বল যে”, বলল কোম্বস, “এক বন্ধু – নামটা তুমি ভাল বুঝতে পারনি – তার সঙ্গে দেখা করতে বলেছে, খুব নাকি দরকার।”

আমি তৎক্ষণাৎ গিয়ে আমার স্ত্রীকে কোম্বসের কথাগুলোই বললাম।

আমি ঘরে ফিরতেই কোম্বস অধীর হয়ে বলল, “গেছে তো? এবার বাড়িটা ভাল করে খুঁজে দেখতে হবে।”

“আমার ধারণা, যাবে না”, আমি বললাম, “সে আমাকে বলল নামই যখন বোঝা যায়নি, তখন আন্দাজে সে কোথায় যাবে?”

“ধুর ধুর!” হিসিয়ে উঠল কোম্বস, “তোমার দ্বারা কিস্যু হবে না। সব কিছু গণ্ডগোল পাকিয়ে দাও। যাই হোক, আমি আমার কাজ চালিয়ে যাব। শোন, আমি যদি তোমার বউয়ের মুখোমুখি হয়ে যাই, আমি নিজেকে কলের মিস্ত্রিই বলব, আর বলব তুমিই আমাকে ডেকেছ হাওয়া ঢোকার পাইপে তোমার মনে হচ্ছে কোথাও একটা ফুটো হয়েছে, সেটা খুঁজে বার করার জন্য। তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে তুমি তাই বলবে বলে রাখলাম।” আমাকে একটি কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

আমি একটা বই নিয়ে পড়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু দেখলাম মন বসাতে পারছি না। বারবার মনে হচ্ছিল আমারই ভুলে কোম্বসের অমূল্য সব অভিযানের কাহিনি হাতছাড়া হয়ে গেল। কোন অপয়া সময়ে জন্মেছিলাম কে জানে! কোন অলুক্ষুনে দিনে আমার সঙ্গে কোম্বসের আলাপ হয়েছিল কে জানে! কেন যে আমার স্ত্রী সব ছেড়েছুড়ে নিরামিষাশী হয়ে গেল কে জানে! কেন যে আমি প্রথম ওই দিনটাতেই মদ্যপান করলাম কে জানে!

এরকম চমৎকার সব কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়েই পড়েছিলাম বোধহয়, কারণ চোখ খুলে দেখলাম কোম্বস আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। ওকে একঝলক দেখেই বুঝতে পারলাম সারা বাড়ি খুঁজেও ওর কোনও প্রাপ্তিযোগই ঘটেনি।

“ধুলো দেখে বুঝলাম পেছনের দরজা বা কোনও জানলাই বছরখানেকের মধ্যেও খোলা হয়নি”, তার গলায় ক্লান্তি।

“হ্যাঁ, তা ওইরকমই হবে”, আমি বললাম, “ঝিটা অদ্দিন আগেই পালিয়েছে।”

কোম্বস গভীর চিন্তায় ডুবে গেল আবার, থুতনি ঝুলে পড়ল বুকের ওপর।

“ভেঙে পড়লে তো চলবে না”, হঠাৎ বলে উঠল কোম্বস। “খুবই দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হবে সেটা, যদি বছরের পর বছর অন্যান্য লোকজনের সমস্যার সমাধান করার পর নিজের কোনও সমস্যার সমাধান করতে না পারি। আর এটা আজ পর্যন্ত আমি যত কেস সামলেছি, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর জটিল।”

ঠিক সেই সময় আমার স্ত্রী দরজায় টোকা মারল।

“পোস্টম্যান এইমাত্র তোমাকে একটা চিঠি দিয়ে গেল।”

“মুদি বা মাংসওয়ালা হলেও কথা ছিল”, বলল কোম্বস, “কিন্তু একটা পোস্টম্যানের সঙ্গেও তোমার দেখা করার কি দরকার বুঝলাম না।”

“দরজার নিচ দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দাও”, আমি চেঁচিয়ে বললাম। তারপর নিচু হয়ে কুড়িয়ে নিলাম পোস্টকার্ডখানা। সেটা লেখা হয়েছে আমাকেই। লেখাটা জোরে জোরে পড়ে শোনালাম কোম্বসকে। সেটা এরকমঃ

“মেসার্স এমেস অ্যান্ড স্ক্রিপ্ট যথাবিহিত শুভেচ্ছাজ্ঞাপনপূর্বক মিঃ হোয়াটসনকে জানাইতেছেন যে অদ্য প্রত্যুষে একখানি খালি এবং ডাকটিকিটবিহীন ফুলস্ক্যাপ খাম, যাহাতে তাঁহার নিজের হাতে ঠিকানা লেখা ছিল – তাঁহাদের অফিসবয় কর্তৃক গৃহীত হইয়াছে এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় ডাকখরচ সারচার্জ হিসেবে দিতে হইয়াছে। তাঁহারা কৃতজ্ঞ থাকিবেন, যদি মিঃ হোয়াটসন ওই ডাকখরচ বাবদ তিন পেন্স তাঁহাদের মিটাইয়া দেন, নতুবা তাঁহার রয়্যালটি হইতে এই অর্থ কাটিয়া লওয়া হইবে, তিনি যেন প্রস্তুত থাকেন।”

“তোমার কি এটা আসল বলে মনে হয়?” আমি কোম্বসকে জিজ্ঞেস করলাম, খামটা তার হাতে তুলে দিয়ে। সে আতস কাচ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছিল সেটা।

“নিঃসন্দেহে”, বলল সে।

“তাহলে এটা থেকে তোমার কি মনে হচ্ছে?”

মিনিটখানেক কোম্বস কোনও কথা বলল না। তারপর বলল, “মনে হয় চোর ভেবেছিল এই ফালতু মাল রেখে ওর কোনও লাভ নেই, তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটা বিদেয় করা দরকার মনে করে হাতের সামনে যে ডাকবাক্স পেয়েছে, তাতেই খামটা ফেলে দিয়েছে।”

“হতে পারে”, আমি বললাম।

কোম্বস কড়া চোখে তাকাল আমার দিকে।

“দেখ, যদি তোমার হাতে ভাল কোনও গোয়েন্দা থাকে তো তুমি সেখানে যাও”, বলল সে। “তুমি জান যে আমি জানি যে তুমি জান যে তুমি আর কোনও ভাল গোয়েন্দার খোঁজ পাবে না, কারণ আমার চেয়েও ভাল আর কেউ নেই।”

আমি ক্ষমা চাইতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই কোম্বস আমায় থামিয়ে দিয়েছে।

“বারোটা বাজে”, সে বলল। “ওই ডিউক অব এডিনবরায় যেতে গেলে কোন দিক দিয়ে যেতে হয় – ডানদিক, না বাঁদিক? আমার দুরত্বটা জানা দরকার।”

আমি ওকে কোন দিকে যেতে হবে বলে দিলাম, আর তার সঙ্গে এটাও বলে দিলাম যে সে যেন বুঝেসুঝে পান করে, কারণ ওখানে এমন কিছু পানীয় আছে, যেগুলো আমার অভিজ্ঞতায় বুঝেছি পান না করাই ভাল।

“অনেক ধন্যবাদ”, বলল কোম্বস। “আজ সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ এসো। আশা করছি কিছু একটা করতে পারব।” বলেই হাওয়া হয়ে গেল কোম্বস।

আমি বসে বসে ভাবতে লাগলাম কি করা যায়। আমি সমস্ত তথ্যই জানি, কিন্তু কিছুই করতে পারছি না, অথচ কোম্বস – আমি যা জানি, ও-ও তাই জানে, আশা করছে কাগজপত্রগুলো উদ্ধার করতে পারবে।

মিনিট কুড়ি বাদে, আমি ভাবা-টাবা ছেড়ে দিয়ে, আমার পকেটে ভরে নিলাম আমার রিভলভারখানা, স্ত্রীকে বললাম আজ রাত্তিরে হয়ত আমার ফেরা হবে না, এক রোগীর কাছে যাচ্ছি, গত তিনদিন ধরে তার এখন-তখন অবস্থা আর সে নিশ্চয়ই ভাবছে তার দেখাশোনা ঠিকমতো হচ্ছে না।

রোগীর কাছ গিয়ে দেখি, খুশির ব্যাপার, তার অবস্থা যতটা খারাপ হবে ভেবেছিলাম আমার অনুপস্থিতিতে, ততটা হয়নি। তবে কিনা, সে একখানা উইল করেছে, সেটা শুনে, তার সইসাবুদের সাক্ষী হয়ে আসতে আসতে কোম্বসের বাসায় যখন আমি গিয়ে পৌছলাম, তখন সাতটা নয়, সওয়া সাতটা বেজে গেছে।

কোম্বসের চেয়ারে বসে পাইপ টানছিলেন হালফ্যাশনের পোশাক পরা এক তরুণী, যাকে খুব চেনা চেনা লাগছিল। তাড়াতাড়ি মার্জনা চেয়ে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছি, হঠাৎ মহিলার ভুরুজোড়া নেচে উঠল এবং সঙ্গে সঙ্গেই মহিলাকে চিনতে পারলাম।

“শুভ সন্ধ্যা, মিস কোম্বস!” আমি বললাম, “আপনার ভাই বোধহয় এখনও ফেরেন নি। আমি একটু বসব?”

“আমার নাম কামরাড”, বললেন মহিলা। “আমিও হের কোম্বসের কাছে এসেছিলাম একটা কাজে।”

উচ্চারণ শুনে মনে হল মহিলা জার্মান – আর এই জাতটাকে আমি একদম পছন্দ করি না। ভাবলাম আমি তাহলে রাস্তায় গিয়েই দাঁড়াই।

সবে অর্ধেক নেমেছি সিঁড়ি দিয়ে, ওপর থেকে একটা গলা ভেসে এল, “হের ভাটসন! হের ভাটসন!”

আমি ফিরে গেলাম আবার।

“বলুন?” বললাম তেতো গলায়।

“আপনি আমায় চিনতে পারলেন না?” বললেন মহিলা, মুখে কান এঁটো করা তোষামুদে হাসি।

“আজ্ঞে না”, সংক্ষেপে বললাম।

“এবার চিনুন”, বলল কোম্বস তার নিজের গলায়, কারণ মহিলা আসলে সে-ই।

বহুবার আমি আমার এই বন্ধুর অবিস্মরণীয় কীর্তিকলাপের সাক্ষী থেকেছি এবং মুগ্ধ হয়েছি, এবারও তার ব্যত্যয় হল না। সে যে শুধু দুর্দান্ত ছদ্মবেশ ধারণ করতে পারে, তাই নয়, সে সেই চরিত্রের সঙ্গে এমনই একাত্ম হয়ে যায় যে আমি – যে অন্যান্য যে কোনও লোকের থেকে তাকে বেশি চেনে – পর্যন্ত তাকে চিনতে পারিনি। সে কারণেই সে যখন বলেছিল সিনেমায় নামবে না, তখন চলচ্চিত্রপ্রেমীরা খুবই হতাশ হয়েছিল।

কোম্বস হাসল।

“আমার পুরোন ক্ষমতাগুলো হারায়নি দেখে ভাল লাগছে।”

“কাগজগুলো পেয়েছ?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“না, পাইনি”, সে বলল, “তবে তুমি শুনে খুশি হবে যে তোমার বউ ওগুলো নেয়নি।”

“তুমি জানলে কি করে?” আমি অবাক হলাম।

“আমি আজ বিকেলে এই ছদ্মবেশেই তার সঙ্গে দেখা করতে গেছিলাম”, সে বলল। “বললাম যে একটা রেজিস্ট্রি অফিস থেকে আমাকে পাঠিয়েছে রাঁধুনি-কাম-ঝিয়ের কাজ করার জন্য। কপাল ভাল, সে পরিস্কার বলল তুমি জার্মানদের পছন্দ কর না, কাজেই আমার আবেদন খারিজ হয়ে গেল।”

কাগজপত্রগুলো উদ্ধার করতে পারেনি বলে আমি তার ওপর একটু বেশি মেজাজ দেখিয়ে ফেলেছিলাম বলেই আমার ধারণা।

“ওসব ছেড়ে একটু চাঙ্গা হও দেখি”, বলল কোম্বস, যদিও তার গলা শুনে কারোর মনে হবে না যে সে চাঙ্গা রয়েছে। “কাগজপত্রগুলো যে কোনও মুহূর্তে এখানে এসে পড়বে।”

আমার ধারণা, আমাকে উত্তেজিত করার জন্যই ও কথাটা বলল।

“কখন? কোথায়? কীভাবে?” আমি চিৎকার করে উঠলাম।

ঠিক সেই সময়েই দরজায় কে যেন টোকা দিল।

“রাতে খাওয়ার সময় হয়ে গেছে, এখন লোক!” অবাক হল কোম্বস। “জরুরি কিছু নিশ্চয়ই।”

দরজা দিয়ে উঁকি মারল এক ডাকপিয়ন। “মিঃ কোম্বস আছেন?”

“আছে”, বলল কোম্বস।

“মাফ করবেন মিস, আমি মিঃ কোম্বসকে চাই।”

“ঠিক আছে ভাই”, হেসে উঠল কোম্বস, একটানে খুলে ফেলল তার পরচুলাটা।

“ওঃ, মাফ করবেন স্যার”, বলল লোকটা, “আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। এক শিলিং লাগবে”, বলে সে একটা বড়সড় মোটা খাম তুলে ধরল।

“আমি কাউকে দানধ্যান করি না”, ভাগিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল কোম্বস।

“ও, তাহলে এটা নেবেন না তো?” জিজ্ঞেস করল লোকটা।

“কি এটা?” জানতে চাইল কোম্বস।

“এই যে, আপনি নিজেই দ্যাখেন না। আমি আজকে এর আগেও দুবার এসেছিলাম, হাপনি তো ছিলেন না, এটা দিয়ে যেতে পারি নাই”, উত্তেজনায় লোকটার কথাগুলো উল্টোপাল্টা হয়ে গেল।

কোম্বস প্যাকেটটা নিয়ে দেখতেই দেখলাম ওর মুখে একটা ভ্যাবাচ্যাকা ভাব।

“নিচ্ছি তো, পরে যদি কিছু হয়!” লোকটার হাতে একটা শিলিং গুঁজে দিয়ে বিড়বিড় করল কোম্বস।

খামটা ছিড়ে সে ভেতরটায় দ্রুত চোখ বুলিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “পেয়েছি!” একটা শ্বাস ছেড়ে সে খামটা ছুঁড়ে দিল আমার দিকে। “এই নাও তোমার জিনিস। ভবিষ্যতে সাবধান থেকো।”

ঠিক কথা। গতকাল সন্ধ্যেবেলা আমি নিজের হাতে এই খামটাতেই কোম্বসের ঠিকানা লিখেছিলাম এবং এর একটি কাগজও খোয়া যায়নি।

আমি আনন্দের চোটে কোম্বসের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ওর হাতে চুমুই খেয়ে ফেললাম কৃতজ্ঞতায়।

“কি করে পারলে?” আমি বললাম, কিন্তু দেখলাম সে ব্যাপারটায় বিশেষ পাত্তা দিল না।

“এখন বাড়ি যাও”, সে বলল। “আমি খুব ক্লান্ত, শুতে যাব। কাল সকালে এস, আমি আগে ব্যাপারটা বুঝে – মানে আমি তোমাকে বুঝিয়ে দেব।” মস্ত একটা হাই তুলল সে।

আমি খুব সাবধানে ওয়েস্টকোটের ভেতরের লাইনিং-এর মধ্যে সেই মহামূল্যবান কাগজপত্রগুলো নিয়ে বাড়ি ফিরলাম এবং গত দুরাতের পর এই প্রথম চোখের পাতা এক করলাম।

পরদিন সকালে গিয়ে দেখি কোম্বস ব্রেকফাস্ট করছে, পরনে একটা রঙচঙে বিচিত্রদর্শন ড্রেসিংগাউন। দেখলাম ওর চোখের তলায় কালি পড়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, সারারাত ঘুমোয়নি।

“তুমি জানতে চাইছিলে না, কীভাবে কাগজগুলো পেলাম”, সে বলল। “বলছি। কাল সারারাত এটা নিয়ে ভেবেছি। যখনই নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে তুমি বেরিয়ে আসার পর বাড়িতে আর কেউ ঢোকেনি, তখনই বুঝলাম ব্যাপারটা খুব সোজা। তোমার মনে থাকবে নিশ্চয়ই যে তুমি বলেছিলে বাড়ির জানলা বা পেছনের দরজা বহু মাস ধরে খোলা হয়নি। তার ওপর, তোমার স্টাডির জানলা দিয়ে কেউ নিচে লাফিয়ে পড়লে নির্ঘাত ঘাড় মটকাতো। আমিও গিয়ে দেখে এসেছি, ওখানে কেউ ছিল না, আর তাছাড়া আমি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডেও খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ওরা রাত্রে কাউকে ওখান থেকে সরায়নি।

“কাজেই, সমস্ত সূত্র ঘেঁটে আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে – তোমার বাড়িতে কোনও চুরি হয়নি, এবং যেহেতু তোমার বাড়িতে কোনও ঝি নেই, এবং আমি নিজে বলছি তোমার স্ত্রী নির্দোষ – কাজেই তোমার স্টাডি থেকে কাগজপত্রগুলো তুমিই নিয়েছ!”

“আমি?!?”

“হ্যাঁ, তুমি”, বলল কোম্বস। “আমার কাছে পরিস্কার যে ডিউক অব এডিনবরা যাওয়ার আগে তুমি যে কোনও একটা খামে কাগজগুলো ভরেছিলে, ভেবেছিলে কোথাও সরিয়ে রাখবে সাবধানে রাখার জন্য, কিন্তু তখন তোমার হাতে একটুও সময় নেই দেখে ডেস্কে চাবি আটকে এক হাত দিয়ে খামটা খামচে তুলে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলে – কোন হাত দিয়ে ধরেছিলে, সেটা অবশ্য আমি বলতে পারব না।

“সদর দরজা বন্ধ করে তুমি দেখলে তোমার হাতে খাম – অন্যমনস্ক হয়ে তুমি ভাবলে এটা পোস্ট করার জন্য এনেছ, কাজেই তুমি রাস্তা পেরিয়ে ওপারের পিলার-বক্সে এটা ফেলে দিলে। তারপর আবার যখন সদর দরজায় এসে পকেট হাতড়াচ্ছো চাবির জন্য, তোমার হাতে ঠেকল ফ্লাস্কটা, আর উত্তেজনায় এই ছোট্ট ডাকবাক্স অভিযানের কথা ভুলে গিয়ে তুমি ছুটে গেলে ডিউক অব এডিনবরার দিকে।

“শোন হোয়াটসন, তুমি ভাবছ বোধহয় আমি কোনও সূত্র ছাড়াই একা একা এর সমাধান করেছি। তা নয়। আসল কথাটা হল, তোমার স্টাডির কার্পেটে পাওয়া কাদার টুকরোটাই আমাকে ভাবিয়েছে। ডিউক অব এডিনবরা আর তোমার বাড়ির মধ্যে কোথাও কাদা নেই আর তুমি ভেবেছ তুমি সোজা ওখান থেকে ফিরেছ। আসল ব্যাপারটা হল, তুমি সোজা ওখানে গেছিলে। যখনই আমি খেয়াল করলাম তোমার বাড়ির সদর দরজা আর পিলার বাক্সের মাঝখানের রাস্তা কাদায় ভরা, তখনই আমি বুঝেছিলাম আমি ঠিক রাস্তায় যাচ্ছি। প্রকাশকের চিঠিটা আমাকে আরও সাহায্য করে।

“এ ব্যাপারে আর কিছু বলার নেই বলেই আমার ধারণা, শুধু এটুকুই বলব যে স্থানীয় পোস্ট-অফিসে গিয়ে পরের ডাকবিলির সময়টা জিজ্ঞেস করতে আমার মিনিট পাঁচেক সময় লেগেছিল, না হলে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য আমাকে পঞ্চাশ মিনিট বসে থাকতে হত।”

“কোম্বস”, আমি তার হাত দুটো জড়িয়ে ধরলাম উত্তেজনায়, তুমি দুর্দান্ত! কী করে যে তোমায় কৃতজ্ঞতা জানাব –”

“আমাকে একটু একা থাকতে দিয়ে, ভায়া হোয়াটসন”, বলল কোম্বস। “যে কোনও মুহূর্তেই আমি একজন মহিলা – ইয়ে – এক গুরুত্বপূর্ণ মক্কেলকে আশা করছি, তার কেস এতই ব্যক্তিগত যে তোমার সামনেও বলা যাবে না।”

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শুনলাম কোম্বস সুর বাঁধছে তার প্রিয় চেলোটায় – যেটা দিয়েছিলেন – ইয়ে – সেই মহারাজা – কোথাকার যেন –

জয়ঢাকের  সমস্ত গল্প ও উপন্যাস

 

   

           

  

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s